#ফিরে_আসা২
৫৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কাকডাকা ভোর। অন্ধকার ভেদ করে সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে আকাশে। লাল আভা খেলে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। পা দুটো ভাঁজ করে বারান্দার বেতের সোফার ওপর বসে আছে সীমা। তার চোখদুটোতে লেপ্টে আছে গভীর ঘুম। মনে হচ্ছে যেন বিছানায় মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাবে ঘুমের রাজ্যে। তবুও কেন এভাবে বসে আছে, সে নিজেও জানে না। অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকলে না-কি মানুষের ঘুমাতে ইচ্ছা করে না। মনের অস্থিরতা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।
অরার জন্যে খারাপ লাগা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সারারাত হাজার বুঝিয়েও শান্ত করতে পারলো না মেয়েটাকে। জেদ ধরে বসে আছে, সে নিজ চোখে যা দেখেছে – সেটাই ঠিক। অরার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা সে করতে পারছে না। অরাকে দোষারোপ করার কোনো কারণ অবশ্য নেই। অন্য এক নারীর সঙ্গে নিজের স্বামীর অন্তরঙ্গ ছবি দেখলে কোনো মেয়েরই স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। সে ছবি আসল হোক, কিংবা নকল।
এই বিষয়গুলো সীমা এখন বুঝতো না, নিজের বিয়ে হওয়ার পর এখন বুঝতে শিখেছে।
কারও হালকা পায়ের শব্দ কানে ভেসে আসতেই ঘুরে তাকালো সীমা। ঘুম ঘুম চোখে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এনায়েত। মনের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো সীমার ঠোঁটে। ভালোবাসার মানুষেরা এমনই, হাজার ক্লান্তি হাজার অস্থিরতার মাঝেও এক বিন্দু প্রশান্তি ছড়িয়ে দিতে পারে মনের মাঝে।
সীমা হাসিটা বজায় রেখেই বলল, “মাত্র উঠলেন?”
এনায়েত বারান্দায় প্রবেশ করলো। সীমার পাশে বসতে বসতে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ। আর তুমি সারারাত ঘুমাওনি তাই না?”
সীমা আলস্যের সঙ্গে এনায়েতের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “অরা মাত্র ঘুমালো। ওকে একা রেখে কী করে ঘুমাই। সারা রাত কান্নাকাটি করেছে বেচারি।”
এনায়েত ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যা ঘটে গেল। তার পরে তো কান্নাটা করাটাই স্বাভাবিক। আমি তো আগেই বলেছিলাম তোমাকে, এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সবাই একই রকম।”
সীমা আচমকা এনায়েতের কাঁধের ওপর থেকে মাথা তুলে থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। বিয়ের এতগুলো দিনে এনায়েতের জানতে বাকি নেই তার বউ প্রিয় সুপারস্টারের জন্যে কতটা পাগল। তাই ইচ্ছে করেই সুযোগ খোঁজে আরশাদের বিরুদ্ধে তাকে উষ্কে দেওয়ার।
তবে আজকের পরিস্থিতিটা ভিন্ন। আজকের এই ঘটনায় কেবল দূরের সুপারস্টার নয়, জড়িয়ে আছে সীমার সবথেকে কাছের বান্ধবীও।
এনায়েত তাই পরাজয় স্বীকার করে বলল, “আচ্ছা সরি সরি!”
সীমা গম্ভীর ভঙ্গিতে আবারও তার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল, “বাজে কথা বলবেন না তো। আরশাদ ভাইয়া মোটেও খারাপ না। আমার বিশ্বাস এর পেছনে কারো গভীর ষড়যন্ত্র আছে।”
এনায়েত চিন্তিত গলায় বলল, “কার?”
সীমা ঠোঁট উল্টে বলল, “কে জানে? এত বড় মানুষের শত্রুর অভাব আছে না-কি?”
এনায়েত শত্রুর প্রসঙ্গ পাল্টাবার উদ্দেশ্যে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “ফেসবুকে ঢোকাই যাচ্ছে না। যেদিকে যাই, সেদিকে শুধু ওই এক ছবি।”
সীমা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “ওহ হ্যাঁ! ছবিগুলো তো দেখলামই না। দেখান তো! আমার ফোনটা চার্জে দিয়ে এলাম মাত্র।”
সারাটা রাত অরাকে সামলাতেই ব্যস্ত ছিল সীমা। ফেসবুকে ঢোকার আর অবকাশ পায়নি। যে ছবিগুলো সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে গেল, সেই ছবিগুলোই তার চোখে পড়লো না এখনো। এনায়েত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ঢুকলো ফেসবুকে। সার্চ দেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। নিউজফিডের শীর্ষে তিনটি ছবি।
অন্তরঙ্গ অবস্থায় দুজন নর-নারী। মেয়েটার মুখ-শরীর সবই ব্লার করে রাখা হয়েছে। পুরুষের অবয়বও অস্পষ্ট। তবে তাকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা সুপারস্টার আরশাদ হক। ছবিগুলো মাত্রাতিরিক্ত জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে সীমার কাছে।
ছবিগুলো পোস্ট করেছে এক সিনেমার গ্রুপ। ক্যাপশনে লেখা, “আরশাদ হকের মতো দুশ্চরিত্র মানুষকে অভিনেতা বলে গণ্য করাই উচিত না। ইতোমধ্যেই তাকে বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে। আসুন আমরা সবাই সেই ডাকে সাড়া দিই।”
ক্যাপশন পড়ে রাগে সীমার গা জ্বলে গেল। যে মানুষটা ইন্ডাস্ট্রির জন্যে এতকিছু করলো, তাকে কী সহজেই বয়কট করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে মানুষ! এরই নাম বাঙালি। সত্য-মিথ্যার বিচার না করেই রায় দিয়ে দেয় ফেসবুক আদালতে।
এনায়েত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোমার কথা যদি সত্যি ধরে নিই তাহলে এই ছবিগুলো ফটোশপড। কিন্তু ফটোশপ তো এতটা নিখুঁত হতে পারে না। দেখো কেমন ঘোলাটে একটা ভাব, আসল ছবির ক্ষেত্রেই তো হয় এমনটা।”
সীমা ছবিগুলো গভীর পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, “মাথায় ঢুকছে না কিছু!”
“আচ্ছা ছবির ক্ষেত্রে না হয় বলবে ফটোশপ করা। কিন্তু কল রেকর্ডিং? তার বেলায় কী বলবে? আরশাদ হকের ভয়েস নকল করে কেউ কথা বলেছে?”
