অপ্রিয় রঙ্গনা পর্ব-৩০+৩১

0
220

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩০

ভোরের মিঠা রোদ!
বহুদিন পর এমন একটা মিষ্টি রোদের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো তাখলিফের। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসে দেখলো পাশে ঝুমুর নেই। হয়তো সকালের নাস্তা বানাচ্ছে বোকাটা। তাখলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলো। টবে ছোট ছোট রঙিন ফুল ফুটেছে। রোদের আলোয় সাদা রঙের ডেইজিগুলো মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। গোলাপগুলোও দেখতে দারুণ। মিষ্টি সুগন্ধে আশপাশ ভরে ওঠেছে। অনেকদিন বাদে গাঢ় ঘুম হওয়ায় শরীর, মন দুটোই চনমনে লাগছে। এমন ভালো সময়ে ইচ্ছে করেই বিষাদের কথাগুলো ভাবতে চাইলো না তাখলিফ। সকালটা আশ্চর্য সুন্দর। আরো বেশকিছু সময় ব্যলকনিতে কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরুলো সে। কিন্তু ঝুমুরকে পেলো না সে কোথাও। সারা ঘরময় নিঃস্তব্ধতা জুড়ে রয়েছে। ঝুমুর কোথায় খুঁজতে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর। বসার ঘরের বারান্দার দরজায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে ঝুমুর। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে মুখের ওপর। তাখলিফ বড় বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলো। হাঁটু মুড়ে বসে আস্তেধীরে ডাকলো,
“এই বোকা! এখানে বসে আছিস কেন? ঘরে চল।”

তাখলিফের গলা শুনে ঝুমুর মুখ তুলে চাইলো। তাখলিফ ওর অবস্থা দেখে হকচকিয়ে গেলো। তাকানো যাচ্ছে না ওর দিকে। থমথমে চেহারা, রক্তজমাট চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ। সামনের চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে। অশ্রু শুকিয়ে গালে লেগে আছে। এককথায় বিধস্ত অবস্থা। তাখলিফের রাগের পারদ বাড়তে লাগলো ওর এ অবস্থা দেখে৷ কে করলো এসব কাজ ঝুমুরের সাথে? তাখলিফ তো ঘুমিয়ে ছিলো। এটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হলো যে ঝুমুরের এই হাল? ও ঝুমুরের দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ওঠলো, “এসব কি করে হলো? কে করেছে এসব? হাত ভেঙে দেব তার। মেজোআম্মা না ঝিনুক করেছে? উত্তর দে…”

ঝুমুরর আচমকা ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো,
“মা তো হাসপাতালে…”

তাখলিফ বিস্মিত হলো। দাদীর কিছু হয়েছে কি-না ভেবে চমকে ওঠলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ওর দু-গালে হাত রেখে বলল, “কি হয়েছে বল, কান্না বন্ধ কর…”

ঝুমুর ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
“ম মা সুইসাইড এ্যাটেম্প করতে চেয়েছিলো!”

তাখলিফ ভেবেছিলো দাদীর কিছু হয়েছে। কিন্তু এ কথাটা শুনে ও দ্বিতীয় দফায় চমকালো,
“মানে? কখন? কেন?”

“রাতে। সবার সাথে ঝামেলা করে।”

তাখলিফ বিচলিত গলায় বলল,
“আমি কোথায় ছিলাম? ওহ শিট! আমায় ডাকিসনি কেন তুই?”

“আপনি তো ঘুমিয়ে ছিলেন। অসুস্থ তাই আর ডাকিনি। তাছাড়া ওখানে আপনার কোনো কাজ ছিলো না। মায়ের সাথে আমার বোঝাপড়া ছিলো…”

রাগে গলা চড়লো তাখলিফের,
“একটা থাপ্পড় দিবো বেয়াদব। একা একা সাহসিকতা দেখাতে গিয়েছে! মুখ দিয়ে তো কিছুই বের হয় না…এখন কি অবস্থা?”

ঝুমুর ভীতু কন্ঠে বলল,
“জানি না আমি, কিছু জানি না। আমার ভয় করছে।”

তাখলিফ ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। হন্তদন্ত হয়ে ফোন এনে কল করলো ইয়াসিফকে। পুরো ঘটনা জানালো সে তাখলিফকে। সাথে এটাও জানালো পাখি বেগমের জ্ঞান ফেরার পরও বেশ পাগলামো করছিলো।
তাই বাধ্য হয়ে কড়া ডোজের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাকে। আপাতত ঘুমে আছে। তবে গলায় বেশ আঘাত পেয়েছে, ভোকাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কথা বলতে পারেনি জ্ঞান ফেরার পর। ডাক্তাররা অনেকগুলো টেস্ট করছে। দেখবে। এটা নিয়েই ওরা এখন চিন্তিত! সবকিছু শুনে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলো তাখলিফ! এতকিছু ঘটে গেলো আর এই ঝুমুর ওকে কিছুই জানায়নি? ও ঝুমুরকে বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে এলো। সোফায় বসিয়ে পানি এনে দেয়। ঝুমুর সবটা ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। তাখলিফ চেয়ে চেয়ে দেখে ওকে। গালের দাগটাতে আঙুল বুলিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “এবার বল, কে মারলো? মেজোআম্মা?”

ঝুমুর নাক টেনে বলল, “আপু….”

তাখলিফ তড়াক করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো,
“মানে? ও কেন তোকে মারবে? ওর সাহস হয় কি করে তোর গায়ে হাত তোলার? সিরিয়াসলি! তুই পড়ে পড়ে ওর মার খেলি?”

