“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩১
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণ আজ রাতে একটু দ্রুতই শুয়ে পড়েছে। দিনে ঘুম হয়নি। অবসরতা এমনিতেও ঘুম নামায়। তাছাড়া রাতের খাবার নিজ হাতে তুলেই নিজের সময় মতো একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে এসেছে। কথায় মনোমালিন্য হওয়ায় ঘরের পরিবেশ একটু থমথমে। বিপু ঘরে এসে ঘটনা শুনেও একটু তব্দা খেয়ে আছে যেন। এসব কি শুনছে এতো ভালো ভাবির বিরুদ্ধে! তিনি এটা করতে পারলেন! সে তো আর জিজ্ঞাসা করতে আসতে পারে না, তবে মনে মনে সংশয় ঠিকই ছিল। ভাবি এমন ছোট হওয়ার মতো কাজ কেন করতে যাবে অযথা! বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আজ কতদিন বাদ। শ্রাবণের একটু চিন্তাও হচ্ছিল ইফতেখারের জন্য। লোকটা সেই কখন বেরিয়েছে। ফেরার নাম নেই। এখন এলেই না ভিজতে ভিজতে আসতে হবে! শুয়ে থাকলেও ঘুম নামেনি চোখে। চোখের পাতা বন্ধ করলেই কত কল্পনা ঝল্পনারা প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে। কিছুটা সময় পরেই মোটরসাইকেলের শব্দ পায়। বুঝতে পারে ইফতেখার এসে গেছে। নিশ্চিত ওই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে। অর্পা যেন বসেই ছিল, ভাই এলে ভাইয়ের কাছে বিচার দিতে ছুটবে। ঠিক তা-ই গেল। মোটরসাইকেল বারান্দায় তুলতেই ঝটপট বেরিয়ে আসে সে। ইফতেখারের টিশার্ট আধোভেজা হয়ে আছে। কাঁধের সাইডটুকু পুরোটাই ভিজে গেছে। অর্পা কাছে এসে মুখটা গোমড়া করে বলে,
“জানো, ভাইয়া। আজ ভাবি কি করেছে?”
ইফতেখার মোটরসাইকেল ঠিক করে রাখতে রাখতে বলে,
“কি করেছে?”
“আমার গলা থেকে চেইন নিয়ে গেছে।”
মোটরসাইকেল থেকে মনোযোগ সরিয়ে ভ্রু কুচকে অর্পার দিকে তাকায় ইফতেখার। অর্পা বলে,
“বিশ্বাস না হলে দেখো গিয়ে, ভাবির গলার আমার চেইন।”
“কোথায় নিয়ে গেছে চেইন?”
“কোথাও না। ঘরেই আছে। রাতে ঘুমের মধ্যে খুলে নিয়ে গেছে। সারাদিন নিজের গলায় দিয়ে ঘুরছে।”
সামান্য হতাশিত নিশ্বাস ফেলে ইফতেখার পুনরায় মনোযোগ দেয় কাজে। জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“তুমিই জিজ্ঞেস করো, কারণ।”
“আচ্ছা, করবো। যাও।”
“এখনই করো।”
ইফতেখার একটু বিরক্ত হয়। চোখ ও মুখের গহ্বরে বিরক্তি থাকলেও ধীর গলায় বলে,
“অর্পা, ঘরে যাও। একটা জায়গা থেকে এসেছি, ফ্রেশ হতে দাও।”
ভাইয়ের বিরক্তির কারণ হয়ে মন খারাপের ভার আরেকটু বেড়ে যায় অর্পার। মুখ মলিন করে ফিরে আসে ঘরে। ভেজা টিশার্ট খুলে বারান্দাতেই নেড়ে দিয়ে ইফতেখার ঘরে চলে গেছে। এদিকে পারভীন বেরিয়ে এসেছে নিজের ঘর থেকে। দুই ভাইবোনের কথা তার কানে গেছে, এদিকে শ্রাবণের কানেও এসেছে। পারভীন অর্পার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একবার শ্রাবণের দিকে দেখে। মশারির ভেতর ঘুমাচ্ছে। পরক্ষণে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“বাইরে থেকে ঘরে আসতে দেরি, এখনই দৌড়ায় যাওয়া লাগবো তোর?”
অর্পার মুখ আরও মলিন হয়ে যায়। পারভীন শক্ত চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। ইফতেখারের তখনকার কথা শুনে ও মুখের ক্লান্তি দেখে পারভীন নিজেও কিছু বললেন না তাকে। খাবার দিতে লাগলেন চুপচাপ। পরীও ঘুমাতে চলে গেছে থালাবাটি একটু এগিয়ে দিয়ে। ইফতেখার ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করলো রান্নাঘরে বসেই। পরক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিল অর্পার কথা এবার ঠিকঠাক শুনতে। কিন্তু এসে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। তাই আর ডাকেনি। এই ব্যাপার জানা হয়েছে তার সকালে নাশতা চলাকালীন। তখনও পারভীনের সামনে বসেই খাচ্ছিল। শ্রাবণ ঘর থেকেই তেমন বের হয়নি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। ভোর থেকে দেখছে কখনো বাড়ে তো কখনো কিছু কমে আসে। কিন্তু সেরে উঠার নাম নেই। তাই বৃষ্টিমুখর সকালের সময়টা কাটিয়েছে সাহিত্যের বই নিয়ে। নাশতাও করা হয়নি। আবার ঘুমঘুম পাচ্ছে বই পড়তে পড়তে। মিনিট পাঁচেক হয় অর্পা বেরিয়েছে স্কুলের জন্য। একবার বলছিল যাবেই না। বৃষ্টির গতি একটু কম দেখে আবার বেরিয়ে পড়লো ছাতা হাতে। বিপু গেলো সাথে, রিকশায় তুলে দিতে। যাওয়ার আগে ইফতেখারকে দেখে গেলেও কথা বলেনি। গতকাল ভাইয়ের বিরক্তির প্রতিক্রিয়ার উপর অভিমান হয়েছে অর্পার। ঘরে শ্রাবণ একা। দরজার দিকে বাইরে তাকিয়ে ছিল একটু আনমনা বেশে। এমনি হনহন পায়ে নাম ধরে ডেকে হাজির হয়েছে ইফতেখার। শ্রাবণ ডাকের সাড়া দিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে বিছানা ছেড়ে। বইটাও হাত থেকে রেখে দিয়েছে খাটে। ইফতেখারের মুখে তাকিয়ে দেখে এক রাশ বিরক্তি! মেজাজও খিটখিটে। পারভীন শুধু চেইনের ব্যাপারটাই জানায়নি, অতিরিক্ত কথাও শুনিয়েছে তাকে এই বাড়ি বউ করে নিয়ে আসার কারণে। মায়ের একের পর এক অপছন্দমূলক কথাই তার রাগের কারণ। মা যে মিথ্যা বলেছে, এমনটাও না। শ্রাবণ কর্তৃক অপ্রত্যাশিত ব্যাপারগুলো নিয়েই ফুসলেছেন, ছেলেকেও বকেছেন। কি অশান্তি এনে দিয়েছে তার সুখের সংসারে। তারই কিছু কৈফিয়ত চাইতে সামনে দাঁড়িয়েছে ইফতেখার। শক্ত গলায় জানতে চায়,
“অর্পার গলা থেকে নাকি চেইন নিয়ে গেছো?”
