আশার হাত বাড়ায় পর্ব-১৮+১৯

0
236

#আশার_হাত_বাড়ায় |১৮|
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের পরিবেশটা এখন ঠান্ডা ও নিস্তব্ধ।ব্যালকনিতে দাড়িয়ে এই পরিবেশ উপভোগ করছে ফারাজ।একাকীত্বের জীবনে লড়াই করছে পুরো দুনিয়ার সাথে।মেয়েকে নিয়ে পুরুষ হয়েও তাকে লড়াই করতে হয়।এটাই দুনিয়া।নারী পুরুষ বলে কথা নেই।লোকের আঙুল সবসময় একে অপরের দিকে তুলবেই।এটাও যে লোকের কাজ।মিমিকে নিয়ে আজ ফেস করলো।হয়তো ভবিষ্যতেও ফেস করতে হবে।কিন্তু মিমির তো দোষ নেই। ফারাজের নিজেরও দোষ নেই।তারপরও মিমির মায়ের করা কৃতকর্মের ফল পাচ্ছে মিমি।পুরোনো কিছু সাংসারিক জীবনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসে।ফারাজ যেনো ওগুলো দেখতে পাচ্ছে এখনও।এই তো কয়েকমাস আগেও অহনা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,”আমার একটা ব্ল্যাক কালারের গাড়ি পছন্দ হয়েছে।ভাবছি ওটা কিনে আমি আর মিমি ঘুরবো।একান্তই আমার আর মিমির জন্য হবে গাড়িটি।”

মুচকি হেসে অহনার কথায় রাজি হয় ফারাজ।বলে,আচ্ছা দিবো।আমার দুনিয়া আমার পরিবার।এদের জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিবো।”

অহনার এই ভালোবাসাটা যে শুধু লোক দেখানো ছিলো এটা বুঝতে পারেনি ফারাজ।কিভাবে বুঝবে?অহনা সবসময় বলে মিমি আর সে এটা ওটা নিয়ে থাকবে।বিদেশে থাকা ফারাজ যেনো দূরে থেকে ভেবে নিতো তার মেয়ে বউ মিলে সুখে আছে।বাসায় আসলে অহনা তাকে কোনোকিছু বুঝতেই দিতো না।এখন বুঝতে পারছে তার টাকা দিয়ে তার বউ অন্য পুরুষের কাছে যেতো।অতীত মনে পড়তেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো ফারাজের।ব্যালকনিতে থাকা সাজানো দেওয়ালে ইচ্ছামত বল প্রয়োগ করে ঘুষি দিতে থাকে।হাত ফেটে রক্ত পড়ছে কিন্তু ফারাজের রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না।অহনাকে ভালোবেসে বিচক্ষণ ফারাজ পুরোটাই অন্ধ হয়ে যায়।অহনার দেওয়া ধোকাকে ভালোবাসা ভেবে জীবনকে উপভোগ না করে বরং নষ্ট করে দিলো।আজ সেই অহনাকে শাস্তি দিলেও শান্তি নেই তার জীবনে।

ফুটো টিনের মধ্য দিয়ে পানি পড়তে থাকে।নিচে বালতি পেতে আছে শ্রেয়া ও রিমলি। খাট ভিজে গেছে কিছুটা।খাটের এক কোনায় শুকনো জায়গায় ঘুমোচ্ছে সৃষ্টি বেগম।শ্রেয়া আর রিমলি নিচে বিছানা পেতে গল্প করছে।ফ্যান বন্ধ করে রেখেছেন সৃষ্টি বেগম।তার ভাষ্যমতে,”এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফ্যান চালিয়ে কারেন্ট বিল বাড়ানোর কোনো মানে নেই।”

মায়ের কথার দ্বিমত করলো না দুই বোন। রিমলি ছোট করে বলছিলো,”কিপ্টে মা।”

সৃষ্টি বেগম চোখ গরম দেখিয়ে শুয়ে পড়েন।শ্রেয়া শুতে যাবে রিমলি বলে ওঠে,”এখনই ঘুমাবে?”

উঠে বসে শ্রেয়া।বলে,”কত রাত হয়েছে দেখেছিস?সকালে অফিসে যেতে হবে।কিছু মডেল আসবে।ওদেরকে নিয়ে আবার ড্রেস সিলেক্ট করতে হবে।অনেক কাজ।এখন ঘুমাই।”

“ধুর!তোমার কাজের জন্য একটু গল্পও করতে পারি না।সন্ধার পর বাসায় এসে তো সেই ঘর গোছাতে থাকো।তারপর খেয়েদেয়ে ঘুম।আবার সকালে চলে যাও অফিসে। একটুও সময় দেও না আমাকে।”

মিষ্টি হেসে রিমলির সামনে এসে বাবুদের মত আসন করে বসলো শ্রেয়া।বলে,”আচ্ছা দুই বোন মিলে এখন গল্প করব। বল কি বলবি?”

রিমলি কিছুক্ষণ শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকালো।দেখলো ফুরফুরে মেজাজের শ্রেয়াকে।শ্রেয়ার মুখটা আগের থেকে উজ্জ্বল হয়েছে।গালের হাসিটা এখন লেগেই থাকে।বাবা বেঁচে থাকতে যে শ্রেয়াকে রিমলি দেখেছিলো সেই শ্রেয়াকে পুণরায় দেখতে পেলো রিমলি।খাটের কোনায় হাত রেখে একটু হেলান দিয়ে রিমলি বলে,”জীবনটা কেমন যেনো বদলাতে থাকে তাই না আপু।সুখ দুঃখ কোনোটাই যেনো স্থায়ী না।”

চোখমুখ ছোট ছোট করে শ্রেয়া বলে,”এমনটা কেনো মনে হলো তোর?”