ঝুমুর চুপসে গিয়ে বলল, “তাহলে কি করতাম? আপুকে মারতাম? আপনি তো জানেনই আপুর মাথার ঠিক নেই, আমাকেই দোষী ভাবে।”

তাখলিফ হতাশ হলো,
“কিন্তু তুই তা নোস। আমার ক্ষেত্রে হলে একটা কথা ছিলো, আমি মেনে নিতাম। কিন্তু তুই? তুই তো কিছু করিস নি। মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা।”

“বাদ দিন। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে…”

মানে সিরিয়াসলি? তাখলিফ ক্রোধে উন্মত্ত হলো।
কি দিয়ে গড়া এই মেয়ে? এত সরল মানুষ হয়? যে সে এসে মেরে যাবে আর পড়ে মার খাবে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাকি দিনগুলো কীভাবে সামলে চলবে এই ঝুমুর? ও তেজ দীপ্ত কন্ঠে বলল, “তাহলে আমাকেও বাদ দে। আমি যেটুকু আছি, যারজন্য আছি সে-ই যদি এমন দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে আমি কীভাবে থাকবো? বিষাক্ত সত্য গুলোকে হাতিয়ার করে সকলে যখন আমাকে কথার তীর দিয়ে ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দেয় তারপরও আমি কেন চুপ থাকি, উত্তর দিই না জানিস? কারণ সেগুলো সত্য, অপ্রিয় হলেও সত্য। এরজন্য ওরা আমাকে মারলে, কাটলেও আমি মেনে নিতাম, নেবোও। কারণ ওরা সবাই সঠিক। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে তা না। তুই আগাগোড়া নির্ভেজাল মানুষ। তাহলে তুই কেন মেনে নিচ্ছিস? আমি দুর্বল তাই বলে তুইও দুর্বল হয়ে পড়বি? দিস ইজ নট ফেয়ার ঝুমুর৷ তুই নিজেকে প্রটেক্ট করতে না পারলে আমায় কীভাবে প্রটেক্ট করবি?”

ঝুমুর চোখ ভরা জল নিয়ে তাকালো ওর দিকে,
“কিন্তু আমি যে চাইলেও পারি না…”

“পারতে হবে ঝুমুর। তোকে যে কেউ এসে মেরেধরে যাবে আমার সেটা সহ্য হবে না কিছুতেই। তুই আমার ভালো থাকার একমাত্র ট্যাবলেট। তুই যদি ভালো থাকিস তাহলে আমিও ভালো থাকবো। এটা মাথায় রাখিস।”

ঝুমুর আবেগপ্রবণ হয়ে শুধু বলল, “রাখবো।”

পরক্ষনেই ঢোক গিলে উৎকন্ঠিত গলায় শুধালো,
“মা এখন কেমন আছে?”

তাখলিফ আর বেশি কিছু বললো না ওকে। শুধু উত্তরে বলল, “মেজোআম্মা ঠিক আছে, তবে গলায় একটু সমস্যা হচ্ছে যার জন্য কথা বলতে পারছে না। দেখতে যাবি তো?”

ঝুমুর মাথা নাড়ালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রাত থেকে ভেতরে ভেতরে ভয়ে চুপসে গেছে ও। মায়ের খোঁজ নেওয়ার সাহস পায়নি। হাসপাতালে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রমিলা, নিশিরা যেতে দেয়নি। ভোরে খবর নিয়ে নিশি যখন ওকে জানালো তেমন গুরুতর কিছু হয়নি, তখনই ভেতরটা একটু স্বস্তি পেয়েছিলো। কিন্তু এরপরেও তা পুরোপুরি নয়। শত ভুল, অন্যায় করলেও দিনশেষে মা হয় তো ওর! ফেলে তো আর দিতে পারে না। ওর ও তো কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য! যে মায়ের ছায়াতলে এতগুলো বছর হেসে খেলে বড় হলো তার এমন পরিণতি তো ও চায়নি! শুধু একটু ভালো থাকতে চেয়েছে, চাচ্ছে। অথচ ওকে জন্ম দেওয়া নারীটি কিছুতেই তা হতে দিচ্ছে না। ঝুমুর চুপচাপ চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছিলো। তাখলিফ অবশ্য ওকে সামলে নিলো। খাওয়াদাওয়ার কিছুই হয়নি দেখে সকালের খাবারের বন্দোবস্তটা নিজেই করলো। দু’জনের জন্য ভাত আর ডিমভাজা। কোনোমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাইয়ে দাইয়ে ঝুমুরকে নিয়ে রওয়ানা দিলো হসপিটালের উদ্দেশ্য। ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অবশ্য বেশ বেলা হয়ে গেলো ওদের। এতকিছুর মধ্যেও অন্যদিনের তুলনায় প্রাণবন্ত তাখলিফকে দেখতে ভুল করলো না ঝুমুর।

.

