আ না ম পর্ব-১৯+২০

0
174

“আ না ম”- ১৯
-Azyah সূচনা

গত রাতের একটা সাদা কাগজের চিঠি যেনো সব পরিকল্পনার উপর পানি ঢেলে দিলো।তারপরও পিছু হটতে ইচ্ছে হচ্ছে না শাবাবের।কাগজ থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়েছে।সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের থেকে নেওয়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর সাথে মিলিয়ে দেখা হলো।মিলছে না কারো সাথেই।যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে তার সমস্ত ডিটেইলস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো রবিন।খুলনার মেয়ে। চট্টগ্রামে এসেছিল পড়ালেখা করতে ২০১৯ সালে।মৃত্যুর সময় চতুর্থ বর্ষের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিল সে।নাম জারা।মৃত্যুর পূর্বে কোনো রকম আঘাত এর চিহ্ন পাওয়া যায়নি।তার মা পোস্ট মার্টম করার অনুমতি প্রদান করেনি।তার আশপাশের সকলের খোঁজ নেওয়া হয়েছে।খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে ঢাকা ব্যুরো এর অফিসাররা। জারার মায়ের খোঁজ নিতে।

শাবাবের সামনে হুইল চেয়ারে বসে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জিল্লুর।ঘিরে থাকা মির্জা,ফাহাদ আর সাইফার সম্মুখে ভীত দেখালো তাকেও।

শাবাব প্রশ্ন করলো,

-“প্রফেসর রাজিন এর কৃতকর্ম সম্পর্কে জানতেন?”

জিল্লুর সাহেব হাতে থাকা সাদা রুমালে সমস্ত মুখ মুছে নিলেন।খানিক বাদে বাদে চোখের পলক ফেলছেন।বয়সের ছাপ স্পষ্ট।দাড়ি,চুল এমনকি চোখের পাঁপড়ির কিছু অংশও সাদা হয়ে গেছে। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জবাব দেন,

-“জানতাম।তবে আমি এসব কিছুর সাথে জড়িত ছিলাম না।”

অবলীলায় বলে ফেললো!জানতো তবে জড়িত নয়।এটা কি তার আংশিক অপরাধকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম?নিজের চোখে ভুল দেখেছে। অথচ প্রতিবাদ করেনি কোনো। চোয়াল শক্ত করে শাবাব বললো,

-“যে পাপ করে আর যে পাপ দেখে অথবা প্রশ্রয় দেয়?সেও সমান অপরাধী।”

জিল্লুর সাহেব শাবাবের দিকে দীপ্ত চোখে চাইলেন।বললেন,

-“আমি শুধুই জানতাম তার কাজে কোনো প্রকার নাক গলাইনি।আমার চরিত্রে আঙ্গুল তোলার সুযোগ ছিলো। রাজিনকে আমি জারা নামক মেয়েটার সাথে অফিস রুমে জোরজবরদস্তি করতে দেখি।যে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।আমি প্রথমে ভরকে গিয়েছিলাম।….. প্রক্টরকে জানাবো বলে হুমকি দিয়েছিলাম।”

-“তারপর?”

শাবাবের তারপরের জবাব দিলো না জিল্লুর সাহেব।মুখে বিশাল তালা এটে নিলেন। কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো শাবাব।তবে তিনি তার নীরবতায় অনড়।এবার চাপ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয় শাবাব।

গান জিল্লুর সাহেবের সামনে রেখে বললো,

-“একটা গুলি অবশিষ্ট এই গানে।আপনি অবশ্যই চাইবেন না প্রবীণ বয়সে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরলোক গমন করেন।”

-“বলছি!” হুমকির মুখে আতংকগ্রস্ত হয়ে বলে উঠে জিল্লুর সাহেব।

শাবাব বললো, -“শুরু করেন আবার”

“প্রশ্নপত্র ফাঁস এর আরোপ ছিলো আমার উপর।যা কোনোভাবে প্রমাণসহ রাজিন জেনে যায়।…সেই সূত্র ধরে উল্টো আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে।….আমি চুপ হয়ে যাই ঠিক তখনই।আমি আপনাদের কাছে হাত জোড় করছি। প্রশ্নপত্রের কথা কাউকে বলবেন না। সেটা আমার ভুল ছিল আমি স্বীকার করছি।তবে সেই প্রশ্নে স্টুডেন্টদের পরীক্ষা হয়নি আর।”

-“পরপর দুটো ভুল করেছেন।তারপরও ক্ষমা আশা করছেন?”

-“প্লিজ আমায় ক্ষমা করুন।আমি এখন রিটায়ার্ড।শুধু পেনশন পাই।আমার ভাগ্য থেকে সেটাও উঠে যাবে।”

-“পেনশন আপনার প্রাপ্য না।যে থালায় খেয়েছেন সেখানেই ছেদ করেছেন।আপনার সাময়িক ব্যবস্থা আমি করব।তার আগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যান নিজের।আপনার চ্যালাকে ডাকেন।তাকেও বলেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে।”

জিল্লুর সাহেব আকুতি জানিয়ে শাবাবের পানে চেয়ে হাত জোর করলো।বললো,

-“প্লিজ”

-“চুপ! যা বলেছি করেন।”

