#ফিরে_আসা২
১৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
গাড়ির কালো কাঁচগুলোতে মাথা ঠেকিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে রয়েছে অরা। এই গাড়িটা আরশাদ এবং তার অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী। এই গাড়ির ছাদটা ঘুরে রাখা যায়। ছাদ খোলা গাড়িতে বসে একবার তারা দুজনে গভীর রাতে জোছনাবিলাস করতে বেরিয়েছিল। দিনের আলোয় সে সুযোগ নেই। সুপারস্টার আরশাদ হক ছাদখোলা গাড়ি নিয়ে বের হলে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে অরাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো আরশাদ। তারা ঢাকায় ফিরেছে গতকাল। সেই থেকে লক্ষ্য করছে মেয়েটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। ঠিক গম্ভীরও বলা চলে না। স্বাভাবিকভাবেই হাসছে, গল্প করছে – তবে হঠাৎ হঠাৎ ডুব দিচ্ছে কোনো অজানা এক ভাবনায়।
আরশাদ হালকা গলায় বলল, “মন খারাপ?”
অন্যমনস্ক অরা আচমকা সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “কার আমার? কই না তো!”
“তাহলে এমন গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো?”
অরা সহজ ভঙ্গিতে বলল, “তেমন কিছু না।”
আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “তেমন কিছু না হলেও কিছু একটা। যেটা আমার বউকে ভাবাচ্ছে। আর আমার বউয়ের মস্তিষ্কে তো আমি ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা থাকার কথা নয়। ব্যাপারটা কী?”
অরা হেসে ফেলে বলল, “সত্যিই আরশাদ, বলার মতো কিছু না।”
আরশাদ কৃত্রিম সন্দেহ দেখিয়ে বলল, “বলার
মতো কিছু না না-কি বলতে চাইছো না?”
এই ছেলেটা নিয়ে আর পারা যায় না! অরার মাঝে কোনো উদ্বেগের ছড়াছড়ি হলে, সেই উদ্বেগে নিজে গা না ভাসানো পর্যন্ত শান্তি নেই আরশাদের। যে ভাবনাগুলো অরাকে ভাবাচ্ছে, তা নেহায়েত তুচ্ছ। তুচ্ছ হলেও জানা চাই আরশাদের। না হলে আজ সারাদিন জ্বালাবে। ফোন করে করে বলবে, “মন খারাপ কেন বললে না তো?”
অরা কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বলল, “আমরা যখন ও বাড়িতে ছিলাম, তখন বড় মামী…”
চিন্তার মৃদু স্রোত বয়ে গেল আরশাদের ওপর দিয়ে। প্রত্যেকটা পরিবারে এমন কিছু আত্মীয় থাকে, যাদের আশেপাশের প্রতিটা মানুষের জীবনে নাক না গলালে চলে না। ভালো-মন্দ না বুঝলেও তাদের মানুষের জীবন নিয়ে একটা না একটা মন্তব্য করতেই হবে। সে দলের বিশিষ্ট এক সদস্য আরশাদের বড় মামী। ছোটবেলায় এই মানুষটা তার আর তার কাজিনদের জীবন বলতে গেলে অতিষ্ট করে ফেলেছিলেন।
যখনই বাড়িতে আসতেন আগ্রহ নিয়ে পরীক্ষার নম্বর জিজ্ঞেস করতেন। পরীক্ষায় তারা যে নম্বরই পেয়ে থাকুক না কেন, তিনি মুখ বিকৃত করে বলতেন, “এটা কোনো নম্বর হলো? লেখাপড়া তো দেখছি কিছুই করিস না। সারাদিন করিসটা কী? তোর মাকে বলে দেবো যেন তোকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়।”
এখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ওরা কেউই আর স্কুলপড়ুয়া শিশু নেই। তবে উনার স্বভাব এখনো আগের মতোই আছে। কাজিনরা অবশ্য এখন আর তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। এই বড় মামী আবার অরাকে উল্টো-পাল্টা কিছু বলে বসেননি তো? অরাকে তার এই উদ্ভট বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে বলা হয়নি। বললে হয়তো মেয়েটা আগেভাগেই সাবধান হয়ে যেতে পারতো।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “বড় মামী কী?”
অরা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না থাক।”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “অর্ধেক কথা বলে থেমে যাবে না তো অরা। কী বলেছে মামী?”
অরা ইতস্তত করে বলল, “জিজ্ঞেস করেছেন, আমরা এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা কেন নিলাম?”
আরশাদ বিস্মিত এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত স্বরে বলল, “হ্যাঁ?”
বিস্ময়ে রীতিমত হকচকিয়ে গেছে আরশাদ। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? বাচ্চা নেওয়াটা একেবারেই স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে অন্য কেউ প্রশ্ন করেই বা কী করে?
অরা আমতা আমতা বলল, “না মানে, তুমি এখন ক্যারিয়ারের পিকে। আমিও কেবল প্রোডাকশন হাউজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখনই কেন…?”
বিস্ময় যেন শেষই হচ্ছে না আরশাদের। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত চিন্তা কীসের মানুষের? ক্যারিয়ারের পিকে থাকার সাথে বাচ্চার সম্পর্ক কী? বাচ্চা এলে কি তার ক্যারিয়ারের পিক শেষ হয়ে যাবে? এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা কোথা থেকে যে মানুষ খুঁজে পায়?
অরা শুকনো গলায় বলল, “আমি বলেছি, আমরা কোনোকিছুই সেভাবে প্ল্যান করেনি।”
অরা হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তবে তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! আমরা প্ল্যান করেছি কি করিনি সেটার কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে কেন?”
অরা চুপ করে রইলো। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে সেও এত কথা বলতে চায়নি বড় মামীকে। কিন্তু তিনি এমনভাবে চেপে ধরলেন যে, না বলে আর পারাই গেল না।
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “সমাজের মানুষদের নিয়ে আর পারা যায় না। বাচ্চা না নিলে বলবে বাচ্চা নিচ্ছো না কেন? আর বাচ্চা নিয়ে ফেললে বলবে, এত জলদি নিলে কেন? আমি বুঝি না বাচ্চা নেওয়ার মতো একটা সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে কেউ কীভাবে নিজের কমেন্ট পাস করতে পারে?”
অরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “তুমি মামীকে ভুল বুঝো না আরশাদ। রনি আসলে তাদের আনপ্ল্যানড চাইল্ড ছিল। মামা-মামী দুজনেই তখন নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করে রনি এসে যাওয়ায় তাদের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না। ভালবাসাটাও না-কি হারিয়ে যায়। আমি ভাবছিলাম, আমাদের সাথেও যদি এমনটা হয়?”
অরার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আরশাদ। মাঝে টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। কথাগুলো শেষ হতেই আরশাদ রহস্যের ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।
অরা আহত গলায় বলল, “তুমি হাসছো?”
আরশাদ কোনোক্রমে হাসি থামিয়ে বলল, “হাসির কথা বললে হাসবো না?”
“হাসির কথা কখন বললাম?”
“তোমার মনে হয় বাবু আসলে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে?”
অরা এবার নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আরশাদের ভালোবাসার প্রতি তার অগাধ ভরসা আছে। কোনোক্রমে, কোনো অবস্থাতেই তা ফুরিয়ে যাবার নয়।
অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “না মানে…”
আরশাদ হেসে হালকা গলায় বলল, “সিরিয়ালি ভেবে দেখো! তোমার কি মনে হয় বাবু এসে গেলে আমি তোমাকে কোনো অংশে কম ভালোবাসবো? না-কি তুমি আমাকে কম ভালোবাসবে?”
অরা গাল ফুলিয়ে বলল, “না। সেটা কি করে সম্ভব?”
আরশাদ আদুরে ভঙ্গিতে অরার গাল টিপে দিয়ে বলল, “প্রত্যেকটা সম্পর্কই আলাদা, বুঝলেন ম্যাডাম। প্রত্যেকটা সম্পর্কের ধরণ আলাদা, গভীরতাও আলাদা। একটা সম্পর্ক দিয়ে অন্যান্য সম্পর্কগুলোকে জাজ করা ঠিক না।”
মুগ্ধ দৃষ্টিতে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রত্যেকটা পরিস্থিতিতে এই মানুষটা এত পজিটিভ থাকে কী করে?
