একঝাঁক জোনাকি পর্ব-১৯

0
171

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৯

কিছুক্ষন বাদেই মুক্তা বেগমের জ্ঞান ফিরলো।চোখ মিটমিট করে সামনে তাকাতেই নিহানকে দেখতে পেলো।আর তার একটু দুরেই অনিমাকে দেখে উঠার চেষ্টা করতেই আবার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো।নিহান মাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলল,

“উঠো না।তোমার প্রেসার হাই হয়ে গেছে।লেবু পানি খেলে ঠিক হয়ে যাবে।রহিমাকে বলেছি।একটু পরেই নিয়ে আসবে।”

মুক্তা বেগম ছেলের কথা পাত্তা না দিয়ে উঠে গম্ভীর গলায় বললেন,

“আমার লেবু পানি টানি লাগবে না।আমি এই মেয়েকে কোনদিন নিজের বউমা হিসেবে মেনে নিতে পারব না।আর না অই বাচ্চা আমার নাতনি।আমি কাওকেই মেনে নিতে পারব না।”

নিহান গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি মানো আর না মানো আমি উনাকে আমার স্ত্রী আর বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে মেনে নিয়েছি তুমি না মানলেও অনিমা যে আমার স্ত্রী সেটা কখনো বদলে যাবে না।”

“অই বাচ্চাটা তোর বাচ্চা না আমি জানি।অই মেয়ে ইচ্ছা তোকে ফাসিয়ে বাচ্চাকে তোর উপর চেপে দিয়েছে।”

“অরিন আমার মেয়ে।তুমি যদি আমার বউ আর বাচ্চাকে এভাবে অপমান করো তাহলে আমি এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।”

নিহানের কথায় মুক্তা বেগম শুয়া থেকে উঠে অবাক হয়ে বলল,

“এসব কি বলছিস তুই?এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি মানে?তুই অই মেয়ের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে,তোর মাকে ছেড়ে যাবি?”

“তাই বলে আমি অনিমা আর অরিনকে এভাবে অপমানের উপর রাখতে পারি না!”

“বিয়ে যখন করেই ফেলেছিস আমি তো আর কিছু করতে পারবো না।তোরা এই বাড়িতেই থাক।তবে আমি একটা কথা বলে রাখছি অই মেয়েকে এই বাড়ির বউ হিসেবে আমি কোনদিন মেনে নিব না।মরে গেলেও না।আমাকে জোর করিস না।”

বলেই বসা থেকে উঠে মাথা ধরে নিজের রুমে চলে গেলেন।নিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অনিমার দিকে ফিরে বলল,

“ঠিক আছেন আপনি?”

“আমার আবার কি হবে?”

“যেভাবে মাকে ধরলেন যদি কিছু হয়ে যেতো?আপনার একদমই উচিত হয়নি এত বড় রিস্ক নেওয়া।কেবল ৩ দিন আগে আপনার অপারেশন হলো!এই অবস্তায় একদমই উচিত হয়নি।”

নিহানের কথা শুনে অনিমা অবাক হয়ে বলল,

“তো?আমি করতাম?উনাকে এভাবে পরে যেতে দেখতাম?আপনার কোলে তো অরিন ছিলো।আমি না ধরলে তো উনি পরেই যেতেন!পরে আবার আরেকটা অঘটন ঘটতো!আমি ছাড়া উনাকে ধরার মতো কেউই ছিলো না।”

অনিমার কথা শুনে নিহান চুপ হয়ে গেলো।সত্যিই অনিমা মাকে না ধরলে অনেক বড়সড় বিপদ হয়ে যেতো।

“যাইহোক আপনি রুমে আসুন।রেস্ট দরকার আপনার।সারাদিন অনেক ধকল গেছে আপনার উপর দিয়ে।”

“কিন্তু আপনার মা….”

“উনাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।প্রেসারের ঔষধ আছে। খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।আমি কিছুক্ষন পর গিয়ে খাইয়ে দিয়ে আস।আমার পিছু পিছু আসুন।আর আস্তে আসবেন।”

অনিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিহানের পিছু পিছু রুমে আসতেই অবাক হয়ে গেলো।চারদিকে শুধু বই আর বই।ডাক্তারদের রুম যেমন হয় সেটার প্রমান অনিমা নিহানের রুমে ঢুকেই বুঝে ফেলল।অনিমাকে সারা রুম এভাবে তাকাতে দেখে নিহান বলল,

“কি হলো?কি দেখছেন?বসুন।”

“অহ,হ্যা বসছি।”

অনিমার হাতে অরিনকে দিয়ে বলল,

“ঘুমিয়ে গেছে।শুইয়ে দিন।”

নিহানের হাত থেকে অরিনকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেই নিহান বলল,

