শ্রাবণধারা পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
192

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“আপনার বোনটাও আপনার মতোই সুন্দর। দেখতে পেলাম, মাস খানেক আগে।”
সাথে সাথেই পিছু ফিরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় শ্রাবণ। অপু বুঝতে পারে, বোনের উপরও নজর পড়েছে জেনে শ্রাবণ আরও একধাপ বেশি ক্ষেপেছে তার উপর। তার এই ক্ষেপে যাওয়াও যেন আরও উদগ্রীব করে তোলে তাকে। ঠোঁটের বাঁকে হাসি সুস্পষ্ট রেখেই সে বলে,
“আপনি নাহয় ভাবিই রইলেন। উনি তবে আমার বেয়াইন। ভালোই। সুন্দর সম্পর্ক এনে দিয়েছে আমার ভাই। হুবহু আপনার কপিই যেন। চেহারা দেখেই বুঝতে দেরি হয়নি আপনার বোন যে।”
শ্রাবণ যানচলাচলের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে মসজিদে যাওয়া সব পুরুষই একে একে বাড়ি প্রবেশ করছে৷ ইফতেখারের মাথাটাও যেন দেখা গেছে। তাই দ্রুতই দূরত্বে চলে যাওয়ার জন্য শক্ত চাপা কণ্ঠে বলে,
“রাস্তায় দশের সামনে জুতা পেটার কথা ভুলে গিয়েছিস বুঝি? তবুও সাবধান ছাড়া তোকে কিছু বলার নেই আমার আপাতত। কাপুরুষের পরিণতি কখনো ভালো হতে দেখিনি। অন্য নারীকে দেখার আগে তোর বোনকে দেখিস। তোর মাকে দেখে নিস একবার। এরপরও যদি নারীতে সম্মান উঠে না আসে, গলায় ফা*স পেতে ম*রে যা। এতেই পৃথিবীর ভালো।”
ওই চোখে মুখের ক্ষিপ্ততা ও মা বোন সম্পর্কিত বাক্য যেন এবার কিছুটা দমিয়ে দিয়েছে অপুর চোখমুখ। দুষ্টু হাসি নিভে এসেছে। সেসব দেখতে দাঁড়িয়ে নেই শ্রাবণ। ইফতেখার রাস্তা থেকে বাড়ি প্রবেশ কালেই দেখেছে শ্রাবণকে ক্ষিপ্ত চোখে কিছু বলতে। অপুর মুখভঙ্গিও নজর এড়ায়নি। সে দেখতে দেখতেই এ পর্যন্ত এলো৷ এদিকে অপু কাজে ব্যস্ত হলো। অপু কিছু বলেছে, সেই সন্দেহ নিয়ে সে বড় মামার ঘরের দিকে গেলো। পারভীন এখানেই বসে আলাপ করছিলো অপুর খালার সাথে। এই মাত্রই জানেন, কনেকে রেখে যাবে না শ্বশুর বাড়ির লোক। প্রথমে শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখার সিন্ধান্ত নেওয়া হলেও দুদিন আগে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের কার্যক্রম আজই সম্পূর্ণ করে নিবেন তারা। তা-ই আয়োজনের পরিধিও কিছু বাড়িয়ে নিয়েছে তার ভাই। শ্রাবণ এসে দাঁড়িয়েছে পারভীনের পাশে। পরপরই আবার ইফতেখার এলো। তাকে দেখতেই পারভীন বললো,
“খেতে বসে যা সব নিয়া। অর্পা কই?”
“জানি না। আমি মসজিদ থেকে এলাম মাত্র।”
“তোর আব্বা আসেনি?”
“আসছে।”
“আয় দেখি।”
উঠে চলে যায় পারভীন। পিছু পিছু যায় শ্রাবণ আর ইফতেখার। পরীকে দেখেই তাকে দিয়ে অর্পাকে ডাকায়। পরক্ষণে পুরো পরিবারই একত্রে খেতে বসে। অপু এসেছিলো তাদের টেবিলের খাবার দাবার এগিয়ে দিতে। প্লেটে প্লেটে তুলে দিতে। ইফতেখার বাঁধা দিয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে গেছে প্লেটে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য।
“তোর দিতে হবে না। আমরাই নিয়ে নিতে পারবো। তুই যা।”
অপু বাধ্য হয় চলে যেতে। যেতে যেতে শ্রাবণের দিকে একবার দেখতে ভুলে না। কিন্তু শ্রাবণ তাকে রীতিমতোই উপেক্ষা করে গেছে। কথায় মজেছে পরীর সাথে। পরী জানাচ্ছিলো, তাদের বাড়ি এখান থেকে কতটা দুরত্বে। সেসব শুনতেই মনোযোগ দিয়েছে সে। বরাবরই কোনো আয়োজনে স্ব পরিবারে গেলে, খেতে বসতে বিপু একপাশে থাকে। অন্যপাশে থাকে ইফতেখার। পরিবারের প্লেটে ডিশ থেকে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব দুই ভাই করে নেয়। এখনো তার ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রাবণ ইফতেখারের পাশেই বসেছিলো। শ্রাবণের অন্যপাশে পরী। প্লেটে খাবার দিয়েই ইফতেখার তার উদ্দেশ্যে বলে,
“বাড়ি গিয়ে কথা বলো। খাও এবার।”
