#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৭
নিহানকে ফোনে না পেয়ে নিহানের মার মাথায় চিন্তা ভর করলো।ও তো কোনদিন এমন করে না।যতই ব্যস্ত থাকুক। ফোন রিসিভ করে।তাহলে আজকে কি হলো?ফোন কেন ধরছেনা?কোন বিপদ আপদ হলোনা তো?যাবার সময় কেন বলল নিহানের জন্য দোয়া করতে?ও যা চায় তাই যেন হয়?ভাবতে ভাবতে সোফায় বসে পরলেন।
কেবল ১০ মিনিট গেলো।এইটুকু সময়টাকে নিহানের কাছে হাজার বছরের সমান লাগছে।মাথায় দুশ্চিন্তারা ঝেকে বসে আছে।অস্তির হয়ে আছে সারা শরীর।বারবার সামনের অপারেশন থিয়েটারের দিকে চোখ যাচ্ছে।কখন লাল বাতিটা নিভে যাবে আর ডাক্তার এসে বলবে সব ঠিক আছে।ফ্লোর থেকে উঠে সামনের চেয়ারটায় বসল।কিছু সময় যেতেই অপারেশন থিয়েটারের লাইট নিভতে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।শুকনো গলায় কয়েকটা ঢোক গিলল।মাথায় নানারকম কথা আসছে।সেসবকে পাত্তা দিলো না।ডাক্তার বের হতেই দ্রুত পায়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তার বললেন,
“অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।আপনার মেয়ে হয়েছে।মা এবং বাচ্চা দুজনেই সুস্ত আছে।”
নিহান কথাটা শুনে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কি পেসেন্টের সাথে দেখা করতে পারব?”
“হুম।”
ডাক্তার যেতেই নার্স এসে নিহানের কোলে বাচ্চাটাকে দিলো।
“অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে হয়েছে আপনার।”
নার্স যখন নিহানের কোলে বাচ্চাটাকে দিচ্ছিলো তখন নিহানের ভয় হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো ওর কোন অসাবধানতার জন্য বাচ্চাটা যদি ব্যথা পায় কিংবা ভালো করে কোলে নিতে না পারে!বাচ্চাটাকে কোলে নেবার সাথে সাথে নিহানের সমস্ত ভয় দুর হয়ে গেল।নিহান অপারেশন রুমের ভিতর গেল।অনিমা তখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো।সামনের চেয়ারটায় বাচ্চাটাকে নিয়ে বসল।
“দেখুন অনিমা বাচ্চাটা পুরো আপনার মতো হয়েছে।নাক, চোখ,মুখ সবটাই ডুব্লিকেট আপনার মতো।আমি অনেক খুশি হয়েছি আপনাদের দেখে।বাচ্চাটাকে আর আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছিল ডাক্তারের কথা শুনে।এখন আপনাদের দুজনকে সুস্ত দেখে অনেক প্রশান্তি পাচ্ছি।আপনি নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন!আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করব না।অনেক কষ্ট করেছেন।আপনার ঘুমটা প্রয়োজন।দেখুন বাবুটাও আমার কোলে চুপচাপ শুয়ে আছে।কোন কান্নাকাটি করছেনা।তার মানে কি আমি ধরে নিব ও আমাকে পছন্দ করেছে?আমি চাই বাচ্চাটা আপনার মতো হোক।শুধু চেহারা দিয়েই না বিহেভিয়ার দিয়েও।আপনার মতোই শান্ত শিষ্ট হোক।তবে আপনার মতো সবরকম অন্যায় মেনে নিক সেটা আমি চাই না।আমি চাই বাবুটা প্রতিবাদ করুক সকল অন্যায়ের। সেটা হোক কাছের মানুষ বা দুরের!কিন্তু আপনি বাবুটাকে না দেখেই ঘুমাবেন?এটা কি করে হয়?”
