“আ না ম”- ১৫
-Azyah সূচনা
স্বরূপ দৃশ্যে মন জুড়াবে না কার।জমিনে পা গুটিয়ে বসে আছে প্রত্যেকটি বাচ্চা। হাতে খাতা কলম।পড়ছে।লিয়ানা নামক রহস্য মানবী শিক্ষাদান করছে তাদের।তাদের ঠিক পাশে নারীদের দল।কেউ চৌকিতে কেউ ফর্সে আবার কেউ সেলাই মেশিনের দায়িত্বে। ফর্সে বসে কিছু নারী কাপড় আর মাটির পাত্রে নকশা করছে।মস্তিষ্কে যতরকম চিত্র আছে সবটাই তুলে ধরছে।অতি বৃদ্ধরা ধর্ম চর্চায় ব্যস্ত।আবার কয়েকজন আলাপ আলোচনায়। পুরুষদের দেখা গিয়েছে সুবিন্যস্ত বাগানে।তাজা সবজি তুলে এনে ধুয়ে রাখছে রান্নাঘরে।এখানে নেই নারী পুরুষ ভেদাভেদ।দেহের শক্তির চেয়ে বড় উৎসাহী মন।বাচ্চাদের পড়তে দিয়ে লিয়ানাকে দেখা গেলো উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে। স্টোভের উপর বড় পাত্র বসিয়ে দিলো।একই সাথে চাল ধুয়ে নিলো অধিক পরিমাণে।সাথেসাথে বিষয়ে দিয়েছে।
একজন মধ্যবয়স্ক নারী এসে তাকে বললো,
-“আজ কি রান্না হইবো?”
লিয়ানা কাজে মনোযোগী হয়েই উত্তর দিলো,
-“আজ? এইতো ভাত,সবজি, ডাল।”
নারীটির মুখটা কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।বললো,
-“বাচ্চাগুলান পাঁচ দিন ধইরা মাছ মাংস খাইতে চাইতাছে। শাক সবজি আমরা বুড়া মানুষ খাইতে পারি।ওরা মুখে তুলতে চায়না।”
লিয়ানার মুখটা আধাঁরে ঢেকে যায়। নিঃশ্বাসের গতি অত্যন্ত ধিমা।কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠলো,
-“আজকের দিনটা মানিয়ে নিতে বলছি।আগামীকাল ব্যবস্থা করবো।”
-“আচ্ছা” বলে চলে গেলেন তিনি।
সবটা দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলো রবিন আর শাবাব।কান খাঁড়া করে সবটাই শুনেছে।একে অপরের দিকে চাইলো উভয়েই।একসাথে কাজ করে অন্তত চোখের ইঙ্গিত বুঝার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
বেরিয়ে আসে দুজনই।রবিন বলল, -“কিছু করা উচিত”
-“করছি তো।”
রবিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলো, -“কি করছেন?”
শাবাবের হাত চলছে ফোনে। ঘাড় ডানে বামে ঘোরাচ্ছে বারেবারে।ভাবুক ভঙ্গিতে দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল চালিয়ে রবিনের দিকে নজর দেয়।বলে,
-“ওহ! হ্যাঁ আমি অনুদান এর টাকা ট্রান্সফার করেছি।আর যাওয়ার আগে এই বাচ্চাগুলো আর বৃদ্ধ মানুষগুলোর জন্য কিছু কেনাকাটা করে দিবো। ফাহাদকে দায়িত্ব দিলাম এই কাজের।আপনি চলুন। প্রফেসর এর চ্যালার খোঁজ নিতে হবে।”
-“আচ্ছা….আমার মনে একটা কথা ছিলো।জানি এটা আমাদের রুলস এর বিরুদ্ধে।তারপরও”
শাবাব ফোন পকেটে রেখে বললো, -“হুম বলুন?”
-“আমরা কি লিয়ানাকে আমাদের সাথে এই কেসে নিতে পারি?”
রবিনের কথাটি একদম পছন্দ হলো না শাবাবের।চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছে।রবিনের দিকে বিরক্তিমাখা চোখে চেয়ে বললো,
-“সে একজন বহিস্কৃত অফিসার আপনি জানেন না?আর সবচেয়ে বড় কথা সে মানসিকভাবে সিক।”
-“কিন্তু তার গেসিং পাওয়ার প্রখর।আপনি নিজে সেটা জানেন।সে যেভাবে সবকিছু অবজার্ভ করে?তার চিন্তাশক্তি আমাদের চেয়ে ভিন্ন।আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন।”
রবিনের যুক্তিযুক্ত কথায় কোনো রকম কান দিলো না শাবাব।কোনোভাবেই একে কেসে ইনভলভ করা যাবেনা।অবশ্যই যথাযথ কোনো কারণ ছিলো তার বহিষ্কার হওয়ার।গেসিং পাওয়ার বিবেচনা করে রিস্ক নেওয়ার প্রশ্ন উঠে না।তারপরও রবিনের কথার সম্মান দেখায় শাবাব।
বলে, -“ভেবে দেখবো।চলুন”
থানায় এসেছে শাবাব আর রবিন। ফাহাদকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলো সে কাজ ঠিক মতন করছে।আবির সকাল সকাল রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। পয়জনটা নিয়ে আরেকবার রিসার্চ করবে। কোথাও যদি কোনো ভুল থাকে? জেলের মধ্যে প্রবেশ করে চেয়ার পেতে বসলো দুজনে।একে একে প্রশ্ন করবে প্রফেসরের জন্য কাজ করা এই ছেলেটিকে।কিছু নতুন প্রশ্ন।যা পূর্বে করা হয়নি।
শাবাব প্রশ্ন করলো, -“গতকাল নাম যেনো কি বলেছিলে?শান্ত?রাইট?”