“এই যে বাবা বেচে থাকতে কত হাসিখুশি ছিলে তুমি।বাবা মারা যাওয়ার পর মনটা আস্তে আস্তে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।তারপর বিয়ে করলে।সেখানে সুখ তোমার সাথে দেখা দেয়নি।কিন্ত যেই তুমি জীবনে নতুন ভাবে চলার চেষ্টা করেছো সুখেরা যেনো তোমাকে নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে।এই সুখ এই দুঃখ আবারও সুখ এভাবেই বদলাতে থাকে জীবন।”

ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শ্রেয়া।হাসির কারণে শ্রেয়ার মুখে টোল দেখা যায়।কিন্তু এই হাসিটা কিছুক্ষণ আগের থাকা ফুরফুরে থাকে না।এই হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে মন খারাপের দিকে।মনে পড়ে গেলো শ্রেয়ার আজ দুপুরের কথা।ফারাজ যখন মিমির স্কুলে শ্রেয়াকে নিয়ে যায়।শ্রেয়া কৌতূহল নিয়ে চেয়েছিলো স্কুলের ভিতরের ঘটনা দেখার জন্য।ড্রাইভার দ্বারা জানতে পারে মিমির ঘটনা।দারোয়ানের কাছে প্রশ্ন করে ড্রাইভার।তখন সব জেনে মিমির উপর মায়া হয় তার।মিমির চেহারা ভেসে আসতেই শ্রেয়া বলে,”আমাদের জীবনে আসা কিছু কিছু সুখ আবার অন্য মানুষের জীবনে দুঃখ নিয়ে আসে।সে যেমন ভাবেই হোক।আমার সুখে কেউ দুঃখী তো কারো সুখে আমি দুঃখী।”

কৌতূহল নিয়ে রিমলি বলে,”কিছু হয়েছে আপু?”

শ্রেয়া সব ঘটনা খুলে বলে রিমলিকে।সব শুনে আফসোসের সুরে রিমলি বলে,”এমন মাও হয়!কিভাবে পারে মেয়ের এমন অন্ধকার জীবন গড়ে দিতে?কিছু করার আগে অন্তত সন্তানের কথা ভাবা উচিৎ ছিল।তোমার বস অনেক ভালো মানুষ।দেখো তাদের জীবনটাও একদিন আলোকিত হবে।”

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শ্রেয়া বলে,”মিমির জীবনটা আলোকিত হোক এটাই চাই।ছোট মেয়েটার জীবনে আর কোনো অন্ধকার না আসুক।বাবা মা থাকা একটা সন্তানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা আমি বাবা হারানোর পর বুঝেছি।আজ মিমিকে দেখে বুঝলাম।জানিস আমার কোলে যখন ও মাথা রাখে ওর হার্টবিট আমি কেমন জানি বুঝতে পারছিলাম।মিমির গায়ের গরম উষ্ণতা তো অহনার মাতৃত্বে ভালোবাসা উপলব্ধি করার কথা।আমি যেটা দূরের কেউ হয়ে পেলাম অহনা মেয়েটা কেনো পেলো না?বিয়ের পর মা যখন বলতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা নে দেখবি ভালো লাগবে আমি তখন লজ্জা পেতাম।আবার ভাবতাম আমার একটি বাচ্চা হবে।আমি তাকে এভাবে বড় করবো এভাবে ওকে নিয়ে ঘুরবো।আমাকে আদুরে কণ্ঠে মা বলবে।সেখানে অহনা মেয়েটা মা হওয়ার পরও কিভাবে মেয়ে থুয়ে এসব করে?আমি না মিমি মেয়েটার কষ্টটা দেখে নিজেকে সত্যি লাকি মনে করি।অর্থ সম্পদ কম থাকুক কিন্তু আমি আমার বাবা মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি।তাদের দেওয়া শিক্ষা তাদের দেওয়া ভালোবাসা অন্তত আমার জীবনের এক অংশকে আলোকিত করেছে।কিন্তু মিমি মেয়েটা তো ছোট থেকেই অন্ধকারে ডুবে গেলো।”

বলেই চোখের পানি ফেলতে থাকে শ্রেয়া। রিমলি শ্রেয়ার চোখের পানি মুছে বলে,”মিমি মেয়েটা অনেক স্ট্রং আপু।তুমি চিন্তা করোনা।দেখবে ওর জীবনটা আলোকিত হবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।তুমি একটু ওকে ভালোবেসো আদর যত্ন করো।ও যখন তোমার কাছে আসে ওকে ভালোবেসে আঁকড়ে নিও।মেয়েটার অন্য সময় যেমন কাটুক তোমার সাথে থাকার সময়টাতে যেনো মেয়েটা হাসিখুশি ভালো থাকে।দেখবে তুমিও শান্তি পাবে।”

মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝিয়ে দিলো শ্রেয়া।দুই বোনের কথাগুলো খাট থেকে শুনছিলো সৃষ্টি বেগম।তিনি ঘুমাননি।শুয়ে ছিলেন।কিন্তু শ্রেয়া ও রিমলিকে বুঝাতে থাকেন তিনি ঘুমিয়ে গেছেন।মেয়েদের এখন আলাদা রুম নেই।তাই তো মেয়ে দুজন আলাদা গল্প করতে পারে না।কখনও কখনও মা বাবার সামনে গল্প করা যায় না।কিছু কথা মা বাবার সামনে বলতে সন্তানদের লজ্জা করে। বন্ধু বা বোন থাকলে মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারে।এটা সৃষ্টি বেগম বোঝেন।তাই তিনি এখন ওদের কিছু না বলে চুপ করে আছে।অন্যদিকে ফিরে কথাগুলো শুনে তার নিজের চোখটাও ভিজে গেছে। আস্তে আস্তে পানীগুলো গড়িয়ে পড়ে বালিশে।ভিজতে থাকে বালিশ।তার স্বামী বেচে থাকলে মেয়েটার এমন অবস্থা হতো না।তিনি সমাজ চিনতে পারে না।ঘরকুনো সৃষ্টি বেগম জীবনে যে শিক্ষা পেয়েছেন সন্তানদের জন্য তাই করছেন।কাজ কর্ম করা বরের মার খাওয়া এছাড়া শ্বশুরবাড়ির খোচা শোনা তার একটা অভ্যাস ছিলো।গ্রাম্য পরিবেশে থাকায় তিনি এত আধুনিক মন মানসিকতার ছিলেন না।যার কারণে রনির মত ছেলের সাথে বিয়েটা হয়ে যায়।

খাটের এক প্রান্তে শুয়ে এ কাথ ও কাথ করছে অহনা।বিরক্ত লাগছে তার। ফোনটাও সেদিন এক্সিডেন্টে ভেঙ্গে যায়। রাগে নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করছে এখন।অহনার পাশেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে মিসেস নাজমা।গাল হা করে নাক ডাকছেন তিনি।লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।রাতের অন্ধকারে ভয় করে তার।জ্বলন্ত সাদা লাইটে চোখ বন্ধ রাখলেও লাল আভাস দেখে তার শান্তি লাগে।বুঝতে পারে চারিদিকে আলো ছড়িয়ে আছে।কিন্তু অন্ধকার দেখলে তার ঘুম ভেংগে যায়।স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি লাইট অফ করে ঘুমাতে পারেনা।মিসেস নাজমা অহনাকে বলেছিলেন,”আজ থেকে আমার সাথে ঘুমাবে তুমি।ফজরের নামাজ পড়তে উঠবে।আমি এলার্ম দিয়ে রেখেছি।নামাজ পড়ে তারপর আমি কুরআন শরীফ পড়বো আর তুমি শুনবে।দেখবে মনটা পবিত্র লাগছে।এই খিটমিটে ভাব থাকবে না।”

