শ্রাবণধারা পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
132

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৯
(নূর নাফিসা)
.
.
ক্ষোভগ্রস্ত দৃষ্টি জোড়া শ্রাবণ থেকে সরিয়ে নিয়েছে ইফতেখার। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে আছে তার। যে মানুষটা বাড়ি নেওয়ার জন্য হুট করেই আপনজনদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করেছিলো, আজ সেই মানুষটাকে যে এভাবে বাড়ি নিতে হবে তা একদম ভাবতে পারেনি। বাবার মুখে মৃত্যু সংবাদ শুনেই হৃদয়টা নিস্তেজ হয়ে গেছে একদম৷ নতুন রঙের সন্ধান দিতে পরিকল্পিত জীবনের রেল লাইনটা যেন হুট করেই বেঁকে গেলো। আর হলো না পাওয়া প্রত্যাশার পূর্ণতা। আর হলো না ফাতিহার শখের সংসারে ফেরা। ইফতেখারের পাশেই একটা চেয়ার পাতানো আছে। যেখানে গম্ভীরমুখে বসে আছে আফজাল হোসেন। দৃষ্টি সম্মুখে ভীড় থাকলেও তার দৃষ্টির মনোযোগ মূলত শূন্যে। ইফতেখার শ্রাবণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর কম্পিত এক নিশ্বাস ফেলে আবারও ম্যানেজারের কাছে যায়, তাদের আবেদনের কী ব্যবস্থা হলো দেখতে। ফাতিহাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক্ক্ষণ যাবতই শুধু আলাপ আলোচনা চলছে তাদের সাথে। বিপু কল করেছে, সে রাস্তায় আছে। আসছে এখানেই। ইফতেখার নিষেধ করে দেয় তাকে। যখন নিশ্চিত অনুমতি পাওয়া হবে কর্তৃপক্ষ হতে, তখন তাকে ওদিকে দাফনের ব্যবস্থাটা করতে হবে। অহেতুক এখানে আসার প্রয়োজন নেই। ওদিকে কর্তৃপক্ষ আফজাল হোসেনকে পুনরায় ডাকায় কথা বলতে। তিনি গম্ভীরমুখে চেয়ার ছেড়ে ধীর পায়ে হেঁটে যান ইফতেখারের ডাকে।
শ্রাবণ শোকে কাতর হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ফাতিহার শিয়রে। হঠাৎ শিখা এসে কাঁধে হাত রাখে। সান্ত্বনা সমেত বলে,
“স্বাভাবিক হও। কেউ আমরা অনন্তকাল থাকতে আসিনি পৃথিবীতে।”
চোখের ধারা বইয়ে গেলেও ভারাক্রান্ত বুক হতে দীর্ঘ নিশ্বাস প্রবাহিত হয় শ্রাবণের। নিজ হাতে গাল মুছতে মুছতে বলে,
“হ্যাঁ, তা-ই। যেটুকু সময়ের জন্য এসেছি, সেটুকুতে গড়া ছোট ছোট শখগুলোও পূর্ণ করার ক্ষমতা নিয়ে আসিনি।”
“হুম। গাড়ি এসে গেছে। তুলে ফেলা হবে এক্ষুণি। তুমিও যাচ্ছো সাথে?”
শ্রাবণ ভ্রু কোণে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বলে,
“গাড়ি কেন? কোথায় নিয়ে যাবে?”
“কেন, গ্রামে। তুমি জানো না মনে হচ্ছে!”
“সত্যিই জানি না।”
“সে কি! ভাইয়া তোমায় জানায়নি? তোমার শ্বশুর তো কতক্ষণ যাবতই স্যারের সাথে আলাপ করছিলো সেখানে নিয়ে দাফন করার জন্য।”
শ্রাবণ চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখা আফজাল হোসেন সেখানে নেই। সে হনহন পায়ে ছুটে কর্তৃপক্ষের কক্ষের দিকে। তবে সে পর্যন্ত যেতে হয়নি তাকে। ম্যানেজারের নিকট দাঁড়িয়ে আছে ইফতেখার ও আফজাল হোসেন। কথা বলে চলে এসেছে ততক্ষণে। ফাতিহার ছাড়পত্র দিলেই তাতে সাক্ষর করে নিয়ে যেতে রওনা হবে তারা। এমনি ম্যানেজারকে সালাম দিয়ে কথা রাখতে চায় শ্রাবণ।
“স্যার কি চলে গেছে, ভাইয়া?”
“মাত্রই তো আমাকে ছাড়পত্র দিতে বলে বিদায় নিলো। বেরিয়েছে কি না, দেখা হয়নি।”
“ছাড়পত্র দিবেন না। আমি আসছি একটু স্যারের সাথে কথা বলে।”
বাবা ছেলে দুজনেই চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। এদিকে ম্যানেজারের প্রশ্ন,
“সে কী! কেন?”
শ্রাবণ একবার তাদের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে ম্যানেজারের জবাব দেয়,
“উনার দাফন এখানেই হবে।”
“পরিবার দাবি করলে ছাড়পত্র দিতে আমরা বাধ্য। স্যারের হুকুম পড়েছে।”
“কিন্তু, তিনি কখনোই গ্রামে যেতে চাননি। উনার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়াটাও আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। স্যারের সাথে আমি কথা বলে আসছি এক্ষুণি।”
“দেখেন। নিষেধাজ্ঞা আনতে পারলে দিবো না।”
পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে উঠে আসে আফজাল হোসেনের ক্ষোভ।
“চাইতাছো কী তুমি?”
নির্ভয় শক্ত গলায় মুখোমুখি জবাব দেয় শ্রাবণ,
“দাফন এখানে হবে, তা-ই চাইছি।”
“সব জায়গায় গোলমাল না করলে তোমার চলে না? যে-ই একটা ব্যবস্থা করছি, সে-ই তোমার ঝামেলা তৈরি করতে হইবো!”
