সুরেলা গল্প পর্ব-০৩

0
222

#সুরেলা_গল্প
লেখা #AbiarMaria

সেদিন কি বার ছিল মনে নেই। তবে পরদিন যে স্কুল বন্ধ ছিল, সেটা মনে আছে। সকালে ঘুম ভেঙে রাতের কথা মনে পড়লো। স্বপ্ন দেখেছিলাম নাকি? স্বপ্নের মতই তো সুন্দর ছিল রাতটা। যতবার ভাবছি, ততবার মনের মাঝে শরতের কুসুম কুসুম বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে। হাতে মুখে পানি দিতেই আপুর ফোন আসলো ল্যান্ড ফোনে। আপুর সাথে আব্বু কথা বলছিল। আজকে আব্বুর অফিস নেই। আমি আব্বুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আব্বুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, ও ফেরত আসবে। আমার বুকের ভেতর চিড়িত করে চিপা দিয়ে উঠলো। আপু আসলে আজকে আর গান শুনতে পারবো না তো! যদি আজকেও সে গান গায়? হায় হায়, আজকের রাতটা লাগবে তো! দ্রুত আব্বুর ফোন নিয়ে বললাম,

“আপু, তুই আসবি আজকে?”
“হ্যাঁ, চলে আসবো ভাবতেছি”
“থাক না আর কিছু দিন!”
“কেন? একা একা রুমে থেকে খুব মজা, না? আমার জিনিসপত্র নষ্ট করতেছিস? নাকি কোনো ঝামেলা পাকাচ্ছিস আবার? আমার তো এক্ষুনি চলে আসা লাগবে মনে হয়! তোকে একদম বিশ্বাস করি না আমি”

আজব! পাশার ছক এভাবে উল্টাচ্ছে কেন? না না, ওকে আমার উপর সন্দেহ করতে দেয়া যাবে না! মানুষের বড় বোনরা নাকি আদর করে, মায়ের মত আগলে রাখে। আমার বোন ছোট থেকে একা শাকচুন্নি। আমাকে দেখতেই পারে না। সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকে। ওর যন্ত্রণায় আমি কোনো কাজ করে পার পেতে পারি না, বোল্ড আউট করে দেয় আব্বু আম্মুর কাছে। এই শাকচুন্নিকে মাঝে মাঝে বলি,
“বিয়ে করে যা! এখানে পড়ে আছিস কেন?”

আপু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। এই বয়সের বেশিরভাগ মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বোন নাকি অনার্স শেষ করবে। আর ততদিন আমার ঘাড় মটকাবে। ওকে বিয়ের কথা বললেই আমাকে ইচ্ছেমতো শাপ শাপান্ত করে। তারপর আম্মুর কাছে নাকী সুরে নালিশ করে,
“আম্মু! তোমার পাক্না মেয়ে আমার বিয়ে হলেই বাঁচে। আমাকে সারাক্ষণ বাসা থেকে তাড়ানোর ধান্দায় থাকে। আমি বিয়ের পর বাড়ি আসলে মনে হয় ও দরজাও খুলবে না!”

আম্মুও আপুর নালিশ শুনে আমাকে মারতে তেড়ে আসে। মাঝে মাঝে বড় মেয়ের প্রতি আমার মায়ের এহেন স্নেহময়ী আচরণ এর কারণে আমার সন্দেহ হয়, সত্যি সত্যি কি আমাকে ব্রিজের নিচ থেকে পেয়ে এনেছে?!

প্রসঙ্গ ঘুরাতে আমি দ্রুত আপুকে বললাম,
“আরে না না, এজন্য না তো। আমিও পরশুদিন চলে আসবো তোদের কাছে। এজন্য বললাম। তুই চলে আসলে আর যাবি না, আমারও যাওয়া হবে না। তবুও চলে আসতে চাইলে আয়। আমাকে সন্দেহ করে ঐ বাসায় থাকার দরকার নেই”

মনে ক্ষীণ আশা, আপু আসবে না। কন্ঠে জোর দিয়ে আরও বললাম,
“তুই এই বাসায় যে আসবি আম্মু তো নাই। সব রান্না তোকেই করা লাগবে। তার চেয়ে অপেক্ষা করতে পারিস আমিও তোর সাথে যোগ দিই একদিন পর। আর রান্না করতে চাইলে আজকেই আয়”

আমার বোন ওপাশ থেকে ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল।
“থাক, আসবো না। তুই আয়। তারপর এক সাথে বাসায় যাবো”

আমি তখন মনে মনে ধিনকাচিকা নাচ দিচ্ছি।আপু না থাকলে আজকে রাতটাও সেই ছেলের গান শুনতে পারবো। হয়ত!

