#ফিরে_আসা২
৪৫+৪৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
টানা ষোলোদিন একনাগাড়ে শুটিং হলো ‘দিগন্ত’ সিনেমার। প্রথম ধাপের শুটিং শেষ। পাঁচদিন পর আবারও শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের শুটিং। এই পাঁচটা দিন যে আরশাদ বিশ্রাম নিয়ে কাটাবে সে উপায়ও নেই। অফিসে বেশ কিছু জরুরি কাজ জমে আছে। অরা যেহেতু নিয়মিত অফিস করতে পারছে না, তাই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো ঝুলে আছে। এই বিরতির মধ্যে অফিসের জরুরি কাজগুলো সারতে হবে। পরবর্তী সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে মিটিং করতে হবে। একটা বিজ্ঞাপনের শুটিংও করতে হবে।
কাজের কথা মাথায় আসতেই ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে আরশাদের। এমনিতেই আজ সারাদিন আউটডোরে শুটিং করে বেচারা ক্লান্ত। হাজারটা কাজ জমে থাকা সত্বেও কালকের দিনটায় কোনো কাজ রাখেনি আরশাদ। কাল সারাদিন বাড়িতে থেকে বিশ্রাম করবে। এত খাটাখাটনির পর এতটুকু বিশ্রাম তো তার প্রাপ্যই। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে আরশাদ। এতটাই ক্লান্ত লাগছে যে ইচ্ছা করছে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়তে।
রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো। ঢাকার জনমানবশূন্য রাস্তায় ছুটছে গাড়ি। যে শহরটা দিনভর মানুষের কোলাহলে ব্যস্ত থাকে, তাকে এই রূপে বড় বেমানান বলে মনে হয়। হঠাৎ মোবাইলের নোটিফিকেশনের আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলল আরশাদ।
মোবাইলটা হাতে নিয়েই দেখলো সুজানার নতুন ম্যাসেজ। সে লিখেছে, “আজকের সিনটা এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। এই সিনেমায় যদি আমার অভিনয় ভালো হয়ে থাকে, তার পুরো ক্রেডিটটাই আপনার।”
ম্যাসেজটা সিন করে রেখে দিলো আরশাদ। রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। রিপ্লাই দেওয়ার অর্থ সুজানাকে অতিরিক্ত পাত্তা দেওয়া। এমনিতেই মেয়েটার ওপরে সে যথেষ্ট বিরক্ত। অরা বলেছিল, “এই মেয়ের অভিনয়ে দারুণ দক্ষতা আছে।” কিন্তু কোথায়? সেই দক্ষতার কোনো উদাহরণ এখন পর্যন্ত চোখে পড়লো না আরশাদের। একটা দৃশ্যও নিজে থেকে বুঝতে পারছে না। কোথায় কোন এক্সপ্রেশন দিতে হবে সেটাও বুঝতে পারছে না। দৃশ্যের মধ্যে সংলাপগুলো বলার কোনো সৌন্দর্য নেই। হড়বড় করে দাঁড়ি-কমা ছাড়া সংলাপ বলে যাচ্ছে।
প্রত্যেকদিনই এজন্যে সুজানাকে বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে আরশাদের। পুরোটাই সিনেমার স্বার্থে। সুজানা নিজের মতো অভিনয় করে গেলে সিনেমাটা হবে অতি অখাদ্য। একেকটা দৃশ্য ধরে ধরে বাচ্চাদের মতো বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে। আরশাদের বিরক্তির সকল সীমা ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিজের কাছে সে ইতোমধ্যেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, আর কখনোই নবাগত অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করবে না।
গাড়ি আরও মিনিট দশেক পর থামলো বাড়ির সামনে। ড্রাইভারকে গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করতে বলে নেমে পড়লো আরশাদ। আজ বহু বছর পর এতটা ক্লান্ত লাগছে তার। ইচ্ছা হচ্ছে যেন বাড়িতে পা রাখতেই ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় তলিয়ে যেতে।
লকের পাসওয়ার্ড চেপে দরজা খুলল আরশাদ। দরজা খুলে যেতেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মোহনীয় এক হাসি। সকল ক্লান্তিরা যেন এক নিমিষে ছুটে পালালো। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে অরা। এতক্ষণ তার মানে আরশাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
অরাকে এক নজর দেখতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল আরশাদের। মেয়েটার প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে। সর্বক্ষণ ঢিলেঢালা জামা পড়লেও ঠিকই চোখে পড়ে তার স্ফীত পেট।
অরার কাছে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরশাদ বলল, “অরা! এখনো ঘুমাওনি তুমি?”
আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে অরা হাসি হাসি কণ্ঠে বলল, “ঘুমালে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম কীভাবে?”
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “আমার সাথে দুষ্টুমি? পরিণাম ভালো হবে না কিন্তু!”
“ঘুম আসছিলো না, কী করবো বলো? বাবু
আজকে এত নড়াচড়া করছে!”
আরশাদ তার একটা হাত রাখলো অরার পেটের ওপরে। বাবু বেশি নড়ে উঠলে এখন বাইরে থেকে টের পাওয়া যায়। আরশাদ হাত রাখতেই টের পেলো বাবু নড়ে উঠেছে। অরার পেটের ওপরে কেমন ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “এই যে জুনিয়র! মাকে এত বিরক্ত করছেন কেন? আপনি এত নড়াচড়া করলে মার কষ্ট হয় না? আপনি একবার পৃথিবীতে চলে আসুন, তারপর আমরা দুজনে একসঙ্গে মাকে বিরক্ত করবো।”
অরা হেসে আবারও জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। আরশাদ এমনভাবে বাবুর সঙ্গে কথা বলে যেন বাবু সত্যিই তার কথা বুঝতে পারছে।
অরা বলল, “তুমি ডিনার করেছো?”
“হুঁ। তুমি করেছো তো?”
“না করে আর উপায় কী? সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তোমার বাবুর খিদে পেয়ে যায়।”
আরশাদের গলা জড়িয়ে রেখেই অরার হঠাৎ খেয়াল হলো তার শার্টের কলারে লাল রঙয়ের একটা দাগ। সাদা শার্ট হওয়ার কারণে দাগটা ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। অরার একবার দেখে মনে হলো, লিপস্টিকের দাগ। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, ধুর! আরশাদের শার্টে লিপস্টিকের দাগ আসবে কোত্থেকে?