“আছে না ওটা ফেসবুকে? শোনান তো!”
নিউজফিড সামান্য ক্রল করতেই পাওয়া গেল সেই কল রেকর্ডিং। আরশাদ সুজানাকে দেখা করার জন্যে জোরাজুরি করছে আর সুজানা বারবার মানা করছে।
সীমা এনায়েতের মোবাইলের স্পিকার কানের কাছে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে সেই কল রেকর্ডিং। এনায়েত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সে নিশ্চিত, সীমা কথাগুলো শোনার জন্যে এতটা মনোযোগ প্রয়োগ করছে না। তার মনোযোগ অন্য দিকে।
এনায়েতের ধারণাটাই সঠিক। কল রেকর্ডিংয়ে আরশাদ বা সুজানা কী বলছে তার কানে ঢুকছে না। তার তীক্ষ্ণ শ্রবণ শক্তি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত আরশাদের কণ্ঠস্বর।
কয়েক সেকেন্ড পরই চমকে উঠে বলল, “হায় খোদা!”
এনায়েত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী হলো?”
সীমা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হো হো করে হাসতে শুরু করলো। তার হাসিতে যেমন রয়েছে বিজয়ের আনন্দ, তেমনই হয়েছে তীব্র রাগ।
এনায়েত অবাক গলায় বলল, “হাসছো কেন পাগলের মতো?”
সীমা হাসি না থামিয়েই বলল, “কারণ আমি পাগল। পাগলকে বিয়ে করেছেন আপনি।”
সীমার পাগলামি এখন গা সয়ে গেছে এনায়েতের। তাই পাগলামিকে বেশি একটা পাত্তা না দিয়ে বলল, “হেঁয়ালি না করে বলো তো সীমা।”
সীমা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “নাহ্! আমার নিজের ফোনের কাছে যেতেই হচ্ছে। আসুন আপনাকে মজা দেখাই।”
সীমা আর এনায়েত তাদের শোবার ঘরে এসে বসলো। বিছানার এক কোণে বসে সীমা বেডসাইড টেবিল থেকে চার্জে রাখা মোবাইলটা তুলে নিলো। এনায়েত তার মুখোমুখি বসে আগ্রহ এবং কৌতুহল নিয়ে দেখছে তার কর্মকান্ড।
সীমা ব্রাউজারে ঢুকে কী একটা ওয়েবসাইট খুঁজে বের করলো। সেখানে সাইন আপ করতে
লাগলো আরও কয়েক মিনিট।
এরপর মোবাইলটা এনায়েতের হাতে দিয়ে বলল, “এখানে যে লেখাটা এসেছে, হুবহু সেটা বলবেন। খবরদার একটা শব্দও এদিক-ওদিক করবেন না!”
এনায়েত দেখলো সীমার মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে কতগুলো ইংরেজি শব্দ। এনায়েত বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! আমাকে কথা বলতে হবে কেন?”
সীমা মজার ছলে বলল, “ওই সুজানা যেভাবে আরশাদ ভাইয়াকে ফাঁসিয়েছে, আমিও সেভাবে ফাঁসাবো আপনাকে।”
এনায়েত হতাশার সুরে বলল, “সেটাই বাকি আছে।”
সীমা হেসে ফেলে বলল, “বলুন না বাবা! মাইক আইকনের ওপর চাপ দিলে আপনার ভয়েস রেকর্ড করা শুরু করবে।”
এনায়েত সীমার কথা মতো স্ক্রীনের ডানপাশে ভেসে ওঠা ছোট্ট মাইক আইকনে চাপ দিয়ে লেখাগুলো পড়তে শুরু করলো, “The mechanic worked skillfully under the hood of the classic car, bringing back the roar of an engine once silent.”
সীমা একপ্রকার কেড়ে তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে গেল। উৎসাহ-উত্তেজনায় ঘুম সেই কখন উড়ে গেছে তার। নিজেকে গোয়েন্দা গোয়েন্দা বলে মনে হচ্ছে।
সীমা বলল, “আপনার ভয়েসটা এখানে সেভ হয়ে গেল কিন্তু!”
এনায়েত দেখলো, সীমা আরও কতগুলো বাটনে চাপ দিয়ে কী সব করলো। এরপর নতুন একটা স্ক্রিন এলো তাদের সামনে। স্ক্রিনের ওপরেই বড় একটা খালি বাক্স।
সীমা আগ্রহ নিয়ে বলল, “এবার দেখুন, আমাকে এখানে কিছু একটা লিখতে হবে।”
সীমা ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করলো – My name is Enayet.
কয়েক সেকেন্ড পরই মোবাইলের ভেতর থেকে এই লেখাটাই অডিও আকারে ভেসে এলো, “My name is Enayet.” তবে অবিকল এনায়েতের কণ্ঠস্বরে।
এনায়েত অবাক দৃষ্টিতে একবার মোবাইলের দিকে, একবার সীমার দিকে তাকালো।
সীমা আবারও কী যেন লিখলো। আবারও মোবাইলের ভেতর থেকে ভেসে এলো হুবহু এমায়েতের কণ্ঠে, “I once lived in Singapore, now I’m a full fledged Bangladeshi!”
দুজনে একে অপরের সঙ্গে বিস্মিত দৃষ্টির আদান-প্রদান করছে। যে কথা এনায়েত বলল না, সেই কথা কী করে বেরিয়ে এলো মোবাইল থেকে?
সীমা বিজয়ীর হাসি হেসে বলল, “কত বড় বাটপার!”
এনায়েত বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “এটা কী করে সম্ভব?”
“এ আই!”
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে কিছুদিন আগেই একটা প্রতিবেদন দেখেছিল এনায়েত। তখন ব্যাপারটাকে এতটা সাংঘাতিক বলে মনে হয়নি। আজ হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়ে মনে হচ্ছে।
সীমা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “কী ভয়ঙ্কর যুগে বাস করি আমরা চিন্তা করুন। আপনার একটা ভয়েস নোট কারও কাছে থাকলেই সে আপনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখে।”
“কিন্তু এখানে তো শুধু ইংলিশে ভয়েস জেনারেট করে। আর ওই কলরেকর্ডিংয়ে আরশাদ হকের ভয়েস কথা বলেছে বাংলায়।”
সীমা স্ক্রিনের কোণায় একটা আইকন দেখিয়ে বলল, “এই দেখুন না, প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন নিলেই যেকোনো ভাষায় ভয়েস জেনারেট করে দেবে। ওই মেয়েটা নিশ্চয়ই সেটাই করেছিল। আমি তো আপনার ভয়েস রেকর্ড করলাম। রেকর্ড না করেও, ডাউনলোড করা অডিও ক্লিপ দিয়ে এ আই ভয়েস বানানো যায়।”
এনায়েত হতবম্ব হয়ে বলল, “কী সাংঘাতিক! এই এ আইয়ের কারণে সাধারণ মানুষের থেকেও তো সেলিব্রিটিরা বেশি বিপদে। কারণ তাদের হাজারটা অডিও ক্লিপ ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“সেটাই তো!”
