#ফিরে_আসা২
৪৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অরা কি আরশাদের ফাজলামিটা সত্যি মনে করেছিল? আরশাদ ফাজলামি করে বলেছিল, নায়িকা যেন ভালো ফ্লার্ট করতে জানে। অরা সেই কথা অনুযায়ী সত্যি সত্যি ফ্লার্ট জানা মেয়েকে নায়িকা হিসেবে পাঠিয়ে দিলো না-কি?
সুজানার অডিশনের তিন সপ্তাহ ইতোমধ্যে পাড় হয়ে গেছে। কয়েকদিন হলো শুরু হয়েছে আরশাদের পরবর্তী সিনেমা ‘দিগন্ত’র শুটিং। ঢাকার অদূরে ৩০০ ফিটে সেট নির্মাণ করে শুরু করেছে প্রথম ধাপের শুটিং। প্রথম কয়েকটা দিন সুজানা স্বাভাবিকই ছিল। অরা বলেছিল মেয়েটা না-কি একেবারেই সাধারণ। নায়িকা জাতীয় কোনো বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে নেই।
প্রথম প্রথম সে কথার সত্যতা আরশাদ নিজেই পেয়েছে। সুজানা চুপচাপ থাকতো, সেটে কাউকে বিরক্ত না করে এক কোণায় বসে স্ক্রিপ্টে নিজের সংলাপগুলো মুখস্ত করতো, কাউকে বিরক্ত করতো না। দুদিন হলো সেই একই মানুষ যেন আচমকা বদলে গেছে। সুজানার কথাবার্তায় উপচে পড়া ঢং, আচরণেও ঢংয়ের ছড়াছড়ি। পরিচালককে কথায় কথায় বিরক্ত করছে। তাছাড়া প্রোডাকশনের ছেলেদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করছে। একবার তাদের কাছে কফি চাইছে। কফি আনলে বলছে, “আরে আজব! চা আনতে বললাম আনলে কফি! একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারো না?”
তার থেকেও বড় কথা আরশাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। গতকাল একটা দৃশ্যের জন্যে কালো শার্ট পরে শট দিতে এসেছে আরশাদ।
তাকে দেখেই সুজানা গলে পড়া গলায় বলে উঠে, “আরশাদ ভাইয়া! আপনাকে কালো শার্টে এত হ্যান্ডসাম লাগে কেন বলুন তো?”
এত বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছে আরশাদ। এমন কোনো সহঅভিনেত্রীকে আজ পর্যন্ত পেল না যার মাঝে গায়ে পড়া স্বভাব নেই। এদেরকে কোনোকালেই পাত্তা দেয়নি আরশাদ। নায়িকাদের যথাসম্ভব এড়িয়েই চলেছে। তবে এই মেয়েটার স্বভাব কেন জানি ভালো ঠেকছে না তার কাছে। কেন আরশাদ নিজেও জানে না। মনের মধ্যে একে নিয়ে খচকচ করছে।
আরশাদও তাই গম্ভীর গলায় বলে দিয়েছে, “ডোন্ট ইউ এভার আস্ক মি ইউর ফালতু কোয়েশচেনস।”
তবুও শোধরাচ্ছে না সুজানা। আজ সকালে আরশাদ সেটে পা রাখার পরই ঢং করে বলল, “আরশাদ ভাইয়া! এতক্ষণ আপনার অপেক্ষাই করছিলাম। আপনি না এলে সেটটা প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকে।”
তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আরশাদ চলে এসেছে তার গ্রিন রুমে। সিনেমায় সেটে সকল অভিনয়শিল্পীদের জন্যে একটাই গ্রিন রুম বরাদ্দ থাকে। এখানেই এরা মেকআপ-গেটআপ নেয়। তবে আরশাদের মতো সুপারস্টার সিনেমায় থাকলে ভিন্ন হিসাব। তার জন্যে বরাবরই আলাদা একটা গ্রিন রুম বরাদ্দ রাখা হয়।
আরশাদ তার চেয়ারে বসে মেকআপ নিচ্ছে। দৃশ্যের প্রয়োজনে তার চোয়ালে একটা কাটা দাগ বসাতে হবে। মেকআপ আর্টিস্ট সুদক্ষভাবে সেই দাগটা আঁকছে। এখনো সম্পূর্ণটা আঁকা হয়নি। তবুও দেখে মনে হচ্ছে যেন সত্যি সত্যি কেটে গেছে।
আরশাদ স্ক্রিপ্টে তার সংলাপগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছে। অয়ন হঠাৎ গ্রিন রুমে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার একটা কথা ছিল।”
আরশাদ স্ক্রিপ্টের দিকেই দৃষ্টি রেখে বলল, “বলো।”
“সুজানার না-কি পরের দৃশ্যটা বুঝতে পারছে না, আপনার হেল্প চাইছে। বাইরেই আছে, আসতে বলবো?”