ছেলেটি দুহাত একত্রে করে মাথা নুয়ে বসে আছে।জেদী হাবভাব দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে।প্রশ্নের উত্তর দিলো না।শক্ত হয়ে বসে রইলো নিজের স্থানে।
শাবাব আবার বললো,
-“শান্ত!….এখানে তোমার জেদ ধূলিকণা বরাবর।ভালোভাবে প্রশ্ন করছি উত্তর দাও। প্রফেসরের জন্য কাজ করো কতদিন?”
জেদী গলায় শান্ত উত্তর দেয়,
-“এক বছর।”
পায়ের উপর পা তুলে শাবাব।গা এলিয়ে টানটান হয়ে বসেছে।মুখের ভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক।আবার প্রশ্ন করলো,
-“এইযে সে তোমাকে দিয়ে এত কাজ করায়?এই ব্যপারে আর কে কে জানে?আর কেউ আছে তোমার সাথে জড়িত?”
শান্ত আবার চুপ হয়ে গেলো।মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে।ভঙ্গিতে পরিষ্কার উত্তর দিতে নারাজ সে। শাবাবের মেজাজের পারদ ধেইধেই করে উপরে উঠে গেল।শান্তর গাল চেপে ধরে বললো,
-“আমার সামনে এত তেজ দেখানো যাবে না!বন্দুকের প্রত্যেকটা গুলি একদম খুলির মধ্যে গেড়ে দিবো।”
শান্তর মুখে বিন্দু পরিমাণ ব্যতিক্রম কোনো ভঙ্গি দেখা মিললো না।এখনও তেজে টগবগ করছে।উঠতি বয়সের গরম রক্ত।সামনে অফিসারদেরকে তোয়াক্কাই করছে না কোনো।
আরো রেগে উঠে শাবাব।কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে কপালে ধরলো।আর বললো,
-“রিলোড করা আছে।উত্তর না দিলে কি হবে বুঝতেই পারছিস।দ্রুত বল!কে আছে তোর সাথে আর?”
-“কেউ নেই।আমি একাই”
-“এসব করে বেড়াস! তুই আর তোর মালিক এটা আর কেউ জানে?”
-“নাহ।আমি স্যারের বাড়িতে কেয়ার টেকার এর কাজ করতাম।আমি ব্যতীত আর কেউ জানে না।”
-“বন্দুক কোথায় পেয়েছিস?”
-“স্যার দিয়েছেন।”
-“চালাতে পারিস বন্দুক?”
-“স্যার শিখিয়েছেন।”
ধাক্কা দিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো শান্তকে। বন্দুক নিজের স্থানে রেখে বললো,
-“এবার জেলে কেয়ার টেকার এর কাজ করিস!তোর গেম শেষ।তোর মালিকের গেম শেষ করতে যাচ্ছি।”
__
বিদায় বেলা ঘনিয়ে এসেছে।আশ্রমের বাহিরে গাড়ি রেডি।একে একে সকলে চলে যাবে।আশ্রমের মানুষগুলোও চেয়ে আছে।নাম না জানা অতিথিদের বিদায় দিতে।জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি এতদিন।জানতে চায় নি তারা কারা?নিজেদের মধ্যে সবসময়ের মতন মগ্ন ছিলো।লিয়ানা দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে।ঠোঁটে স্বল্প হাসি। মলিন মুখটা একই রকম।
রামশা এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।বললো,
-“খুব মিস করবো তোমাকে।আমি চেষ্টা করবো এখানে আসার।ঠিক আছে?”
লিয়ানা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, -“হুম”
সাইফা এসেছে পরপর।বললো,
-“ভালো থাকবে কেমন?সুযোগ পেলে আমরাও আসবো এখানে।”
মির্জা আর রবিন সায় দেয়।চুপ শুধু শাবাব।আজ সূর্য হয়তো পূর্ব দিকের বদলে পশ্চিম দিক চিরে উঠেছে।সাদা শার্টের উপর স্থান পেয়েছে কালো কুচকুচে জ্যাকেট।সাথে নিজের চোখ ঢেকেছে কালো সানগ্লাসে।গাড়িতে হেলান দিয়ে দেখছে সবাইকে।শুনছে সবার কথা।আগ্রহ জাগলো না কোনো তার।
সবাই গাড়িতে উঠে বসে।ড্রাইভিং সিটে বসার পূর্বেই শাবাব ফিরে এলো। হেঁটে গেলো লিয়ানার দিকে।সবুজ মনিযুগল তুলে চায় লিয়ানা।নিশ্চয়ই কিছু বলবে?
দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে শাবাব বললো,
-“আশ্রমের বাচ্চাদের আর বৃদ্ধদের খেয়াল রাখবেন। হ্যালুসিনেট না করে তাদের দিকে বিশেষ খেয়াল দিন।স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েন।আর কোনো প্রয়োজন হলে ফাহাদ এর সাথে যোগাযোগ করবেন।”
লিয়ানা জবাব দেয়, -“আচ্ছা”
-“আসি তাহলে”
-“আবার আসবেন?”
লিয়ানার ফিরতি প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না শাবাব।কথার কথা বলেছে সে।এর অন্য অর্থ বের করে নিলো এই মেয়ে। ভুলও কিছু বলেনি। দ্বিমুখী ধারণা।
শাবাব কথা না বাড়িয়ে বললো, -“ভাগ্যে থাকলে আসবো।”
-“আজও আপনি অকৃতজ্ঞ।ধন্যবাদ জানালেন না আমায়।”
-“বেশি কথা বলেন আপনি শেওলা। হোয়াট এভার…থ্যাংকস!”
গাড়ির ভেতরে বসে তাদের দুজনের দিকে দৃষ্টি দিলো সাইফা।মনের মাঝে অদ্ভূত এক বিচরণ।আজ প্রথমবারের মতোন তার শাবাব আর লিয়ানাকে মুখোমুখি দেখতে ভালো লাগছে না।নিজের এই ভ্রান্ত চিন্তাকে তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলে।কিসব ভাবছে সে?এগুলো ভাবার কোনো কারণই নেই।
ড্রাইভিং এর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় শাবাব।দ্রুত বেগে ছুটলো দুটো গাড়ি একসাথে।ডান দিকের লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তে দেখা মেলে লিয়ানা নামক ওই অদ্ভুত মেয়েটির।ধীরেধীরে দূরত্বের সাথে অবয়ব ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। শাবাব চোখ পিটপিট করে লক্ষ্য করে।খানিক বাদে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে চেয়ে মনোনিবেশ করলো সামনের সরু রাস্তায়।
লিয়ানা ছাদে এসে বসেছে।আজও আসবে ওই দখিনা আকাশে মেঘেরা।তাদের আগেই উপস্থিত হলো লিয়ানা।আকাশের পানে চেয়ে তাদের আগমনের সাথেসাথেই বলতে লাগলো,
-“জানো আমার ওদের সবাইকে খুব ভালো লাগছিলো।অনেক সময় বাদে আমি আমার শখের পেশার কিছু মানুষদের পেয়েছিলাম। বরাবরের মতন আবারও নিঃস্ব হলাম।”
তার নিজের কল্পনায় মেঘেদের উত্তর আসছে,
-“মানুষের সাথে অনুভুতি জুড়তে দেই।এরা থাকে না।হারিয়ে যায়”
-“তোমরা হারাবে?”
-“আমাদের বিচরণ এই আকাশেই।হারানোর পথ নেই।আছি তোমার কল্পনায়”
-“সত্যিই বলেছো আমরা মানুষ কল্পনায়ই বেশি সুখী”
___
হাত পা থরথর কাঁপছে প্রফেসর রাজিনের। ভুক্তভোগী কাতার থেকে বেরিয়ে অপরাধীর কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে সেটা বুঝতে পারেনি।অনেকদিন চলছে তার এই নোংরা কৃতকর্ম।ধরা পড়ার সুযোগ রাখেনি কোথাও।মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তাদের সম্মানকে।আর সেটাকেই মোহরা বানিয়ে নিজের খেলকে চালিয়ে গেছে বিনা ভীতিতে।আজ মনে হচ্ছে সেই বিষে তার মৃত্যু হলে বুঝি বেঁচে যেতো।সব পথ বন্ধ।সমস্ত প্রমাণ অফিসারদের হাতে।সাথে একজন সাক্ষী।প্রশ্নবিত্ব চোখে চেয়ে আছে রাজিন এর স্ত্রী আর মেয়ে।জানতে চাইছে সবটা।
শাবাবের মুখে কাঠিন্য। দাঁত কিড়মিড় করছে।ইচ্ছে হচ্ছে আছড়ে ফেলুক এই জঘন্য লোককে।তার স্ত্রীকে সামনে রেখে বললো,
-“কতগুলো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলেছিস!শিক্ষকতার নামে নোংরামি চালিয়েছিস প্রতিষ্ঠানে?কি লাভ হল তোর এত এত ডিগ্রির। কাপুরুষ কোথাকার!”