শ্রাবণ জানতো, ইফতেখারও বাদ যাবে না। আর তাই প্রস্তুতই ছিল এই ব্যাপারে। ধীর নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য অন্যত্র সরায়। পরক্ষণে তার চোখে তাকিয়ে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, নিয়েছি।”
“কেন?”
“পরতে ইচ্ছে হলো।”
“এ কোন ছ্যাচড়ামি? তুমি আরেকজনের গলা থেকে চেইন কেন নিয়ে যাবে?”
“আমার গলায় নেই যে, তাই নিয়ে গেছি।”
ইফতেখারের আরও রাগ হয়। কণ্ঠও হয়ে উঠে আগের তুলনায় ক্রুদ্ধ।
“তাই বলে তুমি তার চেইন নিয়ে যাবে!”
“তো কারটা নিবো? পরীর গলায় তো নেই যে, পরীরটা নিয়ে যাবো। আম্মারটাও তো নিতে পারি না নিজে খুলে। আর ননদের চেইন নিয়েছি পরার জন্য, তাতে কি এমন জঘন্য কিছু করে ফেলেছি?”
“নিবেই কেন? সে তো তোমাকে দেয়নি। চেইন দাও।”
“পিঁপড়ার ব্যাপারটা যখন হাতির পিঠ পর্যন্ত উঠে গেছে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এটা আর দিবো না।”
“দিবে না মানে!”
“দিবো না মানে, দিবো না।”
“আমি দিতে বলেছি। রাগ বাড়িয়ো না বলছি।”
“রাগ মনে হয় আমারও বাড়ছে।”
“চাইছো কি তুমি?”
“বেশি কিছু না। এটা পরে থাকতে চাইছি। ঠিক আছে। আপনি যখন বলছেন, তো দিবো। তবে, এখন না। আমার পরার শখ যখন শেষ হবে, তখন দিয়ে দিবো।”
থমথমে গলায় প্রত্যুত্তর করে শ্রাবণ তার সামনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ইফতেখার তা হতে দেয় না। মেজাজ তার চরম বিগড়ে যাচ্ছে। তবুও সে যেটুকু পর্যন্ত আছে, ভেতরে ভেতরে শান্ত থাকার চেষ্টাতেই আছে। শ্রাবণ ব্যতিত পরিবারের অন্য কোনো সদস্য হলে হয়ত আরও চেঁচিয়ে উঠতো! শ্রাবণ যেতে লাগলেই শক্ত হাতে বাহু টেনে ধরে ফেলেছে ইফতেখার। যেন গলা থেকে ছিনিয়েই নিবে চেইন। তবুও সে গলায় হাত দেয় না। ভদ্রভাবে চেয়ে নেওয়ার আরও একটা সুযোগ নেয়। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া গলায়ই বলে,
“এখন দিবে।”
গলা উঁচু নয়, কিন্তু দৃষ্টি ও কণ্ঠের এমন কঠিনতর হয়ে উঠা শ্রাবণের ক্রোধান্বিত চোখে পানি এনে দেয়। ক্রোধ জমানো সিক্ত এই চোখে সে ইফতেখারের হাতে তাকায়, যেই হাত তার বাহু ধরে রেখেছে শক্ত চাপে। পরক্ষণে ইফতেখারের চোখে তাকাতেই হাতের চাপ হালকা করে নিয়েছে সে সাথে সাথেই। শ্রাবণ গলায় হাত দিয়ে ঝটপট চেইন খুলে নেয় চাপা ক্রোধের সাথে। যেন ইফতেখারের এমন আচরণটুকু সে প্রত্যাশা করেনি। চেইনটা খুলে ইফতেখারের হাতের মুঠোয় দিয়ে দেয় থিতলে। সেই সাথে নিরব এক কঠিন অভিমানের দৃষ্টিও নিক্ষেপ হয়। কম্পিত নিশ্বাসের সাথে সেই দৃষ্টি সে সরিয়ে নিয়েছে। তর্জনীর পিঠে চোখের কোণের সিক্ততাকে রুক্ষতায় পরিণত করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। ইফতেখার দাঁত কিড়মিড়িয়ে হজম করতে চায় এক ফালি রাগ ও ব্যাথা। মায়ের বকাঝকা এবং স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডই তার এই কঠিন অবস্থার মূল কারণ। মুঠোয় চেইন নিয়ে সে-ও বেরিয়ে আসে কয়েক সেকেন্ড পর। হনহনিয়ে যায় মায়ের কাছে।
“এই নাও তোমার চেইন।”
হাতের চাপে চেইন দিয়ে পুনরায় হনহনিয়েই বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে চলে যায়। পরী পাশেই ছিল। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল ইফতেখারের যাওয়ার পানে। পারভীন চেইন পাওয়ার পরও বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাতেই পরী বলল,
“হইছে, আম্মা। চেইন পাইছেন, এইবার চুপ থাকেন। এমনেই দিছেন রাগাইয়া ভাইজানরে।”
“তুই চুপ থাক!”
উল্টো ধমক খেয়ে নিজেই চুপ হয়ে যায় পরী। ইফতেখার ঘরে এসে বসে বসে রাগ হজম করে নিতে চায়। বাইরে বৃষ্টি না হলে হয়ত বাড়ির সীমানা ছেড়ে গিয়েই ভুলতে চেষ্টা করতো একেকটা ব্যাপার। প্রকৃতির বাধায় বাধ্য হয়ে ঘরেই বসে থাকতে হয়। রাগও হচ্ছে কষ্টও হচ্ছে। একটা চেইনের জন্য শ্রাবণ এমন করতে পারে! মা-ও কতটা বলতে পারে! বউ আনলো এতো পছন্দ করে, অথচ মায়ের সাথেই তার ভাব মিললো না। এ কেমন হলো! মিনিট দুয়েক এসব ভেবেই কাটে তার। আবারও ভেসে উঠে শ্রাবণের মুখটা। চেইনটা দেওয়ার সময় কী কঠিন অভিমান সমৃদ্ধ এক দৃষ্টি স্থির করেছিল তার উপর! হঠাৎই ভাবনায় বাঁধা আসে তার। শ্রাবণ তো তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কোথায় গেল!