“বুঝলাম।”
আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “এখন একটু হাসুন!”
নিজের অজান্তেই প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটজুড়ে। অরা যখন হাসে তখন কেবল তার ঠোঁটই নয়, চোখদুটোও হেসে ওঠে। নির্ঘাত তার অন্তরটাও হেসে ওঠে একইভাবে।
“কাল চেকআপ আছে। মনে আছে তো?”
অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “ওহ! একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। কাল তো আমি সীমাকে বলে রেখেছি ওর বাড়িতে যাবো।”
“চেকআপের পর চলে যেও।”
“আমি তো সীমাকে বলে রেখেছি সকাল সকালই ওর বাড়িতে হাজির হবো।”
“এ ব্যাপারে কোনো ফাঁকি-ঝুঁকি চলবে না অরা। কালকের দিনটা নিয়ে আমি কতটা এক্সসাইটেড তুমি জানো?”
“কেন? কাল কী?”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “এটাও ভুলে গেছ? তোমার কি বুড়ো মানুষের মতো ভুলে যাওয়ার রোগ হলো?”
অরা হাসিমুখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ হয়েছে। এখন বলবে কাল কী?”
আরশাদ উদগ্রীব ভঙ্গিতে বলল, “কাল আমরা বাবুর হার্টবিট শুনতে পারবো।”
দুসপ্তাহ আগেই বাবুর হার্টবিট এসেছে। সেবার কেন জানি ডক্টর শোনেননি, তাদেরকে শোনাননি। তবে আগামীকালের চেকআপে তারা দুজনেই শুনতে পারবে ওই কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি।
মনে পড়ায় অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “তাই তো!”
আরশাদ একরাশ উচ্ছাস নিয়ে বলল, “ওর হার্টবিট রেকর্ড করে নিয়ে আসবো, বুঝলে। সারাদিন কানে ইয়ারপড গুঁজে ওটাই শুনতে থাকবো কেবল।”
সিনেমাজগৎ নিয়ে একটা গুজব প্রচলিত আছে। বাইরের জগৎটাই না-কি থাকে সেলিব্রেটিদের প্রাধান্যের শীর্ষে। পরিবার নিয়ে এরা বেশি একটা মাথা ঘামায় না। এ কারণে সেলিব্রেটিদের বড় একটা অংশের সংসার ভেঙে যায়। নিতান্তই গুজব বটে।
পরিবার যে একটা মানুষের আছে কতটা গুরুত্বের, আরশাদকে না দেখে বোঝার উপায় নেই। বাবুর হার্টবিট রেকর্ড করে আনার কথা যখন বলছিল, তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল।
“আরশাদ?”
“হুঁ?”
অরা মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “তোমার ভালোবাসা এত সুন্দর কেন?”
আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “তোমার কমপ্লিমেন্টগুলো এত সুন্দর কেন?”
আসলেই তো! এত সুন্দর কেন তাদের ভালোবাসা? এমন শুভ্র-সুন্দর ভালোবাসা না-কি হারিয়ে যাবে বাবু এলে। মনে মনে হেসে উঠলো অরা। শুধু শুধুই দুশ্চিন্তা করছিল সে।
অফিসে আজ বিন্দুমাত্র অবসর নেই অরার। একে তো তিনদিনের জমে থাকা কাজ, তার ওপরে আবার নতুন নতুন সব ঝামেলা। দু মিনিট পর পর কেউ না কেউ আসছে তার কেবিনে কিছু একটা অ্যাপ্রুভ করাতে অথবা সাইন করাতে। আবার কেউ আসছে ফাইল চেক করাতে। ইতোমধ্যেই মাথা ধরে গেছে অরার। মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো মিটিংগুলো তো এখনো পড়েই আছে।
এ মাসের মাঝামাঝিতে কালিয়াকৈরে শুরু হয়েছে কে ফিল্মসের পরবর্তী সিনেমা ‘ছাই’য়ের। কালিয়াকৈর জায়গাটা গাজীপুরের থেকে বেশ দূরে। সেখানেই একটা গোটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়েছে। সিনেমায় গল্পটা শুরু হয় এক অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে। একদিন হুট করে গোটা গ্রামে আগুন লেগে যায়। শত শত পরিবার ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।
আজকাল অগ্নিকান্ডের দৃশ্যগুলো ভিএফএক্সের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে পরিচালক এতে রাজি হননি। তিনি চেয়েছেন পর্দায় আগুন যাতে দর্শক হলে বসে অনুভব করতে পারে। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই প্রয়োজনীয় দৃশ্যধারণ শেষে পুরো সেটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সবকিছু পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেকই চলছিল। আগুনের দৃশ্যগুলো সুন্দরভাবেই কোনপ্রকার ঝামেলা ছাড়া ধারণ করা গেছে। ঝামেলা বেঁধেছে পরবর্তীতে। শুটিংয়ের জন্যে সেট হিসেবে যে বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছিল, ওগুলো ছিল মূলত ক্ষণস্থায়ী, কার্ডবোর্ডের তৈরি। তবে ওই বাড়িঘরগুলোর মধ্যে না-কি আসল কয়েকটা বাড়ি ছিল। আগুন সেসব বাড়িতেও লেগেছে।
আসল বাড়িঘরের বাসিন্দারা ক্ষেপে গেছে। শুটিং করতে দিচ্ছে না। পুলিশ আনবে বলে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। তাদের ক্ষতিপূরণ চাই। অরা ভেবে পায় না শুটিং সেটের মাঝে আসল বাড়িঘর থাকবে কেন? যারা সেট বানিয়েছে এটা কি তাদেরই অবহেলার ফল?
ফোনে অনেকটা সময় ধরে কথা হলো ‘ছাই’ সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে। তাকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিলো অরা। যদিও এই ঝামেলা সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না।
দুপুরের দিকে মিটিংয়ে ঢুকলো অরা। কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিম এদিকে নতুন ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেছে। গত মাসে পরিচালক আদনান রহমানের সঙ্গে একটি নতুন সিনেমা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কে ফিল্মসের। একটা সিনেমার গল্প চূড়ান্ত হয়ে গেলে প্রথম চুক্তিটা পরিচালকের সঙ্গেই সম্পাদন করে কে ফিল্মস।
গল্প চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরিচালককে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হয় এখানে। তার স্ক্রিপ্ট যাচাই-বাছাই করে ক্রিয়েটিভ টিম। কোনো ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করতে বলে। আদনানের স্ক্রিপ্ট পড়ার পরও একগাদা সংশোধন দেয়। তবে আদনান স্ক্রিপ্টে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনতে নারাজ।
ক্রিয়েটিভ টিম তাই অরাকে পরামর্শ দিয়েছে এই সিনেমাটা একেবারেই বাতিল করে দিতে। স্ক্রিপ্টে গোঁজামিলের কারণে কিছুদিন আগেই ‘নক্ষত্র’ সিনেমাটাকে রিশুটে পাঠিয়েছে আরশাদ। একই ভুল যাতে আবার না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত।
ক্রিয়েটিভ টিমের হেড যুথী। এছাড়াও এই টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদ্য হাবিব এবং কেয়া। ক্রিয়েটিভ টিমে আরও অনেক সদস্য রয়েছে। তবে যেকোনো জরুরি মিটিংয়ে এই তিনজনই থাকে। আজ কীভাবে যেন মিটিংয়ে ঢুকে গেছে মাহমুদ। তার অতিরিক্ত কথার কারণে এমনিতেই যুথীর অপছন্দের তালিকায় চলে গেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে তাই মাহমুদের উপস্থিতি মোটেও স্বস্তি দিচ্ছে না তাকে।
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি বুঝলাম না। তোমাদের সাথে বসেই তো গল্পটা ফাইনালাইজ করলাম। হঠাৎ কী এমন হলো যে সিনেমাই বাতিল করে দিতে বলছো?”
