সুখের ঠিকানা পর্ব-১৩+১৪

0
225

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৩

জারিফ স্তব্ধ হয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে।কিকরে এখন সবাইকে সেদিনের বিষয়টা বলবে ভেবে পাচ্ছে না।অথচ এখন না বলেও উপায় নেই।এতবড় একটা বিষয় গোপন রেখে কোনো মেয়ের সাথে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা একজন বিবেকবান ,জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের কাজ নয়।সেদিনও জারিফের বিবেকবোধ বিষয়টা সবাইকে জানাতে মরিয়া ছিলো।বাট লিয়া বারংবার বাঁধা দিয়েছিলো।হাত জোড়করে রিকোয়েস্ট করেছিলো বিষয়টা আড়ালে রাখতে।আজ এই পর্যন্ত আসলেও জারিফের সততা,ন্যায়বোধ জারিফকে আরো প্রকট করে তুলেছে।সত্যিটা না বলা পর্যন্ত এতটুকু স্বস্তি মিলছে না জারিফের।তাই জারিফ মনেমনে ডিসিশন নিয়ে নেয়।লিয়া বাঁধা দিলেও সে সবাইকে সত্যিটা বলবে।জারিফকে নির্বিকার দেখে জাহানারা বেগম ভরাট কন্ঠে ফের শুধালেন,,

“কি ব্যাপার জারিফ।এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় ন’ষ্ট করবি।ওদিকে সবাই অপেক্ষা করছে তো।”

জারিফ মাথাটা নুইয়ে নিল।চোখ বন্ধ করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। কন্ঠে অপরাধ বোধ নিয়ে বলল,,”মা আমার কিছু কথা আছে।যা এখন বলাটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট।আর এসব হলুদ প্রোগ্রাম সব ক্যান্সেল করো।”

জারিফের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে জাহানারা বেগম তড়িৎ বেগে বিস্ফোরিত নয়নে ছেলের মুখপানে চাইলেন।ছেলে যে তার মজার ছলে এমন কথা বলছে না তা ওনার ভালোভাবেই জানা।বিয়ে নিয়ে এমন সিরিয়াস বিষয়ে নিশ্চয় জারিফ মজা করবে না।এমন হেঁয়ালি কথার পিছনে কোনো না কোনো কারন তো বটেই আছে। জাহানারা বেগম খেয়ালি নজরে ছেলেকে পরখ করলেন। অবাক গলায় ফের শুধালেন,”মানে?কি বলতে চাইছিস? পরিষ্কার করে বল।”

নীল জারিফের কথা শুনে চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে নির্বাক হয়ে যায়।এমন মূহূর্তে এসে এই ধরণের কথায় যে কেউ অবাক হবে অস্বাভাবিক কিছু নয়। লিয়া ঘামতে শুরু করে।টেনশনে লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।বিষয়টা সবাই জানার পর পরিবারের মান সম্মান কোথায় যাবে?এটা ভাবতেই লিয়ার হৃদস্পন্দন যেনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো।সব কিছুর জন্য লিয়ার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে।

জারিফ দৃঢ় কন্ঠে বলল,,”আমি সবার সামনেই বলতে চাই।সবার থেকে আগে তাসনিমের আর ওর পরিবারের জানা জরুরী।”

.
কমিউনিটি সেন্টারের একটা রুমে দুই পরিবারের সবাই উৎসুক ভাবে দাড়িয়ে আছে।সবারই চোখে মুখে কৌতুহল।কি এমন কথা যা বলার জন্য হলুদের অনুষ্ঠান বাদ রেখে জারিফ দুই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে এক জায়গায় দাড় করিয়েছে।লিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবটা জানার পর কি হবে তাই ভেবে। দূর্ঘটনার কথা জানার পর যদি তাসনিমের বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।তবে লিয়া নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।লিয়া সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে মনেমনে বারবার প্রে করছে।সবাই যেনো দূর্ঘটনাটাকে দূর্ঘটনা হিসেবেই নেয়।আর বিয়েটা যাতে না ভাঙ্গে।জারিফ লিয়ার দিকে এক নজর তাকালো।যা লিয়ার নজরে পড়লো না।কারন লিয়া মাথা নুইয়ে চোখ বন্ধ করে দুইহাতে লেহেঙ্গার এক অংশ মুঠো করে আছে।জারিফ মাথা নুইয়ে তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীন আওয়াজে আওড়ালো,,

“সরি তাসনিম।আ’ম রিয়েলি সরি।আমার আরো আগে বলা উচিত ছিলো।লেইট করে আমি বড্ড বো’কা’মি করে ফেলেছি।জানিনা সত্যিটা জানার পর তোমার সহ সবার রিয়াকশন কেমন হবে।তবুও আমাকে সবটা বলতেই হবে।”

একটু থামে জারিফ। তাসনিম বিস্ময়কর চাহনিতে জারিফের মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে।আর বোঝার চেষ্টা করছে জারিফ একচুয়েলি কি বলতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন্ঠে একরাশ অপরাধ বোধ নিয়ে ঠোঁট আওড়ায়,,” আমার জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।যা আপনাদের সবার জানা জরুরী।পরিস্থিতির কাছে হার মেনে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে।যদিও এই বিয়ের কোনই ভ্যালু নেই আমার কাছে।একদম ভ্যালুলেস।যেটা হয়েছে এক্সিডেন্টলি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে রাতে বাধ্য হয়ে তথাকথিত বিয়ে হয়েছে।”

সবাই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।লিয়ার আত্মা শুকিয়ে আসছে।বাবা মা পরিবার জানলে লিয়াকেই দোষারোপ করবে নিশ্চয়।কেনো জানায়নি?এতবড় একটা ঘটনা আড়ালে রেখেছে কেনো? জাহানারা বেগম যেনো ঘটনার আকস্মিকতায় মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হলেন।ছেলে এসব কি বলছে তা ওনার বোধগম্য হলো না।কয়েক কদম এগিয়ে আসলেন।জারিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে উঠলেন ,,”জারিফ বাবা কি যাতা বলছিস।বিয়ে হয়েছে মানেটা কি?তুই এসব মজা করে বলছিস তাইনা?কালকে তোর বিয়ে সেখানে এরকম মজা কেউ করে বাবা।বাইরে কত অতিথিরা আছে।সবাই এরকম কথা শুনলে কি বলবে ভাবতো।তুই না আমার বুঝদার ছেলে।”

জারিফের বাবা আনোয়ার রহমান সুক্ষ নজরে ছেলেকে পরখ করলেন।ওনার তীক্ষ্ণ নার্ভ জানান দিচ্ছে ছেলে এমনি এমনি এসব বলছে না।মজা করার মতো ছেলে জারিফ না।আর বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে কখনোই মজা করবে না। এতটুকু দৃঢ় বিশ্বাস ছেলের উপর আছে।তাইতো স্ত্রীকে থামিয়ে দিতে বললেন,,”আহ্ জারিফের মা তুমি থামবে।জারিফকে বলতে দাও।জারিফ কোনো প্রকারের হেঁয়ালি ছাড়াই স্পষ্ট করে বলো।এখানে এতো গুলো মানুষ এইমূহুর্তে কেউ তোমার তামাশা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে নেই।তাই বলছি অনেস্টলি সব ক্লিয়ার করে বলো।”