ইফতেখার সাথে সাথেই বেরিয়ে আসে বাইরে। উঠুনে তাকিয়েই হেঁটে চলেছিল অর্পার ঘরে পুনরায় দেখতে। তাকে আর ঘর পর্যন্ত যেতে হয়নি। বারান্দায় হাঁটতে গিয়েই নজর পড়েছে পুকুরের কাছে। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। জোর গলায় ডাকতে গিয়েও ডাকে না সে। ঘরে এসে ছাতা নিয়ে বের হয়।
একাকী বিষণ্ণতা বরণে বৃষ্টি বিলাস করছিল শ্রাবণ। স্থির তাকিয়ে ছিল পুকুরে বাঁধাহীন আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুচ্ছের দিকে। একেক ফোঁটা বৃষ্টি ভরো পুকুরটাকেও কাঁপিয়ে যাচ্ছে রীতিমতো। মৃদু বেগের হাজারটা ঢেউ খেলে যাচ্ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। তাদের খেলাই দেখছে শ্রাবণ এতোক্ষণ ধরে। হঠাৎ একাকিনীর নিঃসঙ্গতা ভাঙতে এলো ইফতেখার। নিজের মাথার ছাতা কিছুটা শ্রাবণের দিকে এগিয়ে বলে,
“এই সকাল বেলা ভিজছো কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ঘরে যাও।”
গলা তার একদমই শান্ত। শ্রাবণ নিশ্চুপ ছাতার আশ্রয় থেকে সরে দুই কদম এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ইফতেখার একই স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
“তোমার কাছে আমি এমন কিছু আশা করিনি, শ্রাবণ। দিনে দিনে আমাকে শুধু হতাশই হতে হচ্ছে।”
“আপনার প্রত্যাশা মোতাবেক যদি আমাকে চলতে হয়, তো আমার নিজস্বতা কোথায় রইল?”
সাথে সাথেই শ্রাবণ পিছু ফিরে শক্ত গলায় জবাব দেয়। ইফতেখার প্রত্যুত্তর করা থেকে বিরত থাকে তার গলা অতিরিক্ত না বাড়ানোর জন্য। এই সকাল বেলা ভিজছে। আবার না অসুস্থতা ডেকে নেয়। তাই ঘরে ফেরানোর চেষ্টায় আবারও বলে,
“ঘরে চলো।”
তাকে উপেক্ষা করে জেদি মুখ ফিরিয়ে নেয় শ্রাবণ। সে ভিজবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। ইফতেখার কিঞ্চিৎ হতাশার নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় এবার। আবার ছাতা মাথায় ধরে। হাতটা ধরে টানতে চায় সাথে নিয়ে যেতে। শ্রাবণ পুনরায় একই মেজাজে তাকিয়ে ঝাড়ি মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। কটাক্ষ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হনহন পায়ে চলে যায় ঘরে দিকে। ঝাড়িতে হাতে যতটুকু না কম্পন অনুভব হয়েছে, হৃদয় যেন তার চেয়ে বেশি তিরতির করে কেঁপে উঠলো। মায়ের রাগ, কেন এমন বউ ঘরে তুললো। বউয়ের রাগ, কেন এমন করে শখের বস্তু কেড়ে নিলো! উভয়ের শখের শিঁকড়টা যেন সে-ই তুলে নিলো মৃত্তিকার বুক থেকে। সেই ব্যাথা নিয়ে ছাতা মাথায় এবার ঠিকই বাড়ির সীমানা ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো ইফতেখার।
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩২
(নূর নাফিসা)
.
.
সকাল দুপুর কেটে গেছে, কিছুই মুখে দেয়নি শ্রাবণ। মন খারাপ ছিল তাই পরীও আসেনি কাছে। আর তো কেউ দেখার মতো নেই ই! ইফতেখার দুপুরে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার দিনটাও সারাদিনই মলিন কাটলো। উঠেছে বিকেলে। বেরিয়ে গিয়েছিল আবার সাথে সাথেই। খাওয়ার জন্য পিছু ডেকেছিল পারভীন। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না, তাই ডাকের সাড়া দেয়নি। সন্ধ্যার পর যখন ফিরলো পরীকে ডেকে খাবার চাইলো। পরী এসে জিজ্ঞেস করে,
“ভাইজান, ভাত খাইবেন? না রুটি খাইবেন?”
“ভাতই দে।”
“ভাত খাইলে বাসি খাইতে হইবো। আপনে খান নাই, ভাবি খায় নাই। দিনের সব ভাত রইছে। গরম কইরা দিমু? না তেলে ভাজা ভাজা কইরা?”
“শ্রাবণ ভাত খায়নি?”
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে ইফতেখার। পরী যেন ইচ্ছাকৃতই শ্রাবণের কথা তুললো ইফতেখারের কান পর্যন্ত খবরটা পৌঁছানোর জন্য। ঘরের কেউই তো সাধতে গেলো না। নিজেও যেতে পারেনি সংশয়ে। কিন্তু সুন্দর মানুষটা তো না খেয়ে আছে! তাই মায়া হচ্ছিল তার। ইফতেখারের জবাব দিতে সে বলে,
“সারাদিনে পানিও মনে হয় তুলে নাই মুখে।”
ইফতেখারের বিরক্তি বাড়ে। কেন শুধু শুধু এমন করে যাচ্ছে সে? কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরটা পর্যন্ত সঠিক দেয় না! সাথে সাথেই ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে অর্পার ঘরে। অর্পা পড়তে বসেছে। শ্রাবণকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। ঘুমাচ্ছে নাকি? এগিয়ে এসে সন্দেহাতুর চোখে হাতটা বাড়িয়ে কপাল স্পর্শ করে। হ্যাঁ, মনের সন্দেহ শতভাগ ঠিক। এইতো, জ্বর বাঁধিয়ে নিয়েছে আবার! দেহের তাপমাত্রা কিছুটা অস্বাভাবিক।
কপালে স্পর্শ পেতেই আচমকা চোখ খুলে তাকায় শ্রাবণ। ইফতেখারকে দেখেই আবার মুখটা ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
“জ্বর আসছে দেখি। ভাত নাকি খাওনি সারাদিন?”
জবাব দেয় না শ্রাবণ। ইফতেখার হাত টানে,
“ওঠো। খাবার দিয়ে যাও।”
“আমি পারবো না। পরীকে বলুন দিতে।”
“তোমাকে আসতে হবে। ওঠো।”
“আমার যখন ইচ্ছে করবে, খেয়ে নিবো। ডেকে ডেকে বিরক্ত করবেন না।”
“আমার খাবার দিয়ে যাও।”
“পারবো না, বললাম না!”
“শ্রাবণ, সবকিছু নিয়ে জেদ করলে চলে না। চলো!”
শ্রাবণ শক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
“বললাম না, না ডাকতে? বিরক্ত করলে আমি এখন বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যাবো।”
হাত ছেড়ে দেয় ইফতেখার। রাগ হয় তার জেদের উপর। রাগটা চাপা রেখে সে-ই বেরিয়ে আসে। এতো ঠেকা তারও পরেনি বিনা অপরাধের মাশুল এভাবে দিয়ে যেতে। সাদরের ডাকে যদি সাড়া না পাওয়া যায়, তবে ডাকবেই কেন আর? পরী তার খাবার এনে দিয়েছে, চুপচাপ সে খেয়ে নিয়েছে। শ্রাবণ খেয়েছে পরদিন সকালে। স্বেচ্ছাতেই এসে দুটো রুটি নিয়ে গেল চুপচাপ। একা একা খেয়ে গেল জানালার পাশে আনমনে বসে। কিছুক্ষণ কথা বলেছে ফোনকলে। ওদিকে ইফতেখার দুপুরে এসে দাঁড়িয়েছে বাবার সামনে।
“আব্বা, ব্যস্ত আছেন?”
