সম্রাজ্ঞী পর্ব-২৬+২৭

0
231

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_26

আরো একটি শুভ্র ভোরের আগমন। বাইরে এখনো অন্ধকার। মহলের কৃত্রিম আলোগুলো টিমটিমিয়ে জ্বলছে। কোথাও কারোর সাড়া নেই। নামাজের সময় হয়েছে। খানিক বাদেই হয়তো সকলে উঠে পড়বে। বেগমের কারাগারের মেঝেতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছটফট করছে পাহাড়ারত দু’জন সৈনিক। মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়ার ফলে কথা বলার চেষ্টা করলে গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছে না। হাত-পায়ে সামান্য কাটাছেঁড়া নজরে আসছে। মেঝেতে বেগমের শুকিয়ে যাওয়া রক্তের পাশেই গড়িয়ে পড়ছে তাদের তাজা রক্ত। ছাড়া পাওয়ার জন্যেই ছটফট করছে তারা। তবে এ শক্ত বাঁধন খোলার উপায় নেই তাদের নিকট। তাদেরই পোশাকের একাংশ ছিড়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে চোখগুলো। বণিক এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কারাগারের সামনেই চার-পাঁচ হাতের যেই ফাঁকা স্থানটুকু ছিলো সেখানেই নামাজ পড়ছেন বেগম। আজানের আগেই নামাজটা পড়ে নিচ্ছে কারন তার মনে হচ্ছে আর সুযোগ পাবে না সে। কিছুক্ষণ পর সালাম ফিরিয়ে উঠে আসলো সে। হাতের চাবির গোছা থেকে বণিকের কারাগারের চাবি খুঁজে খুলে দিলো দ্বার। তবে ডাকলো না তাকে। ফিরে তাকালো নিজের কারাগারের দিকে। যেখানে সৈনিকগুলো পড়ে আছে আহত অবস্থায়। দ্রুত গিয়ে তাদের চোখের বাঁধন খুলে দিলো সে। চোখ বড়বড় করে তাকালো সৈনিক। ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলো মুখ খুলে দেবার জন্য। কিন্তু না, বেগম সে ভুল মোটেও করলো না। শত্রুর উপর মায়া দেখানো মানে নিজের কবর নিজে খোঁড়া। সময় হলে তারা এমনিতেই ছাড়া পেয়ে যাবে। সৈনিক দুটোর চোখে যেন একরাশ অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও যখন সে নামাজ পড়তে চেয়েছিলো তখন তারা কী বিশ্রি আচরনটাই না করেছে। জায়নামাজ তো দেয়ই নাই উল্টো তলোয়ার নিয়ে তেড়ে এসেছিলো। আর সেটাই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। নিজের হাতের চাবির দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে হাসলো বেগম। রাতে দারিয়া তাড়াহুড়োতে চাবি নিতেই ভুলে গেছে। কারাগারের বাইরের মেঝেতে পড়ে ছিলো চাবির গোছা। তখন অবশ্য খেয়াল করেনি সে। ভোরে যখন সৈনিকরা তার দিকে তেড়ে আসে তখনই তাদের পায়ের ধাক্কায় ভেতরে চলে আসে চাবির গোছা। বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবারো ফিরে তাকালো বেগম। একজন সৈনিকের বুকের উপর তলোয়ার দিয়ে আঁচড় কেটেছে সে। চিরচির করে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। ক্ষত বেশি গভীর নয়। মরার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। চিকিৎসা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। বণিকের কারাগারের তালা খুলে দিয়ে ডাকতে চাইল। হুট করে মনে পড়লো কী বলে ডাকবে? সম্বোধন করার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না সে। কয়েকবার লোহার শিকে কড়া নাড়লেও বিন্দুমাত্র নড়লো না বণিক। ঘুম ভাঙা তো দূরের কথা। বেগম উপলব্ধি করতে পারলো এই লোকটাও তার মতো ঘুমের কুমির। ঘুমালে দিন-দুনিয়া ভুলে যায়। তার ঘুম তো এতটাই গভীর যে জমিন উল্টে পড়লেও টের পায় না সে। প্রতিদিন সকালে সুলতান তাকে টেনে টেনে উঠিয়ে দিতো নামাজ পড়ার জন্য। লোকটা এত অসভ্য যে আজানের আগেই ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। আজও তার এই ভোরে জেগে থাকার কারনটা সুলতান। কিন্তু আজ আর তাকে ডেকে ওঠাতে হয়নি। তার চোখ থেকে যে ঘুমটাই হারাম করে দিয়েছে মানুষটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিচ থেকে রক্তাক্ত তলোয়ারদুটো তুলে উপরে উচিয়ে ধরে আচমকা ছেড়ে দিলো। মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল তলোয়ারদুটো। অমনি ধরফরিয়ে উঠে বসলো বণিক। চোখ মেলেই নিজের এত কাছে বেগমকে দেখে হকচকিয়ে গেল সে। ভুল দেখছে না কি? চোখ ডলে আবারো তাকালো তার দিকে। বিরক্ত হলো বেগম। রাগান্বিত স্বরে বলল, “উঠে নামাজ পড়ে নিন।”

কথা বলল না বণিক। হুট করে ঘুম ভাঙাতে সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না জোভিয়া কেন তার কাছে এই সাত সকালে? চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ মাথা চুলকে মনে করতে সক্ষম হলো সবকিছু। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সন্দিহান চোখে কারাগারের বাইরের দিকটা দেখে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “তোমাকে মুক্ত করলো কে?”

“কেউ নয়।”

“তাহলে তুমি বেরোলে কীভাবে? আর এতো শক্ত তালা খুললে কী করে?”

বেগম চোখের ইশারায় বোঝালো পাশের কারাগারে নজর দিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে তাকালো বণিক। সৈনিকদের করুন অবস্থা দেখে চোখদুটো বড়বড় হলো স্বাভাবিকের তুলনায়। বেগমের দিকে চেয়ে হতবাক কন্ঠে শুধাল, “এদের এই অবস্থা তুমি করেছো?”

“হ্যাঁ, অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছেন। এখন উঠে নামাজ পড়ে নিন। আমি আসছি।”

বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালো সে। চমকে উঠলো বণিক। উত্তেজিত স্বরে বলল, “আরে আরে! করছো টা কী? এটা কি তোমার নিজের মহল না কি যে যখন ইচ্ছা এদিক-ওদিক চলে যাবে?”

কটমট করে তাকালো বেগম। কিঞ্চিত ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আপনার কাজ আপনি করুন না। আজান দিলে সবাই উঠে পড়লে আর নামাজ পড়তে পারবেন না।”

“তা নাহয় পড়ছি। কিন্তু তুমি এই ভোরে যাচ্ছো টা কোথায়? আবার সুলতানের কাছে যাচ্ছো না কি অপমানিত হতে?”

“খু’ন করতে যাচ্ছি।” সোজা উত্তর বেগমের।

“কিহ! কার খু’ন করতে যাচ্ছো? শেহজাদি দারিয়ার?”

“না, কাল রাত পর্যন্ত ভুল ছিলাম আমি। সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটলে দোষটা অবশ্যই তৃতীয় ব্যক্তির নয়। সর্বপ্রথম দোষটা হচ্ছে প্রথম ব্যক্তির যে কি-না অন্ধ হয়েছিল দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতি। আর সর্বশেষ দোষটা দ্বিতীয় ব্যক্তির। যে কি-না নিজের জীবনে প্রথম ব্যক্তি থাকার পরেও তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। দারিয়া যেহেতু তৃতীয় ব্যক্তি তাই তার কোনো দোষ দেখি না আমি। হ’ত্যা করার প্রশ্নই আসে না।”

হতবুদ্ধির ন্যায় চাইল বণিক। বিস্মিত কন্ঠে বলল, “তাহলে?”