“ব্যবস্থা তো আপনার আরও আগেই করা উচিত ছিলো। করেছেন আপনি তা? এখন আর ব্যবস্থা করার কোনো প্রয়োজন নেই। সকল ব্যবস্থা বিধাতা করে দিয়েছেন।”
“কথা বাড়াইয়ো না। আগেই করতে চাইছি। সময় সুযোগ দেয় নাই।”
“সময় দিবে সুযোগ? এই বয়সে এসেও এমন মিথ্যা মুখে মানায় না আপনার। একটু তো ক্ষান্ত হোন!”
ক্রুদ্ধ হয়ে আসে আফজাল হোসেনের মুখাবয়ব। শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণের দিকে। এদিকে ইফতেখার এগিয়ে এসে তার বাহু ধরে ফেলে হঠাৎ। থমথমে মুখে হনহন পায়ে টেনে নিয়ে আসে কক্ষের বাইরে। একপাশে দাঁড় করিয়ে কটমটে চোখ দুটো শ্রাবণের ব্যথিত, বিস্মিত চোখে রেখে সে বলে;
“আর একটা কথাও বলবে না তুমি। একটা শব্দও না। অধিকারসহ নিয়ে যেতে এসেছি, ছিনিয়ে না। এখানে তুমি একটু অন্যরকম করার চেষ্টা করলে, ইফতি হাজার গুণ অন্যরকম হয়ে উঠবে। আম্মার দাফনও চেয়ারম্যান বাড়িতেই হবে। একদম চুপ থাকো বলছি।”
নিচু স্বরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শ্রাবণকে সাবধান করে ইফতেখার। শক্ত চাপে ধরে রাখা বাহু ছেড়ে দিয়ে আবারও পিছু পথে যেতে ধরে আরও এক বাক্য সে বলে যায় তাকে,
“সর্বত্র সব লোকের নাক গলানোটাও সাজে না।”
শ্রাবণ স্থির, ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। এই কথাগুলো যদি সেই আফজাল হোসেন বলতেন, তবে অনেক পোক্ত জবাব তার কাছে ছিলো। কেননা সে জানে, আফজাল হোসেন চায়নি ফাতিহা বাড়ি যাক। ওবাড়ি থাকতে নিজ কানেই তো শুনলো, আফজাল হোসেন যে ফাতিহাকে বাড়ি নিয়ে যেতে ইফতেখারকে সম্মতি দেয়নি সেদিন। এর পরের বার্তা তার জানা না থাকলেও সে আরও কিছু কথা এখানে এসে জেনেছে শিখার মুখে যে, আফজাল হোসেন সেদিন এখানে এসেছিলেন। এবং সেদিন হতেই ফাতিহা এমন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শ্রাবণের ধারণা, আফজাল হোসেন তাকে অপছন্দের সাথে এমন কিছু বলেছে যার জন্য শোকাতুর হয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছেন তিনি। তাই তার প্রতি ক্ষোভ রেখেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো ফাতিহাকে এখন নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। অথচ এই রুখে দাঁড়ানোর কার্যক্রমে মুহুর্তেই থেমে যেতে হলো তাকে! পারলো না, ইফতেখারের ওই চোখে চোখ রেখে দুটো কথা বলতে! পারলো না, একইরকম শক্ত গলায় ইফতেখারকে সেই পোক্ত জবাবের এক বাক্যও বলতে। কেন বলবে? ইফতেখার তো তেমন আচরণ প্রাপ্য নয়। সে নিজ চোখেই তো দেখেছে, ফাতিহাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যে এই লোক কতটা উদগ্রীব হয়ে ছিলো। পরিজনদের বিরুদ্ধে একা লড়তে প্রস্তুত ছিলো। তাই সে পারলো না, তার বিরুদ্ধে আজ লড়তে। অথচ মন থেকে একদম ইচ্ছুক নয়, আফজাল হোসেনের সেই ভিটায় ফাতিহাকে যেতে দিতে। মানুষটা যদি এক বিন্দু মায়া দেখাতেন জীবিত ফাতিহার উপর, হয়তোবা অসুস্থ মুখটাও এক ঝটকা হাসির সাথে সব দুঃখ ভুলে যেতে পারতো। অথচ সে জানলো না যে, এই সিন্দুতূল্য দুঃখী জীবনে বিন্দু মায়ার পরশটুকুই ফাতিহাকে আরও শোকাতুর করে তুলেছিলো শেষ দিনগুলোতে!
