অপ্রিয় রঙ্গনা পর্ব-৩২+৩৩

0
245

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২

তাখলিফ আগের মতো রুটিনমাফিক জীবনে ফিরে গেছে। সকালে একে-অপরের মুখ দেখে দু’জনের ঘুম ভাঙে। একসাথে ব্রেকফাস্ট করে ঝুমুরকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে নিয়মিত অফিস করছে, দুপুরে ওর ভার্সিটি শেষ হলে একসাথে লাঞ্চ করছে। এরপর ঝুমুরকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজে আবার অফিসে ব্যাক করছে। কাজ সেরে শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরছে। তখন দু’জনে মিলে চা-সিঙারা খেতে খেতে মুগ্ধ চোখে সন্ধ্যা নামা দেখে। রাতে দুজনে এক বিছানায় শুয়ে তারা গুণতে গুণতে ঘুমিয়ে পড়ে। আড়ম্বরহীন আস্ত একটা ভালোবাসাময় জীবন। সেখানে তৃতীয় কারোর আনাগোনার প্রভাব আশা করে না ওরা!

হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়ায় পাখি বেগমকে বাড়িতে আনা হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হয় নি। আগের মতো জোর দিয়ে কথা বলতে পারেন না। তাই এখন ইশারায় কথাবার্তা সারতে হয় তার। এরপরেও কলুষিত মস্তিষ্কের জোরে তিনি সবার ওপর ছুঁড়ি ঘুরিয়ে কন্ট্রোল করতে চান, না পারলেই মরার ভয় দেখান। তবে কেউই তাকে সেই সুযোগ দেয় না। শামসুল হক তো তার এসব কান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে শেষবারের মতো সাবধান করেছেন। কড়া ভাষায় বলে দিয়েছেন ঝুমুরের সংসারে যাতে তিনি নাক না গলান। তাহলে তিনি এবার চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিবেন। এ কথা শুনে পাখি বেগম কিছুটা দমে গেছেন। তবে তাখলিফকে অভিশাপ দেওয়া থামান নি। এমনিতে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও শামসুল হক পারতপক্ষে পাখি বেগমের সাথে কথা বলেন না। স্বামী-সন্তানসহ বাড়ির সবার সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েছে। প্রমিলা ব্যস্ত থাকেন সাজেদা বেগমের সেবাযত্নে। নিশি-তিথিরাও তাকে এড়িয়েই চলে। ঝুমুর
তো তাকে একদিন দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এ নিয়েও তার মনে ভীষণ ক্ষোভ। শুধুমাত্র বড় মেয়ে ঝিনুককেই নিজের পাশে পান। তবে ঝুমুর যে তমালিকার সত্যিটা কাউকে জানায়নি এখনো, তাতে তিনি অবাকই হন মনেমনে। এদিকে পাখি বেগম বাড়ি ফেরার পর থেকে ঝুমুর বেশ উদগ্রীব। মা আবার নতুন কি নাটক শুরু করে ওর জীবনটা তছনছ করার চেষ্টায় নামে এই নিয়ে ওর শুধু ভয় হয়। হঠাৎ হঠাৎ বমি পায়, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘোরে। রান্না করতে গেলে মনে হয় এক্ষুনি বুঝি আগুন ধরে যাবে, ফ্যান খুলে পড়ে যাবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হয় ভেঙে পড়ে যাবে। রিকশায় বসলে মনে হয় এক্ষুনি বুঝি এক্সিডেন্ট হবে। এভাবে ভয়ে ভয়ে কত থাকা যায়? এজন্য তাখলিফকে ইনিয়েবিনিয়ে একবার বলেছে এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে নিজেদের সংসার সাজাতে। কিন্তু তাখলিফ মা-বাবার স্মৃতি ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। এটুকুই তো ওর সম্বল, সব ছেড়েছুড়ে গেলে ওর পরিচয়টাই যে মিথ্যে হয়ে যাবে। ওর মনের এরকম বিধস্ত অবস্থা দেখে দ্বিতীয়বার আর জোর করেনি ঝুমুর। তাখলিফ সবেমাত্র অপ্রিয় ঘটনাগুলো ভুলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে মাত্র! ও সেটা আবারও নষ্ট করে দিতে চায় না।

.

এরপর সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেলো।
শীত বসেছে জাঁকিয়ে। প্রকৃতিতে কুয়াশাজড়ানো থাকে সারা দিন, রাত। আচমকা একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তাখলিফ কিছু দুর্বৃত্তের সম্মুখীন হলো। আর ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে তাখলিফের ডান হাতে ছু’রির আঘাত লেগেছে। কিন্তু রাস্তায় মানুষের জনসমাগম দেখে তারা তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। দুর্বৃত্তরা ওর থেকে কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়নি যেমনটা ছিনতাইকারীরা করে। শুধুমাত্র ওকে আঘাত করতে চেয়েছে। তাখলিফ এ ব্যাপারটা দেখে ভীষণ আশ্চর্য হলো! ডিসপেনসারি থেকে হাতে ব্যান্ডেজ করে বাড়ি ফিরলো। তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করলো কাটা হাতটা ঝুমুরের থেকে লুকানোর। সেজন্য বাড়ি ফিরেই কায়দা করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। ঝুমুর তাতে একটু অবাকই হলো। নিশি এসেছে একটু আগে। চুলায় চা বসানো হয়েছিলো। নিশির ডাক শুনে রান্নাঘরে ছুটে গেলো ঝুমুর।
.

নিরিবিলি বাড়ির মানুষজন আগের মতো নেই। যেন হঠাৎই কোনো এক কারণে নড়বড়ে হয়ে গেছে বাড়ির মানুষের সম্পর্কগুলো। ঝুমুরের এসব ভালো লাগে না। কোনোদিন ভাবেনি! এতবড় পরিবারটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে? কিন্তু কি করবে? ওর মা’ই তো সব শেষ করলো! ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চা বানানোর পাত্রে
চিনি মেশায়। নিশি উৎসুক গলায় বলল, “আপু হলো?”

ঝুমুর তড়িঘড়ি করে বলল, “হয়েছে। এখানে খাবি না নিয়ে যাবি?”

“নিয়ে যাই, তিথি অপেক্ষা করবে।”

“আচ্ছা যা।”

“থ্যাংক্স আপু। কাল পরীক্ষা। তোমার হাতের চা খেতে ইচ্ছে করছিলো, তাই ডিস্টার্ব করলাম!”

ঝুমুর হেসে বলল, “এক্সাম ভালো করে দিস।”

“দোয়া করো। এখন যাই?”

“যা। আবার আসিস।”

“আসবো।”

বলে নিশি নেমে গেলো দোতলায়৷ ঝুমুর মেইন ডোরটা লক করে ঘরে গেলো। এরপর ক্লজেট থেকে তাখলিফের ট্রাউজার, টি-শার্ট বের করে বিছানার ওপর রাখলো। এরমধ্যেই ও বেরিয়ে এলো তোয়ালে পরিহিত অবস্থায়। ঝুমুরকে ঘরে দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে হাতটা লুকিয়ে নিলো হাতে থাকা তোয়ালেটার নিচে। ঝুমুর আপাদমস্তক ওকে শাণিত দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে কাছে এসে ওড়না দিয়ে ওর চুল মুছে দিতে লাগলে তাখলিফ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জিজ্ঞেস করলো, “কে এসেছিলো?”

“নিশি।”

“এক্সাম চলে?”