কিছুটা লজ্জাবোধ করে মুচকি হাসে শ্রাবণ। আসলেই বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে এই পরীর সাথে মজতে গিয়ে।
খাওয়ার পরপরই একটু বিশ্রামের জন্য পারভীনের সাথে আবার বড় মামাদের ঘরে চলে আসে শ্রাবণ। ইফতেখার পিছু হতে বলে দিলো,
“মায়ের সাথে সাথেই থেকো।”
শ্রাবণ একটু শঙ্কা নিয়েই তাকালো তার দিকে৷ পরক্ষণেই মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে চলে গেলো। ভাবছে, সে দেখে ফেলেছে কি না তখন অপুর সাথে কথা বলতে? এমনই তো মনে হচ্ছে।
বরযাত্রী আসতেও সময় নেয়নি খুব একটা। তাদের আত্মীয়স্বজনও বিদায় নিচ্ছে ধীরে ধীরে। এদিকে পারভীনও চেয়েছিলো চলে যাবে। মেজ ভাইয়ের বউ, শেফালী ধরে বসলো মেয়ে বিদায় দিয়ে যেন যায়। ওদিকে আফজাল হোসেনও দেখলো যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে না। আলাপে জমেছে চাচাতো ভাইয়ের সাথে। তাই সে-ও তাড়া নিয়ে ছুটছে না। শ্রাবণ কিছুক্ষণ তার কাছেই বসে ছিলো৷ পরক্ষণে চলে গেছে বাইরে। এদিকে আসরের পরপর কনে বিদায় হয়ে যায়। কান্নাকাটির ছোটখাটো এক রোল উঠে বিদায়ী পরিবেশে। তার পরপরই বাড়ি যাওয়ার তাড়া পড়ে তাদেরও। অর্পাকে ডেকে নিলো এক দিক থেকে, পরীকে ডেকে নিলো আরেক দিক থেকে। কিন্তু শ্রাবণকে পাওয়া গেলো না কোনোদিকেই! সে আবার কোথায় গেলো? পরীকে দিয়ে এঘর, ওঘর খোঁজ করায়। কারো সাথে বসে আবার আলাপ করছে নাকি। কিন্তু, কোনোদিকে নেই সে! ইফতেখারের মুখখানা মুহুর্তেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। পারভীনকে জিজ্ঞেস করে,
“মা, তোমার সাথেই না ছিলো তখন?”
“সে তো সেই কখনই বেরিয়ে এসেছে।”
“আমি তো তাকে বাইরেও বের হতে দেখলাম না!”
ইফতেখার শ্রাবণের ফোনে ডায়াল করে। ফোন বন্ধ! চিন্তা আরও বেড়ে যায়। পারভীন বলে,
“বাড়ি গেলো কি না আবার? মেয়ের সাহস দেখলে বাঁচিনা! কোথাও যাওয়ার হলে বলে যাইবো না? মানুষ কি এমনি এমনি খুঁজে পাওয়া যায়!”
বলতে বলতে তিনি নিজেই আবার ভাইদের ঘর ঘুরে এলেন। বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের টিন চালার ঘর। মেজ ভাইয়ের ছাদ ওয়ালা ঘর খুঁজে আসে। নেই কোথাও৷ বাইরে এসেই বলে,
“কই, নাই তো কোথাও।”
পরী বলে,
“আবার বরযাত্রীর সঙ্গে সাথী আপুর শ্বশুর বাড়ি চলে গেলো নাকি!”
তার মস্করায় অর্পা ব্যতীত কেউই কান দেয় না। অর্পা মুখ টিপে কিঞ্চিৎ হাসলো শুধু। এদিকে পারভীন চিন্তিত ইফতেখারকে বলে,
“দ্যাখ আবার বিপুর সাথে বাড়ি গেছে কি না। চাবিও তো নিলো না।”
“বিপুকে তো একাই যেতে দেখলাম। আর সে গেলে, আমাকে বলে যাবে না!”
বলতে বলতেই চিন্তিত হয়ে ডায়াল করে বিপুর ফোনেই।
“কোথায় তুই?”
“বাজারের দিকে আছি।”
“শ্রাবণ তোর সাথে গেছে?”
“আমার সাথে? আমার সাথে কোথায় আসবে?”
“আমরা বাড়ি যাবো। তাকে পাচ্ছি না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তোর সাথে গেছে কি না বাড়িতে।”
“না তো। এখনো রওনা হওনি তোমরা!”
“না। রওনা দিবো। দ্যাখ তো একটু বাড়ি গিয়ে, সে গেছে কি না।”
“আচ্ছা, দেখছি।”
“এখনই যা। আর আমাকে শীঘ্রই জানা।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে দেয় ইফতেখার। পরীকে আবার পাঠায় প্রতি ঘরে খুঁজতে। একা কেন চলে যাবে শ্রাবণ? চাবিও নেয়নি। যাওয়ার হলে অবশ্যই তাকে জানিয়ে যেতো, তার ধারণা। বার দুয়েক খোঁজ করায় মামাবাড়ির কেউ কেউ জেনে গেছে শ্রাবণকে পাচ্ছে না তারা। তাই ওঘরের মানুষ এঘরে আবার এঘরের মানুষ পাশের ঘরে গিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ বলে, তখন তো পারভীনের সাথেই বসে থাকতে দেখলো! কেউ বলে, তখন না উঠুনেই দেখলো! কেউ মস্করায় বলে,
“দিপুর সুন্দরী বউয়ের উপর আবার কার নজর লাগলো!”