যুথী ভদ্রভাবে বলল, “ম্যাম আপনি একবার প্লিজ সময় নিয়ে গল্পটা পড়ে দেখুন।”
“পড়েছি যুথী। সমস্যাটা কোথায় সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“সমস্যাটা স্ক্রিনপ্লেতে ম্যাম। গল্পটা শুনতে যতটা ভালো লাগছিল, স্ক্রিপ্টে সাজানোর পর তার মান ততটা ভালো নেই। আরশাদ স্যার তো এই স্ক্রিনপ্লের সমস্যার কারণেই নক্ষত্র সিনেমাটা রিশুটে পাঠালেন। এজন্যে শুরু থেকেই আমরা ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি।”
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “একটা সিনেমার এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে গেছে। ডিরেক্টরকে আমরা কমিটমেন্টও দিয়ে ফেলেছি। চাইলেই তো আর সেই সিনেমা বাতিল করে দেওয়া যায় না। স্ক্রিপ্টে চেঞ্জ করতে বলো। দরকার হলো পুরো স্ক্রিপ্টটাই বদলে ফেলুক!”
হাবিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটাই তো সমস্যা ম্যাম। ডিরেক্টর স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে রাজি না। তিনি একচুলও চেঞ্জ করবেন না তার স্ক্রিপ্টে।”
দুশ্চিন্তার দমকা হাওয়া বয়ে গেল ঘরের মাঝে। নীরবতায় সকলেই গম্ভীর হয়ে মনে মনে সমাধান খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত।
আচমকা নীরবতায় ছেদ ফেলল মাহমুদের উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর, “ম্যাম আমার একটা সাজেশন ছিল!”
অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুথী চোখ রাঙিয়ে বলল, “মাহমুদ! নো!”
মাহমুদের অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যুথীর
দিকে। এই অফিসে দেখি তার মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতাই নেই! ক্রিয়েটিভ টিমের একজন সদস্য যদি নির্ভয়ে নিজের ক্রিয়েটিভি প্রকাশে না আনতে পারে, তাহলে আর এই চাকরি করে লাভ কী?
কেয়া শুকনো মুখে বলল, “আমরা তাও ডিরেক্টরকে একটা অপশন দিয়েছি ম্যাম। কোনো চেঞ্জ না করতে চাইলেও তাকে বলেছি কয়েকটা দৃশ্য ফেলে দিতে। তিনি তাতেও রাজি না।”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “ডিরেক্টরের সাথে এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে যাওয়ার পর একটা সিনেমা বাতিলের মানে নিশ্চয়ই জানো? তার সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষমেশ কাজটা না করা। এটা তো অন্যায়। তিনি চাইলেই পারেন সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে এই নিয়ে কথা বলতে। সাংবাদিকরাও রঙ-চং মাখিয়ে লেখালিখি করবে। এতে আমাদেরই গুডউইল নষ্ট হবে।”
মাহমুদ আবারও লাফিয়ে পড়ে বলল, “ম্যাম!”
তাকে আবারও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাবিব বলল, “আর উনি যেটা করছেন সেটা অন্যায় না ম্যাম? পৃথিবীর কোনো স্ক্রিপ্টই তো পারফেক্ট নয়। আমরা তাকে তার স্ক্রিপ্টটা পারফেক্ট করে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। তাকে নতুন সাজেশন দিচ্ছি। আমাদেরও যে ক্রিয়েটিভিটি আছে এটা সে মানতেই রাজি নয়।”
মাহমুদ হাল না ছেড়ে দিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠে বলল, “আমার একটা সাজেশন ছিল ম্যাম!”
অরা একপ্রকার বিরক্তি হয়েই বলল, “কী সাজেশন মাহমুদ?”
মাহমুদ হাসি হাসি গলায় বলল, “এখন থেকে আমরা একটা গল্প সিলেক্ট করার পর ডিরেক্টরকে বলবো তিন থেকে চারটা স্ক্রিপ্ট দিতে। একই গল্প নিয়ে বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট লিখবে। একটার সাথে কোনো আরেকটার মিল থাকবে না। তাহলে আমাদের এমন ঝামেলাও পোহাতে হবে না।”
ঘরজুড়ে নীরবতায় হাওয়া বয়ে গেল। এতটা সময় সকলে এই ঝামেলা নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত থাকলেও ক্ষণিকের জন্যে তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে বিরক্তি। জরুরি মিটিংয়ের মাঝে মাহমুদ এমনভাবে লাফালাফি করছিল, অরা ভেবেছিল তার কাছে কোনো জোরালো সাজেশন থাকেলও থাকতে পারে।
প্রকৃতি রাগ জিনিসটা তিলপরিমাণ দেয়নি অরার মাঝে। তবুও এমন জটিল পরিস্থিতিতে মাহমুদের অহেতুক সাজেশন শুনে তার মাঝে রাগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
অরা কঠিন গলায় বলল, “এই সাজেশন দেওয়ার জন্যে এতক্ষণ লাফাচ্ছিলে তুমি?”
অরার এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মাহমুদ। মনে মনে সে ধরেই নিয়েছিল তার সাজেশনে রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যাবে এ ঘরে উপস্থিত সকলে।
মাহমুদ আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “মাহমুদ এখানে একটা সিরিয়াস মিটিং চলছে। Stop being a child!”
যুথী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে বলল, “মাহমুদ! Out!”
মাহমুদ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘ মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হলো আদনান সাহেবকে অফিসে ডেকে তাকে বুঝিয়ে বলা হবে, যাতে স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন আনতে তিনি রাজি হয়ে যান।
মিটিং শেষে খানিকটা বিশ্রাম পেলো অরা। বেচারির ওপর দিয়ে আজ প্রচুর ধকল গেছে। এতটা ধকল নেওয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে। ধকল তো আর তার একার ওপর পড়ছে না, তার ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট্ট সুপারস্টারের ওপরেও পড়ছে।
বিশ্রাম পেয়েও মনের মাঝে একপ্রকার অস্বস্তি রয়েই গেল। বকাঝকা অরার স্বভাবে নেই। আজ পর্যন্ত অফিসের কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেনি সে। কেউ ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে বলেছে। আজ তবে কেন মাহমুদকে ওভাবে বকতে গেল সে?
একই নাম তাহলে মুড সুইং! প্রেগন্যান্সির বড় একটা সময় জুড়েই মুড সুইংয়ের বিচরণ। চোখের পলকের আগেই না-কি মনের অনুভূতি বদলাতে থাকে। আগেভাগেই এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ডক্টর।
একপ্রকার অনুশোচনা থেকেই মাহমুদকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠালো অরা।
অরা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “I’m sorry, আমি অফিসে কাউকেই এভাবে বকাঝকা করি না। কিন্তু আজ…”
মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আপনি সরি বলছেন কেন ম্যাম? আপনার মতো মানুষ আমাকে সরি বলবে? এটা কোনো কথা? বকাটা তো আমার প্রাপ্য ছিল। আপনার বকা খেয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তো বুঝতে পারলাম, কী বোকার মতো কাজ করেছি! একটা মানুষ একই গল্প নিয়ে তিন-চারটা স্ক্রিপ্ট কী করে লিখবে? এটা আবার সম্ভব না-কি?”
অরা কিঞ্চিৎ হাসি হেসে বলল, “সম্ভব তবে সেটা একজন ডিরেক্টরকে বলা যায় না। তার ওপরে অনেক চাপ পড়বে। তুমি তো নতুন, এখনো সব শিখে উঠতে পারেনি। এভাবে আইডিয়া দিতে দিতে আর ভুল করতে করতেই তো শিখবে। আমারই উচিত হয়নি তোমাকে চুপ করিয়ে দেওয়া।”
“সমস্যা নেই ম্যাম। আমার অভ্যাস আছে। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে সবাই আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে আসছে। আমি সবার ছোট তো, আমার যে কোনো মতামত থাকতে পারে এটা বাড়ির কারোর মনেই হয় না।”
নিজের মতো করেই অনেকটা সময় গল্প করে গেল মাহমুদ। অরা আজ উপলব্ধি করলো, এই ছেলেটার মধ্যে বিচিত্র এক সরলতা আর শিশুসুলভতা রয়েছে।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
১৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“এটা তো হার্টবিটের শব্দ না। মনে হচ্ছে যেন প্লেন চলছে। মানুষের হার্টবিট তো এমন হয় না।” বিভ্রান্ত গলায় বলল কথা।
আরশাদ অবাক হয়ে বলল, “মানুষের হার্টবিটের শব্দ তুই কীভাবে চিনিস রে?”