মিসেস নাজমার কথা শুনে অহনার মেজাজ আরো বেশি গরম হয়ে গেলো।কিন্তু না পেরে সে চুপ আছে।মিসেস নাজমা এই রাগকে পাত্তা না দিয়ে ঘুমোতে থাকেন।হঠাৎ ফোনের আওয়াজ পেয়ে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে অহনা।মিসেস নাজমার ফোন বেজে উঠেছে।অহনা একটু উচু হয়ে ফোনটা হাতে নেয়।স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম ‘ কবীর ‘।রিসিভ না করার কারণে প্রথম কল কেটে যায়।দ্বিতীয়বার কল আসতেই অহনা নিজে কেটে দেয়। আবারও কল আসে মিসেস নাজমার ফোনে।এবার ফোন রিসিভ করে অহনা বিরক্তি নিয়ে বলে,”এভাবে রাতের বেলা একজন বুড়িকে কল দিতে বিবেকে বাঁধে না?”

আমেরিকার একটি বিলাস বহুল ঘরে বসে দাদীকে কল দিতে থাকে কবীর।এখন তার সময় হয়েছে কল দেওয়ার।ওখানে এখন দিন।সারাদিনের ব্যাস্ততায় দাদীর সাথে কথা বলতে পারে না।দাদীকে ভালোবাসে খুব।তাই কল দিলো।কিন্তু দাদীর কণ্ঠ না পেয়ে অন্য কারো কণ্ঠ পেয়ে কবীর বলে,”তুমি কে?”

অহনা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,”তুমি কে যে এত রাতে কল দেও?”

“তুমি যার ফোন নিয়েছো আমি তার ছেলের ছেলে।এখন দাদীকে ফোন দেও।”

“তোমার দাদী ঘুমাচ্ছে। কাল কথা বলো।”
বলেই কল কেটে দিলো অহনা।অবাক হলো কবীর।তারপর মনে পড়ল এখন তো বাংলাদেশে রাত।তাও আবার গভীর ঘুমের সময়।তাই আর সে ফোন দিলো না।অহনা ফোনটি পাশে রাখবে ওমনি মনে পড়লো মিসেস নাজমা বলেছিলো ওনার এলার্ম দেওয়া আছে।অহনা এলার্ম বন্ধ করে দিলো।তারপর শয়তানি হেসে বিড়বিড় করে বলে,”বুড়ি তুমি নিজেও আরামে ঘুমাবে আর আমিও আরামে ঘুমাবো।”
কথাগুলো বলেই শান্তিতে শুয়ে পড়ে অহনা।

******
ফজরের আজান কানে ভেসে আসে অহনার।সাথে ভেসে আসে মিসেস নাজমার ডাক।অহনাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তিনি বলেন,”এই মেয়ে ওঠো ঘুম থেকে।আজান দিচ্ছে এখন।”

অহনার কোনো সাড়া শব্দ নেই।সে ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে।স্বপ্ন ভেবেই ঘুমের ঘোরে মিটমিট হাসতে থাকে অহনা।কিন্তু এই শান্তির ঘুম স্থায়ী হলো না।মুখের উপর পানি পড়তেই ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতে হলো তাকে।এক লাফে উঠে বসলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো মিসেস নাজমার হাতে জগ।রেগে গিয়ে অহনা বলে,”সমস্যা কি আপনার?ঘুমের মধ্যে মুখে পানি দেন কেন?”

“ফজরের আজান দিয়ে দিছে।এখন ওঠো।আমি যা যা বলব তাই করবে। আর হ্যাঁ মুখের উপর না বলবে না।তুমি আমার কেয়ার টেকার।”

চোখ মুখ ফুলিয়ে অহনা মা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।মিসেস নাজমা আবার বলেন,”আমার এলার্ম শুধু ফোনে দেওয়া থাকে না।আমার কাছে ঘড়ি আছে।তাও একটা না দুইটা।এই সবগুলোতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাই আমি।”

অহনা হা হয়ে গেলো।কিন্তু কিছু বললো না।মিসেস নাজমা তাড়াহুড়া দিয়ে বলেন,”এখন যাও তাড়াতাড়ি আমার হুইল চেয়ার নিয়ে আসো।আমাকে নিয়ে বাথরুমে চলো।অযু করতে হবে।”

মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে চলে গেলো অহনা।এটা দেখে মিসেস নাজমা বিড়বিড় করে বলেন,”খারাপ কে কিভাবে ভালো পথে আনতে হয় এটা এই নাজমা খুব ভালো করে জানে।তুমি তো সোজা পথে আসবেই।”

পুরোনো কিছু কাপড় নিয়ে ঘর মুছতে থাকে শ্রেয়া আর রিমলি।ঘরের নিচ থেকে পানি উঠতে থাকে।পুরোনো টিনের বাড়িতে এই একটাই কষ্ট।ঝড় বৃষ্টি হলে পানি উঠবে।শ্রেয়া জেনে বুঝেই ভাড়া নেয় এই ঘর।সৃষ্টি বেগম রান্না চাপিয়েছেন।সব পরিষ্কার হওয়ার পর শ্রেয়া ওর মা আর বোনের দিকে তাকায়।খারাপ লাগে ওর।এখানে ওর মা আর বোন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।ভালো কোনো ঘর দেখতে হবে তাকে।কথাগুলো ভেবে অফিসের জন্য তৈরি হয় শ্রেয়া। রিমলি মন খারাপ করে আছে।শ্রেয়া আয়নার মধ্যে রিমলির প্রতিবিম্ব দেখে বলে,”তোর আবার কি হলো?”