জারিফ মৃদুস্বরে স্পষ্টভাবে বলল,,”বাবা সেদিন যখন বিয়ের শপিং করে তাসনিমদেরকে ওদের বাসায় রেখে ফিরছিলাম।আমার সাথে লিয়া ছিলো।”

এরমধ্যে তাসনিম কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,,”হ্যা জানি তো।”

মনের ভেতর ভালোলাগার অনুভূতিকে দমিয়ে রেখে ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো জারিফ।তাসনিমের চোখে চোখ রাখতে পারলো না। তাই মাথাটা হেট করে সাহস সঞ্চয় করে নির্ভীক দৃঢ় কন্ঠে বলল,,”তুমি সবটাই জানো না।আমাকে বলতে দাও।”

তাসনিম ঠোঁট মেলে বললো,,”ওকে ফিনিশ করো।”

জারিফ বলতে থাকে,,
সেদিন রাতে লিয়াকে সাথে করে আসার সময় মাঝপথে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়।দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টিপাতও হয়। সময়ের সাথে কালবৈশাখী ঝড় থেমে যায়।তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি রয়ে যায়।জারিফ স্বাভাবিকভাবেই ড্রাইভ করে আসছিলো। এরমধ্যে হঠাৎ করেই জারিফ গাড়ির ব্রেক কষে। জারিফের এভাবে ব্রেক করায় লিয়া পাশে বসা জারিফের দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায়।জারিফ দৃষ্টি সামনে রেখে একহাতে স্টিয়ারিংয়ে হালকা পাঞ্চ করে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলো,”ওহ্ শিট।”

লিয়া সামনে তাকিয়ে এতক্ষণে খেয়াল করলো বিষয়টা। রাস্তা জুড়ে বড়সড় একটা গাছ উপড়ে পড়ে আছে।ঝড়ের কারনে এমন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।জারিফ গাড়ির দরজা খুলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ে।সামনে এগিয়ে গিয়ে বিষয়টা ভালো করে দেখে। কিন্তু না যাওয়ার মতো কোনো অবস্থায়ই নেই।জারিফ মুখায়বে স্পষ্ট বিরক্তবোধ নিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। বৃষ্টির পানিতে জারিফের চুলগুলো কিছুটা ভিজে যায়।জারিফ একহাতে চুলগুলো ঝাড়তে থাকে।ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

“শহরে যাওয়ার এই একটাই কি রাস্তা।না মানে এদিকে কোনোদিন আসা হয়নি।আজ দিয়ে দুইবার হবে।আর সেদিনও এদিকটা দিয়েই গিয়েছিলাম। তোমাদের বাড়ি যাওয়ার পথঘাট ।তোমার তো কিছু জানার কথা।”

লিয়ার চোখে মুখে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটে আসে।লিয়া একহাতে মুখে ছিটে আসা পানিটুকু মুছে নেয়।একটু সময় নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ইয়ে মানে আমার জানা নেই।আসলে আমরা গ্রামে খুব কমই আসি।বিশেষ করে কোনো অকেশন ছাড়া তেমন আসা হয়না।এই ঈদ কিংবা কোনো অনুষ্ঠান এই যা আসা।আর আমি যতবার এসেছি ড্রাইভার আঙ্কেলকে তো এইদিকটা দিয়েই আসতে দেখেছি।”

জারিফ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,,”ওকে।দেখছি এখন কি করা যায়।”

লিয়া ফোন বের করতে করতে বলল,,”আচ্ছা আমি আম্মুর কাছে ফোন দিয়ে জেনে নেই।”

“ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ইমার্জেন্সি উঠে আছে।”

জারিফের কথা শোনার সাথে লিয়া নিজেও নিজের ফোনে দেখতে পায় নেটওয়ার্ক নেই। বৃষ্টি যেনো তার বেগ আরো চারগুণ বাড়িয়ে দিলো।আকাশ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হতে থাকলো।জারিফ হতাশ গলায় বললো,,”উফ্!ঝড় বৃষ্টির কারনে হয়তো ইলেকট্রিসিটিও নেই আর সেইজন্য নেটওয়ার্কেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।”

লিয়া ক্ষীন আওয়াজে বলল,,”এমনিতেই বৃষ্টির সময় গ্রামে নেট প্রবলেম দেখা দেয়।তার উপরে ঝড় হয়েছে।”

জারিফ ভেজা চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করতে করতেই বলল,,”আচ্ছা কিছুক্ষণ ওয়েট করা যাক। বৃষ্টি একটু কমলে তখন আশে পাশে কারো দেখা হলে জেনে নেবো অন্যকোনো রাস্তা আছে কিনা।”

জারিফ সিটের উপর কাধটা দিয়ে নিশ্চুপ রয়।লিয়া উসখুস করতে থাকে।লিয়াকে উসখুস করতে দেখে জারিফ কিঞ্চিত কপাল কুঁচকে বাম ভ্রুটা নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”কি হয়েছে?”

লিয়া জবাবে বলল,,”কই কিছু না।”

জারিফ একটু নড়েচড়ে বসে।দুইহাত স্টেয়ারিংয়ের উপর রাখলো ফের শান্ত কন্ঠে শুধালো,,”কোনো হেজিটেশন ছাড়া বলতে পারো।”

লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আওড়ায়,,”পানি পিপাসা পেয়েছে। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।”

জারিফ গাড়িতে থাকা ওয়াটার বোটলটা খোঁজে।না অনেক খুঁজেও বোটলটা পাওয়া গেলো না।জারিফ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,,”সরি।পানি নেই তো দেখছি।বোটলটাই তো দেখছি নেই।”

“ইটস্ ওকে।”

জারিফের ফের জবাব আসলো,,”আচ্ছা। একটু ওয়েট করো বৃষ্টিটা একটু কমলে।দেখি আশেপাশের কোনো বাড়ি থেকে তোমাকে পানি খাওয়াবো।আর শোনাও যাবে অন্যকোনো রাস্তা আছে কিনা।তারপর সেই রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরা যাবে।তোমার বাসার সবাই নিশ্চয় এতক্ষণে খুব টেনশন করছে।ফোন করে বলে দেওয়াও যাচ্ছে না।কি একটা যন্ত্রনা!উফফ!”