বিকালে আমার বান্ধবী প্রমিকে ফোন দিলাম। দুই বার রিং হয়েও ধরেনি। আমি সারাদিন এলোমেলো ভাবে কেবল রাত কখন হবে, সেই অপেক্ষায় থাকলাম।

আব্বু অনেক দ্রুত ঘুমিয়ে যায়, সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মাঝে। আব্বু ঘুমিয়ে যাবার পর আমি আবারও বারান্দায় বসলাম। গতকাল প্রেক্টিক্যাল থাকাতে কি করে রাত হয়েছে, টের পাইনি। সেদিন আর ঘড়ির কাঁটা চলছে না যেন।

দশটা বাজলো, সোয়া দশটা বাজলো, সাড়ে দশটা বাজলো, এগারোটা, এমনকি বারোটা বাজলো। আমার অপেক্ষায় থাকতে আর মন চাইলো না। এখনই এমন লাগছে, রাত দেড়টা পর্যন্ত জাগবো কি করে!

মাথা কাজ করছিল না, তাই গোছগাছ করছিলাম। কে না কে গান গায়, কোন না কোন বিল্ডিংয়ে বসে আছে, কেমন না কেমন মানুষ, কোন না কোন মেয়ের সাথে প্রেমও করেছে, এমন মানুষের কন্ঠে গান শুনার জন্য আমি সাদিয়া কেন জাগবো? কিছুটা অভিমান কিংবা রাগ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমানোর আগে বারান্দার দরজা আটকাতে গিয়ে মনে হলো, নিজে একটু গেয়ে নিই। এভাবে ঘুম আসবে না। আসলেও শান্তি পাবো না।

বারান্দার মাটিতে বসে আনমনে গান ধরলাম,
“দিয়েছিলে যা নিয়ে নিতে পারো
লেখা কবিতা, গাওয়া গান শত।
খুঁজে দেখো না, পাবে না কেউ আমার মতো।
মুছে দিও না, শুধু হৃদয়ও ক্ষত…”

ঠিক তখনই সেই কন্ঠ শুনতে পেলাম,
“গাইবো না আর কোনো গান তোমায় ছাড়া,
লিখবো না আমি আর তুমিহীনা কবিতা!”

আমি অবাক! আমরা কি এখন ডুয়েট গান গাইবো নাকি? উত্তেজনায় আমার চুলের আগা থেকে পায়ের নখ অব্দি শিরশির করছে। স্কুলে গানের প্রতিযোগিতায় টুকটাক অংশ নিলেও এভাবে কখনো আনন্দ পাই নি! ইশ, সেই ভরাট পুরুষালী কন্ঠস্বর আমার মস্তিষ্কে কেমন আলোড়ন সৃষ্টি করছে, তা যদি দেখাতে পারতাম! আমি আবেগে ভেসে বারান্দার গ্রিল ধরে গেয়ে উঠলাম,

“এক পায়ে নূপুর আমার অন্য পা খালি।
এক পাশে সাগর এক পাশে বালি।
তোমার ছোটো তরী বলো নেবে কি?
নেবে কি?”

ওপাশ থেকে গীটারের সুরে সুরে কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“নয় মিছে আশা,
নয় শুধু ভালোবাসা,
নয় অকারণ প্রেমে অন্ধ।
জানি তুমি আমি আমাদের তরী আজও এক বন্ধুত্ব।
আমার ছোটো তরী বলো যাবে কি?
যাবে কি?”