বন্দোবস্তের সাথে লাশবাহী গাড়িটা স্বপ্ন নিকেতন ছেড়ে চলে গেলো। নিস্তব্ধ বেশে শ্রাবণ গেইটের বাইরে তাকিয়ে রইলো। কিছু করার, কিছু বলার ক্ষমতা নেই তার। যা-ই চেষ্টাটুকু করে যেতো আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তা-ও সম্ভব হলো না মাঝপথে ইফতেখারের বাধায়। ইফতেখারের চেষ্টাকে টপকে যাওয়ার শক্তি সে পেলো না। গাড়িটা যতদূর গেলো, শ্রাবণের মনটা তত গাঢ়তর ভাবে ভেঙে গেলো। কতগুলো দিন, এই স্বপ্ন নিকেতনের দেয়ালে দেয়ালে কতরকম স্মৃতিতে জড়িয়ে ছিলো ফাতিহা। এইযে আজ বের হলো, আর ফেরা হবে না কভু। শুরুটা যেখান থেকে হয়েছিলো, শেষটাও সেখানেই নিঃশেষ হওয়ার বন্দোবস্ত তবু।
গ্রামে মাইকের সাড়া পড়েছে। যাদের কাছে অপরিচিত, তারা পরিচিত হওয়ার জন্য ছুটছে। যাদের কাছে পূর্ব পরিচিত, তারা বিস্মিত হয়ে পড়েছে। চেয়ারম্যানের প্রথম স্ত্রীর পরিচয় কে বহন করে? ফাতিহা এতোদিনে কোত্থেকে আসে? কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে এতো বছর তবে? নানান মুখে নানান প্রশ্ন। তবে প্রত্যক্ষ জিজ্ঞেস করতে বড় ঘরে ছুটে যেতে পারে না চাইলেই। দেয়ালের বাইরে কানাঘুঁষা চলছে রীতিমতো। পথে সাত্তারকে দেখেও জিজ্ঞাসা চালাতে ব্যস্ত হয় কোনো কোনো পথিক! বাড়ি এসে শিরিনের কাছে, মজিদার কাছে কান পাতা শুরু করেছে প্রতিবেশীরা। কোনো জবাব কেউই দিতে পারছে না। এবাড়িতেও প্রত্যেকেরই সময়গুলোই যেন স্তব্ধতায় কাটছে। মজিদা অন্যরকম স্তব্ধ! শ্রাবণ মেয়েটা ফাতিহার পরিচয়েই আশ্রিত হয়েছিলো তার কাছে। যতদূর জেনেছে, ফাতিহা তার জীবনে ভালো আছে। কিন্তু আজ কী নতুন শোনে আবার! চেয়ারম্যানের স্ত্রী হিসেবে কেন পরিচয় উঠে তার? আর সবচেয়ে বড় যেই ব্যাপারটা প্রাণে আঘাত হেনেছে, তা হচ্ছে সখীর মৃ’ত্যু! সংবাদ যখন পাওয়াই হলো, মৃত্যু সংবাদটাই কী পাওয়ার ছিলো? এ জীবদ্দশায় আর দেখা হলো না ওই তরুণ আভার মুখ! আজ তবে কেমন হয়েছে চোখে লেগে থাকা সেই তরুণী মুখটা?
শহরে থাকতেই বিপুকে বন্দোবস্ত করার হুকুম দিয়েছে ইফতেখার৷ বিপু এদিকে ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। পারভীনের অবস্থা নিস্তব্ধতার সাথে বেহাল। কোনো সাড়াশব্দ যেন ভাসতেই চাইছে না আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে। অথচ বাইরের লোকেদের মনে তোলপাড়! এদিক, ওদিক নানাদিকের দুশ্চিন্তা ও মালিন্যতায় ইফতেখারের মুখটাও হয়েছে দেখার মতো। গাড়ি থেকে নেমেই বিপুর কাছে এগিয়ে বলে,
“ব্যবস্থা হয়েছে?”
“হুম। গোরখোদক কাজ করছে।”
ইফতেখার গাড়ির দিকে চলে যায় আবার। ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। এদিকে জবাব দিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে হতম্ভিতভাবে তাকিয়ে আছে বিপু। ভাইয়ের মুখাবয়বের করুণ অবস্থা তার চোখে স্পষ্ট। ফাতিহাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনায় ইফতেখার ব্যর্থ। মূলত এই ব্যাপারটাই তাকে আরও ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে যেন! তারউপর মাথার চারপাশে নানান দুরুহের চাপ তো লেগেই আছে! তার জীবনে শ্রাবণ আসাটাও একটা চাপ। এইযে, তাকে সেখানে রেখে চলে এলো আজও। মন কী সেদিক থেকেও এক বিন্দু স্বাভাবিক আছে?
গাড়ি চলে যেতেই ইফতেখার আসে সাত্তারের বাড়ি। প্রায় আধঘন্টা আগে ভ্যান নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সাত্তার। ইফতেখার এসে শিরিন ও সাত্তারকে বারান্দায় বসা অবস্থায়ই পায়। পাশেই মজিদা দাঁড়িয়ে ছিলো বারান্দার খুঁটিতে ধরে। কথা বলছিলো নিজেদের মধ্যে। এমতাবস্থায় উঠোনের আঁধারে ইফতেখারের উপস্থিতিতে তিন জনের দৃষ্টিই তার দিকে স্থির হয়। ইফতেখার নরম কণ্ঠে নির্দ্বিধায় আহ্বান করে সাত্তারকে।
“কাকা, আম্মার জানাজা বালুর মাঠে। জানাজায় আসেন।”
থমথমে মুখে সাত্তার বলে তাকে,
“ওই বাড়ির কেউর জানাজায় আমি যাইতাম না। তোরা না আইলেও শান্তি।”
ইফতেখার একই মলিন স্বরে শান্ত গলায় বলে,
“মানুষ মৃত্যু সংবাদে কখনোই খুশি হতে পারে না। আপনার মনের অবস্থা আল্লাহ ভালো জানেন। ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকবেন না৷ আফসোস হবে পরে। সুযোগ তো বারবার আসে না, বলেন? ওই বাড়ির কেউ হওয়ার আগে তো বোনটা আপনার। মনে মনে না কেঁদে জানাজায় শামিল হতে আসেন। বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। অযু করে আসেন।”
কিছু বলতে চেয়েও যেন গলা দিয়ে কথা আসে না সাত্তারের। অজানা কিছু একটা যেন গলা চেপে রেখেছে। কণ্ঠে উচ্চারিত হতে চাইছে না কিছু। শুধু কণ্ঠটা ধরে আসছে যেন! ইফতেখার নিজ উদ্যোগেই তাকে আহ্বান করতে এসেছিলো। কথার পরপরই চলে গেছে, দেরি না করে। আম্মার খাটিয়ে উঠবে তার কাঁধে। উপস্থিত থাকতে হবে বাড়িতে। এদিকে মজিদার মনও ইফতেখারের কথায় সায় দেয়। ছেলেটা মন্দ বলে যায়নি। যতই হোক, রক্তের বোন তার। অগোচরে আফসোস ঠিক একটা হবে। তাই সে-ও বলে,
“যান ভাই, যান। জানাজাডা পড়েন।”
সাত্তার স্থির বসেই থাকে। নড়ে না এদিক ওদিক। শিরিনের মনও একই কথা বলে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না স্বামীর ভয়ে। তারও বড্ড ইচ্ছে করছে ফাতিহাকে একবার দেখতে। কিন্তু সেটা চেয়ারম্যান বাড়ি হওয়ায় যেন সাধ্যের বাইরে!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫০
(নূর নাফিসা)
.