আচমকা যেন পরিবর্তন হতে শুরু করলো বেগমের মুখভঙ্গি। চোখদুটো জ্বলে উঠলো ভয়ানকভাবে। দৃঢ় কন্ঠে বলল, “মৃ’ত্যুই যদি সমাধান হয় তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি বিলীন হোক। মৃ’ত্যু হোক ভালোবাসার। মুছে যাক প্রতারণা।”

“মানে টা কী? শেহজাদিকে মা’রবে না তো কাকে মা’রতে যাচ্ছো?”

হাসলো বেগম। বড় রহস্যময় ঠেকল সে হাসি। মেঝেতে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার তুলে নিলো সে। হিজাবের একাংশ ছিড়ে তলোয়ারের হাতল বেঁধে নিলো ডান হাতের সাথে। সামনে এগোতে এগোতে বলল, “পালিয়ে জান মহল ছেড়ে।”

“আর তুমি?”

“আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”

“তোমাকে ছাড়া কিছুতেই যাবো না আমি।” জেদী কন্ঠ বণিকের।

রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো বেগম। কয়েক পা এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “এখানে থাকলে ম’রে যাবেন আপনি।”

“তোমার সাথে ম’রতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু একা একা ফিরে যাবো না আমি।”

অতিশয় বিরক্ত বোধ করলো বেগম। মহা মসিবতে পড়া গেল তো! একজন তাকে মা’রতে উতলা হয়ে উঠেছে। আরেকজন আবার বাঁচাতে চাইছে। আশ্চর্য! বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “ঠিক আছে। নামাজ আদায় করুন আগে। তারপর দেখা যাবে।”

সম্মতি দিলো বণিক। তৎক্ষণাৎ সেই স্থান ত্যাগ করলো বেগম। আজানের শব্দ কানে এলো হাঁটতে হাঁটতেই। নিজের আন্দাজ মতো এগিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ নিজের বাম হাতে সামান্য ব্যথা অনুভব করলো। তাকাতেই বুঝতে পারলো কাল রাতে কামড়ে ধরার ফলে বেশ খানিকটা ক্ষত হয়েছে। কী জঘন্য লাগছে দেখতে! দাত দেবে গেছে মাংস পর্যন্ত। বিচলিত হলো না সে। ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে প্রতিটা কামরা লক্ষ করতে লাগলো। সারি সারি অনেকগুলো কামরা কিন্তু কোনটা কার বুঝে ওঠা দায়। কামরা সবগুলোই রাজকীয়ভাবে সাজানো তবে দুটো কামরা একেবারে ভিন্নভাবে তৈরি। অতিরঞ্জিত সাজসজ্জায় ভরপুর দ্বারগুলো। একটা দ্বার সামান্য খোলা পেয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গেল সেদিকে। উঁকি দিতেই নজরে এলো নামাজরত শেহজাদি দারিয়া। আশেপাশে কোনো সৈনিক নেই, সেবক-সেবিকা নেই। শুধু তার খাস সেবিকা তারই পেছনে বসে নামাজ আদায় করছে। অবাক হলো সে। সুলতান নেই! নিজের অবৈধ প্রেমিকাকে ছাড়া ঘুম হচ্ছে না কি তার? মাথায় তরতর করে রাগ উঠে গেল। ভুলে গেল কিছুক্ষণ আগে নিজের বলা কথাগুলো। হাত চুলকাচ্ছে দারিয়াকে হ’ত্যা করার জন্য। তাকে বেঁচে থাকতে দেখে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। তখনই সে উপলব্ধি করলো তৃতীয় ব্যক্তিকেও ম’রে যাওয়া উচিত। এরা বেঁচে থাকলে আবারো কোনো ভালোবাসার মৃ’ত্যু হবে প্রতারণার শিকারে। হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে এগিয়ে যেতে ধরলো। কিন্তু সেদজারত দারিয়াকে দেখে পুনরায় পিছিয়ে এলো। অপেক্ষা করতে লাগলো নামাজ শেষ হবার জন্য। হাতের তলোয়ারটাও যেন রক্তে গোসল করতে উতলা হয়ে উঠেছে। অপেক্ষা করতে করতে যখন সে বিরক্তির চরম শেখরে পৌঁছেছে ঠিক তখনই পাশের কামরা থেকে ভেসে এলো একটি সুমধুর কন্ঠস্বর। সূরা ফাতিহা পাঠ করছে কেউ। কন্ঠের মালিককে চিনতে বিন্দুমাত্র কসরত করতে হলো না তাকে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে গেল সে। দ্বার কিঞ্চিত ফাঁকা করতেই নজরে এলো সুলতানের মুখখানা। নামাজে দাঁড়িয়েছে সে। কী নিষ্পাপ তার মুখখানি! চাইলেও বিন্দুমাত্র নজর এদিক-ওদিক করতে পারলো না বেগম। সম্মোহিত ব্যক্তির ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সুলতানের দিকে চেয়ে। কতক্ষণ পেরিয়েছে তার জানা নেই। হুঁশ-জ্ঞান সব যেন খুইয়ে বসেছে সে। আচমকা পেছন থেকে কেউ সজোরে ধাক্কা মারতেই দ্বার ঠেলে কামরার ভেতরে আছড়ে পড়লো সে। ধপাস করে শব্দ হলো। তলোয়ারটা হাতের সাথে বাঁধা থাকায় ছুটলো না ঠিকই কিন্তু একটুর জন্য তার কপালের নিচে পড়েনি। মেঝেতে কপাল লেগে ফুলে উঠলো মুহুর্তেই। ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে ফিরে তাকালো সে। দ্বারের সামনেই রাগে ফুঁসছে দারিয়া। ধাক্কাটা যে সেই মেরেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্রুত সালাম ফিরিয়ে পেছনে ফিরতেই এমন দৃশ্যে অবাক হলো সুলতান। হতবাক স্বরে বলল, “ওকে এখানে এনেছো কেন দারিয়া?”

“আমি! তোমার মনে হয় একে আমি এনেছি? এই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখাই ভুল হয়েছে।”

“তাহলে ও এখানে কীভাবে এসেছে? কারাগারে তো তালা লাগানো ছিলো তাই না?”

“আমি নামাজ পড়ছিলাম। নামাজ শেষে ভাবলাম তোমাকে একবার দেখে যাই। এসে দেখি এই মেয়েটা বেহায়ার মতো তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখছিলো শাহজাইন।”

নিমেষেই রাগ ফুটে উঠলো সুলতানের চোখে-মুখে। বেগমের দিকে হিং’স্র দৃষ্টি ফেলে বলল, “কারাগার থেকে বেরিয়েছিস কীভাবে?”

সুলতান আগে কখনো তাকে এভাবে তুইতোকারি করে বলেনি। তাই অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো বেগম। এতে যেন রাগ দ্বিগুণ হলো সুলতানের। হনহন করে এগিয়ে এসে তার চোয়াল চেপে ধরলো সে। চিৎকার করে বলল, “বল, কীভাবে বেরিয়েছিস? মেরে ফেলেছিস সৈনিকগুলোকে? তালা ভেঙে এসেছিস?”

উত্তর না পেয়ে পুনরায় চেচিয়ে উঠলো সে, “আশিকের সাথে থাকতে ভালো লাগছিলো না বুঝি? কেন এসেছিস এখানে?”