ঘন নীল আকাশ। ফুরফুরে বাতাস। অদ্ভুত সুন্দর রুপ প্রকৃতির! তার মাঝে বিশাল আকাশ পাড়ি দেওয়া মেঘ কুঞ্জও আছে। এমন সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না।
ফোর্থ ফ্লোরের ৫২৬ নং কেবিনে পাখি বেগমকে এডমিট করা হয়েছে। তথ্যটা জেনে নিয়ে ঝুমুরকে নিয়ে এলিভেটরে ওঠলো তাখলিফ। উদাসীন ঝুমুর শুধু শক্ত করে ওর হাত ধরে রেখেছিলো। ওর ভয় হচ্ছে শুধু। ততক্ষণে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে ওরা পৌঁছে গেছে। তাখলিফ ঝুমুরকে বললো পাখি বেগমকে দেখে আসতে। সে অবশ্য করিডোরেই রইলো। ঝুমুর ওর মনোভাব বুঝতে পারলো। তাই আর জোর করলো না। দরজা ঠেলে ঢুকলো সে। দুই কামরার সমান বিশাল কেবিন। একপাশে রোগীর জন্য ব্যবস্থা, অন্যপাশে বাড়তি স্পেস। যেখানে অনায়সেই রোগীর সাথের স্বজনরা থাকতে পারবে। ঝুমুর দেখতে পেলো ওর বড় মামী, ছোটখালা কোকিলা বেগমও আছেন। আর বেডে ঘুমিয়ে আছে পাখি বেগম। তার হাতে স্যালাইন লাগানো। তুসি তার টেস্ট রিপোর্টগুলো দেখছে। ঝুমুরকে দেখে ফাইলগুলো রেখে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। ঝুমুর বিপরীতে
প্রশ্ন করল, “বাবা, ভাইয়ারা কোথায়?”

“ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে। তোমার ভাইয়া ডিসপেনসারিতে গেলো মাত্র।”

“ওহ!”

“তুমি বসো না… ”

বলে ঝুমুরকে বসার ব্যবস্থা করে দিলো। ও গিয়ে মায়ের শিয়রের কাছে বসলো। মাকে এমন নির্জীব দেখতে ভালো লাগলো ওর না কিছুই! চোখ দিয়ে টুপ করে দু-ফোঁটা জল পড়লো। আর ওর খালা, মামী মুখ অন্ধকার করে পরপর খোঁচা মেরে কথা বলতে লাগলো। তুসি একসময় সহ্য করতে না পেরে সরু গলায় বলল, “বড়মামী, এখন এসব বলবেন না প্লিজ। ওর ও তো মা হয়, কষ্ট তো আমাদের ঝুমুরও পেয়েছে। সেভাবে বিচার করতে গেলে মা-ও কিন্তু ওর সাথে কোনো ঠিক কাজ করেনি।”

বড়মামী ধমকের সুরে তুসিকে বললেন, “বউ মানুষ হইয়া অত কথা কও কেন? তুমি অহন ঠিক, ভুল বিচার করবা নাকি?”

তুসি শক্ত গলায় বলল,
“বউ বলে তো মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পারি না মামী।
কিছু ব্যাপারে চুপ থাকা যায় না। আর যেহেতু এটা আমার পরিবারেরই ব্যাপার তাই আমি নিজের অপিনিয়ন রাখতেই পারি, যেটা আপনি পারেন না।”

কোকিলা বেগম খ্যাঁকিয়ে ওঠলেন, “তোমার তো সাহস কম না। রুপের যে ছিরি, কালি ভুত। ঢ্যাঙ্গী মাইয়া। আমার ভাইগ্নাডারে ভুলাইভালাই বশ করছো আবার আমাগোরে কও বাইরের মানুষ?”

তুসি হতবিহ্বল হয়ে গেলো। ঝুমুর অবশ্য এসব বাজে কথা আর নিতে পারলো না। তাখলিফের পেছন তো ছাড়ছেই না এবার ওরা তুসিকেও হিউমিলিয়েট করছে? ও এপর্যায়ে আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। মায়ের কাছ থেকে ওঠে গেলো। খালা, মামীকে যথাসম্ভব আস্তে কিন্তু কঠিন গলায় বলল, “হাসপাতালকে বাজার বানিয়ে ছাড়ছো তোমরা মামী। এসব বন্ধ করো। আর এতকিছুর পরেও এখানে রয়েছো ছোটখালা? আরও কি কুবুদ্ধি দেওয়া বাকি আছে তোমার? এতদূর তো এনেছো, আর কতদূর যাবে বলে বসে আছো? আর কার কার বিরুদ্ধে উস্কাবে মা’কে? আমার স্বামী তো আছেই, এবার ভাবিকেও? তোমরা কি চাও বলো তো আসলে? সবাইকে ভেঙেচুরে দিয়ে, অশান্তিতে রেখে মজা নেবে? শুনে রাখো, এক মাঘে শীত যায় না খালা…”

কোকিলা বেগম অবশ্য ওর কথার তোয়াক্কা করলেন না। ভস্মীভূত নজরে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গেলো ঝিনুকের আকস্মিক চিৎকারে, “তুই? তোর কত্তবড় সাহস যে তুই এখানে আসছিস?”

হকচকিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ঝুমুর। পেছনে ফিরে দেখলো ঝিনুককে। বোনের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “মানে? আমি আমার মা’কে দেখতে আসতে পারবো না?”

ঝিনুক ওকে টেনে দরজার বাইরে বের করে দিতে দিতে বলল, “না পারবি না। বের হ তুই।”

ঝুমুর ঝটকা দিয়ে ওর হাত ছাড়িয়ে শক্ত গলায় বলল,
“না হবো না।”

ঝিনুক রাগে ফুঁসতে লাগলো,
“তোর জন্য মায়ের আজ এই দশা। এখন আবার দরদ দেখাতে এসেছিস? শোন, আমরা তোর এসব নাটক দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই ন্যাকামি না করে বেরিয়ে যা তুই।”

ঝুমুর হতাশ গলায় বলল, “আমার জন্য? সবকিছু জানার পরেও তোমার এসব মনে হয়?”