“কার্টুন থেকে। কার্টুনে টেনশনের মোমেন্টে হার্টবিটের আওয়াজ শোনায়।”
আরশাদ আর অরা দুজনেই হেসে ফেলল মেয়ের যুক্তি শুনে। মেয়েটা তার বাবার মতোই বুদ্ধির অধিকারী হয়েছে। তাকে বোকা বানানো নেহায়েত সহজ কাজ নয়।
অরা হাসিমুখে বলল, “আমার কথা কত স্মার্ট দেখেছো?”
আরশাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “তাই তো দেখছি।”
আজ সকালে অরাকে চেকআপের জন্যে হসপিটালে নিয়ে গেছিল আরশাদ। আল্ট্রাসাউন্ডে আজই প্রথম বাবুর ছোট্ট হৃদপিন্ডের ধুকপুক শোনে তারা। সেই থেকে আরশাদের উচ্ছাসে কোনোপ্রকার কমতি নেই। রেকর্ড করে আনা ওই হৃদস্পন্দের ধ্বনি অনবরত শুনেই যাচ্ছে। শুনবে নাই বা কেন? এই ধ্বনি যে তার কাছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম ধ্বনি।
হসপিটাল থেকে তারা দুজনেই গেল কথাকে স্কুল থেকে তুলতে। কথার মনের মাঝেও আজ তাই আনন্দের ছড়াছড়ি। সবসময় তাকে অরাই স্কুল থেকে তুলতে আসে। মাঝেমধ্যে আরশাদও আসে। তবে দুজনেই যখন একসঙ্গে আসে, তার দিনটা যেন একটু বেশিই আনন্দের হয়ে ওঠে। এ কথাটা সে আরশাদ বা অরা কাউকেই জানায়নি। জানালে তারা ইচ্ছে করে কথাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে মাঝেমধ্যেই একসঙ্গে তুলতে যাবে। আনন্দটা আগের মতো থাকবে না তখন আর।
কথাকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে এলো আরশাদ আর অরা। আজ আরশাদের শুটিং শুরু হবে দুপুরের পর। তাই তেমন একটা তাড়া নেই। বাড়ি ফিরেই বসার ঘরের সোফায় বসে আরশাদ আয়োজন করে মেয়েকে অনাগত অতিথির হৃদস্পন্দন শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আরশাদ আর অরা আগে একবার কথাকে জানিয়েছিল, খুব শীঘ্রই সর্বক্ষণ তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে কেউ একজন আসছে। সেবার কথা বিশ্বাস করেনি তাদেরকে। আজ বাবুর হৃদস্পন্দন শোনার পরও যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। তাই তো তার হৃদস্পন্দনকে প্লেনের আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করছে। যদিও আল্ট্রাসাউন্ডে শিশুর হৃদস্পন্দন খানিকটা উড়ন্ত প্লেনের মতোই শোনায়।
আরশাদ সুন্দরভাবে মেয়েকে বুঝিয়ে বলল, “একদম ছোট্ট বাবুর হার্টবিট এমন প্লেনের আওয়াজের মতোই হয় বাবা। তোর ভাই বা বোন যে আসছে, সে তো অনেক ছোট। তোর থেকেও ছোট!”
কথা কৌতূহলভরা গলায় বলল, “ও এখন কোথায় বাবা?”
আরশাদ অরার পেটের ওপরে হাত রেখে বলল, “এই যে এখানে। আর কয়েকটা দিন পরেই আমাদের কাছে চলে আসবে।”
কথা গভীর আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল অরার পেটের দিকে। কোনো মানুষ এখানে কী করে থাকতে পারে? বাবার কথাগুলো একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না একেবারে। একটা ভাই বা বোনের স্বপ্ন তার বহুদিনের। তার স্কুলের বেশিরভাগ বন্ধুদেরই হয় ভাই, না হয় বোন রয়েছে। তার নেই কেবল। এবার কি তবে সেই স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে?
কথা চিন্তিত গলায় বলল, “আচ্ছা বাবা, আমার ভাই আসবে না-কি বোন?”
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “সেটা তো এখন বলতে পারছি না। আর কয়েকদিন পর ও এলেই বোঝা যাবে।”
“ও কবে আসবে?”
কথার জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিতে মনের অজান্তেই হেসে ফেলল অরা। ভাই বা বোনের জন্যে বেচারি এতটাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছে যেন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করাও তার পক্ষে কষ্টসাধ্য।
আরশাদ সহজভাবে বলল, “বেশিদিন না। মাত্র ছয় মাস পর।”
“আমি কি ওর সাথে খেলতে পারবো?”
“কেন পারবি না?”
“ও কি আমার সাথে কার্টুন দেখবে?”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “অবশ্যই দেখবে সোনা। তুই যা বলবি তাই করবে।”
কথার এই কৌতুহল দেখে আরশাদ আর অরা দুজনেই মজা পাচ্ছে। তাদের দুজনের পাশাপশি এখন কথাও বাবুকে নিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন সাজাতে শুরু করেছে।
কথা এবার হাজির হলো নতুন কৌতূহল নিয়ে, “আচ্ছা অরা, ও আমাকে কি ডাকবে? আপা না-কি আপি?”
অরা হাসিমুখে বলল, “তুই কী চাস?”
“আপি?”
“তাহলে তাই ডাকবে। কথা আপি!”
বাবুটা একটু বেশিই ভাগ্যবান। পৃথিবীতে আসার আগেই এত মিষ্টি একটা আপি পেয়ে গেল সে। যে আপি ইতোমধ্যেই অসম্ভব ভালোবাসে তাকে।
কথার গভর্নেন্স পায়েল তাকে নিয়ে গেল তৈরি করে দেবে বলে। আজ সীমার বাড়িতে যাবে অরা। কথাকে তো একা আর রেখে যাওয়া যায় না, তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে।
কথা চলে যেতেই আরশাদ অরার কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে আনলো।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “কী করছো আরশাদ! বাড়ি ভর্তি স্টাফ, কেউ দেখে ফেললে?”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ফেলুক তো।”
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “ফেলুক মানে? ছাড়ো আরশাদ।”
আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “এমন ভাব করছো যেন তুমি আমার বউ না, গার্লফ্রেন্ড। আমাদেরকে এভাবে কেউ দেখে ফেললে বিরাট পাপ হয়ে যাবে!”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এই ছেলের লাগামছাড়া কথাবার্তার সঙ্গে সত্যিই পেরে ওঠা মুশকিল।
আরশাদ কোমল স্বরে বলল বলল, “আজ আমি অনেক খুশি।”
অরা আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, “আমিও।”
আরশাদ অরার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস।”
অরা আরশাদের বুক থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাংকস কেন?”
“এই যে আমার বাবুটাকে তোমার ভালোবাসার আশ্রয় বড় করে তুলছো, সেজন্যে।”
অরা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, “হ্যাঁ সেটাই। বাবু তো তোমার একার আমার তো আর কেউ না।”
আরশাদ আর অরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল।
আরশাদ তার শীতল ঠোঁটের স্পর্শ অরার কপালে দিয়ে বলল, “খেয়াল রেখো।”
“কার?”
“নিজের আর এই দুই বিচ্ছুর।”
অরা আবারও আরশাদের বুকে মাথা রেখে বলল, “তুমিও খেয়াল রেখো।”
“রাখি তো। যতটুকু পারি তোমাদের খেয়াল রাখি।”
“ধুর! আমি তোমার কথা বলছিলাম। নিজের খেয়াল রেখো আরশাদ।”
“সেটার প্রয়োজন হয় না।”
“কেন?”
আরশাদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তুমি আছ না? আমার খেয়াল রাখবে বলে।”
প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটজুড়ে। জীবনটা আজকাল রূপকথার গল্পের মতো হয়ে যাচ্ছে। রূপকথার গল্পের প্রতিটা পাতায় যেমন কেবলই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি, জীবনের প্রতিটা দিনও ঠিক তেমনই। প্রকৃতির কাছে কেবল একটাই প্রার্থনা অরার। জীবনের প্রতি এই মুগ্ধতা যেন কোনোকালেই ফুরিয়ে না যায়।
আরশাদ শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই অরাও কথাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সীমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওর বিয়ের পর মাত্র একবারই অরা গিয়েছে ও বাড়িতে। সীমা বেশ কিছুদিন ধরেই ফোনে জোরাজুরি করছিল যাওয়ার জন্যে। যদিও অফিসে কাজে ভয়ানক চাপ। তবুও চাপের মাঝ থেকে ঠিকই সময় বের করে নিলো অরা।
তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু বলতে সারাজীবন যাকে চিনেছে, সেই সীমা। বন্ধুত্ব এমনই একটা সম্পর্ক, যত্ন ছাড়া একে টিকিয়ে রাখা একেবারেই মুশকিল। তাই তো অরা হাজার ব্যস্ততার ভীড়েও সময় বের করে নিলো সীমার জন্যে।
সীমার বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র অ্যাপায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হলো অরাকে। সীমা ঠিকই বলে। তার শাশুড়ি সাবিহা বেগম অতিরিক্ত মিষ্টি। তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণের মধ্য দিয়েই অতিরিক্ত মিষ্টতার প্রকাশ ঘটে। অরাকে তিন-চারবার জিজ্ঞেস করে গেলেন, “রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো মা?” এমন একটা ভাব যেন অরা আরেক শহর থেকে বেড়াতে এসেছে তাদের বাড়িতে।
সীমার ননদ বর্ষা অরাকে ঘুরে ঘুরে তাদের বাড়িটা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সীমার বিয়ের পর থেকে সাবিহা বেগম তাকে নিজের সংসার সাজানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। সীমা নিজের পছন্দ মতোই বসার ঘরটা সাজিয়েছে।
বসার ঘরের একটা দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করা আরশাদের অটোগ্রাফ। সীমা প্রথম যেদিন আরশাদের সঙ্গে দেখা করেছিল, সেদিন নেওয়া এই অটোগ্রাফ। ফ্রেমটা চোখে পড়তে মনের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। ভালোবাসার মানুষকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে এমন সকল কিছুই তার ভালোবাসার।
সীমাদের পাশের বাড়ির ছোট্ট একটা মেয়ে এসেছে। কথা মুহূর্তেই মাঝে তার সঙ্গে ভাব করে ফেলেছে। দুজনে মিলে এখন বর্ষার ঘরে বসে হইচই করছে। বাচ্চাদের এই এক দারুণ ক্ষমতা। সম্পর্ক গড়ে তুলতে তাদের খুব একটা সময় লাগে না।
এনায়েত আর তার বাবা বাড়িতে নেই। দুদিনের জন্যে না-কি গ্রামের বাড়িতে গেছে। অরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, এই এনায়েত কখনোই বাসায় থাকে না। সীমার সঙ্গে যখনই দেখা হয় বা ফোনে কথা হয়, তখনই শোনা যায় সে বাইরে আছে।
দুপুরের খাবারের ব্যাপক আয়োজন করেছেন সাবিহা বেগম। বিশাল ডাইনিং টেবিল যে কতপ্রকার খাবার-দাবার দিয়ে সাজানো, তাই গুনতে হিমশিম খাচ্ছে অরা। অরা, সীমা আর বর্ষা তিনজনই বসে পড়লো। সাবিহা বেগমকে হাজার জোরাজুরি করা সত্ত্বেও তিনি বসলেন না। বাড়ির সকলের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত না-কি তিনি খেতে পারেন না।
কথাকে হাজার ডাকাডাকি করেও ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত আনা গেল না। নতুন বন্ধুর সাথে সে বর্ষার ঘরেই টিভি দেখছে আর খাচ্ছে।
সাবিহা বেগম পরম যত্নে তিনি একেকটা আইটেম তুলে দিচ্ছেন সকলের প্লেটে।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “এত রান্নাবান্নার কোনো দরকার ছিল না আন্টি।”
সাবিহা বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, “কী যে বলো মা! কিছুই তো করতে পারলাম না। ইচ্ছা ছিল মুড়িঘন্ট করবো, কিন্তু সময়ই করে উঠতে পারলাম না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “আমি এমনিতেও মুড়িঘন্ট খাই না আন্টি।”
সাবিহা বেগম শুকনো মুখে বললেন, “এটা তো আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলছো।”
অরা সত্যিই মুড়িঘন্ট খেতে পারে না। এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ালেই তর্ক বেঁধে যেতে পারে। অরা তাই নিঃশব্দে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
সাবিহা বেগম অবাক ভঙ্গিমায় বললেন,“তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না মা। আরেকটু পোলাও দিই?”
অরা ইতোমধ্যেই অনেক খেয়ে ফেলেছে। এমনিতেই সে কম কম খায়। কনসিভ করার পর তবুও আরশাদের ধমকা-ধমকিতে খাদ্য তালিকা বাড়িয়েছে। তবুও, এতটা খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “আন্টি আমি আর খেতে পারবো না সত্যি!”
সাবিহা বেগম জোর দিয়ে বললেন, “পারবে না মানে? পারতেই হবে।”
অরাকে আর কোনপ্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবিহা বেগম তার প্লেটে চামচভর্তি পোলাও তুলে দিলেন। অরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সীমার দিকে।
সীমা মজার ছলে বলল, “এটা হলো আমার শাশুড়ি মায়ের খাবারের অত্যাচার। তুই একদিন বেড়াতে এসেছিস বলে এই অত্যাচার করছে এমনটা কিন্তু না। আমাদের সবাইকে প্রতিদিন ঠিক এভাবেই অত্যাচার করে।”
সাবিহা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, “তোমরা আজকালকার মেয়েরা কীসব ডায়েটিং-টায়েটিং করো। আমার মেয়েটাকেই দেখো না! নিজেকে ফিট রাখবে বলে না-কি ডায়েটিং করে। আরে বাবা, কম খেয়ে আবার নিজেকে ফিট রাখা যায় না-কি?”
বর্ষা গোমড়া মুখে বলল, “তাই বলে কি বেশি খেয়ে নিজেকে ফিট রাখবো?”
“থাম তো তুই! অরা মা শোনো, এ সময়ে কিন্তু একেবারেই ওসব ডায়েটিং করবে না। ডায়েটিংয়ের জন্যে সারাজীবন পড়ে আছে। আগে বাচ্চার ভালোটা দেখতে হবে তো, না-কি?”
অরা হাসিমুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। মায়েরা সত্যিই অসাধারণ। নিজের ভালোর পরোয়া না করে সন্তানের ভালোটা করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অসাধারণত্বের তালিকায় আর কদিন পর তার নামটাও যোগ হতে যাচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে অরা আবারও তাদের বসার ঘরটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার বান্ধবীর রুচির প্রশংসা না করে উপায় নেই। চমৎকার সব পেইন্টিং আর শোপিস দিয়ে সাজিয়েছে ঘরটাকে। ও ঘর থেকে কথার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। আনন্দময় চেঁচামেচি। আজ বহুদিন পর মেয়েটাকে এত আনন্দিত লাগছে।
অরা উঁচু গলায় বলল, “আস্তে কথা!”
সীমা পাশ থেকে তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “থাক না অরা। স্কুলের বাইরে তো সারাদিন বেচারি একা একাই থাকে। সার্বক্ষণিক সঙ্গী তো এখনও নেই ওর।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আজ আরশাদ কথাকে বাবুর হার্টবিট শোনাচ্ছিল জানিস? বাবুকে নিয়ে ওর কত যে কৌতূহল।”
সীমা মুগ্ধ গলায় বলল, “Picture Perfect!”
“কী?”
“তোর পরিবার। তোর গল্পের একটা হ্যাপি এন্ডিং হলো তাই না?”
“হয়তো। বাস্তব কী আর সিনেমা, যে একটা না একটা এন্ডিং থাকতেই হবে?”
