কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
330

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩৪.

তাথৈদের নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে। একটা ক্লাস শেষে ক্লাসে বসেই যারযারমতো আড্ডা দিচ্ছে সবাই। আলো নিশব্দে উপন্যাস পড়ছে। শার্লি পুরো ক্লাস ঘুমিয়েছে। আড়মোড়া ছেড়ে আবারো হাইবেঞ্চে হাত-মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোতে থাকে ও। তুল্য বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। শার্লির দিকে তাকিয়ে দেখলো, শার্লির ছোটছোট চুলগুলো ওর চোখেমুখে পরে আছে। পুরো ক্লাসে একপলক চোখ বুলালো তুল্য। সবে হাত বাড়িয়েছে শার্লির চুলগুলো কানে গুজে দেবে বলে, আফিফ ডাক লাগায় ওকে। মেজাজ পুরোটাই বিগড়ে যায় তুল্যর৷ যে হাতটা ও শার্লির দিকে নমনীয়তার সাথে বাড়িয়েছিলো, সে হাতেই ঠাস করে শার্লির মাথায় চাটি লাগালো ও। শার্লি লাফিয়ে ওঠে। মাথায় হাত বুলিয়ে কোথায় আছে পরখ করতে থাকে। তুল্য ওকে পাশ কাটাতে কাটাতে বিরক্তিতে বললো,

– গন্ডার একটা!

চরম মেজাজ খারাপ হয় শার্লির। বিশ্রি নামটা, ঘুম নষ্ট আর অহেতুক মারার দায়ে তুল্যকে খুন করার ইচ্ছা জাগলো ওর। তুল্য ততোক্ষণে গিয়ে আফিফের সাথে দাড়িয়েছে। মাথা ডলতে ডলতে সিট থেকে বেরোলো শার্লি। আলোকে বললো,

– এই আলো? তাথৈ কোথায়?

– ও বাইরে বসেছে। বুজোকে খাওয়াচ্ছে।

– ওহ। ওকে।

শার্লি বেরোচ্ছিলো। তবে একটুখানি এগিয়েও থেমে গেলো ও। পেছন ফিরে আলোর হাতের বইটাতে উঁকি দিলো। বইয়ের কভারটা ওর নজর কেড়েছে। সেখানে দুটো মেয়ে আর একটা ছেলের ছায়াময় অবয়ব। শার্লি হেসে বললো,

– লাভ ট্রায়াঙ্গল পড়ছো আলো?

আলো চোখ তুলে চায়। মৃদ্যু হেসে জবাব দেয়,

– লাভ কি কখনো ট্রায়াঙ্গল হয় শার্লি? প্রেম-ভালোবাসা শুধু ওই দুই প্রান্তের দুজনেরই হয়। একতরফা ভালোবাসাকে দেখেছো কোথায়ও মুল্যায়ন হতে?

– কিন্তু আমিতো জানতাম ভালোবাসা ভালোবাসাই! কোনো না কোনোদিন তার মুল্যায়ন ঠিকি হয়। আর…

– এমনটা না হোক!

আলো থামিয়ে দেয় শার্লিকে। ওর জবাব না বুঝে শার্লি ভ্রু কুচকালো। আলো অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। আলো বললো,

– সব ভালোবাসার মুল্যায়ন হতে নেই। কিছু ভালোবাসা অবমূল্যায়িতই থাকা উচিত।

আলো টের পেলো কথা বলতে গিয়ে ওর চোখ জ্বলছে। আর একমুহূর্ত শার্লির দিকে তাকিয়ে থাকলে কান্না বেরিয়ে আসবে ওর। চোখ নামিয়ে ও উপন্যাসে মনোযোগী দেখালো নিজেকে। শার্লি আলোর কথা বুঝলো। শুধু কথার পেছনের প্রেক্ষাপট বুঝলো না। সৌজন্য হেসে রুমের বাইরে চলে আসলো ও। এসে দেখে তাথৈ সেখানে বুজোকে খাওয়াচ্ছে আর আনমনে কিছু ভাবছে। শার্লি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলো। কাধে ঠেলা মেরে বললো,

– কিরে? ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, আনমনে তাহার কথা ভাবা হচ্ছে নাকি? হুম?

– সাভার যাচ্ছি। যাবি?

