প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-১৮

0
172

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৮

নব্য দিন। আকাশে সূর্য মামার উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। মিনিট পরপর মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ঘামার্ত শরীর নিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে অরিন। অপেক্ষা করছে তার রুষ্ট পুরুষের। যখন হেঁটে আসছিলো ভীষণ রোদ ছিলো। ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে। ওড়না দিয়ে মুখখানা মুছে নিলো। ধূসর কিছুটা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো অরিনের সামনে। অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“দুঃখিত নিবেদিতা তোমায় এভাবে অপেক্ষা করানোর জন্য।”

ধূসর বেঞ্চে বসে আবারও বলল,,,
“আগামী শুক্রবার রাফার বিয়ে। এর জন্যই একটু ব্যস্ত সময় পার করছি। তোমায় বেশ অনেক দিন হলো দেখি না তার জন্য ছুটে আসা। তোমাকে কি খুব বেশি অপেক্ষা করিয়েছি?”

অরিন ধূসরের কিছুটা কাছ ঘেঁষে বসলো। ধূসরের ঘামার্ত মুখ খানা নিজের ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে দিলো। ধূসর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। তার ভীষণ রকম ভালো লাগছে। অরিন ঘাম মুছে দিয়ে সরে আসলো। পার্কে খুব বেশি লোক নেই। যারা আছে তারাও প্রেমিক প্রমিকা যুগল। নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। আর এই সময়ে কেই বা থাকবে। ধূসর অরিনের কিছুটা কাছে আসলো এরপর অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

“আমি কি তোমায় জড়িয়ে ধরবো নিবেদিতা?”

অরিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ধূসরের চোখের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে সেই গভীর কালো আঁখিজোড়ার ভাষা। অরিন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ধূসরের আকুলতা। তাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অরিন মাথা নাড়াতেই ধূসর শক্ত করে নিজের বুক পিঞ্জিরায় অরিনকে ঠায় দেয়। অরিন নিশ্চুপ হয়ে থাকে। ধূসরের বুকে মাথা রেখে তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে থাকে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। ধূসর ছেড়ে দেয় অরিনকে। ধূসর অরিনের গালে হাত রেখে বলে,,,

“তোমাকে কাছে পাওয়ার যন্ত্রণা ভীষণ কষ্টদায়ক। তোমাকে রোজ সকালে জড়িয়ে ধরার খুব সখ আমার, তোমাকে রোজ শাড়িতে দেখার শখ আমায়। তোমাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চাই আমার। আমার ভীষণ বাজে ভাবে চাই। কবে আমার হবে?”

অরিন ধূসরের কপালে উষ্ণ স্পর্শ করে বলল,,
“আমি তো আপনারই শুধু একটু অপেক্ষা এরপর আমাদের ছোট্ট সংসার হবে। আমি আপনি ভীষণ সুখে থাকবো। ভালোবাসি রুষ্ট পুরুষ”

দু’জন একাকী বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালো। এখন বাড়িতে ফিরবে অরিন। ধূসর রিকশা ঠিক করে তাতে উঠিয়ে দিলো তাকে। ভাড়াটাও ধূসরই দিয়েছে। তাকে দিতে দেইনি। অরিন খুব একটা জোর করেনি সে জানে ধূসর শুনবে না। রিকশা এসে গেটের সামনে থামলো। অরিন নামতেই বাড়িতে লোক জনের উপস্থিতি টের পেলো। বুকটা ধক করে উঠলো। সে দ্রুত বাড়ির দিকে এগোলো। লোকজনের ভীর ঠেলে বসার রুমে আসলো। তাইবাকে দেখতে পেলো। মায়ের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। অরিন তাইবার কাছে গিয়ে বললো,,
“কি হয়েছে বাড়িতে লোক জন কেনো রে এতো?”

