#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
ইফাদের ওরকম নি’ষ্ঠুর আচরণের শিকার হওয়ার পর বাকি রাতটা রিতুর নির্ঘুম কাটলো। কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না। ভোরের দিকে চোখ লেগে এলেও বিয়ে বাড়ির হৈচৈ আর কাজের ব্যস্ততায়
আবার খুব সকালেই উঠে পড়লো। শ্বাশুড়ি, ননদদের কাজ ভাগাভাগি করে নিলো। কিন্তু ইফাদকে নিয়ে বেশি বেশি চিন্তার কারণে ওর চোখেমুখে একরাশ বিষন্নতা এসে ভর করলো। মনের দুঃখগুলো যেন বাইরে থেকে স্পষ্ট ওর বোঝা যাচ্ছিলো। মেহমানদের কেউ কেউ তো ঠাট্টা করে বলেই ফেললো বরের বিরহে বউটার এই দশা। রিতু ওদের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সবাই ওর দুঃখ বুঝতে পারছে। কিন্তু অংক স্যার তা পারছে না। তিনি ক্রমশই সরল থেকে জটিল হয়ে ওঠছে। ও তো সরল করতেই হিমশিম খেতো, জটিল অংক স্যারকে কীভাবে সামলাবে? ইশিতা ওকে খোঁচা মে’রে বলল, সবই নাটক! রিতু বোনের দিকে মর্মাহত দৃষ্টিতে তাকালো। কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
— তুমি আমার নিজের বোন? এভাবে বলতে পারছো?
আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তা তুমি বুঝছো না আপু?
— না রে। আমার সবই মেকি মনে হচ্ছে…
রিতু আর বোনের পাশে বসলো না। উঠে চলে এলো। যে ওর দুঃখ বোঝেও না বোঝার ভান করে তার কাছ থেকে সান্ত্বনা আশা করাটা বোকামি। নিজের ঘরের দিকে যেতেই নেবে তার আগেই নাজিয়া ইসলামের ডাক পড়লো। রিতু চোখ মুছে শ্বাশুড়ির ঘরে গেলো। নাজিয়া ইসলাম ওকে বসতে বলে আলমারি খুলে একটা গয়নার বাক্স বের করে নিয়ে এলেন। সেখান থেকে একটা ভারী সোনার হার ওকে পরিয়ে দিলেন। এরপর বাক্সটা ওর হাতে দিয়ে বললেন,
— এটা তোমার জন্য গড়ালাম। বাহ! বেশ সুন্দর লাগছে।
— আমার জন্য আবার কেন? এগুলো তো ইফতি আপুর গয়না…
— বারে! এটা তোমার উপহার। আমার একটা ছেলের বউ। মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি বলে বৌমাকে দেব না? ভাবলাম ইশিতার জন্য যখন বানাচ্ছিই, তোমার
জন্যও বানাই। সুন্দর করে শাড়ি পরে সাজবে কিন্তু। আর এগুলো ইশিতাকে পরিয়ে দিও, এখনো গয়না পরানো বাকি রয়ে গেল!
শ্বাশুড়ি বললেন মিষ্টি করে। রিতু মায়ের আদর খুব ছোটবেলায় পেয়েছে। বড় হবার পর মায়ের আদর কি জিনিস তা দেখেনি। ইফাদের সঙ্গে এত দুর্ব্যবহার
করার পরেও নাজিয়া ইসলাম ওকে কি সুন্দর ভালোবাসছেন! রিতুর অপরাধবোধ প্রবল হলো।
হঠাৎ করেই চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো। নাজিয়া ইসলাম আঁৎকে উঠে বললেন,
— সেকি! চোখে জল কেন?
রিতু চোখ মুছে হাসলো,
— মায়ের কথা মনে পড়ছে।
— বোকা মেয়ে। এভাবে কাঁদতে আছে নাকি? আমি
তো তোমার মা-ই।
— আপনি আমার উপর রেগে আছেন তাইনা মা?
— কেন বলো তো?
— স্যারের জন্য।
নাজিয়া ইসলাম হেসে বলল,
— সে একটু রেগে আছি। তাই বলে মা’রবো নাকি?