“হ্যাঁ। পড়তে বসে দু-বোনের নাকি ক্রেভিং হয়েছে আমার হাতে চা খাওয়ার, তাই চা নিতে এসেছে। এখন তো আর আগের মতো চায়ের আড্ডা হয় না দোতলায়।”

বলে ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাখলিফ আনমনা হয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “হুঁ, বাবা যাওয়ার পর থেকে সব শেষ হয়ে গেছে।”

ঝুমুর কথা ঘুরানোর জন্য জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি খাবেন? চা?”

“না। কফি নেবো।”

“আচ্ছা।”

ঝুমুর গিয়ে ইনস্ট্যান্ট কফি তৈরি করে নিয়ে এলো। তাখলিফ বা-হাতে অন্যমনস্ক হয়ে কফির মগে চুমুক দিয়েই ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললো। ঝুমুর বিরক্ত হয়ে বলল,
“একটু দেখেশুনে খাবেন না?”

“তোর থেকে বেশি সতর্ক আমি। এটুকুতে কিছু হবে না।”

ঝুমুর টিপ্পনী কাটলো,
“নিজেকে নিয়ে বেশি কনফিডেন্স আপনার? নাকি আমাকে দেখানোর জন্যই?”

তাখলিফের ইগোতে লাগলো কথাটা। প্রত্তুতর না করে আবারও কফির মগে চুমুক বসালো। ঝুমুর ভাবেনি এরকম কিছু করবে। ও থতমত খেয়ে বারণ করতে লাগলো ওকে। কিন্তু তাখলিফ তা শুনলো না। ঝুমুর হাল ছেড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে ওর কফি খাওয়া দেখলো৷ কফি খাওয়া শেষ হলে খানিকটা রেগে মগটা তাখলিফের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে ফিরে এসে বলল, “দেখি, কই লেগেছে…”

তাখলিফ গম্ভীর স্বরে বলল,
“দেখার হলে আগেই দেখতি। এখন দেখে কি করবি?”

ঝুমুর চোখমুখ কুঁচকে বলল, “চুমু খাবো।”

“না। তোর এসব আমার চাই না। ইউ নো, তুই এখন আমাকে আগের মতো আর কেয়ার করিস না।”

ঝুমুর অবাক হলো। কথাটা সিরিয়াসলি নিলো। কষ্ট হলো ভীষণ। ওর দু-গালে হাত রেখে ভেজা চোখে বলল, “এবার থেকে অনেক বেশি কেয়ার করবো আপনার, আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসবো প্রমিজ। বিশ্বাস করুন আমি কখনো কম ভালোবাসিনা আপনাকে, নিজের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি। জানি না কেন আপনার এমন মনে হলো, হয়তো আমারই কোনো ভুল হয়েছে… ”

তাখলিফ ঠোঁট বাঁকিয়ে, ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “আমি
বলেছি তোর ভুল?”

“বলেন নি?”

তাখলিফ ওর বোকামো দেখে হাসলো মনে মনে। ওকে ঘাবড়ে দিয়ে আচমকা এক হাতে টেনে নিজের উরুতে বসিয়ে ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল, “শোন, আমার ঝুমুর সবথেকে সেরা। ও ভালোবাসায় বা কেয়ারিংয়ে কখনো ভুল করে না। এইযে দেখ, ভুল করে না বলেই ওকে ভালোবাসি বলে কোলে বসিয়েছি!”

ঝুমুর গাল ফুলিয়ে বলল, “তাহলে যে বললেন?”

“গাধী যে তুই!”

“দেখবেন একদিন চালাকিতে আমি আপনাকে হারিয়ে দেবো। এমন বোকা বানাবো যে, আপনি ভাববেন এই কি সেই ঝুমুর? যাকে আমি গর্দভ বলতাম?”

বলে ঝুমুর হাসতে লাগলো। তাখলিফ সরু গলায় বলল, “তাই?”

ঝুমুর বিগলিত চিত্তে ওর গালে টুপ করে চুমু খেয়ে সটকে পড়লো। তাখলিফ গালে হাত দিয়ে থম ধরা গলায় বলল, “চলে গেলি যে! আমার জামাকাপড় কোথায়? দিয়ে যা…”

ঝুমুর রান্নাঘর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ঘরে এসে বলল,
“এইতো বিছানার ওপর। দেখেও দেখেন না নাকি?”

তাখলিফ বিছানার দিকে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। যখন দেখলো জামাকাপড় সব গুছিয়ে রাখা আছে তখন হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। ভুল করলো সে। ঝুমুরকে ডাকা উচিৎ হয়নি। এখনি দেখে ফেলবে হাতের ক্ষত, এরপর কান্নাকাটি জুড়ে দেবে৷ কিন্তু কতক্ষণই বা আড়ালে রাখা যাবে? তবুও ঝুমুরকে বলল,
“কি কাজ করছিলি, যা।”

ঝুমুর তখন থেকেই ওর হাবভাব লক্ষ্য করছিলো। কখন থেকেই বা-হাত নাড়িয়ে কথা বলছে৷ ডান হাত লুকিয়ে। ও বুঝে ফেললো তাখলিফ কিছু একটা লুকাচ্ছে! তাই সরু গলায় বলল, “আপনার হাতে কী হয়েছে? তখন থেকে দেখছি একহাত ব্যবহার করছেন? দেখি তো…”

তাখলিফ অপ্রস্তুত বোধ করলো, “চেঞ্জ করবো সর।”

ঝুমুর সন্দেহী চোখে তাকিয়ে রইলো,
“না দেখালে যাবো না। তোয়ালে সরান বলছি।”

ঝুমুর অনড় দাঁড়িয়ে। তাখলিফের বারণ শুনলো না৷ তোয়ালেটা জোর করে সরিয়ে নিতেই দেখলো হাতে ব্যান্ডেজ, রক্তে ভিজে। ঝুমুর আঁৎকে ওঠে মুখে হাতচাপা দিলো। তাখলিফ অপ্রস্তুত গলায় বলল,
“একটু কেটেছে।”

ঝুমুরের কাঁদোকাঁদো স্বর,
“কীভাবে?”

তাখলিফ কি বলবে খুঁজে পেলো না। ঝুমুরও এমনভাবে চেপে ধরলো যে সত্যিটা বলা ছাড়া ওর আর উপায় থাকলো না। ওর কাছ থেকে নিজের আঘাতপ্রাপ্ত হাতটা যেমন লুকাতে পারেনি তেমনি পারেনি দুর্বৃত্তদের হামলার কথাটা লুকাতে। সব শুনে ঝুমুরের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। অশুভ আশঙ্কা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো। তবে তাখলিফ ব্যাপারটা ছিনতাইয়ের বলে চালিয়ে দিলো। কিন্তু ঝুমুরের মন-মস্তিষ্ক শান্ত হলো না। ছিনতাইকারী হলে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো, জীবন না! তাখলিফ ওকে কোনো যুক্তি দিয়েই বোঝাতে পারলো। হাল ছেড়ে দিলো সে। ঝুমুর ওর বুকে মিশে গিয়ে বলল, “আপনার কিছু হওয়ার আগে যেন আমি ম’রে যাই।”

তাখলিফ ওর হাতের বাঁধন শক্ত করলো। ঠোঁটে আঙুল চালিয়ে থম ধরা গলায় বলল, “চুপ।”

“আমার কিছু হলে আমি একদম কষ্ট পাবো না। কিন্তু আপনার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না।”

“কিছু হবে না ঝুমু, তুই এসব কথা প্লিজ বন্ধ কর।”

ঝুমুর যেন শুনলোই না ওর কথা। শার্টের বুক ভিজিয়ে ম্লান গলায় বলল, “এখানে থাকলে আমার মা কাউকে ভালো থাকতে দেবে না। চলুন আমরা এখান থেকে দূরে চলে যাই।”

“সিরিয়াস হচ্ছিস কেন তুই? এটা একটা এক্সিডেন্ট৷ তুই এ ব্যাপারটা মেজোআম্মার সাথে মেলাচ্ছিস কেন?”