হতবাক বেগম কথা বলতে ভুলে গেছে যেন। টলমল চোখে চেয়ে থাকা ব্যতীত কিছুই বলতে পারলো না সে। ভেঙে গেছে তার শক্ত মনোভাব। বিস্ময়ে চরম শেখরে পৌঁছালে বোধহয় মানুষ কথা বলার শক্তি হারায়। দ্বারে দাঁড়ানো শেহজাদি দারিয়া খুশিমনে এগিয়ে এলো ভেতরে। সুলতানকে আরো উস্কে দিতে ন্যাকাসুরে বলল, “বুঝেছি, তুমি আমাকে মা’রতে এসেছিলে।”

তার কথায় কিঞ্চিত চমকাল সুলতান। বজ্রকন্ঠে বলল, “দারিয়াকে মা’রতে এসেছিলি তুই?”

ডানে-বামে মাথা নাড়ালো বেগম। যার অর্থ দারিয়াকে মা’রতে আসেনি সে। মোটেও সন্তুষ্ট হলো না সুলতান। পুনরায় একই স্বরে শুধাল, “তাহলে? কাকে মা’রতে এসেছিলি?”

“আপনাকে।”

কথাখানা বলেই এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো বেগম। সুলতান বোধহয় একটু বেশিই অবাক হলো। একটু নয় এক আকাশসম বিস্ময় তার দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে গেল দারিয়াও। স্তব্ধ হলো পরিবেশ। বেগমের মুখে এমন কথা শুনবে এই আশা কেউই করেনি। সবাইকে মা’রতে পারে সে। তা বলে সুলতান! সুলতানকে মা’রবে! অবিশ্বাস্যই বটে। সুলতান আবারো তেড়ে আসলো তার দিকে। গলা উচিয়ে উচ্চস্বরে বলল, “কী বললি? আবার বল।”

“কী বলেছি শুনতে পাননি? না কি আবার শুনতে চাইছেন? আপনাকে হ’ত্যা করতে এসেছিলাম। নাহলে এই দ্বারে কখনোই আসতাম না।” কী দৃঢ়ভাবে মিথ্যা কথাটা বলে দিলো বেগম। নিজের টলমলে আঁখি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো তলোয়ারের দিকে চেয়ে। সে খুব করে চাইছে যে-কোনো মূল্যে লড়াই হোক তাদের মাঝে। মিটে যাক তাদের অস্তিত্ব।

তার ভাবনাকে সত্যি করতেই বোধহয় চেঁচিয়ে উঠলো সুলতান, “আমাকে মা’রতে এসেছিস?”

“এক কথা একবার বললে বোঝেন না? না বুঝলে আপনার প্রেমিকা তো আছেই। তার থেকে বুঝে নিন। সে বুঝেছে আশা করি।”

“তোর মনে হয় তুই আমাকে মা’রতে সক্ষম হবি?”

“কোনো সন্দেহ নেই। এলিজা সুলতানের সক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণায় নেই আপনার।”

বারবার এমন দৃঢ় কন্ঠে অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সুলতান। এদিক-ওদিক চেয়ে গটগট পায়ে গিয়ে পালঙ্কের পাশ থেকে নিজের তলোয়ার নিয়ে আসলেন। আগ্রহী নয়নে চেয়ে আছে দারিয়া। একটু বেশিই খুশি হচ্ছে সে। তার ধারণা লড়াই করলে এলিজাই ম’রবে। সে কিছুতেই পারবে না সুলতানের সাথে। কিন্তু ম’রতে ম’রতে তাকে একটু প্রশান্তি দিয়ে যাবে এলিজা। খুশি খুশি মনে সুলতানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে খানিক দূরত্ব বজায় রেখে। কয়েকবার তলোয়ারটা ঘুরিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন সুলতান। প্রহার করার পূর্বে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল, “কী মনে হয় তোর? তুই ম’রবি না কি আমি ম’রব?”

দারিয়া চট করে আনন্দ আর উত্তেজনার মিশেলী কন্ঠে বলে উঠলো, “এটা আবার জিগানোর কী আছে শাহজাইন? অবশ্যই এই মেয়েটা ম’রবে।”

আড়চোখে তার দিকে তাকালেন সুলতান। অধরে মুচকি হাসি টেনে বলল, “তুমি কিন্তু পাশেই থেকো। হাজার হলেও এই প্রথম নিজ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর সাথে লড়তে যাচ্ছি। তুমি কাছে থাকলে এই মেয়েকে শেষ করতে বেশি সময় নেবো না আমি।”

নিজের খোলা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে লাজুক হাসলো দারিয়া। অধর প্রসারিত করে লজ্জার ভঙিমায় বলল, “তুমিও না শাহজাইন।”

সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকায় সুলতানের বাচনভঙ্গি, দারিয়ার লাজুক চেহারা সবই দৃষ্টিগোচর হলো বেগমের। মুহুর্তেই ভেঙে চুরমার হতে চাইল তার শক্ত অভিব্যক্তি। হাতের মুষ্টি এতটাই শক্ত হলো যে তলোয়ারের হাতল দেবে যেতে চাইছে চামড়া ভেদ করে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো সে। আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর আর এই বিশ্রি দৃশ্য দেখতে হবে না তাকে। একটানা কান্না আটকাতে আটকাতে তার গলাটাও ব্যথা হয়ে গেছে কিন্তু সুলতানের ভয়ঙ্কর এ রূপ আর বদলালো না! ধরা গলায় সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল, “আপনাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার এই কঠিন অতৃপ্তি নিয়ে ম’রে যে আমার মৃ’তদেহটাও হারাকার করবে সুলতান।”

বেগমের এই অসীম কষ্ট যেন আজ ছুঁতেই পারলো না সুলতানকে। উপলব্ধি করতে পারলো না তার দহন। সে পুনরায় রাগান্বিত স্বরে শুধাল, “ভয় করছে না তোর? আমার সাথে লড়তে চলে আসলি ম’রার জন্য।”

“ভয় তখন করত যখন আমি জেতার অথবা হারার আশা করতাম। কিন্তু আমি তো আজ নিজের ভালোবাসা কুরবান করতে এসেছি।”

ভ্রু কুচকাল সুলতান। খুব সহজেই যেন উপলব্ধি করে নিলো এই বাক্যের মর্মার্থ। অবাক স্বরে বলল, “মানে দু’জনই মরব? সেটা চাস তুই? কখনোই না। আজ তুই একা ম’রবি। লড়তে যখন এসেছিস ম’রতে তোকে হবেই।”

কথাখানা বলেই প্রহার করে বসলো সে। বেগম যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো। তৎক্ষণাৎ তলোয়ার উচিয়ে পাল্টা প্রহার করলো সে। তলোয়ারে তলোয়ারে সংঘর্ষ হয়ে ঠনঠন শব্দ তুলল। একের পর এক প্রহার চলছে অথচ কেউ কারোর শরীরে তলোয়ার ছোঁয়াতে সক্ষম হচ্ছে না। বারংবার প্রবল আঘাতে তলোয়ার ভেঙে চুরচুর হবার জোগাড়। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো কারোর পরাজিত হবার কোনো লক্ষণই নেই। যেন আজন্মকাল ধরে চলবে এই যুদ্ধ। সুলতান যেমন বিচক্ষণতা আর অভিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় প্রহার করছে ঠিক তেমনি সুকৌশলে সমস্ত প্রহার নিয়ন্ত্রণ করে নিচ্ছে বেগম। সমানে সমানে লড়াই বোধহয় একেই বলে। সুলতানের চোখে-মুখে রাগ আর হিং’স্রতা প্রকাশ পেলেও বেগমের দৃষ্টিতে আকাশসম দৃঢ়তা। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে সে কতটা তৎপর তা তার অস্ত্র চালানোর কৌশলই বলে দিচ্ছে। ঘরময় শুধু অস্ত্রের ঠনঠন শব্দ ব্যতীত কিছুই শ্রবণগোচর হচ্ছে না। হতবুদ্ধির ন্যায় দেখে যাচ্ছে শেহজাদি দারিয়া। আবারো ভুল প্রমাণিত হলো তার ধারণা। এলিজার যুদ্ধ কলাকৌশলের সুনাম সে আগেও শুনেছে। কিন্তু এতটাও আশা করেনি সে। ভেবেছিলো সুলতান সহজেই তাকে পরাজিত করে ফেলবে। কিন্তু এ কি! সুলতান নাহয় তাকে ভালোবাসে না তাই এমন শক্ত প্রহার করছে তার উপর কিন্তু সে তো বাসে। তবুও এমন দৃঢ় প্রহার! সে কি সত্যিই মে’রে ফেলতে চাইছে শাহজাইনকে?