লিয়ার নিজেরও ভীষণ টেনশন হচ্ছে।বাসার সবাই খুব টেনশন করবে।যে করেই হোক দ্রুত ফিরতে হবে।এমন সময় একটু দূরে একটা বাড়িতে মৃদু আলো জ্বলছে দেখে লিয়ার চোখ চিকচিক করে উঠল।লিয়া এক আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে উঠলো,,”ঐ যে পাশেই তো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।আলো জ্বলছে দেখুন। তারমানে লোকজন আছে।তাহলে গিয়ে শুনুন না।শহরে যাওয়ার বিকল্প কোনো রাস্তা আছে কিনা।আর নয়তো হেল্প চাইবেন গাছের গুঁড়িটা যাতে সরিয়ে দেয়।আর আমরা যেতে পারি।”

জারিফ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,”এখনকার মানুষকে এতো ভালো মনেহয় তোমার।এই বৃষ্টির মধ্যে তোমার আর আমার জন্য রাস্তা ক্লিয়ার করে দিবে।আর এইসময় বৃষ্টির মধ্যে এই পথে তো অন্যকোনো যানবাহনের চিহ্ণও দেখা যাচ্ছে না।”

একটু থেমে কিছু মনে হতেই জারিফ বলে উঠল,,”আচ্ছা একটা জিনিস তো করাই যায়।এখন বৃষ্টিটাও একটু কমেছে।ঐ বাড়ি থেকে গিয়ে লোকজনের থেকে শুনে নেই বিকল্প রাস্তার কথা।”

জারিফ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।লিয়াকে বলে,,”তুমি গাড়িতেই থাকো আমি ফাস্ট শুনে আসছি।”

লিয়া শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে জড়তা নিয়ে বলে,,”এই অন্ধকার রাতে একা একা আমি থাকবো।যদি গোস্ট টোস্ট আসে তখন।”

এমন একটা ঝামেলাময় সময়েও লিয়ার কথাশুনে জারিফের হাসি পায়।তবে গম্ভীর মুখাবয়বের পেছনে হাসিটা আড়ালে রাখে। গম্ভীর কন্ঠেই বুলি আওড়ালো,,”ওকে চলো।আর তোমার তো পানি পিপাসা পেয়েছে বললে।চলো দেখি পানি খেয়েও আসবে।”

গুটিগুটি পায়ে লিয়া জারিফের পিছুপিছু যায়।হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।টিনের বাড়ি।বেশ কয়েকটা রুম বোধহয়।সামনে বড় বারান্দা। বারান্দায় হারিকেনটা মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। বারান্দার সামনে শান বাঁধা দুইটা সিঁড়ি। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে জারিফ হালকা কাশে।কেউ আছেন কিনা বলে।এমন সময় এক মাঝবয়সী মহিলা বের হয়।কানে কয়েকজোড়া স্বর্ণের দুল,নাকে বড় নাকফুল,হালকা আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে আরো কয়েক কদম সামনে এগিয়ে আসলেন।জারিফ সালাম দিয়ে ভদ্র নম্র স্বরে বলল,,

“এখান দিয়ে শহরে যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা আছে কি?আর আন্টি এক গ্লাস পানি হবে।”

মহিলাটি বারান্দা থেকে উঠানে পানের পিক ফেললেন।মৃদু হাসলেন। ঠোঁট আওড়ালেন,,”নিশ্চয় হবে। শুধু পানি কেনো সবই হবে।ভেতরে আসো।”

মহিলার কথাটা জারিফের সুবিধার লাগলো না।জারিফ বলে উঠলো,,”নো থ্যাংকস।এখানেই ঠিক আছি।আপনি এক গ্লাস পানি দিন তাতেই হবে।”

লিয়া চুপটি করে জারিফের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।মহিলাটি ব্যাকা হেসে ফের বললো,,”ভেতরে যাও।পানি বিছানা সবই আছে।কোনো কিছুর কমতি নেই। শুধু রেটটা একটু বেশি।”

মহিলার এহেন কথা জারিফের বোধগম্য হলো না।কথাটা ভালোও লাগলো না।পানি চাইলো তার সাথে বিছানা,রেট এসব বলার মানে কি?জারিফ ভাবতে থাকে।মহিলাটি আবার দাঁত দিয়ে পান পিষতে পিষতে বলল,,”নতুন আইছো।তাই বুঝবার পারতোছো না।তোমার মতো কত শহরের পোলাপাইন আসে।সাথে তো একদম কচি মাইয়া লইয়া আইছো দেখছি।এখন দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সময় নষ্ট করবা নাকি?”

মহিলার বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শ্রবণ হতেই জারিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ভ’য়ে লিয়া আরেকটু জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। জারিফ রাগান্বিত হয়ে কিছু বলবে।সেই মুহূর্তে টর্চ লাইটের আলো এসে পড়লো।সাথে কয়েকজোড়া ধপধপ পায়ের শব্দ ধ্বনিত হলো।জোড়েসড়ে একজন বলে উঠল,,

“এইযে মাতব্বর সাব দেখছেন।নিজ চোখে দেখছেন।রোজিনা খালা যে এরহম খা’রাপ কারবার করে।এবার হাতে নাতে পাইলেন তো।”

এমন কথায় জারিফ লিয়া দুজনে হকচকিয়ে উঠলো। কয়েকজন লোক।এদিকেই তেড়ে আসলো।ফের তাদের মধ্যে থেকে বলে উঠলো,,”এই দেহেন।এইযে শহরের এক পোলা সাথে মাইয়া লইয়া আছে।আমি আপনারে আগেও কইছি।রোজিনা খালা ঘর ভাড়া দেয়।আবার মাইয়া জোগাড়ও করে দেয়।এখন বিশ্বাস হইলো তো।”

জারিফ অবাক হয়ে বললো,,”হোয়াট এসব কি বলছেন।”

জারিফের কথা থোড়াই কেয়ার না করে একটা মাঝ বয়সী ছেলে ঘরের দিকে গেলো।কয়েকটা কক্ষের দরজায় নক করতেই জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে বের হয়ে আসলো।টুপি মাথায় দেওয়া একটা মাঝ বয়সী লোক বলে উঠলো,,” নাউজুবিললাহ।মাতব্বর সাহেব হামাগো গ্রামে এমন কাজ চলছে।এটা ঘোর পা’প এখন এর বিচার আপনি করেন।”

মাতব্বর দাড়িতে একহাত বুলিয়ে নিলেন গম্ভীরভাবে বললেন,,”রোজিনার শাস্তি ওকে পুলিশে দেবো।আর এই পোলা মাইয়ারে বিয়া দিতে হইবে।”

জারিফ সবটা বললো।এখানে আসার কারনটা কি।জারিফের কথাকে কেউ বিশ্বাস করলো না। একজন তো বাজেভাবে বলে উঠলো,,”এইডারে বেশি ভদ্র দেখাচ্ছে।আর এই শা”লায় তো দেখছি বেশি**।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই জারিফ লোকটার কলার চেপে ধরে বললো,,”একদম মুখ সামলে কথা বল।বারবার বলছি এখানে বাকিরা যে উদ্দেশ্যে এসেছে।আমরা সেই উদ্দেশ্যে নই।বিপদে পড়ে হেল্প চাইতে আসছিলাম।বাট জানতাম না।এটা একটা বাজে জায়গা।”

লিয়ার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিকরবে ভেবে পাচ্ছে না।এতজনের সাথে জারিফ একা পেড়ে উঠবে না।লিয়া জারিফের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,,”ছাড়ুন ওনাকে। প্লিজ ছাড়ুন। রা’গটা কন্ট্রোল করে ঠান্ডা মাথায় ভাবুন কি করা যায়।”

লিয়ার কথা শুনে জারিফ লোকটাকে ছেড়ে একহাতে কপালের ঘামটা মুছে নেয়।পকেট থেকে ফোন বের করে।সেখানে নেটওয়ার্ক নেই। উফ্!বিপদ বোধহয় একসাথে সব দিক দিয়েই আসে। মাতব্বর সাহেব বলে উঠলেন,,”এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না।আমার সামনে দাঁড়াইয়া আমার লোকের গায়েই হাত তোলো।আর রাত বিরাতে মাইয়া নিয়া ঘুরতাছো।নিজেরে ভালো কইয়া জাহির করছো,হ্যা।”