“কারণ মা-খালা ওরা আপনাকে, আমাকে একসাথে পছন্দ করে না। কতসব ফন্দিফিকির করেছিলো ওরা আপনি তা জানেন না।”

তাখলিফ তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“জানতেও চাইনা। আমরা একসাথে আছি, ভালো আছি, থাকবো বাকি দিনগুলো এটাই সত্য। এরবেশি কিছু জানতে চাইনা। তুই প্লিজ স্টপ কর তোর কান্না। আমার ভালো লাগে না তুই কাঁদলে।”

ঝুমুর তবুও কাঁদতেই থাকলো। তাখলিফ ওর গাল বেয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে শান্ত করলো। ঝুমুর সেঁটে রইলো ওর সাথে। আদৌ ওর সন্দেহ সত্যি কি-না জানে না। আচ্ছা, মা কি এতদূর যাবে? এই অবস্থায়ও লোক লাগিয়ে তাখলিফের ক্ষতি করবে? ভেবে পেলো না ঝুমুর!

এদিকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় স্ট্রেসে ঝুমুরের শরীর অনেক খারাপ হলো। বমি, পেটে ব্যথা, মাথা ঘোরা। তাখলিফ দিশেহারা বোধ করলো। জোর করেও হাসপাতালে নিতে ব্যর্থ হলো তাখলিফ। তাই ডাক্তারের পরামর্শ নিলো ও। অতিরিক্ত স্ট্রেস থেকে এরকম হতে পারে জানালেন তিনি, তবুও কিছু টেস্ট প্রেসক্রাইব করলেন। তাখলিফ আপাতত ঔষধ খাইয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো। ঔষধ নেওয়ার পরপরই ঝুমুর একদম নেতিয়ে পড়লো ওর বুকে। সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো একসময়। ঝুমুরকে বুকে নিয়ে পড়ে রইলো তাখলিফ। সেইসাথে পুরোনো বিষন্নতা আবারও ফিরে এলো। এইযে ঝুমুরের জন্য ও শূন্যতা অনুভব করে, দমবন্ধ লাগে, বুকে ব্যথা হয় এগুলো বোঝে না কেন কেউ?

.

মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম কেটে গেলো ঝুমুরের। তাখলিফ ঘুমে। ঝুমুর আস্তে করে ওকে সরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো৷ চোখেমুখে পানির ছিঁটে দিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথা ধরা কমেছে। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতেই উজ্জীবিত লাগছে দেহ-মন। আচমকা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় চোখ পড়লো নিচে, বাড়ির সামনের বন্ধ টং দোকানে৷ মোটর বাইকের সামনে দুটো মানুষের অবয়ব। একটা পুরুষালি, অন্যটা মেয়েলী। এত রাতে শুনশান রাস্তায় দু’জন দাঁড়িয়ে কি করছে বুঝলো না ঝুমুর। অথচ মেয়েলী অবয়বটা ওর চেনা চেনা লাগছে। ঝুমুরের কাছে দু’জনের গতিবিধি সন্দেহজনক লাগলো। ও লক্ষ্য করতে লাগলো ওদেরকে। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পর যখন আলোতে এলো তখনি ঝুমুর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলো ঝিনুককে দেখে! তার চেয়ে বেশি চমকালো ওর পাশে সবুজকে দেখে। ঝুমুর দুজনকে এভাবে, এতরাতে, একসাথে দেখেও বিশ্বাস করতে পারলো না। নিজের চোখ ঢলে নিলো ও। ভুল দেখলো? চোখের ভ্রম? কিন্তু না, মোটর বাইকের শব্দ তো ঠিকই শুনলো। ঝুমুর আবারও তাকালো নিচে, দেখলো ঝিনুক গেইটের নিচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে সবুজকে বিদায় দিচ্ছে। ঝুমুর ঘরে চলে এলো এলোমেলো পায়ে। আবারও মাথাটা ঘুরছে। আপু তার প্রাক্তন দেবরের সাথে কি করছে? তাও এত রাতে? লুকিয়ে? এসবে ভয় পেয়ে সকালে তাখলিফকে অফিসে যেতে দিচ্ছিলো না ঝুমুর। কিন্তু ইম্পোর্টেন্ট কাজ থাকায় অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও ওর বিধিনিষেধ না শুনেই তাখলিফ অফিসে গেলো।
বলে গেলো তৈরি হয়ে থাকতে, অফিস থেকে ফিরে হসপিটালে নিয়ে যাবে। আর কথা দিলো, সাবধানে থাকবে। তবুও ঝুমুরের অস্থিরতা গেলো না। কালকের দু, দুটো ঘটনা ওর সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছিলো বারবার। স্বাভাবিক হতে পারছিলো না ক্ষণিকের জন্য। তাখলিফ ঠিকঠাকমতো অফিসে পৌঁছে ফোন করে ওকে আশ্বস্ত করলেও ঝুমুর বারবার ওকে ফোন করে বিরক্ত করছিলো। তাখলিফ ওর এমন আচরণে বিস্মিত, অবাক হচ্ছিলো। বুঝেই পাচ্ছিলো কি হয়েছে, অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে এসে ও নিজেও শান্তি পাচ্ছিলো না কেন যেন!
.

এদিকে একসময় ঝুমুর থাকতে না পেরে অস্থির বললো শামসুল হককে সব জানানো উচিৎ। বাবা জানে কিনা আপুর এমন কান্ড কে জানে। এসব তো ভালো লক্ষ্মণ নয়। সেইজন্য দুপুরে ও গেলো দোতলায়। তুসি দরজা খুলে ওকে দেখে খুশিই হলো। তবে ওর চেহারা দেখে বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। ঝুমুর সোজা গেলো বাবার ঘরে৷ শামসুল হক বেরুবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার মাঝে ছোট মেয়েকে দেখে অবাক হলেন৷ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই ঝুমুর ভার গলায় বলল, “বাবা, আপুকে ডাকেন তো।”

“কেন? কি হয়েছে রে মা?”

“আপুকে ডাকেন। বলছি…”

তুসি গিয়ে ঝিনুককে ডেকে নিয়ে এলো। ওর সাথে ঘরে ঢুকলো পাখি বেগমও। বড় মেয়ের সাথে লেপ্টে থাকেন আজকাল। ঘরে ঢুকে ঝুমুরকে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। তমালিকার সত্যি বলে দেবে নাকি মেয়েটা? ঝিনুক ওর উপস্থতি দেখে বিষদৃষ্টিতে তাকালো। ঝুমুর সময় নিলো না। সরাসরিই বলল, “আপু তোমার সাথে কাল সবুজ ভাইকে দেখলাম। রাত দুটোয়। নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে!”

শামসুল সাহেব আকস্মিক এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন, “মানে? কি কও এইসব?”