“মনে হওয়ার কিছু নেই। তুই তোর রুপ দেখিয়ে সবাইকে বশ করে নিস, এটা আর নতুন কি? আমার দেবরকে করেছিস, ভাইয়াকে করেছিস, রাস্তার ছেলেদের করেছিস আসলে তোর তো চরিত্রেরই ঠিক নেই… ”

বোনের কথাগুলো ঝুমুরকে আহত করলেও সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, “আমার না হয় চরিত্রের ঠিক নেই। কিন্তু তুমি? তোমার তো সব ঠিক ছিলো। তাহলে তোমায় কেন মাঝপথে ছেড়ে দিলো দুলাভাই? নিজের ব্যর্থতা মেনে নিতে না পেরে এখন আমায় দোষারোপ করছো?”

ঝিনুক জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকালো। হাত নিশপিশ করতে লাগলো ওর। আক্রমণ করার জন্য হাত বাড়াতেই ঝুমুর এবার সত্যই সেটা মেনে নিলো না। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। বলল, “তুমি এতটাই অমানুষ হয়ে গেছো যে এটা যে হাসপাতাল, তোমার বাড়ি না সেটাও তুমি ভুলে গেছো। মায়ের এমন অবস্থায়ও! আসলে তোমার সাথে যা হয়েছে তা তুমি ডিজার্ভ করতে, সব মেনে নেওয়ার শাস্তি পেয়েছো আর দোষ চাপাচ্ছো অন্যের ওপর! তোমাকে বোন ভাবতে আমার ঘৃণা হচ্ছে আপু…”

ঝিনুক তেড়েমেরে এলো ওর দিকে। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে তুসি এসে ওকে আটকালো। শান্ত করার চেষ্টা করলো। কোকিলা বেগম হায় হায় রব জুড়ে বিলাপ করছেন। ঝুমুর অসহ্য হয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। বড় বলে, নয়তো ঝিনুককে আজ সে একটা থাপ্পড়ই মারতো! ওদিকে ঝিনুক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
.

করিডোরে এসে তাখলিফকে দেখতে পেলো না ঝুমুর। বাবাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলো বাবার কাছে। শামসুল হক মেয়ের বিধস্ত অবস্থা দেখে কি বলবেন ভাষা খুঁজে পেলেন না। মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন, “চিন্তা করিস না। তোর মা ঠিক আছে, কথা বলতে পারবে না শুধু… ”

“এমনটা হোক তা চাইনি আমি। শুধু মায়ের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার জন্যই বলেছিলাম। মা দিনদিন খারাপ পথে পা বাড়াচ্ছিলো….”

শামসুল সাহেব তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
“যা বুঝলাম! তোর মাকে আমরা কেউই আজ পর্যন্ত চিনতে পারিনি রে! এতবছর পর আইসা বুঝেছি তোর মা এতবছর আগাগোড়া একটা খোলসে আবৃত ছিলো। আমি ওকে সরল ভাইবা ভুল করেছিলাম।”

ঝুমুর চোখ মুছলো। বাবার কষ্টটা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু এর প্রতিষেধক ওর জানা নেই। ও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আশেপাশে কোথাও তাখলিফকে দেখতে না পেয়ে বাবার পাশ থেকে ওঠে ইয়াসিফের কাছে গেলো। চাচাকে প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিয়ে ইয়াসিফ এসে বসলো বোনের পাশে। ঝুমুর আড়ষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ও ওনি মানে ভাইয়াকে দেখেছো? এখানেই তো ছিলো…”

“হ্যাঁ৷ ভাইয়া তো একটু নিচে গেলো।”

ঝুমুর চমকে ওঠলো,
“কেন? মানে কিছু দরকারে?”

“কারো কিছু খাওয়া হয়নি, জেনে খুব ঝেড়েছে। তাই নিজেই গেলো খাবার আনতে…”

ঝুমুর ভীতু গলায় বলল,
“তুমি গেলে না! মানে আবার যদি কোথাও চলেটলে যায়..”

ইয়াসিফ ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“ভাইয়াকে তুই এই চিনলি? খাবার আনতে বলে পালিয়ে যাবার মতো মানুষ না নিশ্চয়ই!”

ঝুমুর চুপ করে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
তবুও মনে মনে উৎকন্ঠিত হলো। না চাইতেও এতো আজেবাজে ভাবনা এসে যায়, কি করবে ও? কিছু করার নেই। ওকে অবশ্য বেশিক্ষণ টেনশনে রাখলো। না তাখলিফ। আধঘন্টার মাঝেই ফিরে এলো সকলের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে। এসেই ঝুমুরের হাতে দিলো সেগুলো। ঝিনুকের ঝামেলার থেকে বাঁচতে ইয়াসিফের সাথে গেলো কেবিনে। তাখলিফ ঠাঁই করিডোরেই বসে রইলো। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। দু’হাতে দূরে বসা শামসুল হক একদৃষ্টিতে দেখতে থাকলো ওর দিকে। তিনি আপনমনে লজ্জিত, আহতও হলেন! যারা এই ছেলেটার সাথে অন্যায় করলো, কষ্ট দিলো তাদের জন্যই ও এত ভাবছে? দায়িত্ববোধ পালন করছে নিজের এরকম মানসিক অবস্থায়ও? তিনি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলেন। তাখলিফের অবশ্য চাচার উপস্থিতি টের পেলো না। যারজন্য ভাবান্তর হলো না। শামসুল সাহেব ধীরেধীরে ওর মাথায় হাত রাখলেন৷ তাখলিফ আচমকা চাচার স্নেহময় ব্যবহারে অবাক হলে শামসুল হক বিগলিত কন্ঠে বললেন, “সেইদিন যদি আমি আমার আমার বউ আর মেয়েরে সামলাইতে পারতাম তাহলে আমার বড় ভাই এতডা কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করতো না। তাই তোমরা একসাথে ভালো থাইকা তোমার চাচীকে দেখিয়ে দিও, দু’জন কতটা সুখী৷ আমি শুধু আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তি চাই। অপরাধী তো আমিও!”