অরা কৌতুহল নিয়ে বলল, “এটা কীসের দাগ?”
আরশাদ দাগটার দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে নিজেও খেয়াল করেনি শার্টে এই দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আরশাদ হালকা গলায় বলল, “মেকআপের হয়তো। জলাইনে একটা কাটা দাগের মেকআপ করে না? সেটারই দাগ লেগেছে।”
“ওহ!”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “কেন? তুমি কি ভাবছো আমি কারও সাথে রোমান্স করে এসেছি?”
অরা চোখ পাকিয়ে বলল, “আরশাদ!”
অরা খুব ভালো করেই আরশাদকে চেনে। এতটা ভালো করে হয়তো আরশাদ নিজেও নিজেকে চেনে না। সেজন্যেই আরশাদকে নিয়ে তার কোনো ইন্সিকিউরিটি নেই। সন্দেহ তো বহু দূরের কথা।
আরশাদ একবার কথাকে দেখে এসে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো অরা ইতোমধ্যেই শুয়ে পড়েছে। তার মাথার ওপরে একটা হাত, চোখদুটো বন্ধ।
আরশাদ অরার পাশে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “মাথা ব্যথা করছে?”
অরা অস্পষ্ট স্বরে বলল, “হুঁ, অল্প।”
আরশাদ আধশোয়া হয়ে বলল, “দেখি, হাতটা সরাও।”
অরা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “আরে মাথা টিপে দেওয়ার মতো ব্যথা করছে না তো!”
অরার বারণ শোনার কোনো প্রয়োজন মনে করলো না আরশাদ। সুন্দর করে টিপে দিচ্ছে অরার মাথা। কে বলবে, একটু আগে ক্লান্তিতে এই ছেলে প্রায় অবশ হয়ে যাচ্ছিল? অরার সামান্যতম অসুবিধা আরশাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অরা আবারও বলল, “মাথা টিপে দিতে হবে না আরশাদ। সারাদিন পরিশ্রম করেছো। এখন রেস্ট নাও তো!”
আরশাদ নরম স্বরে বলল, “আমার বউয়ের মাথা ব্যথা আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমাবো? তোমার কী মনে হয় আমাকে? পাষাণ?”
ভালোলাগাভরা চোখে অরা তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। ছেলেটা এত সুন্দর করে “বউ” ডাকে তাকে! যতবার ডাকে, ততবার ঠিক এই একই সৌন্দর্য বজায় থাকে। অরার হঠাৎ কী যে হলো! টুপ করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল আরশাদের কানের নিচে।
আরশাদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো অরার দিকে। লজ্জাবতী লতিকা খুব কমই নিজ থেকে প্রথমে আদর করে তাকে। কিন্তু যখন করে, ভিন্ন এক দুনিয়ায় হারিয়ে যায় আরশাদ। মনে হয় বেঁচে থাকাটা যেন সার্থক।
আরশাদ অন্যরকম কণ্ঠে বলল, “এই মেয়ে! বারবার পাগল করে দাও কেন আমাকে?”
এবার সত্যিই লজ্জামাখা প্রবল হাওয়া বয়ে গেল অরা। আরশাদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই দৃষ্টি খুব ভালো করেই চেনে অরা। তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার দৃষ্টি।
হুট করে আরশাদ মুখ ডুবিয়ে দিলো অরার ঘাড়ে। পাগলের মতো চুমু দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। যেন বহু বছরের তৃষ্ণার্ত সে। অরা চোখ বন্ধ করে খামচে ধরলো তার টি-শার্ট। বিচিত্র এক ঘোরের দুনিয়ায় ডুব দিয়েছে দুজনে। যে দুনিয়ায় তারা একে অপর ছাড়া আর কেউ নেই।
হঠাৎ অরার ঘোর কাটলো একটা রিংটোনের শব্দে। আরশাদের ফোন বাজছে।
অরা ক্ষীণ স্বরে বলল, “আরশাদ, তোমার ফোন।”
কথাটা আরশাদের কর্ণকুহরে পৌঁছালো কিনা কে জানে? অবিরতভাবে ভালোবাসাময় স্পর্শের বর্ষণ করেই যাচ্ছে অরার ওপরে। অরা আরও কয়েকবার ডাকাডাকির পর ঘোর কাটলো তার।
ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আরশাদ বলল,
“আমার ফোনটা বারবার ভুল সময়ে বেজে ওঠে কেন বলো তো?”
অরার বুঝতে বাকি রইলো না কোন ঘটনার স্মৃতিচারণ করে প্রশ্নটা করলো সে। খিলখিল করে হেসে উঠলো অরা।
আরশাদ বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইলের কাছে যেতে যেতে বলল, “সিরিয়াসলি, এই ফোনের কারণেই তো ঠিক সময়ে প্রথম চুমুটা খেতে পারলাম না।”
অরা কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “কে ফোন করলো এত রাতে?”
“আপা।”
কিছুটা অবাক না হয়ে পারলো না আরশাদ। এত রাত করে সাধারণত আশফিয়া ফোন করে না তাকে।
আরশাদ তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেলো আশফিয়ার ব্যস্ত কণ্ঠস্বর, “আরশাদ ঘুমিয়ে পড়েছিলি?”
আরশাদ স্বাভাবিকভাবে বলল, “না আপা বলো।”
আশফিয়া ইতস্তত করে বলল, “তোকে বিকেলের দিকেই ফোন করতাম। কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, ফোন করার কথা একেবারে ভুলেই যাই।”
“বলো না কী বলবে! এত ফর্মালিটির কী আছে?”
আশফিয়া উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “কাল আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে পিকনিকে যাচ্ছি বুঝলি। বেশি দূরে না, এই রমনা পার্কে। সারাদিন থাকবো। বান্ধবীদের বাচ্চা-কাচ্চারা আসবে, হই-হুল্লোড় করবে। আমি ভাবছিলাম, কথাকেও নিয়ে যাই। কাল তো ওর স্কুলও নেই।”
আরশাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কথাকে নিয়ে যাবে? সামলাতে পারবে তো? এখন কিন্তু অনেক বিচ্ছু হয়েছে কথা।”
আশফিয়া জোর গলায় বলল, “তোর থেকেও ভালো করে সামলাতে পারবো।মাঝখানে একদিন কথা আমার এখানে এলো না?”