ঝুমুর শক্ত গলায় বলল,
“আমি যেটা দেখেছি সেটাই বলছি, বাকিটা আপনি জিজ্ঞেস করেন আপুকে। আমি শুধু জানতে এসেছি মা আবার কোনো চাল চালছে কিনা… ”

পাখি বেগম বোকা বনে গেলেন৷ ঝিনুক সবুজের সাথে দেখা করেছে কই তাকে তো বলেনি! এদিকে ঝিনুকের রাগে গা জ্বলছে। বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই। ও চিল্লিয়ে ওঠলো ঝুমুরের ওপর, “হ্যাঁ করেছি দেখা। তাতে তোর কি?”

শামসুল হক ওর গালে থাপ্পড় বসিয়ে বললেন, “নির্লজ্জ হয়ে গেছো? ঐ বাড়ির কেউ এহন তোমার আপন মানুষ না। সব পরপুরুষ। কেন গেছিলা? ওর লগে তোমার কি কাজ? ছি ছি!”

ঝিনুক মুখ কালো করে বলল, “কিছু না।”

শামসুল হক ক্ষেপে গেলেন,
“কিছু না তো আসছে কেন? তাও অত রাতে? কি চলে?”

ঝিনুকের গলা শুকিয়ে এলো৷ তবুও সামলে নিয়ে বলল, “এমনি দেখা করছি। ও আসছিলো আমার খোঁজখবর নিতে৷”

শামসুল হক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন,
“সত্যি?”

“এছাড়া আর কোনো কারণ নেই। বিশ্বাস করেন।”

শামসুল হকের সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি,
“খোঁজখবর এত রাতে নেয়?”

“এদিকেই কাজ আসছিলো, খুব করে অনুরোধ করলো। তাই গিয়েছিলাম!”

“মনে রাইখো ওদের লগে আমাগো সম্পর্ক নাই। আর যাতে এমন না হয় মাথায় রাইখো।”

ঝিনুক ক্ষোভ সামলে নিয়ে বলল,
“ভুল হয়েছে, আর হবে না।”

ঝিনুকের কথা অবশ্য ঝুমুরের বিশ্বাস হলো না। সামান্য কারণে এত রাতে কেউ দেখা করতে আসে? উত্তর নেই। মা আছে এখানে, অসহ্য লাগছে ঝুমুরের। ও মা আর ঝিনুকের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল, “শুনো আপু, তোমার এসব অধপতনে আমার কিছু যায় আসবে না। তবে আমি কেন্দ্রিক যাতে কিছু না ঘটে তাই বলতে এসেছি।”

ঝিনুক দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“তুই কি এমন হনু রে? আমায় হুমকি দেস, ভুলে গেছিস আমি তোর বড়? তুই না!”

“ভুলিনি বলেই সাবধান করতে এসেছি। মা বা তুমি, কেউ যদি আর কিছু করো তাহলে আমি কিন্তু ছাড়বো না তোমাদের।”

কড়া গলায় বললো কথাগুলো ঝুমুর। এরপর চিন্তিত বাবার দিকে তাকিয়ে একটু থামলো। ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এরপর কাল রাতে তাখলিফের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জানালো বাবাকে। শামসুল সাহেব বিস্মিত হয়ে রেগে গেলেন, “আমায় জানাও নাই কেন? তোমার কি এখনো বিবেকবুদ্ধি হয় নাই ঝুমুর? আমি তোমার বাবা না? ছেলেডার এখন আমরা ছাড়া কে আছে?”

ঝুমুর নতকন্ঠে বলল, “চিন্তায় ফেলতে চাইনি বাবা।”

“এই শরীলে আবার অফিসে যাইতে দিসো? আটকাও নাই?”

“আমি যেতে দেইনি, ওনিই জোর করে বেরিয়ে গেলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আসলে অনেকদিন তো মিস গেলো, তাই…”

“ঠিক হয়নাই। সাবধান থাকতে বইলো। আজকাল দেশে যা ঘটতেছে।”

ঝুমুর মাথা নাড়ালো। শামসুল হক বেরিয়ে গেলেন স্ত্রী-মেয়েকে আবারও শাসিয়ে। ওরা দু’জনেই বিরক্ত হলো। ঝিনুকের ক্রোধ আরও বাড়লো। তবে ও শান্ত রইলো। ঝামেলা বাড়ালেই বিপদ। এদিকে তাখলিফ ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিলো এই ঘটনাটা শুনে ঝিনুকের মুখের আদল যে পাল্টে গিয়েছিকো, সেটা পাখি বেগম ছাড়া অন্য কেউ লক্ষ্য করেন নি।
এমনিতে কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন, ইশারা ছাড়া জিজ্ঞেসও করতে পারবেন না। আর এদের সামনে জিজ্ঞেস করাটাও ঠিক হবে না। তাই তিনি চুপ রইলেন। সময় বুঝে মেয়েকে জিজ্ঞেস করবেন সবুজ কেন ঝিনুকের সাথে দেখা করলো?

.

দোতলায় আসা হয় না ঝুমুরের, আজ যখন এসেছে তাই নিজের ঘরটাও একটু দেখে এলো। শয্যাশায়ী দাদীকেও দেখে এলো। কাঁদলোও অনেকক্ষণ! তুসির সাথেও অনেকক্ষণ কথা বললো। নজর রাখতে বললো মা, বোনের ওপর। তুসি ওর উৎকন্ঠা দেখে আশ্বস্ত করলো। মেয়েটার এ অবস্থা ওকেও খুব বিচলিত করছে। ও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইয়াসিফ ইদানীং ব্যস্ত, আগেরটার চেয়ে আরো ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। বেতন প্রথমবারেই পঁয়ত্রিশ হাজার। কাজের চাপে থাকে, ভাইয়ের সাথে দেখা না হওয়ায় মনক্ষুন্ন হলো ঝুমুরের অকারণেই। তিনতলায় ফিরে এসে প্রথমেই একগ্লাস পানি খেলো। এরপর ফোন নিয়ে ম্যাসেজ লিখলো ইয়াসিফকে, “অনেকদিন আমাদের চায়ের আড্ডা জমে না ভাইয়া। নিশি-তিথি মন খারাপ করে থাকে। আজ তোমাদের নিমন্ত্রণ। রাতে আমি তোমাদের জন্য রান্না করবো। খবরদার যদি না আসো, কথাই বলবো না আর কখনো।”

লাঞ্চ আওয়ারে বোনের ম্যাসেজ দেখে ইয়াসিফ হাসলো। আসলেই, চায়ের আড্ডা জমে না অনেকদিন। ইয়াসিফ বোনকে ফিরতি ম্যাসেজে ‘আসবো’ লিখে সেন্ড করলো। ঝুমুর সেটা দেখে
মলিন হাসলো।

.

তাখলিফ অফিস থেকে বেরুতেই দেখলো ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। ও এত বিস্মিত হলো যে কথা ভুলে গেলো। ঝুমুর এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলল,
“চমকে দিলাম না?”

তাখলিফ বিস্মিত নয়নে তাকালো,
“তুই আসবি? আমাকে জানালি না কেন?”

“আসতে বারণ করতেন। জানি আমি।”

“তাই বলে এভাবে? উফ! তুই না…”

ঝুমুর উৎসুক চোখে তাকালো,
“আমি কী?”

তাখলিফ ওকে বড়বড় চোখ করতে দেখে হেসে বলল, “বর পাগল।”

ঝুমুর ওর দুই বাহু আঁকড়ে ধরে লজ্জা পেয়ে বলল, “মোটেও না।”

“হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। কোথাও যাবি?”

“নাহ। আজ ভাইয়ারা আসবে। একসাথে গল্পটল্প জমবে।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকালো,
“কোনো অকেশন?”