এবার খানিক বিচলিত হয়ে পড়লো সে। চিন্তিত হয়ে উঠলো সুলতানের জন্য। এভাবে লড়াই চলতে থাকলে দু’জনেই ম’রবে। কিন্তু শাহজাইনকে তো বাঁচতে হবে। সে খুব বেশি ভালোবাসে শাহজাইনকে। তাকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবে না। শাহজাইন এমন একজন পুরুষ যাকে দেখার পরেই তার আজীবন বিবাহ না করার দৃঢ় সংকল্প ভেঙে চুরমার হয়েছে। নতুন স্বপ্ন বেঁধেছে এই পুরুষটাকে নিয়ে। সে গটগট করে নিজ কামরায় গিয়ে নিজের তলোয়ার নিয়ে এলো। তখনও সমানে লড়ে যাচ্ছে দু’জন। হাঁপিয়ে উঠেছে দু’জন কিন্তু কারোর পরাজিত হবার কোনো লক্ষণ নেই। তাদের দিকে এগোতে নিলেই প্রায় হুরমুর করে কামরায় ঢুকে পড়ে বণিক। ছুটে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “এসব কী করছো জোভিয়া? থেমে যাও। তলোয়ার লেগে যাবে যে কোনো সময়।”

কারাগার থেকে কোনোমতে পালিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে সে। সেবকের পোশাক শরীরে থাকায় একটু সুবিধায় হয়েছে। শেহজাদির কামরা চিনতো সে তাই সোজা এখানে আসতেই চক্ষু যেন চড়কগাছ। মহলের সবাই উঠে পড়েছে। যে কোনো সময় এখানে চলে আসতে পারে। বেগম আর সুলতানের ভাবগতি দেখে মনে হলো না তার কথা তারা শুনতে পেয়েছে বা থামবে আজ। তাই দ্রুত গিয়ে দ্বার ভিড়িয়ে দিলো যেন বাইরের কেউ এ দৃশ্য দেখতে না পারে। পুনরায় উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “কী করছো তোমরা? দু’জন দু’জনকে হ’ত্যা করবে নাকি? বন্ধ করো এই লড়াই।”

কে শোনে কার কথা। তার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপই করলো না বেগম। কিন্তু সুলতানের মনোযোগ নষ্ট হলো।হুট করে সে ফিরে তাকালো তার দিকে। অমনি সুলতানের দিকে তলোয়ার চালিয়ে দিলো বেগম। আৎকে উঠলো দারিয়া। সে চিৎকার করতে নিতেই আচমকা তলোয়ার ঘুরিয়ে নিলো বেগম। চোখের দৃষ্টিতে দৃঢ়তা হারিয়ে স্থান পেল অগণিত মায়া। তলোয়ারের দিক পরিবর্তন হয়ে সুলতানের পেটের পাশ ছুঁয়ে চলে গেল অথচ সুলতানের শরীরে একটা আঁচড় পর্যন্ত কাটলো না। দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো বেগমের চোখ বেয়ে। নিজ মনে মেনে নিলো নিজের অক্ষমতা। যায় হোক না কেন সুলতানকে আঘাত করতে পারবে না সে। কিন্তু আজ বোধহয় কাউকে না কাউকে দিতেই হতো নিজের প্রাণ। লেখা ছিলো কারোর মৃত্যু। সুলতানের দৃষ্টিতে তখনও হিং’স্রতা বিদ্যমান। লড়তে লড়তে আচমকা বেগম এভাবে তলোয়ার ঘুরিয়ে দিক পরিবর্তন করাতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চালানো তলোয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো সুলতান। বেগমের তলোয়ার যখন মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল ঠিক তখনই সুলতানের তলোয়ারটা শরীরে গেঁথে গিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হলো। তাজা রক্ত ছিটকে এসে লাগলো সুলতানের চোখে-মুখে। আকস্মাৎ ঘটনায় হতভম্ব হলো সুলতান নিজেও। সে ভাবেনি এই মেয়েটা হুট করে তলোয়ার ঘুরিয়ে নেবে, হাত থেকে ফেলে দেবে নিজের তলোয়ার। মৃ’ত্যুর কঠিন শ্বাস নিয়ে স্তব্ধ হলো পরিবেশ। দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বণিকের দৃষ্টি শূন্য হলো। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন থমকে গেল তার পৃথিবী।

চলবে……….

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_27

সকালের মিহি আলো ফুটছে গগণ চিরে। মহলের ফ্যাকাসে সোনালি রঙের উপর তাজা রক্তের ছিটে। কয়েকফোঁটা লাল বর্ণের তরল গড়িয়ে পড়ছে দেয়াল বেয়ে। সতেজ অনিল যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমস্ত বিষাদ। ভিড়িয়ে দিচ্ছে রঙিন আলোর সূচনা। তলোয়ার বিদ্ধ নারী শরীরটা টলকে টলকে উঠছে। শেষ শক্তিটুকুও ফুরিয়ে আসলে পেট চেপে ধরে মেঝেতে আছড়ে পড়লো সে। রক্তে রঙিন হলো মেঝে। তার হাত ভরে উঠলো উষ্ণ তরলে। হতভম্ব সুন্দর কাজল কালো নয়নজোরা। চোখদুটো বড়বড় করে হতবাক নজরে চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। সম্মুখে দাঁড়ানো সুলতানের চোখে হিং’স্রতা। তলোয়ারে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ব্যক্তির রক্তের পরশ। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তলোয়ার বেয়ে। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করা অসহায় মুখশ্রী যেন বাড়িয়ে তুলল তার হিং’স্রতা। গটগট পায়ে এগিয়ে গেল সে। সামান্য ঝুঁকে পড়ে খানিকটা ব্যঙ্গ করেই শুধাল, “কেমন লাগছে দারিয়া? আমার ভালোবাসার উপহার পছন্দ হয়েছে তো?”

“তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে শাহজাইন!” কাতর কন্ঠ দারিয়ার। মৃত্যুর যন্ত্রণায় ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উঠছে তার শরীর। দৃষ্টিতে তখনও মিলছে অবিশ্বাস।

“তোর ভাগ্য ভালো যে এতোগুলো দিন তোকে সহ্য করেছি আমি। মাহতাবকে তোর ভাই গায়েব না করলে অনেক আগেই মে’রে দিতাম তোকে। তোর মতো বেহায়া নারীর সঙ্গ আমাকে প্রতি মুহূর্তে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। কত অভিনয় করতে হয়েছে তোর সাথে। তবুও ছাড়লি না মাহতাবকে। মাহতাবের মুখ চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছি। কিন্তু আজ সহ্যের বাইরে চলে গেছে। আমি পৃথিবীর সমস্ত অত্যাচার, দুঃখ-দুর্দশা সব সহ্য করতে পারি শুধু আমার বেগমের কষ্ট ব্যতীত। তোর আর তোর ভাইয়ের জন্য সেটাও সহ্য করতে হলো। ভেবেছিলাম তবুও যেমন করেই হোক অভিনয় চালিয়ে যাব তোর ভাই ফিরে আসা পর্যন্ত। সে এসে মাহতাবকে মুক্ত করে দেবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু পারলাম না। এলি কষ্ট পাচ্ছিল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আমার। সারারাত হন্যে হয়ে পুরো সাম্রাজ্যে মাহতাবকে খুঁজেছি। সকালে মাত্র মহলে এসে নামাজ পড়তে বসেছিলাম আর তুই কি-না আমার কলিজায় হাত দিয়ে দিলি! মেঝেতে ফেলে কপাল ফুলিয়ে দিলি আমার এলির?”