.
বাড়ির সামনে দিয়েই খাটিয়া গেলো বালুর মাঠে। শেষ বারের মতো মসজিদের মাইকে বাজে জানাজার আহ্বান। সাত্তারের কান পর্যন্ত আসে সেই আওয়াজ। একই জায়গায় নিস্তব্ধ বেশে বসে আছে সে। মিনিট খানেক পরই উঠে চলে যায় বাড়ির বাইরে। শিরিন একা একা বসে থাকে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে। জানালায় হেলান দিয়ে কান্তাও বসে ছিলো ঘরের ভেতরে। জানালা দিয়ে সে-ও দেখলো আঁধার পেরিয়ে বাবার অবয়ব হনহন পায়ে চলেছে রাস্তার দিকে। মসজিদের আওয়াজে তার বুকের ভেতরও ধুকপুক করে চলেছে। একজন ফুফু এতোকাল বেঁচে ছিলো তার, অথচ জানতোই না! এখন যা-ই জানলো, তা-ও মৃ’ত হিসেবেই জানতে হলো! মানুষের জীবন এতো অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা কেন?
মসজিদে ওযু করে জানাজায় এসে শামিল হয়েছে সাত্তার। বহু লোকের উপস্থিতি আছে এই মধ্য রাতেও। যে এসময় গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে, সে-ও যেন সজাগ রয়েছে ভারি কৌতুহল নিয়ে। একদম পেছনের সারিতেই এসে দাঁড়িয়েছে সাত্তার। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো বিপু। নানান কাজ সামলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তারও অবস্থান হয়েছে পেছনে। সাত্তার তাকে খেয়াল না করলেও বিপু করেছে। এবং মনে মনে একটু অবাকই হয়েছে। সে আসবে, তার ধারণার বাইরে ছিলো।
জানাজার পর খাটিয়া পুনরায় আসে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে। সাত্তার পিছু চলতে চলতে নিজ বাড়ি পর্যন্তই থেমে গিয়েছিলো। মনটা কেমন করছিলো খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে। কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে ভেবেও পেলো না সে। কিন্তু মনের অবস্থা আজ বড় দুরুহ! এই সংসারে একজন সংসারীর ঠাঁই না হলেও চেয়ারম্যান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানই ফাতিহার শেষ আশ্রয় হলো। একে একে সমাধির সকল কার্য শেষ হলো সময়ের সাথে সাথে। এক দুঃখিনীর গল্প শেষ হলো নিমেষে। সে কী সাধ, আর সে কী পরিকল্পনা ছিলো গত দিনগুলো জুড়ে। আজ সবটাই থমকে আছে অপূর্ণতায় মিলিয়ে।
পারিবারিক কবরস্থানের কাজ শেষ করে বাড়ির গেইটে প্রবেশ করে ইফতেখার। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীর ও মন। হাঁটার গতিও যেন স্বাভাবিক নয়। কদম জুড়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্লান্তিরা। পিছু থেকে হঠাৎ বিপুর কণ্ঠ আসে। খুব বেশি দূর হতে ডাকেনি। ঘরে উঠার আগে সামান্য দূরত্বে থেকে থামালো আরকি। ইফতেখার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বিপু ঘনপায়ে স্বল্প সময়ে তার নিকটবর্তী হয়। একত্রেই ঘরের দিকে চলতে চলতে নিচু স্বরে বলে,
“সাত্তার কাকা জানাজায় গেলো দেখি! আমি ভাবছিলাম যাবেই না।”
“গেছে? দেখলাম না তো।”
“হু, গেছে। পেছনে দাঁড়াইছিলো। তুমি তো সামনের দিকে ছিলা।”
“যাক, গেলে ভালো। নয়তো বড় আফসোস করতেন কোনো না কোনো সময়। আমি তখন বাড়ি গিয়েছিলাম উনাকে সাধতে। নিষেধ করেছিলেন। ভেবেছি সত্যিই বুঝি আসেননি।”
“ও, তুমি যাওয়াতেই আসছে তবে।”
“না। আমাকে তো নিষেধই করে দিলেন। আত্মার টান থেকে গেছেন।”
বলতে বলতে বারান্দা অতিক্রম করতে থাকে তারা। সাত্তারের প্রসঙ্গ বাদ দিতে না দিতেই বিপু সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি দেখি এলো না? খবর পায়নি সেখানে?”