“না, আয়। কি দরকার?”
“আমাকে কিছু টাকা দিতে হবে।”
“কত?”
“পঞ্চাশ হাজার।”
আফজাল হোসেন ভেবেছিল হাত খরচের জন্য হাজার দুয়েক চাইবে। টাকার পরিমাণ জেনে কিঞ্চিৎ বিস্ময় বেগের ধাক্কা যেন খান। কেননা, বড় অংকের টাকা নিতে হলে সবসময় আগে কারণ বলে তারপর টাকার হিসেব পেশ করে। আর আজ বিনা কারণেই সে বড় অংকের টাকা চেয়ে বসেছে। তাই জিজ্ঞেস করেন,
“পঞ্চাশ হাজার?”
“হুম।”
“এতো টাকা দিয়া কি করবি?”
এমনিতেই দুদিন যাবত মন মলিন। তারউপর বাবার জিজ্ঞাসাটুকু যেন আরও ভারি হয়ে গেল বহন করা। একটু তাকিয়ে থাকে সে বাবার দিকে। সাথে সাথেই উত্তর করে না কারণ জিজ্ঞাসার জন্য। শ্রাবণের একটা কথা তার বেশ মনে পড়ে গেলো। ওইযে, বলেছিল বউয়ের জন্য কিছু কিনতে গেলেও বাবার কাছে কৈফিয়ত দিয়ে নিতে হবে। তা-ই যেন ঘটলো এবং মনে লাগলো। বাবা জিজ্ঞাসা না করলেই বোধহয় তার কাছে ভালো লাগতো এই ব্যাপারটায়। কেননা টাকাটা ঠিক বউয়ের জন্যই চাইতে এসেছিল। কৈফিয়ত দিতে এখন খানিক দ্বিধাগ্রস্ত সে। কিঞ্চিৎ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয় আবার। না চাইতেও উত্তর দেয়,
“শ্রাবণের জন্য একটা চেইন কিনবো।”
আফজাল হোসেন যেন অসন্তোষ হলেন। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন, ছেলের মুখটা এমন দেখাচ্ছে হয়তো গতকালের চেইন নিয়ে ঘটা ঘনঘটার জন্যই। মনোমালিন্য তো হয়েছেই। কিন্তু টাকা তো এমনি এমনি দিয়ে দিতে পারেন না খরচে। ঘরের একটা কাজ ধরেছে, সেখানেই টাকার উপর টাকা যাচ্ছে। অতিরিক্ত খরচটা তিনি চাপিয়ে নিতে চান। শ্লেষ্মা পরিষ্কারে গলা খাঁকারি দিয়ে ছেলেকে বলেন,
“এখনই চেইন কিনা দেওয়া লাগবো? কতদিকে কত খরচ যাইতাছে। হিসাবের কিনারা পাই না খুঁজে। খরচ একটু চাপাইতে হইবো।”
“কিছু কিছু খরচ অপরিহার্যই হয়। আমার এখনই লাগবে।”
“ঘরের কাজটা শেষ হোক, পরে নিস। আর চেইন কেনার দরকার নাই। পারভীনরে বলমু নে, তারটাই দিবো নে শ্রাবণ যখন চাইছে।”
“শ্রাবণ চায় নাই। আর মায়ের চেইনও দরকার নাই।”
“এই শোন…”
হনহনিয়ে চলে যায় ইফতেখার। বাবার আপত্তি মোটেও পছন্দ হয়নি। রাগ বেড়েছে নিজের উপর। এইতো, নিজে একটা চেইনই দিতে পারলো না স্ত্রীকে! তার আয় ঠিক কোথায় তবে? সত্যিই কি কোনো স্বকীয়তা নেই? নেই-ই তো। কৈফিয়ত দেওয়ার পরও নেই। প্রয়োজনে না পাওয়ায় আজ গায়ে লাগলো কথা। হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো বাজারের দিকে। পথে বিপুকে দেখলো। মধ্যদুপুরের বিরতিতে স্কুল থেকে বাড়ি আসছে সে। ইফতেখারের মন বলে, বিপু বড্ড ভালো কাজ করেছে কোনো একটা কাজে লেগে। নিজের একটা আলাদা খুঁটি সে পোক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করছে জীবন যাপনের প্রয়োজনে। ছোট ভাইয়ের সামনে যেন আজ নিজেকেই বড় বেকুব লাগছে ইফতেখারের। ক্লাবে এসে একা বসে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। সন্ধ্যায় বাড়ি এলে নিজের ঘর থেকে পারভীন তাকে ডাকে। ইফতেখার শুনতে এগিয়ে এলেই বলেন,
“দাঁড়া।”
আলমারি খুলে নিজের গহনাগাঁটি নেয় পারভীন। ছেলেদের বিয়ে করানোর আগেই পুত্রবধূ বরণ নিয়ে একটা প্রত্যাশা বুনে রেখেছিল মনে। এরমধ্যে একজন নিয়েও চলে এলো, আয়োজনের প্রত্যাশায় ধুলো উড়িয়ে। এরপর তার জন্য ভাবনাটা ভেবেছিল অন্যভাবে। গুণ দেখে গহনা জড়িয়ে দিবে পুত্রবধূর গায়ে। রূপ দেখে শুরুতে ভালোই লেগেছিল। কিন্তু দিনের পর দিন আচরণে লক্ষ্য করতে গিয়েই ভাগটুকু আর দেওয়া হলো না। এখনো দিতে ইচ্ছুক না। যে মনে জায়গা গড়তে পারেনি, তার দেহে শখের গহনা কেন গড়ে দিবে সে? তবুও আফজাল হোসেন আজ দুপুরে বলাতে নিজের মোটা গড়নের চেইনটা গলা থেকে খুলে নিয়েছে। গহনার বাক্সে রাখা আছে চিকন গড়নের একটা। ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দুইটা চেইনই হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“কোনটা নিবি, নে। তবুও শান্তি চাই আমি।”
একবার চেইনে, আরেকবার মায়ের মুখে তাকায় ইফতেখার। একটা চেইনও স্পর্শ না করে বলে যায়,
“তোমার কোনোটাই লাগবে না। তুমিই দুইটা পরে বসে থাকো।”
পারভীন চেইন হাতে কটাক্ষ চোখে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। তার পছন্দের গুরুত্ব দিতে চাইলো মা, তবুও রাগ কেন দেখাবে সে! ইফতেখারের পরোয়া নেই পিছু পথে। খেমটা মেজাজে ঘরে এসে দরজা চাপিয়ে দিয়েছে। দুইটা চেইন ই তো ছিল মায়ের কাছে। তো ছেলের বউ যখন পরতেই চেয়েছিল, দুদিন ধরে ব্যাপারটা গড়াগড়ি না করিয়ে কি তিনি পারতেন না তখনই একটা দিয়ে দিতে? কেন নালিশ, সালিসের সৃষ্টি করে গেলেন? অশান্তির সৃষ্টি কে করলো তবে? ইফতেখারের রাগ হচ্ছে। নিজের কাছে থাকা টাকা মেলানোর চেষ্টা করছে। শ্রাবণ যখন চেইন নিয়ে একটা কাহিনী সৃষ্টি করেই গেলো, সে যেভাবেই হোক তার একটা চেইন গড়ে দিবে। শুধু তা-ই না। ভাবছে নিজের জন্যও। কৈফিয়ত দিয়ে টাকা যেন আর না চাইতে হয় বাবার কাছে। কিছু করতে হবে তাকে। স্বকীয়তা অর্জন করতে হবে।