– কিহ?

চেচিয়ে বলে সেকেন্ডের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে যায় শার্লি। আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে পুরো ক্লাস বাইরে তাকালো। ওকে ওমন লাফাতে দেখে বুজোও আওয়াজ করে উঠেছে। তাথৈ নিরস দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। শার্লি নিজেকে সামলালো। আবারো তাথৈয়ের পাশে বসে গিয়ে, ফোকলা হাসি দিলো একটা। তাথৈ বললো,

– লেইম রিয়্যাক্ট দেওয়া বন্ধ কর। সাভার যাবো। পরপার না।

– বিশ্বাস কর তাথৈ! তোর সাভার যাওয়া নিয়ে আমার একবিন্দু বিস্ময় নেই। কিন্তু তুই ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে সাভার যাবি? সিরিয়াসলি?

– মাস্টার্সে ক্লাস চলছে। কিন্তু তাশদীদ আজ ক্লাসে আসেনি। আমার ভালো লাগছে কিছুই।

বিরবির করে বললো তাথৈ। শার্লি গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে ওর কথা শুনছে আর মনেমনে বলছে, ‘আহা! কি সুন্দর প্রেম! প্রেমিক ক্লাসে আসেনি বলে প্রেমিকা তাকে দেখতে বিশ কিলোমিটার পাড়ি দেবে! বাট ওয়েট! লাইনটা উল্টো হলো না?’ তাথৈ পাশ ফিরতেই জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক করলো শার্লি। বললো,

– ত্ তো এখন কোথায় যাবি তুই? শুধু জানিস তাশদীদ ভাই সাভার থাকে। সাভারে কোথায় থাকে সেটা জানিস? যাবিটা কোথায়?

– জেনে নেবো।

তাথৈ উঠে ক্লাসে গিয়ে ব্যাগ কাধে নিলো। তারপর বেরিয়ে আসলো ক্লাস থেকে। বুজো ওর পেছনপেছন ছুটছে। শার্লি যেনো বাহানা পেয়েছে ক্লাস না করার৷ উৎফুল্ল হয়ে ওউ ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছিলো। আলো ওদেরকে ওমন বেরিয়ে যেতে দেখে বললো,

– কি ব্যাপার শার্লি? ক্লাস আছে তো? এখন কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

– ঘুরতে। তাথৈ আমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে!

শার্লি একছুটে বেরিয়ে আসে। তাথৈ ফোন বের করে কল লাগালো রুমনকে। ফোন আবারো পকেটে পুরে হেডফোনে বললো,

– কোথায় তুই?

– ক্লাসে। কেনো?

– ক্লাস না থাকলে পুকুরপাড় আয়। যাবো একজায়গায়।

তাথৈ কল কাটলো। রুমন দু মিনিটে হাজির হয়। শার্লিকে ইশারায় শুধায়, ‘কোথায় যাবে?’ শার্লি দাঁত কেলিয়ে বললো,

– সাভার।

– সাভার কেনো?

– প্রেমের টানে।

রুমন শব্দ করে হেসে দিলো। একনজর দুজনের দিকে তাকালো তাথৈ। ওরা তৎক্ষনাৎ হাসি লুকালো। তাথৈ গাড়ির লক খুললো। সবে গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, পাশ থেকে আওয়াজ আসে,

– হেই তাথৈ!

তাথৈ পাশ ফিরলো। ওর সামনে ধবধবে ফর্সা, রোগাপাতলা দেহী একটা ছেলে। পরণে টকটকে লাল টিশার্ট, ছেড়াফাটা ডিজাইনের কালো প্যান্ট, গলায় কয়েকটা চেইন, হাতের কবজিতে ফিতে বাধা, মাথায় উল্টোপাশ করে রাখা ক্যাপ। ছেলেটার বেশভুষা দেখে ভ্রু কুচকে আসে তাথৈয়ের। একই অবস্থা শার্লি-রুমনেরও। রুমন বিরবিরিয়ে বললো,

– এই ইয়ো ইয়ো হরিপদ আবার কে?

শার্লি ফিক করে হেসে দেয়। ছেলেটা অতিমাত্রার উৎসাহ নিয়ে তাথৈয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

– হেই! আ’ম টেরেন্স। এন্ড ইউ আর তাথৈ! রাইট?