সীমা শতভাগ নিশ্চিত ওই কল রেকর্ডিংয়ে আরশাদের ভয়েস এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। আরশাদের যেকোনো একটা সিনেমা বা ইন্টারভিউ থেকেই তার কণ্ঠস্বর নেওয়া যায়। সেটা এখানে সেভ করেই করা হয়েছে কাজটা।
এনায়েত কী যেন ভেবে বলল, “আচ্ছা সীমা! তার মানে তো ওই ছবিগুলোও এ আই দিয়ে তৈরি করা।”
সীমার মাথায় তড়িৎ গতিতে কী যেন খেলে গেল। অতিরিক্ত উৎসাহে বিছানা ছেড়ে কম্পিউটারের কাছে গিয়ে বসলো সীমা। এনায়েত তার পাশের চেয়ার টেনে বসলো।
উত্তেজনায় ছটফট করছে সীমা। তার অবস্থা হয়েছে চোর ধরার আগ মুহূর্তে পুলিশের মনের অবস্থার মতো। মনে মনে আনন্দের ছড়াছড়ি, আবার কিঞ্চিৎ ভয়। যদি চোর ছুটে পালিয়ে যায়? যদি কোনো ভুল হয়ে যায়।
কম্পিউটার অন হতেই আরেকটা এ আই ওয়েবসাইট বের করলো সীমা। ফ্রিল্যান্সার হওয়ার সুবাদে এই ওয়েবসাইটগুলো বেশ ভালো করেই চেনা তার।
সীমা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“এ আইকে, এ আই দিয়েই কাটবো!”
এনায়েত চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কী করবে তুমি?”
“সবার আগে ব্লার দূর করবো। যাতে মেয়েটার মুখটা পরিষ্কার দেখা যায়।”
“সেটাও সম্ভব?”
“এ আইয়ের যুগে এখন সব সম্ভব!”
সীমা ফেসবুক থেকে ওই ছবিগুলো ডাউনলোড করে নিলো। এ আই ওয়েবসাইটে মিনিট খানেক বিচরণ করতেই দূর হয়ে গেল ছবিতে উপস্থিত মেয়েটার ওপরের ঘোলাটে স্তর। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সুজানার মুখ।
সীমা আবারও বিজয়ীর হাসি হেসে বলল, “এই দেখুন!”
সীমার পারদর্শিতায় গর্বিত না হয়ে পারলো না এনায়েত। তবে সমস্যার সামধান এখনো হয়নি। এ আই ব্যবহার করে একটা মানুষের শরীরে আরেকটা মানুষের মুখ বসানো যায় ঠিকই, তবে মুখ সরানো মুশকিল।
দুজনেই চিন্তায় পড়ে গেল কী করে প্রকৃত ছবিগুলো বের করবে। ছবিগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন দুজনেই।
এনায়েত হঠাৎ বলে উঠলো,“আমার কী মনে হচ্ছে জানো সীমা?”
“কী?”
“এই তিনটা ছবিই কোনো একটা ভিডিওর অংশ। ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়ে আলাদা করা হয়েছে।”
সীমা চমকে উঠে ভালো করে তাকালো ছবিগুলোর দিকে। আসলেই তো! ভিডিওর অংশ হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তিনটা ছবিই একই অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা। মেয়েটার হাতে ক্যামেরা। হতে পারে সে সেলফি ভিডিও করেছে।
সীমা ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, “এনায়েত!”
“কী?”
“আপনি জিনিয়াস!”
এনায়েত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সীমার দিকে। জিনিয়াসের মতো কী করলো সে?
সীমা হাস্যোজ্বল কণ্ঠে বলল, “ডিপফেক!”
“ডিপফেক? এটার নাম তো শুনেছিলাম কিছু দিন আগে। নায়িকাদের কী সব আজেবাজে ভিডিও তৈরি করা হয় এটা দিয়ে!”
“ঠিকই শুনেছেন। ডিপফেক হলো ভিডিওর ফটোশপ। একটা ভিডিওতে যেকোনো মানুষের শরীরে যেকোনো মানুষের মুখ বসানো যায় এর মাধ্যমে।”
“এটা যদি ডিপফেক হয়ে থাকে, তাহলে তো আসল ভিডিওটা খুঁজে বের করতে হবে!”
সীমা দাঁতে দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল, “সেটা কী করে বের করি!”
এনায়েত সীমার দাঁতের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “এ আই দিয়ে করা যাবে না?”
সীমা থমথমে গলায় বলল, “এ আই কি আমার দুলাভাই লাগে? যে শালিকা শালিকা বলে আমার সব আবদার পূরণ করবে?”
সীমার রসিকতায় কর্ণপাত না করে এনায়েত বলল, “এমনও তো হতে পারে আসল ভিডিওটা ইন্টারনেটের কোথাও নেই!”
সীমা চোখমুখ অন্ধকার করে বলল, “তাহলে তো সর্বনাশ!”