পরীকে ডেকে একবার শ্রাবণের খবর নিলো। জ্বর বেড়েছে কি না? পরী জানিয়ে গেলো, জ্বর নেই। হাঁচি দিচ্ছে সারাদিনই। ওষুধের কথা জানতে চাইলেও মধ্যস্থতা রক্ষা করা পরী জবাব দিয়ে গেছে, “লাগতো না।”
পরবর্তী দুদিনেও শ্রাবণের সামনে দাঁড়ায়নি ইফতেখার। বিনা দোষে তাকে হেলা করায় অভিমান জন্মেছে কিছুটা। আজ দাঁড়িয়েছে প্রয়োজনে। মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরতেই শ্রাবণকে পেয়ে গেছে সামনে। সে প্রবেশ করতে গেলেই বারান্দা ছেড়ে বের হতে যাচ্ছিলো শ্রাবণ, পরীর সাথে। পঞ্চাশ হাজারের মধ্যেই মধ্যম গড়নের চেইন হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে ইফতেখার। বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নাও, এটা তোমার জন্য কেনা।”
শ্রাবণ ভ্রু মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বাক্সে তাকায়। পরক্ষণে ইফতেখারের চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমার প্রয়োজন নেই এসবের।”
“তুমি যখন চাইবে, তার সাথে সাথেই হাজির করার সামর্থ্যটাও আমার নেই। থাকলে তখনই দৌড়ে আনতাম। প্রত্যাশা পূরণে একটু তো দেরি হতেই পারে। রাখো।”
“কীসের প্রত্যাশা? আমি তো চাইনি, আপনার কাছে।”
“চাওনি, কিন্তু বুঝতে দেরি হলো সেদিন কিসব দায়িত্বের কথা বলেছিলে। এখন বুঝলাম, কোনটা আসলে আমার দায়িত্ব।”
“আপনার কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে না।”
“হালকা জিনিস হালকাই থাকতে দাও, শ্রাবণ। বেশি গভীর করার প্রয়োজন নেই। ধরো এটা।”
“আমার, লাগবে, না!”
শক্ত গলায় কথা বলে তাকে উপেক্ষা করে হনহনিয়ে বারান্দা ছেড়ে উঠুনে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। পিছু থেকে রাগান্বিত গলায় ধমক দেয় ইফতেখার,
“শ্রাবণ!”
কে শুনে কাকে? তার যাওয়া সে চলে গেছে। গোয়ালের নতুন সদস্য জন্মেছে। দেখতে গেছে শ্রাবণ তাকে। ইফতেখার বিরক্তি নিয়ে ঘরে চলে গেছে। বাক্সটা বিছানায় থিতলে রাখতে গেলে ফ্লোরে পরে যায়। উপরের কভারটায় ফাটল ধরে তাতে। হাতাশার সাথে আবার ঠিকভাবে তুলে রাখে ইফতেখার। খিটখিটে মেজাজে কোনো কিছুই ভালোভাবে ঠিক জায়গায় রাখা যায় না যে! যত্নে তুলে রাখা জিনিস গুলোই সুষ্ঠু, সুন্দরভাবে সজ্জিত থাকে যথাস্থানে। হোক সেটা কোনো বস্তু কিংবা সম্পর্ক।
কিছুক্ষণ পর যখন শ্রাবণকে একা ঘরে শুয়ে থাকতে দেখলো, নিজের ঘরে এসে চেইনটা আবার নিয়ে গেলো ইফতেখার। অর্পার ঘরে এসে দরজা চাপিয়ে দিলো ভেতর থেকে। দরজার শব্দেও ফিরে তাকায়নি শ্রাবণ। বুঝতে পারলো ঘুমাচ্ছে সে। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে আসে ইফতেখার। পাশে বসে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত শ্রাবণ পানে। গর্জন থাকবে বৈশাখী ঝরের। গর্জন থাকবে আষাঢ়ের কালো আকাশে। গর্জন কেন তার শ্রাবণমায়ার মুখগহ্বরে বাসা বাঁধে? শ্রাবণের ধারা তো ঝুমঝুমির তানে ভাসবে দুয়ারে দুয়ারে। এই শ্রাবণ কেন তবে জেদের বশে মুখ কালো করে রাখবে? ইফতেখার চেইনটা নিয়ে তার গলায় পরিয়ে দিতে যায়। খুব বেশি সময় হয়নি গোয়ালের কাছ থেকে ফিরে শ্রাবণ ঘুমিয়েছে। কাঁচা ঘুমটা তার ভেঙে গেছে গলায় স্পর্শ পেয়ে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ইফতেখার সামনে বসা। তাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি স্পষ্ট করার চেষ্টা করে নিজের কাজ চালিয়ে যায় সে। ভালোই লাগছে তার শ্রাবণ গলায় সোনার চেইন। পরানো হতেই বললো,
“ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম? স্যরি।”
শ্রাবণ নিজের গলায় তাকিয়ে আবার তার মুখে তাকায় কপালে সূক্ষ্ম ভাব ধরে রেখে।
“এটা তোমার জন্যই কেনা। কারোরটা না। আমি দিলাম কিনে। খুলবে না বলছি। ঘুমাও।”
ইফতেখার উঠে যায় কথার পরপরই। বেরিয়ে যেতে পা বাড়িয়েছে কয়েক কদম। ততক্ষণে শ্রাবণ উঠে বসেছে ঝটপট। পিছু বলে উঠে,
“চেইন লাগবে না আমার। কিছু টাকার দরকার। টাকা দিন আমাকে।”
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“চেইন লাগবে না আমার। কিছু টাকার দরকার। টাকা দিন আমাকে।”
ভ্রু কুচকে পিছু ফিরে তাকায় ইফতেখার। মাথায় ধরা দেয় অন্যরকম চিন্তা। তার সাথে কি শ্রাবণের শুধুই টাকার সম্পর্ক? চাইতে হলে টাকাই কেন চাইতে হবে বারবার? দুতিনদিন যাবত চেইন নিয়ে যে ঘটনা ঘটে গেলো, অর্পার গলা থেকে না নিয়ে তার কাছেও তো চাইতে পারতো। তা-ও তো চাইলো না। চাওয়ার মধ্যে টাকা ছাড়া এ পর্যন্ত কিছুইনি চায়নি বোধহয়। কিন্তু কেন? যতটুকু এগিয়েছিল, চিন্তিত বেশে তার অর্ধেকটা পিছিয়ে এসেছে ইফতেখার। জানতে চায়,
“টাকা? টাকা কেন?”