আর এই মস্করাপূর্ণ বাক্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ইফতেখারের মধ্যে ক্রোধের জন্ম দিলো তাৎক্ষণিক। ডানে বামে তাকিয়ে কারো তালাস করে রগরগে চোখে। মেজ মামার ঘরের দিকে তাকাতেই জানালা দিয়ে অপুকে দেখতে পায় সে। এদিকে আফজাল হোসেন বলে,
“বাড়িতেই চলে গেছে হয়তো কোনো কারণে। আয়, বাড়ি গিয়ে দ্যাখ আগে।”
কিন্তু, ইফতেখার রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত না হয়ে পা বাড়িয়েছে অপুদের ঘরের দিকে। নতুন পোশাক পাল্টে নেওয়ার জন্য আলমারি খুলেছিলো অপু। পায়ের শব্দ পেয়েই প্রবেশকালে পিছু ঘুরে তাকিয়েছে সে। হনহন পায়ে ইফতেখার এসে দাঁড়িয়েছে অপুর কাছে। প্রথমত নিজেকে শান্ত রেখেই শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“শ্রাবণ কোথায়?”
সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে আসে অপুর। যেন কিছুই জানে না, অদ্ভুত কিছু শুনলো হঠাৎ। এমন একটা ভঙ্গিমা প্রকাশ পায় তার মুখাবয়বে। যা ক্রমশই রাগিয়ে দেয় ইফতেখারকে। আর তাই সাথে সাথেই তার পাঞ্জাবির কলার পাঁকড়ে ধরে দুই হাতে। চোখের শিরা হয়ে উঠে রক্তিম! গলার ক্রুদ্ধ স্বর হয়ে আসে উচ্চ!
“শুনতে পাসনি আমার কথা? শ্রাবণ কোথায়?”
তাকে কলার পাঁকড়ে ধরতে দেখে বাইরে থেকে হুড়হুড় করে সব চিৎকার সহিত ছুটে গেলো ঘরে। অপু তার এমন আচরণের কারণে পাল্টা ক্ষিপ্ত হয়েছে। দুহাতে শক্ত করে ধরে টেনে ছাড়াতে চাইছে ইফতেখারের হাত। তার জবাবের গলাও উঁচু হয়েছে।
“শ্রাবণ কোথায়, তা আমি জানি? আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“তুই জানিস না? শ্রাবণকে কি বলেছিলি দুপুরে?”
অপু চোয়াল শক্ত করে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরায়। সাথে সাথেই এক ঘুষি দিয়ে বসে ইফতেখার।
“শ্রাবণ কোথায়, বল!”
যদিও ততক্ষণে বাইরের লোকজন এসে তাকে টানতে শুরু করেছিলো, কিন্তু সরে আসার আগে মাইর একটা দিয়েই নিলো। অপু ক্ষেপে নিজেও আসছিলো তাকে আঘাত করতে। কিন্তু তাকেও বিপরীতে টেনে ধরে রেখেছে পরিজনরা। মায়েদের এদিকে কান্না করার অবস্থা! পারভীন ছেলেকে ঝাপটে পিছু সরাতে সরাতে বললো,
“কী শুরু করলি, ইফতি! এইসব কী শুরু করলি তোরা!”
ইফতেখার তাদের কোনো জবাব দেয় না। তীক্ষ্ণ রক্তিম চোখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়েই থাকে অপুর দিকে। মামারা সহ আফজাল হোসেন এসে উপস্থিত হয়েছেন ততক্ষণে। ছেলের আচরণে নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছেন। তাই ছোটখাটো একটা ধমক দিলেন ছেলেকে,
“কী হচ্ছে এইসব! ওরে মারতে গেলি ক্যা?”
ক্রোধে কাঁপা কণ্ঠে ইফতেখার অপুর দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়ই বলে,
“সে জানে, শ্রাবণ কোথায়।”
ওদিকে অপু পাল্টা বিক্ষোভ করে,
“আমি ক্যামনে জানমু তার বউয়ের খবর! আমি কি তার খবর নিয়ে ঘুরি?”
ক্ষিপ্ত ইফতেখার সাথে সাথেই জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, তুই ঘুরছ!”
আফজাল হোসেন আবার ধমক দেয়।
“এই, থাম। মেজাজ ঠান্ডা কর। আমার সাথে কথা বল। সে জানবো ক্যামনে শ্রাবণের ব্যাপার? শ্রাবণ কি তার কাছে বলে যাইবো?”
“বলে যাবে না, আব্বা। কিন্তু আমার সন্দেহ তার জন্য শ্রাবণ নিখোঁজ।”
এমনি ফোন বাজে তার। বিপু কল করেছে। রিসিভ করতেই জানায়, শ্রাবণ বাড়িতে নেই। বকুল কাকার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলো, তিনিও দেখেননি তাকে আসতে। ইফতেখার ফোন রেখে পিতাকে বলে,
“দেখছেন? যায়নি বাড়ি। সে শ্রাবণকে চিনতো অনেক আগে থেকেই। বদমাশি করে বেড়ায় শহরে। শ্রাবণের পিছুও ঘুরছে। আজ দুপুরেও শ্রাবণকে কী যেন বলছে। আব্বা, আমি নিশ্চিত সে জানে।”
“চুপ থাক।”
শান্ত গলায় তাকে থামতে বলে। ওদিকে মেজ মামা অপুকে জিজ্ঞেস করে,
“কী রে? কী কয় এগুলা?”