তাখলিফ বিষন্ন চিত্তে বসে রইলো। প্রত্তুতর করলো না কোনো। আজ বাবা থাকলে দিনগুলো অন্যরকম হতো। কতদিন দেখে না সে বাবাকে! সেদিন যে কেন এত রাগ করেছিলো? একটু কেন বুঝলো না, শুনলো না বাবার কথাগুলোকে? অসময়ে কেন এত আফসোস হচ্ছে ওর? কেন বুক ভারী হচ্ছে বারবার? এ কষ্টের নিস্তার কি করে পাবে? ও নিজে ভালো থাকলে? কিন্তু ও তো নিজেকে দূর কাউকেই ভালো রাখতে পারছে না! ওর বুক চিঁড়ে বেরুলো দীর্ঘশ্বাস। বুকের যন্ত্রণাটা আবারও প্রকট হচ্ছে।
.

এদিকে পাখি বেগমের এ অবস্থা আর শত দুঃখের মাঝেও ঝুমুরের সুখী সংসার, ওর প্রতি তাখলিফের যত্ন, কেয়ার, খুঁটিনাটি সব বিষয়ে লক্ষ্য রাখা ঝিনুকের শিরায় শিরায় অগ্নিবর্ষণ করে যেন! বুকের ভেতর দলা পাকায় ঈর্ষা। দহনে পুড়ে ছাই হয় ওর মনুষ্যত্ব! আচমকা হাতে থাকা ফোনটা ভাইভ্রেট করায় ঝিনুকের সংবিৎশক্তি ফিরে এলো। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো ইংরেজি অক্ষরে ‘সবুজ’ নামটা ভেসে ওঠেছে। যে ছেলেটা এখনো পাণিপ্রার্থীর ন্যায় বসে আছে ঝুমুরের অধিকার গ্রহণ করার! স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিনুকের হঠাৎ মনে হয়, মা সবুজকে কালো জাদুটাদু কিছু করেছে কি? নয়তো ও এখনো ঝুমুরকে পেতে মরিয়া হয়ে বাড়ির সবার সাথে লড়াই করছে কেন? তবে যেটাই হোক, ঝুমুরের বিনিময়ে যদি নিজের ভেঙে যাওয়া সংসারটা ফিরে পাওয়া যায় তাহলে তা-ই সই! ঝিনুক কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় জনমানবহীন করিডোরের শেষ মাথায়। হাতে থাকা ফোনটা তখনো একনাগাড়ে ভাইব্রেট করে যাচ্ছে।

______
#চলবে…

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩১

ঝিনুক কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলো জনমানবহীন করিডোরের শেষ মাথায়। হাতে থাকা ফোনটা তখনো একনাগাড়ে ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। ঝিনুক ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে সবুজের গলা শোনা গেলো, “হ্যালো?”

ঝিনুক উত্তর দেওয়ার আগেই সবুজ আবারও অধৈর্য গলায় বলল, “হ্যালো? শুনতে পাচ্ছো?”

ঝিনুক থমথমে গলায় বলল, “শুনছি।”

সবুজ একটু থামলো। কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো ভাবি?”

‘ভাবি’ ডাক শুনে ঝুমুরের চোখ ভিজে এলো। কতদিন পর কেউ এভাবে ‘ভাবি’ বলে সম্বোধন করলো ওকে! যেন কত আপন! ঝিনুক ভেজা কন্ঠে বলল, “কেমন আছি জানি না। শুধু আছিই। কিন্তু তুমি আমায় ভাবি ডাকছো কেন? আমি তো এখন আর তোমার ভাবি না। তোমার ভাইয়া আমায় ছুঁড়ে ফেলেছে!”

ওপাশ থেকে সবুজ ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভাইয়া তোমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। আমি তো না, দিনশেষে তুমি আমার ভাবিই থেকে যাবে।”

“সেই অধিকার নেই আমার।”

“আমি দেবো সেই অধিকার ফিরিয়ে।”

“কীভাবে? তোমার ভাইয়া তো চায় না আমাকে।”

“তুমি বোধহয় বাড়িতে আমার গুরুত্ব কতটুকু সেটা ভুলে গেছো ভাবি। আমি বললে এক্ষুনি তোমায় ফিরিয়ে আনবে।”

ঝিনুক এবার করুণ কন্ঠে বলল,
“তাহলে বলো তাকে। প্লিজ সবুজ, আমার এটুকু উপকার তুমি করো ভাই। আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারছি না…”

সবুজ যেন এটার অপেক্ষায়ই ছিলো। ও এবার আসল কথাটা বলল, “সেটা তো আমিও জানি যে তুমি ভাইয়াকে কতোটা ভালোবাসো। সেরকমও ঠিক আমিও ঝুমুরকে ভালোবাসি। তুমি তো জানতে তোমাদের বিয়েতে প্রথম দেখেই আমি ঝুমুরকে পছন্দ করেছিলাম? এই দুটো বছর শুধু ওর বড় হওয়ার, এইচএসসি শেষ হওয়ার জন্য ধৈর্য ধরেছিলাম। মাওই মা তো আমায় কথা দিয়েছিলো তার মেয়েকে আমার হাতেই তুলে দেবে। কিন্তু এখনো কেন সেটা দিচ্ছে না?”