তাইবা মাথা নিচু করে ছিলো অরিনের দিকে তাকাতেই অরিন চমকে উঠলো। তাইবার চোখে পানি। কি হয়েছে। তার মায়ের বা হায়াতের কি কিছু হলো। বুক ধড়ফড় করছে। ছুটে গেলো সে মায়ের রুমে। তাইবাও ছুটলো অরিনের পিছু। অরিন রুমে আসতেই থমকালো। তার মা বিছানায় শুয়ে আছে পাশে হায়াত কাঁদছে তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে তোহা আর তাইবার মা। অরিন ধপাস করে পরে যেতে নিলো। পেছন থেকে তাইবা ধরে ফেললো। হায়াত আপুকে দেখে সেদিকে গেলো। কিন্তু অরিনের কি সে খোঁজ আছে সে তো সেই তখনই জ্ঞান হারিয়েছে। হায়াত আপুকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলে,,

“আপু আম্মুকে বল না উঠতে। ও আপু দেখ না আম্মু কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। আম্মুকে উঠতে বল আমায় একটু বকতে বল। এমন কেনো করছে আম্মু।”

হায়াত উঠে আবার মায়ের কাছে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,“ও আম্মু আম্মু উঠো না। দেখো না তোমার অরিন হায়াত কাঁদছে। উঠে একটু বুকে আগলে নাও। আম্মু আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু”

হায়াতের আর্তনাদে রুমে থাকা সবার চোখে পানি। তোহা তাইবার কাছে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। অরিনকে তাইবা ধরে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মহিলারা সবাই দেখছে। তাইবা তোহার হাত থেকে পানি নিয়ে অরিনের মুখে ছিটালো। কিন্তু জ্ঞান ফিরলো না। অরি শোকে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে। বাপ মারা যাওয়ার পর মা বোনই ছিলো তার শেষ সম্বল। আজ মাকেও হারালো। তাইবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটাকে সে নিজের বোন মনে করে এই অবস্থা মেনে নিতে পারছে না সে। তাইবা দু’জন মহিলার সাহায্যে অরিনকে তার রুমে শুইয়ে দিলো। এখন পুরুষ মানুষের খুব প্রয়োজন। তার বাবা একা কিই বা করবে। বয়স্ক মানুষ। তাইবা অরিনের ব্যাগ হাতরে ফোন বের করে ধূসরকে ফোন করলো। একবার রিং হতেই অপর পাশ থেকে রিসিভ হলো।

“ নিবেদিতা পৌঁছেছো?”

তাইবা ভাঙা গলায় বললো,,
“আমি তাইবা ভাইয়া। অরিনের আম্মু আর নেই। ওর অবস্থা ভীষণ খারাপ। শুনেই জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি কি আসতে পারবেন। ছেলে মানুষ নেই বাড়িতে আমার আব্বুর বয়স হয়েছে সে একা পারবে না”

ধূসর থামকালো সব শুনে। নিজেকে স্বাভাবিক করলো। নিবেদিতা তার বউ এতো বাজে পরিস্থিতির ভেতরে আছে। সে সব ভুলে গেলো। তাইবাকে বলল,,,
“আপু তুমি কিছুক্ষণ ওদিক খেয়াল রাখো আমি আসছি তাড়াতাড়ি। তুমি একটু দেখো অরিনকে আমি এখনি আসছি”

ধূসর কল কাটলো। সবে বাড়ি ফিরেছিলো। অরিনের অবস্থা জেনে সে বসে থাকতে পারবে না। জানুক সবাই তার বউ নিবেদিতা। ধূসর গায়ে শার্ট জড়িয়ে উমেদকে কল করলো। উমেদকে সাথে নিয়ে রওনা হলো অরিনদের বাড়িতে। পৌঁছে দেখলো বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা। তার আসতে ১৫ মিনিটের বেশি সময় লেগেছে। মহিলারা অরুনী শেখকে গোসল করাতে নিয়ে গেছেন। হায়াত নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে বসার রুমে। তোহা তার পাশে বসা। ধূসর হায়াতের সামনে গিয়ে বলে,,,

“তোমার আপু কোথায় হায়াত?”