অপু জবাব দেয় না। খিটখিটে মেজাজে শুধু ইফতেখারকে দেখে। মেজ মামা বাহুতে ঠুকে বলে,
“কথা কছ না ক্যা?”
উঁচু স্বরে অপু বলে,
“তার বউয়ের সাথে আমি কীসের কথা বলমু! সে জানে, আমি বদমাশি করছি? দেখছে কোনোদিন? প্রমাণ দেক তবে!”
এদিকে আফজাল হোসেন তার উদ্দেশ্যে বলে,
“থামো। শান্ত হও। আমি তোমারে একবার জিগাই, তুমি জানো শ্রাবণ কোথায় আছে?”
“না।”
পরক্ষণে ইফতেখারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“সে বলছে যখন জানে না, আর কোনো কথা নাই। সন্দেহ দিয়া সব সত্য হয় না। যা।”
ইফতেখার যাওয়ার আগে রগরগে চোখে আবারও অপুর দিকে তাকিয়ে বলে যায়,
“তুই জানোস না, না? সবার সামনে এখন বলে যাই; যদি শ্রাবণের কিছু হয় আর ঘটনার পিছু তোর হাত থাকে, তোকে আমি নাজেহাল করে ছাড়বো।”
হনহনিয়ে বেরিয়ে গেছে ইফতেখার। পিছু পিছু গেছে তার পরিবার। আফজাল হোসেন এদিকে পারভীনের মেজ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেলো,
“কিছু মনে করবেন না। তাগো মনের ভেতরে কী আছে, তারাই ভালো জানে। আমি ইফতিরে সাবধান করবো। শ্রাবণের খোঁজটা নিয়ে নেই আগে।”
তিনিও প্রত্যুত্তরে বলেন,
“আমারও তো মাথায় ধরতাছে না। কীসের মধ্যে কী হইয়া গেলো!”
“হুম, পরে কথা বলমু নে। আসি।”
বিদায় নিয়ে চলে যায় আফজাল হোসেন। এদিকে যান চলাচলের রাস্তায় এসে রিকশা ঠিক করে নেয় ইফতেখার। বাবা মাকে এক রিকশায় তুলে অর্পা ও পরীর সাথে অন্য রিকশায় উঠে বসে সে। ইচ্ছে করছে না এই বাড়ি ছেড়ে যেতে। কেন মনে হয়, শ্রাবণ এখানেই আছে! সে ভুল করছে না তো, এই বাড়ির সীমানা ছেড়ে গিয়ে? মনে মনে আল্লাহকে ডাকে সহায় হওয়ার জন্য। শ্রাবণকে যেন বাড়ি গিয়েই পেয়ে যায়। মনের সন্দেহ যেন ভুল হয়! মন্দভয় যেন দূর হয়!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণকে আর পাওয়াই গেলো না এই দিন। ইফতেখার কল করতে করতে ক্লান্ত। প্রতিবারই ফোন বন্ধ! কান্তাদের বাড়ি গিয়ে নিজে দেখে এলো, সেখানেও নেই। মন বলে আবার মামাবাড়ি যেতে। অপুকে আরও কিছু ধাওয়া করে কথা টেনে বের করতে। কিন্তু সম্ভব হয় না আত্মসম্মানেরও ভয়ে। বাবা তো হটিয়ে নিয়ে এলো। মা তো বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, আগেও কোনোদিন জানিয়ে যায়নি কোথাও। নির্ঘাত আজও কোথাও গেছে। টেনশনে না মারলে চলে না তার। মায়ের মুখে এতোসব শুনেও কিছু বলতে পারে না ইফতেখার। তার এখন শ্রাবণের খোঁজ দরকার। দুহাতে মাথা চেপে ধরে মনের ভয়ে হৃদয় আঙিনায় আর্তনাদ করে,
“শ্রাবণ, তুমি কোথায়? একটু সাড়া দাও। টেনশনমুক্ত করো।”
পরক্ষণেই এই সন্ধ্যা পথ কাটিয়ে সে মোটরসাইকেলে করে শহরে আসে। সাথে বিপু এসেছে। বিপু নিজেই ড্রাইভ করে এনেছে তাকে। দুশ্চিন্তায় ইফতেখার বড্ড উত্তেজিত হয়ে আছে। মামাবাড়ির ঘটনা জেনেও সে তব্দা খেয়ে আছে। এমন একটা দিনে ভাই এমনটা কেন ঘটিয়ে এলো! আর ভাবিই কোথায় গেলো!