এমন দা’জ্জা-ল শ্বাশুড়ি বুঝি আমি?
রিতু দু-পাশে মাথা নাড়ালো। ওর কেমন দিশেহারা এক অনুভূতি হচ্ছে। গত রাতে ইফাদের সাথে কথা বলার পর থেকেই ওর কারণে অকারণে বুকের ভেতরটা ভারী ঠেকছে। শুধু কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে একটু পর পর। নাজিয়া ইসলাম ওর মনোভাব বুঝতে পেরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
— আমার ছেলের ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছো?
রিতু চোখ লুকানোর চেষ্টা করলো,
— না না…
— বড্ড জ্বালাচ্ছে না?
রিতু মাথা নিচু করে বলল,
— আমিও তো কম জ্বালাইনি।
রিতুর মুখ দেখে মায়া হলো নাজিয়া ইসলামের। মেয়েটার বয়স কম। নিজে ভুল করেছে, এখন সেই ভুলের কারণে কষ্টও পাচ্ছে। স্বামীর থেকে দূরে থাকার কষ্ট! চেয়েও তিনি আর কঠিন হতে পারলেন না। নরম গলায় বললেন,
— আমার ইফাদ এরকম নয়। আমি ওকে বকে দেব, তুমি কেঁদো না মা।
— আপনি বললে স্যার ফিরে আসবে।
— তুমি বলো, ঠিক আসবে…
— আমি বলেছি, শুনে নি।
নাজিয়া ইসলাম ছোট্ট করে শ্বাস ফেললেন৷ ছেলেটা এবার সত্যিই অভিমান করেছে৷ তিনি কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। এরমধ্যেই ইফতির গয়না নেওয়ার জন্য রুফি এসে তাড়া দিলো৷ রিতু ওর সাথে উঠে চলে গেলো। নাজিয়া ইসলাম বারবার করে বলে দিলেন যাতে ও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয়।
.
ইফতিকে লাল রঙের বেনারসিতে দারুণ লাগছে দেখতে। সবাই ওর প্রশংসা করছে। কেউ কেউ ঠাট্টা, মশকরাও শুরু করেছে। আশফি বারবার ম্যাসেজ করছে। ওর বউ সাজ দেখতে চাইছে৷ ইফতি বলে দিলো সে কোনো ছবিটবি পাঠাতে পারবে না৷ একেবারে বিয়ের আসরেই দেখা হবে। আশফি বেচারা হতাশ হলো বউয়ের কথায়। ইফতি মজা নিলো। তবে পটের বিবি সেজে বসে থাকতে ওর বড্ড বিরক্ত লাগছে। এরমধ্যেই ইফাদের ফোন এলো। ছোট ভাইয়ের ফোন দেখেই ইফতি ঠোঁট টিপে হাসলো। ফোন রিসিভ করে বলল,
— আজকে আমার বিয়ে। এরমধ্যেও তুই শান্তি দিবি
না? নিজের বউকে ফোন দে না বাপু, আমাকে ছাড়…
ইফাদ গলায় হতাশা ফুটিয়ে বলল,
— আমি তো রিতুকে একটু টাইট দিচ্ছি। এজন্য ওর সাথে যোগাযোগ করা যাবে না।
— বেশি টাইট দিলে বউ না আবার ফস্কে যায়।
ইফাদ ঘাবড়ে গেলো,
— মানে?
— তোর বউয়ের চেহারার দিকে তাকানো যায় না আর। বেচারি কাউকে কিছু বলছে না, কিন্তু যে মনে মনে খুব ভুগছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। শোন ইফাদ, অনেক হয়েছে। এবার সব ঠিক করে নে।
ইফাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— আমি তো সব ঠিক করার জন্যই এসব করছি।
ইফতি কিছুটা রাগী সুরেই বলল,
— যোগাযোগ বন্ধ করলে সব ঠিক হবে ভাবছিস?
বোনের রাগ দেখে ইফাদ মজা করে বলল,
— দূরত্ব গুরুত্ব বাড়ায় একটা প্রবাদ নিশ্চয় শুনেছো?