“হুঁ।”
“সেদিন আমার এক বান্ধবীও এসেছিল ওর বাচ্চাদের নিয়ে। একদিনেই কী ভাব হয়ে গেছে কথার ওদের সঙ্গে! অনেক মজা পাবে মেয়েটা। বাড়িতে খেলার সঙ্গী নেই। সারাদিন শুধু মোবাইল নিয়েই বসে থাকে।”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “চেষ্টার কোনো কমতি রাখলাম না আপা। খেলার সঙ্গী আসতে এত দেরি করলে আমাদেরই বা কী করার আছে?”
আশফিয়া হেসে ফেলে বলল, “হয়েছে, হয়েছে। এখন বল নিয়ে যাবো কিনা?”
“এক মিনিট, একটু হোল্ড করো।”
আরশাদ অরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরা! আপা না-কি কোন পিকনিকে যাবে কাল। বেশি দূরে না। কথাকে নিতে চাইছে।”
আরশাদের এই ব্যাপারটা দারুণ মুগ্ধ করে অরাকে। কথার ব্যাপারে ছোট-বড় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অরার মতামত সে নেয়।
অরা হাসিমুখে বলল, “হ্যাঁ যাক না! সমস্যা কোথায়?”
আরশাদ আবারও ফোনটা কানে নিয়ে বলল, “যাও আপা, তোমাকে গ্রিন সিগন্যাল দিলাম।”
আশফিয়া হাসি হাসি কণ্ঠে বলল, “Thank you.”
“আমি তোমার বাসায় কথাকে দিয়ে আসবো?”
“না, না। তোকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না। আমিই যাওয়ার সময় ওকে পিক করে নেবো।”
আপার সঙ্গে কথোপকথন সেরে মোবাইলটা আবারও বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে দিলো আরশাদ। ঘরের সবগুলো বাতি নেভানোই ছিল। কেবল বিছানার দুপাশে বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্পশেডের আলো জ্বলছিল। সেগুলোও নিভিয়ে অন্ধকারে ঘরটা মুড়িয়ে দিলো আরশাদ।
অরাকে কাছে টেনে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে বলল, “এর মানে কী দাঁড়ালো বলো তো?”
“কী?”
“কাল যদি স্টাফদের আগেভাগে ছুটি দিয়ে দিই, তাহলে পুরো বাড়িতে শুধু তুমি আর আমি!”
অরা চুপ করে রইলো। নিশ্চয়ই কোনো দুষ্টুমি ভর করছে আরশাদের ওপরে।
আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “কাল তোমার কী হবে অরা?”
অরা লজ্জায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কী আর হবে? কিছুই হবে না।”
আরশাদ দুষ্টুমিভরা গলায় বলল, “এখনই ভয় পাচ্ছো?”
অরা আরশাদের বুকে মাথা রেখে বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাতে দাও তো।”
আরশাদও ক্লান্ত ছিল। তাই আর কথা বাড়ালো না। প্রশান্তিময় ঘুমে যে দুজনেই কখন তলিয়ে গেল, কেউ জানে না।
সকাল সকাল আশফিয়া হাজির কথাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ফুপির সঙ্গে বেড়াতে যাবে বলে তার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। অরা তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একটা ব্যাগে গুছিয়ে দিয়েছে। একটা টাওয়াল, সানস্ক্রিন, কথার রঙিন সানগ্লাস, কথার পছন্দের কয়েকটা চকলেট, ইমার্জেন্সির জন্যে কিছু ওষুধ, ফার্স্ট-এইড। এই ব্যাগটা কথা বোঝাই করছে রাজ্যের সব খেলনা দিয়ে।
সকলে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করলো। বেশির ভাগ কথাই হলো আশফিয়া আর কথার মাঝে। আরশাদ-অরা মনোযোগী শ্রোতা কেবল। আশফিয়া বলছে আজ সারাদিন তারা কী কী করবে আর কথা উজ্জ্বল চোখে তার কথাগুলো শুনছে।
ব্রেকফাস্ট শেষেই বেরিয়ে গেল দুজনে। স্টাফদের ক্লিনিং শেষে তাদেরও ছুটি দিয়ে দিলো আরশাদ। বাবুর্চি আব্দুর আর তার সহকারীদেরও বিদায় দিয়ে দিলো। আজ সে নিজের হাতে রান্না করবে অরার জন্যে।
অরা অবাক হয়ে বলল, “একটা দিন মাত্র ছুটি পেলে। কোথায় রেস্ট নিয়ে কাটাবে? শুধু শুধু ঝামেলা করছো!”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তোমার জন্য রান্না করতে আমার কী পরিমাণ ভালো লাগে, কোনো আইডিয়া আছে? রেস্ট নেওয়ার থেকে বেশি প্রশান্তিদায়ক আমার রান্না খাওয়ার পর তোমার রিয়্যাকশন দেখা।”
অরা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আরশাদকে দেখছে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, কতটা আনন্দ নিয়ে সে রান্না করছে অরার জন্যে। আরশাদ আজ রান্না করছে গরুর কালা ভুনা, পোলাও আর কাবাব। সবই অরার পছন্দের। একটু পর পর সে অরার কাছে আসছে। কখনো লবণ চেক করে দেখতে, কখনো পোলাওতে কয়টা কাঁচা মরিচ দেবে জানতে আর কখনো এমনিই, অরার কপালে আলতো চুমু খেতে।
রান্নাবান্না শেষে আরশাদ নিজেই অরাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এই মানুষটার অতিরিক্ত যত্ন অরার কাছে স্বর্গসুখের থেকে কম কিছু নয়। অরা মাঝে মধ্যে নিজেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, আসলেই কি এতটা ভালোবাসার সে যোগ্য?
মনের অজান্তেই অরার চোখে জল এসে জমা হলো।
সেই জল গড়িয়ে পড়ার আগেই আরশাদ তা মুছে দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “কী হলো অরা? বেশি ঝাল হয়েছে না-কি?”