মোটরসাইকেল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছেছে স্বপ্ন নিকেতনে। ইফতেখার বিপুকে রেখেই গেইট খোলা পেয়ে দ্রুতপায়ে পৌঁছেছে ভেতরে৷ দারোয়ান ডাকছিলো পেছনে, সে শুনেনি। এদিকে দারোয়ানকে থামিয়ে দিয়েছে বিপু। সে সামলে নিচ্ছে তাদের জরুরী প্রয়োজনের কারণ। তাদের পরিচিত একজন থাকে এখানে, অবস্থা সম্ভবত খারাপ। তাই ছুটে আসা। অথচ এদিকে সত্যিই যে ফাতিহার অবস্থা খারাপ, তা জানে না তারা। দারোয়ানের কাছে সেটা ছিলো বিপুর এক বানানো গল্প। ইফতেখার ভেতরে এসে ফাতিহাকে দেখতে পায় বাস্তব দুরুহ অবস্থায়! শোয়া থেকে উঠতেই পারে না। গোঙাচ্ছে শুয়ে শুয়ে। পাশেই একজন মহিলা তার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। হাত ঘষে ঘষে তালুতে মালিশ করছে। শ্রাবণের কথা আর জিজ্ঞেস করবে কী তার কাছে! সে এগিয়ে এসে ফাতিহার গালে হাত রাখে। জ্বর আছে শরীরে। পাশে বসে সে ডাকে তাকে,
“আম্মা! আম্মা।”
দ্বিতীয় ডাকের পর চোখ খুলতে সক্ষম হয় ফাতিহা। ইফতেখারের মুখটা দেখতেই চোখের দুই ধারে গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা অশ্রু। ইফতেখার পাশের মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করে,
“উনার জ্বর কবে থেকে?”
“কাল থেকে।”
“ডাক্তার দেখানো হয়েছে? ওষুধ দিয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
সে পুনরায় ফাতিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মা, আপনার খুব বেশি খারাপ লাগছে?”
চোখের পাতা বন্ধ করে হালকা করে মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে ফাতিহা। বুঝাতে চায়, তার খারাপ লাগছে না। অথচ চোখের সামনেই ইফতেখার দেখতে পাচ্ছে, তার করুণ অবস্থা! এ অবস্থায় সে শ্রাবণের কথা কীভাবে জিজ্ঞেস করবে, তা নিয়ে যত দ্বিধা। মিনিটখানেক চুপ করে বসে ছিলো ইফতেখার। ফাতিহা তাকে দেখে চোখ বুজে আর খুলে। হঠাৎ দরজার দিকেও চোখ যায়। বিপুকেও দেখতে পায় আজ প্রথমবারের মতো। চিনে না সে তাকে। কিন্তু চেহারায় ইফতেখারের মিল খুঁজে পায় কিঞ্চিৎ। অর্থাৎ আফজাল হোসেনের গঠন প্রায় দুই ছেলেরই। তাই তার মনের সন্দেহ, এ-ই ছোট ছেলে। বিপু নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ফাতিহার দিকে। পরক্ষণে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। তবুও তাকিয়েই থাকে। ফাতিহাও দেখে তাকে। দৃষ্টিতে মায়া বাঁধে। ইচ্ছে হয়, দুই হাত দুই ছেলের মাথায় তুলে একটু আদর করে দিতে। অথচ সামর্থ্যে কুলায় না। ইফতেখারই এদিকে তার মাথায় হাত দিয়ে ফেলেছে। সাথে সাথেই পরম আবেশে চোখ বুজে নিয়েছে ফাতিহা। ভেতর বাহির অসুস্থতায় কাতরাতে থাকলেও এই পরশ যেন তার এক রাশ শান্তির কারণ। মনটা প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেছে নির্ভরযোগ্য এক হাত মাথায় উঠায়। ইফতেখার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু খাবেন, আম্মা?”
“না রে, বাবা।”
ভেজা ও ভাঙা গলায় উত্তর দেয় ফাতিহা। তার কণ্ঠও যেন অসুস্থতার প্রকোপে কাঁপছে। অশ্রুপাত হয় চোখের দুই ধারে। ইফতেখার দ্বিধান্বিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ এসেছিলো, আম্মা?”
“হু।”
“আজকে?”
চোখের পলকে সায় দেয় ফাতিহা। মনের উত্তেজনা বেড়ে যায় ইফতেখারের। সে আরও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জিজ্ঞাসা চালিয়ে যায়,
“কখন গেছে? সে তো বাড়ি যায়নি এখন পর্যন্ত।”
“যায়নি?”
“না। দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো তার জন্য, জানেন? আমাকে পর্যন্ত জানিয়ে আসেনি এখানে আসবে যে। অনেক্ক্ষণ আগে কি বেরিয়েছে?”
“হু।”
ইফতেখার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয় দুশ্চিন্তায়। চিন্তামগ্ন থেকেই বলে,
“কোথায় গেছে তবে! কোথায় খুঁজি এখন তাকে!”
ওদিকে কাঁপা গলায় ফাতিহা বলে দেয়,
“তার বাড়িতে গেছিলা? মায়ের সঙ্গে দেখা না কইরা তো যায় না।”
কথা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে যায় যেন ইফতেখার! মা! বাড়ি! তাকে তো এসব সম্পর্কে কোনোদিন বলেনি! কত স্কুল কলেজের গল্প হলো, নানাবাড়ির গল্প হলো। নিজ বাড়ি কিংবা মা নিয়ে তো কোনোদিন বলেনি! সে তো জানতো তার বাবা মা নেই। এমনকি বাবার মৃত্যুর পর কতটা কষ্টকর হয়ে উঠেছিলো তার একাকী জীবন সেই গল্পও শুনেছে। তবে কি এসব বানোয়াট ছিলো?