“হুম। নিশি-তিথি কাল মন খারাপ করলো চায়ের আড্ডা হয় না বলে তাই আরকি ছোটখাটো আয়োজন।”

তাখলিফ বলল, “তাহলে কিছু খাবারদাবার নিয়ে যাই?”

ঝুমুর বলল,
“একদম না। আমি রান্নাবান্না করেই এসেছি। চলুন…”

তাখলিফ গলায় বিস্ময় ঢেলে বলল, “সিরিয়াসলি? তুই আবারও? একা হাতে? দেখি তোর হাত!”

বলে টেনে নিয়ে ঝুমুরের হাত উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো কোথাও কেটেছে কি-না! ঝুমুর হেসে বলল,
“লাগেনি কোথাও!”

ঝুমুরকে উচ্ছ্বসিত দেখে তাখলিফ অবশ্য আর বকাঝকা করলো না। মাথায় গাট্টা মেরে এরপর রিকশা ডেকে ওঠে পড়লো ওকে নিয়ে। ঝুমুর ওর হাত আঁকড়ে ধরে সন্ধ্যা পড়া ম্লান আকাশে দৃষ্টি মেলে বলল, “এত মেঘ আকাশে! বৃষ্টি হবে।”

তাখলিফ মৃদু স্বরে বলল, “তুই-ই তো আস্ত একটা বৃষ্টি, আর বৃষ্টির দরকার নেই।”

ঝুমুর ওর খোঁচা বুঝে বলল,
“হুহ! ভেসে যাবে তাহলে পৃথিবী।”

তাখলিফ, ঝুমুর দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো। রিকশা এগুচ্ছে। সত্যিই কিছুক্ষণের মাঝে আকাশ তার গতিবিধি পাল্টালো। বাতাস ভারী হলো। রাস্তাঘাট জনশূন্য হতে লাগলো৷ ঝুমুর বলল, “আমার ভয় করছে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“আমি আছি।”

ঝুমুরের মন আগের চেয়েও বেশি উৎকন্ঠিত হতে লাগলো। পাশে বসা মানুষটা তো আর জানে না ও কেন এসেছে! একা ছাড়বে না বলেই তো আগে ভাগে এসে বসে আছে ঝুমুর। মায়ের প্রতি বিশ্বাস নেই ওর। নতুনভাবে বোনের প্রতিও ওর সব বিশ্বাস ওঠে গেছে। স্বার্থপর মনে হয় সবাইকে। কীভাবে বলবে সেসব তাখলিফকে? হুড তোলা রিকশাটা তখন প্রায় জনশূন্য রাস্তা ধরেই যাচ্ছিলো। আচমকা এক কান্ড ঘটলো। চারটে মোটরসাইকেল এসে ঘিরে ধরলো ওদেরকে। রিকশাওয়ালা হঠাৎ ব্রেক কষতে গিয়ে ভিমড়ি খেলো। নিজেকে সামলে মুখ তুলে গালি দিয়ে বসলো মাঝবয়েসী রিকশাওয়ালা। এমনিই তার গালে ঘুষি বসালো মোটর সাইকেল আরোহীদের একজন। ঝুমুর আর তাখলিফ বিস্ময় বনে গেলো। হচ্ছেটা কী? ঝুমুর ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। লক্ষ্য করলো চারটে বাইকে করে মোট আটজন মুখ বাঁধা লোক। ওর আত্মা তখন ভেতরে নেই। তাখলিফ নামতে গেলে ও জাপ্টে ধরে বলল, “এরা কারা?”

“বুঝছি না তো।”

“কী হবে?”

“জানি না। দেখি ওরা কী চায়!”

ঝুমুর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো,
“আপনি যাবেন না…”

তাখলিফ ওকে বোঝালো,
“বিপদে পড়ে গেছি ঝুমুর। ছিনতাইকারী হলে সবকিছু দিয়ে দেওয়াই শ্রেয় হবে। একা আমি এতজনের সাথে পারবো না, তুই সাথে আছিস। চুপ করে বস, আমি দেখি ওরা কি চায়। খবরদার নড়বি না…”

বলে তাখলিফ ওর হাত ছাড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। রিকশাওয়ালাকে তখন দুজন ধরে মারছে, বাকিরা ওদের ঘিরে আছে। তাখলিফ এগিয়ে গেলো রিকশাওয়ালাকে মারতে থাকা দু’জনের দিকে। ওদের থামানোর চেষ্টা করে উঁচু গলায় বলল, “কী চাই তোদের? ছাড়, নিরীহ একজনকে মারছিস কেন?”

দু’জন লোক রিকশাওয়ালাকে বেঁধে ওর দিকে
এগিয়ে এলো। এরপর বলল, “তোর নাম তাখলিফ হাসান? সানওয়ার হকের তোর বাপ?”

তাখলিফ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“আগে প্রশ্নের উত্তর দে!”

ঝুমুর স্থির থাকতে না পেরে ছুটে এলো তাখলিফের কাছে। এসে জাপ্টে ধরলো। তাখলিফ ওর হাত ধরে রেখে বলল, “হ্যাঁ, আমি তাখলিফ। সানওয়ার হকের ছেলে।”

লোকগুলো একেঅপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো৷ ঝুমুর লোকগুলোর উদ্দেশ্য ভীতু কন্ঠে বলল, “আপনারা কি চান? আমাদের কাছে তেমন কিছু নেই। যা আছে নিয়ে যান৷ আমাদের যেতে দিন।”

একজন বিশ্রি হেসে বলল,
“এমনি এমনি তো যাইতে দিমু না মামুণি৷ তুমি কেডা?”

বলে কুদৃষ্টি দিলো ঝুমুরের দিকে। তাখলিফ রেগে গিয়ে ঘুষি মারলো লোকটার নাকে। ঝুমুর আঁৎকে ওঠলো। গন্ডগোল বাঁধলে সব শেষ। এদিকে তাখলিফের হাতে মার খেয়ে ফুঁসে ওঠলো লোকটা। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলল, “খারায় আছস কেন? কাম সার! কু* বাচ্চা আমার গায়ে হাত দেয়। ওরে দেখায় দে আমরা কেডা…”

তাখলিফ, ঝুমুর কিছুই বুঝে ওঠতে পারলো না এরমধ্যেই লোকগুলো তাদের প্যান্টের পকেট থেকে লাঠি, ছুড়ি বের করলো। তাখলিফ বিস্মিত হয়ে গেলো। ঝুমুরকে সাইডে দাঁড় করিয়ে বলল , “এসব কী? দেখ, আমাদের সাথে যা কিছু আছে নিয়ে যা। কিন্তু আমাদের যেতে দে।”

লোকগুলো ওর কোনো কথা শুনলো না। সবাই মিলে আক্রমণ করে বসলো একসাথে। মেরেধরে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দিলো তাখলিফকে। ও বুঝে পেলো না ওর দোষ কি? কেন এমন করছে ওরা?
তার আগেই তাদের নিগ্রহের শিকার হতে হলো ওকে। ঝুমুরকে দুটো লোক ততক্ষণে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিয়েছে। চারদিকটা কেমন নীরব। ভারশূন্য। তাখলিফ বমি করে দিলো, ওর নিজেকে অসহায় লাগলো। আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারলো না, পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে দিলো একজন। আর্তনাদ করে ওঠার সুযোগও মিললো না, মনে হলো মৃত্যু বুঝি এখানেই। তখন নিজের প্রতি না, ঝুমুরকে নিয়ে ওর চিন্তা হতে লাগলো। মেয়েটা কাঁদছে চিৎকার করে, লোকগুলোর হাত থেকে ছুটে ওর কাছে আসতে চাইছে। কিন্তু তাদের শক্তির সাথে পারছে না। তাখলিফ দেখলো একজন একটা বড় চা-পাতি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কি হতে যাচ্ছে ভেবেই ও ঝুমুরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো, মেয়েটা নিতে পারবে না এসব। ওরা কি একটু দূরে নিয়ে মারবে ওকে? বললে শুনবে? সবকিছু চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এলো। এরপর সৎবিৎ ফিরলো সেকেন্ডের মধ্যেই। দেখলো ঝুমুর ওর দিকে ছুটে আসছে। মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “মারবেন না, মারবেন না ওনাকে। ওনি আ…”