অরা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমাকে এত বেশি ভালোবাসো কেন আরশাদ? একটু কম কম বাসলেও তো পারো।”
আরশাদ তার মোহনীয় হাসিটা হেসে বলল “সেটা তো সম্ভব নয় অরা। যতদিন বেঁচে থাকবো, এই জিনিস প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তেই থাকবে। কমার কোনো সুযোগ নেই।”
আবারও জল জমে গেল তার দুচোখে। ভাগ্য করে মানুষটাকে পেয়েছিল সে। না পেলে কবেই তলিয়ে যে অতল গহ্বরে!
আরশাদ আবারও অরার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “আর কাঁদে না। খাও তো এখন। খারাপ হয়েছে না-কি?”
অরা হেসে বলল, “অনেক মজা হয়েছে।”
আরশাদ অরাকে খাইয়ে দেওয়ার পর নিজেও বসে পড়লো। অরা তার পাশে বসে বসে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করছে।
হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইশ! এমন একটা দিন যদি বারবার আসতো!”
আরশাদ সহজ ভঙ্গিতে বলল, “আসছে তো! শুধু শুধু কী আর এত তাড়াহুড়ো করে শুটিংটা
শুরু করলাম? শুটিং শেষ হলে সব কাজ বন্ধ। এরপর থেকে আমার সব সময় শুধু আপনার।”
অরার মনে পড়ে গেল আরশাদের পেটার্নিটি লিভ নেওয়ার কথা। মুহূর্তেই হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটজুড়ে। সিনেমার শুটিং তো সমানের মাসের শেষের দিকেই শেষ হয়ে যাবে। তার মানে এর পর থেকে আরশাদ সারাক্ষণ তার চোখের সামনে? আনন্দে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠলো অরার মনটা।
খাওয়া-দাওয়া শেষে অরা হঠাৎ আবদার করে বসলো, “আরশাদ, আমি ছাদে যাবো!”
আরশাদ না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “না অরা। এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যাবে না।”
“কেন? সিঁড়ি বেয়ে আমি দোতলায় ঘরে যাই না?”
“ওই সিঁড়িগুলোতো একেবারেই গায়ে গায়ে। আর ছাদে ওঠার সিঁড়িগুলো উঁচু।”
“যাই না একবার!”
অরার এই শিশুসুলভ জেদ ভালো উপভোগ করলো আরশাদ। আসলেই তো, অনেকদিন হলো মেয়েটা ছাদে যায় না। বিয়ের পর তো অনেক অনেক সময় ওই ছাদেই কাটাতো। কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি তাদের ওই ছাদটায়।
আরশাদ হঠাৎ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “আচ্ছা চলো।”
ছাদের ওঠার উঁচু সিঁড়িগুলো পাড় করিয়ে আরশাদ অরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। চোখদুটো বুজে প্রাণভরে শ্বাস নিলো অরা। কতদিন পর এসেছে এই প্রিয় জায়গাটায়! প্রেগন্যান্সির পর থেকে তার ছাদে আসার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরশাদ। অরা ঘুরে ঘুরে তার গাছগুলো দেখছে। মালীরা নিয়মিত যত্ন নিচ্ছে বলে বেশিরভাগ ফুল গাছেই ফুল ধরেছে। আগে তো অরা নিজেই যত্ন নিতো।
বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে অরা ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই তাকে নিয়ে আরশাদ বসলো দোলনার ওপরে। নিজেও বসলো তার পাশে।
অরা আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “মোটা হয়ে যাচ্ছি দেখো। আগে এই দোলনার অল্প একটু জায়গা লাগতো আমার।”
আরশাদ একহাতে অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি এমনভাবে বলছো যেন মোটা হওয়াটা খারাপ।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আমার জীবনের সবথেকে মজার সিক্রেটটা কী জানো?”
আরশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী?”
অরা হাসিমাখা কণ্ঠে বলল, “একটা সময়ে তোমার ওপরে ক্রাশ খাওয়া মেয়েগুলোকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম। এমনকি যখন তোমার ম্যানেজার ছিলাম, তখনও। তোমার মেয়ে ফ্যানরা যখন গোলাপ নিয়ে সেটে ঢুকে পড়তো, কত কষ্টে যে হাসি চেপে রাখতাম। অথচ এখন…”
অরাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আরশাদ বলল, “এখন নিজেই দিন-রাত ক্রাশ খাচ্ছো?”
অরা অবাক গলায় বলল, “এখন দেখি সিক্রেটগুলো বলতেও হয় না। বলার আগেই বুঝে ফেলো”
আরশাদ অন্যরকম কণ্ঠে বলল, “সারাদিন তো কথায় কথায় লজ্জা পাও। আর এখন নিঃসংকোচে ক্রাশ খাওয়ার কথা স্বীকার করছো কীভাবে?”
“আমাকে লজ্জা পেতে দেখতে খুব ভালো লাগে তোমার?”
“ভীষণ! পাও না একটু লজ্জা।”
অরা এবার সত্যিই লজ্জা পেয়ে গেল। লজ্জায় অন্যদিকে ফিরে তাকালো।
আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “তাকাও এদিকে! This is what I wanted to see!”
অরা তাকালো আরশাদের চোখের দিকে। চোখে চোখে নীরব কথোপকথন করলো তারা কয়েক মুহূর্ত। পুরুষ মানুষের না-কি স্ত্রীয়ের প্রতি বেশি দিন আকর্ষণ থাকে না। অন্য পুরুষের কথা আরশাদ জানে না। তবে নিজের স্ত্রীয়ের প্রতি তার আকর্ষণ এ জীবন কমবার নয়।
আরশাদ হঠাৎ শুকনো গলায় বলল,
“অরা?”
“হুঁ?”
“ওই ঘটনাটা নিয়ে তুমি আমার ওপর রাগ পুষে রাখোনি তো?”
অরা অবাক হয়ে বলল, “কোন ঘটনা?”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে থমথমে গলায় বলল, “ওই যে, তোমার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখলাম, আজাবাজে কতগুলো কথা বলে তোমাকে কষ্ট দিলাম।”
অরা আরশাদের গালে হাত রেখে বলল, “আরশাদ, ওসব কী এখনো আমি মনে করে বসে আছি না-কি?”
আরশাদ চাপা স্বরে বলল, “জানি। তবুও খারাপ লাগে মাঝে মাঝে। ভয় হয়, যদি সত্যিই তুমি এখনো আমার ওপরে রাগ পুষে রাখো? আমি এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারিনি অরা, বিশ্বাস করো। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
অরা জোরপূর্বক ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন এক হাসি টেনে এনে বলল, “পাগল একটা! তোমার ওপরে রাগ করে থাকতে পারি আমি? সেই ক্ষমতা আছে আমার?”