“আপনিও রেস্ট নিন।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।অনিমা পুরো রুম তাকাতে হঠাত খাটের পাশের ছোট টেবিলে নজর গেলো।নিহানের ছবি রাখা অইখানে।সামগ্লাস পরে হাসিমুখে ছবিটা তুলা।মন হয় সি বিচে তোলা।আশেপাশে বালু দেখা যাচ্ছে।আশ্চর্য নিহানকে কোনদিন ভালো করে দেখেইনি সে।জাস্ট কথা বলতো এইটুকুই।ভালো করে কোনদিনই দেখা হয় নি।ছবিতে নিহানের গালে টোল পরা আছে।তার মানে কি উনি হাসলে গালে তোল পরে?কই আগে দেখেনি তো!অবশ্য লোকটা ওর সামনে বেশি হাসেও নি!
.
.
নিহান মার রুমে যেতেই দেখল বিছানায় শুয়ে আছে ও পাশ ফিরে।দরজায় নক দিয়ে বলল,

“আম্মু আসব?”

মুক্তা বেগম কোন উত্তর দিলেন না।নিহান চুপচাপ রুমে ঢুকে ড্রয়ার থেকে প্রেসারের ঔষধ বের করে মার সামনে গিয়ে হাতে থাকা খাবারের প্লেট বিছানার উপর রেখে বলল,

“খাবারটা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।”

“পরে খাবো।তুই যা এখান থেকে।”

“কেন রাগ করে আছো?আমি মানছি তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করাটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে।আমার আর কিছু করার ছিলো না।তুমি তো জানো আমি কোন কাজ কোন রিজন ছাড়া করি না।অনিমা মেয়েটা অনেক ভালো! তিথির থেকে।আমি তোমাকে আর কিছুই বলব না।আস্তে আস্তে তুমি নিজে বুঝবে অনিমা এই বাড়ির বউ হিসেবে যোগ্য কিনা!খাবারটা খেয়ে নিও।আমি আসছি।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।অনিমার জন্য খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই টেবিলের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে হেসে সামনে গেলো।অনিমা নিহানকে ঘরে আসতে দেখে নাই এখনো।গলা ঝেড়ে নিহান বলল,

“অনেক তো আমার ছবি নিয়ে গবেষণা করলেন।খাবারটা খেয়ে নিন।”

আচমকে নিহানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো অনিমা।মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই নিহানকে দেখতে পেলো।হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়ানো।লজ্জা পেলো খুব।এভাবে কিনা একটা ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে ছিল যে ঘরে কেও ঢুকেছে সেটা টের পাওয়া তো দুরের কথা বুঝতেও পারেনি।নিহান কিছু না বলে অনিমার সামনে বসে পরল।হাতে থাকা খাবারের প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার অনিমার মুখের সামনে ধরে ইশারায় বলল খেতে।অনিমাও চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো লোকমাটা মুখে তুলে নিলো।যদিও একটু অস্বস্তি হচ্ছে।কারন হাসপাতালে সবসময় নিহাম চামচ দিয়েই খাবার খাইয়েছে। কিন্তু আজকে প্রথম নিহানেত হাতে খাবার খাচ্ছে।অস্বস্তি তো হবেই।নিহান আরেক লোকমা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আম্মুর কথায় কিছু মনে করবেন না।আম্মু এরকমই।বাইরে দিয়ে কঠিন ভেতর দিয়ে নরম।আম্মুর পছন্দের পাত্রী ছিলেন তিথি।তার বদলে আপনাকে বিয়ে করেছি।তাই একটু কষ্ট পেয়েছে।আপনাকে একবার পছন্দ করে ফেললে দেখবেন আম্মু কত ভালো,কত মিশুক।”

অনিমা মুখে লোকমা নিয়ে বলল,

“না না,কি মনে করব?আমি কিছু মনে করিনি।গুরুজন যা বলবে তাই ঠিক।হয়তো আমিই ভুল করেছি।”

“আপনি কোন ভুল করেন নি।যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ি আপনার এতে কোন দোষ নেই।নিজেকে এভাবে দোষ দিবেন না!”

অনিমা আর কিছু বলল না।চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো।নিহাম খাবারের প্লেট নিয়ে যেতেই যাবে হঠাত রুমের ভিতর একটা মেয়ের আগমম ঘটল।মেয়েটা রুমে ঢুকেই অনিমার দিকে তাকিয়ে নিহানের দিকে তাকালো।মেয়েটাকে দেখে নিহানও যে অবাক হয়েছে সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।মেয়েটা নিহানের সামনে গিয়ে কোমড়ে দুই হাত দিয়ে বলল,

“ভাইয়া এসব কি শুনছি?তুই নাকি বিয়ে করেছিস?পিচ্চিও নাকি আছ্ব তোদের?”