পথ চলায় গতি কমিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকায় ইফতেখার। পরক্ষণে ঘরের দুয়ার ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে পা বাড়িয়ে বলে,
“এসেছে। সেখানে দেখেছে। যা তো, মা কেমন আছে দ্যাখ একটু। আশপাশের কারণে উনার মাথায় বড্ড চাপ পড়ছে আমার মনে হয়। একটু খেয়াল রাখিস সবাই। আমার চেহারা দেখলেই রাগে কেমন দুঃখ পায় মা। তাই আমি সামনে যাচ্ছি না আপাতত।”
বিপু আর ঘরে প্রবেশ করে না। তার ভালো ভাবিটা যে ভীষণ ভালো ভাইটাকে গাঢ় রকম এক কষ্ট দিয়েছে, তা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পারে সে। তাইতো, কী সুন্দর এড়িয়ে গেলো কথা শুরু না করতেই! সে মাকেই একটু দেখতে চলে যায় পাশের ঘরে। বাবার মনটাও ভীষণ রকম খারাপ হয়ে আছে।
এপ্রান্ত ওপ্রান্ত উভয় প্রান্তের কিছু চোখ আজ নির্ঘুম রাত যাপন করছে। নানান ব্যথা একত্রে পিঞ্জিরার ভেতরটা ছারখার করে দিচ্ছে। যেমন, ঘুম নেই চেয়ারম্যান বাড়ির কারো চোখে। তেমনই নেই এদিকে শ্রাবণের চোখেও। স্বপ্ন নিকেতন থেকেই কেমন নিস্তব্ধ বেশে এসেছে। খাওয়া দাওয়া তো দূর, একটু স্বাভাবিক উত্তর পর্যন্ত করতে পারেনি মায়ের জিজ্ঞাসার। সুলতানা মেয়েকে সান্ত্বনা স্বরূপ মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ বুঝালেন এই ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে। তেল লাগিয়ে দিলেন মাথায়। সাথে অপ্রকাশ্যে এই দুঃখও পুষলেন যে, তিনি পৃথিবী ছাড়া হলে না মেয়ে দুটো এমনি শোকাহত হয়ে পড়ে আবার! একদম না হোক এমন কিছু। তার রত্নকন্যারা সবসময় শক্ত ও শক্তিশালী থাকুক, তা-ই তার প্রত্যাশা। একই বিছানায় মা ও মেয়েদের অবস্থান। একটু সময় নিয়ে হলেও পাশের দুজন ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ কিন্তু শ্রাবণের চোখের দ্বারপ্রান্তও ছুঁতে পারছে না নিদ্রা-ঘোর! ফাতিহার দুঃখী জীবনের ডায়েরির প্রতি পাতার প্রতিটি শব্দই যেন তার স্মরণে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের মতো ধাক্কা খাচ্ছে। মনে পড়ছে তার থেকে পাওয়া স্নেহময় মুহুর্তগুলোকেও। মনে পড়ছে ওই মুখের হাসি, চোখের কান্না৷ মনে পড়ছে ছোট ছোট অভিযোগ আর অভিমান। আরও মনে পড়ছে চেয়ারম্যান বাড়ির আশ্রয়স্থলে তার না যেতে চাওয়ার বায়না! অথচ সে কিছুই করতে পারলো না তার জন্য। জীবিত থাকতেও না, শেষ বেলার শেষ আশ্রয়েও না। এই ব্যাথার প্রকোপে চোখ দুটো বারবারই অশ্রু ঝরায় তার। মনটা বারবারই চিৎকার করে বলতে চায়,
“আমি পারিনি, আম্মা। আপনার শখের পূর্ণতা, সুখের পূর্ণতার এক অংশও পূরণ করতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করে দিয়েন। এপাড়ে যত দুঃখ পেয়েছেন, ওপারে তার চেয়েও উত্তম সুখের প্রতিদান যেন পাওয়া হয় আপনার। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে না হোক, রবের কাছেই আপনি ভালো থেকেন।”
ভোরের সালাত, ফজর কারোই বাদ যায়নি আজ। পরীটা পর্যন্ত নামাজে দাঁড়িয়েছে কেমন এক ভয় ভয় উত্তেজনা নিয়ে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হালকার উপর যা-ই হয়েছে, সেটা ঘুম না আরও কিছু ভাবা মুশকিল। বারবারই চোখে ভাসছিলো ফাতিহার নিথর মুখটা। এতোদিন যাবত এবাড়ি কাজ করছে, অথচ জীবনের প্রথম ও শেষ দেখা হলো এবাড়িটার এই কৌতুহল পূর্ণ সদস্যের সাথে। তবুও কী ভীষণ অদ্ভুতভাবে! বরাবরই কাছের কারো মৃত্যু হলে তার দিনক্ষণ ভয়াবহতার সাথে পার হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নামাজ আদায়ের পরই বারান্দায় ঘুরঘুর করছিলো পারভীনের দেখা পাওয়ার প্রত্যাশায়। ঘর থেকে তিনি বের হচ্ছেন না। কুরআন পড়ছেন অনেক্ক্ষণ যাবত। ডাকতেও তাই দ্বিধা। তারউপর মনমানসিকতার করুণ হাল তো আছেই! অবশেষে নিজ উদ্যোগেই রান্নাঘরে এসে ভাত বসিয়ে দেয়। থালাবাটি মেজে নেয়। উঠুনে ঝাড়ু কাজ চালাতে চালাতে মন ভয় নিয়ে তাকায় ফাতিহাকে শেষ গোসল দেওয়ার স্থানে। আগরবাতির ঘ্রাণে এখনো পুরো বাড়ি ছেয়ে আছে। গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ইফতেখারকে। কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফিরেছে সে। মাটির দিকে চোখ রেখে ভাবুক বেশেই যেন ঘরে চলে গেলো। পরীর মনটা আরও বিষণ্ণতায় ছেয়ে রইলো। বাড়ির একটা মানুষও আজ ভালো নেই। মানুষ চলে যাওয়ার শোক, নাকি কারো পরিচয় ফাঁস হওয়ার শোকে কাতর হয়েছে সব, বুঝে উঠা মুশকিল! তার শ্রদ্ধেয় কাকা এমন একটা গোপন চিত্র না তৈরি করলেও পারতেন। তবে আজ হয়তো বাড়ির পরিবেশটাও অন্যরকম থাকতো। বড়সড় নিশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগ দিয়েছে পরী। ইফতেখার আবারও কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলো ঘরে এসে। বিপু সেই যে ফজরের আজান শুনতে পেয়ে বেরিয়েছে, আর ঘরে আসেনি। এদিকে আফজাল হোসেনও নামাজ পড়েই কবর জিয়ারত করে এসেছেন ইফতেখারের আগে আগেই। কিছুক্ষণ ঘরের ভেতর বসে থেকে এখন আবার চেয়ার নিয়ে বসে আছেন বারান্দায়। পরী শুরুতেই একবার জিজ্ঞেস করেছিলো চা খাবে কি না। একটু পরে খাবেন বলেছিলেন। তাই কিছুক্ষণ পর এসে পরী আবারও জিজ্ঞেস করে,
“কাকা, চা দেই?”