“তবুও তোমাকে ওভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার তো আমার নেই।”
অরা আরশাদকে সহজ করার জন্যে বলল, “এত ভালোবাসার অধিকার যার, সে একটু কষ্ট তো দিতেই পারে।”
আরশাদ সহজ হলো না। অস্পষ্ট কণ্ঠে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “না, পারি না। খুব রাগ হয় মাঝে মাঝে নিজের ওপরে জানো? নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। ঠিক যেভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছিলাম।”
“আরশাদ! আমি তো ওসব কিছুই মনে রাখিনি। তুমি একটা ভুল করে ফেলেছো। ভুল তো মানুষই করে।”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমার সব সিক্রেট তুমি জানো অরা, একটা বাদে।”
“কোনটা?”
“আমার সবথেকে বড় ভয়।”
অরা বিস্ময় নিয়ে বলল, “কী তোমার সবথেকে বড় ভয়?”
“তোমাকে হারিয়ে ফেলা।”
অরা দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যেন অরাকে হারিয়ে ফেলার চিন্তা করাটাও তার জন্যে পৃথিবীর সবথেকে কষ্টকর কাজ।
আরশাদ অরার একটা হাত দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “প্লিজ আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যেও না অরা। আমি সহ্য করতে পারবো না, মরেই যাবো।”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “খবরদার আর কখনো এসব কথা বলবে না তুমি! কোথায় যাবো আমি? তুমি ছাড়া আর কী আছে আমার?”
আজ প্রথম আরশাদের চোখে ভয় দেখলো অরা। নিতান্তই অহেতুক ভয়। যতই ভয়ঙ্কর প্রলয় আসুক না কেন, অরা কখনোই আরশাদকে ছেড়ে কোথায় যাবে না। যাবে?
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৪৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
পাঁচদিনের বিরতি শেষে আবারও শুরু হলো ‘দিগন্ত’র শুটিং। এবারের লোকেশন নারায়ণগঞ্জ। গল্প অনুযায়ী আরশাদ নারায়ণগঞ্জে এসেছে তার রোগীর দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে। সুজানা বারবার বলছে আট বছর বয়সে নিজের বাবা-মায়ের
খু/ন সে নিজেই করেছে। মেয়েটা আগে থেকেই যেহেতু মানসিক ভারসাম্যহীন, তাই পুলিশ তার কথা একেবারেই আমলে নিচ্ছে না। ডক্টর হিসেবে আরশাদেরই একমাত্র মনে হচ্ছে সুজানার করা দাবিটা অগ্রাহ্য করা যায় না। তাই সে নিজেই নেমে গেছে তন্দন্তে। সুজানার গ্রামের বাড়ি হিসেবে সিনেমায় দেখানো হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ।
এখানে পুরনো আমলের একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে। কোন কালের কোন জমিদারের বংশধরদের বসবাস এখানে। শুটিংয়ের অনুমতি প্রথমে পাওয়া যাচ্ছিল না। আরশাদ হকের নাম শুনতেই এক লাফে রাজি হয়ে গেল তারা। সঙ্গে বিশাল ইউনিটের থাকার ব্যবস্থাও হলো এই বাড়িতেই। ঢাকা থেকে দূরত্ব বেশি না হলে আরশাদ কখনোই শুটিং সেটে থাকতে চায় না। রাতটুকুর জন্যে হলেও তার বাড়ি ফেরা চাই। বিশেষ করে অরার প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে, তাকে একেবারেই না দেখে থাকা আরশাদের পক্ষে অসম্ভব। তাই পুরো ইউনিট সহ অন্যান্য অভিনয়শিল্পীরা থেকে গেলেও আরশাদ রোজ রাতে শুটিং শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের এই ধাপের শুটিংয়ে আরশাদের সঙ্গে সুজানার কোনো দৃশ্য নেই। গল্পে যেহেতু আরশাদ একাই তদন্ত করতে এসেছে, তাই বেশির ভাগ দৃশ্যগুলোই তার সুজানার পরিবার হিসেবে যারা অভিনয় করছে তাদের সঙ্গে। ওদিকে সুজানার দৃশ্যগুলো সবই ফ্ল্যাশব্যাকের।
তবুও শান্তি নেই আরশাদের! সুজানা এখনো অনবরত বাজে অভিনয় করে যাচ্ছে। ফ্ল্যাশব্যাকে তার উনিশ বছর বয়সী সময়কালটা দেখানো হচ্ছে। তখনো সুজানা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেনি। মাঝে মাঝে বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে, আগের মতো আর কারো সঙ্গে মেশে না। চুপচাপ থাকে। এই সময়কালে সুজানা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো অভিনয় করছে। যেমনটা সে এতদিন ধরে অভিনয় করে আসছিল।
এতদিন চলছিল বর্তমান সময়কালের শুটিং। আর এখন চলছে ফ্ল্যাশব্যাকের। একজন অভিনয়শিল্পী যদি দুই সময়কালের পার্থক্য না বুঝে অভিনয় করতে না পারে তাহলে তার অভিনয় করার প্রয়োজনই বা কী?