প্রফেসর রাজিনের এগারো বছর বয়সী মেয়ে বলে উঠলো,
-“আপনি আমার বাবাকে এসব কেনো বলছেন?”
রবিন সাইফাকে ইশারা করে।ওকে এখান থেকে নিজে যাওয়ার জন্য।বাচ্চার মস্তিষ্ক এখনও অপরিপক্ব এরূপ পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য।সে যেতে চাইলো না। সাইফা তাকে ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে সরিয়ে নেয় সেখান থেকে।
শাবাব আবার বললো,
-“তোর মতন লোকের ফাঁসির শাস্তিও কম!”
প্রফেসর রাজিন এর স্ত্রী বলে উঠলো,
-“আপনারা কি বলছেন আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলুন।আমাদের পুলিশের নজরদারিতে রাখা হয়েছিল এতদিন।আমাদের কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।কি হচ্ছে এসব!”
রবিন জানতে চায়,
-“কেনো আপনি জানেন না?আপনার ফোন থেকে প্রতিনিয়ত আপনার স্বামী কারো সাথে কন্টাক্ট করে যাচ্ছে।আপনি কিছুই জানেন না?”
অসহায়ের মতন চেয়ে প্রফেসর এর স্ত্রী উত্তর দিলেন,
-“আমি জানি না।উনি আমার কাছ থেকে ফোন চেয়েছেন আমি দিয়েছি।”
-“শুনে খুব খারাপ লাগবে আপনার।তারপরও আপনার বিশ্বাস ভাঙতে আমি বাধ্য হচ্ছি।আপনার স্বামী একজন বিবাহিত আর একজন মেয়ের বাবা হওয়া স্বত্বেও কত কত মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলেছে।তাদের ব্ল্যাকমেইল করেছে। নোংরামিতে মেতে ছিলো এই লোক। এইযে রুবি নামক মেয়েটিকে দেখছেন সেও আপনার স্বামীর শিকার।তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়।অজ্ঞান করে তার ছবি তুলে নেয়।আমরা একজনকে পেয়েছি।না জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের কত মেয়ে ভুগছে!”
এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো শাবাব।বলতে বলতে কপালে রগ ফুটে উঠেছে।রবিন বলল,
-“আপনার মেয়ে যখন জানতে পারবে তার সবচেয়ে ভরসার স্থল তার বাবাই মেয়েদের সম্মান করতে জানে না?সে কোন পুরুষে ভরসা করবে?সে তো ভেঙে পড়বে।”
প্রফেসর রাজিনের স্ত্রী ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়।এত বড় সত্যের ধাক্কা হয়তো নিতে পারেননি। পূর্ণবার নিশ্চয়তার জন্য প্রশ্ন করলেন,
-“আপনারা ঠিকঠিক খোঁজ নিয়েছেনতো?”
-“সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।চাইলে দেখতে পারেন।” রবিন জবাব দেয়।
একে একে সব প্রমাণগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি।সাহস যুগিয়েছেন বুকে।সত্যটা অবশ্যই জানতে হবে তার। ভুলের ক্ষমা হয়।পাপের নয়।চোখ ভেঙে পানির ধারা বইছে।প্রতিটি প্রমাণের সাথে সাথে তেরো বছরের সংসারকে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে দেখলেন প্রফেসর রাজিনের স্ত্রী।তার শেষ আশ্বাসটুকু অবশিষ্ট রাখলো না।সম্মান পেলো না ভরসার। মাথাটার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সবটা।নিজের স্বামীর দিকে চাইলেন।অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়ে বসে আছে। আসলেতো সে অপরাধীই!সময় অতিবাহিত হয়ে পনেরো মিনিট পাড় হয়।দুহাতে মুখ মুছে নেন ভঙ্গুর নারীটি।পাথরের ন্যায় নিজেকে শক্ত করে উঠে গেলেন স্বামীর দিকে।
হাতের সমস্ত শক্তিটুকু প্রয়োগ করে চড় মারলেন প্রফেসর রাজিনের ডান গালে।পরপর অনবরত কয়েকটা চড় দিয়ে বললেন,
-“নারীকেতো তুমি সবসময় দুর্বল ভাবতে।অথচ আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী।কারণ আমরা আমাদের সম্মানের ভয় করি সবসময়। তোমার মতন নোংরা মস্তিষ্কের পুরুষের কিসের সম্মান?সম্মান নেই বলেইতো এত জঘন্য কাজ করেও দিব্যি দিন কাটিয়েছো।নিজের মেয়ের কথা ভাবলে না?তোমার মেয়ের সাথে যদি এমন হতো? কি করতে? পারতে সহ্য করতে?….আমিও কাকে কি বলছি।তোমার শাস্তি হওয়া উচিত।তোমার মেয়েকে আমি নিজে জানাবো যে তার বাবা কত খারাপ ছিলেন।…..আর আমি এতটুক যোগ্য যে একা আমি আমার মেয়েকে মানুষের মতন মানুষ করতে পারবো।তোমার মতন কুলাঙ্গারের আমার আর আমার মেয়ের জীবনে প্রয়োজন নেই।তোমার মৃত্যু হলেও আমার আজ থেকে কিছু যায় আসেনা।”
চলবে…
“আ না ম”- ১৬
-Azyah সূচনা
-“আসবো এস. আই শাবাব?”