এরপরের কথাটা শেষ হলো না। তাখলিফ দেখলো ওর ওপর কেমন নেতিয়ে পড়েছে ঝুমুরটা, ব্যথিত মুখ। ও বুঝে পেলো না কিছু, শুধু নিজের দুর্বল হাতটা দিয়ে ঝুমুরের পিঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো। ভেজা ঠেকলো হাতটা। বুজে আসা চোখদুটো অনেক কষ্টে মেলে দেখলো র’ক্তে ভরে গেছে হাতটা। লোকগুলো ঘাবড়ে সরে পড়লো। ভুল হয়েছে ওদের! আর তাখলিফ এত অবাক হলো যে নিজের ব্যথা ভুলে গেলো। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঝুমুরকে ডাকলো, “এই ঝুমুর! গাধী? ঠিক আছিস তুই?”

উত্তর এলো না। চারদিকটা কেমন শুনশান হয়ে এলো। যেন কোথাও কেউ নেই।

_________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#চলবে…

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৩

পৌষ মাস।
এক বিভীষিকাময় সন্ধ্যা!
ঝুমুরের রক্তে রক্তিম হয়ে যাওয়া নিজের হাতটি অপলক দৃষ্টিতে দেখার পর ছুরিকাঘাতে আহত তাখলিফ নিজের জন্য ব্যথা অনুভব করেনি আর।
রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো তাখলিফের পুরো দেহ।
নিজের রক্তের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েছিলো ঝুমুরের রক্তও! মস্তিষ্ক তাখলিফকে সচেতন বাণী পাঠিয়ে বারবার জানান দিচ্ছিলো পৃথিবী উল্টে যাক, ঝুমুরের জন্য হলেও নিজেকে ঠিক রাখতে হবে।
কিন্তু এই চাওয়াটা একটু বুঝি কঠিনই হয়ে গেলো। তাখলিফ নিজের শরীরকে অবশ অনুভব করলো।
রুদ্ধ কন্ঠে সে শুধু মাঝবয়েসী রিকশাওয়ালা সগির মিয়ার সাহায্যই চাইতে পেরেছিলো। আর কিছু না। এদিকে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এমন নির্মম হামলা দেখে তখনো শকে ছিলো সগির মিয়া। তার বুক কাঁপছিলো ধুকপুক করে। তরতাজা দুটো মানুষকে চোখের সামনে নিথর হয়ে যাওয়াটা সে মানতে পারছিলো না কোনোভাবেই। তাই ঝড়ো
হাওয়া বইয়ে দেওয়া প্রকৃতির নিষ্ঠুরতাকে তোয়াক্কা
না করে লোকজন জড়ো করে সগির মিয়া যে
কীভাবে গুরুতর আহত দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো তা সে নিজেও জানে না।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর পর একপ্রকার হইচই পড়ে গেলো সেখানে। সন্ত্রাসী
হামলায় গুরুতর জখম দু’জনের তড়িঘড়ি করে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা হলো। তাখলিফের ওয়ালেট, ফোন ঘেঁটে অনেক চেষ্টার পর হসপিটাল কর্তৃপক্ষ নিরিবিলির সদস্যদের খবর দিতে সক্ষম হলো। মুমূর্ষু অবস্থায় তাখলিফের চিকিৎসা শুরু করলেন ডাক্তারগণ। কিছু টেস্টের পর কপালের
রক্ত পড়া বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করলেন। ছুরিকাঘাতে ক্ষত হওয়া পেটের রক্ত পড়া কোনোক্রমে বন্ধ করা গেলেও ডাক্তার জানালেন অপারেশন লাগবেই লাগবে৷ এবং তক্ষুনি অপারেশনের ব্যবস্থা করা
হলো। জ্ঞানশূন্য তাখলিফ অবশ্য তা আর জানতে পারলো না। ওদিকে ঝুমুর একেবারেই নিথর!
শুধু থেমে থেমে শ্বাসনালি টুকু চলছে। ডাক্তাররা জানালেন অপারেশন মাস্ট, তবে বাঁচার চান্স এক পার্সেন্ট। শামসুল হক এমনিতেই দু’জনের এরকম অবস্থা দেখে বিধস্ত ছিলেন। দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। তার মাঝে ডাক্তারের মুখ থেকে এমন একটা খবর আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো, তিনি অ্যাটাক করে ফেললেন! তাকেও এডমিট করা হলো। পাখি বেগম স্বামী আর মেয়ের অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে চুপসে গেলেন। বিমূঢ় ভঙ্গিতে মেয়ের ওটি থিয়েটারের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। রক্তাক্ত ঝুমুরকে একপলক দেখার সৌভাগ্যও হয়নি তার। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না কি ঘটে গেলো এসব? লাল টুকটুকে গাল, হাসলে যার দু-গাল ভেদ করে ছোট ছোট টোল পড়তো, মায়ের সব কথা যে শুনে চলতো এতকাল! তাখলিফের জন্য যে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে গেছিলো সেই মেয়েটা? যার একটুখানি আঙুল কাটলেই কেঁদে বুক ভাসাতো, তার নাকি আজ খাদ্যনালী সহ, পেট-পিঠ ভেদ করে ছুরি বেড়িয়েছে? বাঁচার আশা দিতে পারছেন না ডাক্তাররা? এমনটা তো মনেমনে তিনি তাখলিফের জন্য চাইতেন। সেখানে তার মেয়ে কেন? ঝুমুর কেন? পাখি বেগমের মাতৃসত্তা নড়বড়ে হয়ে গেলো। তিনি চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখলেন। ইয়াসিফ নিশ্চল ভঙ্গিতে শুধু ওটির সামনে করিডোরের মেঝেতে বসে রইলো। হাতে ফোন, ঘন্টা পাঁচেক আগে পাঠানো বোনের ম্যাসেজটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। সাঈদ হক দিশেহারা বোধ করলেন। এসব আর নিতে পারছেন না, তার সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটো এতদিন অনেক কষ্টে শত আঘাত সামলেছে। আবার কেন ঝড় এলো ওদের জীবনে? কি দোষ ওদের? কার বি’ষনজর পড়লো ওদের ওপর? উত্তর জানা নেই তার!

.