ঝিনুকের এত রাগ হলো বোনের প্রতি, সবুজের প্রতি! তবুও তা প্রকাশ করলো না। বলল, “তুমি তো জানো ভাই, ঝুমুর এখন বিবাহিতা…”

সবুজ রেগে গেলো,
“এসব শুনতে চাই না। তাছাড়া মাওই মা তো আশায় রাখলো আমায়,ওনি তো বললেন সব ঠিক করে দেবে। তাছাড়া ওটা কোনো বিয়ে নাকি? একটা ছেলেখেলা। আমি ঝুমুরকে কতটা ভালোবাসি, কতটা চাই তা তো এই দু’বছর দেখলে। এতদিন ধৈর্য ধরে রাখলাম, এবার এসবের একটা বিহিত করো তোমরা। আমার কিন্তু ওকে সত্যিই চাই। বিনিময়ে আমি ভাইয়াকে বোঝাবো তোমার ব্যাপারে। জানো তো, ভাইয়াও আজকাল তোমায় মিস করে খুব…”

ঝিনুক এবার সত্যিই গলে গেলো। সবুজ জিজ্ঞেস করলো, “মাওই মা কেমন আছে এখন?”

ঝিনুক অবাক হয়ে বলল,
“তুমি জানলে কোথা থেকে?”

“সব খবরই রাখি আমি। মেয়েকে আমার হাতে তুলে না দিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি তো সেটা হতে দেবো না।”

ঝিনুক বিস্মিত হলো,
“কী করবে তুমি?”

সবুজ ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
“এখন রাখি। রাতে ফোন দেবো, তখন কথা হবে।”

সবুজ ফোন রেখে দিলো। ঝিনুক একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠছে। সজীব ওকে মিস করে? সত্যিই? কই, কোনোদিন তো ওর খোঁজ নিলো না। নাকি ওর প্রতি রাগ করে আছে বলে খোঁজ নেয় না? ঝিনুক কি করবে? ওর তো একছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে সজীবের কাছে। ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ মুছে মায়ের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। করিডোরে আসতেই বড়মামীকে দেখতে পেলো। পাখি বেগমের জ্ঞান ফিরেছে। ননদের সুস্থতা দেখে সে এখন চলে যাচ্ছে। ঝিনুক হাফ ছেড়ে মামীকে বিদায় দিতেই দেখলো ঝুমুর বেরুচ্ছে কেবিন থেকে। ওর মুখচোখ কেমন অন্যরকম। হাসি বিহীন, কঠিন চেহারা নিয়ে দাঁড়ালো তাখলিফের পাশে। ঝিনুকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়লো ওদের ওপর। তাখলিফ দাঁড়িয়ে শামসুল হকের সাথে কোনো বিষয়ে কথা বলছিলো। ঝুমুর ওর পাশে দাঁড়াতেই ওর দিকে তাকিয়ে মৃদুভাবে হাসলো। বিনিময়ে ঝুমুরও মুখ হাসি হাসি রাখার চেষ্টা করলো। দু’জনের মুখেই কষ্টের ছাপ থাকলেও নিজেদের মধ্যে যে তারা সুখী তেমন একটা ভাব বোঝা যাচ্ছে। এই কয়দিনে তারা যে একে-অপরের বেশ ভালো সৌলমেট হয়ে ওঠেছে তা দেখেই ঝিনুকের গা-পিত্তি জ্বলে গেলো। ও অসহ্য হয়ে মায়ের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।

.

হাসপাতাল থেকে বিদায় নিয়ে তাখলিফ, ঝুমুর বেরিয়ে এলো। শীতের এই রুক্ষ দুপুরেও হালকা বাতাস গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। রোদে তেজ নেই৷ হাসপাতাল থেকে বেরুনোর পর থেকেই ঝুমুর বেশ চুপচাপ। তাখলিফ ওকেই সেই কখন থেকেই লক্ষ্য করছিলো। চোখমুখ শুকিয়ে আছে মেয়েটার। তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। তাখলিফ তাই ওকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। ঝুমুর মুখ গোঁজ করে শান্ত স্বরে বলল, “আপনি অর্ডার করুন, আমি কিছু নেবো না।”

তাখলিফ মেন্যু কার্ড দেখছিলো। ওর কথা শুনে কপালে ভাঁজ ফেললো,
“কেন নিবি না?”

“ক্ষিধে নেই।”

তাখলিফ পাত্তা দিলো না দিয়ে ওয়েটারকে ইশারা করতে করতে বলল, “তবুও খেতে হবে।”

“জোর করবেন না। আমার ভালো লাগছে না।”

তাখলিফ বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
“চল…”

ঝুমুর চোখ তুলে চাইলো। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “খাবো আমি। আপনি বসুন।”

তাখলিফ বসলো। ওয়েটার এলো। ঝুমুরই অর্ডার করলো। তবে বেশি খেতে পারলো না। তাখলিফ জোর করলো না অবশ্য। বেরিয়ে এলো দু’জনে।
রিকশায় বসে ঝুমুরের হাত মুঠোয় ধরে বসে রইলো তাখলিফ। ওর কপালের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“এসবে তোর কোনো দোষ নেই। তাই নিজেকে দায়ী করবি না একদম।”