“সত্যি করে বলোতো তুমি কি আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও ভালোবাসোনি? আমার রূপের মোহে পড়োনি?”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সুলতান। যেন এর চেয়ে মজার কথা এই জীবনে সে শোনেনি। আকস্মাৎ হাসি থামিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “রূপ! রূপের বড়াই করছিস? তাও আবার আমার সামনে! তোদের মতো নারীদের রূপ আমার শরীরে বিষাক্ত কাঁটার ন্যায় বিঁধে।ধারাল তলোয়ারের ন্যায় চিরে দেয় শরীর। আমার বেগমকে দেখেছিস? না দেখলে মৃত্যুর আগে ভালো করে দেখে নে একবার। তারপর কবরস্থানে শুয়ে শুয়ে হিসাব মিলিয়ে নিস আসল রূপ কাকে বলে।”

দারিয়া কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় তাকে ছুঁতে। তৎক্ষণাৎ নাক সিটকে দূরে সরে গেল সুলতান। চিৎকার করে বলল, “খবরদার! আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করিস না। যতটুকু ছুঁতে পেরেছিস এ কদিনে ততটুকুই হজম করতে পারছি না। অসহনীয় এই স্পর্শে যেন শরীরে আগুন ধরে যায়।”

“আমাকে বাঁচাও শাহজাইন। আমি খুব ভালোবাসি তোমায়। আমি তোমার দ্বিতীয় বেগম হয়ে থাকতেও রাজি। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বাঁচাও আমাকে।”

“দ্বিতীয় বেগম? কিন্তু আমার মন তো একটাই। যেটা অনেক আগেই জুরে নিয়েছে কেউ। শুধু মন নয়, পুরো আমিটাকেই জুরে নিয়েছে সে। অন্য কোনো নারীর স্থান নেই সেখানে। কেউ জোরপূর্বক সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে তাকেও জ্বলতে হবে, ম’রতে হবে অকালে।”

“আমাকে বাঁচাও। আমি বাঁচতে চাই।”

“তোর প্রাণভিক্ষা দিতাম। অবশ্যই দিতাম। যদি না আমার এলিকে এই ধাক্কাটা না মারতি তুই। দেখতো কেমন লাল হয়ে গেছে কপালটা। ফুলে গেছে মসৃন ললাট।” বেগমের কপালের দিকে ইশারা করলো সে।

দারিয়া সেদিকে না তাকিয়ে তার দিকে চেয়ে আবারো মিনতি করতে চাইতেই চেঁচিয়ে উঠলো সে, “তাকিয়ে দেখ।”

সুলতানের এই উন্মাদনায় যেন ভয় সৃষ্টি হলো দারিয়ার হৃদয়ে। অসহায় দৃষ্টিতে বেগমের দিকে চাইল সে। বেগমের নির্লিপ্ত দৃষ্টির মাঝে কপালের সামান্য লালচে আভা খোঁজার সময় নেই তার নিকট। বাঁচতে চায় সে।
আবারো সুলতানের দিকে চেয়ে বলল, “দয়া করে আমাকে বাঁচিয়ে নাও। আমি কথা দিচ্ছি কখনোই তোমাদের জীবনে ফিরে যাব না। তোমার সৈনিক প্রধানকেও ছেড়ে দেবো।”

সুলতানের নিকট বোধহয় নিছক হাস্যকর শোনালো বাক্যগুলো। থমথমে গলায় বলল, “ধাক্কা দেওয়ার আগে সেটা ভাবা উচিত ছিলো। এখন সময় নেই তোর কাছে। তারপরও যদি বাঁচতে চাস আমার যতগুলো সৈনিক তোরা হ’ত্যা করেছিস সবার প্রাণ ফিরিয়ে দে। পারবি ফিরিয়ে দিতে? বিনা দোষে কতগুলো প্রাণ হ’ত্যা করেছিস। তোদের শাস্তি শুধুই মৃ’ত্যু।”

“সামান্য ধাক্কা দেওয়ার জন্য আমাকে হ’ত্যা করবে তুমি! তোমার যত সৈনিক লাগে সব দেবো আমি।”

উত্তর দিলো না সুলতান। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। ভাবখানা এমন যেন অধির আগ্রহে সে অপেক্ষা করছে দারিয়ার মৃত্যুর। তলোয়ারটা এখনো খাঁড়া হয়ে গেঁথে আছে দারিয়ার পেটে। বেগমের দিকে তলোয়ার এগোতে দেখে তার যত উত্তেজনা ছিল সব শেষ হয়েছিল যখন সুলতান সেই তলোয়ার এলিজার পরিবর্তে তার শরীরে গেঁথে দিয়েছিলো। সে এলিজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল যেন সুলতানের লক্ষ ছুটে গেলে সে তলোয়ার চালাতে পারে অথচ নিমেষেই রূপ পাল্টে ফেলল সুলতান। এলিজার পরিবর্তে কুরবান করলো তাকে। বর্তমানে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তার। চোখ উল্টে যেতে চাচ্ছে। স্পষ্ট মৃত্যুর যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে তার মুখখানাতে। সুলতানের কোনো ভ্রুক্ষেপ না পেয়ে কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো দারিয়া, “সামান্য ধাক্কা দিয়েছি বলে আজ আমাকে হ’ত্যা করলে তুমি। একদিন এই এলিজাই তোমার মৃত্যুর কারন হবে শাহজাইন। তোমার সম্মুখে অন্য পুরুষের হাত আঁকড়ে ধরবে। সেদিন কিছুই করার থাকবে না তোমার। ভালোবাসার অভাবে ধুকে ধুকে ম’রবে তুমি।”

বাক্য শেষ করতে না করতেই তার পেট থেকে তলোয়ার তুলে নিলো সুলতান। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো দারিয়া। তাকে আর একমুহূর্ত সময় না দিয়ে
সর্বশক্তি দিয়ে আবারো গেঁথে দিলো তলোয়ার। গগণ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো দারিয়া। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। মৃত্যু যখন তার দাঁড়গোড়াতে ঠিক তখনি সে বিশাল এক শ্বাস নিয়ে কাঁটা কাঁটা গলায় বলল, “আমার ভাই তোমাদের ছাড়বে না। কাউকে ছাড়বে না।”

শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল সে। ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। সুলতান এখনো হিং’স্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। যেন এত সহজ মৃত্যুতে তৃপ্তি পায়নি সে। হতবাক নয়নে সবকিছু দেখছিল বণিক। সুলতানের এই রূপ তার হজম হলো না। কোনো স্বাভাবিক মানুষ সামান্য ধাক্কা দেওয়ার জন্য কাউকে হ’ত্যা করতে পারে না। মাহতাবকে বন্দি করা, এতোগুলো সৈনাককে হ’ত্যা করার মতো কঠিন বাক্যগুলো বোধহয় সে শুনতেই পায়নি। আবারো সুলতানের দিকে লক্ষ করলো সে। সুলতানের হিং’স্রতা, তার দৃষ্টি, বাচনভঙ্গি সবকিছুই যেন আকাশসম উন্মাদনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। হুট করে বণিক ভীত হয়ে পড়লো। ছুটে গিয়ে বেগমের হাত ধরে দ্বারের দিকে টানতে টানতে বলল, “এই লোক স্বাভাবিক নয় জোভিয়া। এর কাছে থাকলে কোনদিন তোমাকেও আঘাত করে বসবে। চলো আমার সাথে।”

তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকালো সুলতান। মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠলো দারিয়ার দেওয়া অভিশাপ ‘তোমার সামনেই অন্য পুরুষের হাত আঁকড়ে ধরবে এলিজা’। ধপ করে আঁখিজোড়া বন্ধ করে নিলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ছুটে গিয়ে বণিকের গলা চেপে উঁচু করে ধরলো। অগ্নির শিখা বিচ্ছুরিত হবে বুঝি দৃষ্টি দিয়ে। শ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করতে করতে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে বণিক কিন্তু পেরে উঠছে না সুলতানের সাথে। এতোক্ষন নির্লিপ্ত ভঙিতে দাঁড়িয়ে থাকা বেগম আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কী থেকে কী হয়ে গেল সে বুঝতেই পারলো না। সব ভুলে ছুটে এসে টেনে ধরলো সুলতানের বাহু। টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই নিজ থেকেই ছেড়ে দিলো সুলতান। বণিককে ছুড়ে ফেলে অধর প্রসারিত করলো বেগমের দিকে চেয়ে। তৎক্ষণাৎ তার বাহু ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল বেগম। মনোক্ষুন্ন হলো সুলতান। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো, “কাছে এসো।”

আসলো না বেগম। এমনকি তাকালোও না তার দিকে। বরং বণিকের চেয়ে বলল, “চলুন।”

রাগের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না সুলতানের মুখশ্রীতে। সে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গেল বেগমের দিকে। দু’হাঁটু মেঝেতে গেড়ে বসলো বেগমের সম্মুখে। এখনো নির্জীব, নির্লিপ্ত বেগম। তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। হাসলো সুলতান। মিহি কন্ঠে ডাকলো, “এলি।”

বেগমের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়েও বিরক্ত হচ্ছে না সে। বরং কিছুক্ষণ আগে যেই হাতটা বণিক ধরেছিল সেই হাতটা তুলে ধরলো মুখের সামনে। অন্য হাতে মাথা থেকে পাগড়ি খুলে আলতো ধরে মুছে দিলো হাতটা। অতঃপর শব্দ করে অধর ছোঁয়ালো হাতটাতে। একবার নয়, দুইবার নয়, পরপর পাঁচবার অধরের পরশ দিয়ে মাথা তুলে তাকালো বেগমের মুখের দিকে। অপরাধীর ন্যায় নত কন্ঠে বলল, “ক্ষমা করে দাও। আর কখনোই এমন হবে না।”

এবারও নিশ্চুপ বেগম। কথা বলার কোনো প্রয়াস নেই তার মাঝে। কিছুক্ষণ বাদে সুলতানের কাছ থেকে টেনে ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাতটা। বণিক অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। বিরক্ত হলো সুলতান। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আড়াল করে দাঁড়ালো বেগমকে। সুলতানের বলিষ্ঠ দেহের ওপারে থাকা বেগমকে আর দেখতে পাচ্ছে না বণিক। হতাশার শ্বাস ফেলল সে। এতে অবশ্য খানিক শান্তি পেল সুলতান। পুরো একটা রাত বেগমের পাশে এই বণিককে সহ্য করেছে সে। কী অসহ্যকর অনুভূতি! ইচ্ছেতো করছে এখনি এই বণিকের ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিতে। শুধু বেগমের জন্য পারছে না। কপালে অধর ছুঁইয়ে বেগমকে আগলে ধরার উদ্দেশ্যে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিতেই সজোরে তার বুকে ধাক্কা মেরে বসলো বেগম। নিজের কাছ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “কী সমস্যা? বারবার আমাকে স্পর্শ করছেন কেন আপনি? প্রমিকা নেই তাই আমাকে ছুঁতে আসছেন? কাউকে না ছুঁয়ে থাকতে পারছেন না বুঝি?”

“না পারছি না। বিবাহিত পুরুষ স্ত্রীকে না ছুঁয়ে থাকতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। আর কীসের প্রমিকা? প্রমিকা হোক, বেগম হোক সবকিছুই তুমি। তাই বাজে কথা বলো না।”

“ছোবেন না আপনি আমাকে।”

“আমি না ছুঁলে কে ছোঁবে?” থমথমে কন্ঠে সুলতানের। অথচ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না বেগম। দ্বারের দিকে এগিয়ে গেল সে। দ্বারের সামনেই বণিক ছিল। তার দৃষ্টিতে তখনও বিস্ময়। মুহুর্তেই চোখ-মুখ কুচকে নিলো সুলতান। বড়বড় পা ফেলে টেনে ধরলো বেগমের হাত। খানিক অবাক হয়েই বলল, “বারবার এই ছেলেটার দিকে যাচ্ছ কেন?”

“আমি বাইরে যাচ্ছি, কারোর কাছে নয়। আমার চরিত্র নিজের চরিত্রের মতো ভেবেছেন না কি?”

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল বেগম। উদ্দেশ্য সুলতানকে অপমান করা। কিন্তু সে বিন্দু পরিমাণ অপমানবোধ করলো বলে মনে হলো না। বরং এগিয়ে এসে মিশে দাঁড়ালো বেগমের সাথে। বেগম সরতে চাইলে দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলল, “চুপচাপ দাঁড়াও।”

তার হাতে বাঁধা হিজাবের কাপড়টুকু খুলে নিয়ে নিচ থেকে তলোয়ার তুলে নিজের বাম হাতে শক্ত করে বেঁধে নিলো তলোয়ারের হাতল। কয়েকবার ঘুরিয়ে ঠিকঠাক হয়েছে নিশ্চিত হয়ে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো বেগমের সামনে। ভ্রু কুচকাল বেগম। উপলব্ধি করতে পারলো না সুলতানের উদ্দেশ্য। তখনই বেগমের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল সুলতান। বেগম ঠিকই বুঝতে পারলো কোনো বদবুদ্ধি নিয়ে বসেছে তার পায়ের কাছে। তাই দ্রুত সরে পড়তে চাইল সে। কিন্তু তার পূর্বেই আচমকা কোমর চেপে ধরে তাকে কাঁধে তুলে নিলো সুলতান। নিয়ন্ত্রণ হারালো বেগম। ভারসাম্য রক্ষা করতে আঁকড়ে ধরলো সুলতানের চুল। খানিক ব্যথা পেলেও হাসি মিটল না সুলতানের মুখ থেকে। মিটমিটিয়ে হেসে বলল, “আমার মাথা খেয়ে খেয়ে বড্ড ভারি হয়ে গেছো তুমি।”

বিরক্ত হলো বেগম। টেনে হিচড়ে নেমে যেতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। শক্ত করে ধরে আছে সুলতান। রাগান্বিত হয়ে সে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরলো চুলগুলো। এবারও কিছু বলল না সুলতান। চুল টেনে টেনেও যখন কোনো ফায়দা হলো না তখন তার কাঁধের পেছনে কামড় বসিয়ে দিলো সে। ব্যথায় চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সুলতান। কামড়ে ধরে থাকতে থাকতে যখন চামড়া ভেদ করে দাঁত গেঁথে রক্ত বেরিয়ে এসে বেগমের দাঁতে লাগলো তখন নিজ থেকেই ছেড়ে দিলো সে। সমস্ত ব্যথা ভুলে আবারো হাসলো সুলতান। খানিক আর্তনাদের স্বরেই বলল, “মাথা খেয়ে খেয়ে মজা পাওনি বুঝি? এখন রক্তও খেতে শুরু করেছো। রক্তচোষা পিচাশে আছর করলো না কি? চলো, মহলে ফিরে কামরায় গিয়ে সব ছাড়িয়ে দেবো জ্বীন, পিচাশ যা আছে।”