— দূরত্ব মাঝেমাঝে দূরেও ঠেলে দেয়।
ইফাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— আমি সেটাই দেখতে চাই। সেরকম হলে ধরে নেব, মরীচিকার পেছনে ছুটে লাভ নেই। আমাদের মধ্যে কিছুই সম্ভব নয়।
ও কথাটা বেশ সিরিয়াসলি বললো৷ ইফতি তাই প্রসঙ্গ বদলের প্রয়োজন অনুভব করলো।
ইফাদও সেটা বুঝতে পারলো। বোনকে বলল,
— তোমার বিয়েতে থাকতে পারলাম না বলে সরি।
— থাক। আমি তো তোর কেউ নই, আসবি কেন!
ভালো করেছিস আসিস নি…
— রাগ করছো কেন? সবে এলাম। পরিস্থিতি তো
বুঝতে হবে…
ইফতি ধমক দিলো,
— রিতু বললে যে এক্ষুণি টিকিট ওকে করে ফেলবি সেটা আমি খুব ভালোই জানি।
ইফাদ হো হো করে হেসে ওঠলো।
— এখন আর এতটা উদার হতে ইচ্ছে করে না…
— দেখা যাবে।
ফোন রেখে দেওয়ার আগে ইফাদ বোনকে বলল,
— আই মিস ইউ আপু।
— মি টু।
.
বরপক্ষ চলে এলো যোহরের নামাযের পরপরই।
বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো আড়াইটার দিকে। এরপর বিয়ে পরবর্তী বাকি সব আয়োজন শুরু হলো।
বিয়েতে রিতু মেরুন রঙের শাড়ি পরলো। এই
শাড়িটাও ইফাদের দেওয়া। শাড়িটা পরার পর এক ধরণের ভালো লাগা অনুভব করলো রিতু, এটা ইফাদ ওকে ভালোবেসে দিয়েছিলো। রিতু তখন বোঝার চেষ্টা করেনি, কিন্তু আজ করছে। ও বসেছিলো।রুফিদের পাশে। একপর্যায়ে ওর চোখে পড়লো অমি ফোন
নিয়ে চো’রের মতো ওর আশেপাশেই ঘুরছে।
তৌফ নেই সাথে। গত রাতের কথা মনে হতেই রিতু
ওর কাছে গিয়ে সন্দেহী চোখে তাকালো,
— ঘটনা কী?
অমি থতমত খেয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
— কিছু না তো।
এরপর একটু থেমে ইতস্তত করে বলল,
— ভাবি আপনার ক’টা ছবি তুলে দেই?
রিতু সাথে সাথেই ‘না’ বললো। অমি আশাহত ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই রিতু বলল,
— স্যার আমাকে ফোন করে না। তোমাদের করলে বলো, আমাকে যাতে ফোন দেয়।
অমি বোকা বোকা হেসে বলল,
— হে হে আমি কী বলব? আপনি বলে দিয়েন…
বলতে বলতে অমি আড়াল হয়ে গেলো। রিতু
সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলো৷ বিয়ের
সব কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ। এবার বউ বিদায়ের পালা। বিদায়ের সময় ইফতি একটুও কাঁদলো না। বরং হাসিমুখেই বিদায় নিলো আশফির হাত ধরে। রিতু অবাক হলো, সেইসাথে নিজের বিদায়ের কথা মনে পড়লো ওর। সেদিন কীভাবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিলো বাবাকে ধরে, আর ইফাদ ওকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলেছিলো! বিয়ের স্মৃতি মনে পড়া মাত্রই রিতু শক্ত হয়ে গেলো৷ সব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর তৌফকে গিয়ে ধরলো ও। অনেক কাকুতিমিনতি আর জোর করার পর ইফাদের নাম্বার সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো ও। এরপর ধীরেসুস্থে, সময় নিয়ে রাত গভীর হতেই কল করলো ইফাদের নাম্বারটিতে। অনেকক্ষণ রিং হয়ে কেটে গেলো। রিতু কাঁদলো কিন্তু হাল ছাড়লো না। কল করতেই লাগলো যতক্ষণ না ফোন রিসিভ হয়, ইফাদ হ্যালো বলে। অবশেষে ফোন রিসিভ হলো। শোনা গেলো ইফাদের ঘুমঘুম কন্ঠস্বর। রিতুর রাগে তখন সত্যিই কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। ওর ঘুম হা’রা’ম করে এ লোকটা নাক ডেকে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। এও ছিলো ওর কপালে? রিতু ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইফাদ
জিজ্ঞেস করলো,
— হ্যালো? হু আর ইউ?
