ফুলপিসি পর্ব-০১

0
360

#ফুলপিসি
#পর্ব-০১
#লেখা_ Bobita_Ray

-‘ ঋষি দরজাটা খুলে দে না বাবা? এবার আর ভুল হবে না। সত্যি সত্যিই ওই মেয়েটার সাথেই তোর বিয়ে দেব৷ দরকার পড়লে, ভাত, কাপড়ের দায়িত্ব তোর বাপ নিবে। তবুও তুই উল্টাপাল্টা কিছু করিস না।
-‘বৌদি তোমার মাথা ঠিক নেই। তুমি অতিরিক্ত টেনশনে আবোলতাবোল বকতেছো। ছেলের বউয়ের ভাত, কাপড়ের দায়িত্ব কোনদিন শ্বশুর নেয় না কী? আজব!
ঋষি দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। ফুলপিসির কথার উত্তরে বলল,
-‘কেন নিবে না পিসি? আমার হবুবউ কী রাক্ষসী? যে আমার বাপের সব সম্পদ খেয়ে ফেলবে?
-‘তুই একটা পাগল! পাগল! পাগল!
-‘মা তোমার এই কুটনি ননদ আসেই আমাদের সোনার সংসারে জিলাপির প্যাঁচ লাগাতে। পিসিকে এখুনি আমাদের বাসা থেকে চলে যেতে বলো?
ফুলপিসি আঁতকে উঠল। বৌদির কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
-‘সত্যি করে বলো তো বৌদি? এই ছেলে তুমি কাকে দিয়ে জন্ম দিছো? আর যাইহোক ওর মতো বজ্জাত ছেলে আমার দাদার হতেই পারে না।
-‘আহ্ ফুলি কী সব বলছো?
ফুলি মুখের ঘাম মুছে নিয়ে চিন্তিত হয়ে নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘তাহলে কী ওকে জন্ম দেওয়ার সময় দাদা নেশাপানি করে তোমার কাছে গিয়েছিল বৌদি? তারজন্যই বুঝি, তোমার মতো শান্তশিষ্ট মানুষের পেট থেকে ওর মতো ডেটএক্সপায়ার ছেলের জন্ম হইছে। ভেরী স্যাড।
ঋষি, ফুলপিসির দিকে আগুন চোখে তাকাল। এই মহিলা আসেই বাবা-মার মাথা ঋষির বিরুদ্ধে বিগড়ে দিতে। ফুলপিসি ভেংচি কেটে বলল,
-‘ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। মেয়ে আমার একটুও পছন্দ হয়নি। সো বিয়েটিয়ে বাদ।
-‘মা…
-‘ফুলি তুমি চুপ করো তো?
ঋষি বলল,
-‘আমি বার বার বলে দিচ্ছি ওই মেয়ে ছাড়া আমি বিয়েই করব না মা! দরকার পড়লে সন্ন্যাসী ব্রত পালন করব। তখন বুঝবা, বংশ ধ্বংস হতে কতক্ষণ সময় লাগে!