সন্ধ্যারাতে খোলা রাস্তায় দুজন মানুষের
ওপর এমন ভয়াবহ হামলার ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল পড়ে গেলো। শহরবাসীর উদ্বেগ বাড়লো। নিউজ হলো, পুলিশ এলো। তারা গুটিকয়েক পথচারী, রিকশাচালক সহ প্রতক্ষ্যদর্শী লোকজনদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তদন্ত শুরু করলো। সব শুনে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অবাক হলেন ব্যাপারটি ছিনতাইয়ের নয় বলে! তারা সেই রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে আসার অপেক্ষা করলেন। ফুটেজ হাতে এলেই তারা মূল ঘটনাটির অনেককিছুই অনুধাবন করতে পারবে, সেইসাথে হামলাকারীদের শনাক্ত করতেও কাজে দেবে।

এদিকে পৌষের শীতেও ঝিনুক দরদর করে ঘামছে।
ঝুমুর তো বাড়িতে ছিলো, তাখলিফ অফিসে। তাহলে ও কীভাবে তাখলিফের কাছে পৌঁছালো? দু’জনে একসাথে কীভাবে হামলার শিকার হলো? সবুজের সাথে পরিকল্পনা করার সময় তো ভেবে দেখেনি পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হবে! এমন রক্তারক্তি, পুলিশি হস্তক্ষেপের ব্যাপারগুলো তো মুহূর্তের জন্যও মাথায় আসেনি। তখন শুধু নিজের রাগ, জেদ, ক্ষোভ থেকে সায় দিয়েছে সবুজের পরিকল্পনাতে। নিজের হারানো সম্পর্ক, মর্যাদা, সুখ ফিরে পেতে। অথচ আজ যেখানে তাখলিফের থাকার কথা ছিলো, সেখানে ঝুমুর চলে এলো। ঝিনুকের মাথা কাজ করছে না। কি করবে এবার? একেরপর এক ফোন করেই যাচ্ছে কিন্তু সবুজ ফোন ধরছে না, বন্ধ আসছে। ঝিনুকের ভয় হচ্ছে, কি হবে? কোনোভাবে কেউ জেনে যাবে না তো? পুলিশ জানলে কি ওকে ধরে নিয়ে যাবে?

.

রাত দশটা। ওটি থেকে বের হয়ে ঝুমুরকে ট্রিট করা ডাক্তারদের একজন এসে ভয়াবহ আরেকটা নিউজ দিলেন। ঝুমুর প্রেগন্যান্ট ছিলো, দু-মাসের।
হামলার সময় পেটের ভেতরই বাচ্চাটা মরে গেছে।
আর ঝুমুরের অবস্থাও ক্রিটিকাল। সারা শরীর থেকে ব্লিডিং হচ্ছে অনবরত। সব মিলিয়ে জগাখিচুরি অবস্থা। ওর অপারেশন সাকসেসফুল করতে ডাক্তারদের টিম ওঠেপড়ে লেগেছে তবুও এক পার্সেন্ট আশা ছাড়া কিছুই দিতে পারছেন না। নিরিবিলি বাড়ির মানুষজন স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই খবরটা অকল্পনীয় ছিলো তাদের জন্য। ঝিনুকের মাথা ঘুরতে লাগলো। ও ভয়ে একেরপর এক ঢোক গিলতে লাগলো, এসব তো
ওর চিন্তারও বাইরে ছিলো! ডাক্তাররা ঝুমুরকে
লাইফ সাপোর্টে রাখতে বললেন। অন্যদিকে তাখলিফের অপারেশন সাকসেসফুল হলো। ওকে অবজার্ভেশনে রাখা হলো কয়েক ঘন্টার জন্য। পাখি বেগম নিজের দোষে সব হারিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন। কার জন্য খুড়লো গর্ত, আর তাতে কে পড়লো!

অপারেশনের পরদিন সকালে তাখলিফ যখন চোখ খুললো দেখলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।
ঘোর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা মস্তিষ্কটা অনুভব করলো সারা শরীর অবশ হয়ে আছে। কপালে ব্যান্ডেজ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন চলছে। এসবকে ছাপিয়ে কপালে, পেটের একপাশে কেটেকুটে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত শরীর, ব্যাকুল মনে তাখলিফ শুধু ঝুমুরের কথা জিজ্ঞেস করছিলো ছোটচাচার কাছে, ইয়াসিফের কাছে। তবে কারো কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায় নি ও। সবাই শুধু মলিন মুখে শুনিয়েছে ঝুমুর ভালো আছে, ঠিক আছে। তাদের কথা অবশ্য বিশ্বাস করেনি তাখলিফ। মন শুধু ‘কু’ ডাকছিলো ওর। যেন কোথাও খুব বড় কিছু একটা ঘটেছে, কিছু নেই। সব শূন্য। ওর বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। তাখলিফের অজানা আশঙ্কায় মাথার যন্ত্রণা, বুক যন্ত্রণা শুরু হলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। শুধু ঝুমুরের একটা ভালো খবর শোনার আশায় উদগ্রীব তাখলিফকে কেউই জানানোর সাহস করলো না আসল সত্যগুলো। কীভাবে বলবে ঝুমুরের জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত এখন দামী, ভীষণ দামী? কোন মুখে তাদের দুজনের সন্তানের মৃত্যুর খবরটি জানাবে? যার আগমনী খবর জানার আগেই ভ্রুণ অবস্থায় বিদায় নিয়েছে, নিতে হয়েছে কিছু পশুদের জন্য? অস্থির তাখলিফকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুমে রাখা হলো। এরপর কয়েক বার জ্ঞান ফিরলেও অত্যাধিক মাথাব্যথা আর দুর্বলতার দরুণ কথা বলা বা চিন্তাশক্তি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয় ও। প্রায় তিন দিন এমনিভাবে কেটে গেলো।

.

সোনাবরণ রোদ্দুর কাচ ভেদ করে লুটোপুটি খাচ্ছিলো কক্ষটিতে। মেশিনের ঝিম ধরা আওয়াজে কক্ষের নিস্তব্ধতা আরো প্রকট হচ্ছে। তাখলিফ অনুভব করলো তার শরীর হালকা লাগছে। কোনো ব্যথা নেই তবে বুক ভার হয়ে আছে। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে সব মনে করার চেষ্টা করলো ও। এরপরই আচমকা মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে বসতে গেলো। কিন্তু পারলো না। ও অনুভব করলো পেটের বা-পাশটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। বেল বাজতেই ডাক্তার-নার্স ছুটে এলো। ইয়াং ডক্টর শাফায়াত জায়িন চেকআপ করে এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন অনুভব করছেন এখন?”

তাখলিফ উল্টো জিজ্ঞেস করল, “ঝুমুর, আমার বউ। কোথায় ও? আপনারা ওর সাথে কি করেছেন?”

“সব বলবো। তার আগে বলুন আপনি এখন কেমন আছেন? ব্যথা আছে কোথাও?”

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন…”

সিস্টার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ডাক্তার
বললেন, “আপনি অসুস্থ! আমাদের কাজ সবার আগে আপনাকে ট্রিট করা…”

তাখলিফ চড়া গলায় ধমকে ওঠলো,
“আপনি বলছেন না কেন ঝুমুর কোথায়? বলে দিলেই হয়, প্লিজ বলুন…”

ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেন জানি মিথ্যে বলতে মন সায় দিলো না। সত্যটাই বলল, “ওনার খুব ক্রিটিকাল অবস্থা। অপারেশনের পরেও জ্ঞান ফিরেনি।এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন।”

তাখলিফের দমবন্ধ হয়ে এলো, “ম মানে?”

“দেখুন, এরবেশি কিছু আপনাকে আমরা জানাতে পারবো না। শুধু আল্লাহকে স্মরণ করুন। তিনি চাইলে ম্যাজিক হতে পারেন।”

তাখলিফ বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুঁচকে এলো ওর। ঝুমুরের কথা ভেবে উৎকন্ঠা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।
বাড়তে বাড়তে বুক জ্বালাপোড়া অনুভূত হলো। ডাক্তার ওর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে ধৈর্য ধরলেন। ধীর স্বরে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন মিস্টার তাখলিফ?”