আবির হন্তদন্ত হয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলো।কেস সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য দেওয়ার আছে।এই বিষ কি দিয়ে তৈরি সেই সন্ধান পেয়েছে সে।গতরাতে নেট জগৎ পুরো তোলপাড় করে আশানুরূপ ফলাফল পায়।দ্রুত জিল্লুর সাহেবকে বিদায় করে গোল টেবিলে বসলো ল্যাপটপ নিয়ে।চেয়ারে বসে মনোযোগী হলো। পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে রবিন আর শাবাব।উভয়েই টেবিলে একহাত রেখে ঝুঁকে চোখ গাড়লো ল্যাপটপ স্ক্রিনে।

আবির শাবাব আর রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“বিষটা কার্মিকা প্লান্ট এর বীজ থেকে তৈরি।খুব রেয়ার।ইউরোপিয়ান কান্ট্রির হিমশীতল স্থানগুলোতে পাওয়া যায়।যেখানে সারাবছর বরফ পরে।সাথে মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট সেই স্থানের মাটি ভিন্ন।আমাদের দেশের পরিবেশ আর মাটিতে এই প্লান্ট হওয়ার কোনো চান্স নেই।কাইন্ড অফ ইম্পসিবল।আমি সন্দেহ করছি প্লান্ট এর বীজ পিষে রস বের করে ড্রাগ এর সাথে মিশ্রিত করা হয়েছে।যা দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।আর এর ডোজ কম আর বেশি নির্ধারণ করে যার শরীরে প্রবেশ করেছে সে কতক্ষন বাঁচবে।বাঁচবে নাকি মারা যাবে। প্রফেসর এর দেহে পরিমাণ কম ছিলো যার কারণে আমরা তাকে বাঁচাতে সক্ষম হই।”

-“এর এন্টিডোট নেই কোনো?” শাবাব জানতে চাইলো।

-“আছেতো।ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো এই গাছের পাতাই এর এন্টিডোট। রুফারমিল নামক একটা মেডিসিন আছে যা অনেকাংশে বিষ এর সাথে মোকাবেলা করতে পারে।তবে পয়জন এর মাত্রার উপর নির্ভর করে মেডিসিন এর কার্যকারিতা।”

(উপরিউক্ত গাছের, মেডিসিন নাম,বর্ণনা সবটা কাল্পনিক।কার্মিকা নামক কোনো প্লান্ট পৃথিবীতে নেই)

রবিন অবাক সুরে প্রশ্ন করে, -“এটা কিভাবে সম্ভব?যে গাছের বীজ বিষাক্ত আর পাতা উপকারী?”

আবির জবাব দেয়,

-“সম্ভব।বরফে থাকতে থাকতে এক সময় পাতাগুলো নষ্ট হয়ে যায়।তখন পাতা তার বিষাক্ততা হারায়।আর সেটাই হয়ে উঠে এই বিষ এর এন্টিডোট”

-“ইউরোপিয়ান একটা গাছ বাংলাদেশে কিভাবে?” রবিন প্রশ্ন তোলে।

শাবাব একটা শব্দও করলো না।মস্তিষ্ক জুড়ে চলছে অন্য চিত্র।মাছির মতন ভনভন করতে শুরু করেছে বিশেষ বিষয়। বারবার সন্দেহের তীর একদিকে গিয়ে কেনো ঠেকছে?নাকি নিজে থেকে টেনে নিচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তি? হিসাবে তালগোল পাকানোর পূর্বে সঠিকভাবে মনে করতে শুরু করলো সবটা।শুরু থেকে।

আবির রবিনের উদ্দেশ্যে বললো, “সেটাই আমিও ভাবছি।”

-“এর উত্তরতো গাছ প্রেমীরাই দিতে পারবে তাই না?” আকস্মিক রাশভারী গলায় বলে উঠে শাবাব।

তদন্তকারী ধীশক্তি। ছল, বল,কৌশল সবটা চট করে ধরে ফেলে। কাঁটা ঘুরে গেলো আরো একজনের দিকে।ঠিক কি সন্দেহ?নাকি বিশ্বাস।নাকি গল্পের ঘুরে যাওয়া কোনো মোড়? ঘনঘন নিঃশ্বাসের গতি রেখা চিত্র একে নিলো।দেখা হবে পূনরায়।আবার!সেদিন বলা হয়েছিলো।

-“ভাগ্যে থাকলে?আবার দেখা হবে”

__

সদ্য গোসল করা ফর্সা বদন বেয়ে মুক্ত ঝড়ছে।চুলের দৈর্ঘ্যতো স্বল্প।সাদা রঙের তোয়ালের বদৌলতে অর্ধ শুকিয়ে এলো।ছোপ ছোপ ভেজা কাপড়টাও বাতাসে উড়তে লাগলো। তোয়ালের ঠায় নিলো লম্বা দড়িতে।দেহের ওড়না সামলে পেছনে তাকাতেই ভীত হয়ে উঠে।কল্পনার বাহিরে কাউকে দেখে সাহস দৌড়ে পালায়। লিয়ানার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।শীতল বাতাসে নেত্র সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শাবাবকে উপলদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে নিলো।

শাবাব হেঁসে বলে, -“হাই”

-“আপনি?….আবার এসেছেন কেনো?”