আরেকজন বলল,,”মাতব্বর সাব।এইডারে আগে বিয়া দেন।পরে বাকি কয়টারে।”

“হোয়াট?কি সমস্যা আপনাদের হ্যা।বিয়ে একটা ছেলেখেলা নাকি?বললেই হলো।এভাবে জোড় করে কখনো বিয়ে হয়।বিষয়টা হাস্যকর। প্লিজ স্টপ দিস।”

মাতব্বর কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে ফের বলল,,”এই ছেলে এই।মাইয়া নিয়া অশ্লীল কাজ করে বেড়াবে আর বিয়া করবে না।এই রফিক ফটো তোল মোবাইলে।সব কয়টার ফটো তোল।আর কাইলকে শহরে যাইয়া পত্রিকায় ছাপাবি। অশ্লীল কাজ করতে গিয়ে এই পোলা মাইয়া হাতে নাতে ধরা পড়ছে।”

জারিফ লিয়া দুজনের মাথায় যেনো বাজ পড়ে।একজন মোবাইল বের করে ফটফট ছবি তুলে নেয়। মাতব্বর ফের শাসিয়ে বললেন,,”এইবার ভাইবা দেখো।বিয়া করবা নাকি এইসব কাজ কর্মের কথা পত্রিকায় ছাপাবো।আর রফিক এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। ফেসবুক না কি কয়।ঐখানেও ছাড়বি।”

লিয়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।জারিফ নিজেও ভেবে পাচ্ছে না কিকরবে। মানুষ তো আর ওদের মুখের কথা বিশ্বাস করবে না।কারন যেহেতু এখানে আসলেই এরকম ঘটনা ঘটেছে।ওরা দুজনে এসবে জড়িত না থাকলেও এই মুহূর্তে এইখানে থাকার জন্য কেউ বিশ্বাস করবে না ।আর এই খবর সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোর গতিতে ভাইরাল হয়।এটা ভাইরাল হলে সমাজে পরিবারের নিজের সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?তা ভাবতেই জারিফের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।লিয়া বাকশুন্য হয়ে পড়ে। অবশেষে পরিস্থিতির কাছে হার মেনে জারিফ লিয়াকে বিয়ে করতে হয়। মাতব্বর সেই সময় একজন কাজী ডেকে বিয়ে দেন।সেদিন সেই মুহূর্তে কয়েক জোড়া বিয়ে হয়।সাথে লিয়া জারিফেরও।
.
সবাই সবটা শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। পিনপতন নীরবতা বইছে।সবার মুখেই কোনো কথা নেই। এরমধ্যে লিয়ার ছোট চাচিমা শিরিন সুলতানা তহমিনা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,,”কি সাংঘাতিক ব্যাপার।আমাদের বাড়ির এক মেয়ের সাথে অলরেডি বিয়ে হয়ে গিয়েছে।আর আজ অন্য মেয়ের সাথে হলুদ অনুষ্ঠানে এসে এসব বলছে।”

কথাটা আস্তে বললেও সবারই কর্ণপাত হয়। জাহানারা বেগম সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নেন।শিরিন সুলতানার কথাটা ঠিক হজম করতে পারছেন না। আবার প্রতিবাদ করে কিছু বলতেও পারছেন না।জারিফের বাবা আনোয়ার রহমান কঠোরভাবে বললেন,,”মানছি দূর্ঘটনা ঘটেছে।এতে তোমার বা লিয়ার কোনো হাত ছিলোনা।তবে তোমরা গোপন রেখেছো কেনো?জারিফ তুমিতো ছোটো নও।তুমি কিকরে পারলে এতবড় বিষয়টা গোপন রাখতে।তোমার থেকে এটা আমি আশা করিনি। আরো আগে বলা উচিত ছিলো।”

বাবার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জারিফ মাথা হেট করে নিশ্চুপ রয়।এটা দেখে লিয়া অবাক হয়।জারিফকে চুপ করে থাকতে দেখে লিয়া মনেমনে আওড়ায়,উনি সত্যিটা বলছে না কেনো।আমিই তো বলেছিলাম।আমিই তো বাঁধা দিয়েছিলাম সত্যিটা সবাইকে বলতে।উনি তো সেদিনই সবাইকে বলতে চেয়েছিলেন।আমি বারবার ওনাকে বাঁধা দিয়ে বলেছি,বিষয়টা গোপন রাখতে। আর আপুকে বিয়েটা করতে।যা কিছু ঘটেছে দু’জনের মধ্যেই গোপন থাক।আর ভালো উকিল দেখে গোপনেই সমস্যা টা সলভ করতে।উনি প্রথমে মানতে চাননি। আগে সবাইকে বলবে তারপর সমাধান করবে।আপুর বিয়ে ভেঙ্গে গেলে বড়মা,বড় আব্বু কষ্ট পাবে ফ্যামেলির সম্মান হানি হবে।এটাসেটা বুঝিয়ে আমি ওনাকে বাঁধা দিয়েছিলাম।উনি তো চাইলেই আমার কথা বলতে পারে।এখন সবাই দোষটা উনাকে দিচ্ছে।উনি চুপচাপ মেনে নিচ্ছে।সবাই উনাকে ভুল বুঝছে।

ইমতিয়াজ খাঁন এনামুল খান দুজনেই নির্বাক।কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এরমধ্যে তাসনিম স্বাভাবিক গলায় বলল,,”মানছি যা হয়েছে এক্সিডেন্টলি।তারপরেও জারিফ আমি তোমাকে বলবো সবটা মেনে নিতে।”

“এটা নিতান্তই একটা দূর্ঘটনা।যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আর দূর্ঘটনাটার প্রতিকার করতে চাই আমি।”

জারিফের কথাশুনে তাসনিম ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে ফের ঠোঁট আওড়ালো,,”বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। যেখানে আমার ছোটো বোনের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে।সেখানে আর কোনোভাবেই আগানোর কথা আমি ভাবতে পারবো না।সেটা শুধু এখন কেনো কখনোই নয়।তুমি যদি ভাবো লিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে পরে নতুন করে আমার সাথে শুরু করবে।তাহলে আমি বলবো এটা কখনোই সম্ভব হবে না।আমি সাফ আমার কথা বলে রাখলাম।আর বাকিটা তোমার ইচ্ছা। তুমি কিকরবে সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার।”

আনোয়ার রহমান ইমতিয়াজ খাঁনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,”ভাই আমি দুঃখিত।আমার ছেলের হয়ে আমি নিজে ক্ষমাপ্রার্থী।বিষয়টা দুইদিন আগেই বললে আজ লোকজনের সামনে অনন্ত মাথা হেট হতো না ।বুঝে শুনে বিষয়টা হ্যান্ডেল করা যেতো।তবে ভাইজান আমি বলবো যেটুকু সম্মান খুইয়েছে সেটুকুই থাক।আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে কালকে বিয়ে হবে।কালকের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে না।”