তাখলিফ কাঠ গলায় শুধু বলল,
“আ’ম ওকে।”

“শিওর? কোনো ইন্টার্নাল প্রবলেম হচ্ছে? কিছু লুকাবেন না, আমাদের সাথে কোঅপারেট করবেন প্লিজ… ”

“বললাম তো আমি ঠিক আছি। স্টিল বেঁচে আছি। আ’ম ওকে।”

কাঠ গলায় বললো তাখলিফ। ডাক্তার শাফায়াত থামলো। রিপোর্ট দেখে সিস্টারকে ওর হেলথ আপডেট নোট করে রাখতে বললেন। ঘুমের ইনজেকশন দিতে বললেন। তাখলিফ সেটা বুঝতে পেরে ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমি ঠিক আছি ডক্টর। প্লিজ এসব ঔষধ আর সাজেস্ট করবেন না। আমার অসহ্য লাগে!”

ডাক্তার একটু থেমে এরপর বললেন, “ওকে, বাট…”

তাখলিফ ডাক্তারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি হাঁটাচলা করতে পারবো?”

“পারবেন। তবে খুব সাবধানে।”

“থ্যাংক্স।”

ডাক্তার ধন্যবাদটুকু গ্রহণ করে চলে যেতে গিয়েও দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছু একটা ভেবে এরপর বললেন, “মিস্টার তাখলিফ?”

তাখলিফ উত্তর দিলো,
“হু?”

“আপনার স্ত্রীকে আপনি খুব ভালোবাসেন?”

তাখলিফ চোখ বুজে এরপর গাঢ় স্বরে বলল,
“জানি না।”

ডক্টর শাফায়াত আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। কক্ষ হতে বেরিয়ে গেলো। এদিকে তাখলিফের জ্ঞান ফিরেছে শুনে পাখি বেগম, ঝিনুক আর নিশি বাদে বাড়ির সকলেই ওকে দেখতে এলো। তবে একসাথে না। একে একে। তাখলিফ অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই সবার সাথে কথা বললো। কিন্তু কাউকে ঝুমুরের কথা জিজ্ঞেস করলো না। সারা দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। তাখলিফ গেলো না ঝুমুরকে দেখতে।
আর কাকতালীয়ভাবে সেদিন রাতেই ঝুমুরের অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে পড়লো। বাড়ির সবাই কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। পাখি বেগম ঝিনুককে ধরে বিলাপ করতে কর‍তে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে যখন দিশেহারা তখন নিশি আর স্থির থাকতে পারলো না। ভাইয়ের কাছে ছুটলো, খুব না দেরি হয়ে যায়! নিশি তাহলে কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
ও তো জানে তাখলিফ ঝুমুরকে কতটা ভালোবাসে! জানে, ঝুমুর প্রতিটা মুহূর্ত নিজের জীবনের সাথে লড়াই করছে। ও জানে, আড়ালে শুনেছে ডাক্তারদের কথা। ঝুমুরের বাঁচার আশা যে এক পার্সেন্টও ছিলো, সেটাও নেই। শূন্য। তাখলিফ ভাইয়াকে ভালোবেসে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে ঝুমুর আপু নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। নয়তো ওদের দু’জনের একটা সুন্দর সংসার ছিলো, সেখানে ক’টা দিন পরেই ফুটফুটে কিউট একটা ফুল হতো। সেই ফুলটার বাবা তাখলিফ, আর সেখানে তাখলিফের কাছ থেকেই সবাই সবকিছু লুকাচ্ছে? এমনকি বাবা হওয়ার খবরটাও? বিষয়টা একদমই নিতে পারেনি নিশি। নিজের মনের মধ্যে খচখচ করছিলো ব্যাপারগুলো নিয়ে। অপরাধবোধে ভুগেই
সে এতক্ষণ যায়নি তাখলিফের কাছে। কিন্তু শেষমেশ না পেরে ও তাখলিফের কাছে গেলো এবং গড়গড় করে ভাইকে সব বলে দিলো। তাখলিফ এতটা সময় নিজেকে শান্ত রেখেছিলো, মনে শক্তি, সামর্থ্য সঞ্চয় করছিলো ঝুমুরের জন্য। কিন্তু ছোটবোনের মুখে এসব শুনে ওর দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেলো। পৃথিবী ফাঁকা হয়ে গেলো। ঝুমুর, ওর বাচ্চা? তাখলিফ বেরিয়ে এলো নিজের কেবিন থেকে। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো তবুও সব ভুলে গেলো ঝুমুরের জন্য! এরপর ওর কেবিনের সামনে আসতেই ওর সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে পড়লো। ফিনাইলের কড়া গন্ধের মাঝে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো, চোখদুটো বুজে এসে দুনিয়া অন্ধকার করে শরীর ভেঙে পড়তে চাইলো তবুও! তবুও প্রাণপণে নিজের সংবিৎশক্তি চালু রাখার চেষ্টা করলো তাখলিফ। শুধু ঝুমুরের জন্য! হসপিটালে কর্মরত স্টাফ, ডাক্তার, নার্সরা ভীষণ অবাক হলো পেশেন্টটির এমন আচরণে। তাদের অনুরোধ, বাড়ির সকলের শত অনুরোধ, জোরাজুরি কিছুতেই কাজ হলো না ওকে একচুল পরিমাণও নড়াতে, সরাতে। হসপিটালের সবচেয়ে বেস্ট ডক্টর তার টিম নিয়ে ঝুমুরকে রাখা কেবিনটাতে ঢুকতে যাবে, এরমধ্যেই দরজার সামনে ধপ করে বসে ডাক্তারের পা ধরে ফেললো তাখলিফ। এরপর রুদ্ধ হয়ে আসা করুণ গলায় এলোমেলো ভাবে অনেক কষ্টে বলল, “আমার ঝুমুর ভালো নেই ডক্টর! একটুও ভালো নেই। আমার বউটা খুব সরল, খুব ছোট, খুব ভীতু। এতগুলো দিন ধরে ও অনেক কষ্ট পাচ্ছে। আমি পাশে থাকতে পারিনি। কি বালছাল সেট করে রেখেছেন, মুখফুটে কাউকে কিছু বলতে পারছে না। আমি চিনি তো ওকে! আপনি ওকে সারিয়ে দিন, আমার কাছে ফিরিয়ে দিন প্লিজ ডক্টর। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না, ভালো থাকি না৷ আমার বউটা ছাড়া আমার আর কেউ নেই ডক্টর, কেউ নেই! ওকে প্লিজ সারিয়ে দিন…”

আঠাশ বছরের একজন যুবক। হাউমাউ করে কাঁদছে দেশের নামকরা সার্জন ডক্টর মাহমুদ তারিকের পা জড়িয়ে ধরে। ডক্টর মাহমুদ হকচকিয়ে গেলেন এমন কান্ড দেখে। তিনি পেশেন্টের যাবতীয় কন্ডিশন স্টাডি করে দেখেছেন, অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। তিনি ভেবে পেলেন না কি সান্ত্বনা দেবেন, কি আশা দেবেন এই ছেলেটাকে! এত বছরের ডাক্তারি পেশায় এমন অভিজ্ঞতা তার নেহাতই কম না। তবুও আজকের ব্যাপারটা একদম অন্যরকম। আচমকাই তার বুকের ভেতরটা অনবরত কাঁপতে লাগলো!

__________________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। শেষ পর্বের প্রথম অংশ।]

চলবে….