মন খারাপ করে রিমলি বলে,”আমার ছাত্র ছাত্রীদের মা কল করেছিলো।বলেছে ওদের নাকি পরীক্ষা।এমন সময় এত গ্যাপ দিলে হয় না।ওরা মনে হয় নতুন টিচার দেখবে।”

হিজাব বাঁধতে বাঁধতে শ্রেয়া বলে,”তাহলে দেখুক নতুন টিচার।”

মুখ ভেংচে রিমলি বলে,”হ্যাঁ তাই তো! যা একটু হাত খরচ ওই ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ায় পাই ওগুলো উঠে যাক।ওরা হাত থেকে ফসকে গেলে আমি যশোরে গিয়ে কাদের পড়াবো?”

“যশোরে যাবি কেনো?”

“ওমা তোমার এই বাড়িতে কয়দিন থাকবো?মা তো বলেছে আর তিন চারদিন থেকেই চলে যাবে।”

রান্নাঘরে কাজ করছিলেন সৃষ্টি বেগম।গলা উঁচিয়ে শ্রেয়া বলে,”তোমরা কি যশোরে যাবে মা?”

সৃষ্টি বেগম বলেন,”হ্যাঁ রে।অনেকদিন তো হলো থেকেছি।এবার যশোরে যাওয়া লাগবে।”

“কিন্তু যাওয়ার দরকার কি?এখানে থাকো তোমরা।আমরা সবাই তো এখানেই ভালো আছি।”

ফোড়ন কাটল রিমলি।বলে,”আমার এখন কলেজে ভর্তি হতে হবে।পড়াশোনা তো করতে হবে তাই না?”

শ্রেয়া কোমড়ে হাত রেখে রিমলিকে খোচা মেরে বলে,”কত বই পড় তুমি?যশোরের কলেজে পড়তে হবে না।ঢাকায় কোনো সরকারি কলেজে ভর্তি করায় দিবো তোকে।”

কিছুক্ষণ খুশি হলেও মন খারাপ করে রিমলি বলে,”এখানকার দ্রব্যমূল্য যে হারে বৃদ্ধি পায় আমি এখানে থাকবো না।সবকিছুর কেমন চওড়া দাম।আবার আমার টিউশনির ব্যাবস্থা নেই।নিজে তো তাও যশোরে থাকলে কিছু করতে পারি।অন্তত প্লে নার্সারি কেজি এদের পড়ালেও আমার হাত খরচ আমি উঠাতে পারি।”

শ্রেয়া জানে রিমলি একটু সেল্ফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট টাইপের।ও কারো কাছে কিছুই চাইতে পারে না।শুধু নিজের যোগ্যতায় চলে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে শ্রেয়া বলে,”ড্রাইভার আংকেলের বউয়ের সাথে তো ঘুরঘুর করিস সারাদিন।ওনার কাছে একটু বল যে তুই ছোট ছোট ছাত্র ছাত্রী খুজতেছিস।কলেজ করে এসে এখানে বাচ্চাদের পড়াবি।”

রিমলি কিছু বলার আগে সৃষ্টি বেগম বলেন,”সে নাহয় হলো।কিন্তু আমি যে কিছু কাঁথা বুনে দু এক টাকা আয় করি।তার কি হবে?এখানে তো আর ওসব চলবে না।কে নিবে আমার বানানো কাঁথা?আমার যা একটু আয় হয় তাও চলে যাবে।তোর এত খরচ করতে হবে না।”

“আরে মা তুমি জানো না।যশোরের থেকে ঢাকায় কাঁথার প্রতি মানুষের ঝোক বেশি।যশোরে তো যেখানে সেখানে নকশী কাঁথা বুনে দেয়।কিন্তু এখানে এতকিছু হয় না।যে যার মতো ব্যাস্ত।আমার কাছে তাই দু একজন আন্টি এসে বলতেন,ভালো কাঁথা পেলে ভালো হয়।বাজারে যে দাম কিনতে কষ্ট।তুমি যে সুন্দর কাঁথা বুনো ওগুলো ঢাকায় চার হাজারের নিচে নেই।তুমি তো এখানেই কাঁথা বুনতে পারবে।আর আশেপাশে লোকজন দেখলে এমনি এগিয়ে আসবে।”

খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে রিমলি।হাত তালি দিয়ে বলে,”তাহলে তো হয়েই গেলো।আমরা এখানে থাকবো।আমি ঢাকায় পড়াশোনা করবো।অনেক ভালো লাগছে।”

সৃষ্টি বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,”যেটা ভালো হয়।তাহলে তো যশোর থেকে কিছু ফার্নিচার আনতে হবে।এখানে তো এভাবে থাকা সম্ভব না।”

শ্রেয়া ব্যাগে টাকা রাখতে রাখতে বলে,”নতুন ঘর দেখতে হবে মা।এখানে এমনিতেও থাকা সম্ভব না।আমি ড্রাইভার আংকেলকে বলেছি।উনি আমাকে কিছু বাড়ির অ্যাড্রেস দিয়েছিলো।ওগুলো নিয়ে ঘর খুঁজতে হবে।যেটা ভালো লাগে একটু সাধ্যের মধ্যে পাবো ওটাই নাহয় ভাড়া নিবো।”

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সৃষ্টি বেগম।শাড়ির আচল তার মাথায় ছিলো।মুখে গুজে কান্না করে দেন।শ্রেয়া আর রিমলি অবাক হয়ে বলে,”কান্না করছো কেনো?”

সৃষ্টি বেগম বলেন,”বাবা মায়েদের দায়িত্ব সন্তানদের আগলে রাখা।আর আমি কিনা তোদের উপর নির্ভর।তোদের জীবনে সুখ তো এনে দিতে পারলাম না।উল্টো তোর ঘাড়ে চেপে আছি।এমন অভাগা মা হওয়ার চেয়ে না হওয়া ভালো।”

কষ্ট পেলো শ্রেয়া। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”এভাবে একদম ভাববে না।মা বাবা কেনো শুধু সন্তানকে দেখবে।সন্তানও তো মা বাবাকে দেখবে।এতে কি এমন ক্ষতি?সন্তানের টাকায় মা বাবা চলাটা কি অন্যায়?”

সৃষ্টি বেগম মাথা নাড়ালেন।তিনি যতই বলুক শ্রেয়া বুঝবে না।সৃষ্টি বেগম কোনো কিছু সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না।কিন্তু শ্রেয়াকে এইভাবে কষ্ট করতে দেখে মা হিসেবে তার বুক চিড়ে আসে।কোনো বাবা মা চায় না তার সন্তান তাদের জন্য কষ্ট করুক।কিন্তু এটা একদিকে আলাদা এক ভালোলাগাও কাজ করে।সৃষ্টি বেগমের ভালো লাগলেও আবার তিনি মেয়ের কষ্ট দেখলে নিজেই কষ্ট পান।

চলবে…?