মানুষটা গভীর ঘুমে ছিলো। গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
এজন্যই হয়তো খেয়াল করেনি যে নাম্বারটা বাংলাদেশি। নয়তো রিতু যে ফোন করেছে সেটা প্রথমেই বুঝতে পারতো। যাক, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। নয়তো দেখা যেত, অংক স্যার ওর নাম্বার দেখে ফোনই রিসিভ করলেন না! রিতু নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এরপর কাঁপা গলায় বলল,
— আমি রিতু।
এতক্ষণে ইফাদের হুঁশ ফিরলো৷ কান থেকে ফোনটা সরিয়ে স্ক্রিনে নাম্বার দেখে অবাক হলো ও। দেশে এখন গভীর রাত৷ এত রাতে রিতু ওকে কেন ফোন করেছে? কিছু কি বি’প’দ হয়েছে? ইফাদ উদ্বিগ্ন বোধ করলো। চিন্তিত হয়ে বলল,
— ক কী হয়েছে রিতু? এত রাত করে ফোন করলে যে?
রিতুর সংকোচ হচ্ছিলো ভীষণ। কিন্তু একসময় সেটা কাটিয়ে চোখ বন্ধ করে বলেই দিলো,
— আমি আপনাকে মিস করছি স্যার।
ইফাদ শান্ত হলো। বি’প’দ কিছু হয়নি তাহলে। পরক্ষণেই রিতুর কথাটা মাথায় দামামা বাজালো।
ভ্রু কুঁচকে এলো। বাংলাদেশ সময় এখন রাত দুটো।
এই গভীর রাতে মেয়েটা ফোন করে বলছে ওকে মিস করছে? আশ্চর্য! ইফাদের বুকের ভেতরটা কাঁপলো, শীতল হলো। মনের ভেতর প্রজাপতি উড়তে লাগলো। নরম সুরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কাঠিন্যতা মিশিয়ে বলল,
— তুমি কি মজা করছো আমার সাথে রিতু? আমি কিন্তু এখন মজার মুডে নেই।
— আমি মজা করছি না। সত্যিই মিস করছি আপনাকে।
বলে রিতু কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। ওপাশে
ইফাদ হকচকিয়ে গেলো,
— কাঁদছো কেন? একদম কান্নাকাটি করবে না।
— তাহলে বলুন আপনি আমার উপর আর রেগে থাকবেন না?
ইফাদ বলল,
— আমি কারো উপর রাগ করি না।
রিতু নাক টেনে অভিযোগের সুরে বলল,
— কেন করেন না? আপনাকে যখন আমি কষ্ট দিতাম তখন কেন আমাকে দুটো চ’ড় দিয়ে বলেন
নি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন? রিতু তুমি অ’ন্যা’য় করছো?
হু? কেন বলেন নি?
ইফাদ চুপ করে ওর কথাগুলো শুনলো। কিন্তু রিতুর নাক টানার শব্দে ওর হাসি পেলো। অনেক কষ্টে সেটা আটকালো। গলার স্বর গম্ভীর করে বলল,
— পুরোনো কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। ঘুমিয়ে পড়ো, গুড নাইট।
রিতু মনে মনে বলল, আপনি চলে যাওয়ার পর আমার কোনো রাতই আর গুড হয় না স্যার। সবগুলো রাতই এখন ব্যাড নাইট। সেটাও আপনার জন্য।
এসব ভেবে কিছু একটা বলতে যাবে এরমধ্যেই ‘টুট টুট’
শব্দ ভেসে এলো। রিতুর নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো বোকামোর জন্য। এই লোকের রাগ, অভিমান ভাঙানো প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে সেটা হবে? যদি ইফাদ ওর সাথে কথা না বলে?
_________________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…