সকাল সকাল ঠিক এই কারণেই মেজাজ হারিয়ে ফেলল আরশাদ। বাড়ির ছাদে একটা দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছে। দৃশ্যে সুজানা আর তার মামীর ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী। তেমন আহামরি কোনো দৃশ্য নয়। সুজানা ছাদে এসে তার মামীকে অদ্ভুত কয়েকটা কথা বলবে। বড়োজোর দুই মিনিটের দৃশ্য। এই দৃশ্যে সুজানা আটবার সংলাপ ভুলে গেল। আর অভিনয় তো করছেই পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো।
আরশাদ সেই দৃশ্যে না থাকলেও পরিচালকের পাশে বসে দেখছিল শুটিং। সুজানার একেকটা ভুল একটু একটু করে রাগ বাড়াতে থাকে।
এক পর্যায়ে আরশাদ মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে সুজানা বলল, “এরকম চলতে থাকলে তোমার অভিনয় করারই প্রয়োজন নেই! ছেড়ে দাও সিনেমা।”
সুপারস্টারের এক ধমক থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি করে পুরো সেটে। লাইট, প্রোডাকশনের যারা যারা কাজে ফাঁকিবাজি করছিল, তারাও সোজা হয়ে গেল। সুজানা তো চমকে জড়োসড়ো হয়ে গেল একদম। রাগ নিয়েই দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিলো সুজানাকে আরশাদ। একবার বুঝিয়ে দিতেই তার অভিনয় হলো সুন্দর।
আরশাদ ভেবে পায় না, এত কঠিন একটা চরিত্রের জন্যে পরিচালক কী মনে করে এই মেয়েকে কাস্ট করেছে। অডিশনের সময়ে অরাও ছিল। তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। একজন পরিচালক যতটা ভালো করে অভিনয় বুঝবে, অরা কী ততটা ভালো বুঝতে পারবে? রাহাতের প্রতিও এজন্যেই আরশাদের হচ্ছে তীব্র রাগ। ইচ্ছা করছে পরিচালক-নায়িকা সব পাল্টে আবারও নতুন করে সিনেমার শুটিং শুরু করতে। লস হয়, হোক!
তবে চাইলেই তো সেটা সম্ভব নয়। মিডিয়ার মাধ্যমে ভক্তকুল জেনে গেছে এই সিনেমায় আরশাদের বিপরীতে কোনো অভিনেত্রী অভিনয় করছে, কোন পরিচালক পরিচালনা করছে। হুট করে তাদের বলতে দিলে শুরু হয়ে যাবে একদলের সমালোচনা।
সমালোচনার ভয় আরশাদ কখনোই পায় না। তাকে নিয়ে সমালোচনা করার সাহস খুব কম মানুষেরই আছে। যে সমালোচনা করবে, তার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বে আরশাদের ভক্তকুল।
এই মুহূর্তে সিনেমা থেকে সুজানাকে বাদ দিয়ে দিলে সমালোচনা হবে কে ফিল্মসকে ঘিরে। নিজের প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে নেতিবাচক কিছুই জুড়তে চাইছে না আরশাদ।
এই বাড়ির সামনে বিশাল বাঁধানো পুকুর ঘাট। পুকুর ঘাটের দুপাশে পলাশ ফুলের গাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। সেখানেই করা হয়েছে আরশাদের বসার ব্যবস্থা। আরশাদ তার চেয়ারে বসে স্ক্রিপ্ট পড়ছে আর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। সিগারেটের প্রচন্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে, তবুও সিগারেট খাচ্ছে না। অরা তো এই সাতটা মাস ধরে তার সমস্ত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলছে। মেয়েটার একটা মাত্র নিষেধাজ্ঞা মানতে ক্ষতি কোথায়? আরশাদের পাশে আরও একটা খালি চেয়ারে তার ডায়রি আর কতগুলো রঙিন সাইন পেন পড়ে আছে। এলেই বলে অভিনেতা! শুটিংয়ে আসার আগে পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করে আসাটা দায়িত্ব মনে করে আরশাদ।
হঠাৎ আরশাদ লক্ষ্য করলো সুজানা এগিয়ে আসছে এদিকে। বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠলো আরশাদের। না জানি আবার কোন দৃশ্য বুঝতে আসছে। সুজানার সঙ্গে অভিনয় শুরু করার পর থেকে কেমন একটা শিক্ষক শিক্ষক ভাব হচ্ছে আরশাদের। বহুকষ্টে নিজের বিরক্তি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক হলো আরশাদ। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো স্ক্রিপ্টের দিকে।
সুজানা তার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল, “ভাইয়া আমি অনেক সরি। আপনাকে খুব বিরক্ত করছি তাই না?”
আরশাদ একবার সুজানার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি স্ক্রিপ্টের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “না, ইটস ফাইন।”
সুজানা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “বসতে পারি এখানে?”
আবার বসতে চাইছে কেন? নীরবতা, নিঃসঙ্গতাও মাঝে মধ্যে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। অথচ মানুষ পৃথিবীর যেখানেই চলে যাক না কেন, সেখানে কেউ না কেউ থাকবেই তাকে বিরক্ত করার জন্যে। আরশাদ যদি এখন “না।” বলে তাহলে তা হয়ে যাবে অভদ্রতার চূড়ান্ত। এমনিতেই একটু আগে সবার সামনে ধমক দিয়েছে সুজানাকে।
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁ বসো।”
সুজানা ফাঁকা চেয়ারটার ওপর থেকে আরশাদের ডায়রি আর সাইনপেনগুলো হাতে নিয়ে বসে পড়লো। আরশাদ কোনপ্রকার কথোপকথনে জড়াতে চাইছে না সুজানার সঙ্গে। তাই নিঃশব্দে স্ক্রিপ্টের দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো।
সুজানা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “জায়গাটা ভালো লাগছে?”
“হুঁ।”
সুজানা হাসি হাসি মুখে বলল, “আসলে আমি এই এলাকার মেয়ে তো। তাই জিজ্ঞেস করলাম?”
আরশাদ ক্ষীণ বিস্ময় নিয়ে বলল, “তোমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে?”
“আমার নানাবাড়ি। এই তো, এখান থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা। ছোটবেলায় প্রায়ই আসতাম এখানে। মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতাম। এখন অবশ্য ওই বাড়িতে কেউই নেই। নানা-নানী মারা যাওয়ার পর আমার মামারা বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে।”
আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “বাহ্।”
আরশাদকে বেশি একটা কথা বলতে না দেখে সুজানা ইতস্তত করে বলল, “আসলে ভাইয়া, আমি প্রতিনিয়ত আপনাকে বিরক্ত করে যাচ্ছি বলে খুবই লজ্জিত।”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। প্রথম প্রথম নার্ভাস হওয়াটা স্বাভাবিক।”
যদিও মনে মনে সে সুজানার ওপরে প্রচন্ড বিরক্ত। বিরক্তির প্রকাশ কিছুক্ষণ আগেই একবার ঘটিয়েছে সে। দ্বিতীয়বার ঘটানোর কোনো মানে হয় না।
সুজানা আবারও কম্পিত স্বরে বলল, “আমি কখনো এত বড় বাজেটের সিনেমায় অভিনয় করিনি। কখনো সুযোগ হবে সেটাও আশা করিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নাটকে অভিনয় করতাম। তাও আবার সাইড ক্যারেক্টার। প্রথম সিনেমাটাও তেমন বড় আঙ্গিকে তৈরি করা হয়নি। এই প্রথম একটা আসল সিনেমার সেটে আমি, তাও আপনার বিপরীতে। প্রত্যেকটা শটের সময়েই নার্ভাস হয়ে পড়ি।”
“সমস্যা নেই, বললামই তো প্রথম প্রথম সবারই হয় এমনটা।”
“তাছাড়া…”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সুজানা। যেন জরুরি কিছু বলতে যাচ্ছিল, আরশাদের রাগ বা বিরক্তির ভয়ে বলতে পারছে না। আরশাদ চায় না মানুষ অহেতুক তাকে রাগী ভেবে ভয়ে ভয়ে চলুক। যদিও সে রাগী, তবে মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখাটা তার স্বভাবে নেই।
আরশাদ সুজানাকে সহজ করতে বলল, “তাছাড়া?”