বলতে না বলতেই অনিমা চোখ খুলল।অনিমাকে এমন হঠাত করে চোখ মেলতে দেখে নিহান অবাক হয়ে বলল,
“আপনি ঘুমাননি?এতক্ষম জেগে ছিলেন”
অনিমা শুয়া থেকে উঠার চেষ্টা করতে নিহান বাধা দিয়ে বলল,
“উঠবেন না!মাত্র অপারেশন হয়েছে আপনার।আমি বাবুকে আপনার পাশে শুইয়ে দিচ্ছি।”
বলেই বাচ্চাটাকে অনিমার পাশে শুইয়ে দিলো।অনিমা শুয়া থেকেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ। ”
নিহান ভ্রু কুচকে বলল,
“কিসের জন্য? ”
“এমনি!হঠাত দিতে ইচ্ছা হলো।”
কথা বলতে না বলতেই নিহানের পকেটের ফোন তীব্র শব্দে ভেজে উঠলো।
“আমি একটু বাইরে থেকে কথা বলে আসছি।”
অনিমা উপর নিচ মাথা নাড়লো।নিহান রুম থেকে বের হতে না হতেই কল কেটে গেলো।মোবাইল স্কিন ওপেন করতেই ২৫ টা মিসড কল দেখল মায়ের।শিট!এতকিছুর মাঝে ফোনটার কথা মনেই ছিলো না।এখন মাকে কি বলবে সে?আর কত মিথ্যা কথা বলবে?মিথ্যা বলতে বলতে হাপিয়ে উঠেছে।একটা শ্বাস নিতেই আবার ফোন বেজে উঠলো।নিহান সাথে সাথেই রিসিভ করল।
“কিরে?কতবার কল করলাম!রিসিভ করিস না কেন?”
“আম্মু!আসলে আমি একটু বিজি ছিলাম!”
“সেটা ফোন রিসিভ করে বললে কি সমস্যা হতো!এই কথা বলতে আর কতক্ষনই বা লাগতো?জানিস আমি কত টেনশন করছিলাম?ভাবলাম কোন বিপদে পরেছিস কিনা!”
“সরি আম্মু।”
“এখন কি করিস?”
“তেমন কিছুনা।আচ্ছা আমি রাখছি।বাসায় এসে কথা হবে।”
বলেই ফোন কেটে দিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকতেই অনিমা জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার মা কল করেছিলেন?”
“হুম।”
“কি বললেন?”
“আমি কোথায় আছি,কি করছি এসব।”
“আপনি কি উত্তর দিলেন?”
“বললাম কাজে আছি।পরে কথা হবে।”
“মিথ্যা বলেছেন?”
“এছাড়া আর কি করার আছে আমার?আমি যদি আম্মুকে বলি আপনার সাথে আছি তাহলে ঠিক কি হবে সেটা শুধু আমি জানি।আপনি আমার মাকে চিনেন না।”
“যদি জানতে পারেন আপনি তাকে মিথ্যা বলেছেন তখন….”
‘তখনেরটা তখন দেখা যাবে।আমি সামলিয়ে নিব।আপনি রেস্ট করুন।কথা বলবেন না।ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছেন।”
নিহানের কথামতো অনিমা চুপ হয়ে গেল।আসলেই কথা বলার সময় পেটে টান পরছে।তাই চুপ থাকাই ভালো। কিন্তু তার জন্য কেও মিথ্যা কথা বলুক সেটাও তো অনিমা কোনদিন চায়নি।নিহান একটার পর একটা মিথ্যা বলে যাচ্ছে শুধুমাত্র তার জন্যই।নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কিছুক্ষন বাদেই নিহান এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসে অনিমার সামনের চেয়ারে বসল।বসে স্যুপের ঢাকনা খুলতে খুলতে বলল,
“বাবু ঘুমিয়ে পরেছে?”
“হুম।কিছুক্ষন আগেই ঘুমালো।”
“এই স্যুপটুকু খেয়ে নিন।সকাল থেকে তো কিছুই খাননি।আর এখন এই অবস্থায় আপনাক্র ভারি খাবারও খাওয়ানো যাবে না।সব লিকুইড খাবার খেতে হবে।”
“কিন্তু স্যুপ….”
“স্যুপ আপনার যে পছন্দ না সেটা আমি জানি।কিন্তু এই স্যুপটা হাসপাতাল থেকে কিনা না।হোম মেইড।ঘরে বানানো।আশা করি ভালো লাগবে।”
বলেই নিহান এক চামচ স্যুপ অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো।অনিমাও আর কথা না বারিয়ে স্যুপটা মুখে দিতেই বুঝল আসলেই স্বাদটা একদম আলাদা।অন্যান্য স্যুপে তো লবনও ঠিক মতো দেয়না।বিশেষ করে হাসপাতালের স্যুপগুলাতে।শুধু পানির মতো বুঝা যায়।অইগুলার থেকে এই স্যুপটার টেস্ট পুরাই ভিন্নরকম।অনিমার খাওয়া দেখে নিহান মনে মনে মুচকি হাসলো।যাক অনিমার পছন্দ হয়েছে।কত শত ইউটিউবে ভিডিও দেখে তারপর স্যুপটা বানিয়েছে।
আরেক চামচ অনিমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“বাবুর নাম কি রাখবেন ভেবে দেখেছেন?”