সীমার দিকে আড়চোখে তাকালো অরা। মেয়েটা আজ অন্যরকম লাগছে। সীমা মানেই তো প্রাণবন্ত-হাস্যোজ্বল একটি মেয়ে। কথায় কথায় যার ঠাট্টা করা চাই। আজ হঠাৎ তাকে এত নিষ্প্রভ লাগছে কেন? অরা জিজ্ঞেস করতে চাইছে, তবে ঠিক সুযোগটা যেন পাচ্ছে না।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসার ঘরে প্রবেশ ঘটলো সাবিহা বেগমের। তার হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে কতগুলো বাটিভর্তি পায়েস।
একটা বাটি তিনি অরার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “এই নাও মা। খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে?”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আবার পায়েসের কী দরকার ছিল আন্টি?”
“খাওয়ার পর ডেজার্ট থাকবে না, তা কী করে হয়? গোবিন্দভোগ চালের পায়েস। আমি নিজে গিয়ে এই চাল নিয়ে এসেছি। কেমন হয়েছে?”
অরা প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “দারুণ হয়েছে আন্টি। আপনার রান্নার হাত সত্যিই অসাধারণ!”
তিনি প্রশংসায় খানিকটা হয়ে বললেন, “সব আমার শাশুড়ি কাছ থেকে শেখা। উনার মতো ভালো রান্না আমি কাউকে করতে দেখিনি। উনার মতো তো আর পারি না। তবুও যতটুকু শিখেছি, বৌমাকে শেখানোর চেষ্টা করি।”
অরা হতবাক ভঙ্গিতে সীমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই রান্না করিস না-কি?”
সীমা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “ওই আর কী!”
সীমা কোনোকালেই খুব একটা রান্না করতো না। তারা দুজনে যখন একসঙ্গে থাকতো, তখনও প্রতিদিন একজন কাজের লোক এসে রান্না করে দিয়ে যেত। সেই মেয়ে না-কি এখন শাশুড়ির কাছে রান্না শেখে! বিয়ের পর মানুষ আসলেই কম সময়ের ব্যবধানে বদলে যায়।
সাবিহা বেগম হঠাৎ বলে উঠলেন, “বৌমা! তোমাদের বাড়িটা অরাকে দেখিয়ে আনো।”
অরা বলল, “তোদের বাড়ি মানে?”
সাবিহা বেগম হাসিমুখে বললেন, “প্রত্যেকটা মেয়েই তো চায় নিজের মতো করে সংসার সাজাতে। আমার বৌমাও নিশ্চয়ই মনে মনে তাই চাইতো। মুখ ফুটে কিছু না বললে কী হবে? আমি তো ঠিকই বুঝতে পারি। গত মাসে আমাদের এই ফ্ল্যাটের নিচের ফ্ল্যাটটা খালি হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ফেললাম এনায়েত আর বৌমার জন্যে। কয়েকটা দিন থাকুক নিজের মতো করে। নিজেদের বুঝতে শিখুক। কী বলো মা?”
প্রত্যেকটা মা না-কি চায় বিয়ের পর ছেলে তাদের আঁচলে নিচে থাকুক। বউয়ের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে মায়ের কথামতো চলুক। আর সেখানে সাবিহা বেগম নিজেই ছেলে আর পুত্রবধূকে একান্তে সংসারযাপন করার সুযোগ করে দিচ্ছেন!
সীমা আর এনায়েতের নিজস্ব ফ্ল্যাটটা ছোট হলেও যেন এক শান্তির নীর। পুরো বাড়িটাকেই সীমা নিজের মতো করে সাজিয়েছে। বারান্দায় ফুলের বাগান করেছে। বসার ঘরে বিশাল কাঠের দোলনা ঝুলিয়েছে।
অরা দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে বলল, “তোর শাশুড়ি তো বেশ স্মার্ট!”
সীমা দোলনার বিপরীতে থাকা সোফায় বসতে বসতে বলল, “স্মার্টের কী দেখলি?”
“স্মার্ট না হলে কোনো মা তার ছেলে আর ছেলের বউকে একা সংসার সাজাতে পাঠিয়ে দেয় না-কি?”
সীমা হাসলো। সহজ-স্বাভাবিক এক হাসি। তবে এই হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে বিচিত্র এক মলিনতা। এই মলিনতা আর কারও চোখে না পড়লেও অরার চোখে পড়তে বাধ্য।
“সীমা?”
“হুঁ?”
অরা সংশয় নিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”
সীমা অনাবশ্যক জোর দিয়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমি সবসময় ঠিকই থাকি।”
অরা সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “সেটা তো আমিও জানি। সবসময় ঠিক থাকলেও এই মুহুর্তে ঠিক নেই তুই। ব্যাপারটা কী?”
সীমা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কিছু না অরা।”
“এনায়েত ভাইয়ার সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
“আরে না।”
নিজের বলা কথাটা যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না সীমা। সে যা বলছে, যেন তা বলতে চাইছে না। বলতে চাইছে ভিন্ন কিছু। অরা তাকে জোর দিতে চাইলো না।
কী যেন মনে করে সীমা নিজেই বলে উঠলো, “ঝামেলা হওয়ার জন্যে তো ভালো সম্পর্ক থাকতে হয়।”
“এখনো কিছু ঠিক হয়নি?”
“না।”
অরা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু কেন? এখন তো নিজেদের আলাদা সংসার রয়েছে। একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
সীমা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “এটাই তো সমস্যা।”
“মানে?”
সীমা নিচু গলায় বলল, “আগে যখন সকলের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতাম তখন বাধ্য হয়ে সে সকলের সামনে দুয়েকটা কথা বলতো। এক ঘরে থাকতে হতো। কিন্তু এখন…”
কথাগুলো বলতে বলতেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সীমা।
অরা কৌতূহল নিয়ে বলল, “এখন কী?”
সীমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “রাত করে বাড়ি ফেরে। আমার সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা বলে না। মাঝেমধ্যেই অন্য ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাত অব্দি ফোনে কথা বলে।”
অরা হতবিহ্বল ভঙ্গিতে বলল, “সে কী?”
সীমা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আগেই ভালো ছিলাম অরা। যখন জীবনে কোনো পুরুষমানুষ ছিল না। এমন কিন্তু না যে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। কিন্তু তার এই
অবহেলাও সহ্য করতে পারছি না।”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুখে অস্বীকার করলেও মনে মনে সীমা তার সিঙ্গাপুরীর প্রতি একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অরা এটা খুব ভালো করেই জানে। তবে সীমার প্রতি এনায়েতের এই অবহেলার কারণ কী?
অরা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “একটু ধৈর্য ধর না সীমা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিছুই ঠিক হবে না। আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
সীমা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “অন্য কোনো মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক আছে।”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “কী বলছিস এসব?”
সীমা থমথমে গলায় বলল, “ভুল কিছু বলছি না। কোন ব্যাটার দায় পড়েছে গভীর রাত পর্যন্ত তার সাথে ফোনে কথা বলার?”
“কাজের কথা থাকতে পারে না? তুই শুধু শুধু ভুল বুঝছিস।”
“মানলাম রাত জেগে কাজের কথা বলছে। কিন্তু শার্টে মেয়েদের পারফিউমের গন্ধ?”
অরা হতবাক গলায় বলল, “কী?”
সীমা শুকনো গলায় বলল, “বাইরে থেকে ফিরে যখন শার্ট ঝুলিয়ে রাখে, তখন আমি মেয়েদের পারফিউমের গন্ধ পাই। বাড়ি থেকে যাওয়ার সময়ে তো ওই গন্ধ থাকে না।”
অরা চুপ করে রইলো। সে কী বলবে, তার কী বলা উচিত? অরা কিছুই বুঝতে পারছে না। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সে খুব ভালো করেই জানে। খুব কাছ থেকে আরশাদকেও এই একই জাতের যন্ত্রণা পেতে দেখেছে সে।
সীমা আবারও আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো, “প্রতিদিন নতুন নতুন শার্ট পরে, ফোনের দিকে তাকিয়ে অকারণেই হেসে ওঠে। সেদিন আবার দেখলাম চুলের স্টাইলও বদলে এসেছে। একটা মানুষ প্রেমে পড়লে যেমন আচরণ করে, তার আচরণ ঠিক তেমনই।”
অনেকটা সময় চুপ করে থেকে অরা কম্পিত স্বরে বলল, “এখন কী করবি তুই?”