কথাটা শুনে, উত্তেজিত হয়ে ফুলপিসির প্রেশার বেড়ে গেল। চিৎকার করে বিনাকে ডাকল। বিনার বয়স তেরো বছর। এই বাড়িতে কাজ করে। বিনা দৌঁড়ে এলো। ফুলপিসি উঁচুস্বরে ডাকলেই তার বুক ধড়ফড় করে। ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘কী হইসে পিসি?
-‘শিগগিরই বরফ আর তেঁতুল নিয়ে আয়? আমার মাথা ও প্রেশার হট হয়ে গেছে।
বিনা দৌঁড়ে গিয়ে ফ্রীজ থেকে হাতে করে এক টুকরো বরফ নিয়ে আসলো। ফুলপিসি রাগে আগুন হয়ে বিনার মাথায় চাট্টি মারল।
-‘এভাবে কেউ বরফ আনে গাধী? যা বাটিতে করে নিয়ে আয়?
ফুলপিসি মাথায় বরফ দিয়ে, তেঁতুল গোলা খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে সোফায় বসল। ঋষির ফোন থেকে চুরি করে নেওয়া, গোপন নাম্বারে ফোন দিয়ে বলল,
-‘হ্যালো?
একটা কোমল নারীকণ্ঠ ধীর গলায় বলল,
-‘কে?
ফুলপিসি এত সুন্দর কণ্ঠস্বর শুনে দমে গেল। মিনমিন করে বলল,
-‘তুমি কে মা জননী?
-‘আমি পৃথিলা। আপনি কে?
ফুলপিসি নিজের উপর বেশ বিরক্ত। এত সুন্দর করে মেয়েটার সাথে কথা বলা ঠিক হলো না। কণ্ঠে বিরক্ত ফুটিয়ে বলল,
-‘শোনো, পৃথিলা না মিথিলা। আমি তোমার ভালোর জন্যই ফোন করছি। ঋষিকে তো তুমি চিনো নিশ্চয়ই? ওই যে তোমার বহুদিনের ঝুলিয়ে রাখা বেকার প্রেমিক। এই ছেলেটা একটা পাগল বুঝলা? পাগল না..পাগল না একদম বদ্ধ উন্মাদ। তার উপরে বেকার। এতদিন বাপের টাকায় ফুটানি দেখিয়ে চলতো। এখন তো আবার বাপের চাকুরীটাও নাই। শুনেছি ছেলেটার বাবা ছদ্মবেশে ঢাকা, আজীমপু রোডে ভিক্ষা করে। শুধু তাই না, ছেলেটা সিগারেট ছেড়ে বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে গাঁজাও টানে। পুরাই নষ্ট, বখে যাওয়া ছেলে। এই ছেলেকে আবেগের বশে তুমি যদি বিয়েও করো। তোমার ভবিষ্যত অন্ধকার।
-‘আপনি কী ফুলপিসি বলছেন?
অবাক বিস্ময়ে ফুলপিসির চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল।
-‘আহ্..কী সাংঘাতিক? মেয়েটা আমাকে চিনে ফেলল কীভাবে? মুখে বলল,
-‘ না..না। আমি কোন ফুলকলি না।
পৃথিলা মুখ টিপে হাসল খানিক। বলল,
-‘সমস্যা নাই। এখন তো শুধু আমার হবুশ্বশুর ভিক্ষা করে। পরবর্তীতে আমার ওই বাড়িতে বিয়ে হলে, আমি সবাইকে উৎসাহ দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়ে দেব। কোন কাজই ছোট না। দরকার পড়লে, ভিক্ষার উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশেও ভিক্ষা করতে যাব। তখন শুধু টাকাই টাকা। আমি খবরে দেখেছি, এমনিতেই বর্তমানে অলস জনগন কাজ বাদ দিয়ে এই পেশাটাই বেশি বেছে নিচ্ছে।
ফুলপিসির আবারও প্রেশার বেড়ে গেল। বুক ধড়ফড় করছে খুব। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-‘চুপ করো অসভ্য মেয়ে। মেয়ে তো নয়, যেন এটম বোম।
পৃথিলার হাসি চওড়া হলো। ফুলপিসি আবারও বলল,
-‘ ভাল কথা বললাম! শুনলা না। মাথা পাগল, এক লাইন বেশি বোঝা বেকার ছেলের বউ হলে, পরে বুঝবা! বিয়ের আসল মজা কী!