“নাহ!ভাবা হয়ে উঠেনি।”
“আমার একটা নাম পছন্দ হয়েছে।বলি?”
“হুম।বলেন।”
“অরিন রাখলে কেমন হয়?আপনার নামের সাথে মিল আছে। তাই এই নামটা চুজ করা।”
“বাহ!বেশ ভালো নাম তো!পছন্দ হয়েছে আমার।তাহলে এখন থেকে ওর নাম অরিন।আকিকা করিয়া পুরো নামটা ঠিক করব।”
নিহান হেসে মাথা নাড়ালো।
.
.
“নিহান! তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
নিহান কেবল বাসায় ঢুকে নিজের রুমে যাচ্ছিলো।মায়ের এমন কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল।পিছনে ফিরে বলল,
“একটু পরে কথা বলি?অনেক৷ টায়ার্ড লাগছে।ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলছি কেমন?”
বলেই যাওয়া ধরতে নিলেই আবার নিহানের মা আটকে দিলো।আদেশের স্বরে বলল,
“তোমাকে আমি বলেছি তোমার সাথে কথা আছে মানে এখনই বলব।সোফায় বসো।”
মায়ের এমন কথা শুনে নিহানের ভ্রু কুচকে এলো।
কি এমন বলবে যা পরে বললে হয় না।সোফায় বসতে বসতে বলল,
“বলো কি বলবে?শুনি!”
নিহানের মা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুই বিয়ে কবে করবি?”
“হঠাত এই প্রশ্ন?”
“৮ মাসের বেশি চলে গেলো তুই এখনো বিয়ে করার কোন নাম গন্ধ নেই।আমি তোর মা!তোকে নিয়ে আমার টেনশম হয়।”
“কয়েকদিম পরেই!”
নিহানের মা খুশি হয়ে বললেন,
“তাহলে তিথির মার সাথে কথা বলি?”
“তিথির মার সাথে কেন কথা বলবে?”
তিথির মা আজকে ফোন দিয়েছিলো।বলল তিথি নাকি এখনো তোকে বিয়ে করতে রাজি।দেখেছিস?মেয়েটা কত ভালো? এতকিছুর পরও তোকে বিয়ে করতে চাইছে।এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
“আমি তিথিকে বিয়ে করব না!বিয়ে করলে অনিমাকেই করব।”
“তুই আবার অনিমার নাম নেওয়া শুরু করেছিস?মেয়েটা কি তোকে কি জাদু টুনা করল বলতো?মাথা থেকে যাচ্ছেই না!”
“অই মেয়ে আমাকে কোন জাদু টোনা করেনি।বরং আমিই উনাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছি।এতে উনার কোন দোষ নেই।শুধু শুধু উনাকে বাজে কথা বলবে না।আমি আমার ডিশিসন জানিয়ে দিয়েছি।শুধু শুধু বারবার তিথিকে বিয়ে করার কথা বলে আমাকে রাগিও না।সারাজীবন তোমার কাছে আমার সিদ্ধান্তের কোন মূল্যই ছিলো না।আমিও সবসময় তোমার কথা শুনে এসেছি।সম্মান করে এসেছি।কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে আমি তোমার কথা রাখতে পারব না।”
বলেই সোফা থেকে চলে গেল।নিহানের কথা শুনে নিহানের মা হতবম্ব হয়ে বসে রইলেন।তার চাওটাকি ভুল?একজন মা হয়ে ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রী খুজাটা কি ভুল?
.
.
৩ দিন পর আজকে অনিমা হাসপাতালে থেকে বাসায় যাবে। নিহান সবকিছু ব্যাগে প্যাক করে ফেলেছে।এইতো আর ১০ মিনিট পর ৯ টা বাজলেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাবে।৯ টা বাজার সাথে সাথেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসলো।অনিমার কোলে অরিন।নিহান সব ব্যাগ পত্র গাড়ির পিছনে রেখে সামনে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল।কিছুক্ষন বাদে অনিমার মনে হলো ওরা বাসার দিকে যাচ্ছে না।বরং অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?এটা তো বাসায় যাওয়ার রাস্তা না।”
চলবে….