হায়াত চোখ তুলে তাকালো। সে চিনে এই মানুষটাকে। কিছুদিন আগেই অরিন তাদের জানিয়েছে এটা তার দুলাভাই। তার আম্মু ভীষণ খুশি ছিলো বিয়ের ব্যাপারটা শুনে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো। উমেদ দেখলো হায়াতের মলিন মুখ খানা। তার খুব ইচ্ছে করছে হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। হায়াত ভাঙা গলায় বললো,,,

“ভাইয়া আপনি এসেছেন? দেখুন না আমার আম্মু উঠছে না। আপু ও কেমন শুয়ে আছে। সবাই এমন কেনো করছে বলুন না। উঠতে বলুন না ওদের। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাদের আর কেউ রইলো না ভাইয়া, কেউ না”

ধূসর কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। সে শুধু অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,,
“আমি আছি তো হায়াত। তোমার ভাইয়া আছে। আম্মুকে কি তোমাদের এমন অবস্থা দেখে খুশি হচ্ছে বলো? তুমি কেঁদো না। শান্ত হও। ভেঙে পরলে হবে বলো তো। তুমি না খুব শক্ত একজন মেয়ে। তোমার আপুর রুমটা?”

হায়াত হাতের ইশারায় দেখালো। ধূসর সেদিকে পা বাড়ালো। রুমে প্রবেশ করতেই চোখে পরলো তার নিবেদিতার মলিন নিস্তেজ দেহখানা। পাশেই তাইবা বসে আছে। তাইবা ধূসরকে দেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ধূসর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার বউয়ের দিকে। পাশে বসে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর অরিন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। অরিনকে চোখ খুলতে দেখে ধূসর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অরিন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। মায়ের কথা মাথায় আসতেই পাগলামি করা শুরু করলো। ছুটে বের হতে চাইলো। ধূসর হাত টেনে নিজের কাছে আনলো। শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের সাথে। অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

“ধূসর ছাড়ুন আমায় আমার আম্মার কাছে যাবো আমি। আমার আম্মা ধূসর আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকে ফেটে যাচ্ছে। আমি কি করবো। ধূসর বলুন না আমার আম্মাকে ঠিক হতে।”

অরিন ধূসরের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিল ঘুষি মারলো ধূসরের বুকে। তবে নিজেকে ছাড়াতে ব্যার্থ হলো। ধূসর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,,,
“শান্ত হও বউ। একটু শান্ত হও। তুমি এমন করলে হায়াতকে কে সামলাবে। ও তো অনেক ছোট। ভীষণ ছোট তুমি এমন করলে ওকে যে সামলানো যাবে না। আল্লাহ তায়ালা যা ভালো বুঝেন তাই করেন শান্ত হও তুমি”

“ধূসর আমার বুকটা খা খা করছে। যার মুখ দেখে রোজ সকালহয় আমার তাকে আর দেখতে পারবো না। তাকে ছুঁতে পারবো না। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ও ধূসর এনে দিন না আমার মাকে।আমার মা তো গত কাল রাতেও ঠিক ছিলো তবে এক রাতের ব্যবধানে কি হলো”

ধূসর চুপ। কি বলবে সে। মেয়েটা বাপ মা দু’জনকেই হারালো। এই বয়সে কতটা পরিশ্রম করে। নিজের মা বোনকে ভালো রাখার জন্য। তার দুনিয়া ছিলোই দু’জন মানুষকে নিয়ে।তার ভেতর আর একজনই নেই। এখন পুরো পৃথিবীতে তাদের আর বাপ মা বলতে কেউ থাকলো না। অরিন বুঝলো কি না কে জানে হঠাৎ শান্ত কন্ঠে বলল,,,

“আমায় ছাড়ুন ধূসর আমি বাইরে যাবো হায়াতের কাছে।”

#চলবে~