বুকের ভেতর এক পিন্ড ব্যথার সৃষ্টি হয় সাথে সাথেই। ব্যথিত দৃষ্টিতেই সে পুনরায় তাকায় ফাতিহার দিকে। বিপুও কেমন সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ফাতিহার দিকে। কি বললেন তিনি, মাথার উপর দিয়ে গেলো যেন! ইফতেখার উঠে দাঁড়ায় পরপরই। মলিন কণ্ঠে বলে,
“আমি আসছি, আম্মা। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। খাবার, ওষুধ ঠিকমতো খাবেন। আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।”
বিপু নিশ্চুপেই পিছু পিছু চলে। চলার আগে আরও একবার ফাতিহার মুখটা মনোযোগে দেখে নিতে ভুলেনি। তবুও বলা হলো না কিছু। কি বলবে, ভেবেও পেলো না। কিন্তু কেমন অদ্ভুত মায়া কাটছিলো সেই অসুস্থ মুখে। কেমন করে তিনি সিক্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলেন তাদের দিকে। ভাইয়ের পিছু পিছু স্বপ্ন নিকেতন ছাড়তে ছাড়তেই বিপু জিজ্ঞেস করে,
“ভাই, উনি কার কথা বললেন? ভাবির পরিবার আছে?”
হনহন পায়ে চলতে চলতে থমথমে গলায় ইফতেখার প্রত্যুত্তরে বলে,
“জানি না।”
“তবে কোন বাড়ি যাওয়ার কথা বললেন?”
“আমি জানি না। ওর সম্পর্কে আর কিছুই জিজ্ঞেস করিস না। বাড়ি চল।”
দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করে ইফতেখার। ক্রমশই রাগান্বিত হয়ে পড়েছে শ্রাবণের উপর। সব কিছুরই সীমা ছাড়িয়ে গেছে যেন শ্রাবণ। যেই মনে এক প্রণয় প্রাসাদ গড়ে যাচ্ছিলো এতোদিন যাবত, সেই মনে বড্ড বিরক্তি জন্মেছে আজ তারই বিরুদ্ধে। প্রণয়ের প্রতিদানও যেন দারুণভাবেই নিদারুণ করে গেছে তার পছন্দের শ্রাবণ!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৫
(নূর নাফিসা)
.
.
সারারাত ঘুম হলো না। মাথায় জটলা জ্যাম পাকিয়ে রেখেছে শ্রাবণ। কখনো দুশ্চিন্তা, কখনো রাগে ফাটছে ইফতেখার। এ-ই মনে হয়, সামনে পেলে মেরে ফেলবে৷ আবার এ-ই মনে হয় কোনো বিপদ হলো। ওদিকে পারভীনের মাথা নষ্ট শ্রাবণের খোঁজ না পাওয়ায়! বিপু এসে বলতেই হায় হুতাশ শুরু করেছে সে, তার গহনাগাঁটি সব নিয়ে পালিয়েছে৷ যতসব ধান্ধা নিয়ে বাড়ি এসেছে। ছেলেকে সরল পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে। এবার সুযোগে সব লুট করেছে। সংসারেও সৃষ্টি করে গেছে একের পর এক ভয়ানক অশান্তি। তার যত্নে গড়া গহনা, সাধের সংসার সুখ! হায়! হায়!
নির্ঘুম, নিস্তব্ধ মুখাবয়ব নিয়ে সকালেই বেরিয়ে যায় ইফতেখার। তখনও মায়ের কণ্ঠ শুনে আসে। বাবার সাথেই হয়তো রাগারাগি করছেন, এখনো পুলিশে জানাচ্ছেন না কেন। আর এসবে মাতামাতি করতে দেখে ইফতেখার তার মায়ের উপরও বিরক্ত। তার এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয় না শ্রাবণ গহনাগাঁটি নিয়ে পালিয়েছে। অথচ সে-ও জানে, শ্রাবণের অঙ্গ জড়ানো ছিলো মায়ের গহনায়! কিন্তু তার মনের যত চাপ শ্রাবণ হারানোর ভয়! এই ভয় হতে সে বিন্দুমাত্র সরতে পারছে না। “শ্রাবণ ঠিক আছে তো?” এই একটা বাক্য যখনই নাড়া দেয় মনে, তখনই ছুটতে পাগল হয়ে উঠে। এই সকালে আবারও নাড়া দিতেই দুয়ার খুলে বেরিয়ে গেলো। না খাওয়ার মনোযোগ, আর না নির্ঘুম চোখের মায়া! সবই শ্রাবণ নিমিত্তে উপেক্ষা। একা একাই ছুটেছে এবার শ্রাবণ সন্ধানে, আবারও ইট পাথরের শহরে।
স্বপ্ন নিকেতনের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ যেন শ্রাবণকে দেখতে পায় পথে চলতে। মোটরসাইকেলটা যতটুকু সম্ভব, দ্রুত থামিয়ে নেয় ইফতেখার। মনের উত্তেজনায় দ্রুত পিছু ডেকে উঠে,
“শ্রাবণ!”