#আশার_হাত_বাড়ায়|১৯|
#ইশরাত_জাহান
🦋
মাত্র অফিসে এসে পৌঁছালো শ্রেয়া।আজ একটু দেরি হয়ে গেছে।প্রথমে ঘর ভর্তি পানি পরিষ্কার করে আসতে হয়েছে তারউপর রাস্তায় ভিড়।ফারাজ আসার অন্তত পাঁচ মিনিট আগে এসে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে তাকে।কিন্তু এখন যে সময় তাতে ফারাজ এসেছে আরো দশ মিনিট আগে।ঘড়ি দেখে তাড়াহুড়া করে লিফটের দিকে গেলো শ্রেয়া।লিফটের দিকে চোখ যেতেই শ্রেয়া যেনো আবারও ভয় পেলো।ফারাজ মাত্র লিফটে উঠেছে।এখন দেরি হওয়ার জন্য হয়তো এখান থেকেই বকা খেতে হবে। মনে মনে শ্রেয়া বলে ওঠে,”আজ পেট ভরে ভাত খাইনি কিন্তু স্যারের বকা খাবো।”

শ্রেয়া দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথাগুলো ভাবতে থাকে ঠিক তখন তার কানে ভেসে আসে ফারাজের কথা।নিজের হাতে থাকা ফোন টিপতে টিপতে ফারাজ বলে,”এভাবে দাড়িয়ে থাকলে দেরি হয়ে যাবে মিস শ্রেয়া।লিফটে এসে এভাবে সময় নষ্ট করে দাড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।দ্রুত কাজ করতে শিখুন।”

ফারাজের সব কথার মধ্যে একেকটা উক্তি থাকে।শ্রেয়া বুঝলো তাকে লিফটে উঠতে বলা হয়েছে।কিন্তু সরাসরি না উল্টোভাবে বুঝিয়ে।লিফটে ঢুকেই মনে মনে আওড়ায়,”এত না পেচিয়ে শুধু লিফটে উঠতে বললেই তো হয়।এভাবে পেচানোর মানে কি বুঝি না!”

ফারাজ লিফটের বাটন চেপে ধরে।সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।শ্রেয়া অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ফারাজের সাথে এভাবে বদ্ধ হয়ে থাকতে তার ইতস্তত লাগছে।ফারাজ নিজ মনে ফোন চালিয়ে যাচ্ছে।শ্রেয়া লিফটের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।যেনো লিফটা কত সুন্দর।আটতলা বিল্ডিং পার করে এবার লিফট যাবে নয় তলাতে।কিন্তু ঠিক তখনই হালকা ভূমিকম্প অনুভব করলো শ্রেয়া আর ফারাজ।ফারাজ এক হাত নিজের পকেটে রেখেছিলো আরেক হাত দিয়ে ফোন টিপছিলো।এভাবে কাপতে দেখে আশেপাশে ভালোভাবে তাকালো সে।শ্রেয়া তো ওখানেই ভয়তে জমে গেছে।চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়া শুরু করেছে।হঠাৎ করেই লিফট থেমে গেলো।চোখ খুলে শ্রেয়া দেখলো লিফটের লাইট বন্ধ হয়ে গেছে।শুধু ফারাজের ফোনের আলোর জন্য লিফট আলোকিত আছে। ফারাজের দিকে মাথাটা ঘুরালো শ্রেয়া।বিড়বিড় করে এখনও বিপদের দোয়া পড়ছে।তাকিয়ে দেখলো ফারাজ ফোন টিপছে।কাপা কাপা মাথা নিয়ে আরেকটু উকি দিলো।দেখতে পেলো ফারাজ কারো নাম্বার খুঁজতে থাকে।কাঙ্ক্ষিত নাম্বার পেয়ে ফারাজ কল করে লিফট সম্পর্কে বলে দেয়।শ্রেয়ার দম বন্ধ হয়ে আসার মত।লিফট বন্ধ তার উপর কারেন্ট নেই।একটু আগে যেভাবে লিফট কেপে উঠলো তাতেই শ্রেয়ার মাথা ঘুরছে।লিফটের মধ্যে আলাদা এক গন্ধ থাকে।যার ফলে সাধারণ মানুষ বেশিক্ষণ থাকলে সেও অসুস্থ হয়ে যাবে।ওড়না দিয়ে নাকে ধরে শ্রেয়া দেখলো ফারাজকে।একদম রোবটের মত দাঁড়িয়ে আছে।ফোনটা এখন আর টিপছে না।শুধু লাইট জ্বালিয়ে এক মনে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে।মিনিট দশ বিশ হয়ে এলো কারো খোঁজ নেই। আর ফারাজ রোবট হয়ে আছে।এদিকে শ্রেয়ার গা গুলিয়ে এসেছে।নিচে বসে পড়ে সে।ফারাজ এবার শ্রেয়ার দিকে তাকালো।শ্রেয়ার মধ্যে ভীতু ভাব দেখে ফারাজ বলে,”আপনি কোনো বাচ্চা না মিস শ্রেয়া।নিজেকে স্ট্রং রাখতে শিখুন।বিপদে আপনাকে কেউ সাহায্য করতে আসবে না।আপনার নিজেকে সামলে চলতে হবে।সব পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে থাকতে হবে।এছাড়া বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখতে হবে।আপনার মাথায় রাখা উচিত লিফটে আপনি ছাড়াও আরও একজন আটকে আছে।তাই ক্ষতিকর কিছু হবে না। হলে এতক্ষণে সেভাবেই স্টেপ নিতাম আমি।কাজ চলছে বাইরে।একটু পর লিফট চালু হবে।”

শ্রেয়া একবার একটু ফারাজের দিকে তাকালো।দুই সেকেন্ড মত দেখে চোখ সরিয়ে নেয়।মনে মনে বলে,”আপনি মানেই তো একটা ভয়।তার উপর আছি দম আটকানো ছোট গন্ধ জায়গায়।গাড়িতে যেমন পেট্রোলের গন্ধ থাকে এমন বিদঘুটে।ভালোভাবে বললেই তো হয়।যে টেনশন করার কিছু নেই। তা না ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলে।”