পরনে টি শার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে কিশোর বেশ ধরেছে।হাত পা ছড়িয়ে বিশাল বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে।আজ ইচ্ছে হলো নিজের আসল আস্তানায় রাজত্ব দেখাতে। সর্বাঙ্গ অলসতায় মোড়া।কাজ আছে জানা সত্বেও দায়িত্বহীন এর মতন নিথর পড়ে রইলো।ঘূর্ণায়মান ফ্যানের গতি পরিমাপ করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এক নারী কন্ঠ।
না চেয়েই বললো,
– “নিজের বাড়ি,নিজের ঘর প্রবেশ করতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে ডক্টর রুনা বেগম?”
রুনা বেগম ভেতরে এলেন।শুয়ে থাকা শাবারের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
-“আপনারতো আবার অল্পতে রেগে যাওয়ার বদ অভ্যাস আছে।তাই অনুমতি নিলাম।”
-“মাথা ধরেছে।আপনার স্বামীকে বলুন এককাপ চা দিতে।এই বাড়িতে নতুন শেফ হয়ে ঘুরছে আজকাল।”
হালকা করে থাপ্পড় দিলেন রুনা বেগম। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে ধমকে বললেন,
-“বাবা হয় তোমার।”
-“আমার বাবা আপনার স্বামী না?নাকি কুড়িয়ে এনেছেন তাকে?”
-“কোথা থেকে আবিষ্কার করো এসব কথা? এতোটা ঘাড়ত্যাড়া কি করে হলে?”
-“এমনে এমনেই হাওয়ায় বাতাসে ভেসে”
মাথা দুদিকে দোলান রুনা বেগম।কি করবে এই ছেলেকে নিয়ে?নিজের বাড়ি ফেলে একা একা থাকে।বদ্ধ এক রুমের একটা ফ্ল্যাটে।নিজের বাবার তৈরি ঘর থাকতে ভাড়া কেনো থাকতে হবে?কোনো কারণ ছাড়া।এগিয়ে এসে শাবাবের মাথা তুলে নিজের কোলে রাখলেন।
আদরে যতনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“মায়ের কথা মনে পড়লো তাহলে?”
-“ভালো লাগছিলো না তাই এসেছি” সোজাসুজি উত্তর দেয় শাবাব।
-“ভালো লাগলে বুঝি মায়ের কাছে আসা যায়না?”
-“যায়তো।কিন্তু আপনার স্বামী আমার দিকে এমনভাবে চায় যেনো আমি কোনো চোর!”
-“তোমার বাবা তোমাকে কতো মিস করে জানো?একটা ছোট আবদার নাহয় করেছিলো?কি হতো পূরণ করলে?ওই ছোট একটা ঝগড়ার জেদ ধরে বাড়ি ছাড়লে।”
-“এমনতো না যে আসি না। আসি বেহায়ার মতোন।আর আপনি ভুল বলেছেন ডক্টর রুনা।আপনার স্বামী একটা না দুই দুইটা আবদার করেছিলো।ভিত্তিহীন আবদার।”
-“মাহি মেয়েটা খারাপ ছিলো না।”
মুখ কুঁচকে চাইলো মায়ের দিকে।বলে উঠলো,
– “মাহি মেয়েটা খারাপ হোক আর ভালো আমার কি?আগের যুগের সিনেমার কাহিনীর মতন আমাকে যারতার গলায় ঝুলিয়ে দিবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তাতো হবে না।…..আমাকে ছোটোবেলা থেকে চাপ প্রয়োগ করে গেছে।সারাক্ষণ শুধু পড়ালেখা।আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে।কেনো?এসব ছাড়া পেশা নেই।এসব পেশায় জুড়লেই বুঝি সমাজে বাবার মুখ উজ্জ্বল হতো?স্ট্রেঞ্জ মা! লাইফলেস পুরো কনসেপ্টটা।আর সেদিন কথা আমি না বাবা বাড়িয়েছে।তার বন্ধুর মেয়েকে আমারতো বয়েই গেছে বিয়ে করতে।আমি সারাজীবন তোমাদের কথায় রোবোটিক লাইফ লিড করেছি।এখন নিজের মনমত সব করছি।এটায় দোষের কিছু নেই আমার মতে।”
শাবাবের কর্কশ আওয়াজ ধরে লুৎফর বেইগ এসে হাজির। হাতে খুন্তি ধরে আছেন। অদ্ভুত মুখ ভঙ্গি করে চেয়ে আছেন মা আর ছেলের দিকে।কি বিষয়ে কথা চলছে?তার বদরাগী ছেলেটার গলার আওয়াজে তেজ হঠাৎ কেনো বাড়লো?এটা জানতেই রান্না ফেলে এখানে আসা।একই সাথে দুজন চাইলো দরজার দিকে।
শাবাব তার মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
-“দেখো অবস্থা!”