আনোয়ার রহমানের কথায় সবাই বড়বড় চোখ করে চাইলেন।বিয়ে হবে মানে কি?সবারই এক প্রশ্ন।আনোয়ার রহমান কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ফের শান্ত গলায় বললেন,,”আমি আপনাদের কাছে রিকোয়েস্ট করছি। কালকে আপনাদের ছোটো মেয়ে লিয়ার সাথেই জারিফের বিয়ে হবে।যদি আপনারা রাজি থাকেন তবেই।”

জারিফ বাবার দিকে মাথাটা তুলে তাকালো।যেখানে হাজারো দ্বিধা আছে।তারপরেও বাবার মুখের উপর কিছুই বলার সাহস হলো না।লিয়ার বাবা এনামুল খান নির্বাক কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ইমতিয়াজ খাঁন কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললেন,,”ঠিক আছে তাইই হবে। যেহেতু বিয়ে হয়ে গিয়েছে।যেভাবেই হোক না কেনো।আর সবাইকে ইনভাইটও করা হয়েছে।বিয়ে বিষয়টা তো আর ছেলেখেলা নয়।তাই আমিও আপনার সাথে সহমত পোষণ করছি।”

তাসনিমের নিজেকে কেনো জানি অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে।জারিফ চুপচাপ ঠাঁয় বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে।লিয়ার কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না।নিজেকে খুব খাঁটো মনে হচ্ছিলো।লিয়া বুঝতে পারে জারিফ নিশ্চয় বাবার কথার বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। সেইজন্য চুপচাপ আছে।লিয়া সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,,”বড় আব্বু আমার কিছু বলার আছে।”

সবার দৃষ্টি তখন লিয়ার দিকে। তাসনিম লিয়ার কাছে এগিয়ে গেলো।লিয়া হাত মুঠো করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অতঃপর চোখ বন্ধ করে দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলো,,

“আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আমি এই দূর্ঘটনাকে দূর্ঘটনা হিসেবেই নিতে চাই।এটাকে আঁকড়ে ধরে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না।আমি চাইবো তোমরা জোর করবে না আমাকে ‌। বরং আমি সমঝোতা চাই।আমার পক্ষে কালকে আবার নতুন করে বিয়ের আসরে বসা সম্ভব নয়।সেদিনের দূর্ঘটনাকে আমি দূর্ঘটনা হিসেবেই মনে রাখতে চাই।সেটাকে বিস্তৃত করে ফের কোনো বাঁধনে বাঁধা পড়তে চাইনা। প্লিজ,আমার কথাটা তোমরা রাখবে।।সামনে আমার এক্সাম।আর এখন আমার একমাত্র ডেসটিনেশন পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করে নামকরা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া।বিয়ে শাদি ঘর সংসার এসব নিয়ে আমি এক্ষুনি কিছু ভাবতে পারবো না। প্লিজ প্রাডোন মি।পারলে তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।তবুও আমি এই দূর্ঘটনাকে বয়ে বেড়াতে চাইনা। যতদ্রুত সম্ভব সমঝোতা চাই।”

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৪

“শুধুমাত্র বিয়ের দোহাই দিয়ে আর যাইহোক কখনো সংসার হয়না।আবার হয়তো বা হয়। কিন্তু সেটা কখনো সুখের হয়না জাস্ট লোক দেখানো,মেনে নেওয়া এই আরকি।আমার কথাটা তোমাদের সবার কাছে খা’রাপ লাগতে পারে।বাট আমার কিছু করার নেই। সারাজীবন একটা দূর্ঘটনাকে বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে পসিবেল নয়।”

একনাগাড়ে নির্ভীক চিত্তে কথাগুলো বলে থামে লিয়া।জারিফ মাথাটা তুলে লিয়ার দিকে তাকায়।জারিফের কথাগুলোই যেনো দ্বিগুণ তাচ্ছিল্য ভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে লিয়া।যা জারিফের ইগোতে লাগে। রাজিয়া সুলতানা লিয়ার সামনা-সামনি দাঁড়ালেন।চোখ মুখ শক্ত করে ধমকের সুরে বলে উঠলেন,,”লিয়া তুমি কিন্তু তোমার সীমা অতিক্রম করছো। এখানে বড়রা কথা বলছে তার মধ্যে তোমার এসব ডেস্পারেট কথাবার্তা মানা যাচ্ছে না।এখানে ডিসিশন নেওয়ার জন্য তোমার আব্বু তোমার বড় আব্বু ওনারা আছেন।ওনারা নিশ্চয় তোমার খা’রাপ চাইবে না।আর তুমি এখনো ছোটো তাই ভালো মন্দ বোঝার মতো জ্ঞান তোমার খুব কমই হয়েছে।”

লিয়া মুখায়বে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে ফের কিছুটা করুণ স্বরে বলে উঠলো,,”আম্মু লাইফটা আমার।সেখানে ডিসিশন নেওয়ার রাইট আমারও আছে।”

উপস্থিত সবাই লিয়ার কথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। লিয়ার কথা শুনে জাহানারা বেগমের মেজাজটা খা’রাপ হয়ে যায়।লিয়ার একরোখা কথা শুনে ওনার লিয়াকে ডেস্পারেট মনে হচ্ছে। উনি মনেমনে আওড়ায়,যেখানে বাবা চাচারা কথা বলছে সেখানে এতটুকু মেয়ের এভাবে বিরোধিতা করা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।মেয়েটার মধ্যে আদব কায়দা মনে হয় কমই আছে।তাইতো মুখে মুখে কথা বলছে।যেখানে আমার ছেলে এখনো চুপ করে আছে।আর মেয়েটার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।আমার ছেলেকে কিনা সরাসরি মুখের উপর রিজেক্ট করছে।এসব কথা মনেমনে ভাবলেও মুখে কিছুই বললেন না।তবে স্পষ্ট বিরক্তবোধটা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

লিয়ার বাবা এনামুল খান লিয়াকে ধমক দিয়ে বললেন,,”লিয়া অনেক কথা বলে ফেলেছো।তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।তুমি এতোটা বড়ও হওনি যে সব বিষয়ে নিজের ডিসিশন নিজে নিবে।এই মুহূর্তে আর নতুন করে কোনো সিনক্রিয়েট করো না।এমনিতেই তোমার জন্য যথেষ্ট মান সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে।”

আনোয়ার রহমান কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভাবলেন। অতঃপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এনামুল খাঁনকে উদ্দেশ্য করে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন,,”ভাইজান মাথা ঠান্ডা রাখুন।আর আমার মনেহয় ছেলে মেয়েকে চাপ দেওয়া ঠিক হবে না।জোর করে কোনো কিছু করলে তার ফলাফল ভালো হয়না।তাই বলছি ওদেরকে সময় দেওয়া যাক।ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে।লিয়া আম্মুকে ভাববার জন্য সময় দেওয়া হোক।লিয়া বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুক।তারপর লিয়া যা জানায়। আপনারা আমাদেরকে ফোনে জানিয়ে দিয়েন।তাহলে আমরা সে ভাবেই আগাবো।আর একটা রিকোয়েস্ট থাকবে বাচ্চা মেয়েটাকে জোর করবেন না।”

অবশেষে আনোয়ার রহমানের কথাই রইলো। নীল জারার চুলে থাকা একটা হলুদ গাঁদা ফুল হাতে নেয়।অন্য হাত দিয়ে পাপড়ি গুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে মৃদু আওয়াজে বলে,,”লে হালুয়া।কি থেকে কি হয়ে গেলো রে জারা।এ যাবত কাল ধরে তোর ভাইয়ের পছন্দের জিনিস আমি নিয়ে আসলেও।এবার তো দেখছি তোর ভাই একদম ছক্কা মে’রে দিলো।আমার মনেমনে পছন্দ করা মেয়েকে একদম বউ বানিয়ে ফেললো।”

জারা সরু চোখে চাইলো।কপাল কুঁচকে দাঁত কটমট করে বললো,,”হোয়াট?কি বলতে চাইছিস?তোর পছন্দ করা মানে?”