সীমা ব্যর্থ ভঙ্গিতে বলল, “কী আবার করবো? এখানেই পড়ে থাকতে হবে। ফাইন্যান্সিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে আমি। চাইলেই ছেড়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু তখন সমাজই আমাকে খারাপ বলবে। আফটার অল, আমি সংসার করতে পারলাম না। দোষ তো আমার হবেই।”
যতটা প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে এ বাড়িতে পা রেখেছিল অরা, এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ততটাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। বিবাহিত জীবন না-কি জটিল এক সমীকরণ। সমীকরণের জটিলতার মুখোমুখি কখনো হতে হয়নি তাকে। বিবাহিত জীবন মানেই তার কাছে একরাশ মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। অথচ এই বিবাহিত জীবনেই কতটা যন্ত্রণা পোহাতে হয় মানুষকে!
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
২০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, সূর্য উঠেছে তবে তার উত্তাপ আজ অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে না। বরং মিষ্টি লাগছে। কফির কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সকালটা উপভোগ করা যায়। তবে সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীদের জীবনে উপভোগ বলতে কিছুই থাকে না। এই বিশাল কে ফিল্মসের অফিস যদি একটা সাম্রাজ্য হয়, সেই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী অরা। ছোট-বড় সকল সিদ্ধান্ত তার ওপরে। আর সেখানে যদি বড় কোনো সমস্যা উদ্ভূত হয়ে পড়ে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সম্রাজ্ঞীর রাতের ঘুম হারাম।
বিশাল সমস্যা তো বটেই। কে ফিল্মসের পরবর্তী সিনেমা ‘ছাই’য়ের শুটিং সেটে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঝামেলার কোনো সমাধান হয়নি। ঝামেলা বরং আরও বেড়েছে। শুটিংয়ের জন্যে একটা গোটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়। প্রায় ত্রিশটার মতো নকল বাড়িঘর। কার্ডবোর্ড বা ককশিটের তৈরি। ওসব বাড়িঘরের মধ্যে ছিল ছয়টি আসল বাড়ি। যেখানে মানুষ সত্যিই বসবাস করতো। যারা সেট তৈরি করেছিল তারা বিষয়টাকে অগ্রাহ্য করেছে। হয়তো তাদের জানা ছিল না সেই পুরো সেটেই শুটিংয়ের প্রয়োজনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সেটের নকল বাড়িঘর থেকে আগুন তার তেজস্বী ভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়ে ওই আসল বাড়িগুলোতেও। মানুষের জীবনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও তাদের মূল্যবান জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়েছে। তারা মাথার ওপরের ছাদ হারিয়েছে। বাড়িহারা ওই মানুষগুলো এরপর থেকে শুটিং করতে দিচ্ছে না। একটা ক্যামেরা ভেঙে ফেলেছে। যে হোটেলে পরিচালক, অভিনয়শিল্পী এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা রয়েছে, সেখানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
অস্থির এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে গতকাল ঢাকা থেকে কালিয়াকৈরে গিয়ে পৌঁছায় কে ফিল্মসের প্রোডাকশন টিমের পাঁচজন সদস্য। এই প্রোডাকশন টিম একটি সিনেমা তৈরির মূল কাঠামোর ওপরে কাজ করে। বাজেট তৈরি হয়ে গেলে এই বাজেট কোন কোন খাতে ব্যবহার করা হবে সেই নিয়েই তাদের কাজ। এছাড়াও সেটে উদ্ভূত যেকোনো সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের।
সমাধান করতে গিয়ে উল্টো সমস্যা বাড়িয়ে এসেছে তারা। অরা তাদেরকে বলে দিয়েছিল, ওই বাড়িহারা মানুষদেরকে ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিতে। প্রোডাকশন টিম প্রস্তাব না দিয়ে সরাসরি টাকাভর্তি একটা খাম তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বলে, “এটা নিয়ে সোজা এখান থেকে চলে যান। কোনো বাড়তি ঝামেলা করবেন না।”
গরীব মানুষের আত্মসমানে আঘাত লাগে এমন ঘটনায়। তারা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল, “আমরা কি ভিখারী না-কি? আমাগো ঘর পুড়ায় দিছেন, এহন নতুন ঘর বানায় দিবেন। ঘর না দেওয়া পর্যন্ত আপনেগো শুটিং বন্ধ!”
শুধু কথা পর্যন্ত ক্ষান্ত থাকেনি তারা। ইউনিট যে হোটেলে আছে তার সামনে মাটিতে চাদর বিছিয়ে অনশনে বসে গেছে। শুটিং সেটের কেউ আশেপাশে ঘেঁসলেও ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারছে।
চাইলেই তো আর নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়া যায় না। বাড়ি তৈরি একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। টিনের চালের বাড়ি হলেও সেটা বানাতে এক সপ্তাহ লাগে। এই এক সপ্তাহ শুটিং ইউনিট ওখানে আটকে থাকা মানে বিশাল ক্ষতি।
আজ সকালে অরা তাই জরুরি মিটিং ডেকেছে। প্রোডাকশন টিমের হেড সাদিক সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার টিমের কারণে সমস্যার গভীরতা এতটা বেড়ে গেছেন। চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক।
কফির কাপে ছোট চুমুক দিয়ে অরা শুকনো গলায় বলল, “চারদিন ধরে শুটিং বন্ধ হয়ে আছে। খরচ কিন্তু বন্ধ হয়নি। আপনারা তো কোনো সমাধানই বের করতে পারলেন না।”
শুটিং সেট মানেই হাজারটা খরচ। জেনারেটরের খরচ, হোটেলের খরচ, কলাকুশলীদের খরচ। শুটিং বন্ধ হয়ে আছে বলে যে এই খরচগুলোও বন্ধ হয়ে থাকবে এমনটা নয়।
সাদিক সাহেব ইতস্তত করে বললেন, “আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ম্যাম।”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “চেষ্টার কোনো ফল তো আমি দেখতে পাচ্ছি না সাদিক সাহেব। প্রয়োজন হলে যে ফ্যামিলিগুলো ক্ষয়-ক্ষতির স্বীকার হয়েছে তাদেরকে কম্পেন্সেশন দিন।”
সাদিক সাহেব ক্ষীণ জোর দিয়ে বললেন, “ম্যাম আমার বিশ্বাস ওই ফ্যামিলিগুলোর বাড়ি সেটের মধ্যে ছিল না। ওরা চক্রান্ত করে কম্পেন্সেশন পাওয়ার জন্যে নাটক করছে।”
অরা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “গরীব মানুষের কাছে একেকটা দিনের মূল্য জানেন?”
বাড়িঘর পুড়ে গেছে বলে যারা অনশন করছে তাদের সকলের বসবাস দরিদ্র সীমার নিচে। কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর। এই মানুষদের কষ্ট আর কেউ না বুঝলেও অরা খুব ভালো করেই বোঝে। একটা সময়ে তো তাদের জীবনটাই যাপন করেছিল সে।
অরা আবারও বললেন, “আপনার ধারণা তারা কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে এমনি এমনি অনশন করছে?”
সাদিক সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, “না মানে ম্যাম…”
অরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যদি এমনটাই হয় তাহলে আসলেই ওই সেটের মধ্যে তাদের বাড়িঘর ছিল কিনা এই সত্যিটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন!”
“জি ম্যাম।”
অরা হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “আমি অসম্ভব হতাশ। এই নিউজটা মিডিয়ার কাছে যায় কী করে? সামান্য ঘটনাটা আপনারা কনফিডেন্সিয়াল রাখতে পারলেন না? গতকাল পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। গতকাল আপনাদের টিমের মেম্বাররা পর্যবেক্ষণে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে।”
সাদিক সাবধানে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “এটা আসলে আমাদেরই ভুল ম্যাম। প্রেসের লোকরা কৌশলে আমাদের টিমের মেম্বারদের কাছ থেকে সব ইনফরমেশন নিয়ে গেছে।”
“ভুলটা আপনাদের। কিন্তু দোষারোপ করা হচ্ছে গোটা কে ফিল্মসকে। আজকের পত্রিকার হেডলাইন কী জানেন? ছয় পরিবারকে ঘরহারা করলো কে ফিল্মস। এটা কোনো কথা?”