মেয়েটা ভ্রু হালকা কুঁচকে পিছু দেখতেই উত্তেজনায় ধোঁকা খেয়ে বসে ইফতেখার! একটু বোকার মতো হয়ে বলে,
“স্যরি।”
শব্দটা মেয়েটির কান পর্যন্তও হয়তো পৌঁছায়নি। কিন্তু তার উত্তেজিত অবস্থার দিকে কেমন তাকিয়ে রইলো হাঁটতে মনোযোগী হওয়া পর্যন্ত। এদিকে ইফতেখারও কিছুটা ভাবুক বেশে বসে রইলো মোটরসাইকেল একদিকে চাপিয়ে। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে তার। মনের ক্লান্তি, দেহের ক্লান্তি উভয়ে মিলে ধরেছে তাকে। মেয়েটার যাওয়ার দিকেও তাকিয়ে ছিলো দ্বিতীয়বার। কেন সে শ্রাবণই হলো না? একটা মানুষকে কি এভাবে খুঁজে বের করা যায়? কোনো চেনা নেই, জানা নেই, প্রকাশিত কোনো তথ্য নেই। কোথায় খুঁজবে তবে তাকে?

ছোট্ট বারান্দায় একটা টুলের উপর পা গুটিয়ে বসে আছে শ্রাবণ। মন মলিন রেখে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। কখনো হর্নের শব্দ মনোযোগ টেনে নিচ্ছে নিচের যান চলাচলের পথে। কখনো আকাশের বিশালতা নজর আঁকড়ে ধরছে পাখির ডানা ঝাপটানো দেখতে। কখনো বা পাশের বাড়ির মুখোমুখি বারান্দাটা নজরে পড়ে। বয়স্ক দুজন নারী পুরুষকে প্রায়ই দেখা যায় এই বারান্দায়। আরও সদস্য থাকে এই ফ্ল্যাটে। একটা বাচ্চাও সাথে দেখা যায় মাঝে মাঝে। হয়তোবা ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনী নিয়েই এখানে থাকছেন অবসরপ্রাপ্ত এই দম্পতি। কী সুখী সুখী একটা ভাব তাদের মধ্যে। কিন্তু এই বারান্দাটায় জোড়া চড়ুইয়ের মতো বুড়ো বুড়িকেই দেখতেই পাওয়া যায় বেশি। অবসর কাটানোর স্থল এই বারান্দা। একে অপরের সাথে ঝগড়া করার এই বারান্দা। খোশগল্পের বৃক্ষ বুনন কেন্দ্র এই বারান্দা। ছোট্ট নাতনীর সাথে খেলা করার জায়গা এই বারান্দা। ওপারের নগরে তাদের ঠিক সুখী একটা পরিবার মনে হয় এপার থেকে দেখে। এখনো বসে দুজন গল্প করছেন৷ বৃদ্ধ হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছেন, কিছু হয়তো বুঝাচ্ছেন সঙ্গিনীকে। সঙ্গিনীও মনোযোগে তার মুখে তাকিয়ে কথা শুনছেন। কী দারুণ দেখতে এই মুহূর্ত! এই দৃশ্যে মনোযোগ দেওয়ায় মলিন মুখেও কিঞ্চিৎ হাসি ভেসে উঠে শ্রাবণের ঠোঁট কার্ণিশে। মনে হয়, এইতো সে আর তার বুড়ো ইফতেখার বসা পাশে। কী খোশগল্প হচ্ছে তাদের মাঝে! অথচ এমন মুহুর্ত খুবই কম এসেছে তাদের এই কয়েক দিনের জীবনে। কেমন আছে লোকটা? যোগাযোগ হচ্ছে না পর্যন্ত! অথচ যোগাযোগ করতেও যত সংশয়! কী ভাবছেন তার সম্পর্কে? মন্দ কিছু? নিশ্চয়ই তা-ই। মন্দই তো করে এলো। তবে ভাবতে আর অন্যায় কী?