-“তোমার মা আমাকে বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে নতুন করে কি দেখবে শুনি?”
শাবাব চোঁখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“মা নিয়ে যাও ওনাকে এখান থেকে।”
-“আমি একা কেনো যাবো।টেবিলে এসো খাবার রেডি।”
লুৎফর বেইগ এর কথার জবাবে শাবাব বললো,
-“কি না কি বানিয়েছেন!আমি একটা ইম্পর্ট্যান্ট কেসের সাথে জড়িত।এসব হাবিজাবি খেয়ে পেট খারাপ করতে চাই না।”
লুৎফর বেইগ রেগেমেগে একাকার।বলে উঠলেন খুন্তি তুলে,
– “তোমার ছেলের মুখেতো আমি নিজ হাতে মধু দিয়েছিলাম।কানে আযানও দিয়েছি। বিষাক্ত মুখ আর ইবলিশের মতন স্বভাব কোথা থেকে পেলো? নির্ঘাত বাচ্চা চেঞ্জ হয়েছে আমাদের।”
রুনা বেগম চোখ রাঙালেন উভয়কে।কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
-“চুপ থাকো তোমরা দুজন। যতক্ষণ হাসপাতালে থাকি ততক্ষন আমার শান্তি। উফ!”
___
সুবিশাল হোটেলের কামরায় কাপড় একে একে লাগেজে নিয়ে নিচ্ছে রামশা।সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ফিরবে।তার বাবা ভীষণ রকমের রেগে।মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে দিনের পর দিন এমন ভবঘুরের মতন ঘুরে বেড়াবে সেটাতো হয়না।আজ অনেকদিনের জমানো রাগটা ফোন করে ঝাড়লেন।আগামীকাল সকালের মধ্যে তার মুখ সম্মুখে হাজিরা দিতে বলেছেন।গলার সুরের অতিমাত্রায় রাগের আভাস পেয়ে তরতর করে কাপড় গুছিয়ে নেয়। রবিনকে বলা হয়নি এখনও।সে ব্যুরোতে আছে।
চট করে রবিনকে মেসেজ করলো,
-“বাবা ভীষণ রেগে আছেন।আমাকে ঢাকা ফিরতে বলেছেন। তুমি আজ ফিরবে?আমি এক ঘণ্টার মধ্যে বের হবো”
মিনিট খানেক বাদে ফিরতি মেসেজ আসে,
-“আমি রাস্তায় আছি।দেখা করবো।অপেক্ষা করো”
রবিন এসেছে পনেরো মিনিট পরে। রামশা ব্যাগ পত্র নিজে তৈরি। রবিনকে দেখে মলিন হাসলো।বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে কাছে এসে রবিনের গাল টেনে বললো,
-“আসি মিষ্টার রোজারিও।এতদিন বেশ জ্বালিয়েছি আপনাকে।কেস সলভ করে দ্রুত ফিরবেন।”
রবিন হেঁসে উত্তর দেয়, -“এসে তোমাকে বিয়ে করবো?”
-“অবশ্যই!…. তুমি কি চাও বাবা আমাকে অন্য একটা বুড়ো লোক দেখে বিয়ে দিয়ে দেক?”
দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসে রবিনের। মুখে মিছেমিছি গম্ভীর ভাব টেনে নিলো।বললো,
-“তোমার বাবা যদি বলে বুড়ো লোককে বিয়ে করতে অবশ্যই করবে।আমার আগে তোমার বাবা।তার ইচ্ছে পূরণ তোমার দায়িত্ব।আমিও বাঁধা হয়ে আসবো না বাবা মেয়ের মধ্যে”
রবিনের কথার ছলনা বুঝলো না রামশা।এতদিন একে অপরকে চিনেও যেনো চিনেনি।সত্যি ভেবে নেয়। মুখশ্রীর ভঙ্গি পরিবর্তন হলো চটপট।এক দৃষ্টিতে চাইলো রবিনের দিকে।রবিন বহু কষ্টে হাঁসি দমিয়ে রেখেছে।
নিজের রাগ সংবরণ করে রামশা বললো,
– “আমার ভালোবাসা বৃথা যাবে না।আমি যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যেটা আমি চাই সেটা হাসিল করবো।মাইন্ড ইট রবিন রোজারিও!”