“না। খাইতাম না।”
চুপচাপ চলে যায় পরী। আগেই তো চা বানিয়ে ফেলেছিলো তার জন্য। কিন্তু এখন কে খাবে তা? জানালা দিয়ে বকুল কাকাকে দেখে গোয়ালের কাছে। কাজকর্ম সেরে চুপটি করে বসে আছেন তিনি। পরী ডাকে,
“বকুল কাকা? ওই বকুল কাকা।”
বকুল কাকা ফিরে তাকাতেই পরী বলে,
“চা খাইবেন?”
“না।”
“ক্যা, রোজা রাখছেন?”
“না। পাতিল পোছা চা আমি খাই না। তোর চা তুই খা।”
পরীর মনে পড়ে কিছুদিন আগের কথা। পরীকে চা খেতে দেখে বকুল কাকাও চা চেয়েছিলো সেদিন। দুষ্টু পরী ঠমক মেরে নিষেধ করতে গিয়েও করেনি। চায়ের লিকার পাতিলে অবশিষ্ট ছিলো মনে পড়ে। তাই ঝগড়ার শাস্তি দিতে উদ্ধুদ্ধ হয়ে চায়ের লিকারে এক কাপ পানি ঢেলে নেড়েচেড়ে চা রঙা করে কাপে ছেকে নিয়ে যায়। বকুল কাকা তা মুখে তুলে ক্রুদ্ধ হতেই ফিক করে হেসে বলেছিলো, চা শেষ। কিন্তু মুরুব্বি মানুষকে নিষেধ করে কীভাবে? তাই যা ছিলো, নিংড়ে নিংড়ে পানিতে কাপ ভরাট করে এনেছে তার জন্য। আর তারই ফলশ্রুতিতে আর চা খেতে রাজি নয় বকুল কাকা। পরী মুখ টিপে কিঞ্চিৎ হেসে কাপে করে চা নিয়ে আফজাল হোসেনের কাছ দিয়েই বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। গোয়ালে কাছে এসে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় বকুল কাকার সামনে।
“ধরেন। খাইলে খান। কাকি তো চা কইরা খাওয়ায়ই না, জানি। পরীর স্পেশাল চা খান।”
“কইছি না, খাইতাম না!”
“আরে খান। আজকারটা ভালা আছে। চেয়ারম্যান কাকার জন্য মনোযোগে বানাইছি। কিন্তু তিনি খাইবেন না।”
“তা-ও তো, ফেলনাটাই দিলি!”
“এহ! আপনের জন্যে আবার আলাদা হাড়ি বসামুনি! জমিদারি পাইছে! খাইবেন কি না কন!”
কাপ হাতে নেয় বকুল কাকা। খাওয়া শেষে কাপটা জানালা দিয়ে রাখতে বলে পরী চলে যায় পরপরই। তবে বারান্দায় উঠার আগেই থেমে যায় গেইটের দিকে কারো উপস্থিতি পেয়ে! আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে ভাবনায় মত্ত ছিলেন চেয়ারে বসে। তারও ধ্যানভঙ্গ হয় বাড়িতে অতিরিক্ত কারো উপস্থিতিতে। শ্রাবণ এসেছে…!

শুভ ৫০ শ্রাবণধারা… 🌼

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫১
(নূর নাফিসা)
.
.
বুকে জমা এক রাশ ব্যথা নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছে শ্রাবণ। ফাতিহাকে নিয়ে প্রত্যাশার কাল এখন যেন স্বাপ্নিক হয়ে গেলো তাদের নিকট। না হলো রূপনগর গ্রামের বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, আর না হলো চেয়ারম্যানের সাধের সংসারে ঠাঁই! সবটাই ইতিহাস হয়ে বেঁচে রইলো এই ভিটায়। নির্ঘুম রাত ও কান্নার কারণে চোখমুখের অবস্থা একটু ভিন্নরকম হয়ে আছে। পরী এবং চেয়ারম্যান যে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তা বুঝতে একদমই ভুল করেনি শ্রাবণ। পারভীনও মাত্রই বেরিয়েছিলো ঘর থেকে, এমনি বারান্দায় উঠে শ্রাবণ। আর তাই তিনিও থেমে গেছেন দরজার কাছেই। ওদিকে বিপুও বাড়িতে প্রবেশ করেছে মাত্র। শ্রাবণকে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগে তার মধ্যেও। ভেবেছিলো গত রাতেই আসবে৷ তা না এলেও আজ সকালে দেখা গেছে ভাবিকে। বিস্ময়াপন্ন হয়েই সে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসে ঘরের দিকে। শ্রাবণ চুপচাপ হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছে চেয়ারম্যানের সামনে। মলিন গলায় একটা সালাম দেয়। চেয়ারম্যানও বিড়বিড়িয়ে দেয় সালামের জবাব। পরপরই শ্রাবণ স্পষ্টতর গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ভালো আছেন তো আপনি, চেয়ারম্যান সাহেব?”
সময় ও কণ্ঠের আকস্মিক পরিবর্তনে এর জবাব আর দেওয়া হয় না আফজাল হোসেনের। সে কি তাচ্ছিল্যের সাথে বিদ্রুপ করলো তাকে? নেহাতই ভুল ধারণা এনেছে তার বিরুদ্ধে, তাতে নিশ্চিত হতে পারছেন যেন তিনি। শ্রাবণ বিদ্রুপাত্মক নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ভালো থাকারই কথা। জীবন থেকে একটা সমস্যা চিরতরে চলে গেলো বলে কথা!”
তার এই কটু কথায়ও কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। তবুও নিশ্চুপ থেকে মুখটাকে থমথমে করে রাখেন। সে যে কি চায়, কিছুই যেন ভেবে পায় না। কেন এমন করে অযথা? কেন অপরকে আঘাত করতে প্রস্তুত থাকে সবসময়। শ্রাবণ তার প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে নেই। পারভীনের দিকে একবার তাকিয়ে কাঁধে থাকা ব্যাগটা খোলে। রুমালে জড়ানো গহনাগাঁটি নিয়ে দরজার দিকে দুই কদম এগোয় পারভীনের সামনে। রুমাল খুলে গহনা তুলে ধরে বলে,
“আপনার গহনাগুলো। বুঝে নিন। কোনো নড়চড় নেই।”
তাকে দেখে ও চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলার ধরণ দেখে পারভীনের মুখও থমথমে হয়ে থাকে। সে খেমটা মেজাজে বলে,
“পালায়ছিলা ক্যা এগুলা নিয়া?”
