#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০
সময় বহমান। চলছে নিজ গতিতে, নিজ স্রোতে।
ক্যালেন্ডার বদলেছে কয়েকটা। রিতু-ইফাদের জীবন নিজস্ব ধারায় চলছে। নতুন করে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ইফাদ এখন পুরোপুরি গবেষণার কাজে ব্যস্ত। অন্যদিকে রিতু এবার অনার্স থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার্থী। পড়াশোনাটা রিতু মূলত নিজের জন্য করে না। করে ইফাদের জন্য। ওর বকা খাওয়ার ভয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে হয় রিতুকে। পড়াশোনার প্রতি রিতুর অবহেলা ইফাদ একদম নিতে পারে না। মেয়েটা দিনদিন ওকে যত বাঁধনে বেঁধে ফেলছে ঠিক ততটুকুই দূরে চলে গেছে পড়াশোনা নামক জিনিসটা থেকে। তাই সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, রিতু যদি এভাবেই চলতে থাকে, সে যদি ঠিক করেই থাকে পড়াশোনা আর করবে না তাহলে ওর উপর থেকে সব আশা-ভরসা হারিয়ে ফেলবে ইফাদ। আর যেখানে আশা-ভরসা নেই
সেখানে অহেতুক সময় নষ্ট করবে না সে। এই হু’মকি শুনেই রিতুর একটু কান্ডজ্ঞান হয়েছিল। তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও সে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। সামনের মাসেই ওর পরীক্ষা। এতদিন পড়াশোনার ধারেকাছেও যায়নি রিতু। তাই এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে কি ভুলটাই না এতদিন করেছে সে। অল্প সময়ে এই লম্বা সিলেবাস শেষ করা অসম্ভবই বটে। তবে ইফাদ ওকে গাইড করছে। বলেছে প্রথম থেকে পড়াটা ধরতে, ভাগাভাগি করে প্রতিটা সাবজেক্ট পড়লে অনেকটাই কভার করা যাবে। রিতু ওর কথামতোই রুটিন করে পড়ছে। কিন্তু ওর মনোযোগ নেই পড়ায়। মন নামক শ’ত্রুটা সবসময় পড়ে থাকতে চায় ইফাদের কাছে। এই পরীক্ষার দোহাই দিয়ে ইফাদ সারাদিনে একবার কল দেয় ওকে, তাও পাঁচ মিনিটের বেশি এক সেকেন্ডও কথা বলে না। এতদিন ঘন্টার পর ঘন্টা যেখানে কথা হতো, সেখানে এখন পাঁচ মিনিট কথা বলে রিতুর কিছুতেই মন ভরে না। খুব রাগ হয় ওর ইফাদের প্রতি। লোকটা বড্ড বেশি করছে ওর প্রতি। রিতু একদিকে পড়ার কষ্টে কাঁদে অন্যদিকে স্বামীর দুঃখে কাঁদে।
.
এভাবে কেটে গেল দুই সপ্তাহ। এরমধ্যে ইফাদের সঙ্গে রিতুর কথা হলো চৌদ্দ দু-গুণে পাঁচ, অর্থাৎ সত্তর মিনিট। এই অল্প সময়ের কথায় রিতুর মনের কানাকড়িও ভরে না। মন খুলে কথা বলতে না পারায় রিতুর মন ভালো নেই। ইফাদ কি এখন অন্য কাউকে পেয়ে গেছে যে রিতুর সঙ্গে আগের মতো কথা বলে না?বাহানা করে? এই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে রিতু একদিন ওকে জেরা করল এবং ইফাদের উত্তর শোনার আগে নিজেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ফোনে। ইফাদ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। ছোট্ট করে ধমক দিল বউয়ের বাচ্চামো আচরণে। ঠাট্টা করে বলল,
— তুমি যদি ভালো সিজিপিএ তুলতে না পারো তাহলে অবশ্যই, অবশ্যই আমি অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য হব।
রিতু তৎক্ষনাৎ কান্নাকাটি থামিয়ে ফেলল বিস্ময়ে এ কথা শুনে। বলল,
— হবেন কি? হয়েই তো গেছেন। আমি এখন পুরোনো হয়ে গেছি না? হবই তো! সুন্দরী দেখলে কার আর মাথার ঠিক থাকে?
ইফাদ মজা পেল। কেশে বলল,
— ঐ যে কাঁচাবাজারে পুঁটিমাছ ওয়ালীটা, সে এখন আমার ঘাড়ে এমনভাবে চেপে বসেছে যে সুন্দরীদের দিকে ঘাড়টা ফেরাতেই দেয় না। তুমি কী আমার হয়ে তাকে একটু বলে দেবে?
রিতু কটমট করে বলল,
— কী বলে দেব?