সুজানা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “না ভাইয়া, কিছু না।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোনো সমস্যা?”
সুজানা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমার বাবা। প্রটেস্ট ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে।”
মুহূর্তেই নাম না জানা এক অনুভূতিতে গা ভাসালো আরশাদ। তার নিজের বাবাও এই একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। নিজের বাবার দীর্ঘ দিন প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেছিল আরশাদ। তার মৃত্যুর পর সেই ঘৃণা হয়তো চলে গেছে, তবে জন্ম নেয়নি কোনো ভালোবাসা।
একটা মানুষের জীবনে বাবার ভূমিকা কতটা প্রগাঢ় হতে পারে আরশাদ তার বাবার কাছ থেকে শেখেনি। শিখেছি কথার কাছ থেকে। কথার সমস্ত আনন্দ, আহ্লাদ, আবদার – সবই তার বাবার কাছে। মানুষ যে তার বাবাকে কতটা ভালোবাসতে পারেনি, কথাই শিখিয়েছে তাকে। সুজানার অনুভূতিটা তাই বেশ ভালো করেই টের পাচ্ছে আরশাদ।
আরশাদ কণ্ঠ থেকে কাঠিন্য যথাসম্ভব দূর করে বলল, “I’m so sorry, আমি জানতাম না।”
সুজানা মলিন হাসি হেসে বলল, “It’s completely fine. আমি কাউকে বলিও না। রূপালী পর্দায় কাজ করি আমরা। খুশি ছড়ানোই তো আমাদের কাজ। কষ্ট ছড়িয়ে লাভ কী?
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “কোন স্টেজ?”
সুজানা চাপা স্বরে বলল, “ফাইনাল স্টেজ। কেমো চলছে। তবে ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছে মাত্র ছয় মাস।”
আপনজনকে হারানো কষ্টকর। তবে তার থেকেও কষ্টকর, এটা জেনে জীবনযাপন করা যে আপন মানুষটা আর কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। সুজানার চোখভর্তি জল এসে জমেছে।
সেই জল সে সাবধানে মুছে বলল, “এই ব্যাপারটাই মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। কাজে মন দিতে দেয় না। সারাজীবন যে মানুষটাকে প্রানবন্ত দেখলাম, তার আয়ু না-কি মাত্র ছয় মাস।”
“এই সময়ে তোমার বাবার পাশে থাকা। আর তুমি শুটিং করছো?”
“এটাই আমার বাবার ইচ্ছা ভাইয়া। সে সবসময় আমাকে বলে কাজ করে যেতে। মৃত্যুর আগ দিন পর্যন্তও যেন কাজ করে যাই। এতেই তার শান্তি।”
থমথমে এক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারদিকে। আরশাদের মধ্যে ক্ষীণ অপরাধবোধও হচ্ছে। সেই শুরু থেকে সুজানার অভিনয়ে অপারগতা নিয়ে কেবল বিরক্তই হয়ে এসেছে সে। একবারও জানতে চায়নি তার কোনো অসুবিধা আছে কিনা।
আরশাদ হঠাৎ বলল, “সুজানা?”
“জি ভাইয়া?”
আরশাদ সুজানাকে আশ্বস্ত করে বলল, “প্রেশার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ধীরেসুস্থে কাজ করো। আর যদি মনে হয় তোমার ব্রেক দরকার, বাবার কাছে থাকার প্রয়োজন – সরাসরি আমাকে বলবে।”
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সুজানা কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। আরশাদ এমনই, রেগেমেগে ধমকও দিতে পারে। প্রয়োজনে পাশেও থাকতে পারে।
সুজানা কৃতজ্ঞ গলায় বলল, “তবুও, থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”
দুজনের কেউই জানলো না দূর থেকে তাদের এই অতি স্বাভাবিক কথোপকথনের দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করছে কেউ একজন।
এদিকে ঢাকায়, ক্লান্তির মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করছে অরা। আজকাল প্রায়ই সকলের দিকে তার মাথা ঘুরে ওঠে। হাঁটার শক্তি পর্যন্ত পায় না। প্রেগন্যান্সির শুরুর দিকে এমনটা হতো। এখন কেন এমন হচ্ছে কে জানে? বেশিক্ষণ বসে থাকতেও ক্লান্তি বোধ হয় অরার। সারাদিনই বিছানায় পড়ে আছে।
একটু পর পর খিদে পাচ্ছে। অদ্ভুত সব জিনিস খেতে ইচ্ছা করছে। ডাইনিং টেবিলে বসে প্রায়ই অরা একটার সঙ্গে আরেকটা খাবার মিশিয়ে জগাখিচুড়ি বানাচ্ছে অরা। কখনো আচার দিয়ে মধু, টমেটো সস দিয়ে বিভিন্ন রকম ফল, আইস্ক্রিম দিয়ে চিপস। তার থেকেও বড় কথা প্রত্যেকটা খাবার অরা মজা করে খাচ্ছে। এগুলো না-কি ‘প্রেগন্যান্সি ক্রেভিংস’। প্রেগন্যান্সির এ সময়টায় অদ্ভুত সব খাবার খেতেই ভালো লাগে।
অফিস থেকে কতগুলো ফাইল আর চেক এসেছে অরার স্বাক্ষরের জন্যে। তাই বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বের হতে হয়েছে তাকে। আরশাদ তাকে অফিসের কাজ দিয়ে মাথা ঘামাতে একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছে। যে দুয়েকটা কাজ না করলেই নয়, সেগুলোই অরা করছে কেবল। এই কাজগুলো যখন করে, তখনই তার মধ্যে ক্লান্তির ভাবটা আসে না।