কিছুক্ষণ পরই লিফটের লাইট জ্বলে ওঠে।লিফট আবারও চালু হয়।গন্ধটা এখনও আছে।ফারাজ বলে,”লিফটের কাজ চলছিলো তাই এমন গন্ধ।একটু সমস্যা গিয়েছিলো লিফটে।যাওয়ার সময় কিছু অফিস কলিগের নাম্বার নিয়ে যাবেন।একা একা এমন কিছু ফেস করলে ওদের কল করলেই হবে।”

ফারাজের কথা শুনে শ্রেয়া স্পষ্ট ভাবেই বলে,”ওকে স্যার।”

লিফট নাইন ফ্লোরে আসতেই দরজা খুলে গেলো।প্রথমে ফারাজ বের হয় তারপর শ্রেয়া।সবাই তাকিয়ে দেখছে সেদিকে।ফারাজকে দেখে সবাই দাড়িয়ে আছে।এনি দেখতে থাকে সোজা পথে আসা ফারাজ ও শ্রেয়াকে।আনমনে বলে ওঠে,”হ্যান্ডসাম এন্ড শেহনাজ আর লুকিং জাস্ট পারফেক্ট।”

পাশেই দাড়িয়ে ছিলো অর্পা।অর্পা মিমি অহি ও ফারাজের পুরো পরিবার এসেছে আজ।সেলিব্রেটি মিথিলা আসবে বলে সবাই এক্সাইটেড।এনির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অর্পা এমন কিছু শুনে কিছুক্ষণ ফারাজ ও শ্রেয়াকে দেখতে থাকে।তারপর সেও খুশি হয়ে বলে,”আমি তো এমন ভেবে দেখিনি।আসলেই তো এদের পারফেক্ট লাগছে।”

এনি ঘুরে দাড়ালো অর্পার দিকে।তারপর বলে,”শেহনাজ তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আই মাস্ট সে তোমাদের মধ্যে বন্ডিংটা অনেক সুন্দর।তুমি যেমন শেহনাজও তেমন হবে।”

“ও অনেক ভালো।একদম ইনোসেন্ট।আমাদের ফ্রেন্ডশিপে আর কেউ আসতেই পারেনি।কারণ আমরা একে অপরের জন্য বেস্ট ছিলাম।ছোটবেলা থেকেই ও আমাকে নিজের সাথে আগলে রেখেছে।আমাকে ওদের ফ্যামিলি মেম্বার এর মত ট্রিট করতো।”

“ওয়াও!আমাদের হ্যান্ডসাম আর শেহনাজ দুজনেই ইনোসেন্ট পারসন।সাথে ওদের লাইফটাও একই রকম।টক্সিক পার্টনারের জন্য এরা দুজনেই আজ ভিন্ন কিছু ফেস করছে।আই থিঙ্ক বাট নট শিওর হ্যান্ডসামের পাশে শেহনাজকে মানিয়েছে।”

অর্পা খুশি হয় খুব।কিছুটা এক্সাইটেডের সাথে বলে,”আমাদের শ্রেয়া অনেক ভালো ম্যাম। ও তো দেখতেও অনেক কিউট।এখন তো রোদে পুড়ে চামড়ার এই অবস্থা।যশোরে যখন ঘরকুনো হয়ে থাকতো তখন ওকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগত।ও তো আমাদের মত বাইরে তেমন বের হয়না।ছোট থেকেই ওকে দেখলে ভাবতাম কিভাবে ওর মতো উজ্জ্বল থাকবো সুন্দর হবো।পরে দেখি আমি তো বাইরে বাইরে বেশি ঘুরি।রোদে পুড়ে এই অবস্থা। রিমলি আর আমি একটু ঘুরে বেড়াতে বেশি পছন্দ করতাম।ও ঘরে বসে থাকতো।স্কুল কোচিং আর বাসা।এত সুন্দর একটা মেয়ের বিয়ের পর বাজার করা বাইরে থেকে এই আনা ওই আনা তারউপর নির্মম অত্যাচারে মেয়েটার মুখটা এমন হয়েছে।”

বলেই কষ্ট পায় অর্পা।তারপর ভাবে সে তো একটু বেশিই কথা বলছে।এনির দিকে তাকালে এনি হেসে দেয়।অর্পা মৃদু হেসে বলে,”আসলে আমি একটু বেশি কথা বলি।”

এনি আলতো হেসে বলে,”আই নো অর্পা।তুমি একজন ফ্রেন্ডলি পারসন।এটাই বেস্ট তোমার জন্য।মনের কথা চেপে না রেখে প্রকাশ করে দেও। আই লাইক ইট।”

শ্রেয়ার চোখ গেলো অর্পার দিকে।অর্পাকে দেখে শ্রেয়া অবাক হয়ে গেল।খুশি হয়ে তাকালো অর্পার দিকে।অর্পা নিজেও মৃদু হাসি দেখায়।ঠিক তখনই শ্রেয়ার কোলে দৌড়ে আসে মিমি।শ্রেয়ার ভাবনার বাইরে ছিলো।মিমিকে দেখেনি সে।তাইতো হঠাৎ করে মিমি আসাতে অবাক।শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে মিমি বলে,”তুমি আর পাপা লিফটে আটকে গেছিলে শুনে আমি অনেক ভয় পেয়েছি।”

অর্পা এসে মিমিকে নিয়ে বলে,”সে কি কান্না মিমির।যেই শুনেছে তোরা লিফটে আটকে গেছিস।এখন একটু শান্ত হলো।”

ফারাজ চলে গেলো তার কেবিনে।শ্রেয়া মিমির মুখে হাত দিয়ে আদর করে বলে,”তুমি তাহলে এখানে আড্ডা দেও আমি ফাইল নিয়ে আসি।একটু পর মডেল আসবে।”

“ওকে।”(মিষ্টি হেসে মিমি বলে)
শ্রেয়া চলে যায় তার কেবিনে।ফারাজ আজকের জন্য যে ফাইল তাকে কাছে রাখতে দিয়েছিলো ওগুলো দেখতে থাকে।ডিজাইনগুলো আবারও দেখে নেয় শ্রেয়া।সাথে খরচের হিসাবটাও করতে থাকে। একটু পর ডিজাইন ও কাপড়ের সাথে ভিন্ন কি কি খরচ হবে এগুলো পাই টু পাই বুঝিয়ে দিবে ফারাজকে।