নীল কথা এড়িয়ে যেতে বলে,,”কানে সমস্যা হয়েছে তোর।কি বললাম আর কি শুনলি।যাইহোক অতি দ্রুত একজন নাক কান গলা স্পেশালিস্টের কাছে তোকে নিয়ে যেতে হবে।না হলে এরকম বয়রাকে কেউ বিয়ে করতে আসবে না।না জেনে বিয়ে যদিও বা করে।বিয়ে করে এক গাড়িতে করে নিয়ে যাবে। ঘন্টা খানেক পরে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে দিবে।”

জারা নাক মুখ কুঁচকে বললো,,”নীলের বাচ্চা।”

নীল জারার চুল ধরে টান দিয়ে বলল,,”আমি তোর থেকে গুণে গুণে আট বছরের বড়।তাই সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”

জারা মুখ ভেংচি কে’টে চলে যায়। নাতাশা জারার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো। নাতাশা ঘাড় তুলে জারার দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে বলে,,”খালামনি।আ্যই খালামনি।মামার বিয়ে খাবো কখন?”

জারা নাতাশার দিকে তাকালো।মজার ছলে বলল,,”বিয়ে আবার খায় কিভাবে?নাতাশা বেবি।”

নাতাশা দুইহাত কোমড়ে রাখল। ছোট ছোট চোখ করে চাইল। ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,,”খায় তো।এইতো কিছুদিন আগেই তো আমি নানুভাই আর নানুমনির সাথে বিয়ে খেয়ে আসলাম।তুমি ভুলে গিয়েছো?”

জারা মৃদু হাসলো।কিছুটা দূরে লিয়াকে গাড়ির সামনে দেখতে পেলো মূহূর্তেই হাসিটা মিইয়ে গেলো।নাতাশার দিকে ঝুঁকে ম্লান মুখে ক্ষীন আওয়াজে বলতে থাকে,,”তোমার মামার বিয়ে তো অলরেডি হয়ে গিয়েছে।”

জারার কথার মাঝেই নাতাশা একগাল হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,,”তাই!ওয়াও!তাহলে তো মামী এখন আমাদের সাথে থাকবে।নানুমনি তো বলেছিলো মামার বিয়ের পর থেকে মামী আমাদের সাথেই থাকবে।কি মজা!এখন থেকে ভালো আন্টি আমাদের সাথে থাকবে।!”

জারা ভারী গলায় বলে,,”ওহ্ সোনা!ভালো আন্টি নয়।মিষ্টি হলো তোমার মামার বউ।”

“ওহ্!”

ঠোঁট উল্টিয়ে একশব্দে কথাটা বলে । অতঃপর নাতাশা জোরে ডেকে বলে উঠলো,,”আ্যই মিষ্টি আন্টি।”

লিয়া গাড়িতে উঠবে বলে পা দিবে সেই মুহূর্তে নাতাশার ডাক শুনে থেমে যায়।নাতাশা দৌড়ে যায়।দুইহাতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।।লিয়া তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা পিছিয়ে যায়।নাতাশা লিয়ার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসে। মিষ্টি করে আদূরে গলায় বলে,,”খালামনি বলছিলো তুমি আমার মামার বউ।তাহলে তুমিই আমার মামী।”

লিয়ার মনের ভেতরে অনুভূতির ঝড় বইতে থাকে। তবুও লিয়া বাইরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখে।বাহিরে বেশ কাঠিন্যতার ছাপ ফুটিয়ে রেখে।লিয়া নির্বিকার থাকে।জারিফ পার্কিং লনে আসে। ওদের গাড়ির কাছে যাবে।সেইসময় লিয়া আর নাতাশাকে দেখতে পায়।লিয়া জারিফকে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। নাতাশা আবেদনময়ী কন্ঠে ফের বলতে থাকে,,”মামী তুমি আমাদের সাথে যাবে না?ঐতো মামার গাড়ি। চলো।আমি তোমার কাছে বসবো,হ্যা।আর মামী আমাকে কিন্তু এত্ত এত্ত আদর করতে হবে।যেমন আমার মামা আদর করে। অনেননননক।”

শেষের কথাটা দুইহাত মেলে ধরে দেখিয়ে টেনে বলে।লিয়া নাতাশার কথা এড়িয়ে যায়। আলতোকরে নাতাশার দুইগালে হাত রাখে। খানিকটা ঝুকে নাতাশার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।তারপর মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়ালো,,”ভালো থেকো কিউটিপাই। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সবসময় সুস্থ রাখুক।ভালো রাখুক।তোমার জন্য এত্ত এত্ত দোয়া রইলো।”

কথাগুলো বলে লিয়া নিজেকে নাতাশার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে।সবাই গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করে।লিয়ার বাবার পাজেরো গাড়িটা শাশা শব্দে শহরের পিচঢালা পথ দিয়ে যেতে থাকে। উল্টো পথে জারিফের টয়োটা গাড়িটা গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
.
বিয়ে বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।সবারই চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।রাজিয়া সুলতানা মেয়ের পাশে বসে এটা সেটা বুঝিয়ে যাচ্ছেন আসার পর থেকে। স্বামীর কড়া নির্দেশ লিয়াকে রাজি করানো।লিয়া মূর্তির মত বিছানার হেডের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।কোনো কথায়ই সাড়াশব্দ নেই।আসার পর থেকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েও যখন মেয়ের মুখ থেকে পজেটিভ উত্তর মিললো না।সেই সময় বি’র’ক্ত হয়ে রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত্রি নয়টা বাজতে চললো।এইতো কিছুক্ষণ আগে এনামুল খাঁন এসে শাসিয়ে গেলেন।আর ঘন্টা খানেক দেখবেন। অতঃপর জারিফের বাবার কাছে ফোন দিয়ে পজেটিভ মতামত দিবেন।লিয়া যেনো কোনো বাড়াবাড়ি না করে।ধমকিয়ে বেশ শাসিয়েই গেলেন।লিয়া বিছানা থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিচে গেলো।নিচে দক্ষিণে দাদিমনির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,,

“দাদিমনি আসবো?”