অরা তো মনে করে প্রেগন্যান্সির এই সময়টায় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সবথেকে বেশি প্রয়োজন। মনের মধ্যে হাজারো উদ্বেগের সৃষ্টি হয় এই সময়টায়। বাবুকে নিয়ে উদ্বেগ, নিজেকে নিয়ে উদ্বেগ। মনের এই অস্থিরতার মাঝে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে মন কিছুটা স্বস্তি পায়।
এক স্প্যানিশ সিরিজে অরা দেখেছিল, একজন প্রেগন্যান্ট পুলিশ কোনপ্রকার বিরতি না নিউ কাজ করে যাচ্ছে। নয় মাসের পেট নিয়ে ডাকাতের পেছনে দৌড়াচ্ছে। এমনকি ডাকাতকে কিডন্যাপও করে ফেলেছে। আরশাদকে সেই সিরিজের কথা বলতেই সে থমথমে গলায় বলে ওঠে, “অরা সিনেমা আর বাস্তব যে এক না সেটা আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। তাই এসব উদাহরণ না দিয়ে কোনো বাস্তব উদাহরণ থাকলে নিয়ে এসো।”
অরার কাছে আজ ফাইলপত্র নিয়ে এসেছে মাহমুদ। অফিস থেকে একেকদিন একেকজন আসে। সকলেই ফাইলগুলো অরাকে বুঝিয়ে দেয়, অরা স্বাক্ষর করে দেয়। ব্যস কাজ শেষ। তবে মাহমুদ অতিরিক্ত বাচাল স্বভাবের হওয়ায় একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে।
“ম্যাম, অফিস কিন্তু আপনাকে খুব মিস করছে।”
অরা ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকেই হাসিমুখে বলল, “আমিও অফিসকে খুব মিস করছি।”
মাহমুদ উসখুশ করছে আরও কিছু বলার জন্যে। তবে অরার সকল মনোযোগ ফাইলের দিকেই আবদ্ধ। মাহমুদ তার সামনে রাখা কফির কাপে কয়েকবার চুমুক দিলো। বসার ঘরে রাখা আরশাদের বিশাল অ্যাওয়ার্ডের শেলফের দিকে কিছুক্ষণ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। যেই বুঝতে পারলো ফাইলটা অরার পড়া শেষ, সেই মুখ খুলল কিছু বলার জন্যে।
তার আগেই অরা বলল, “আচ্ছা মাহমুদ, আটটা বাজেটের মধ্যে পাঁচটা আমি সাইন করেছি। বাকি তিনটায় সমস্যা আছে তাই এখনি অ্যাপ্রুভ করছি না। কোথায় কোথায় সমস্যা আছে মার্ক করে রাখছি। অফিসে গিয়েই এগুলো রিয়াজকে দেখাবে।”
“জি আচ্ছা ম্যাম।”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তোমার মনে থাকবে না মাহমুদ। ডায়েরিতে লিখে রাখো।”
মাহমুদ সঙ্গে করে ছোট্ট একটা ডায়রিও এনেছে। এতক্ষণ সেটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। অরা বলার পরেই সেটা খুলে কী যেন লিখলো।
অরা এবার ফাইলগুলোতে আরেকবার চোখ বুলাচ্ছে।
মাহমুদ হঠাৎ হালকা গলায় বলল, “সেদিন ম্যাম শুটিং দেখতে গিয়েছিলাম।”
“কোন সিনেমার?”
কে ফিল্মসের ব্যানারে একসঙ্গে অনেকগুলোর সিনেমারই শুটিং চলছে এই মুহূর্তে। মাহমুদ কোন সিনেমার কথা বলছে অরা আসলেই বুঝতে পারলো না।
মাহমুদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “দিগন্তর!”
“ও আচ্ছা। কেমন চলছে শুটিং?”
“ভালো ম্যাম। চমৎকার সেট তৈরি করা হয়েছে।”
“হুঁ, দেখেছি ছবিতে।”
শুটিং বা সেট নিয়ে অরা যে কোনপ্রকার আগ্রহ দেখাচ্ছে না, ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না মাহমুদের।
আগ্রহ সৃষ্টি করতেই তাই সে বলল, “রাহাত সাহেবের ওপর আরশাদ স্যার মনে হয় একটু বিরক্ত।”
“কেন?”
মাহমুদ সহজ গলায় বলল, “সুজানার জন্যে। বেচারি নতুন তো, আরশাদ স্যারের সাথে অভিনয় করতে গিয়ে ঘাবড়ে যায়। ভুল-ভাল অভিনয় করে, রাহাত সাহেবও কিছু বলে না।”
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “শুনেছি। ভুল করলাম সুজানাকে পছন্দ করে।”
মাহমুদ জোর গলায় বলল, “না ম্যাম! অভিনয় সুন্দরই করছে। আরশাদ স্যারের মতো কোওপরেটিভ সহঅভিনেতা পেয়েছে বলে কথা। প্রত্যেকটা দৃশ্য সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।”
“সেটাই তো স্বাভাবিক।”
“তবে ম্যাম আমার মনে হয় কী সুজানার বাসা থেকে প্র্যাক্টিস করে আসা উচিত। প্রতিদিন আরশাদ স্যারকে ওকে অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে। এত বড় একজন সুপারস্টার কেন ওকে এতটা সময় দিবে?”
মনে মনে বিরক্ত না হয়ে পারলো না অরা। আরশাদ যদি সুজানার অভিনয় ভালো করানোর জন্যে তাকে বাড়তি সময় দিয়েই থাকে, তাহলে ক্ষতি কোথায়? এমনিতেই সুজানাকে এই সিনেমায় জন্যে পছন্দ করে সে বিরাট ভুল করে ফেলেছে। আরশাদ যে তার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে এটাই অনেক।
অরা গম্ভীর গলায় বলল, “মাহমুদ, আমার মনে শুটিং সেটের এসব বিষয় নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামানোই উচিত।”
(চলবে)