একে একে মির্জা, সাইফা,রবিন,আবির হাজির।সকলের মুখে হাসি। অবাক হয় লিয়ানা।লিয়ানার প্রশ্নের জবাবে শাবাব এগিয়ে এসে বললো,

-“আপনাকে খুব মিস করছিলাম আমরা সকলে।তাই এসেছি।”

ছলাৎ করে উঠে সাইফার হৃদয়।সে জানে কেনো এসেছে।তারপরও শাবাবের এমন বাক্য তাকে অস্থির করে তুললো মুহূর্তের মধ্যে।পেছনে হাত বেঁধে কাটকাট হয়ে দাঁড়ালো। নড়বড়ে হলেতো চলবে না।

লিয়ানা সর্বদার ন্যায় বাঁকা হাসে।বলে,

-“কোনো ফন্দি এঁটেছেন অফিসার শাবাব?”

-“আপনার কি মনে হয়?”

-“দেখেতো মনে হচ্ছে বিশাল ফন্দি এঁটেছেন।”

-“তাহলে তাই।….বাচ্চাদের কি খবর?স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন?”

-“হুম”

-“ভেরি গুড!আসুন আমাদের চা নাস্তার ব্যবস্থা করুন।”

এই স্থানে নিজের আধিপত্য ভেবেই হেঁটে হেঁটে ভিতরের দিকে এগিয়ে গেলো শাবাব।বোকার মতন চেয়ে আছে লিয়ানা।বাকিরা ভাবছে।লিয়ানার সঙ্গে যাবে নাকি শাবাবের পিছু নেবে। সাইফার দিকে নজর গেলে সাইফা চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো।

বললো, -“চলো”

আশ্রমের মানুষ আবারো শাবাব, সাইফা,রবিন,মির্জা এবং আবিরকে দেখে চিনে ফেলে তৎক্ষনাৎ।কিছু মানুষ চেয়ার টেনে দিলো তাদের জন্য। অতিথি আপ্যায়নের তোড়জোড় শুরু করলো দুই নারী। লিয়ানা এখনও ভাবছে।তার এখানে পূনরায় আসার কারণ কি?কোনো উদ্দেশ্যবিহীন কখনোই আসবে না।জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলো তাদের দিকে।

মির্জা শান্তভাবে হ্যান্ডেল করার উদ্দেশ্যে লিয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,

-“ঠিক ধরেছেন।আমরা কাজেই এসেছি।আপনার সাহায্য দরকার।”

লিয়ানা প্রশ্ন করে ধিমা গলায়, -“কেমন কাজ?”

শাবাব মির্জাকে টপকে বলে উঠলো, -“গাছ ভালোবাসেন তাই না?অবশ্যই গাছের পরিচর্যা জানেন।”

শাবাবের দিকে চেয়ে লিয়ানা জবাব দেয়, -“না জানার কি আছে?”

-“কি কি গাছ আছে আপনার কাছে?”

-“কেনো জানতে চাইছেন?”

লিয়ানার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে শাবাব আবার বললো,

-“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।কি কি গাছ আছে আপনার কাছে।”

লিয়ানা বিরক্ত হয়।মুখে গুমোট ভাব।বলে উঠে ক্লান্তিমাখা গলায়,

-“প্রয়োজনীয় সব গাছ আছে।”

-“কার্মিকা গাছটাও আছে?”

কপালের ভাঁজ গাঢ়তর হয় লিয়ানার।মুখটা ফুলে আছে।লালাভ বর্ণ ধারণ করা নাকের ডগা।গলার স্বরে রুষ্টতা মিশ্রিত করে বললো,

-“কার্মিকা নামে কোনো গাছ আছে?”

আবির উত্তর দিলো,

-“আছে। ইউরোপিয়ান গাছ।বরফে ঢাকা শীতল অঞ্চলে হয় এই গাছগুলো।অনেকটা বিষাক্ত আর রেয়ার!”

আবিরের দিকে আড়চোখে চেয়ে তার কথা শুনলো লিয়ানা।পরপর নজর দিলো শাবাবের দিকে।বুকে হাত বেঁধে চেয়ারে পিঠ ঠেকায়।

বলে, -“কেস বাদ দিয়ে গাছ বিশেষজ্ঞ হওয়া হচ্ছে?”

শাবাব তার উত্তরে বলে, -“হয়তো এই গাছ এর সূত্র ধরেই আপনার মতন অসুস্থ মস্তিষ্কের কোনো অপরাধীকে ধরা যেতে পারে”

-“আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

-“বাংলাদেশে কি এই গাছের উৎপাদন সম্ভব?”

লিয়ানা আশ্চর্য্য না হয়ে পারলো না।এই ক্ষুদ্র একটা বিষয় ধরে এখানে এসেছে?সন্দেহ করছে?নাকি সাহায্য নিতে এসেছে?

-“আমাকে উদ্ভিদবিজ্ঞানী মনে হয় আপনাদের?আমি অবাক হচ্ছি আপনারা কোনো এক্সপার্ট এর কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসেছেন।”

শাবাব মাথা নামিয়ে স্মিথ হাসে। নির্ভয় মুখভঙ্গি বজায় রেখে লিয়ানার দিকে চেয়ে বলল,

-“এত কাঁচা খেলোয়াড় মনে হয় আমাদের শেওলা? এক্সপার্ট এর কাছে না গিয়েই আপনার মতন পাগলের কাছে এসেছি?”

-“তাহলে আমার দ্বিতীয় ধারণা ঠিক।নিজের নিরর্থক আক্রোশের জেরে আমাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলছেন।”

-“আপনার সাথে আমার আক্রোশ সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।আমার কেস এর বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।এটা আমার দায়িত্ব।নিজেকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বিরত রাখিনি।মুখে প্রকাশ না করলে চোখের মধ্যে সব আবদ্ধ করছি।একেক করে ঘাড় চেপে ধরবো নাহয়?”