এনায়েতের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো। মোবাইলটা বের করে ফেসবুকে ঢুকলো সে। আরশাদের একটা ফ্যান গ্রুপে জয়েন করে পোস্টের মাধ্যমে জানিয়ে দিলো ওই কল রেকর্ডিংটা এ আই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলো ব্লারহীন ছবি। জানালো, ছবিগুলোও নকল। হতে পারে কোনো ভিডিওর অংশ। তাই সে আরশাদের ভক্তকূলকে অনুরোধ করলো, ভালো করে ওই ছবিতে থাকা নর-নারীর পোশাক-আশাক, বিছানার চাদর, ঘর খেয়াল করতে। এবং এর সঙ্গে মিল রয়েছে এমন কোনো ভিডিও ইন্টারনেটে খুঁজে বের করতে।
এই একটা ঘটনায় আরশাদের সমস্ত ভক্তকূল তার বিপক্ষে চলে যায়নি। প্রকৃত ভক্তরা এখনো আগের মতোই রয়েছে আরশাদের পাশে। এই সাত-সকালেও পোস্টটা পেয়ে পাগল হয়ে গেল তারা। নকল কল রেকর্ডিংয়ের তথ্য পেতেই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে গেল তাদের মাঝে।
তবে আনন্দ যাপন স্থগিত রেখে তারা ব্যস্ত হয়ে গেল আসল ভিডিওটা খুঁজতে। ঘন্টাখানেকের মাঝেই এক ভক্তের ম্যাসেজ এলো এনায়েতের কাছে।
সেই ভিডিওতে অবিকল ওই ছবিগুলোর মতো পোশাক পরে আছে দুজনে। অবিকল সেই বিছানার চাদর। তিন মিনিটের লম্বা সেই ভিডিওতে রয়েছে দুজন ভিনদেশী তরুণ-তরুণী।
ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ভিডিওতে ওই দুই তরুণ-তরুণীর মুখের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আরশাদ এবং সুজানার মুখ। এরপর ভিডিওর বিভিন্ন অংশ থেকে স্ক্রিনশট দিয়ে আলাদ করা হয়েছে ফেসবুকে ঘুরতে থাকা ওই তিনটি ছবি।
ভিডিওটা হাতে পেয়েই দানবীয় হাসি হেসে উঠে সীমা বলল, “বাটপারের দশদিন, সীমার দশ সেকেন্ড!”
পিএইচডির থিসিস লেখার মতো লম্বা একটা স্ট্যাটাস দিলো সীমা। পুরোটাই ইংরেজিতে। স্ট্যাটাসে সে তুলে ধরেছে গত দুই ঘন্টা যাবত তার খুঁজে পাওয়া সমস্ত তথ্য। নকল কল রেকর্ডিং, নকল ছবি। ছবিগুলো সুজানা কীভাবে তৈরি করেছে – সব! সেই সঙ্গে সীমা জুড়ে দিয়েছে আসল ওই ভিডিওটা।
সীমার প্রোফাইলে বন্ধু সংখ্যা মাত্র বাহাত্তরজন। তবুও মনে হয় প্রায় সকলেই শেয়ার করে ফেলল পোস্টটা। মিনিট দশেকের মধ্যেই একশটা রিয়্যাক্ট। তবে এত কম রিয়্যাক্ট দিয়ে কিছুই হবে। তার এই পোস্টটা ইন্টারনেটে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে হবে।
অরা যে ঘরে ঘুমিয়ে রয়েছে সেই ঘরে ধীর পা ফেলে প্রবেশ করলো সীমা। বেঘোরে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়ে আছে অরা। সীমা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোকা মেয়েটাই জানলোই না এদিকে এত কান্ড ঘটে গেছে। কোন মুখে অরা আরশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই শুধু দেখার অপেক্ষায় সীমা।
অরার সবকিছুকেই সীমার নিজস্ব সম্পত্তি। তাই তার মোবাইল ধরার আগে অনুমতির ধার ধারলো না। অরার মোবাইলে স্ক্রিনলক থাকে না। তাই সহজেই কললিস্ট থেকে খুঁজে বের করলো কে ফিল্মসের পি আর টিমের হেড খালেদকে।
এই লোকটাকে সীমা চেনে না। চেনার কোনো প্রয়োজনও এই মুহূর্তে নেই। তবে অরার মুখে শুনেছিল, এই লোকটাই কে ফিল্মসের প্রচার সংক্রান্ত দিকটার দেখাশোনা করে।
সীমা তাকে ফোন করে জানালো তাই পোস্টটা মানুষের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি। ব্যস, এতেই কাজ হয়ে গেল! এক ঘন্টার ব্যবধানে ভাইরাল হয়ে গেল সীমার পোস্ট। এমনকি নিউজ চ্যানেলেও দেখানো হচ্ছে সেটা। পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি রিয়্যাক্ট পড়ে গেল আরও এক ঘন্টার মাঝে।
রাতটা নির্ঘুম কাটিয়ে, সকাল আটটা অব্দি জেগে থাকা সার্থক হলো সীমার। যে মানুষগুলো আরশাদকে বয়কটের ডাক দিচ্ছিল, তারা এখন রূপ বদলে আবারও হয়ে গেল তার জন্মান্তরের ভক্ত!
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৬০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সাফল্য, সে বড়ই অদ্ভুত। প্রত্যেকটা মানুষের অবচেতন মনে পাকাপোক্তভাবে বিরাজমান থাকে। জেনেবুঝেই হোক কিংবা মনের অজান্তে মানুষ তার সারাটাজীবন কাটিয়ে দেয় সাফল্য নামক এই প্রবল আরাধ্য জিনিসটির পেছনে ছুটতে ছুটতে। সাফল্যকে হাতের মুঠোয় পেলেও যে সে ক্ষান্ত হয়, তা নয়। সাফল্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়। আরও তীব্রতর সাফল্য পাওয়ার জন্যে মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
আরশাদ তার ব্যতিক্রম নয়। খুব কম বয়স থেকেই সফল হওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল সে মনের মাঝে। তার বাবা তাদের পুরো পরিবারটাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আরশাদ বুঝে যায়, পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব একদিন তাকেই নিতে হবে। দায়িত্ব ছাড়াও, কিছু একটা করে দেখানোর জেদ তাকে ঝেঁকে ধরে। মনে মনে স্বপ্ন দেখে একদিন এতটা সফল হবে যে আশেপাশের মানুষেরা তাকে নিয়ে ঈর্ষায় জ্বলে ছাই হবে।
আরশাদ কখনো বিখ্যাত হতে চায়নি এটা ঠিক। তবে অভিনয়ের প্রতি তার ভালোবাসাই তার জন্যে খুলে দেয় সাফল্যের দ্বার। আরশাদ তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘আষাঢ়ে’ দিয়ে জায়গা করে নেয় ভক্তদের হৃদয়ে। বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির তখন বেহাল দশা। সস্তা গল্পের অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ সব সিনেমা হল ভরিয়ে রাখতো। ফলে দেশের বৃহত্তর জনগণ হয়ে গেল হল বিমুখ।
খরায় ফাটা মাটিতে একদিন্দু বৃষ্টির জলের মতো ‘আষাঢ়ে’ ইন্ডাস্ট্রির বুকে প্রাণ ফিরিয়ে আনলো। আবারও মানসম্মত সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শক আবারও ফিরলো সিনেমা হলে।
এই ইন্ডাস্ট্রিতে আরশাদের অবদান অনেক। ‘আষাঢ়ে’ মুক্তি পাওয়ার পর ওই নতুন নায়কটা মানুষের প্রিয় হয়ে উঠলো। এমন কিছু দর্শক তৈরি হয়ে গেল যারা সিনেমা হলে যায়ই কেবল আরশাদের সিনেমা দেখতে। বছরে তার যে কটা সিনেমা মুক্তি পাবে, তারা শুধুমাত্র সে কটাই দেখবে।