তাথৈয়ের কপাল শিথিল হয়। একবার টেরেন্সের বাড়িয়ে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে, দুহাত বুকে গুজলো ও। পরিপূর্ণ ভাব বজায় রেখে বললো,

– তাথৈ আলফেজ।

তাথৈয়ের গা ছাড়া স্বভাব দেখে টেরেন্স একটু আটকে যায়। বিদেশে মেয়েরা নিজ থেকে ওর গায়ে লেপ্টে থাকতে চায়। ও কারো দিকে হাত বাড়ালো, আর সে হাত কেউ ধরলো না, এমনটা আজ প্রথমবার ঘটেছে। ‘আমার মেয়েটা একটু জেদী’ তাথৈয়ের মায়ের বলা কথাটা মনে পরে যায় ওর। টেরেন্স হেসে দুহাত একসাথে করে তালি দিলো। আগের মতোই উৎসাহে কিছু বলতে যাবে, তাথৈ তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে গাড়িতে চড়ে বসলো। টেরেন্স দ্বিতীয় দফায় আটকায়। আশপাশ দেখে নিয়ে ইংরেজীতে বললো,

– আমি এখানে তোমার সাথে কথা বলতে আসলাম, আর তুমি চলে যাচ্ছো?

তাথৈ ড্রাইভিং সিটে বসা অবস্থায় ওরদিক তাকালো। ইংরেজীতেই বললো,

– না আমি তোমাকে চিনি, নাইবা আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য। অতএব আমি তোমার কথা শুনছি না।

সানগ্লাস চোখে দিয়ে জানালার কাচ তুলে দিলো তাথৈ। জানালার কাচে নিজের অপমানিত অবয়ব দেখে যেনো টেরেন্স নিজেকেই চিনলো না। রুমন উল্টোদিকের জানালা দিয়ে ফ্রন্টসিটে বুজোকে তুলে দিলো। তারপর নিজেও পেছনের সিটে বসলো। শার্লি টেরেন্সকে পাশ কাটিয়ে পেছনের সিটে উঠতে উঠতে বললো,

– নাম টেরেন্স হলে কি হবে, ছাদে মাল নাই।

টেরেন্স বুঝলো না ওর কথা। গাড়ি স্টার্ট দেয় তাথৈ। দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো টেরেন্স। গাড়িটা চোখের আড়াল হলে ও অদ্ভুত হেসে বললো,

– এটিটিউড! ওকে! আই লাইক ইট!

জ্যাম ঠেলে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক পর সাভারের মুলসড়কে পৌছালো তাথৈ। পেছনের সিটে বসে শার্লি লোকেশন দেখছে। রুমন শান্তকে কল করে তাশদীদের ঠিকানা জেনে নিয়েছে। বুজো জানালায় সামনের দু পা তুলে বাইরের হাওয়া খাচ্ছে। একটাসময় শার্লি বললো,

– আর তিনমিনিট এগিয়ে ডানের রোড বেয়ে নেমে যাবি।

তাথৈ তিনমিনিটই গাড়ি চালালো। তবে ডানে এগোনোর পরিবর্তে মোড়টাতেই গাড়ি থামিয়ে দিলো ও। ব্রেক কষতে দেখে পেছন থেকে রুমন প্রশ্ন করলো,

– কিরে? গাড়ি থামালি কেনো? আরো যেতে হবে তো!

– আমি সরাসরি তাশদীদের বাসায় গেলে ও অস্বস্তিতে পরবে রুমন।

চিন্তিতস্বরে বললো তাথৈ। রুমন-শার্লি একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শার্লি বললো,

– অস্বস্তিতে পরবে মানে? কিসের অস্বস্তি? তাশদীদ ভাইয়ের কোনো অস্বস্তি-ফস্বস্তি নাই। আমরা…

– আছে! তাশদীদের ব্যক্তিত্ব সবজায়গায় জ্বলজ্বল করে। আমি চাইনা আমার অসময়ী, অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি ওর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে একবিন্দু ছায়া ফেলুক! কেউ ওকে প্রশ্নতাক করুক। আমরা ওর বাসায় যাচ্ছি না!

তাথৈয়ের জবাব প্রাসঙ্গিক হলেও শার্লি মানলো না। বললো,

– তো? এখন এতোদুর এসে দেখা না করেই চলে যাবি নাকি?