-“আমাকে এসব বলার অর্থ কি?”

সোজাসুজি উত্তর দেয় শাবাব, -“আপনার বাগান সার্চ করতে চাই।সাথে এই আশ্রমটাও”

মধ্যে-মধ্যে আবেগ আর আত্মসম্মানবোধটা উদ্দীপিত হয়ে উঠে লিয়ানার। ইহজগতের মায়া থেকে দূরে থেকেও এই ইহজগতেই তার বাসস্থান।নিজেকে অন্য জগতে বসবাসকারী হিসেবে গণ্য করলেও বাস্তবতা এটাই।সেও রক্ত মাংসে গড়া এক মনুষ্য।নিজ সুখের জন্য পাড়ি জমায় অন্য রাজ্যে।তাই বলে কি আশ্রম নিয়ে তার কোনো অনুভূতি নেই?

কটমট করে চাইলো লিয়ানা।শক্ত গলায় জবাব দিলো,

-“এখানে অনেক বৃদ্ধ আর বাচ্চারা আছে অফিসার!”

-“সেসব আমরা ভেবে চিন্তেই এসেছি।নিজেদের মতন কাজ করবো। টের পাবে না তারা।আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো শেওলা?”

গরম নিঃশ্বাস ফেলে লিয়ানা বলে উঠলো, -“ওয়ারেন্ট এনেছেন?”

পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে লিয়ানার দিকে এগিয়ে দিলো।সার্চ ওয়ারেন্ট এটা।আগে এই পেশায় থাকা সূত্রে এক দেখায় লিখিত সবকিছুর অর্থ বুঝতে সক্ষম।

-“যদি কিছু না পান অফিসার?কি মাশুল দিবেন?”

-“আমার কাছে মাশুল চাইছেন?আইনি কাজ এগুলো জানেন না?…..অথচ আপনার লাইব্রেরীতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অহরহ বই।আর সেই বইগুলোর মধ্যে একটি বইয়ে উপকারী গাছের সাথে বিষাক্ত গাছের নামও ছিলো।…..একা চোরের মতন রাত জেগে আমার বই পড়ার শখ এভাবে আমার কেসকে টার্নিং পয়েন্ট দিবে ভাবতে পারিনি।”

লিয়ানা সরু দৃষ্টিপাত করে শাবাবের দিকে।বলে উঠলো,

-“সেখানে আরো বই ছিলো।আপনার কেনো সেগুলো চোখে পড়লো না?”

-“ক্লু পাবো তাই ভাগ্য সহায় হয়েছে।”

-“দৃষ্টি ভ্রম!যেই সংখ্যাকে আপনি আপনার দিক থেকে নয় দেখছেন আমি সেটাকে দেখছি ছয়।”

নীতি পূর্বপরিকল্পিত।এবার শুধু সেটাকে কার্যকর করার পালা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের প্রারম্ভিক অংশে মিশে গেলো সবার মাঝে অতিথি হয়েই।চোখের ধুলো দিয়ে একেক করে সবকিছু চেক করছে।বিশেষ করে লিয়ানার ঘরে।তারপর লাইব্রেরীতে কড়া সার্চ চালালো শাবাব আর সাইফা।আবির বাহিরে প্রত্যেকটা গাছ থেকে কিছু নমুনা গ্রহণ করছে।

শাবাব সাইফাকে ইশারা করলো।নিজের ঘরে থম মেরে বসে আছে লিয়ানা। শাবাব বললো,

-“ওই শেওলা পাগলের দরজার কাছে গিয়ে দাড়াও ”

সাইফা জানতে চায়, -“কেনো স্যার?”

শাবাব তার হাতে মুঠ করে রাখা চাবিটি দেখিয়ে বললো,

-“এই চাবিটা লুকানোর চেষ্টা করছিলো সে।আমার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই এখানে কোনো সিক্রেট রুম আছে। ভারী ছল জানে এই মেয়ে।হয়তো চাচ্ছিলো না আমরা সেটা খুঁজে পাই।কিছুক্ষনের জন্য ওর দরজার বাহিরে দাড়াও।কোনোভাবে যেনো বাহিরে না আসে”

-“কিন্তু স্যার?”

-“আমার কথার উপর কথা বলা পছন্দ না”

শাবাবের কথামত কাজ করলো সাইফা।দরজার দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ।ঠিকঠিক আন্দাজ করে নিলো লিয়ানা।তবে মুখ ফুটে একটা কথাও বললো না।চুপ করে রইলো আভাস পেয়েও।অন্যদিকে শাবাবের সন্দেহ কিছুটা সঠিক প্রমাণিত হয়।কোনো হিডেন রুম না থাকলেও একটা লুকায়িত সিন্দুক আছে লাইব্রেরি রুমে।একগুচ্ছ চাবি ট্রাই করতে করতে একটিতে খুলে যায়।ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি পুরনো এলবাম। জোরালো বাতাসে দরজা বারি খায়।সাইফার হাতেও লেগেছে কিছু অংশ।ব্যথা উপেক্ষা করেই দরজার লকে হাত রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। লক হয়ে গেছে।আকাশের গুড়ুম গুড়ুম ডাকে ভীতিকর পরিবেশ। আকষ্মিক বজ্রপাতে ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়ে আশ্রম ঢেকে গেলো আধাঁরে।এত সময় চুপচাপ বসে থাকা লিয়ানা একলাফে উঠে দাঁড়ালো।এই দরজার লক নষ্ট মনে পড়তেই দৌড়ে আসে দরজার দিকে।

দৌড়ে আসে দরজার দিকে। শাবাবও ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে বললো,

-“দরজা বন্ধ কেনো?”