“দরকার আছে।”
তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয় শ্রাবণ। সন্দেহাতীত গলায় ইফতেখার জিজ্ঞেস করে বসে,
“অর্পার চেইনটা কি তুমি বিক্রির জন্য নিয়েছিলে তবে?”
নিরুত্তর বাইরে তাকিয়ে বসে থাকে শ্রাবণ। ইফতেখার পাশে বসে বলে,
“একটা কথা এতবার কেন জিজ্ঞেস করতে হয় আমাকে? এ পর্যন্ত কতবার জিজ্ঞেস করেছি, অর্পার চেইনটা তুমি কেন নিয়েছো? জবাব দিয়েছো? কোনো কিছুর পরিষ্কার উত্তর কেন দাও না আমাকে?”
“কারণ, আমি মানুষটাই ভেজাল।”
“সবকিছু ভেজালে রাখলে চলে না। সমস্যা যখন তৈরি হয়ে যায়, এর খোলাসা হওয়াটা জরুরী। আমি জানি, তুমি এমন নও, যেমনটা রটেছে।”
“চেইন নিয়ে আমি আর কোনো কথাই শুনতে চাইছি না। আর না চাইছি কিছু বলতে। আপনি প্লিজ থামুন। আর টাকা দিবেন কি-না, বলুন। এই চেইনও আমার লাগবে না।”
“ঠিক আছে। বললাম না আর সেসব। কিন্তু, টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?”
কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে হাঁটু জড়িয়ে বসে শ্রাবণ। হাঁটুতে তাকিয়েই বলে,
“বলিনি আপনাকে, আমি দেনা আছি? দেনা পরিশোধ করবো।”
“হিসেব করে জানাবে বলেছিলে। কত?”
“আপাতত দশ হাজার দিন।”
“সবমিলে কত?”
“এত প্রশ্ন কেন করেন? দিতে সমস্যা? এই চেইন নিয়ে যান। এটা ফেরত দিয়ে টাকা দিন।”
“দিতে সমস্যা কি না, সেটা বড় কথা না। তোমার বলতে কেন সবসময়ই সমস্যা হয়ে থাকে? কিছু জিজ্ঞেস করলেই মেজাজ দেখাও আমার সাথে। পরিষ্কার উত্তর করো না। আমি তো নিষেধ করিনি তোমাকে, প্রয়োজনে আমার কাছে চাইতে। তারপরও কেমন অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটিয়ে পরিবারের শান্তি নষ্টের কারণ বনে গেলে। আমার দোষটা কি, বলো দেখি একটু? এমন অশান্তি, দুশ্চিন্তামূলক চাপে কেন থাকতে হয় আমাকে?”
“আপনার কোনো দোষ নেই। চাপটাও আপনি ইচ্ছাকৃত নেন।”
“এমন পরিস্থিতির জন্যই তো নিতে হয়। স্পষ্ট জানাও না কেন আমাকে কিছুই?”
“বলবো। এখন আমার ভালো লাগছে না। আপনি টাকা দিবেন কি না, সেটা বলুন।”
পুনরায় পাশে বসে ইফতেখার। শ্রান্ত গলায় বলে,
“তুমি আমার কাছে বারবার মিথ্যে বলছো, শ্রাবণ। টাকা দিবো আমি। কিন্তু কেন দিবো, সেটা আমাকে জানতে হবে।”
“জানাচ্ছি না? প্রতিবার তো জানিয়েই নিচ্ছি।”
“সত্যটা জানাচ্ছো না।”
“হ্যাঁ, আমি মিথ্যুকই।”
“আমি তোমাকে মিথ্যুক বলছি না।”
শ্রাবণ তার চোখে তাকিয়ে বলে,
“সত্য বলছি না যখন জানেন, তবে মিথ্যুক নয় তো কি?”
“কিছু লুকাচ্ছো। আর লুকানোর জন্যই মিথ্যের আশ্রয় নিচ্ছো। আগেরবারও টাকাটা তুমি প্রকৃত কারণ লুকিয়ে নিয়েছো। কি করেছো? কেন এত প্রয়োজন টাকার?”
“আমি লোভী। টাকার প্রতি লোভ আমার। তাই আপনাকে মিথ্যে বলে বলে টাকা নিয়ে যাচ্ছি। দেখলেন না, আপনার বোনের চেইনটাও কীভাবে নিয়ে গেলাম!”
গলা ধাধিয়ে আসতে চায়, তবুও শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা তার। ইফতেখার প্রত্যাশার জবাব না পেয়ে হতাশার সাথে চোখ বুজে নেয় একটা মুহুর্তের জন্য। পরক্ষণে আরেকটু চেপে বসে। দুহাতে শ্রাবণের মুখটা ধরে বলে,
“তুমি এমন নও। প্লিজ, সত্যিটা বলো আমাকে।”
“আমি এমনই।”
“না।”
“এত বিশ্বাস কেন আমার উপর?”
চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় শ্রাবণ। ইফতেখার তাৎক্ষণিক জবাব দেয় না। তাকিয়ে থাকে ওই চোখে। সিক্ত হয়ে আসছে যেন মায়াচোখের রাশি। হাতটাও ধীরে ধীরে মুখ ছেড়ে দেয়। এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ যেন ইফতেখারের কাছেও নেই। কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব করছে শ্রাবণ, মানতে নারাজ সে। নিজের চোখের ভেজা ভাব উপলব্ধি করতেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে শ্রাবণ। ইফতেখার এতক্ষণে উত্তর দেয়,
“জানি না।”
শ্রাবণও গলা নরম রেখে জিজ্ঞেস করে,
“আমি আপনাকে ঠকিয়ে গেলে, আপনার কষ্ট হবে না?”
“যে আমার কষ্ট নিয়ে ভাবতে পারে, সে কখনোই ঠকাবে না।”
চোখ টলমলে হয়ে আসে শ্রাবণের। নত চোখের দুই ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে যায় কোলে। ইফতেখার চোখ সরায় না তার দিক থেকে। হতাশিত গলায় জানতে চায়,
“তুমি কি বলবেই না?”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কম্পিত শ্বাস নেয় শ্রাবণ। বলে,
“কাল আমি এক জায়গায় যাবো। আপনি যাবেন সাথে। কিছু টাকাও নিবেন।”
“কোথায়?”
“গেলেই তো দেখবেন।”
“ঠিক আছে। সর্দি কমেছে তোমার? ওষুধ লাগবে?”
“না। কমে গেছে।”
আগামীকালের অপেক্ষা নিয়েই চলে গেলো ইফতেখার। জিজ্ঞাসা করলো না অতিরিক্ত কিছুই। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে বাবা ছেলে একত্রে বের হয় মসজিদ থেকে। ইফতেখারকে ডেকে আফজাল হোসেন একত্রে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেন,
“ব্যাংকে নাকি গেছোস?”