চোখটা হালকা ভিজে আসে। বুকের ভেতর থেকে নির্গত হয় দীর্ঘ নিশ্বাস। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে একদমই অকেজো হয়ে গেছে। সিমও এক্টিভ করা হয়নি। এদিকে মা-ও তাকে জঘন্যরকমভাবে আটকে দিয়েছেন। এতোটা কঠোর হয়ে উঠবে পরিস্থিতিটা, ভাবতে পারেনি সে। আফজাল হোসেনের বাড়ি গিয়েছে শুনেই মেয়ের উপর ভীষণ রেগে গেছেন সুলতানা। সন্তানদের বুকে আগলে রেখে বেঁচে আছেন তিনি এই ধরণীতে। বাবা নেই তাই নিজ দায়িত্বে দাঁড়িয়ে উঠার সাহস তিনি আরও বহু আগে থেকেই দিয়ে এসেছেন তাদেরকে। শিখিয়েছেন লড়াই করে একা বাঁচতে। একা একা নিজ জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষেত্রেও সবসময় সাপোর্ট দিয়ে এসেছেন। মেয়ে একক সিদ্ধান্তে বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাতেও তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তিনি সবসময় চাইতেন, মেয়ে দুটো যেন নিজের পছন্দের একটা জীবন পায়। পিতৃহীন এই পৃথিবীতে যেন তারা নিজেকে অসহায় মনে না করে। কখনো হঠাৎ তিনি হারিয়ে গেলেও যেন মায়ের অভাবটা তাদের কুড়ে কুড়ে না খায়। তারা যেন নিজের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে ভালো থাকতে পারে, মজবুত থাকতে পারে। সঙ্গী হিসেবেও যেন একজন মনের মানুষ খুঁজে নিতে পারে, রবের নিকট এই দোয়াটাও তিনি সবসময় করে যান। তিনি পছন্দ করে তাদের জন্য কিছু ঠিক করতে গিয়ে যেন তাদের পছন্দের ব্যাঘাত না ঘটান, সেদিকেও তিনি ভীষণ সতর্ক থাকেন। কিন্তু শ্রাবণের প্রতি তবুও তিনি ক্ষুব্ধ। কারণ, সে আফজাল হোসেনের বাড়ি গেছে। অন্য যেকোনো পাত্র সে পছন্দ করলে হয়তো আজ সুলতানা ভীষণ খুশি হতো। ভেবে আনন্দিত হতো, মেয়ের একটা নতুন জীবনের সূচনা হয়েছে। তার মাথা থেকে একটা চাপ কমে এসেছে। অথচ সেই মাথা এখন তপ্ত লাভার মতোই যেন ক্রোধান্বিত! শ্রাবণ বিয়ে করে নিয়েছে, ছোট মেয়ের মুখে তা শুনেই তিন-চারদিন আগে তিনি শ্রাবণকে কল করে নাগাদ বাড়ি আসতে বলেছেন। তার সাথে দেখা করতে বলেছেন যদি সে তাকে কখনো “মা” বলে ডাকতে চায় তো, “মা” বেঁচে আছে মানতে চায় তো। শ্রাবণ তা নিয়েই বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো এখানে আসার আগে। একদিকে ফাতিহার অসুস্থতা, একদিকে সেই পরিবারের অশান্তি। আর এদিকে মায়ের ক্রোধ! সব মিলে দারুণ চাপে ফেলেছিলো তাকে। ভয় হচ্ছিলো মায়ের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ভাবতেই। আর মায়ের কাছে আসবে বলেই ইফতেখারকে পর্যন্ত বলে এলো না, সে শহরে আসবে। ইফতেখারের সাথে ফাতিহাকে দেখতে এলে তার মায়ের সাথেও দেখা করা হবে না। তাই চুপচাপ পালিয়েছিলো। তা-ও গহনাগাঁটি নিয়ে। এই গহনাও ছিলো তার এক অন্যরকম বড় উদ্দেশ্য। যার পিঠে অঙ্কিত বিফল চিত্র!
ফাতিহার এক কল্পগল্প সাজাতে চেয়েছিলো সে এই গহনা দিয়ে। চেয়ারম্যান বাড়ির গহনা। বঞ্চিত ফাতিহার অধিকার। সেই পুরনো কিশোরী ফাতিহার এক টুকরো সাধ। সাধ ছিলো, লাল বেনারসি আর সোনার গহনা অঙ্গে জড়িয়ে সেই চেয়ারম্যান বাড়ি উঠবে নববধূ বেশে। আলতা রাঙা নুপুর পায়ে সারাবাড়ি দৌড়াবে। হলো না সেই সাধের পূর্ণতা পাওয়া। অথচ বধূ সাজের কত শখ মনের কুঠুরিতে বাঁধা ছিলো এতো গুলো বছরের আঁটিতে! তিনি বধূ সাজবেন। সেই সাজটা একটা মূহুর্তের জন্য হলেও নিজ হাতে করে দিতে ছোট্ট একটা পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টায় এই গহনাগাঁটি নিজের অঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলো শ্রাবণ, পারভীনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে। ছুটে এসেছিলো আম্মাকে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য বধূ সাজের বেশে দেখতে। ফাতিহা একদমই ইচ্ছে পোষণ করলো না। ছুঁতেই চাইলো না এসব, মর্মব্যথার কারণে। এসব তিনি একদম চান না। এর সবই নাকি তার অধরা স্বপ্ন ছিলো, যার বাস্তবতার সাধ তার মাঝে আর বেঁচে নেই। অপূর্ণ প্রাপ্তিটুকু আঁকড়ে রেখেই ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি শ্রাবণকে। সেই বাড়ির কিছুই তিনি চান না। এদিকে মায়ের সাথে দেখা করতে এলেই মায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞায় বাঁধা পড়ে গেছে শ্রাবণের। আফজাল হোসেনের বাড়ির সীমানায় ছায়া না ফেলার চরম নিষেধাজ্ঞা সুলতানার! মাকে বুঝানোর চেষ্টা করেও শ্রাবণ পারেনি। প্রকাশ করেও পারেনি একটু বুঝাতে তার উদ্দেশ্যটা। পারেনি তুলে ধরতে ইফতেখারের গুরুত্বটা! আজ আম্মার সাথে দেখা করতে যেতে চাইলো, তাতেও তিনি অনুমতি দিলেন না মেয়েকে। মনমরা হয়ে শ্রাবণ তাই বসে আছে, তার একাকী গড়া বেদনার ঘুড়ি ব্যস্ত শহরের ধূসর আকাশে উড়াতে।

চলবে।