— বলবে অনুগ্রহ করে আমাকে যাতে সুন্দরী রমণীদের দিকে একটু তাকাতে দেয়। একটু অনুগ্রহ যাতে করে। নয়তো এ নরাধমের জীবন-যৌবন সব নিরামিষের মতো কাটবে।
রিতুর মুখ হা হয়ে গেছে। রাগে শরীর কাঁপছে। ইফাদের সব চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। গলা টি’পে ধরতে ইচ্ছে করছে। এতবড় সাহস অংক স্যারের? ওকে এসব কথা বলছে? বিয়ে করা বউকে? নির্লজ্জতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে? এসব নিকৃষ্টতার জন্য আবার অনুমতি চাইছে?
রিতু তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলো। ইফাদের মতো করেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— অনুগ্রহ চাওয়ার কিছু নেই। অনুমতি দেওয়া হলো। সেইসাথে আমাকেও অনুমতি দিন, আমারও তো জীবন-যৌবন আছে। তাই না?
ইফাদ শুনার সাথেই প্রকান্ড এক ধমক দিল রিতুকে। ফোনের এপাশে রিতু কেঁপে উঠে কথা বলা ভুলে গেল কিছুক্ষণ। এরপর নিজেকে সামলে, কান্না আটকে
বলল,
— ফোন রাখছি। আর কক্ষণো ফোন করবেন না।
বলে কেটে দিল। ইফাদ ধমকটা দিয়েই বুঝতে পারল সে একটু বেশিই করেছে। রিতুটা তো ওর সঙ্গই চাইছিল, ওর সাথে কথা বলার জন্য একটু সময় চাইছিল। সে-ই তো বাড়াবাড়িটা করছে। বউকে নিয়মের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। উল্টাপাল্টা সন্দেহ হওয়াটা তো স্বাভাবিক। এরমধ্যে ও আবার আগুনে ঘি ঢেলেছে সুন্দরী রমণীদের কথা বলে। মেয়েটা ওকে এত ভালোবাসে আর ও কিনা এভাবে বকলো? রিতু নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে। ইফাদ ফোন ব্যাক করল আবার। রিতু পাঁচবারের মাথায় রিসিভ করে বলল,
— সমস্যা কী? অনুমতি তো দিলাম। যা খুশি করুন। আমাকে ফোন দেওয়ার মানে কী?
ইফাদ লজ্জিতবোধ করল। ছি ছি। রিতু ওকে নিয়ে এসব ভাবে? ও তো ঠাট্টা করছিল। একরাশ অস্বস্তি এসে ভর করলো ওর মনে। ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
— সরি। একশোবার সরি। আমার নাক, কান কেটে
নাও, যা খুশি করো এরপরেও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
রিতু ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় বলল,
— আমাকে এসব বলছেন কেন? আমার কী?
আমি কে?
ইফাদ বউয়ের রাগ বুঝতে পারল। ওর কথার মাঝখানেই গলা নরম করে বলল,
— তুমি রিতুই তো আমার সব। তোমার অভাবে কত পুষ্টিহীনতায় ভুগছি আমি! এত রাগ করে না মিষ্টি বউ।
রিতু তাতেও গললো না,
— কীসের বউ? কে বউ? আমি কারো বউ না। কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এভাবে বলে না।
আবার কেঁদে ফেলল রিতু। ইফাদ অসহায়বোধ করল। বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
–যে তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতেই পারিনা সেই তুমি এভাবে সন্দেহ করলে, মাথাটা গরম হবে না? বলো? ভুল করেছি। ক্ষমা করে দাও। তুমি রেগে
থাকলে আমার চোখে ঘুম আসবে না।
এ কথা শুনতেই রিতুর মনটা নিমিষেই গলে গেল। চোখমুখ মুছে নিয়ে বলল,
— আচ্ছা ঠিক আছে।
ইফাদ হাসি চেপে বলল,
— রাগ কমলো?
— কমেছে।
ইফাদ ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
— আজ অনেকক্ষণ কথা বলব।
রিতু বলল,
— দরকার নেই। ফোন রাখছি। ঘুমান।
ইফাদ অনুনয় করল,
–প্রমিজ তোমার পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে আগের মতো সময় দেব তোমাকে। এখন কেন সময় কম দিই সেটা তো জানো তুমি। ফোনে এত সময় নষ্ট করাটা তোমার জন্য ক্ষতি। এ ক’টা দিন কষ্ট করে পড়াশোনাটা করো৷ দেখবে পরীক্ষার ফলটা ভালো হবে। তোমার কি ইচ্ছে করে না আমাকে একটা ভালো রেজাল্ট উপহার দিতে?