ঋষিকে বসার ঘরে আসতে দেখে, ফুলপিসি ভেংচি কাটলো। ঋষি সোফায় বসতে বসতে মাকে বলল,
-‘কবে যাবা? বিয়ের পাকা কথা বলতে?
ফুলপিসি ভেংচি কেটে বলল,
-‘তুই দেখি বিয়ে করার জন্য একদম মরে যাচ্ছিস ঋষি?
-‘শুধু মরেই তো যাচ্ছি পিসি! সরাসরি মেয়েকে ধরে এনে তো আর ঘরে তুলিনি।
-‘আমি মেয়ের বাড়িতে বলে দিমু, তুই বেকার, লুকিয়ে বিড়ির ভেতরের তামাক ফেলে দিয়ে গাঁজা ভরে টানিস।
ঋষি রাগে আগুন হয়ে গেল। বলল,
-‘মা তোমার এই কুটনি ননদকে এখুনি আমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে বলো? এই মহিলা শুধু মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে, পরিবেশ দূষণ করে।
ফুলপিসি ভেংচি কেটে বলল,
-‘আমি যামু না। এটা কী তোর বাপের বাড়ি? যে কথায় কথায় আমাকে চলে যেতে বলিস?
ঋষি ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
-‘তো কার বাপের বাড়ি?
-‘তোকে কেন বলুম?
-‘তুমি একটা পাগল পিসি।
-‘তোর চৌদ্দগুষ্ঠী পাগল।
-‘তুমি কী আলাদা গুষ্টির না কী?
-‘তোকে কেন বলুম?
-‘অসহ্য।
নিভা রানী বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘এই তোরা পিসি-ভাতিজা থামবি? সারাক্ষণ পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো একটা আরেকটার সাথে লেগে থাকিস। ঝগড়া করিস। অথচ পাঁচ মিনিট কেউ কাউকে না দেখলেই, অধৈর্য হয়ে যাস। দুইটাই পাগল।
-‘তোমার ছেলে পাগল বৌদি।
-‘তোমার ননদ পাগল মা।
ফুলপিসি, ঋষিকে বলল,
-‘তুই পাগল।
-‘তোমার জামাই পাগল।
ফুলপিসি রাগে কাঁপতে কাঁপতে পৃথিলাকে ফোন দিল। বলল,
-‘তুমি একটা পাগল।
বলেই ফোন রেখে দিয়ে, ঋষির দিকে একপলক তাকিয়ে পৈশাচিক হাসি দিল। এখন শান্তি লাগছে খুব। ঋষিও কম যায় না। পিসেমশাইকে ফোন দিয়ে বলল,
-‘আপনি একটা ন্যাংটি পাগল।
ফুলপিসি আঁতকে উঠল। ঋষি ফোনটা রেখে এক চোখ টিপে ঘরে চলে গেল।

মেয়ে দেখতে যাওয়ার দিন ফুলপিসি মাঞ্জা মেরে পার্লার থেকে সেজে এলো। এক ধাক্কায় বয়স দশ বছর কমে গেছে। ঋষি, পিসিকে দেখে বলল,
-‘আরেহ্..বাহ তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। তুমি এত সেজেগুঁজে কোথায় যাচ্ছো পিসি?
ফুলপিসি ব্যস্ত হাতে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বলল,
-‘কেন তোর বিয়ের পাকা কথা বলতে যামু।
-‘মা তোমার এই কুটনি ননদ গেলে কিন্তু আমি যাব না। নির্ঘাত মনে মনে শয়তানি ফন্দি এঁটেছে আমার বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য।
পিসি বলল,
-‘চুপ কর বেয়াদব। সবাই মেয়েরবাড়ি গিয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে ভালমন্দ গিলবি। আর আমি বাড়িতে বসে থাকুম ভেবেছিস? তুই না গেলে না যাবি। আমি তো যামুই। দেখি কে আটকায় আমায়!
ঋষি কোমরে দুইহাত রেখে বলল,
-‘ওহ, এখন বেকার ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে যাবা। তোমার সম্মানে লাগবে না?
-‘কেন আমার দাদার কী কম আছে? সে এখনো ইচ্ছে করলে তোর মায়ের মতো আরও দশটা বউ পালতে পারে।
নিখিলেশ শুকনো ঢোক গিলল। তার এই ছোট বোনটা সবসময় লাগামছাড়া কথাবার্তা বলে। কেশে বলল,
-‘এসব কী বলছিস তুই ফুলি?
-‘ওহ কিছু না। আমাদের পিসি-ভাতিজার কথার মাঝখানে তুমি কেন ফোঁড়ন কাটছো দাদা?