থেমে ঐ রাতে আরও বেশ কিছু গান গেয়েছি। থাকে না মানুষের কাছে একটা ‘মেড ফর ইচ আদার’ টাইপ গাটস্ ফিলিং হয়? আমারও হচ্ছিল। এখন, এই বয়সে যদিও সেটা কৈশোরের পাগলামী বই কিছু মনে হয় না, তখন এই কিঞ্চিৎ সময় এর মাঝে আমি ঐ কন্ঠস্বরের উপর একেবারে প্রেমে পড়ে মরো মরো দশা।

ঐদিন বেশিক্ষণ এসব চলে নি। ডাইনিং এ আলো জ্বলতে দেখলাম আমার বন্ধ ঘরের দরজার নিচ থেকে। চোরের মতো দ্রুত বিছানায় এসে কাঁথা টেনে ঘুমের ভাণ ধরলাম। আব্বুর কাছে ধরা পড়া যাবে না।

ওদিক থেকেও আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

কি ভাবছেন? এই ছেলেকে পরে খুঁজে বের করে প্রেম করে বিয়ে করেছি? আরেহ ভাই, গল্পের শুরুতে বললাম জীবনটা সিনেমার মতো। তার মানেই কি এটা নাকি? আমি সত্যি গল্প বলতেছি ভাই। সত্যি গল্পে এইসব হয়? এটা কি তামিল সিনেমা? না কে-ড্রামা?

এসব চিন্তা সাইডে সরান। কারণ ঐ রাতের আমার জীবনেও আর সেই ছেলেকে খুঁজে পাই নি। আমি না জানি ছেলের বয়স, না চিনি চেহারা, না জানি নাম ঠিকানা। শুধু তার গান শুনেছি। এই যে এতগুলো বছর পার করলাম, আমার কপালে আর এই ফাজিলকে খুঁজে পাওয়ার মত সিনেমাটিক কাহিনী ঘটলো না। এটা কে-ড্রামা হলে অবশ্যই একে খুঁজে পেতাম, প্রেম হতো।

হয়নি। কিচ্ছু না।

তাহলে সিনেমার গল্প কিভাবে হলো?

বলছি। একটু অপেক্ষা করেন!

এই যে গল্পটা বললাম, এই গল্প আমি এর পরেরদিন স্কুল খোলার সাথে প্রমিকে বলেছিলাম। প্রমি আমাকে টিটকিরি মেরে একদম উড়িয়ে দিল! ও তাচ্ছিল্য দেখে আর আমি কখনো কাউকে বলিনি। কে বিশ্বাস করবে এসব কথা? তার উপর আমার মতো গান গাচ্ছে রাত বিরাতে, আশেপাশের কেউ আমার কন্ঠ চিনেনি, বাসায় অভিযোগ আসেনি, তাই কি হয়?

অথচ হলো। দুইটা রাতের গল্প একেবারে আমার মনের গহীনে চাপা পড়ে গেল। থাকে না নিজের কিছু গল্প যেটা আর কাউকে বলা যায় না? কিংবা বলতে ইচ্ছে করে না? মনে হয়, গল্পের পাতাগুলো মন সিন্দুকে তালা মেরে রাখি? মাঝে মাঝে সেই গল্পের পৃষ্ঠায় হাত বুলাতেও শান্তি লাগে।

হয় না এমন?

আমার এই গল্পটাও এমন।

আমি ধীরে ধীরে বড় হলাম। আমি যখন ইস্ট ওয়েস্টে ভর্তি হলাম, তখন আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। সারা বাড়িতে আমার একার রাজত্ব। আর ভার্সিটিতেও খুব দাপিয়ে বেড়াই। সে সময় সুস্ময় ভাইয়ার সাথে পরিচয় হলো। দুর্দান্র ভোকালিস্ট এবং গিটারিস্ট। পাকিস্তান জাল ব্যান্ডের ফ্যান আমি তখন সুস্ময় ভাইয়ার ব্যান্ডে জয়েন করলাম।

না রে ভাই, না। সুস্ময় ভাইয়া সেই রহস্যময় ছেলেটা না। ঐ ছেলের কন্ঠ আমার ঠিক মনে আছে। মানে গান গাইলে অবশ্যই চিনতে পারবো। কিন্তু সেটা সুস্ময় ভাইয়া না। এমনকি সেটা আমার পুরো ভার্সিটির আর কেউ কিনা তাতেও সন্দেহ!

চলবে…