আতঙ্কিত সুরে সাইফা বলে উঠলো, -“স্যার লক হয়ে গেছে!”

ঠিক তখনই কান্নারত গলায় আওয়াজ আসে দরজার ওপাশ থেকে।লিয়ানা বলে,

“দরজাটা খুলে…দাও।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অফিসার শাবাব?.. সাইফা…”

বাতাসের সাইসাই আওয়াজে কিছুই পরিষ্কার শোনা গেলো না।সাইফা বাহির থেকে চেঁচিয়ে বললো,

-“ভেতর থেকে খোলার চেষ্টা করো লিয়ানা।”

দরজার হাতল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেষ্টা করলো।পারলো না।আবারো একই সুরে লিয়ানা বলে উঠে,

-“পারছি না।…প্লিজ সাইফা আমাকে বের করো।আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে।”

শাবাব চেঁচিয়ে বললো, -“চাবি কোথায়?”

-“সেটা আপনি নিয়ে গেছেন উপরে স্যার”

লিয়ানার কন্ঠস্বরের আকুলতা দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।ভয় পেয়ে গেছে সে। শাবাব এলবাম ফেলে দৌড় লাগায় দোতলায়। হাতের থাবায় নিচে পড়ে থাকা চাবিটি তুলে নিয়েছে। আধাঁরে বেখেয়ালিতে পড়ে গিয়েছিল।পায়ের গতি বাড়িয়ে নিচে নেমে আসে।

দরজায় একটার পর চাবি ট্রাই করছে শাবাব। যুদ্ধ করছে রীতিমত।রবিন মির্জা এসে হাজির। অবশেষে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সাইফা। দ্রুত গতিতে কেউ তাকে জাপ্টে ধরলো “মা” শব্দটি উচ্চারণ করে।এটা লিয়ানার কন্ঠস্বর। ফুপাচ্ছে রীতিমত। শ্বাসটা অব্দি নিতে পারছে না ঠিকমত।

সাইফা গালে হাত রেখে বলল, -“ভয় পেও না লিয়ানা।কিছু হয়নি”

লিয়ানার সবুজ মণিযুগল ছলছল করছে।ফোনের আলোয় জ্বলজ্বল করা চোখ। ভীত, সন্ত্রস্ত। সাইফা পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে তাকে।লিয়ানা আকস্মিক বলে উঠলো সাইফার দিকে চেয়ে,

-“মা আজও আসেনি না?…মা কখনো আসেনা।আমি আঘাত পেলেও আসেনা।অবহেলা করে শুধু।আমি কি অপরাধ করেছি?” বলেই ঢুলে পড়লো সাইফার গায়ে।

চলবে…

“আ না ম”- ২০
-Azyah সূচনা

পালস রেট চেক করলো মির্জা।গাড়ি থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র এনে প্রেশারটাও মেপে নিলো।প্রেশার লো। তাছাড়াও ভয় পেয়েছে অনেকটা।হয়তো আবদ্ধভীতিও রয়েছে। ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার কারনেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।তাকে বিছানায় শুইয়ে মাথার পিছন থেকে বালিশ সরিয়ে নেওয়া হয়।মির্জা ব্যতীত সেখানে কেউ ঘেরাও করে দাঁড়ালো না আর।হাওয়া বাতাস গায়ে আসার ব্যবস্থা করে দিলো। গালে কয়েকবার হাত দিয়ে অত্যন্ত ধীরে চাপড়ে দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলে মিনিট দশেক এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে লিয়ানার। আস্তে আস্তে চোখ খুলে চেয়েছে লিয়ানা।সম্মুখে সবকিছু ঝাপসা মনে হচ্ছে।কয়েকদফা চোখের পলক ফেলে।সবটা পরিষ্কার হতেই দেখলো মির্জা বসে আছে।

মির্জা প্রশ্ন করলো নরম গলায়, -“ঠিক আছো লিয়ানা?”

জড়ানো কন্ঠে লিয়ানা বললো, -“পানি দিবেন একটু?”

শাবাব হাত বাড়িয়েছিলো পানির জগের দিকে।তার আগেই সাইফা নিয়ে নেয়।খানিকটা বিরক্তবোধ করলেও প্রকাশ করলো না শাবাব।সং সেজে দাঁড়িয়ে রইলো তার জায়গায়। বৃদ্ধাশ্রমের কেউই এই ঘটনার আভাস পায়নি।আবির গিয়ে দেখে এসেছে তাদের।তৃতীয় তলায় তারা যে যার মতন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।পনেরো মিনিটের ব্যবধানে ইলেকট্রিসিটি চলে আসায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।সাইফা লিয়ানার পাশে বসে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো।পানি পান করে যেনো শুঁকনো মরুভূমির মতন গলাটা সস্তি পেলো।

মির্জা বলে উঠলো,

-“অনেক দুর্বল তুমি।খাওয়া দাওয়া করো না ঠিকমতো।প্রেশার কত লো জানো?”