মেয়ের বাড়িতে গিয়ে সবাই ভদ্রতা করে প্লেটে অবশিষ্ট ফল, মিষ্টি, কিছু খাবার রেখে দিল। ফুলপিসি তো নিজের প্লেট পরিষ্কার করে খেলোই। একে একে সবার প্লেটের খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। পিসিকে রাক্ষসের মতো গপাগপ গিলতে দেখে, ঋষির খুব কান্না পেল। শুকনো ঢোক গিলে নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘এভাবে অন্যের প্লেটের খাবার খেতে হয় না পিসি।
পিসি ধমকে উঠল। উঁচুস্বরে বলল,
-‘চুপ কর তুই! অন্যের প্লেটের খাবার কী রে? আমি না খেলে খাবার গুলো শুধু শুধু নষ্ট হতো। ওনারা তো ফেলেই দিতো। তাই আমিই খেয়ে ফেলেছি। এতে আমারও পেট ভরল। ওনাদের খাবারও অপচয় হলো না। আমি কী ভুল কিছু বললাম বেয়াইমশাই?
পৃথিলার বাবার দিকে তাকিয়ে পিসি বলল। ভদ্রলোক শুকনো ঢোক গিলে, মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘না..না ঠিকই তো বলেছেন।
ফুলপিসি পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। পৃথিলার বাবা, কাকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘এখনকার ছেলে-মেয়েরা কেন যে বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে যায়! আমি বুঝি না বাপু! এদের আবার লজ্জা শরমও কম। সারাক্ষণ বিয়ে হয় না। বাপ-মা বিয়ে দেয় না। এসব হা-হুতাশ করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ায়। আমি তো ফেইক আইডি দিয়ে বর্তমান জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের কীর্তিকলাপ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। অথচ আমাদের যুগে বিয়ের কথা শুনলেই দশ হাত দূরে থাকতাম। কী যে লজ্জা লাগতো। আমার দাদাকে মানে ঋষির বাবাকে তো আবার একটা সাইকেল ও হাতঘড়ি ঘুষ দিয়ে বাবা বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল।
ঋষির বাবা হঠাৎ কেশে উঠল। তার এই বোনটার জন্য সবসময় লজ্জায় পড়তে হয়। কী দরকার ছিল। নতুন কুটুমবাড়ি এসে এইসব আলোচনা করার!
পিসেমশাই আলতো করে ফুসপিসির হাতে চিমটি কাটলো। যেন চুপ থাকে। পিসি চিল্লিয়ে উঠল। চোখ গরম করে বলল,
-‘এই তুমি এত জোরে চিমটি কাটলে কেন?
ভদ্রলোক লজ্জায় পরে গেল। মিনমিন করে বলল,
-‘কখন?
-‘কখন মানে? কেবলই তো কথা নেই বার্তা নেই আমার হাতে ঠুস করে চিমটি কাটলে? দেখো দেখো? আমার ফর্সা হাতটা তোমার নখের আঁচড় লেগে পুরো লাল টমেটো হয়ে গেছে।
ঋষির মা ফুলিকে নীচু কণ্ঠে মৃদু ধমকে বলল,
-‘আহ্..ফুলি এত কথা বলো না। চুপচাপ বসো। চেয়ে দেখো পাত্রী আসছে?
ফুলপিসি পৃথিলাকে দেখে, ঋষির মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘বৌদি পাত্রী তো প্রডাক্ট সুন্দরী। চেয়ে দেখো? পা দুটো শ্যামবর্ণ। অথচ মুখ আর হাত কী ফর্সা। ফুলপিসি ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে ভাল করে পাত্রী দেখে নিল। পাত্রীকে প্রশ্ন করল।
-‘তোমার নাম কী?
পৃথিলা আস্তে করে উত্তর দিল।
-‘পৃথিলা।
-‘তা মা তুমি মুখে কী প্রডাক্ট ইউজ করো? না মানে আমাকে বললে আমিও একটু ট্রাই করে দেখতাম।
পৃথিলা এত লজ্জা পেল। পাত্রী দেখতে এসে কেউ এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন করে না কী? আজব! অন্তত আড়ালে বলতে পারত। ঋষির খুব কান্না পেল। আজ যদি পৃথিলা বেঁকে বসে কিংবা বিয়েটা কোনভাবে ভেঙে যায়। ঋষি কিছুতেই ভাত খাবে না। ভাত না খেয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে পিসির চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করবে। তাতে যদি পিসির একটা কঠিন শিক্ষা হয়!

(চলবে)