জান্নাত বেগম কিছুক্ষণ আগেই এশার নামাজ শেষ করে একটা চেয়ারে বসে আঙ্গুলের সাহায্যে তাসবিহ গুনছিলেন। বয়সের ভারে অতটা পথ জার্নি করে শহরের কমিউনিটি সেন্টারের হলুদ প্রোগ্রামে জাননি।তবে সবটাই শুনেছেন।ছেলে আর ছেলের বউদের মুখ থেকে।সবকিছু শুনে নির্বাক আছেন।মাথাটা তুলে দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়ানো অষ্টাদশী লিয়াকে দেখে কন্ঠে একরাশ স্নেহ জড়িয়ে বললেন,,”আসো।ভেতরে আসো ছোটো আপা।”

লিয়া ভেতরে যায়। ফ্লোরে বসে পড়ে। দাদিমনির কোলের উপর মাথাটা রাখে। জান্নাত বেগম একহাত লিয়ার মাথায় রাখেন। স্নেহের হাত বুলিয়ে আদরমাখা গলায় বললেন,,”এই লিয়া কিছু বলবি?আমার ছোটো আপার নিশ্চয় কোনো বড়সড় আবদার আছে।”

লিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁট প্রসারিত করে বলে উঠলো,,”দাদিমনি আমি এই সম্পর্কটা আগাতে চাইনা। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু কখনোই কাংখিত কোনো ফল বয়ে আনে না।আর এই বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।আমি চাই তুমি আব্বুকে বুঝিয়ে বলো।তুমি বললে আব্বু তোমার কথা ফেলতে পারবে না। কালকের বিয়ের প্রোগ্রাম এসব বাদ দিতে বলো।আর এও বলো দ্রুত সমঝোতা করতে।এই জোর করে হওয়া তথাকথিত বিয়েটার সমাধান করতে।নামে মাত্র বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।”

জান্নাত বেগম লিয়ার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,”বিয়ে শাদি কি এতটাই খেলনা ছোটো আপা?মন চাইলো না আর ভেঙ্গে দিলাম। একটা সম্পর্ক ভাঙ্গা সহজ তবে গড়াটা খুবই কঠিন।”

লিয়া দাদিমনির দিকে মুখ তুলে তাকায়। তড়িৎ বলল,,”সম্পর্ক যেখানে তৈরিই হয়নি সেখানে ভাঙ্গার প্রশ্নই আসে না দাদিমনি।জোর করে কখনো সম্পর্ক হয়না।আর দূর্ঘটনা সব সময় দূর্ঘটনাই সেটাকে মন থেকে মেনে নেওয়া যায়না।চাপে পরে পরিস্থিতির কাছে হার মেনে হয়তো মানিয়ে চলতে হয়। সেটা শুধু লোক দেখানো। সেখানে ভালোবাসা থাকে না।সেখানে থাকে শুধু দয়া দক্ষিণা।”

লিয়া একটু থামে। খানিকটা সময় নিয়ে ধরে আসা গলায় ফের বলে,,”দাদিমনি তুমি নিশ্চয় চাইবে না। তোমার নাতনি সারাজীবন অন্যর দয়ায় থাকুক।কেউ তাকে দয়া করে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে।দয়া করে সারাজীবন বোঝা হিসেবে বয়ে বেড়াবে।কখনো ভালোবেসে নয়।”

জান্নাত বেগম মৃদু হাসলেন।যা লিয়ার দৃষ্টিগোচর হলোনা। শান্ত গলায় ফের বললেন,,”আজ ভালোবাসা নেই।তবে ভালোবাসা তৈরি হতে কতক্ষন ছোটো আপা।আর বিয়ে হলো এমন একটা পবিত্র বন্ধন।যেখানে আপনা আপনি মহব্বত ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।যে বন্ধনে ভালোবাসা দিনদিন ফিকে হয়না বরং গাঢ় হয়। সন্তান সন্ততির মাধ্যমে বন্ধন আরো মজবুত হয়।তাই বলছি ছোটো আপা আরেকটু ভেবে দেখলে হয়না?”

লিয়া চোখ বন্ধ করলো। দুইচোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।ভেজা গলায় ঠোঁট আওড়ালো,,”দাদিমনি এসবের জন্য উনি আমাকেই দোষারোপ করেন।ওনার মতে সেদিন যদি আমি ওনার সাথে না থাকতাম তাহলে এই দূর্ঘটনা ঘটতো না।”

লিয়া নাক টেনে নিয়ে ফের ক্ষীন আওয়াজে বলতে থাকে,,”অবশ্য ওনার কথাটাও ফেলনা নয়।ঠিকই তো বলেছেন আমিই দায়ী।আর আমিই যেহেতু দায়ী।তাই এই ভুলটা শুধরে নেওয়ার দায়িত্বটাও আমারই। প্লিজ দাদিমনি আব্বুকে বোঝাও।”

জান্নাত বেগম অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলেন।কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন। অতঃপর কাজের মেয়েটাকে ডেকে ছেলে আর ছেলের বউদের এখানে উপস্থিত হতে বললেন।একএক করে সবাই উপস্থিত হলো।সবাই উৎসুকভাবে আছে।কি বলবেন তা জানার জন্য। অবশেষে জান্নাত বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,,”মেজো খোকা আমি চাইবো লিয়াকে জোর না করতে।”

এনামুল খাঁন অবাক হয়ে তড়িৎ বললেন,,”কি বলছো মা?তারমানে লিয়ার কথামতো এখন বিয়েটা ভাঙ্গতে হবে।”

জান্নাত বেগম গম্ভীর গলায় ফের বললেন,,”আহ্! আমার কথা শেষ করতে দাও।হুট করেই কখনো কোনো চরম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়না।এখন লিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।আবার লিয়ার কথামতো এখনই একটা চরম সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া যাবে না।রয়েসয়ে, ভেবেচিন্তে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।তাই আমি বলছি,কালকের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দাও।আর লিয়াকে আরো সময় দেওয়া হোক।লিয়ার পরিক্ষা অব্দি এভাবেই থাক।তিনমাস সময় পাবে লিয়া ভাববার জন্য।তিনমাস পরেও যদিও লিয়া আজকের অনুরূপ কথা বলে।তবে তাই হবে।”

কিয়ৎক্ষন থেমে ফের স্পষ্ট করে বললেন,,”সবার কথাশুনে যা মনেহলো,ছেলেটারও তো মতামত ছিলো না।আর না থাকারই কথা। সেখানে বিয়ের দোহাই দিয়ে আমাদের মেয়েকে চাপিয়ে দিতে পারিনা।লিয়া জারিফ এই তিনমাস ভেবে দেখবে। অতঃপর যদি ওরা বিয়েটা মেনে নিতে নাই পারে।তবে আমি নিজে দাঁড়িয়ে সমঝোতা করে দেবো।আমি যেটা বললাম।সেই কথাটা ফোন করে ওবাড়িতে জানিয়ে দাও।আমি আশাকরবো এর বাইরে তোমরা কেউ কিছু বলবে না।আর নাতো লিয়াকে কোনো চাপ দিবে।”