– তা কেনো হবে? আমি আছি না? দাড়া দেখছি কি করা যায়।

রুমন গাড়ি থেকে বেরিয়ে কল লাগালো তাশদীদের নম্বরবে। ও বেরোতেই বুজোও লাফিয়ে তাথৈয়ের কোলে আসলো। এদিকটার জানলায় পা দিয়ে বারি দিতে লাগলো। ‘রিল্যাক্স বুজো’ বলে তাথৈ থামানোর চেষ্টা করলো বুজোকে। ও মানছে না। এরমাঝেই রুমন বাইরে থেকে গাড়ির জানালায় হাত ঠেকালো। ঝুকে দাড়িয়ে বললো,

– এ তাথৈ! কল করেছিলাম তাশদীদ ভাইকে। সে তো বাড়িতে নেই। তার মা নাকি তাকে মাসকাবারির বাজার করতে পাঠিয়েছে!

তাথৈ একটা ছোট শ্বাস ফেললো। বুজো তখনো জানালা খোলানোর জন্য ছটফট করছে। মনটা খারাপ করে জানালার কাচ নামিয়ে দিলো তাথৈ। বুজো জানলা খোলা পেয়ে খুশি হয়ে যায় যেনো। দুবার আওয়াজ করে সামনে তাকিয়ে। তাথৈ অগ্রাহে একবার বাইরে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারো রাস্তার উল্টোপাশে দৃষ্টি নিলো তাথৈ। মেইনরোড পার হয়ে ওদিকেও একটা রাস্তা নেমে গেছে। ইটবিছানো ভাঙাচুড়া রাস্তাটার পাশে ঝুড়িতে করে শাকসবজি নিয়ে সবজিওয়ালারা বসেছে। আর রাস্তার সর্বসম্মুখে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত এক মানব দাড়ানো। সে তাশদীদ ওয়াসীর। বা হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরে, ডানহাতে ফোন আর মানিব্যাগটা প্যান্টের পকেটে গুজলো তাশদীদ। তারপর উবু হয়ে প্যান্টটা আরেকটু ভাজ দিয়ে উপরে ওঠালো। তাথৈয়ের মন যেনো ময়ুরের মতো পেখম মেলে। বুজোকে রেখে, ঠোঁটে হাসি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে তাথৈ। পেছন থেকে শার্লি বললো,

– তুই আবার উল্টোদিকে কোথায় যাচ্ছিস?

– পথ যাই হোক, আমার গন্তব্য ওই একটাই। তাশদীদ।

শার্লি-রুমন বুঝলো তাথৈ তাশদীদকে দেখেছে। তাশদীদ ততক্ষণে বাজারের ভেতরে ঢুকে গেছে। তাথৈ রোড পার হলো। ওর সাথে রুমন শার্লিও এসে দাড়ালো বাজারের মাথায়। শুরুর মুরগীর দোকানটা থেকে বিদঘুটে গন্ধ আসছে। শার্লি নাকমুখ চেপে ধরে দাড়িয়ে গেলো। কিন্তু তাথৈয়ের থামার নাম নেই। রুমন ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

– তুই কি এখন এই নোংরা কাচাবাজারে ঢুকবি? এমন ধুলাবালি…

– যে পথে তাশদীদ হেটে যায়, সে পথের ধুলোবালি মাড়ানো কেনো, আমি নিজেই সে পথের ধুলোবালি হয়ে যেতে পারি।

রুমন ভাষাহীন হয়ে যায় তাথৈয়ের এমন নিস্প্রভ জবাবে। পা বাড়ায় তাথৈ। ওর তৃষ্ণার্ত চোখ কেবল তাশদীদকে চাইছে। তাশদীদ মুরগীর দোকানে মুরগীর অর্ডার দিলো। তারপর গেলো বড় একটা মুদির দোকানে। একটা লিস্ট দেখেদেখে বাজার বলতে লাগলো। তাথৈ আরেক দোকানের আড়াল থেকে ওকে দেখছিলো। সে দোকানের মালিক ওকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– কি নিবেন?