“দেখতেই তো পাচ্ছিস!জিজ্ঞেস করার কি আছে?”

“তুই এটা কি করে করলি?তোর ১৫ বঁছরের ভালোবাসার কি হবে?যার জন্য তুই অপেক্ষা করলি?এভাবে তোর ভালোবাসা বদলে গেলো?”

নিহান ইশারায় চুপ করতে বলল।কিন্তু মারিয়া তো মারিয়াই!ওকে কেও চুপ করাতে পারবে না।মারিয়া এবার অনিমার কাছে গেলো।

“শুনো ভাবি ভাইয়া যেহেতু তার ১৫ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে তোমাকে বিয়ে করেছে তারমানে তুমি তার কাছে স্পেশাল!ভাইয়াকে কখনো তার পুরনো প্রেমিকার কথা মনে করতে দিও না কেমন?”

অনিমা অবাক হয়ে নিহানের দিকে তাকালো। নিহান মারিয়ার কাছে গিয়ে বলল,

“এই তোর কোন পড়া লেখা নাই?সারাটাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াস!”

মারিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

“ভাইয়া তুই মনে হয় ভুলে যাচ্ছিস আমি কয়েকদিন আগে এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছি।১২ তারিখ আমার রেজাল্ট। এখন আমার কোন পড়ালেখা নেই।”

“১২ তারিখ রেজাল্ট না?রেজাল্টটা দিয়ে নিক! যদি খারাপ করিস তাহলে তোর খবর আছে বলে দিলাম!এখন যা আমার রুম থেকে।”

“অবশ্যই! তোমাদের প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করতে দেওয়া উচিত আমার।”

“তুই যাবি?”

মারিয়া অনিমার কাছে গিয়ে বলল,

“ভাবি তুমি না অনেক কিউট।আম্মুর তোমাকে পছন্দ মা হলেও আমার তোমাকে অনেক পছন্দ হয়েছে বুঝলে এজন্যই তো ভাইয়া তার ১৫ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে তোমাকে বিয়ে করেছে।এখন বুঝতে পারছি।”

বলে হেসে নিহানের দিকে তাকাতেই নিহানের চাহনি দেখে হাসি থেমে গেলো।

“আমি আসি হ্যা?”

অনিমা মাথা নাড়লো।মারিয়া দৌড়ে রুম থেকে চলে গেলো।অনিমা বলল,

“আপনি কোথায় ঘুমাবেন?”

“অইটা নিয়ে আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না।আপনি ঘুমান।”

অনিমা নিহানের কথায় সম্মতি জানিয়ে শুয়ে পরল।কিছুক্ষন বাদেই ঘুমিয়ে পরল।নিহান দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল কোথায় ঘুমানো যায়।বিছানায় তো একেবারেই না।তাহলে কি ফ্লোরে ঘুমাবে?হুম এইটাই করতে হবে।সামনের কাবার্ড থেকে চাদর আর বালিশ নিয়ে ফ্লোরে বিছালো।ঘরের লাইট নিভিয়ে শুতে যাওয়ার আগে অনিমার মুখের দিকে তাকালো।ড্রিম লাইটের আলোয় অনিমার মুখের সৌন্দর্য যেন ৫ গুন বেড়ে গিয়েছে।নিজেকে সামলিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরল।রাত প্রায় ৩ টা বাজে কান্নার আওয়াজে নিহানের ঘুম ভেংগে গেল।চোখ মুখ কুচকে শুয়া থেকে উঠলো।কেবল একটু আগেই ঘুমিয়ে ছিলো।শুয়া থেকে উঠে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল অরিন কান্না করছে।অনিমা পাশে ঘুমিয়ে আছে।এখনো টের পায়নি। অনিমা টের পাওয়ার আগেই নিহান অরিনকে কোলে তুলে নিলো।

“কি হয়েছে আমার মা টার?কান্না করছো কেন?ক্ষিধে লেগেছে?”

অনেক হেঁটেও কান্না থামাতে পারলো না।কোলে নিয়েই কিচেন রুমে চলে গেলো দুধ বানানোর জন্য। কিছুক্ষন বাদেই দুধ বানানো হয়ে গেলে হাতে ঠান্ডা হবার জন্য রেখে দিলো।ঠান্ডা হতেই ফিডারে ভরে অরিনের মুখে দিয়ে দিলো।খাবার পেয়ে যেন কান্নার কথা ভুলে গেলো।চুপ করে খাবার খেতে লাগলো।খাবার খাওয়া শেষে নিহান হেঁটে হেঁটে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

সকালে মিষ্টি রোদের আলোয় অনিমার ঘুম ভেংগে গেলো।শুয়া থেকে উঠে একটু সামনে যেতেই….
চলবে….