ততদিনে আরশাদ হক নামটার আগে যুক্ত হয়েছে নতুন একটা শব্দ, সুপারস্টার! সেলিব্রিটি তো গিজগিজ করছে ইন্ডাস্ট্রিতে। কোনো অভিনেতা একটা সিনেমায় অভিনয় করে, সেই সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও – তাকে ডাকা হয় সেলিব্রিটি। তবে সুপারস্টার শব্দটার যেন আলাদা একটা মাহাত্ম্য আছে। ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘ অনেকটা সময় সুপারস্টারের অভাবে ভুগছিল। আরশাদের আগমন যেন নিমিষেই সেই অভাব পূরণ করে দিলো।
এমনই একটা সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে সিনেব্লাস্ট মিডিয়া নামক একটি প্রোডাকশন হাউজের। তারা মানসম্মত সিনেমা নির্মাণে বদ্ধ পরিকর। সিনেব্লাস্টের কর্ণধার শাফকাত আলম তার হাজারটা ব্যবসার মাঝে নতুন করে শুরু করলো সিনেমার ব্যবসায়।
আরশাদের সঙ্গে সিনেব্লাস্টের পথ চলা ‘আয়না’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমাটার মাধ্যমেই দর্শক পরিচিত হয় তাদের তৎকালীন প্রিয় জুটি আরশাদ-নওশীনের সঙ্গে। সিনেমা ব্যাপক ব্যবসা-সফল তো হয়ই, সেই সঙ্গে চারদিকে প্রংশায় ভাসতে থাকে।
নওশীন তখন একেবারেই নতুন। সিনেমার সাফল্যের পুরো কৃতিত্বটাই দেওয়া হয় সুপারস্টার আরশাদ হককে। যদিও সে বরাবরের মতোই সাফল্যের কৃতিত্ব পুরো টিমকেই দেয়।
‘আয়না’র মধ্য দিয়ে আরশাদের খ্যাতি আরও বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন হলে চলেছিল সিনেমাটি। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলেও সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। বিদেশি বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালেও প্রদর্শিত হয় ‘আয়না’।
আরশাদের যেমন লাভ হয়েছিল, লাভটা শাফকাতেরও নেহায়েত কম হয়নি। সিনেমার ব্যবসায় যে এতটা লাভজনক এই সিনেমার মাধ্যমেই জানতে পারে না। আগে সিনেব্লাস্টকে এতটা মনোযোগ না দিলেও, ধীরে ধীরে সিনেমার ব্যবসায়ে তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানেরও সুনামও ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। শুধুমাত্র একটা সিনেমা দিয়েই সিনেব্লাস্ট মিডিয়া হয়ে যায় দেশের প্রথম সারির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।
আরশাদ এবং শাফকাত প্রায় সমবয়সী হওয়ায় অদৃশ্য একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয় তাদের মাঝে। সাধারণত নায়ক এবং প্রযোজকদের মধ্যে যে গম্ভীর ধরনের একটা সম্পর্ক থাকে, তাদের মাঝে সেটা ছিল না। তাদের আলোচনার মূল বিষয়-বস্তুই ছিল সিনেমা। আরশাদ শাফকাতকে পরামর্শ দেয় কী করে ব্যবসার বিস্তৃতি সৃষ্টি করা যায়। ওদিকে শাফকাত তাকে পরামর্শ দেয় কোন ধরনের সিনেমায় তার অভিনয় করা উচিত।
সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার ব্যানারে বছরে অন্তত একটা সিনেমায় আরশাদ অভিনয় করবেই। এটা যেন অলিখিত নিয়ম। আরশাদ এবং সিনেব্লাস্ট এই দুইয়ের সংমিশ্রণ কখনোই খারাপ হতে পারে না, দর্শকরাও ততদিনে বুঝে ফেলল।
তবে অন্যান্য প্রযোজকদের সিনেমাতেও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল আরশাদ। একেবারে সিনেব্লাস্ট নির্ভর হয়ে ওঠেনি সে। তবে সিনেব্লাস্ট ঠিকই একটু একটু করে আরশাদ নির্ভর হয়ে উঠতে শুরু করলো ক্রমেই। বছরে আরশাদকে নিয়ে যে একটা সিনেমা তারা নির্মাণ করে, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ব্লকবাস্টার। তবে বাকিগুলোর নাম হিটের খাতাও ওঠে না।
শাফকাতের আকাঙ্ক্ষা তাই বেড়ে গেল। আরশাদকে তাই বেশি বেশি সিনেমার প্রস্তাব দিতে লাগলো সে। অতিরিক্ত মাখামাখি কোনো কালেই আরশাদের পছন্দ নয়। তবুও সিনেব্লাস্টের ব্যানারে এক বছরে সর্বোচ্চ তিনটি সিনেমায় অভিনয় করেছে সে।
শাফকাত চাইতো আরশাদ যেন কেবল তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমাতেই অভিনয় করে। আরশাদ সেটা চায়নি। ইন্ডাস্ট্রিতে সকেলর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রাখাটা জরুরি। তাছাড়া সিনেব্লাস্টের পাঠানো গল্পগুলোও তার পছন্দ হচ্ছিল না। এই নিয়ে হয়তো ক্ষীণ মনোমালিন্য ভুগছিল শাফকাত।
শেষমেশ ঝামেলা বেঁধেই যায়, যখন আরশাদ ওই যৌথ-প্রযোজনার ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চুক্তি বাতিল করে। স্ক্রিপ্ট না পড়ে, রীতিমত শাফকাতের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে একদিনের মাথায় ওই সিনেমায় সাইন করেছিল আরশাদ। পরবর্তীতে স্ক্রিপ্ট পড়ে জানতে পারে, সিনেমায় বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হবে।
পাঠ্যবইয়ের পাতার মতো উদার দেশপ্রেমিক আরশাদ নয়। তবে তার কাঁধে ভারী একটা দায়িত্ব রয়েছে। কোটি মানুষের বিনোদনের জন্যে কাজ করে সে। দেশের বাইরেও মানুষ দেখে তার সিনেমা। সে নিজেই নিজের দেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে কী করে? আরশাদ স্ক্রিপ্ট পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনেব্লাস্টের অফিসে গিয়ে চুক্তি বাতিল করে দিয়ে আসে।
সিনেমাটা ছিল দুই দেশের যৌথ-প্রযোজনার। অর্থাৎ শাফকাতের বাইরেও বিদেশী একজন প্রযোজক রয়েছে। শাফকাত তাকে কথা দিয়েছিল, বাংলাদের একমাত্র সুপারস্টার আরশাদ হক থাকবে এই সিনেমায়। আরশাদ যেহেতু চুক্তি বাতিল করে দিলো, সুতরাং সিনেমার প্রযোজনা থেকেও সরে দাঁড়ালো ওই বিদেশী প্রযোজক।
রাগে ফেটে পড়লো শাফকাত আলম। এই সিনেমাটা তৈরি হলে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তো সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সুখ্যাতি। সেই সঙ্গে আয়ের খাতাও হয়ে উঠলো ভারী। তার সাজানো পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো আরশাদ।
সেদিন শাফকাত আরশাদকে ফোন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কাজটা ভালো করলে না আরশাদ। ভুলে যেওনা তোমাকে সুপারস্টার কে বানিয়েছে? এত ওপরে উঠেছো আমার সিনেব্লাস্টের কারণেই!”