রিতু মুখ ফুলিয়ে বলল।
— করে।
— এইতো ভালো মেয়ে, অনেক ভালোবাসা।
রিতু শান্ত হলো,
— এখন রাখব?
ইফাদ হাসলো,
— আজ আরেকটু থাকো। কাল থেকে ভালোভাবে পড়বে। হুম?
— পড়ব।
রিতু খুশি হলো। রাগ টাগ সব ধুয়েমুছে গেল। ইফাদের অনুরোধ রক্ষা করল, যদিও ইচ্ছেটা ওরই বেশি।
ইফাদ সারাদিনে কী করেছে, খেয়েছে, পড়াশোনা কতদূর এগুলো সেসব নিয়ে আলোচনা শুরু করল। প্রেমের কথাও হলো কিছুক্ষণ। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। রাত গভীর হলো। ফোনে কথা বলতে বলতে রিতু কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল টের পেল না। ইফাদ নিজেই বকবক করতে করতে যখন ওপাশ থেকে সাড়া পেল না তখন ও আপনমনে হেসে ফেলল। রিতু কখনোই ওর ফোন কাটে না, সবসময় ওকেই কাটতে হয়। ওর ক্ষ্যাপা বউটা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে
পড়েছে ভেবে স্বস্তি পেল। রিতুর ঘুমন্ত চেহারাটা
দেখার ইচ্ছে তীব্র হলো। ইফাদ চোখ বুজে ইমাজিন করে নিলো ঘুমিয়ে থাকা অভিমানীনিকে।
★
রিতুর থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে।
এখন ওর স্বস্তি। তখনি খবরটা এলো। ইশিতা মা হবে। বিয়ের দীর্ঘ ছয় বছর পর। খবরটা শুনে রিতু ভীষণ আনন্দিত। সে খালা হবে। কতদিনের স্বপ্ন ওর। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো বড় আপু মা হবে বলে। ইশিতার কতদিনের স্বপ্ন-আকাঙ্খা। বিয়ের মাস ছয়েক পর থেকেই ও মা হতে চেয়েছে। সেজন্য কত কান্নাকাটি, অনুনয়! কিন্তু এজাজ চায় নি বউ তার পড়াশোনা ছেড়েছুড়ে বাচ্চা সামলাক। যে নিজেই এখনো বাচ্চা, বাচ্চার মতো আচরণ সে কীভাবে বাচ্চা মানুষ করবে? এ নিয়ে সেসময় দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডাও হয়েছিল। তবে এটা সত্যি এজাজ ইশিতাকে বড্ড ভালোবাসে, চোখে হারায়। তাই সে শর্ত দিয়েছিল গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলে তবেই বাচ্চা নেবে। ইশিতা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে, এজাজও তার কথা রেখেছে।
রিতুর মনে তখনই চিন্তাটা এলো। ওর আর ইফাদের বিয়েরও কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। ওরা বাচ্চা নেবে কবে? ও মা হবে কবে? ইফাদ কবে বাবা হবে?
এতটা সময় পেরিয়ে গেল এই চিন্তাগুলো তো প্রশ্রয় পায়নি ওর মনের মধ্যে। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতো। কিন্তু ভাবনাটা ডালপালা মেলেনি কখনো। কিন্তু ইশিতা মা হবে শুনে এবার রিতুর মনেও মা হওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগলো। ইফাদকে সে কথা বলতে ওর লজ্জা লাগছিল। কিন্তু ওর ইতস্তত ভাব আর লাজুক গলা শুনে ইফাদ যখন ওকে চেপে ধরল তখন কোনোমতে সুপ্ত চাওয়াটা জানালো রিতু। জানিয়েই ফোন কেটে দিলো। এত লজ্জা মনে হয় না কখনো পেয়েছে রিতু। ঘোরের মাথায় ও বেবী কবে আসবে সে এটাই জিজ্ঞেস করেছে ইফাদকে। ইশ! কী লজ্জা! অনেকক্ষণ দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল রিতু। টুংটাং করে নোটিফিকেশন বেল বেজে উঠতেই ও আবার ফোনটা হাতে নিলো। ইফাদ ম্যাসেজ করেছে। রিতুর ভ্রু কুঁচকে গেল। কল না দিয়ে
ম্যাসেজ? কী এমন লিখল? রিতু আগ্রহ নিয়ে ম্যাসেজটা ওপেন করে পড়ল। ছোট্ট করে লেখা,
— ভেরি সুন।
মা হওয়ার মতো অতীব সুন্দর আর চমকপ্রদ ব্যাপারটাকে ইমাজিন করে রিতু বালিশে মুখ চেপে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
_______
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। লিখতেই আছি, শেষ হয়েও হচ্ছে না।]
চলবে…