“আমার একটা কথা ছিল ম্যাম।”
মুখ খুললেন কে ফিল্মসের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান রবিন সাহেব। এই লোকটার বিচক্ষণতার কারণে এক বছরের মাঝে পদোন্নতি হতে হতে আজ এ পর্যায়ে তিনি।
“বলুন রবিন সাহেব।”
রবিন সাহেব গুছিয়ে বললেন, “পরিস্থিতিটা আসলে একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটে যারা আটকে পড়েছে, বিশেষ করে আমাদের ডিরেক্টর আর প্রোডাকশন ডিজাইনার, তাদের পক্ষে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। ওই ফ্যামিলির লোকজন তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে। এখানে বসেও আমাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। আমি বলি কী ম্যাম, আপনি নিজে স্পটে গিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়ে আসুন। ওই ফ্যামিলিগুলোকে বুঝিয়ে বলুন।”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আমি বুঝিয়ে বললেই তারা বুঝবে কেন?”
“যদি কিছু মনে না করেন ম্যাম, আপনার তো একটা ফেস ভ্যালু আছে। আপনাকে দেখলেই বেশির ভাগ মানুষ চিনে ফেলে।”
বিভ্রান্তিতে তীব্রভাবে ডুবে গেল অরা। তার আবার পরিচিতি আছে না-কি? বড় বড় কোম্পানির কর্ণধারদের কেউ চেনে না তেমন একটা। তাহলে তাকে চিনতে যাবে কেন? পরমুহূর্তেই মনে পড়লো, তার যে আরেকটা পরিচিতি আছে, সেই পরিচিতির জন্যে চিনলেও চিনতে পারে। আরশাদ হকের স্ত্রীয়ের পরিচিতি।
রবিন সাহেব আবারও বললেন, “আমাদের প্রোডাকশন টিম যখন তাদেরকে ক্ষতিপূরণের কথা বলেছে, তখন তারা উল্টো ক্ষেপে গেছে। আপনি বুঝিয়ে বললে তারা বুঝতেও পারে।”
মিটিং সেরে নিজের কেবিনে এসে ডেস্কের ওপরে মাথা রাখলো অরা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। কিছু কিছু মানুষ কর্মক্ষেত্রের দুশ্চিন্তা কর্মক্ষেত্রেই ফেলে আসতে পারে। বাড়ি এসে এমন একটা ভাব করে যেন তার মাথার ওপরে কোনো চাপই নেই। অরা সেটা পারে না। কর্মক্ষেত্রের দুশ্চিন্তা সর্বক্ষণ কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। গভীর রাত অব্দি না ঘুমিয়ে কেবল সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে না।
ডোরবেল বেজে উঠলো। অরা সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাইরে যুথী দাঁড়িয়ে।
অরা উঁচু স্বরে বলল, “Come in.”
যুথী দরজা সামান্য ফাঁক করে মাথা বের করে বলল, “ম্যাম আসি?”
“এসো যুথী।”
যুথী এসে অরার বিপরীতে থাকা চেয়ারগুলোর একটায় বসতে বসতে মুখ ভার করে বলল, “ম্যাম, এটা আমার সেক্টরের মধ্যে পড়ে না তবুও ইন্টারফেয়ার করতে বাধ্য হচ্ছি।”
“কী?”
“একবার এই নিউজটা পড়ুন প্লিজ।”
যুথী তার ফোনটা বাড়িয়ে দিলো অরার দিকে। নিউজটা যে একেবারে ভিত্তিহীন তা বোঝার জন্যে পুরো নিউজ পড়ার দরকার নেই। হেডলাইনটাই যথেষ্ট। নিউজের হেডলাইন “আরশাদ হক এবার আগুন দিলেন দরিদ্র মানুষের ঘরে?” মিথ্যা নিউজ নিয়ে যাতে কেউ তাদের প্রশ্ন করতে না আসে, তাই নিউজের শেষে একটা অহেতুক প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে দেওয়া। অরা ফোনটা ফিরিয়ে দিলো যুথীর
কাছে।
যুথী বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ স্যার না-কি প্ল্যান করে ওই বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে! কোনো মাথামুন্ডু আছে এই নিউজের?”
অরা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “অথচ এদিকে যে এত কান্ড ঘটে গেছে, সে ঠিকমত জানে কিনা সন্দেহ।”
কয়েক মুহূর্ত পর অরা কী যেন মনে করে বলল, “যুথী?”
“জি ম্যাম?”
“কোন পত্রিকা?”
“জাগরণ।”
অরা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ওহ! তাই বলো। অন্যান্য পত্রিকা টার্গেট করছে কে ফিল্মসকে। আর তাদের টার্গেট আরশাদ। এটাই স্বাভাবিক। গত পাঁচ-ছয় বছরে তাদের একটাও ইন্টারভিউ দেয়নি আরশাদ। ওর কোনো সিনেমার প্রেস কনফারেন্সেও ডাকা হয় না তাদের।”
“কেন ম্যাম?”
অরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ওকে নিয়ে মিথ্যা নিউজ করেছিল, তাই।”
নওশীনের সঙ্গে আরশাদের ডিভোর্সের পর তাকে নিয়ে একরাশ পত্রিকা মিথ্যা নিউজ করেছিল। তবে সবার আগের নিউজটা এই দৈনিক জাগরণই করেছিল।
যুথী ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “এদের ব্যাপারে তো সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত। একের পর এক মিথ্যা নিউজ করে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে!”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “পাত্তা দিতে হয় না যুথী। জীবনে তুমি যতই সফল হয়ে যাও না কেন, দুয়েকটা ফালতু লোক থাকবেই তোমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর জন্যে। সবাইকে পাত্তা দিলে কি আর জীবন চলে?”
যুথী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই! এই সমস্যার কোনো সমাধান হলো ম্যাম?”
“আপাতত না।”
“প্রোডাকশন টিম তাহলে এতদিন বসে কী করলো?”
অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “তাদেরকে সমস্যার সমাধান করতে পাঠিয়েছিলাম। উল্টো সমস্যা বাঁধিয়ে এসেছে তারা। যে ফ্যামিলিগুলো অনশন করছে তাদের সাথে উল্টো ঝগড়া বাঁধিয়েছে। ওরা এতে আরও ক্ষেপে গিয়ে, যে হোটেলে আমাদের আর্টিস্ট আর ডিরেক্টর আছেন, সেই হোটেলে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে।”
যুথী অবাক ভঙ্গিতে বলল, “এ তো ভয়াবহ অবস্থা!”
অরা শুকনো গলায় বলল, “ভয়াবহ তো বটেই। আমাদের ম্যানেজমেন্ট হেড রবিন সাহেব অবশ্য একটা ভালো কথা বলেছেন। এখানে বসে তো আমরা কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। আমি নিজে যদি ওখানে যাই, ওই ফ্যামিলিগুলোকে বুঝিয়ে বলি তাহলে না-কি সমস্যার সমাধান হবে। আমার না-কি কী সব ফেস ভ্যালু আছে।”
“আছেই তো ম্যাম!”
“আমার সেটা মনে হয় না।”
যুথী হাসিমুখে বলল, “কী যে বলেন ম্যাম! সুপারস্টার আরশাদ হকের ওয়াইফ আপনি। আপনাকে চেনে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি গেলেই ওরা এই অনশন বন্ধ করবে।”
“তাহলে আমার যাওয়া উচিত বলছো?”
“অবশ্যই ম্যাম!”
চাইলে তো যাওয়াই যায়। এর আগেও শুটিং সেটের নানা সমস্যা সমাধানের জন্যে অরা নিজে সেটে গিয়েছিল। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার অরা একা নয়। তার মাঝে লুকিয়ে আছে আরও একটি প্রাণ। অরা নিজেকে সামলে নিতে পারবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যাতে বাবুর কোনো কষ্ট না হয়। তবে সামলাতে যাকে পারবে না, সে হলো আরশাদ।
আরশাদ কি রাজি হবে অরার এ সিদ্ধান্তে? কখনোই না। আরশাদকে রাজি করানোর থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করে আসা সহজ। তবুও অরা মনে মনে ঠিক করলো, সে চেষ্টা করবে। কে ফিল্মস নিঃসন্দেহে তার সন্তানের থেকে কম কিছু নয়। সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করার সব দায়িত্বও তো তার।
(চলবে)