আরশাদ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সেও তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল, “শাফকাত, যতদিনে তুমি এই ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা বুঝতে শিখেছো ততদিনে আমি এখানকার পাকা খেলোয়াড়। তুমি না থাকলেও আমার কিছুই যায় আসতো না। টাকার নেশায় তুমি নিচে নামতে পারলেও আমি পারবো না।”
এই তিক্ততা থেকেই দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি টানা তাদের। আরশাদ সিদ্ধান্ত নেয় সিনেব্লাস্টের সিনেমায় সে আর অভিনয় করবে না। আরশাদ অন্যান্য যে প্রযোজকদের সিনেমায় অভিনয় করে, সেগুলো বরাবরের মতোই সাফল্যের মুখ দেখে। তবে সিনেব্লাস্ট যেন হারিয়ে যায় ধূসর অন্ধকারের আড়ালে।
যে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান এক কালে ছিল সবার শীর্ষে, তারাই এখন বছরে তিন-চারটার বেশি সিনেমা তৈরি করছে না।
সিনেমার ব্যবসায় নিয়ে ততদিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শাফকাত। অন্যান্য ব্যবসায়ে মনোযোগ সরিয়ে ফেলে। তবে রাগে-ক্ষোভে রীতিমত ফুঁসে ওঠে যখন জানতে পারে আরশাদ নতুনভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখতে যাচ্ছে, প্রযোজক হিসেবে।
ভেবেছিল শখের বসে দুয়েকটা সিনেমা প্রযোজনা করবে আরশাদ। কিন্তু না, সে তো পুরোদস্তর কোম্পানি খুলে বসলো! শুধু তাই নয়, আরশাদের কে ফিল্মস তড়িৎ গতিতে বসে গেল সকল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে। কে ফিল্মসের সিনেমা নিয়ে দর্শকের মাঝে বিচিত্র আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে এই প্রথম কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দর্শকের আগ্রহ পাচ্ছে।
রাগে ফুলে-ফেঁপে উঠলো শাফকাত। তার ব্যবসায়ে আগুন ধরিয়ে আরশাদ হক নিজে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে! যেদিন থেকে কে ফিল্মসের আবির্ভাব সেদিন থেকেই আরশাদের ক্যারিয়ার ধ্বংসের পরিকল্পনার ছক কষতে শুরু করে সে। যেকোনো মূল্যেই হোক, আরশাদকে জনতার কাছে অপদস্ত করতে হবে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সুনাম অচিরেই ভেঙে চুরমার করতে হবে। এতসবের পেছনে অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। সেই কারণটা আরশাদের জানা নেই।
ড্রাইভিং সিটে বসে সিগারেট টানছে আরশাদ। অতিরিক্ত রাগে এই জিনিস ছাড়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই অসম্ভব। আরশাদের পেছনের গাড়িতে বসে আছে ঝড়। তুফানকে সে পাঠিয়েছে অন্য একটা কাজে। ওদিকে সুজানা আর মাহমুদের খাতির-যত্নের দায়িত্ব দিয়ে আসা হয়েছে কে ফিল্মসের অফিসের সবথেকে কড়া সিকিউরিটি গার্ড মোখলেসকে।
আরশাদের বিখ্যাত গাঢ় সবুজ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ‘গলফার্স প্যারাডাইস’র সামনে। উচ্চবিত্তদের জন্যে বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে গলফ কোর্স, নাম দেওয়া হয়েছে ‘গলফার্স প্যারাডাইস’। এখানে যে কেউ চাইলে এসে গলফ খেলতে পারে না। তাকে গুনতে হয়, মোটা অংকের মেম্বারশিপ ফি।
শাফকাত বহু বছর থেকে ‘গলফার্স প্যারাডাইস’র সদস্য। প্রতি শনিবার সকালে নিয়ম করে গলফ খেলতে আসে সে। আরশাদের সেই তথ্য বেশ ভালো করেই জানা। শাফকাতের মুখোমুখি হবে বলে যে চলে এসেছে এখানে।
সিগারেটটা শেষ করেই আরশাদের গাড়ি প্রবেশ করলো ‘গলফার্স প্যারাডাইস’র ভেতরে। ঝড়ের গাড়িটা এলো তার পেছনে পেছন। শাফকাত প্রাইভেট ভিআইপি এরিয়ায় গলফ খেলে। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে পায়ে হেঁটেই সেদিকে গেল আরশাদ।
শাফকাত নিঃসন্দেহে খবর পেয়ে গেছে কে দেখা করতে এসেছে তার সঙ্গে। সেজন্যে তার ভিআইপি এরিয়ার বাইরে স্ক্যানার হাতে নিজের বডিগার্ডকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। শাফকাত যথেষ্ট বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই এতক্ষণে আঁচ করে ফেলছে তার কুকীর্তি ধরা পড়ে গেছে আরশাদের কাছে। সেজন্যেই এই বাড়তি সতর্কতা।
শাফকাতের বিরুদ্ধে প্রকৃত কোনো প্রমাণ নেই আরশাদের কাছে। সুজানা আর মাহমুদের মুখের কথা তো আর যথেষ্ট নয়। শাফকাত হয়তো ভাবছে, প্রমাণ জোগাড়ের উদ্দেশ্যে রেকর্ডিং ডিভাইজ লুকিয়ে নিয়ে এসেছে আরশাদ। যেটা দিয়ে তাদের কথোপকথন রেকর্ড করে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করবে আরশাদ। ক্ষীণ হাসি বজায় রেখেই এগিয়ে গেল আরশাদ। শাফকাতের বডিগার্ডকে চেকিংয়ে কোনপ্রকার বাঁধা দিলো না।
চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি, আকাশটাও আজ স্পষ্ট নীল, মাথার ওপরে মিষ্টি রোদ। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই সাদা একটা পতাকার কাছে গলফস্টিক হাতে শাফকাত চোখে পড়লো। পরনে সাদা পোলা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার। এখনো একই রকম আছে শাফকাত। ছয় ফুট লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সুদর্শন এই মানুষটার সঙ্গে আগে প্রায়ই নায়িকারা ফ্লার্ট করে বলতো, “আপনি সিনেমায় নাম লেখাচ্ছেন না কেন বলুন তো?”