কাজের বিষয়ে সহশিল্পীকে সাহায্য করতে মোটেও কার্পণ্য করে না আরশাদ। যদি সে একাই ভালো অভিনয় করে যায় আর সহশিল্পী বাজে অভিনয় করে – তবে পুরো দৃশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে। অন্য কেউ হলে ভেতরে আসার অনুমতি আরশাদ ঠিকই দিতো।
সুজানাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না বলেই থমথমে গলায় বলল, “আমি কি ডিরেক্টর যে জনে জনে সবাইকে দৃশ্য বোঝাতে যাবো? রাহাতের কাছে পাঠাও!”
অয়ন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল গ্রিন রুম থেকে। গায়ে পড়া স্বভাবের নায়িকাদের এভাবেই এড়িয়ে চলতে হয়।
আজ যে দৃশ্যটা ধারণ করা হবে সেখানে সুজানা তার ডক্টর, অর্থাৎ আরশাদের কাছে বর্ণনা করবে আট বছর বয়সে কেমন নৃশংসভাবে সে তার বাবা মা-কে হ/ত্যা করেছিল।
শট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁধলো বিপত্তি। সুজানা বারবার তার সংলাপ ভুলে যাচ্ছে। ভুল জায়গায় ভুল সংলাপ দিচ্ছে। বারবার পরিচালককে “কাট!” বলতে হচ্ছে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্যে বারবার সংলাপ ভুলে যাওয়াটা আসলেই বিরক্তিকর। আরশাদের জায়গায় অন্য কোনো অভিনেতা থাকলে এতক্ষণে রাগারাগি করে ফিরে যেত গ্রিন রুমে। তবুও আরশাদ বিরক্ত হলো না। নতুনদের ক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারে।
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “ডায়লগগুলো মুখস্ত করো।”
কয়েকদিন ধরে আরশাদের পাত্তার পিপাসু সুজানা তার মুখ থেকে এই একটা বাক্য শুনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। শট থেমে রইলো সুজানার মুখস্ত করার অপেক্ষায়। মিনিট দশেকের মাঝেই সংলাপগুলো মুখস্ত করে ফেলল সুজানা। আবারও শট শুরু হলো। এবার আর ভুল সংলাপ বলছে না সুজানা। তবে বেঁধেছে অন্য সমস্যা।
সুজানার চরিত্রটা এই সিনেমায় মানসিক ভারসাম্যহীন একটি মেয়ের। তার কথাবার্তার মধ্যেও সেই ভাবটা থাকতে হবে। অথচ সুজানা স্বাভাবিকভাবেই সংলাপগুলো বলে যাচ্ছে। আরও অনেক সমস্যা চোখে পড়লো তার অভিনয়ের। অথচ পরিচালক কিছুই বলছে না।
দৃশ্য ধারণের মাঝেই আরশাদ পরিচালকের আর ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই কাট, কাট!”
রাহাত উঠে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বলল, “কী হয়েছে আরশাদ ভাই?”
আরশাদ রাহাতের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সুজানার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমাকে দেখে তো মোটেই মেন্টালি ডিস্টার্ব বলে মনে হচ্ছে না। আর এই ডায়লগগুলো দেওয়ার সময়ে তোমার চোখেমুখে গিল্ট থাকতে হবে। কিন্তু তুমি তো গর্ববোধ করে বলে যাচ্ছো কীভাবে বাবা-মাকে খু/ন করেছিলে।”
সুজানা আমতা আমতা করে বলল, “আসলে ভাইয়া আমি বুঝতে পারছিলাম না এই দৃশ্যে কীভাবে অভিনয় করবো। এজন্যেই আপনার কাছে হেল্প চাইতে গিয়েছিলাম। আপনি তো ব্যস্ত ছিলেন। রাহাত ভাইয়ার কাছে গেলাম, তিনিও কিছু বললেন না।”
আরশাদ থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাহাতের দিকে।
রাহাত ইতস্তত করে বলল, “আরশাদ ভাই, এই সিনটা তো শুটিংয়ের আগেই ওকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই আর…”
রাহাতকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আরশাদ বলল, “আরেকবার ব্রেক দাও। যেমন-তেমনভাবে এই শট নেওয়া যাবে না।”
আরশাদ নিজে প্রযোজক বলে যে আরেকজনের অভিনয় নিয়ে এতটা মাথা ঘামাচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। বরাবরই সে সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সহযোগিতা করে থাকে। তখন যদি রাগারাগি না করে সুজানাকে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিতো, তাহলে এতটা সময় নষ্ট হতো না।
সেটে বসেই আরশাদ সুন্দর করে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিলো তাকে। কোন সংলাপ দেওয়ার সময়ে কীভাবে অভিনয় করতে হবে সেটাও বলে দিলো। আবার শট শুরু হতেই আর কোনো সমস্যা হলো না। নিখুঁতভাবে অভিনয় করে গেল সুজানা।