অবশেষে লিয়া কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে জান্নাত বেগমের দিকে তাকায়।লিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস তিনমাস কেনো? তিন বছর পরেও জারিফ এই সম্পর্কটা মেনে নিবে না।তাই এখন থেকেই মনটাকে সেই ভাবেই কঠোর করে গড়ে তুলতে হবে। অবশেষে জান্নাত বেগমের কথাগুলো ওবাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফোনকলের মাধ্যমে।
.
ডায়নিং এ বসে আছে সবাই। আনোয়ার রহমান,নীল,জারা।সাথে জারিফের একমাত্র ফুপু কল্পনা বেগম।বিয়ে উপলক্ষে আজকেই আসছে।
জারিফ এসে চেয়ার টেনে বসতেই আনোয়ার রহমান সবটা বললেন। ওবাড়ি থেকে একটু আগে ফোনে যা যা বলেছে সেইসব।তবে সেসবে জারিফের কোনো ভাবান্তর নেই। জারিফ ভাবলেশহীন আছে। নিরুপমা বেগমকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। দাঁড়িয়ে জগ থেকে পানি ঢালছেন আর মনেমনে ভাবছেন,ইশ!কি থেকে কি হয়ে গেলো।কোথায় ভেবেছিলাম জারিফের বিয়েটা হবে।এদিকে নীলের পড়াশোনা শেষ হয়ে কোনো চাকরি বাকরিতে ঢুকলেই।জারিফকে দিয়েই লিয়ার সাথে নীলের বিয়ের প্রস্তাব দিবো।বাড়ির বড় জামাই প্রস্তাব দিলে ওনারা নিশ্চয় ফেলতে পারতেন না। উফ্!এদিকে তো সব এলোমেলো হয়ে গেলো।ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে আমার নিজের বউমা করতে খুব ইচ্ছে হয়ছিলো।ধ্যাত কি থেকে কি হয়ে গেলো।নিরুপমা বেগমের ভাবনার ছেদ ঘটে জাহানারা বেগমের ডাকে,,

“এই ছোটো।কি এতো ভাবছিস বলতো। গ্লাস ভরে পানি উপচেপড়ে টেবিল ভেসে যাচ্ছে।আর তুই কিসের ধ্যানে আছিস বলতো?”

নিরুপমা বেগম নিজেকে তটস্থ করে হাত থেকে কাঁচের জগটা নামিয়ে রাখে। অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠে,,”এইরে খেয়াল করিনি।আসলে লিয়ার কথা ভাবছিলাম।”

লিয়ার নাম শুনতেই জাহানারা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,”বাদ দে ঐ মেয়ের কথা।ঐ মেয়ের জিদ দেখলি।পরিবারের সবাই বলল।অথচ তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়লো না।তিনমাস পরেও যে একই সিদ্ধান্তে থাকবে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। তাই ঐ মেয়েকে নিয়ে আমি আর কিছুই ভাবতে পারবো না।”

কল্পনা বেগম ফোড়ন কে’টে বলে উঠলেন,,”বাদ দাও তো ভাবী।ভাত ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয়না।ঠিক তেমনি মেয়ের অভাব হবে না।আমাদের হিরের টুকরো ছেলে জারিফ।তারজন্য কখনো উচ্চ শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়ের অভাব হবে নাকি?আর মেয়েটাও তো বেশি শিক্ষিত না। ইন্টার পাশ করেনি।এসব বাদ দাও।বড় মেয়েটা তাও জারিফের জন্য উপযুক্ত ছিলো। ডক্টর ছিলো।তাই বলছি আমাদের এই মেয়েকে নিয়ে আর না ভাবাই উত্তম। তারচেয়ে বরং যতদ্রুত ঝামেলা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।আমার জারিফ বাবার জন্য যোগ্য মেয়ে আমি নিজে খুঁজে দিবো,হু।”

নীল বিড়বিড় করে বললো,এইরে ফুপ্পি তো আগুনের মধ্যে কেরোসিন তেল ঢালার উস্তাদ।একদম বড়মাকে উস্কে দিচ্ছে।নীল গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,,
“তা ফুপ্পি কিযেনো বলছিলে। ওহ্!মনে পড়েছে।লিয়া বেশি শিক্ষিত না। ইন্টার পাশ করেনি।তা বলি ফুপ্পি লিয়ার বয়স কত জানো তুমি?লিয়া সবে আঠারোতে পা দিয়েছে।আর সামনে ও এইচএসসি দিবে।বয়স অনুযায়ী পড়াশোনা সব ঠিক আছে।আর পড়াশোনায়ও ভালো।আঠারো বছর বয়সে কি ও এমবিএ কমপ্লিট করবে নাকি?আজব!তোমার ভাতিজার তো ছাব্বিশ বছর চলছে। মাস্টার্স এখনো শেষ হয়নি।”

নীলের কথাটা কল্পনা বেগমের গায়ে লাগে।মুখটা চুপসে যায়।মুখ কাচুমাচু করে ফেলেন। জারা মিটমিট করে হাসছে।জাহানারা বেগম নীলকে বললেন,,”আহ্!নীল হচ্ছে টাকি। চুপচাপ খাবার খাতো।”

কল্পনা বেগম ফের ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলেন,,”যতই বলো ভাইজান।ঐ মেয়ে বড়দের সামনে যেভাবে কথা বললো। সেটা আমি মেনে নিতে পারছিনা।আর আমাদের বাড়ির ছেলেকে কিনা মুখের উপর প্রত্যাখ্যান করলো। নাহ্!এটা কিচ্ছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।তুমিই বলো মানা যায়?”

উফ্!আবার শুরু করলো।এই ফুপ্পি তো দেখছি দমবার পাত্রী নয়। নিজের মেয়ের সাথে ব্রো এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।সেটা তো আর হয়নি।তাই এখন কিভাবে উস্কে দেওয়া যায় তাই করছে। উফ্!এসব কথা মনেমনেই আওড়ায় নীল। আনোয়ার রহমান কল্পনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বললেন,,”আসলে মেয়েটা ছোটো।কতই বা বয়স।ওর কথা ধরলে চলে।আর সবার মনের অবস্থা তো জানা যায়না।মেয়েটার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো না কোনো কারন থাকতেই পারে।কারো আচরণের জন্যও হয়তো বা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে পারে।”

শেষের কথাটা জারিফের দিকে তাকিয়ে বলেন।কথাটা কিছুটা হলেও জারিফের গায়ে লাগলো।এরমধ্যে কল্পনা বেগম ফোড়ন কাটল ঠোঁট আওড়িয়ে ফের বলল,,”আরে ভাইজান কোনো কারন যে আছে তা আমি শতভাগ নিশ্চিত।এখনকার মেয়েছেলে।কোনো যায়গায় লাইন টাইন আছে হয়তো।অন্যকারো সাথে সম্পর্ক আছে। সেইজন্যই হয়তো এই বিয়ে মানতে চাইছে না।”

কথাটা জারিফের কাছে মোটেই ভালো লাগলো না। ফুপ্পিকে সম্মান করে তাই সহজেই কিছু বলতে পারলো না।আবার কেনো যেনো একদম চুপ করেও থাকতে পারলো না। মুখশ্রীতে বিরক্তবোধটা নিয়ে বলে উঠল,,”স্টপ ফুপ্পি। প্লিজ স্টপ দিস।তখন থেকে একই কথা ভালো লাগছে না।”

এতটুকু বলে খাবার রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় জারিফ।হাত ধুয়ে গটগট করে রুমে চলে যায়।

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]