মলিন ঠোঁটের বাকে তাচ্ছিল্যকর হাসি এলিয়ে দেয় শ্রাবণ। বলে,
“দেখতে চেয়েছি, আপনার হার্ট দুর্বল কি না। গহনা হারানোই যদি সইতে না পারেন, ঘরে সতীন সইতেন কীভাবে? আসলে আপনার ভাগ্যই ভালো। এক নারী অধিকারের অ-ও পেল না। আর আপনি অধিকারের পরে অতিরিক্ত পূর্ণতাটুকুও পেয়ে গেছেন। এই দেখুন, সতীন এলো। তা-ও লাশ হয়ে। মানে, আপনার জীবনে কোনো ভেজালই নেই।”
“বেশি বেশি বলতাছো না এইসব!”
“কাজ যখন বেশি পর্যন্ত এগিয়েছে, কথা আর খাটো থাকে কীভাবে? ভাগ্যিস, শ্রাবণ যা জানে; এই রূপনগর তা জানে না!”
আফজাল হোসেন এমনিতেই ব্যথার যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে কাতরাচ্ছিলেন। তারউপর শ্রাবণের একেকটা কথা তাকে আরও অসহনীয় যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি আর চুপ না থেকে এবার ক্রোধান্বিত গলায় বলেন,
“তুমি আর একটা কথাও বলবা না। একটাও না।”
ব্যথার ভারে ক্রোধের গলাও উঁচু হয় না যেন তার। উপস্থিত সকলেই ধরতে পারে এই গলার সুর কোন রঙের তান ধরতে চেয়েছিল, আর কোন রঙ ধরে নিয়েছে। শ্রাবণের গলা শুনেই অর্পা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। আর এদিকে বিপু, পরী তো আছেই। সকলেই যেন কেমন বিস্মিত হয়ে আছে শ্রাবণের আচরণ, স্পর্ধার উপর। শ্রাবণ পারভীনের হাতে গহনা তুলে দিয়ে পুনরায় এসে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের সামনে। নির্ভয়, সুস্পষ্ট গলায় বলে;
“কেন, ভুল বললাম কিছু? সজ্ঞানে পুরনো পাতা ঘাটলে আমার এখন বলা একটা কথাও আপনি ভুল প্রমাণ করতে পারবেন না, সেটা আপনিও বেশ ভালো জানেন। স্বপ্ন নিকেতন এই গল্পের একাংশ জানলে গত রাতে আম্মাও এখানে আসে না।”
“তুমি সব জায়গায় বেশি বেশি করতাছো। বাচ্চা মানুষ, বাচ্চার মতোই থাকো। আমার সজ্ঞান দেখাইতে গিয়া যে নিজের জ্ঞান হারাইতাছো, সেইটা তুমি বুঝতাছো না।”
“আর কী বুঝতে হবে আপনাদের নিয়ে? আর কী বুঝার বাকি পড়ে আছে এখনো? জীবন নিয়ে লড়তে লড়তে একটা প্রাণ হারিয়ে গেলো চোখের সামনে, এখনো আমার বুঝার বাকি পড়ে আছে বলছেন? কোন সুমহান বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে চাইছেন আপনি? স্বামীর ঘর ছিল, পৈতৃক ভিটা ছিল। নিজের নামে উভয় দিক থেকেই পাওনা সম্পদ ছিল। তবুও সেই নারী শহরের ধুলোয় পড়ে রইলো। একূল ওকূল উভয় কূলের পাড় আপনি নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছেন নিষ্ঠুরতার সাথে। কিছু মানুষ সম্পদে খাবলায় না, জানেন তো? তারা একটা সম্পর্ক নিয়ে বাঁচতে চায় শুধুমাত্র। অথচ সম্পর্কিত মানুষগুলো নিরীহদের প্রতি এতোটাই স্বার্থপর হয় যে, সেই মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত ধোকা দেয়। ঠকিয়ে যায়, অধিকার বঞ্চিত করে। ফাতিহা নামক নারীও বঞ্চিত হয়েছিলেন। অতি মমতাময়ী বলেই কোনো দুয়ারেই এসে দাঁড়াননি নিজের অধিকার চাইতে। শুধুমাত্র অধিকার দাতার ভালোবাসাটুকু তার প্রত্যাশা ছিল। সম্পদের প্রত্যাশা তিনি করেননি। আর লালসার ঘোরে অন্ধ মানুষগুলো তাকে ভালোবাসাটুকুও দিতে পারেনি। আরে, কি হবে এই প্রতিপত্তি দিয়ে? প্রকৃত অস্ত্র ধরতে না পেরেই তো জীবন যুদ্ধে হেরে গেলেন।”
ক্রমশই ক্রুদ্ধ হয় আফজাল হোসেন। জেনে আর না জেনে বলা ছোট মুখের এতো কথা তিনি নিতে পারছেন না। সুস্পষ্টবাদী শ্রাবণকে হয়তো তিনি শুরু থেকেই পছন্দ করতেন, দ্বিতীয় মেয়ের মায়াতুল্য চোখে দেখেন তাই ততটা শাসাতেও পারেন না। শুধু চাইছেন, আর না বলুক। থেমে যাক। সদয় হোক তার অবস্থার প্রতি। তাই ক্রোধের মাত্রা তীব্র হলেও তিনি কথা না বাড়িয়ে ছোটখাটো ধমকের মাধ্যমে সামলে নিতে চান।
“চুপ থাকো! একদম চুপ! নিজের ঘরে যাও চুপচাপ।”
আরও একবার তাচ্ছিল্যের হাসি শ্রাবণ মুখে।
“দুঃখিত, চেয়ারম্যান সাহেব। আমি এখনে থাকতে আসিনি। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যের একাংশ গতকালই দাফন হয়ে গেছে ওই কবরে। তারপরও আজ আসার কারণ এই আপনাদের অর্থসম্পদ বুঝিয়ে দেওয়া। এক কণাও কম নেই। বুঝে নিন।”