কোনো জবাব দিলো না লিয়ানা। ঠোঁট কামড়ে বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে আছে।মুখ দেখে মনে হলো বড্ড বিষণ্ণ তার মন।কান্নার কারণে ফুলে আছে মুখটা।

মির্জা বললো,

-“সাইফা?তুমি কিচেনে গিয়ে এক গ্লাস দুধ আনতে পারবে লিয়ানার জন্য?প্রেশার অনেক লো ওর”

পরপর লিয়ানার দিকে চেয়ে বলল,

-“ওকে বলে দাও কোথায় কি রাখা আছে”

লিয়ানা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ছোট করে জবাব দেয়, -“ফ্রিজে”

আবির দ্বিতীয়বারের মতন উপরের ফ্লোরগুলোতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে আসলো। শাবাবের মুখোমুখি হতেই শাবাব প্রশ্ন করে,

-“অল ওকে?”

-“হুম ঠিক আছে” উত্তর দেয় আবির।

শাবাব বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সাইফার কিচেনে বেশি একটা কাঠখড় পোহাতে হলো না। কিছুদিন আগেইতো থেকে গেছে এখানে।কিছু কিছু জিনিসের সাথে পরিচিত।গরম দুধের সাথে রাতের খাবারটাও বুদ্ধি খাটিয়ে নিয়ে আসে লিয়ানার জন্য।আসার পথে শাবাবকে এলবাম হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কোনো প্রশ্ন করেনি সাইফা।চোখ নামিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে।

সাইফাকে লিয়ানার সাথে আজ রাতটা রেখে মির্জা বললো,

-“খেয়াল রেখো।কোনো সমস্যা হলে ডাকবে।”

মির্জা বেরিয়ে আসে।চোখ বুলিয়ে দেখলো আশপাশ। শাবাব মহোদয়ের হদিস নেই কেনো?ছোটোখাটো একটা চিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো।তখন থেকেই ভারী চুপচাপ সে।খুঁজতে লাগলো মির্জা।নিচ তলায় না পেয়ে উপরে চলে যায়। লাইব্রেরী বেয়ে কিছু আওয়াজ শুনতে পেলে পা বাড়ালো সেখানে।দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো ভিন্ন দৃশ্যপট।জমিনে পড়ে থাকা কয়েকটি বই তুলে শেলফে সাজিয়ে রাখছে শাবাব। মির্জার উপস্থিতি টের পেয়ে একপলক চেয়ে আবার দৃষ্টি ঘোরায় শাবাব।বই গোছানোর কাজ শেষে হেঁটে এসে বসলো চেয়ারে।টেবিলের উপর রাখা লাল রঙের ছোট্ট এলবামটা খুলে দেখতে লাগলো।মির্জা আসন গ্রহণ করে তার ঠিক পাশাপাশি।

প্রশ্ন করলো, -“কোথায় পেয়েছো?”

শাবাব জবাব দিলো,

-“শেলফের পেছনে একটা ছোট্ট সিন্দুক ছিলো।ওখানেই পেয়েছি।”

-“খালি দেখাচ্ছে”

শাবাব এক এক করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো।কিছুই নেই। দশ বারো পৃষ্ঠা খালি পাওয়ার পর হঠাৎ একটি ছবি ভেসে উঠলো চোখ সম্মুখে। চারজন মানুষের উপস্থিতি এখানে।বেশ পুরোনো ছবিটা। জ্ঞাত হয় দুজন মধ্যবয়স্ক নারী এবং পুরুষ।একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে।মেয়েটির পরনে কনভোকেশন স্যুট।নারীটির পাশে আরো একটি ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে।সাদা রঙের ড্রেস পরিহিত।মায়ের দিকে হাঁসি মুখে চেয়ে। অদ্ভুতভাবে একত্রিত তিনজনের মুখ কলমের গাঢ় কালি দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।শুধু সাদা ড্রেসের মেয়েটির মুখ দৃশ্যমান।

মির্জা প্রখর দৃষ্টি ফেলে বললো, -“লিয়ানা না এটা?”

-“হতে পারে।কিন্তু পাশের তিনজনের মুখ ঢেকে দিলো কেনো কালি দিয়ে?”

মির্জা বাঁকা হাসে। ছবিটি হাতে তুলে দেখলো আরেকদফা। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে রেখেই বললো,

-“ছবিটি ভালোভাবে দেখো শাবাব?”

-“দেখছিইতো ভালোভাবে।হয়তো এরা লিয়ানার বাবা মা আর কনভোকেশন স্যুট পড়া মেয়েটা ওর বোন হবে হয়তো।”

-“হুম ঠিক গেস করেছো।কিন্তু এই ছবির পেছনের গল্পটা তোমার চোখে পড়ছে না।আমি যা দেখছি সেটা তুমি বুঝতে পারছো না।”

শাবাব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে মির্জা আবার বলে উঠে,

-“ছবিটা একটা ক্যান্ডিড পিকচার।দেখো সবাইকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। পুরুষ আর নারীটি হয়তো তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।আরেকটা জিনিস খেয়াল করো।লিয়ানা নারীটির হাত ধরার চেষ্টা করছিলো হয়তো।কিন্তু সে হাত এমন একটা পজিশনে উচু করে রেখেছে যেনো সে চায় না লিয়ানা তার হাত ধরুক।….কতটা নির্বোধ দেখাচ্ছে লিয়ানাকে।হাসি মুখে যাকে জাপ্টে ধরে সেও ফ্যামিলি পিকচার অংশ হতে চেয়েছিলো?তাকে খুব অবহেলায় দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

শাবাব ভ্রূ কুচকে শুনলো সবটা কথা।কিছু সময় পর বলে উঠলো,

-“এমন নাও হতে পারে তাইনা?… মনগড়া কাহিনী বললেইতো হয়না।তুমি বেশি ভাবছো”

-“বেশি ভাবছি না।৭০ শতাংশ হলেও ঠিক ভাবছি।ভুলে গেলে লিয়ানা ভীত হয়ে কি বলেছিলো?তার মা আসেনা।সে আঘাত পেলেও আসেনা।অবহেলা করে।কি অপরাধ তার?”