“ছাড়ুন আমাকে। চরিত্রহীন মানুষের স্পর্শে শরীর ঘিন ঘিন করে আমার। অসহ্য লাগছে আপনার সান্নিধ্য।”

“এসব শুনলে লোকজন হাসবে। তুমি বোধহয় রাগে ভুলে গেছো যে একটা মেয়ে হয়ে গেছে আমাদের। তার বয়স ইতিমধ্যে চার বছর পেরিয়ে গেছে। আর আজ কি-না তুমি বলছো আমার স্পর্শ পছন্দ নয় তোমার! দু’দিন পর বুড়ো হয়ে গেলে তখন তো আমাকে ছেড়েই দেবে তুমি।”

একটা মানুষ ঠিক কতটা অসহ্যকর হলে এমন কথা বলতে পারে জানা নেই বেগমের। রক্তে সুলতানের পোশাক খানিক ভিজে উঠেছে। দেখেও ভ্রুক্ষেপ করলো না সে। ইচ্ছা করলো আরো একটা কামড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু রক্ত দেখে আপাতত ইচ্ছাটাকে দমিয়ে নিলো সে। আহাম্মকের মতো বিস্মিত নয়নে দাঁড়িয়ে আছে বণিক। সেই ভোর থেকে এদের দু’জনের লড়াই, খুনোখুনি, চুল টানাটানি, কামড়াকমড়ি, পরিস্থিতির বিপরীত আচরন দেখতে দেখতে তার অবস্থা নাজেহাল। বিস্ময়ে চোখ যেন বেরিয়ে আসবে তার। এরা কি সবসময় এমন অদ্ভুত আচার আচরণ করে?

তার ভাবনার মাঝেই দারিয়ার দিকে এগিয়ে গেল সুলতান। বাঁকা হেসে বলল, “জানাজা মুবারক।”

অতঃপর বেগমকে নিয়ে দ্বার খুলে বেরিয়ে এলো সে। বণিকের ভ্রুক্ষেপ না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো বেগম, “হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কি ম’রার জন্য? দ্রুত আসুন নয়তো কেউ টের পেলে মে’রে ফেলবে আপনাকে।”

ধ্যান ভঙ্গ হলো বণিক। ছুটলো তাদের সাথে সাথে। বেগম পুনরায় বলল, “এই সাম্রাজ্যে থাকলে ওরা আপনাকে ছাড়বে না। রামান সাম্রাজ্যে চলুন। ওখানেই থাকবেন।”

“তোমার দেখছি খুব চিন্তা হচ্ছে।” হেঁয়ালি স্বরে বলল সুলতান।

“হ্যাঁ হচ্ছে তো আপনার সমস্যা কী? আপনার মতো অকৃতজ্ঞ নই আমি।”

ফুঁসে উঠলো সুলতান। কটমট করে তাকালো বণিকের দিকে। আচমকা তার দিকে তেড়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “আরেকবার প্রেমিকের নজরে তাকালে চোখ তুলে সাজিয়ে দেবো নূর বাজারে।”

বণিক চমকালেও প্রকাশ করলো না। কিন্তু ভ্রু কুচকাল বেগম। সে ডান কাঁধে আর বণিক হাঁটছে বাম দিকে। তার উপর সুলতান কথাটা বলেছে ফিসফিস করে। যার দরুন সে শুনতে পায়নি কী বলেছে। তাই জিজ্ঞাসু স্বরে শুধাল, “কী বলছেন আবার ওনাকে?”

“না কিছু না। নদীতে বানিজ্য শুরু করার কথা বলছিলাম।” সুন্দর, স্বাভাবিক উত্তর সুলতানের।

বেগম পুনরায় সন্দেহপ্রবন কন্ঠে বলল, “এই কথাটা ফিসফিস করে বলার কী আছে?”

“তুমি আজকাল খুব সন্দেহ করতে শুরু করেছো। তোমাকে পত্র দিলাম যে তালাক নিতে চাইলে এই সাম্রাজ্যে এসে নিয়ে যেও। কসম বলছি, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। তাই ইচ্ছা করে ওগুলো লিখেছিলাম। কিন্তু তুমি ঠিকই শনির দশা হয়ে চলে আসলে। নিশ্চয়ই ভেবেছিলে বিবাহ করে আমি এখানে সংসার পেতে বসেছি, তাই না?”

“সংসার পাতেননি? অভিনয় কম করবেন। সাধু সেজে থাকেন আমার সামনে। আর এখানে আসতে না আসতেই লীলা শুরু করে দিয়েছেন। বাগানে বসে কোলের উপর পরনারী নিয়ে আহা সে-কী প্রেম! ছি! ইয়াক! নোংরা, চরিত্রহীন, নষ্ট লোক। ঘৃণায় রি রি করছে আমার শরীর। আপনি আমাকে ছেড়ে দিলেই আমি উত্তরীয় সাম্রাজ্যে চলে যাবো। চরিত্রহীন মানুষের সাথে থেকে নিজর চরিত্র বরবাদ করতে পারবো না আমি।”

“আবার বাজে কথা বলতে শুরু করেছো। আরে বাবা শুনলে না মাহতাবকে বন্দি করে রেখেছে ওরা। অভিনয় না করলে মে’রে ফেলতো মাহতাবকে।”

“এসব না বলে বলুন যে আপনিও একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। মাহতাবের অছিলায় তা কাজে লাগিয়ে নিলেন। আবার লজ্জাও পায় ঐ মেয়েটা। নববধূর মতো লজ্জা পেয়ে বলে তুমিও না শাহজাইন। কেন রে? কীসের এত লজ্জা? আমিও তো এখনো পর্যন্ত নাম ধরে ডাকিনি। সত্যি করে বলেন কী করেছেন ওর সাথে?”

অসহায় হলো সুলতানের মুখভঙ্গি। হতাশ গলায় বলল, “খোদার কসম, হাত ধরা ছাড়া কিছুই করিনি আমি। তুমিও বলবে শাহজাইন। সমস্যা কোথায়? আমার নামটা তো আর খারাপ নয়।”

বেগম রেগে গিয়ে আরো কিছু বলার পূর্বেই থামিয়ে দিলো বণিক। কথা শুনতে শুনতে তার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনোর জোগাড়। খানিক উচ্চস্বরেই বলল, “ঝগড়া না করে নিচে তাকিয়ে দেখো।”

ততক্ষণে তারা হাঁটতে হাঁটতে প্রধান দ্বারের কাছে চলে এসেছে। বেগম নিচে তাকাতেই দেখতে পেলো সমস্ত সৈনিকদের হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে মেঝেতে। প্রায় সকলেই আহত। অবাক হলো সে। এই জন্যই কামরা ছেড়ে এতোটা চলে এলো তারা অথচ কেউ কোনো বাঁধা দিলো না। প্রধান দ্বার পেরোতেই নজরে এলো রক্তাক্ত তলোয়ার হাতে সটান দাঁড়িয়ে থাকা মাহতাব। তার পুরো শরীরে চাবুকের আঘাত, মুখটা কালো হয়ে গেছে। ক্ষতবিক্ষত শরীরেও মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো সে। নত কন্ঠে বলল, “ঘোড়া প্রস্তুত মহামান্য।”

“মাহতাব!” বিস্মিত কন্ঠ বেগমের। মাহতাবকে দেখে কাঁধ থেকে নামার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সুলতান ছাড়ছে না।

“কেমন আছেন সুলতানা? জুঁই কেমন আছে?” শুধাল মাহতাব। দৃষ্টিতে একরাশ উত্তেজনা।

“এসব পরে আগে বলো তোমার এ অবস্থা কেন? বন্দি করে অত্যাচার করেছে ওরা?”