এই দৃশ্যের পর আরেকটা দৃশ্য ধারণ করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। এবারের দৃশ্যটা আরশাদের একার। আরশাদ তার স্টাডি রুমে বসে তার রোগীর দেওয়া তথ্য আর পুলিশের ফাইল ঘাটাঘাটি করছে। আসলেই এই মেয়েটা যা বলছে, তা সত্যি কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।
আরশাদের স্টাডি রুমের যে সেট বানানো হয়েছে সেটা দেখেই তার মেজাজ বিগড়ে গেল। একটু একটু করে এগিয়ে গেল যারা সেট সাজাচ্ছে তাদের ধমকাবে বলে। ওদিকে যে সেটজুড়ে ব্যস্ততা ছড়িয়ে গেল সে বুঝতেও পারলো না।
ব্যস্ততা তো বটেই। কে ফিল্মসের সিইও সাহেবা এসেছেন বলে কথা। শুটিং সেটে কোনো সমস্যা না হলে অরা আসে না, প্রেগন্যান্সির পর তো সেটা একেবারেই কমে গেছে। আজ হঠাৎ ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলো। তবে আজ সে ঠিক করে এসেছে, সিইওর কোনো ভূমিকাই পালন করবে না। কোনপ্রকার হিসাব-নিকাশ মেলাতে বসবে না। পুরোদস্তুর আরশাদের স্ত্রীর ভূমিকা পালন করবে। আরশাদের অভিনয় দেখবে।
সেটের সবাই তার আগমনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রোডাকশন ম্যানেজার, “ম্যাম বসুন।” “ম্যাম কী খাবেন?” – বলে বলে ক্লান্ত হচ্ছে। অরা অবশ্য বসছে না। ঘুরে ঘুরে সেটটা দেখছে। সেট দেখা তো অজুহাত মাত্র, মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সবথেকে প্রিয় মানুষটাকে।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন সুজানা দৌড়ে এলো। অরাকে জড়িয়ে ধরলো। অরাও আন্তরিক ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
সুজানা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “কেমন আছো আপু?”
এই কয়েকদিনের মধ্যেই সুজানার আপনি তুমিতে আর ম্যাম আপুতে নেমে এসেছে। অরার অবশ্য এতে কোনোই আপত্তি নেই। মেয়েটা তার বয়সীই। শুধু শুধু এসব ফর্মালিটির দরকার কী?
অরা হাসিমুখে বলল, “ভালো আছি আপু। তুমি কেমন আছো?”
সুজানা ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, “আমি তো সবসময় ভালোই থাকি। এখন তোমাকে দেখে আরেকটু বেশি ভালো হয়ে গেলাম।”
অরা প্রশংসার সুরে বলল, “বাহ্! তোমার পারফিউমটা তো দারুণ। বিদেশী?”
সুজানা হাসিমুখে বলল, “না, না! খাঁটি বাংলাদেশী!”
“তারপর? শুটিং করে কেমন লাগছে?”
“অনেক ভালো লাগছে আপু। সেটের সবাই এত ভালো! মনে হচ্ছে যেন নিজের বাড়িতেই আছি।”
সুজানার সঙ্গে কিছুক্ষন কথা বলেই অরা আবারও বেরিয়ে পড়লো আরশাদের খোঁজে। বেশিদূর খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। একটা ঘরের দরজায় উঁকি দিতেই দেখতে পেলো আরশাদ সেট সাজানোর দুটো ছেলেকে ধমকাধমকি করছে।
আরশাদ দরজার উল্টোদিকে ঘুরে আছে বলে দেখতে পেলো না অরাকে। অরা একটু একটু করে এগিয়ে গেল।
আরশাদ সামনে ঝাড়ি মেরেই যাচ্ছে ছেলেদুটোকে, “না মানে, তোমাদের কি কোনো ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হয় না? একটা সাইক্রিয়াটিস্টের ঘরে কঙ্কাল থাকবে কেন? আর এটা কী বই এনেছো? আমি ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে রিসার্চ করছি, আর আমার স্টাডি রুমে ছোটদের আইন্সটাইন? মানে, বিজ্ঞানের বই আনতে বলেছে বলে যা খুশি তাই নিয়ে আসবে? কী মনে করো এগুলো ক্যামেরায় ধরা পড়ে না?”
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো ছেলের একজন কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “সরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে।”
আরশাদ কঠিন গলায় বলল, “আধ ঘন্টার মধ্যে আমি পারফেক্ট সেট দেখতে চাই। কীভাবে কী করবে, তোমাদের ব্যাপার।”
ছেলেদুটো চলে যেতেই আরশাদ পেছনে ঘুরলো। চোখের সামনে যাকে দেখতে পেলো, তাকে দেখে রীতিমত চমকে গেল। আরশাদের চমকে খিলখিল করে হেসে উঠলো অরা।
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “তুমি?”
অরা হাসিমুখে বলল, “সারপ্রাইজ দিতে এলাম। পছন্দ হয়নি?”
আরশাদ প্রশ্নটার উত্তর দিলো না। অরার হাত ধরে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। পুরো সেটজুড়ে নানান মানুষের নানান রকম ব্যস্ততা। এদিকটায় কেউ নেই।
আরশাদ হুট করে অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “এমন সারপ্রাইজ প্রতিদিন দাও না কেন?”