ছবিটি যেনো মুখ্য বিষয় হয়ে উঠলো শাবাব আর মির্জার আলোচনার।সার্চ চালিয়ে কিছুই পায়নি।তার মধ্যে লিয়ানার হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে পরিবেশ থমথমে।মির্জার মতনই শাবাবও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো ছবিটি। নির্জীব চিত্রের গল্প শোনার চেষ্টা করলো।তবে শুনতে পাচ্ছে না কিছুই।

মির্জা বললো, -“খুব সহজেই কাউকে জাজ করতে নেই। প্রতিটি চোখের পেছনে হাজারো গল্প থাকে শাবাব।হিসাব মিলে যাচ্ছে কিনা বলো?….আমিতো উত্তর পেয়েছি মেয়েটি কেনো সারাক্ষণ কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়।সুখ সন্ধান করে হয়তো।”

-“আমাকে গিল্টি ফিল করাতে চাচ্ছো?”

-“যদি বলো সন্দেহ করেছো বলে আমি এসব বলছি?তাহলে আমার জবাব না।এটা তোমার কাজ।কিন্তু তোমার যে লিয়ানার প্রতি অহেতুক ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে।সেটা কমাও।ওকে পছন্দ না হলে এড়িয়ে যাও। তোমারতো এই স্ট্রেন্থ অনেক বেশি।ইগনোর করার।”

শাবাব মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দেয়, -“হুম”

___

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে চট্টগ্রাম এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে পুরো টিম।আসার পূর্বে লিয়ানাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।মির্জা আর ডাক্তারের সম্মিলিত আলোচনায় বোঝা যায় মানসিক অস্থিরতার সাথে সাথে শারীরিকভাবেও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলো তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করছে।লম্বা পথ পেরিয়ে চট্টগ্রামে হাজির।আসার পথে লিয়ানার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আনা হয়। অনিচ্ছাস্বত্বেও।পাশাপাশি প্রত্যেকটি সন্দেহজনক গাছের স্যাম্পল।আবির বিশ্রাম নিলো না।সাদা এপ্রোন,গগলস আর মাস্ক, গ্লাভস পড়ে ল্যাবে ঢুকে গেছে টেস্ট করার উদ্দেশ্যে। প্রথমেই লিয়ানার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর চিঠিতে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে নিলো। ম্যাচ হয়নি চেঁচিয়ে জানালো আবির।

রবিনের ফোনে ফোন আসলো।জুনিয়র অফিসাররা কল করেছে।রবিন ফোন রিসিভ করেই জানতে চাইলো,

-“এ্যানি আপডেট?”

রেজা বললো, -“ইয়েস স্যার!…. জারা নামক মেয়েটা খুলনার।এখানে তার মা এবং ছোট ভাই আছে।বয়স হবে আঠারো,উনিশ।ছোট ভাই স্বাভাবিক নয়।মেন্টালি আনস্ট্যাবল।অটিজম যাকে বলে।”

রবিন বলে উঠে, -“কোনো সাস্পেসিয়াস একটিভিটি?”

-“তার মায়ের তেমন কোনো সাস্পেসিয়াস একটিভিটি দেখিনি।কিন্তু ওর ভাই আবোলতাবোল কথা বলে।বলে সে নাকি তার বোনকে দেখতে পায়।কথা বলে তার সাথে।আমরা যতক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেছি ততক্ষন শুধু একটা কথাই বলছিলো ‘আমার আপু কাঁদছে’।তারপর বলেছে ‘আপু কেঁদো না আমি আর মা তোমার কাছে আসছি’তারপর আবার বলছে সব ধ্বংস করে দিবে সে।তেজী একটা ভাব দেখা যায়।”

সন্দেহ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাদের এখন।ক্লু পাচ্ছে তবে কোনো কাজেই দিচ্ছে না।এবার সরাসরি সন্দেহ গেলো জারার ছোট ভাইয়ের উপর।রবিন আদেশ করলো,

-“খুলনার ডক্টরের শরণাপন্ন হও জারার ভাইকে নিয়ে।এটা শিউর হও ছেলেটা আসলেই মানসিকভাবে আনস্ট্যাবল নাকি সবকিছু একটা সাজানো নাটক”

-“জ্বি স্যার।”

-“দ্রুত।সময় অপচয় হয়ে গেছে এমনেতেই অনেক”

রবিন কথা শেষে সমস্ত কিছু খুলে বললো শাবাব আর বাকিদের।সাব্বির এর কথামত প্রাথমিকভাবে ধরে নিলো ‘আনাম’ একজন পুরুষ।আর জারার ছোট ভাই এর মানসিক অবস্থা।দুটোই কেমন যেনো অনেকাংশে মিলে যাচ্ছে। আসলেই কি মানসিকভাবে অসুস্থ সে?নাকি সবটাই ছলনা।বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে?