ঝুমুর দু-পাশে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। তবে মুখে কিছু বললো না। অনেক কষ্টে নিজের আবেগ, কষ্ট চেপে রেখেছে। ও কীভাবে বলবে? কোন মুখে বলবে? আজ ওর সব থেকে বেশি ঘৃণা হচ্ছে পাখি বেগমকে নিজের জন্মদাত্রী ভাবতে, মা ডাকতে। একটা মানুষ সংসারের প্রতিটা মানুষের সাথে এমন নিঁখুত অভিনয় চালিয়ে গেলো আর কেউ কখনো এসব বুঝলো না। বছরের পর বছর অন্যায় করে গেলো অথচ কেউ টেরই পেলো না? নিজের মায়ের এমন রুপ! কখনো কি ভেবেছিলো ঝুমুর! তমালিকার মৃত্যুর পেছনে পরোক্ষভাবে ওর মায়েরও হাত আছে? না ভাবেনি। ভাবতো তাখলিফ না হোক, বড় মাকে বোধহয় মা খুবই ভালোবাসে। কিন্তু আজ সেটাও মিথ্যে প্রমাণিত হলো। মনে পড়লো সেই সময়টা, পাখি বেগমের জ্ঞান ফেরার অনেকক্ষণ পর ও যখন মা’কে দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেবিনে গেলো তখন দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ও মা’কে বলতে থাকা ছোট খালার তিক্ত সত্যি কথাগুলোও শুনে নিয়েছে। এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি হয়ে ঝুমুর পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। খালার মুখোমুখি হয়েছে, তার চমকে ওঠা মুখ খানা দেখেছে! পাখি বেগম বেডে শুয়ে নিজের কুকীর্তি ফাঁস হওয়া দেখে ভয়ার্ত হয়ে মেয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখেছে। কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বেরুয়নি। কোকিলা বেগম ঝুমুরের হাতেপায়ে ধরে মাফ চেয়েছেন, বুঝাতে চেয়েছেন, ব্রেন ওয়াশ করতে চেয়েছেন কিন্তু ঝুমুর সেই সুযোগ দেয়নি আর। ওর ইচ্ছে হয় নি৷ প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছিলো মা, খালার ওপর। তাই একদলা থুথু তাদের দিকে ছুঁড়ে মেরে ও বেরিয়ে এসেছে। কেউ জানেনি, দেখেওনি যে ঝুমুর কতটুকু শূন্য আর ছোট হয়ে তাখলিফের হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই গোপন সত্যিগুলো, কাকে বলবে ঝুমুর? কীভাবে হালকা হবে? কী শাস্তি দেবে নিজের মা’কে? আচমকা ঝুমুর তাখলিফের হাতে কপাল ঠেকিয়ে ধরা গলায় বলল,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। কখনো আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।”

“যাবো না। কিন্তু কি হয়েছে তোর?”

“মায়ের জন্য আমাকে ছাড়বেন না।”

“সয়ে নিচ্ছি আমি। তোকে ছাড়বো না বলেই তো!”

ঝুমুর ম্লান গলায় বলল, “আপনি খুব ভালো। এত ভালো বলেই সবাই আপনাকে কষ্ট দেয়।”

“তুই না দিলেই হবে। তোর জন্যই তো আছি।”

হুড তোলা রিকশায় বসে ঝুমুর শক্ত করে ধরে
রাখলো তাখলিফের হাত। ছেড়ে দিলেই না হারিয়ে যায়! মায়ের সব ষড়যন্ত্র, সব চতুরতা থেকে ও সবসময় রক্ষা করবে তাখলিফকে। সব তো কেড়ে নিলো মানুষটার থেকে। মা’কে আর কোনো ক্ষতি করতে দেবে না আর। এবার মা’কে ও কঠিন শাস্তি দেবে। যেন মা বেঁচে থেকেও চির জীবন পস্তায়। অন্যের জীবন নষ্ট করার শাস্তি মা’কে সে দেবেই। আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণাটা সে সুদে-আসলে বুঝিয়ে দেবে সুযোগ পেলে। ঝুমুরের উদ্বিগ্ন, ঘৃণিত মনের এই অব্যক্ত কথাগুলোর সাক্ষী হয়ে রইলো শেষ দুপুরের রোদ্দুরের ঝিকিমিকি আলো আর পিচঢালা রাস্তা!
.

ঝিনুক ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে।
আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই। সম্পূর্ণ আলো হীন। ঘুটঘুটে অন্ধকার! তেমনি ঝিনুকের জীবনটাও আলো হীন, অমাবস্যার মতো। তবে একজন আলো ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বলেছে ফিরিয়ে দেবে সজীবকে ওর জীবনে। ঝিনুক জানে, ওর রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়ির সবাই তাদের ছোট ছেলে সবুজ বলতে অজ্ঞান। সে যা চায়, তা-ই পায়৷ পেয়ে আসছে ছোটকাল থেকে। সেই ছেলে যখন একবার ঝুমুরকে চেয়েছে, তার মানে তার সত্যিই চায়! এ কথার নড়চড় আর হবে না। এমনকি পরিবারের মান সম্মানের কথাও ভাববে না সজীবের মতো। তবে এ কথা সত্য, ছোট ভাইকে বেশ ভালোবাসে সজীব৷ ও যদি একবার বলে ঝিনুককে ফিরিয়ে নিতে, তাহলে সজীব ঠিকই ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু আদৌ নেবে তো? এসব নিয়েই দোটানায় ভুগছিলো ঝিনুক। কি হবে, কি করবে ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। তখনি বেজে ওঠলো ফোনটা। ঝিনুক তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করলো। সবুজ ধরেই জিজ্ঞেস করল,
“কি করছো ভাবি?”