সূর্যের আলো সরাসরি এসে পড়ছে শাফকাতের মুখের ওপরে। সানগ্লাস থাকার কারণে তার চোখদুটো ঢাকা পড়ে গেছে।
আরশাদকে দেখতেই সূক্ষ্ম হাসি হেসে এগিয়ে এলো শাফকাত।
হাসিটা বজায় রেখেই একটা হাত আরশাদের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আরশাদ হক! কত দিন পর! কী খবর?”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে তার হাতটা নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। তবে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “অবশ্য তোমার খবর জানার জন্য একজন টিভির পর্দাই যথেষ্ট।”
এবারও উত্তর দিলো না আরশাদ। এমনটা নয় যে উত্তর দেবার কোনো ভাষা তার নেই, তবে উত্তর দেওয়ার জন্যে ভাষা নয়। অন্য পদ্ধতির প্রয়োগ করবে সে।
শাফকাত সৌজন্যের ভঙ্গিতে তাকে নিয়ে গেলো কিছুটা দূরে মুখোমুখি থাকা দুটো সাদা চেয়ারের কাছে। দুটো চেয়ারের মাঝে একটা গোলাকার কাঁচের টেবিল। আরশাদ গিয়ে বসলো একটা চেয়ারে, শাফকাত তার বিপরীতে। কিছুটা দূরেই দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ঝড়।
শাফকাত চোখের ওপর থেকে সানগ্লাসটা সরিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল, “বলো, কীভাবে সাহায্য করতে পারি তোমাকে?”
আরশাদ এবার সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “কী করে মনে হলো সাহায্য চাইতে এসেছি তোমার কাছে?”
শাফকাত মেকি আফসোস করে বলল, “বলা তো যায় না। দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না তোমার। অবশ্যখারাপই লাগে তোমার জন্য। এত সুখ্যাতি, এত সুনাম – একদিনের মাথায় সব পানিতে? তাও আবার সামান্য একটা মেয়ের জন্য?”
আরশাদ ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার খারাপ লাগে তোমার জন্য। ইন্ডাস্ট্রির এক সময়কার টপ প্রোডিউসার! তোমার অফিসে সেলিব্রিটিরা গিজগিজ করতো সারাদিন। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ায় রীতিমত ব্লাস্ট লেগেছে।”
অপমানে রীতিমত দমে গেল শাফকাত। ভুল তো কিছু বলেনি আরশাদ। সিনেব্লাস্ট মিডিয়া, তার একসময়কার সবথেকে সফল ব্যবসায় আজ প্রায় ডুবতে বসেছে।
আরশাদ হালকা মেজাজে বলল, “শুনেছি ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের বিজনেসে ধরা খেয়েছো, সিনেমার বিজনেসটাও ডুবেছে সেই কবে। নাহ্! খারাপই লাগে তোমার জন্য।”
শাফকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজের কথা ভাবো। আপাতত তোমাকে সেটাতেই মানাবে।”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি তো সারাক্ষণ নিজের কথাই ভাবি। তুমি যাতে ভাবতে শুরু করো, সেই ব্যবস্থা করতে এসেছি।”
শাফকাত বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মানে?”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এক কথা বারবার এক্সপ্লেন করতে ভালো লাগে না। বুঝে নাও।”
আরশাদের এই বাঁকা হাসি একদমই সহ্য হলো না শাফকাতের।
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তুমি যে কতটা নোংরা আমি সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম। টাকার জন্যে বিদেশি প্রোডিউসারদের কাছে দেশের সুনাম বিক্রি করতেও তোমার রুচিতে বাঁধেনি।”
শাফকাত কোনপ্রকার ভনিতা না করে বলল, “ভালোমানুষি দিয়ে বিজনেস হয় না আরশাদ। আর এই পৃথিবীতে টিকে থাকার একমাত্র উপায় বিজনেস।”
“বিজনেস যেন তুমি একাই করো!”
আরশাদের এই তীক্ষ্ণ কটাক্ষ গায়ে না মেখে পারলো না শাফকাত। অভিনেতা আরশাদ ক্রমেই ব্যবসায়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এই সত্য তাকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
শাফকাত অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এটা আমার ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রিকে যদি আজ দেশের বাইরে কেউ চিনে থাকে সেটা আমার কারণে। আমি যতগুলো সিনেমা প্রডিউস করেছি, ততগুলো সিনেমা প্রডিউস করা কারো সাধ্যের বাইরে।”
শাফকাতের মাঝে সত্য লুকাবার কোনো প্রচেষ্টা নেই। সে যেন বরং চাইছে আরশাদ জানুক, তার এমন কাজের পেছনের প্রকৃত কারণটা কী।
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “বড় বড় কথায় কোনো লাভ তো হচ্ছে না। সেই জায়গাটা ইতোমধ্যেই অন্য কারো দখলে।”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “আরেকজনের জায়গা দখলে নিয়ে খুব গর্ব হয় না তোমার? নিজের জায়গা নিজে তৈরি করলেও একটা কথা ছিল।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এতই যখন বিজনেস বোঝো, নিজেকে বিজনেসম্যান বলে দাবি করো – তখন দিতে টক্কর! সেই চেষ্টা পর্যন্ত করলে না। ক্লাসের টপার একবার পরীক্ষায় খারাপ করলে, আরও বেশি পরিশ্রম করে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য। নকল করে না। অন্তত তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।”
শাফকাত স্পষ্ট বুঝতে পারছে কোন দিকে ইঙ্গিত করছে আরশাদ। তার মাঝে কোনো অপরাধবোধ দেখা গেল না। আরশাদকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল শাফকাতের একমাত্র লক্ষ্য। যাতে সুপারস্টারের খ্যাতি মিশে যায় মাটির সঙ্গে। যাতে সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে না পারে আরশাদ।
শাফকাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “You deserved it.”