শাবাব প্রশ্ন করে,

-“ছেলেটার মেন্টাল কন্ডিশন একবার জানা হলেই আমরা ওর দিকে মনোযোগী হবো।আমার মন বলছে এই ছেলের মধ্যে ঝামেলা আছে”

রবিন বলল,

-“ছেলের মধ্যে ঝামেলা আমিও আন্দাজ করছি।কিন্তু যদি সে মারতেই চাইতো তাহলে প্রফেসরকে আগে মারতো।বাকিদের সাথে তার কি শত্রুতা থাকতে পারে?”

শাবাব বললো,

-“তাও ঠিক।….আরেকটা বিষয় ভুলে গেলে হবে না।তেইশ সেপ্টেম্বর।কিছু একটা ঘটতে চলেছে তেইশ সেপ্টেম্বর।”

ক্যালেন্ডার এর নজর গিয়ে ঠেকে।গুনেগুনে পঁচিশদিন বাকি।চিঠিতে বলেছিলো।দেখা হবে হয়তো।সে কি সত্যিই খুন করা থেকে ছুটি নিলো?নাকি আরো কোনো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা চলছে এর পেছনে। দৌড় ঝাঁপ করাচ্ছে পুরো টিমকে।একের পর এক ধাঁধায় ডুবিয়ে রাখার পর নিজ থেকে আল্টিমেটাম দিলো।

-“পঁচিশ দিন কি তাহলে অপেক্ষা করবো?” আবির জানতে চায়।

-“কক্ষনো না!চিঠিটা ভালোমত পড়েছো?দেখেছো কি বলেছে সে?আরো অনেক অনেক অপরাধ হচ্ছে।আমরা যা সন্দেহ করছি আর ওই লিয়ানা যে পয়েন্টটা আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে সেটা আর রুবির পালিয়ে বেড়ানো, জারার মৃত্যু,ওর ভাইয়ের পাগলামো ঠিক সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।”

রবিন বলে উঠলো, -“এরমানে আবার এই নৃশংসতা
ঘটলে আনাম ফের হিংস্র হয়ে উঠবে।”

শাবাব উদ্দীপিত গলায় বলে উঠে, -“এক্সাক্টলি!আর অপরাধটা ঘটাবো আমরা।সব রেডি?”

এত গম্ভীর থমথমে আলোচনায় চিৎকার করে খুশি উদযাপন করতে ইচ্ছে হচ্ছে।এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। ভাগ্য সহায় খুনি তাদের নজরে নজরে রেখেছে।নয়তো পরবর্তী শিকারের তালিকায় ফাহাদের নাম উঠতো।চিন্তায় মগ্ন ফাহাদকে জাগায় সাইফা। হাতে ধাক্কা দিতেই সে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

-“রেডি স্যার”

___

স্মৃতি সবটা কুড়িয়ে নিচ্ছে মির্জা।তুলতুলে হাতে তুলে দিলো রুবির।কেমন যেনো এক জড়তা তাদের মধ্যে।আবারো এক হতে চেয়ে অস্বাভাবিক একটা ভাব থেকেই যায়।সেই গাছের নিচে আবারো দেখা তাদের। হাতে সময় আধ ঘণ্টা।অল্প সময় নিয়ে এসেছে।পুরোনো স্মৃতির সাথে নতুন কিছু মুহূর্ত যোগ করতে।ইট পাথরের রাস্তাটা ভেজা।এবছর বৃষ্টির জোর বেশি।কখনো উজ্জ্বল ঝলমলে রোদ কখনো শীতল বৃষ্টি।

এক বিশাল সময়ের নীরবতা কাটিয়ে রুবি প্রতিবেশের ন্যায় ঠান্ডা গলায় বললো,

-“ভেবেছিলাম আমার প্রতি অনেক কঠোর হয়ে গেছো এতদিনে”

-“হয়ে গিয়েছিলাম”

-“আবার চাইছো যে আমাকে?”

-“তুমি চাও না?”

-“চাই….তবে তোমার প্রতি করা অন্যায় আমাকে সারাজীবন দোষী করে রাখবে।”

নিচ থেকে বৃষ্টিতে ভেজা এক শুকনো পাতা কুড়িয়ে নিলো মির্জা।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো।রুবির নজরে পড়েছে এই দৃশ্যটি।যার কোনো অর্থ নেই। নিরর্থক কর্মকাণ্ড।

-“ভুল বুঝতে পেরেছো।এতেই চলবে।…. রুবি আমি আগের মতনই আছি।আবার ছেড়ে যাবে?”

-“দ্বিতীয়বার অপরাধ করার মতন সাহস অবশিষ্ট নেই। যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছি মানুষের মন ভেঙে।আমাকে গ্রহন করো আর না করো।আমি এমনই থাকবো সবসময়।”

বোকার মতন শুকনো পাতা রুবির দিকে এগিয়ে দিলো মির্জা।এই দেখে হাঁসি ফুটেছে রুবির মুখশ্রীতে।কি করবে এই পাতা দিয়ে?তারপরও সাদরে গ্রহণ করলো।

মির্জা আকাশ পানে চেয়ে বললো,

-“পুরুষের বাহ্যিক রূপ যতটা কঠোর?প্রেমিক হিসেবে সে ঠিক ততটা দুর্বল।প্রেমে ওই শক্ত দেহটাও ভেঙে চুরমার হয়।বাচ্চাসুলভ আচরণ প্রকাশ পায় তার মাঝে”

চলবে…