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“ক্যা?”
“লোন তুলতে।”
“লোন! লোন ক্যা?”
“শ্রাবণের জন্য চেইন কিনেছি।”
“লোন উঠাইয়া তোর চেইন কেনা লাগবো?”
“আপনার কাছে তো আগেই বলছিলাম আব্বা, কিছু কাজ অপরিহার্য হয়ে যায়। আপনি যখন মানা করলেন, ভিন্ন ব্যবস্থা তো করতেই হবে কোনো একটা।”
ছেলের জবাবে অসন্তুষ্ট হলেন আফজাল হোসেন। একটু বেশি বাড়াবাড়ি মনে করলেন ব্যাপারটা। অতঃপর বললেন,
“তোর মা-ই তো সাধছিলো। নিলি না ক্যা?”
“মায়েরটা নিবো কেন? মা দেওয়ার হলে সেদিন দিতে পারলো না, যেদিন এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে? এতো রটিয়ে রটিয়ে এখন কেন চেইন দিবেন তিনি?”
কথা ঠিকই বলেছে। আর এজন্য একটা ধমকও দিয়েছিলেন সেদিন পারভীনকে, যেদিন ইফতেখারকে টাকার জন্য নিষেধ করলো। তাইতো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেকে ডেকে চেইন দিতে গেলেন পারভীন। আর এর শুরুর দিন তো শ্রাবণের অপমানের উপরই ক্ষেপে ছিলেন। নয়তো, সেদিনই যদি পারভীন একটা চেইন দিয়ে দিতো ব্যাপার এতো মন্দভাবে গড়াতো না। আফজাল হোসেন একটু গম্ভীর হয়ে থাকেন। ইফতেখারের লোন নেওয়াটাও তিনি পছন্দ করেননি। যদি জানতেন, চেইনের জন্য লোন পর্যন্ত নিয়ে ফেলতে চাইবে। তবে তখনই টাকা দিয়ে দিতো। সে তো নিষেধ করে একটু খরচ চাপাতে চাইছিল মাত্র! তার জিদ্দি ছেলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেছে ঘর ছেড়ে। তিনি গম্ভীরমুখেই বলেন,
“কত তুলছোস?”
“তিন লাখ।”
“চেইনের জন্য তিন লাখ টাকা তুই লোন উঠাইতে গেলি ক্যা?”
“চেইন না শুধু। প্রয়োজন আছে। ভেবে নিয়েছি, ব্যবসা শুরু করবো শীঘ্রই। কথা বলছি মালামাল নিয়ে।”
“কিসের ব্যবসা?”
“ওই বালুর মাঠকে আমিই কাজে লাগাবো। পার্টি ডাকতে হবে না কোনো। ব্যবসা শুরু করতে দিন, মাসে মাসে যেই ভাড়াটা আপনি পার্টির কাছ থেকে পেতেন। সেটা নাহয় আমিই দিবো। সবটা গুছিয়ে নেই আগে।”
“তুই কি করবি এই জায়গায়?”
“বালু, পাথর, কনক্রিটের ব্যবসা সামলাবো।”
আইডিয়া ভালো। কিন্তু ছেলেকে একক সিদ্ধান্ত নিতে দেখে অসন্তোষভাবে তাকিয়ে থাকেন আফজাল হোসেন। সেই চোখকে এড়িয়ে গেইটের ভেতর আগে চলে যায় ইফতেখার। একই গম্ভীরতা যাপন করে তিনি পায়ের গতি ধীর করে নিয়েছেন। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। একা একা সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছে। যেখানে তিনি বাবা হয়েও ছেলেকে ডেকে ডেকে জানিয়ে একত্রে বসে পরামর্শ করেন প্রায় সমস্ত ব্যাপারই, সেখানে ছেলে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করেনি নিজ থেকে। ছোটটাও তো এভাবেই দায়িত্ব নিতে শিখলো। যাক, করবে যখন কিছু। করুক। জমি নিয়ে বাঁধা দিলেন না। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ব্যথাটা ঠিকই জমাট বাঁধলো বুকে।
শ্রাবণের গলায় চেইন দেখে সকালে পরী ফিসফিস করে,
“ভাবি, আপনে জিতছেন কইলাম। জিতছেন। শাবাশ! এমন রাগই তো করা দরকার। আপনের সাহসটাও কিন্তু আমার ভাল্লাগছে। ক্যামনে আরেকজনের গলার চেইন খুইল্লা নিজের গলায় দিয়া সামনে সামনেই হাঁটতেছিলেন।”
“লুকিয়ে নেওয়া তো চোরের কাজ। আমি কি চোর?”
“না না। তাইতো কই, সাহসী মাইয়্যা। কি যে ভাল্লাগে আপনারে।”
“জীবনে যুদ্ধ করতে হলে সাহস রাখার দরকার আছে।”
“আপনের জন্ম তবে পঞ্চাশ, ষাটে হওয়া দরকার ছিল। একাত্তরে নাইম্মা পড়তেন লাঠিবেন্দা নিয়া।”
শ্রাবণ মৃদু হেসে বলে,
“লাঠিবেন্দায় কাজ হতো না। রাইফেল লাগতো।”
“আপনে হেইডাও চালাইতে পারবেন। কোনো সন্দেহ নাই।”
প্রশংসা করে কাজে চলে যায় পরী। এদিকে ইফতেখারের অপেক্ষা করছিল শ্রাবণ। দেখা পেতেই বললো,
“আপনাকে না এক জায়গায় নিয়ে যাবো বললাম?”
“কখন যাবে?”
“এখনই যেতে হবে। নয়তো জ্যামে পড়লে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।”
“আজ তো একটু কাজ পড়ে গেছে আমার। আগামীকাল যাই।”
“তবে আমাকে টাকা দিন। আমার যেতে হবে আজই।”
ইফতেখার একটু চিন্তিত হয় দোটানায়। ব্যবসায় শুরু করার জন্য মালামাল নিয়ে যে লোকটার সাথে কথা হচ্ছিলো, আজ তার সাথে দেখা করার কথা। উপস্থিত থেকে একটু দেখে, বুঝে আসতো পুঁজির ব্যাপারস্যাপার। সে শ্রাবণকে বললো,
“ঢাকাই যাচ্ছো তো?”