আরশাদ মেকি বিস্ময় নিয়ে বলল, “Did I?”
“হুঁ। এই জীবনে আমি যা যা চেয়েছি, তার সব তুমি পেয়েছো। পেয়েছো বললে ভুল হবে, আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছো।”
আরশাদ খানিক বিস্ময় এবং বিভ্রান্তিমাখা চোখে তাকালো শাফকাতের দিকে। ছিনিয়ে নিয়ে গেছে কী? প্রোডাকশন হাউজের সাফল্য? আরশাদ তো কে ফিল্মসের মাধ্যমে কারও অবস্থান ছিনিয়ে নেয়নি। বরং ইন্ডাস্ট্রিতে নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাহলে কীসের কথা বলছে শাফকাত?
শাফকাত কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলতে শুরু করলো, “মেয়েদের প্রতি আমার বাড়তি কোনো ইন্টারেস্ট নেই। একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলাম। প্রাইভেট জেটে প্রপোজ করেছিলাম। দুবাই থেকে আনা এক্সপেন্সিভ আংটি দিয়ে। আর সে কিনা বলে তোমাকে ভালোবাসে! তোমাকে!”
ভ্রু ওপরে তুলে তাকালো আরশাদ। বিস্ময়ে তার রীতিমত হাসি পেয়ে গেল।
হেসে ফেলেই সে বলল, “তাই না-কি? অবশ্য নওশীনের তোমার সাথেই বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। একেবারে মেড ফর ইচ আদার জুটি! আমি যদি টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যত ঘুরতে এসে দেখতে পারতাম, তোমরা দুজনেই একই প্রকৃতির – ট্রাস্ট মি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতাম তোমাদের।”
“কিচ্ছু বলিনি সেবার। চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম সবটা। নওশীনের অনুরোধে তোমাকেও জানতে দিইনি এই ঘটনা এতবছর। যে মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখলাম, তাকে বিয়ে করে তুমি হয়ে গেল আইডিয়াম হাসবেন্ড!”
আবারও সেই একই অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো শাফকাত। জীবনে ওই একবারই কোনো মেয়ের প্রতি তার ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল। তিন বছর আগে যখন ফাঁস হলো, নওশীনের কুকীর্তিই ছিল আরশাদের সঙ্গে তার ডিভোর্সের প্রধান কারণ – মনে মনে খুশিই হয়েছিল। সে নিজে যা পেলো না, আরশাদ তা নিজের করে রেখেও ধরে রাখতে পারলো না।
কে ফিল্মসের সাফল্যের পর থেকে শাফকাত ঈর্ষার আগুনে জ্বলছিল। সেই আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কাজ করে আরশাদ আর অরার বিয়ে। আরশাদ প্রায়ই তার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে। সেই সকল ছবি দেখে ক্রমেই জ্বলতে থাকে শাফকাতের উত্তপ্ত মন।
এদিকে নিজের বিবাহিত জীবনের প্রতি অতিষ্ট শাফকাত। মায়ের পছন্দ করে আনা মেয়েকে বিয়ে তো করেছে ঠিকই, তবে সেই মেয়েটার সঙ্গে এক মুহূর্তও শান্তি পায়নি। আরশাদের ভালো থাকা তাই একেবারেই সহ্য হয়নি শাফকাতের।
শাফকাত তর্জনী কপালে ঘষতে ঘষতে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাতে গড়া ইন্ডাস্ট্রি একটু একটু করে যখন নিজের হাতে মুঠোয় নিতে শুরু করলে, তখনই বুঝলাম অনেক হয়েছে। তোমাকে আর প্রশয় দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাকে প্রশয় দেওয়া বা না দেওয়ার দায়িত্ব কে দিয়েছে তোমাকে?”
শাফকাত থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো আরশাদের দিকে। আরশাদ সেই দৃষ্টির ধার না ধেরে বলল, “ইন্ডাস্ট্রি তোমার একার না। তোমার জন্মেরও আগে থেকে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। অবদান রেখেছো ঠিক আছে। যোগ্যতা থাকলে আরও অবদান রেখে দেখাও।”
শাফকাত সতর্কতার সুরে বলল, “আমার যোগ্যতা তোমার কল্পনারও বাইরে।”
আরশাদ হেঁয়ালির সুরে বলল, “তাই না-কি? কাজে লাগলো তথ্যটা।”
“তোমার উড়ে বেড়ানোর দিন শেষ আরশাদ হক। এখন থেকে শুধুই পতনের মুখোমুখি হবে। তোমার অভিনয়ের ক্যারিয়ারও শেষ, প্রোডাকশন হাউজও শেষ। আমি চাইলে সব করতে পারি।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ক্ষমতার গরম কাকে দেখাচ্ছো তুমি? আমি চাইলে ঠিক এই মুহূর্তে নরক বানিয়ে দিতে পারি তোমার জীবনটা।”
“পারবে না। আমার কিছুই করতে পারবে না তুমি। কোনো প্রমাণই নেই আমার বিরুদ্ধে।”
“এই কেসে এমনিতেও জড়াবো না তোমাকে। কুকীর্তি তো মাশাল্লাহ কম করোনি জীবনে। শুধু দেখো, নিজের কুকীর্তি কীভাবে নিজেই তোমাকে শেষ করে দেয়।”
শাফকাত যেন কিছুটা দমে গেল। আরশাদ হককে বিন্দুমাত্র ভরসা নেই তার।
দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “কী করবে তুমি?”
আরশাদ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির আভা ফুটিয়ে তুলে বলল, “শাফকাত আলম, ধ্বংস করে ছাড়বো তোমাকে আমি।”
(চলবে)