রামশার এমন ভারী কথা শুনে রবিন হেঁসে ফেলে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-“থাক বাচ্চা মেয়েটা রাগ করে না।যাও সাবধানে যাবে।আর হ্যাঁ আমি দিয়ে আসবো তোমাকে এয়ারপোর্ট অব্দি।”
-“এসব ব্যাপারে ঠাট্টা আমার পছন্দ না।”
-“আচ্ছা বাবা সরি।চলো এবার”
___
-“আমি আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবো?আমাকে যেতে দিন”
বিদঘুটে এক জায়গায় বেঞ্চি পেতে বসে আছে এক অদ্ভুত মনুষ্য।চারিদিকে গাছপালা ঘেরা।জনমানব শূন্য ভুতুড়ে জায়গাটা বোধহয় অপরাধ নিয়ে আলোচনা করার জন্য সঠিক জায়গা।
-“খাবারের টেস্ট এর মতন করে থাকার জায়গাটাও পরিবর্তন করো।”
আবারো সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর।সেদিন রেস্টুরেন্টে এই গলার আওয়াজটার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।নিজের জীবন বাঁচাতে কারো জন্য শেষ খাবারের আয়োজন করেছিল।মাথায় বন্দুক চেপে তাকে দিয়েই তৈরি করানো হয় প্রফেসর এর জন্য খাবার।অভিজ্ঞতা আর নৈপূণ্য ব্যবহার করে বিষাক্ত খাবারকে করে তুলে সুস্বাদু।তবে অনিচ্ছাকৃত।নিজের জীবনের ভয় সকলেরই আছে।এই কাজের বিনিময়ে অগোচরে ফেঁসে যাচ্ছে চোরাবালিতে।পুলিশের হাতে ধরা খাওয়ার ভয়।ম্যানেজার এর আধ ঘণ্টার অনুপস্থিতিতে কত কি ঘটে গিয়েছিলো সেদিন সেটা এই রহস্যময় মানুষ ব্যতীত আর কেউ হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি।
আনাম বলে উঠলো,
-“ভয় পাচ্ছো?কিসের ভয়? প্রফেসরতো বেঁচে গেছে।আমি নিজে হসপিটালে তাকে দেখে এসেছি।”
-“আপনি…আপনি আমাকে দিয়ে খাবার তৈরি করিয়েছেন।সবাই আমার দিকে সন্দেহ করবে।আমাকে কোনো উপায় বলেন।আমি আপনার কথামত কাজ করেছি।আমায় বলে আমি এখন কোথায় যাবো?”
-“ফিরে যাও যেখান থেকে এসেছো।পুলিশ তোমাকে প্রশ্ন করলে কি বলবে জানো?”
-“কি?”
-“বলবে তুমি খাবার তৈরি করে চলে গিয়েছিলে।এরপর কি হয়েছে তুমি জানোই না।কিসের বিষ?কেমন বিষ? বিষ কাকে বলে? কিচ্ছু জানো না তুমি”
-“কেউ বিশ্বাস করবে না”
-“আলবৎ বিশ্বাস করবে।কারণ কি জানো?…..আমি প্রফেসরকে ঠান্ডা খাবার পরিবেশন করিয়েছি।খাবার ঠান্ডা হতে খানিক সময়তো দরকার হয়ই তাই না?….. বুদ্ধি নেই তোমার আসলে।তোমাকে যা বলছি করো সাব্বির।যাও”
সাব্বির ফিরে যাবে কি যাবে না এই দ্বিধায় ভুগছে।যদি সে ঠিকঠিক মিথ্যে বলতে না পারে?যদি পুলিশ তাকে দোষী করে?মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো।বলে দিবে এই কালো আবরণে মোড়ানো ব্যক্তির সমস্ত কথা।সাহস যুগিয়ে প্রশ্ন করলো ফিরে,
-“আপনি?আপনি নারী নাকি পুরুষ?”
বেঞ্চিতে বসে থাকা মানুষটি মাথা তুলে সামান্য। খয়েরী রঙের বুট জুতো শব্দ করে জমিনে রাখে।পরপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসে সাব্বিরের দিকে।শক্ত করে ভীত সাব্বির এর কাঁধে হাত রেখে চাপ প্রয়োগ করলো।ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে সাব্বির।
সে বলল,
– “আজ থেকে তুমি আমাকে কখনো দেখোনি,আমি তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাইনি। বিশ্রী দুর্গন্ধযুক্ত বিষ সামান্য কেউড়া জল,পরিমাণের চেয়ে অধিক মশলা মিশিয়ে পরিবর্তন করোনি,আমি তোমাকে কোনো টাকা দেইনি,আমি তোমাকে জোর করিনি,আমি তোমার কপালে বন্দুক ঠেকাইনি।বুঝতে পেরেছো সাব্বির?”
-“জ্বি.. জ্বি!”
-“গুড….বাঁচতে চাইলে কথাগুলো মনে রাখবে।আর যাওয়ার পথে ফিরে চাইবে না কিন্তু!”
সাব্বির উল্টো ঘুরে ভো দৌড় লাগায়।পিছু ফিরে দেখার কোনো সুযোগ আর ইচ্ছে কোনোটাই নেই। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আধাঁরে তলিয়ে গেলো।মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠে আধার রজনী জুড়ে।
কেউ আনমনে বললো,
– “কতটা নির্বোধ এরা! আমি চেয়েছিলাম বলে এত মৃত্যু হয়েছে….আর আমি চেয়েছি বলেই কেউ বেঁচে আছে।কৃতিত্ব আমার আর ভোগ করছে অন্য কেউ?”