শক্ত গলায় কথা বলে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রাবণ। ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে গুনে নেয় ঠিক আছে কিনা। আরও নেয় ভাজ করা একটা কাগজ। বিপুর সামনে দাঁড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা নিন।”
চিন্তিতভাবে হাতে নেয় বিপু। বুঝে উঠার জন্য কাগজটাই হয়তো খুলে দেখতো আগে। কিন্তু শ্রাবণই কারণ বলে দেয় সে ধরতে না ধরতে।
“এই টাকাটা আপনার ভাইয়ের। উনাকে দিয়ে দিবেন। মন বলছিলো, উনাকে হয়তো বাসায় পাবো না এসময়। তাই উনার জন্য কিছু কথা নিয়ে আসা কাগজের পাতায়। এটাও দিবেন।”
টাকা এবং চিরকুট হাতে দিয়ে সাথে সাথেই বাইরে বের হতে পা বাড়িয়েছে শ্রাবণ। সিঁড়িতে পা দিতে গিয়ে একবার পরীর দিকেও তাকায়। কিন্তু বলে না কিছুই। পিছু হতে পারভীনের ক্রুদ্ধ গলায় উচ্চারিত হয়,
“গহনা তো তোমার পরনে আরও আছে। সব দিয়া যাও। এই বাড়ির কিছুই নিতে পারবা না সাথে।”
থেমে যায় শ্রাবণ৷ পেছনে তাকিয়ে আপত্তিহীনভাবে ফিরে আসে আবার। পারভীনের সামনে দাঁড়িয়েই তার দেওয়ার হাতের চুড়ি জোড়া খুলে দিয়ে দেয় গহনার রুমালে।
“নিন, দিলাম৷”
“গলায় চেইনও আছে।”
“হ্যাঁ, আছে। কিন্তু দুঃখীত, আম্মা; এটা আপনার দেওয়া না। তাই আপনাকে দিতেও পারছি না। এটা আমি পরিনি, তাই খুলতেও পারছি না। যেই হাতে চেইন আমার গলায় উঠেছে, সেই হাত যদি খুলে নিয়ে আসতে পারে তো আসবে। তাতে আমার বিন্দুমাত্রও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু আপনার কথায় সেই চেইন খুলতে আমার ভীষণ রকম আপত্তি। এটা আপনার দেওয়া না, তাই কোনোরকম অযুহাত দেখিয়ে আপনার রেখে দেওয়ারও কোনো অধিকার নেই। আসি।”
ইফতেখার ঘরেই বসা ছিলো। শুনছিলো সবই, রাগে ফাটছিলো, ক্ষোভের চাপে মগ্ন ছিলো, অজানা এক ব্যথায় আটকে ছিলো। সুখ, শান্তির এক বিন্দু অনুভব করারও যেন তার চারপাশে তীব্র অভাব! গলা শুনেও আসেনি মুখোমুখি হতে। চেয়েও পারেনি একটু শাসন করে তাকে ঘরেই বেঁধে রাখতে। এমন দশায় পড়ে আছে সে যে, শ্রাবণের আচারব্যবহারের কারণে তাকে সামনে সহ্যই করতে পারবে না। আবার মায়ার টানে জড়িয়েও নিতে পারবে না। না যেতে দিতে আর না রেখে দিতে প্রস্তুত আছে সে! সবদিকেই যত যন্ত্রণার ছড়াছড়ি।
বাইরেও কেউ বলেনি সে যে ঘরে আছে। টাকা চাইলে তার হাতেই দিয়ে যেতে পারতো। যে বলবে, সে তো জানতোই না। মাত্র বাইরে থেকে এলো বিপু। এদিকে আফজাল হোসেনও ক্রোধের চাপে নিস্তব্ধভাবে বসে ছিলেন যেন৷ মৃত্যু শোক, মুখের উপর অপমান আর কটুবাক্যের ব্যথা তাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করে রেখেছে। মন চাইছিলো শ্রাবণ থেকে যাক, তবুও থামানোর মতো গলায় পর্যাপ্ত শক্তি পায়নি। মন ভালো নেই, মেজাজও ভালো নেই। কাউকে বুঝানোর মতো মানসিকতাও তার এখন নেই। সবমিলেই গম্ভীর হয়ে আছেন তিনি। তাছাড়া বাকিদের কারোই সাধ এবং সাধ্য বজায় রয়নি। কেবলই দেখে গেছে শ্রাবণের চলে যাওয়া।
হনহন পায়ে বাড়ির সীমানা ছেড়েছে শ্রাবণ। রওনা হয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তার আগে পুনরায় একবার চেয়ারম্যান বাড়ির সীমানা ঘেঁষা পারিবারিক কবরস্থানের গেইটে দাঁড়াতে ভুলে না। রাস্তায় দাঁড়িয়েই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে নব গড়ে তোলা কবর পানে। তার মমতাময়ী আম্মা সকল মায়া গুটিয়ে নিয়ে শুয়ে আছেন যেখানে। মনে মনে শান্তি কামনায় সালাম দেয়। দোয়া রাখে ওপারের সুখে পরিপূর্ণ থাকতে। চোখ দুটো টইটম্বুর হয়ে আসতেই তার নির্লিপ্ত চোখে পলক পড়ে। গাল দুটো ভিজে যায় অনায়াসে। জমা ব্যথা আর জড়ানো মায়া নিয়েই সে এই প্রাঙ্গণও ছেড়ে যায় গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্যে।

চলবে।