“হুম।”
“তুমি ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে যাও। কাজ সেরে দুপুরের দিকে নাহয় আমি সরাসরি সেখানে চলে যাবো। টাকাও আমি নিয়ে আসবো।”
“আচ্ছা। যাত্রাবাড়ী গিয়ে আমাকে কল দিলেই হবে।”
“তোমার ফোন তো বন্ধ পাওয়া যায়।”
“সমস্যা নেই, আমিই আপনাকে কল দিবো।”
ইফতেখার তাকে কিছু খুচরা টাকা দিয়ে যায় ভাড়ার জন্য। তাড়াহুড়ো করে না গিয়ে, নাশতা করে যেতে বলে। অথচ এদিকে সে নিজেই তাড়াহুড়োয় নাশতা করে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটেছে। শ্রাবণ ধীরে সুস্থেই বেরিয়েছে। পারভীন থমথমে চোখে তাকিয়ে ছিল শুধু পিছু, বললো না কিছুই। কথাই বলে না আজ ক’দিন যাবত। প্রয়োজন না পড়ায় শ্রাবণও যায় না বলতে। ঘন্টা দুই সময় নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায় শ্রাবণ। ফাতিহার জ্বর কমলেও দুরারোগ্য ব্যাধি হানা দিয়েছে তীব্রতর। ক’দিন পরপরই এই অসুস্থতা গাঢ় হয়ে আসে। চিকিৎসা চলে, পরম দয়ালুর রহমতে আবার একটু সুস্থ হয়ে উঠেন। আবারও অবস্থার অবনতি হয়। গত দুদিন যাবত তার দুরাবস্থা জানাচ্ছে শিখা। শ্রাবণ তাই দেখতে চলে আসে। ইফতেখারের মনে সন্দেহ পুরোপুরি গেঁথেছে উপলব্ধি করতে পারলে তাকেও জানানোর প্রয়োজন মনে করে। তাই আসতেও বলে। রিকশা থেকে নেমেই শ্রাবণ স্বপ্ন নিকেতনে প্রবেশ করে। সাথে সাথেই আবার বেরিয়ে আসে কিছু ফলমূল নেওয়ার জন্য। ফলের দোকানের দিকে এগোতে গেলেই গেইটের কাছাকাছি খালিদ ভাইয়ের সামনে পড়ে যায়। খালিদ যেন কিছু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তার নজরে পড়ে! শ্রাবণ এগিয়ে যায়।
“আরে, খালিদ ভাই যে! আপনি এখানে?”
“এমনি। আইছিলাম, কাজে।”
“এমনি! আবার কাজে! আব্বার কোনো কাজে নয়ত?”
“নাহ। আমারই কাজে। তুমি এনে ক্যা?”
“আমি এসেছি বেড়াতে।”
“তোমার বাপের বাড়ি এদিকে?”
“কেন, বাপের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও বেড়াতে আসা যায় না?”
“যায়। যাইবো না ক্যা।”
ঠোঁটের ধারে কিঞ্চিৎ হাসি এঁটে শ্রাবণ বলে,
“আমার বাপের বাড়ি দেখার খুব আগ্রহ যেন আপনার! আপনি আমায় ফলো করছিলেন না তো আবার?”
“তোমারে ফলো করমু ক্যা?”
“তা তো আমারও কথা। তবে মনে হলো আরকি। যাইহোক, আপনার কাজটা কি এখানেই?”
“না।”
থমথমে মুখে হনহন পায়ে হেঁটে চলে যায় খালিদ। শ্রাবণ মুখ টিপে হেসে ফলের দোকানে যায়। কিছু আঙুর ও কমলা নিয়ে সে স্বপ্ন নিকেতনে আসে। দেখা করে ফাতিহার সাথে। অসুস্থ ফাতিহা তাকে দেখেই কান্না করে। কাঁপা হাতে শ্রাবণের হাত আঁকড়ে ধরে বলতে থাকে, বাঁচবে না সে। অসময়ে শ্রাবণের ধারা বয় শ্রাবণ ফুরিয়ে গেলেও। যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে ফাতিহার সেবায় মগ্ন থাকতে চায় সে। আজ তার প্রিয় ম্যাম আছে এখানে। সেবায় বিরতি নিয়ে তার সাথেও দেখা করে আসে শ্রাবণ। পুনরায় ফাতিহার কাছে ফিরতেই ইফতেখারের কল আসে। যাত্রাবাড়ী পৌঁছেই কল দিয়েছে সে। স্বপ্ন নিকেতনের ঠিকানা জানিয়ে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় ইফতেখার। তাকে রিসিভ করতে বাইরে যায় শ্রাবণ। দেখা পেতেই ইফতেখার জানতে চায়,
“বৃদ্ধাশ্রমে তোমার কি?”
“এখানে আমি একসময় চাকরি করতাম।”
“ওহ্। কিন্তু..”
“কিন্তু জানাতেই আপনাকে এনেছি। আসুন। সব কিন্তুই জানাবো।”
ইফতেখারকে আর বলতে না দিয়ে সাথে নিয়ে যায় ভেতরে। হাজির হয় ফাতিহার সামনে। ফাতিহা হাতে কমলালেবুর এক খণ্ড নিয়ে বসে আছেন। তাদের দেখেই তাকিয়ে থাকেন অচেনা ইফতেখারের মুখে। পরিচয় করিয়ে দিতে ইফতেখারের উদ্দেশ্যে শ্রাবণ বলে,
“ইনি আমার আম্মা। উনাকে দেখার জন্যই আমি এখানে এসেছি। আপনাকেও দেখা করতে ডেকেছি।”
ইফতেখার একটু বিব্রত হয় তার কেমন আম্মা, তা না জেনে। অধিকাংশ নিশ্চয়তা, তার জন্মদাত্রী নন। চেহারায় তো মিল নেইই, তারউপর তার আম্মা কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে যাবে! এমনি কোনোভাবে ডাকে, ভেবে নিয়েছে। সামনে উপস্থিত থাকায় শ্রাবণকে প্রশ্ন করেও নিশ্চিত হতে পারে না। পরিচিত হওয়া সাপেক্ষে সংশয়ে থেকেই সে ফাতিহাকে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন আপনি?”
ফাতিহা ভাবুক বেশে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে হালকা করে মাথা নাড়ে যে, সে ভালো আছে। অথচ চেহারাতেই স্পষ্ট, সে খুবই অসুস্থ। তার জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে এদিকে শ্রাবণ বলে,
“একটা সম্বোধন তো সাথে করতেই পারেন। আমার যেহেতু আম্মা, আপনিও আম্মা ডাকতে পারেন।”
কথার সাথে শ্রাবণের ঠোঁট কার্ণিশে যেমন হাসি স্পষ্ট হয়েছে, ইফতেখারও সৌজন্যতায় হেসে আবার বলে,
“আপনি সত্যিই ভালো আছেন, আম্মা? আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না যে, ভালো আছেন।”
শ্রাবণের মুখের হাসি এবার সন্তুষ্টির সাথে প্রস্ফুটিত হয়। মায়াময় দৃষ্টিতে তাকায় ফাতিহার মুখে। তাদের দুষ্টুমিতে এবার ফাতিহাও মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেন। কথা বলতে চেষ্টা করেন কাঁপা গলায়।
“এই বয়সে আর ভালো থাকা!”
শ্রাবণ ইফতেখারকে প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দিয়ে নিজে বসে ফাতিহার কাছে। ফাতিহার প্রত্যুত্তর করে,
“বয়স কিন্তু তেমন হয়নি, আম্মা। মনের দিক থেকেই আপনি দুর্বল হয়ে পড়েন।”
ফাতিহা বিড়বিড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কে এইডা?”
“কেন? আমার সুখের নাগর। যার কাছে আমাকে সুখের রানি হয়ে থাকতে বলতেন।”