অরা কোমল স্বরে বলল, “দিতেই তো চাই। প্রতিদিন এই সারপ্রাইজ দিতে গেলে তুমি বলবে, অরা! তোমার কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই। জানো না এই সময়ে এতটা পথ জার্নি করতে হয় না!”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “তা অবশ্য ঠিক।”
“ওভাবে ধমকাচ্ছিলে কেন ওদের? ভয়ে রীতিমত চুপসে গিয়েছিল ওরা।”
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “গাধার মতো কাজ করলে ধমক তো খেতেই হবে। তুমি দেখোনি? ওটা কোনো সেট হলো? দেখে মনে হয় একটা সাইক্রিয়াট্রিস্টের স্টাডি রুম?”
অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “না। তবে একটু ভালো করেও বললেও তো হতো।”
“বাঙালিকে ভালো কথা বললে কোনো কাজ হয় না। এদের সারাক্ষণ ধমকের ওপর রাখতে হয়।”
অরা কী যেন মনে করে হেসে ফেলল।
আরশাদ অবাক গলায় বলল, “হাসছো কেন?”
অরা হাসি থামিয়ে বলল, “আগে তো কেবল শুটিং সেটেই দেখতাম তোমাকে। ভাবতাম তুমি বুঝি আসলেই এমন বদরাগী। ভাগ্যিস আসল রূপটা দেখেছিলাম।”
আরশাদ হঠাৎ অরার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ম্যাডাম, আমার আসল রূপ দেখার অধিকার শুধু আপনারই।”
অরার সারা শরীরে কাটা দিয়ে গেল। আরশাদ কাছে এলেই তার ভেতরে ওলট-পালট তুফান শুরু হয়।
শট শুরু হলো। অরা মনিটরের সামনে বসে দেখলো আরশাদের অভিনয়। এই দৃশ্যে কোনো সংলাপ নেই। তবে আরশাদের প্রত্যেকটা এক্সপ্রেশন সংলাপের থেকেও ভালো কাজ করছে। এতটা নিখুঁত অভিনয় কেউ কীভাবে করতে পারে?
এই দৃশ্যের পর আরও একটা দৃশ্য ধারণ করে শেষ হবে আজকের শুটিং। তবে সেই দৃশ্যে আরশাদ নেই। তাই আর অপেক্ষা না করে এখনই বেরিয়ে পড়লো অরাকে নিয়ে। এমনিতেই মেয়েটার এতক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক হচ্ছে না।
সারাদিন শুটিং করে আরশাদ বেশ ক্লান্ত। তবুও ড্রাইভারকে সঙ্গে নিলো না। নিজেই ড্রাইভ করছে। হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও অরাকে পাশে নিয়ে ড্রাইভ করার এই অনুভূতিটা তার সবথেকে পছন্দের।
আরশাদের একটা হাত নিজের দুটো হাতের মধ্যে বন্দী করে কোলের ওপর রাখলো অরা।
নরম সুরে বলল, “তুমি অনেক ক্লান্ত না?”
আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “প্রচন্ড! কবে যে বাবুটা আসবে!”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড! বাবু আসার সাথে তোমার ক্লান্তি দূর হওয়ার সম্পর্ক কী?”
আরশাদ দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “আছে, আছে। তুমি বুঝবে না।”
অরা কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। কথার মানেটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফেরালো অরা।
“ছি! এত অসভ্য তুমি?”
আরশাদ হেসে বলল, “অসভ্যতার কী হলো? আমি তো বলছিলাম তোমার রান্নার কথা। আগে কত মজার মজার রান্না করে খাওয়াতে আমাকে। তোমার রান্না খেয়েই আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। এখন বাবু তোমার পেটের মধ্যে থাকার কারণে আমি নিজেই তোমাকে রান্নাঘরে যেতে দিই না। সেজন্যেই বলছিলাম, কবে বাবু আসবে আর কবে তুমি আবারও রান্না করতে পারবে। এখন তোমার মাইন্ড ডার্টি হলে তো আমার কিছুই করার নেই।”
আরশাদ কথাগুলো বলছে আর মিটিমিটি হাসছে। অরা এখনো মুখ ফিরিয়ে রেখেছে লজ্জায়। ছেলেটা মাঝে মাঝে এত কেন জ্বালায় তাকে?
আরশাদ হাসিমাখা স্বরেই বলল, “এই অরা! এদিকে তাকাও না। লজ্জা পেলে তোমাকে যা অদ্ভুত সুন্দর লাগে! এই দৃশ্যটা মিস করি কী করে?”