*********
এই নিয়ে সাত আটটা বাড়ি ঘুরে দেখেছে রিমলি।সৃষ্টি বেগম এতক্ষণ ছিলো রিমলির সাথে।ওনার কোমরের ব্যাথা বেড়েছে।এখন আবার দুপুরের রান্নাও বাকি।তাই তিনি বাসায় যেয়ে রান্না করবেন।রিমলি একাই এখন বাকি বাড়িগুলো দেখবে।সৃষ্টি বেগম বলেছিলেন,”তোকে একা দেখতে হবে না বাড়ি।কি না কি হয়।”

রিমলি আশ্বস্ত দিয়ে বলে,”কিছু হবে না মা।শুক্রবার ছাড়া আপু সময় পায় না।আমাদেরকে এভাবেই দেখতে হবে। আর আমরা তো একই পাড়ায় আছি।সমস্যা নেই আমার।আমি পারবো বাসা দেখতে।”

রিমলির জোরাজোরিতে সৃষ্টি বেগম চলে যান একা।ড্রাইভার আংকেলের বউয়ের থেকে এড্রেস নিয়েছে বাড়িগুলোর।এমনিতেও বাড়ির সামনে টু লেট দেখে বোঝা যায় এই বাসা এখন ভাড়া দেওয়া হবে।টু লেটের নিচে বাড়িওয়ালার নাম্বার দেখে রিমলি কল করে তাকে।এভাবে কিছু বাড়ি দেখে।একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে যায় রিমলি।বাড়ির সামনের পরিবেশ নিরিবিলি।ফাঁকা একটা মাঠ আর পাশেই ছোট টিনের ঘর।দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা পুরোনো চায়ের দোকান।এখন বন্ধ হয়েছে।বাড়িটি একবার দেখে আবার সামনের পরিবেশ একবার দেখে।কিছুটা গ্রাম্য লাগছে।মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রিমলির মন ছুঁয়ে নিলো।বিশেষ করে সৃষ্টি বেগমের জন্য।তিনি খোলামেলা পরিবেশ পছন্দ করেন।কিছুক্ষণ খুশি থাকলেও শেষে কিছু একটা ভেবে মুখটা মলিন হয়ে যায়।এসব বাড়ি তো হাজার দশের উপরে নিবে।এতক্ষণ যেগুলো দেখছিলো ওগুলো তাই সর্বনিম্ন আট হাজার বলেছিলো।শ্রেয়াকে ম্যাসেজ দিয়ে বলে,”আপু একটা সুন্দর মনোরম পরিবেশ পেয়েছি।যেখানে থেকে আমরা কিছুটা স্বস্তি পাবো।বাড়িটি তিনতলা বিল্ডিংয়ের।সামনে ফাঁকা মাঠ।কিছু গাছপালা আছে।দেখতে সুন্দর।এটা কি দেখবো?”

শ্রেয়া তার মত ব্যাস্ত।এখন রিপ্লাই আসা সম্ভব না।তাই রিমলি একটু ফেসবুক নোটিফিকেশন দেখছে।শিহাব আইডি থেকে ম্যাসেজ,”জানেন লেখিকা আমিও না গল্পের হিরোদের মত এক হিরোইনের প্রেমে পড়েছি।কিন্তু বেচারি আমার দিকে তাকালো না।আচ্ছা আমার মনে হয় সেও গল্পের মতো করে আমাকে প্রথমে দেখবে না পাত্তা দিবে না।আমাকেই হিরো হতে হবে তাই না?”

শিহাবের এসব অহরহ ম্যাসেজ তাও অন্য মেয়েকে নিয়ে দেখে হেসে দিলো রিমলি।এই ম্যাসেজ কাল এসেছে।অতিরিক্ত ঝড় বৃষ্টির কারণে নেট সমস্যা ছিলো।তাই ম্যাসেজগুলো আজ দেখলো।রিমলির হাসির মাঝেই ওর ফোনে আবারও ম্যাসেজ আসে,”ওর হাসিটা না অনেক মায়াবী।আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি।একদম পিচ্ছি একটা মেয়ে।এই হবে পনেরো ষোলো বছর বয়স। শ্যাম বর্ণের মেয়ের চোখের পাতা গাঢ় কালো পাপড়ি মোটা মোটা ভ্রু আর.. আর বেশীদুর না যাই। আপাতত মুগ্ধকর বিষয়গুলো বললাম।পিচ্ছি মেয়েটিকে সূর্য বিলাস করতে দেখে যেনো আরো বেশি মনোমুগ্ধকর লাগছে।”

রিমলি এবার একটু অবাক হলো সাথে করে বিরক্ত।সে নিজেই তো ষোলো বছর বয়সী এক যুবতী।তাহলে তো সেও পিচ্ছি।এদিকে শিহাব কিনা তাকে আপনি বলে সম্বোধন করে ।রিমলিকে কখনও দেখেনি বলে কি বয়স বেশি মানতে হবে?ঠিক তখনই শ্রেয়ার ম্যাসেজ আসে। ফাইল চেক করে শ্রেয়া ফোন হাতে নিয়ে ওর আলাদা নোট প্যাডে কিছু ডিটেইলস রেখে দেয়।রিমলির ম্যাসেজ দেখে রিপ্লাই করে,”এমন বাসা দেখবি যেটাতে মা অনেক কমফোর্ট ফিল করবে।মায়ের শরীর এমনি দুর্বল।প্রাকৃতিক বাতাসের দরকার।”

“কিন্তু আপু ভাড়া অনেক হতে পারে।আগে যেগুলো মোটামুটি পছন্দ ছিলো ওগুলোই তাই হাজার এগারো বারো বলেছিলো।”

“ভাড়ার টাকা নিয়ে চিন্তা করবি না।তোর বোন এখন বড় এমাউন্টের চাকরি করে।তাই এখন সে তার মা আর বোনকে প্রানভরে সেবা যত্ন করবে।এই টাকা এই সবকিছু নিয়ে বসে থেকে লাভ কি?যদি আমি মেয়ে হয়ে আমার আমকে স্বাচ্ছন্দ্যে না রাখতে পারি।আমার বোন মা আর আমি এখন থেকে আনন্দে থাকবো।যতদিন ভাগ্যে আছে এভাবে চলব।অন্তত মাকে তো একটু সুখে রাখতে পারব।”

“আচ্ছা আপু তাহলে আমি বাড়িওয়ালাকে কল দিয়ে দেখি।”

“আচ্ছা বোন সাবধানে।”