“কিছু না। তোমার ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিলাম।”

“ওহ! মাওই মা কেমন আছে?”

“ঠিক আছে। তবে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে।”

“চিন্তা করো না। ঠিক হয়ে যাবে।”

এটা-সেটা আরো অনেক কথার পর ঝিনুক ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলো,
“তোমার ভাইয়ার সাথে কথাটথা হয়েছে?”

সবুজ ওকে হতাশ করে দিয়ে বলল, “ভাইয়ার সাথে এখনো কথা হয়নি। তবে বলবো আমি। তুমি কিছু ভাবলে?”

“কীসের ব্যাপারে?”

“সত্যিই ভাইয়াকে চাও নাকি চাও না?”

ঝিনুক করুণ গলায় বলল,
“চাই। আমি আমার স্বামী-সংসার ফিরে পেতে চাই।”

সবুজ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
“তাহলে ঝুমুরকে ফিরিয়ে দাও ভাবি। কথা দিচ্ছি আমি সব ঠিক করে দেবো।”

“বোঝার চেষ্টা করো সবুজ, এটা কীভাবে করবো আমি? তাছাড়া মা বাদে বাড়ির সবাই ওদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে।”

এটা শুনে সবুজ কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগান্বিত হলেও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “ভাবি একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“আমাদের পথের কাঁটাটার, মানে যার জন্য এ সবকিছু তার একটা ব্যবস্থা করা যায় না?”

ঝিনুক ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠল, “মানে?”

সবুজ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“যে এসবকিছুর মূলে! যার জন্য মাওই মা, তুমি, আমি কষ্ট পাচ্ছি তার একটা ব্যবস্থা করে ফেলি! মেইন কালপ্রিটই তো সে-ই, তোমার ওই জা’র’জ ভাইটা।”

ঝিনুক রুষ্ট হলেও জবাবে বলল, “কালপ্রিট আর কি? ঝুমুরই তো ভাইয়াকে ছাড়া এক পাও ফেলতে চায় না

সবুজ ক্রোধিত গলায় বলল,
“ঝুমুর তো সরলসোজা, তাই ওকে পেয়ে ভালোই ব্রেনওয়াশ করেছে। সেজন্যই তো বলছি, ওকে পথ থেকে সরিয়ে দিই।”

ঝিনুক আঁৎকে ওঠল, “কি বলছো তুমি? শত হলেও আমার ভাই হয়।”

সবুজ তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপন তো আর না।”

কথাটা ঝিনুকের মাথায় ঠোকর খেলো। আসলেই তো তাখলিফ ওদের আপন কেউ না। অথচ ওর জন্য সব সমস্যা হচ্ছে৷ ঝিনুক কিছুক্ষণ চুপ থেকে রোবটের মতো বলল, “আমি কিছু ভাবতে পারছি না সবুজ…”

সবুজ রহস্য গলায় বলল,
“ভাবতে হবে না। তুমি শুধু পাশে থাকলেই চলবে। বাকিটা আমি বুঝে নেবো। ভেবে দেখো, এতে কিন্তু আমাদের লাভ বৈ ক্ষতি কিছু হবে না। বরংচ আমাদের সবার চাওয়াই পূরণ হবে। ওর মতো বে’জ’ন্মা একটা লোকের জন্য আমাদের প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো তো বৃথা যেতে পারে না ভাবি। ভালোবাসা হারানোর ব্যথা তুমি নিশ্চয়ই বুঝো…”

ঝিনুক ভেজা চোখে মন দিয়ে কথাগুলো শুনছিলো। ভালোবাসা, সংসার হারানোর ব্যথা ওর চেয়ে আর কে ভালো জানে? মনে পড়লো দুপুরে নিজ চোখে দেখা ঘটনাগুলো৷ কীভাবে তাখলিফ ঝুমুরের হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। একসাথে রিকশা করে বাড়ি ফিরলো! সব জটিলতার মধ্যেও দু’জনে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে, একসাথে আছে, ভালো আছে। একে-অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আহারে! মানুষের সংসার ভেঙে নিজেরা কতই না সুখী! পৃথিবীতে বুঝি এসব স্বার্থপরেরাই ভালো থাকে? ঘৃণায় ঝিনুকের মন বিষিয়ে এলো। ওপাশ থেকে সবুজ ‘হ্যালো হ্যালো’ করেই যাচ্ছে। ঝিনুক আর বেশিদূর ভাবলো না। সবুজের কথা ফেলে দেওয়ার মতো না। একজনের জন্য বাকি সবাই কষ্টে থাকবে এটা তো অন্যায়। আর ওর মতো নির্দোষের সাথে তো মহা অন্যায়! ঝিনুক তাই সবুজের পরিকল্পনায় নীরব সম্মতি দিলো। সবাই ভালো আছে, ও নিজেও ভালো থাকতে চায়। অন্যকারো সাথে না, শুধুমাত্র সজীবের সাথে। এতে তো কোনো দোষ নেই! একটু না হয় স্বার্থপর হোক!

সব জীবনের সব ব্যর্থতা, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা ভুলে, বাবার আত্মার শান্তি কামনা করে মেজোআব্বার কথামতো তাখলিফ ঠিক করলো এবার থেকে নিজেকে শক্ত রাখবে। ভুলতে শিখবে সবকিছু। ওর জীবনের একমাত্র সত্য ঝুমুরকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবে অমাবস্যার কালো আকাশ ভেদ করে পূর্ব আকাশে উদিত ঐ উজ্জ্বল নক্ষত্রটার মতোন!

______

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
#চলবে…