“উমার প্রতারণা করেছে আমাদের সাথে। সন্ধির নামে ডেকে এনে নেশা জাতীয় কোনো জড়িবুটি খাবারের সাথে মিশিয়ে খাইয়েছে আমাদের। আমরা যখন অজ্ঞান ছিলাম তখনই সমস্ত সৈনিককে হত্যা করে আমাকে আর সুলতানকে শেকল পরিয়ে বন্দি করে ফেলে। পরে অবশ্য শেহজাদি দারিয়া এসে সুলতানকে মুক্ত করে আর তখনই আমাকে শেকলে পেঁচিয়েই মহলের পেছনের কুয়োর মধ্যে ফেলে রাখে সুলতানের আড়ালে। আজ ভোররাতে সুলতান মুক্ত করেছে আমাকে। ভাগ্যিস সে সময় শেকল দিয়ে শব্দ করেছিলাম আমি।”

বেগম কিছু বলার পূর্বেই সে পুনরায় উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “জুঁই কেমন আছে?”

ভ্রু কুচকাল বেগম। নিজের শরীরে হাজারটা ক্ষতচিহ্ন আর ঘুরেফিরে বারবার বুবুর খোঁজ করছে! তখনই তার কানের কাছে ঝুঁকে এলো সুলতান। ফিসফিসিয়ে বলল, “মাহতাব মনে হয় ভালোবাসে জারনাবকে।”

“আপনাকে বলেছে? সবাইকে নিজের মতো মনে করেন?” দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল বেগম।

“আশ্চর্য! ভালোবাসা কি খারাপ না কি?”

“এই জন্যই দারিয়াকে ভালোবেসেছিলেন?”

হতাশার শ্বাস ফেলল সুলতান। ভালো যন্ত্রণা হলো তো! এই নিয়ে কতদিন জ্বলতে হবে আল্লাহ জানে! এখন কিছু বললে বেগম আরো তেতে উঠবে তাই আর উত্তর দিলো না সে। তার প্রশ্ন উপেক্ষা করে ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাহতাবের উদ্দেশ্যে বলল, “জারনাব ভালো আছে। মহলে গিয়ে দেখো। এখন তোমার সাথে বণিককেও নিয়ে এসো।”

মাহতাব সম্মতি জানাতে ঘোড়ার সামনে এগিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিলো বেগমকে। তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে দাঁড়ালো বেগম। সুলতান অবাক হয়ে বলল, “দূরে সরে যাচ্ছ কেন? এটাতেই যাবো আমরা।”

“আপনার সাথে যাবো না আমি।” দৃঢ় কন্ঠ বেগমের।

অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো সুলতান। খুলে নিলো হাতের তলোয়ার। নির্লিপ্ত বেগম। আচমকা সুলতান তার কোমর পেঁচিয়ে ধরতেই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সে। ঝাঁঝালো গলায় কিছু বলার পূর্বেই নিজেকে আবিষ্কার করলো ঘোড়ার পিঠে। এক বিন্দু সময় ব্যয় না করে তার পেছনে উঠে বসেছে সুলতান। বেগমকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিলো নিজের শরীরের সাথে। বণিকের দৃষ্টিতে প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলার সূক্ষ্ম কষ্ট ধরা দিলেও মাহতাব নিচে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। সে জানে সুলতান পাগলের মতো ভালোবাসে বেগমকে। তার অনেক উদাহরণও সে দেখেছে। দারিয়ার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করার অপরাধের মাশুল কতদিন ধরে তাকে দিতে হবে কে জানে। সুলতানের আকাশসম ধৈর্যের কারনেই হয়তো এতো জেদ সে খুব সহজেই মেনে নেয়।
সুলতানের ঘোড়া ছুটে নজরের বাইরে গেলে সেও বণিককে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে।

এদিকে ছুটে চলা ঘোড়ার উপরেও ছটফট করছে বেগম। খোলার চেষ্টা করছে পাগড়ির বাঁধন। কিন্তু সুলতান নিজের পিঠের কাছে বাঁধন দিয়েছে। যার কারনে উল্টো দিকে ফিরে বাঁধন খুলতে হচ্ছে তাকে। সুলতান এক হাতে ঘোড়ার লাগাম অন্য হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। বালু উড়িয়ে ছুটছে সরোবরের দিকে। বেগমকে ছটফট করতে দেখে ধমকে উঠলো সে, “ঠিক করে বসো। পড়ে যাবে।”

“নামিয়ে দিন আমাকে।”

আমলে নিলো না সুলতান। আরো ভালো করে আঁকড়ে ধরলো নিজের সাথে। আকস্মাৎ অধর ছোঁয়ালো বেগমের কাঁধে। বিজলির ঝটকা লাগার মতোই বাঁধন ছেড়ে বেঁকে গেল বেগম। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঠিক আছে বাঁধন খুলছি না তবুও নিজের অসভ্যতামি বন্ধ করুন। আমি আপনার সাধের প্রমিকা নই যে রাস্তাঘাটে নোংরামি শুরু করেছেন।”

কিছুই মনে করলো না সুলতান। সরে বসার বদলে উল্টো তার কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে নেশালো কন্ঠে বলল, “অসভ্যতামি করতে নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন হয় না পাখি। সুন্দরী স্ত্রীর প্রয়োজন হয়।”

“ধুর!” চোখ-মুখ কুচকে ফেলল বেগম।

ঠোঁট চেপে হাসি দমালো সুলতান। সরোবরের সামনে আসতেই থেমে গেল ঘোড়া। সাঁকোর উপর পরিচিত কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতবাক হলো বেগম। তার তো এ সাম্রাজ্যে আসার কথা নয়। ঘোড়ার খুড়ের শব্দে তাদের দিকে ফিরে তাকালো ব্যক্তিটি। চমকে উঠলো বোধহয় তাদের দেখে। হয়তো অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলো সে। তার থতমত খাওয়া চেহারার দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসলো সুলতান। ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলল, “স্বাগতম।”

আতঙ্কিত হয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় ব্যক্তিটি। সুলতানের কথা বলার ভঙ্গিমাতে সে বুঝে গেছে তাকে এখানে এসে দেখা করার জন্য বার্তা দারিয়া পাঠাইনি বরং সুলতান শাহজাইন পাঠিয়েছিল। কোনো রকম বাছবিচার না করে দারিয়ার বার্তা পেয়ে এভাবে চলে এসে ভুল করেছে সে। মারাত্মক ভুল। সুলতানের বিছানো জালে ফেঁসে গেছে সে। ইতিমধ্যে হাত-পা কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেছে তার। বেগমকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে সে মুখ খোলার পূর্বেই সুলতান বলল, “ভালো করে দেখে নাও এলি। এই সেই শুভাকাঙ্ক্ষী যে কি-না তোমাকে হ’ত্যা করার জন্য অর্থ প্রদান করা, মহল থেকে নথিপত্র গায়েব করার মতোন মহান মহান কাজগুলো করেছিলো। হাত মিলিয়েছে উমারের সাথে। তার একমাত্র লক্ষ তুমি। যে-কোনো মূল্যে তোমাকে হ’ত্যা করতে চায় সে।”

বেগমের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে তলোয়ার শক্ত করে ধরলো সুলতান। হিং’স্র দৃষ্টিতে তাকালো সম্মুখের ব্যক্তিটির দিকে। আচমকা বেগমের গালে অধর ছুঁইয়ে আবদারের সুরে বলে উঠলো, “মে’রে ফেলি?”

চলবে……….