শাবাবের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না।রবিন,আবির আর মির্জা উভয়েই তার খোঁজে ব্যুরোতে।তার নিজের কোনো খবর নেই।একের পর এক কল করে গেলো। ফোনটাও বন্ধ!এমন কখনো হয়না।বাড়ি গিয়েছে জানিয়েছিলো।তবে ফোন বন্ধ রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত করার মতন লোক নয় সে।আবির চতুর্থ দফায় পয়জন এর ল্যাব টেস্ট সম্পন্ন করেছে। সিনিয়র ফরেন্সিক এক্সপার্টদের সাথে আলোচনা করছে।নতুন একটি বিষয় লক্ষ্য করেছে।পূর্বের ভিক্টিমদের চেয়ে অত্যন্ত কম পরিমাণে প্রফেসরের খাবারে বিষ মেশানো হয়।বাকিদের ডোজ এত বেশি ছিলো যে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় তাদের দেহের ইন্টারনাল অর্গান বাজেভাবে ড্যামেজ হতে থাকে।ফাহাদ আর সাইফা রিপোর্ট দিয়ে গিয়েছে। স্মাগলারদের উপর সন্দেহ আছে অনেকটা।যারা এই ধরনের ড্রাগ আর পয়জন সাপ্লাই এর কাজের সাথে জড়িত।খুবই ঠান্ডা মাথায় একে একে প্রত্যেকের খোঁজ নিতে হবে।
রবিনের ফোন বেজে উঠে। ফোনে নাম এ্যারিক রোজারিও এর।বাবার ফোন দেখে নড়েচড়ে উঠলো রবিন।রিসিভ করে বললো,
-“হ্যালো”
মোটা পুরুষালি গলার আওয়াজ ভেসে আসে,
– “কি অবস্থা?”
বাবার প্রতি ভয় এবং শ্রদ্ধা উভয়ই একইভাবে কাজ করে রবিনের।মিনমিনে গলায় বললো,
-“ভালো বাবা।তোমার কি খবর?”
-“মাথা থেকে ভার তো নামছে না।কেস কতদূর?”
-“আগের চেয়ে একটু এগিয়ে।খুব শীগ্রই আমরা আসল আসামী পর্যন্ত পৌঁছে যাবো বাবা।বেশ কিছু ক্লু এসেছে,আসছে।”
-“অনেক সময় লাগছে রবিন।দ্রুত কাজ করো।”
-“জ্বি বাবা।”
থমথমে গলায় এ্যারিক রোজারিও বললেন,
-“সাবধানে থেকো।কেস দিকে আর নিজের উভয়ের খেয়াল রেখো।রাখছি”
রবিন ফোন রেখে মির্জা এর আবিরের পানে চাইলো। শাবাব এখনও মিসিং।ফোন অফ।কতবার কল করেছে!ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে একটায় এসে ঠেকেছে।রবিন সাদা সমতল টেবিলের দিকে চেয়ে ভাবনায় ডুব দেয়।ভাবতে থাকে কোথায় গিয়ে যোগসূত্র স্থাপিত হবে এই কেস এর। তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করতে করতে হঠাৎ থেমে যায়।
মুখ তুলে মির্জা আর আবিরের উদ্দেশ্যে বললো,
-“একটা বিষয় খেয়াল করেছেন?”
মির্জা জানতে চায়, -“কি বিষয়?”
-“প্রফেসর এর মৃত্যু নিশ্চিত করেনি খুনি”
আবির বললো,
-“আমিও তাই ভাবছি।তাছারাও অন্যান্য বডির চেয়ে প্রফেসর এর বডিতে ৭০% কম পয়জন ছিলো। যার কারণে তাকে বাচাঁনো সম্ভব হয়েছে।”
-“এবারও কি আমাদের চোখে ধুলো দিলো?আমাদের প্রফেসর এর কেসে এলোমেলো করে দিয়ে সে অন্যকিছু প্ল্যান করছে” রবিন চিন্তিত গলায় বললো।
মির্জা তার বিচক্ষণতা খাটিয়ে আরো একটি বিষয় তুলে ধরে,
-“নাকি সে চাচ্ছিলো আমরা এই কেসে জুড়ি।ইচ্ছে করে বাঁচিয়ে রেখেছে?সে অবশ্যই জানতো প্রফেসর বেঁচে থাকলে পুলিশের সাহায্য নেবে।দুটো উদ্দেশ্য হতে পারে।”
সমস্ত কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো রবিন। মুদ্রার দুটো পিঠ।দুটোই প্রয়োজনীয়।রবিন বলল,
-“হয়তো এলোমেলো করতে চেয়েছে নয়তো সে চেয়েছে আমরা এই কেসের মধ্যে জড়াই।”
– “তাহলে লিয়ানার কথা ধরেই আগাই?”
চলবে…