রিমলি কল করে বাড়িওয়ালার নাম্বারে।উপর থেকে রিমলিকে দেখছিলো শিহাব।কিন্তু ওর একটা কথাও শুনতে পায়নি।হঠাৎ ল্যান্ড লাইনে কল আসে তার।শিহাব ওদিকে পাত্তা না দিয়ে দেখতে থাকে রিমলিকে।প্রথম কল কেটে যায়।রিমলি ঘেমে একাকার।এই গরমের মধ্যে চোখদুটো পিটপিট করতে থাকে ।শ্যামলা মুখে লালের আভাস হয়ে আছে।কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।মায়া হলো শিহাবের।বিরক্ত হয়ে রিমলি আবারও কল দেয় শিহাবকে।মাথার তালু গরম হয়ে গেছে।এদিকে তার ফোন ধরার কেউ নেই।ঘরের ফোন বাজার সাথে রিমলির কল দেওয়া মিলে গেছে দেখে শিহাব দৌড়ে গেলো ফোন রিসিভ করতে।শিহাব রিসিভ করতেই রিমলি বলে ওঠে,”আসসলামু আলাইকুম আংকেল।”

ভেবাচেকা খেলো শিহাব।এটা কনফার্ম যে ফোনের ওপাশে সালাম দেওয়া ব্যাক্তি রিমলি।কিন্তু তাই বলে আংকেল!এই সম্বোধন মেনে নিতে পারল না শিহাব।যার জন্য একজন লেখিকাকে তার প্রতি হওয়া মনের ভাব প্রকাশ করে সে এখন আংকেল বলছে।এটা মানা যায় না।শিহাব উপন্যাস প্রেমী।ঘরে তার নিজস্ব লাইব্রেরি আছে।ফেসবুকে কিছু কিছু লেখক/লেখিকাকে ফলো দিয়ে রাখে।যার গল্প মন ছুঁয়ে যায় তাকে প্রশংসা করে শিহাব।তাই তো লেখিকা ফারজানা ইয়াসমিন ওরফে রিমলিকে দেখে ফলো দিয়েছে।ফারজানা ইয়াসমিনের গল্পগুলো কিছুটা মন ছুঁয়ে নেওয়ার মতো তাই।শিহাব তাকে সিনিয়র কিছুই ভাবে।আসলে শিহাব অতি পার্সোনাল বিষয় ঘাটাঘাটি করে না।লেখার ধরণে মেচিউরিটি প্রকাশ পায়।বিশেষত স্ট্রং ক্যারেক্টার এমনটাই প্রকাশ করে।তাই তো ফারজানা ইয়াসমিন ওরফে রিমলির কাছেই সে তার মনের কথাগুলো বলে দেয়।মনের দুঃখে এখন ফোন কানে দাড়িয়ে আছে শিহাব।যার জন্য সুন্দরী মেয়েরা লাইন লাগিয়ে রাখে সে অবিবাহিত থেকে এক যুবতী কন্যার মুখে আংকেল শুনলো।রিমলি এতক্ষণ হেলো হেলো করে কোনো রেসপন্স না পেয়ে এবার কর্কশ কণ্ঠে বলে,”এই যে আংকেল আপনি কি কানে শুনেন না?সেই পাঁচ মিনিট যাবত আপনাকে তিনবার সালাম দিয়েছি আর বিশবারের উপরে হেলো বলে যাচ্ছি।আর কত?”

শিহাব কণ্ঠ মোটা করে বলে,”ওয়া আলাইকুমুস সালাম।আমি তোমার আংকেল না।”

“লিসেন আংকেল না দাদু এটা পরে দেখা যাবে।আমি বাড়ি ভাড়ার জন্য এসেছিলাম।কিন্তু আপনারা তো কোনো রেসপন্স করেন না।থাক আপনাদের মত আধ পাগলের বাসা না নেওয়াই ভালো।এই গরমে মানুষদের অপেক্ষা করায়।নিলাম না এই বাসা ভাড়া।”

রিমলির মুখে বাসা ভাড়ার কথা শুনে মুখে হাসি ফুটে উঠলো শিহাবের।মনে মনে বলে,”পাখি নিজে থেকেই ধরা দিলো।হুররে!”

রিমলি কল কাটতে যাবে ওমনি শিহাব বলে,”এই না না।আমি আসছি।তোমাকে ঘর দেখাই। আশা করি ভালো লাগবে।এক মিনিট।”

বলেই দ্রুত একটি ভালো টি-শার্ট পরে ছাতা হাতে নিয়ে চলে যায়।পিছনে গেটের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো রিমলি। ছাতা হাতে সাদা লুংগি পরা ও গায়ে টি শার্ট জড়ানো শিহাবকে দেখে অবাক।শিহাবকে দেখে চিনতে পারল।সেদিন বাজারে দেখা তাদের।শহরের ছেলেরাও লুংগি পরে।এটা দেখে অবাক রিমলি।ওদের দূরবর্তী কিছু আত্মীয় শহরে থাকে।লুংগি নিয়ে এমন ভাব করে যেনো লুংগি বাংলাদেশে কেউ কোনোদিন দেখেইনি। রিমলির নিরবতা দেখে শিহাব কিছুটা আন্দাজ করলো।আসলে এভাবে লুংগি পরা শহরে কম দেখা যায়।আজকাল বাঙালি পুরুষের এই ঐতিহ্য আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।শিহাব ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলে,”আসলে বাঙালি স্মার্ট পুরুষ নিজের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে না।কিন্তু আমি নিজেকে বাঙালি ভাবি।এই গরমে লুংগির থেকে বেস্ট কিছু হয় না।লুংগিতেই শান্তি।”

কোমড়ে হাত দিয়ে রিমলি বলে,”আপনার এই লুংগির রচনা শেষ হলে ঘর দেখতে পারি কি?আপনার থেকে রচনা শুনতে আসিনি।ঘর দেখতে এসেছি।”

“ঘরের সাথে হবু বরকেও দেখতে পারো।”(বিড়বিড় করে)

রিমলি ভ্রু উচু করে বলে,”কিছু বললেন?”

“না।আসো ঘর দেখাই।”

“আপনার বাসায় কেউ নেই?”

“মা বাবা সবাই আছে।বাবা তার অফিসে মা নানু বাসায়।আমি আজ ছুটিতে।তবে তোমাকে ঘর দেখানোর সময় আমাদের মালি আন্টি থাকবে।”
বলেই শিহাব ইশারা দিয়ে দেখায় মালিকে।উনি সুতির শাড়ি পরে মাথায় আচল দিয়ে ধরে আছেন।হাতে বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র।মালিকে দেখে স্বস্তি পেয়ে রিমলি ভিতরে আসে।

চলবে…?