হাজার লজ্জা সত্ত্বেও আরশাদের দিকে তাকালো অরা। ধ্বক করে উঠলো আরশাদের বুকটা। আসলেই লজ্জা পেলে তার সৌন্দর্য হাজারগুণ বেড়ে যায়।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৪৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
লাইব্রেরিতে ল্যাপটপ খুলে বসে অফিসের কাজ করছে অরা। একটা মানুষ ছুটিতে থেকেও এত গুরুত্ব নিয়ে অফিসের কাজ করতে পারে? তাও আবার এই সাত-সকালে? কে ফিল্মসের পরবর্তী একটা সিনেমার খরচ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। বাজেট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ষাট লাখ, তবে যে হারে খরচ হচ্ছে তাতে এক কোটি স্পর্শ করবে নিঃসন্দেহে। এই সিনেমায় কোনোভাবেই এক কোটি টাকা খরচ করা যাবে না। অফিসে ফাইন্যান্স টিম কাল সারাদিন চিন্তাভাবনা করেও খরচটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তাই সকাল সকাল অরার সাহায্য চেয়েছে। অরাও বিন্দুমাত্র দেরি না করে বসে গেছে ল্যাপটপ নিয়ে। নিজেই নতুন করে বাজেট তৈরি করছে।
ওদিকে ঘোরলাগা দুটো চোখ যে তাকে অবিশ্রান্ত হয়ে দেখেই যাচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল অরার নেই। সকাল সকাল শুটিংয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল আরশাদ। ব্রেকফাস্টের জন্যে অরাকে ডাকতে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল দরজার কাছে। অরাকে আজ একটু বেশিই স্নিগ্ধ লাগছে। ধবধবে সাদা জামা আর খোলা তুলে তার সৌন্দর্য যেন সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আজও ভাবতে অবাক লাগে আরশাদের, এই মানুষটা তার একান্ত ব্যক্তিগত। এই মানুষটার ওপরে রাজত্ব চালানোর সকল অধিকার কেবলই তার।
কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে আছে অরা, তার ঢিলেঢালা জামাটা যে কাঁধ থেকে সরে গেছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। আরশাদের চোখের সামনে ফুটে উঠলো অরার কাঁধের তিলদুটো। চোখের সামনে ভাসতে থাকা অতিরিক্ত এই সৌন্দর্য কেমন ঘোরের মধ্যে ডুবে গেল আরশাদ। একটু একটু করে এগিয়ে গেল অরার কাছে।
অরার দৃষ্টি এখনো ল্যাপটপের দিকেই আবদ্ধ। এত কাজ করে কেন মেয়েটা? অরার কাজের প্রতি ক্ষীণ হিংসা হলো আরশাদের। কাজই যদি তার সকল মনোযোগ নিয়ে যায়, তাহলে আরশাদ পাবে কী?
আরশাদ নেশাক্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো অরার উন্মুক্ত কাঁধে। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো অরার। আরশাদের স্পর্শ প্রতিবারের তার মাঝে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। এমন হুট-হাট পাগলামি শুরু করলে কোথায় যায় বেচারি?
অরা ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “এরকম কোরো না তো আরশাদ!”
আরশাদ অরার কাঁধ থেকে মুখ তুলে কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “কেন? কী হবে এরকম করলে?”
অরা কিছুই বলতে পারলো না। চুপসে রইলো লজ্জায়।
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “সোজাসুজি বললেই তো পারো আরও বেশি আদর খেতে ইচ্ছা হয়।”
অরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “আরে ধুর! আমি কি সে কথা বলেছি না-কি?”
আরশাদ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “তুমি না বললে কী হবে? তোমার মনের কথা বুঝতে পারার সুপারপাওয়ার আমার আছে।”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আরশাদের কথা মিথ্যা নয়। ছোট্ট একটু স্পর্শ পেলেই তার ইচ্ছা হয় আরেকটু বেশি স্পর্শ পেতে। আরশাদের ভালোবাসার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে রাখতে। এ কথা ভুলেও স্বীকার করা যাবে না। লজ্জায় তাহলে শেষই হয়ে যাবে অরা। চুপ করে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো অরা।
আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে হাসিমুখে বলল, “আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। এরপরই টের পাবে আদর কাকে বলে!”
অরা লজ্জারাঙা কণ্ঠে বলল, “উফ আরশাদ! থামবে তুমি?”
আরশাদ হেসে বলল, “আচ্ছা বাবা। চলো, ব্রেকফাস্ট করবো।”
নিঃশব্দে ব্রেকফাস্ট করছে অরা। আজকের দিনটা অন্যরকম হতে যাচ্ছে তার জন্যে। এই দিনটার অপেক্ষা সে বেশ কিছুদিন ধরেই করছিল। তবে দিনটার মুখোমুখি হওয়ার পর কিছুটা দুশ্চিন্তাও কাজ করছে।
মাসখানেক আগে মোবারকের সঙ্গে পুনর্মিলনের পর থেকে আর অফিসে যায়নি অরা। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে নয়। অফিসে তার জরুরি কোনো কাজ পড়েনি বলে। তবে মোবারকের চিন্তা কখনোই মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি অরা। মোবারকের সঙ্গে সেদিনের কথোপকথনের পর থেকেই অরা ঠিক করে রেখেছে তিন ভাইয়ের জন্যে কিছু একটা করবে। কিন্তু সেই ‘কিছু একটা’ কী?
অনেক চিন্তা-ভাবনা করেও যখন কূল-কিনারা পেল না অরা, তখন বুদ্ধি চাইলো আরশাদের কাছে। আরশাদই তাকে বলল, তিনজনের নামে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট লিখে দিতে। মাথার ওপরে ছাদটা নিশ্চিত থাকলে মানুষের মানসিক কষ্ট অর্ধেক কমে যায়। নগদ টাকা দেওয়াটা খারাপ দেখায়। তাই আরশাদ বুদ্ধি দিলো বড় দুজনকে ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। কে ফিল্মসে নয়, প্রতিদিন তাদের মুখোমুখি হওয়ার অর্থ অরার মনে বারবার ছোটবেলার বিস্মৃতিগুলো ভেসে ওঠা। তাদের এমন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে, সেখানে বেতনটাও ভালো থাকে। কাজ শিখে দক্ষতা বাড়িয়ে পদোন্নতিরও সুযোগ থাকে। আর একেবারে ছোটটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। যদিও শিক্ষাজীবন শুরু করার জন্যে তার বয়সটা একটু বেশি। তবুও, কী আর করা? একেবারে অশিক্ষিত থাকার থেকে দেরিতে শিক্ষাজীবন শুরু করাই ভালো।
আরশাদের বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হলো অরার। মিরপুরের দিকেই বারো’শ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট পছন্দ হলো। রেডিমেট ছিলো বলে কিনে ফেলতেও খুব একটা সময় লাগলো না। ফ্ল্যাট অরা নিজের টাকা দিয়েই কিনেছে। যদিও আরশাদ প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। তবে অরার মতে, এই দায়িত্বটা তারই নেওয়া উচিত। একটা মেয়ে কেবল শপিং করার জন্যে টাকা রোজগার করে না।
মোবারক আর সোলেমানের জন্যে একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরির ব্যবস্থা করলো অরা। সেখানে কায়িক পরিশ্রমের থেকে মেধা দিয়েই কাজ করতে হবে বেশি। তাদের প্রধান কাজ ফ্যাক্টরির বিভিন্ন রোবট চালনা করা। বেতন আপাতদৃষ্টিতে অনেক ভালো। কাজ শিখতে পারলে পদোন্নতির সুযোগও রয়েছে। তার থেকেও ভালো কথা, এই ফ্যাক্টরি তার শ্রমিকদের জন্যে বিভিন্ন ওয়ার্কশপের আয়োজন করে থাকে। এসবের মাধ্যমে শ্রমিকরা ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা পায়। পরবর্তীতে নিজেরাই ব্যবস্থা গঠন করার জন্যে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
তিন ভাইয়ের জন্যে ভালো ব্যবস্থা করা হলেও তাদের মায়ের জন্যে কিছুই করবে না অরা। সে চাইলেই পারে ভদ্রমহিলাকে শহরের সবথেকে নামকরা হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু অরা করবে না। নিজের প্রতি তাহলে বিরাট অবিচার করা হবে। ছেলেদের ভালো ব্যবস্থা করে দিয়েছে, ছেলেরা মায়ের চিকিৎসা করাক!
আরশাদ কোমল স্বরে ডাকলো, “অরা?”
অরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “হুঁ?”
“শিওর তুমি একাই যাবে?”
অরা ক্ষীণ হেসে বলল, “হ্যাঁ আরশাদ। ওদের সাথে ইমোশনাল কোনো অ্যাটাচমেন্ট আমি রাখতে চাচ্ছি না। সারাটা জীবন তো নিজের একটা পরিবার ছাড়াই কাটিয়ে দিলাম। এখন হঠাৎ কোনো টান বাড়াতে চাই না। আমার পরিবার তো আছেই। তুমি, কথা, মা, আপা, তোমার মামা-মামী, খালা-খালু, চাচা-চাচী, কাজিনরা – এটাই তো আমার পরিবার। প্রত্যেকটা মানুষের কাছ থেকে এত ভালোবাসা পাই! যাদের কাছ থেকে কখনো ভালোবাসা পাইনি, তাদের ওপর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?”
আরশাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে বোন হিসেবে কখনো পাশে থাকবে না ওদের?”
অরা ফ্যাকাশে কণ্ঠে বলল, “না। ওদের হয়তো আমার প্রয়োজনও নেই। যতটুকু করছি, দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে করছি।”
এত বছর পর হারানো পরিবার খুঁজে পেয়ে তাদের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন করে তোলার কোনো ইচ্ছা অরার নেই। পরিবার তো কেবল নামেই, এই পরিবার কখনোই তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দেয়নি। আজ যদি তার বাবা বেঁচে থাকতেন, তবুও এই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ অরা রাখতো না। দায়িত্বটুকুই পালন করতো কেবল।
শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে আরশাদ অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“সাবধানে থাকবে অরা। ওই এলাকাটা কিন্তু ভালো না। প্লিজ একা কোথাও যেও না। যেখানেই যাবে, জহুরুল যেন তোমার সাথে থাকে।”
সেই কিডন্যাপিংয়ের ঘটনার পর থেকে অরা অফিসে বাদে অন্য কোথাও একা গেলেই মনে ক্ষীণ ভয় কাজ করে আরশাদের। যদিও এখন সবসময় তার সঙ্গে বডিগার্ড থাকে। তবুও চিন্তার শেষ নেই আরশাদের। আরেকবার মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলার কথা সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।
অরা হাসিমুখে বলল, “যথা আজ্ঞা স্যার!”
আরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার পর কথাকে ডেকে তুললো অরা। তাকে ব্রাশ করিয়ে, ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে, স্কুলের জন্যে প্রস্তুত করে দিলো। সকালের দিকটায় আজকাল বেশ ক্লান্ত লাগে অরার। বিছানা ছেড়ে ওঠাই দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাবু পৃথিবীতে আসা পর্যন্ত তাই এই দায়িত্বগুলো পায়েলকেই দিয়েছে অরা। তবে আজ অনেকদিন পর সকালটায় শরীর ভালো থাকায় অরা নিজেই করলো সব।
আধ ঘন্টার মধ্যে অরা নিজেও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো কথাকে নিয়ে। কথাকে স্কুলের সামনে নামিয়ে সোজা চলে গেল অফিসে। তার গাড়ি গ্যারেজে এসে থামতেই একজন সিকিউরিটি গার্ড ছুটে এসে দরজা খুলল।
অরা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “ভালো আছো কুদ্দুস?”
অরার এই এক বিরাট গুণ। অফিসে এত এত কর্মচারী, অথচ সকলেরই নাম মনে রাখতে কোনপ্রকার ভুল সে করে না।
কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, “জি ম্যাডাম। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ। শোনো, আমি আজ ওপরে যাবো না। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। পাঁচতলায় মোবারক নামে একজন ফ্লোর বয় কাজ করে ওকে ডেকে নিয়ে এসো।”
অরার ডাক পেয়ে মোবারক বিস্মিত হয়ে ছুটে এলো। এমনিতেই অনেকদিন হলো অরা অফিসে আসছে না। হুট করে এসে আবার খোঁজ করছে তার। বিস্ময়টাই স্বাভাবিক।
অরা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “গাড়িতে ওঠো মোবারক। একটা জায়গায় যেতে হবে।”
মোবারক দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে বলল, “কই যামু ম্যাডাম?”
“ওঠো আগে।”
মোবারক গাড়িতে উঠে বসতেই অরা বলল, “তোমার বাসার ঠিকানাটা ড্রাইভারকে সাহেবকে বলো।”
মোবারকের বিস্ময় যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একে তো অরা তাকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিলো, এখন আবার তার বাসার ঠিকানা চাইছে! হাজার বিস্ময় নিয়ে ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলো মোবারক।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর মিরপুরের এক বিস্তৃত বস্তির সামনে থামলো গাড়ি। সারি সারি টিনের ঘরের ফাঁকে সরু হাঁটার পথ। কেউ কেউ বাড়ির সামনে দড়ি টানিয়ে কাপড় শুকাতে দিয়েছে, কেউ টিনের ছাদ ফুটো হয়ে গেছে বলে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে ছাদের ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে রেখেছে। রুগ্ন কতগুলো ছেলেমেয়ে টায়ার আর লাঠি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। বস্তির দুইধারে আবর্জনার ছড়াছড়ি। দারিদ্রের এই চিরচেনা দৃশ্যের সঙ্গে বহু আগে থেকেই পরিচিত অরা। অবর্জনার দুর্গন্ধে তাই মুখ বিকৃত হলো না তার। ওড়নাটা দিয়ে মাথার ওপরে ঘোমটা টেনে নিলো অরা।
মোবারক তাদের ঘরটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে অরাকে। অরার পেছন পেছন গম্ভীর মুখে হাঁটছে তার বডিগার্ড জহুরুল। মিনিট কয়েক হাঁটতেই তারা পৌঁছে গেল মোবারকদের ঘরের সামনে।
ভগ্নপ্রায় একটা টিনের ঘর। ছাদের ওপরে নীল রঙের প্লাস্টিক বিছিয়ে রাখা। একটা জানালার কপাট নারকেলের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। ঘরের চারপাশ অগোছালো। একদিকে স্টিলের একটা ভাঙা কলস কাঁত হয়ে পড়ে আছে। আরেকদিকে কতগুলো ছোট-বড় প্লাস্টিকের বোতল স্তূপ করে রাখা।
ঘরের ভেতরে পা রাখতেই অরার গা বেয়ে হুহু করে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। ঘরের একেবারে কোণায় ছোট্ট একটা বিছানা। সেখানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে বয়স্ক এক মহিলা। এই মানুষটাকে চিনতে একেবারেই অসুবিধা হলো না অরার। পাথরের ন্যায় জমে গেল সে। এক ঝলকে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোটবেলায় তার ওপরে হওয়া অগণিত অত্যাচারের দৃশ্য। এই মানুষটাই তো তাকে হাজারো কষ্ট দিয়ে বিষিয়ে ফেলেছিল। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই কেড়ে নিয়েছিল অরার কাছ থেকে।
আজ আর কোনো ভয় নেই অরার। তাকে অত্যাচার করার কোনো সাহস বা শক্তি এই মহিলার আজ নেই। তবুও ভয় করছে অরার। ছোটবেলায় নিজেকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে ধারণ করে ফেলেছে যেন।
অরার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে অনায়েসেই এই মহিলার দিকে ছুঁড়ে দিতো প্রতিশোধের তীর। সেই ক্ষমতা অরার আছে। তবে তার মনটা যে একেবারেই নরম। প্রতিশোধ তো দূরের কথা, কোনো মানুষের ক্ষতির চিন্তাও সে করতে পারে না।
ঘরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে বসলেন আয়েশা বেগম। আরেকটু ভালো করে তার মুখটা দেখতে পেলো অরা। চুলগুলোতে সব পাক ধরেছে, বয়সের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে চোখমুখে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার শরীরজুড়ে দুর্বলতা।
আয়েশা বেগম কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অরার দিকে। যেন ভরদুপুরে ভূত দেখলেন তিনি।
রীতিমত চমকে উঠে আয়েশা বেগম বললেন, “আখি না?”
চুপ করে রইলো অরা। সে তো আখি নয়। ওই মেয়েটাকে নিজ হাতে মেরে ফেলেছে অরা।
তার হয়ে মোবারকই উত্তরটা দিলো, “না মা। আমার অফিসের বড় ম্যাডাম। আমগো বাসা দেখতে আইসে।”
আয়েশা বেগম অবিশ্বাস নিয়ে বললেন, “না, না। এইটা তো আখি। ভালো কইরা দেখ।”
মোবারক মায়ের কথাটা অগ্রাহ্য করে বলল, “আইচ্ছা আইচ্ছা, তুমি ঘুমাও এহন।”
“এইটা আখি!”
“ঘুমাও তো মা।”
জোর করে মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো মোবারক। গাড়িতে বসেই সোলেমান আর জাহানকে খবর দেওয়া হয়েছিল। এতক্ষণে তারাও এসে গেছে।
তিন ভাইকে কতবছর পর একসঙ্গে দেখলো অরা। ছোটবেলার সঙ্গে চেহারায় কোনোই মিল নেই তাদের। তিনজনই ছিল বিচ্ছু প্রকৃতির। সারা বাড়ি তাদের চেঁচামেচিতে থাকতো মুখরিত। অথচ কতটা বদলে গেল এরা। অভাব আর দারিদ্র্য তাদের বদলে যেতে বাধ্য করেছে।
ঘরের সামনের খোলা জায়গায় বসলো অরা।
তার পাশেই মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো জাহান। মোবারক আর সোলেমান তার সামনে দাঁড়িয়ে। অরা হ্যান্ডব্যাগ থেকে একে একে বের করলো জরুরি কাগজগুলো। ফ্ল্যাটের দলিল, চাকরির জয়েনিং লেটার, জাহানের স্কুলে ভর্তির কাগজ-পত্র।
মোবারক আর সোলেমান বিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি। কবেকার কোন হারিয়ে যাওয়া সৎ বোন, সে কিনা এতকিছু করছে তাদের জন্যে? বিশ্বাসই করতে চাইছে না দুজনের কেউ। অরা সবগুলো কাগজ বুঝিয়ে দিলো তাদের। বলে দিলো, কখন কী করতে হবে।
মোবারক আর বিস্ময় ধরে না রাখতে পেরে বলল, “এইসব ক্যান করলেন ম্যাডাম?”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মলিন হাসি হেসে বলল, “একটা সময়ে তোমার ম্যাডাম ছিলাম না, বুবু ছিলাম। সেই বুবু অনেক ভালোবাসতো তোমাদের। তোমাদের জন্যে নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও কোনো আক্ষেপ ছিল না তার। ধরে নাও, সেই বুবুও এসব করলো তোমাদের জন্যে।”
সোলেমান লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “কেমনে ধন্যবাদ দিই এহন আপনেরে?”
অরা হাসিমুখে বলল, “ধন্যবাদ দিতে হবে। শুধু জাহানের খেয়াল রেখো।”
অরা মেঝেতে বসে থাকা জাহানের দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“কী রাজামিয়া! অনেক লেখাপড়া করতে হবে, অনেক বড় মানুষ হতে হবে। পারবি তো?”
প্রশ্নটা করে নিজেই অবাক হলো অরা। মোবারক বা সোলেমান কাউকে আগের মতো আপন করে নিতে পারেনি সে। তাদের এবং অরার মাঝে যেন অদৃশ্য কোনো দেয়াল। অথচ জাহানের সঙ্গে ঠিকই আগের মতো সহজ হতে পারলো। জাহানের জন্মের পর ঠিক এভাবেই তাকে ‘রাজামিয়া’ বলে ডাকতো অরা। এমন তো নয় এই ডাকটা অরা মনে রেখেছিল। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। অবচেতন মন আচমকাই মনে করিয়ে দিয়েছে, অরাও আচমকা বলে ফেলল। তাহলে কি বাচ্চাদের আপন করে নেওয়াটা বেশি সহজ?
অরাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে জাহান বলল, “ক্যান পারমু না বুবু?”
অরার চোখে জল চলে আসার উপক্রম হলো। বুবু , কতদিন পর এই ডাকটা শুনলো সে!
(চলবে)