তাথৈ হচকিয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে বস্তায় থরেথরে সাজানো কোনোকিছুই ওর পরিচিত না। ডাল, ছোলা থেকে শুরু করে গুড়ো মশলা, সব যেনো আজ প্রথমবার বাস্তবে দেখলো ও। তাথৈ তাশদীদের দিকে তাকালো। ও লিস্ট দেখে কি কি বলছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনে নিয়ে দোকানিকে বললো,

– হ্যাঁ! ডাল এক হালি, শ্যাম্পু দুই পোয়া, জিরা এক ডজন, ডিম তিন কেজি।

দোকানী মাপ দেবার উদ্দেশ্যে ডাল তুলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাথৈয়ের ফর্দ শুনে যেনো তিনি পাথর হয়ে গেলেন। তাথৈ চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো৷ ভাবনাচিন্তা না করে পরিমাপ বলাটায় কতোবড় গন্ডগোল পাকিয়েছে, সে বুঝ হয়ে নিজের ছাত্রীত্বের ওপর তীব্র লজ্জা হলো ওর। কোনোমতে হিসাব বুঝে নিয়ে আবারো বললো,

– ইয়ে মামা, ডাল এক কিলো, শ্যাম্পু দুই ডজন, জিরা এক পোয়া, আর ডিম তিন হালি।

দোকানী এতোক্ষণে শ্বাস নিলেন। ঠিকঠাক বলে দিয়ে তাথৈ নিজেও লম্বা শ্বাস নিলো একটা। দোকানী সেগুলো প্যাক করতে লাগলো। শার্লি রুমন অতিকষ্টে বাজারের ভেতরটায় আসলো। তাথৈ টাকা মিটিয়ে দেখে তাশদীদ সবজির দোকানে ঢুকেছে৷ সবজিতে পানি ছেটাতে ছেটাতে পায়ের নিচটা কদর্মাক্ত করে ফেলেছে দোকানীরা। একজন যাওয়ার সময় তাথৈয়ের পায়ে পারা দিয়ে চলে গেলো। কাদায় মাখোমাখো হয়ে যায় তাথৈয়ের পা। তবুও টু শব্দটাও করলো না ও। বরং ও মনোযোগ দিয়ে তাশদীদের দর কষাকষি উপভোগ করছে। আলুর দাম পঞ্চান্ন থেকে পঞ্চাশ করার জন্য কয়েকবার দোকানীকে বলছে সে৷ বেগুন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে খুঁত দেখাচ্ছে। তাথৈয়ের মুগ্ধ চোখজোড়া দেখে রুমন আনমনে বলে উঠলো,

– তাথৈ আর তাথৈ নেই।

– ইটস জাস্ট দ্য ট্রেইলার ব্রো।

শার্লিদের কথাগুলো কানে গেলো না তাথৈয়ের। তাশদীদ নিজের বলা দামে সবজি নিয়ে গেলে কলকলিয়ে হেসে ওঠে ও। গর্বের সাথে ‘মাই ম্যান’ বলে তেমনি চেয়ে রয় তাশদীদের দিকে। রুমন ওর হাত থেকে বাজারের জিনিসগুলো নিয়ে বললো,

– তোর ম্যান বাজার করছে। তোর আবার কি দরকার ছিলো বাজার করার?

– এগুলো না কিনলে ওই দোকানদার মামা মনেহয় তার দোকানের সামনে দাড়াতে দিতো না।

– তাও ভালো। তা দেখিতো! তাথৈ আলফেজ প্রথমবার বাজারে ঢুকে কি কি কিনেছে? কতো টাকার বাজার এখানে?

– হ্যাঁ একটু দেখতো? তাশদীদ চলে আসছিলো বলে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে চলে এসেছি। মামা আরো পাবে কিনা।

শার্লি ঠাস করে কপাল চাপড়ালো। তাথৈ বুঝলো, ও বেশিই দিয়ে এসেছে। আর ওদিকটায় দাড়ালো না ও। দ্রুতপদে চলে আসলো বাইরে। দুর থেকে দেখলো তাশদীদ একটা ভ্যানে সব বাজার তুলে দিয়ে ভ্যানওয়ালাকে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। তারপর কাউকে কল করলো ও। এলোমেলো পায়ে এগোতে থাকে তাথৈ।

তামজীদকে বাজার নিতে বলে ফোন কান থেকে নামালো তাশদীদ। হুট করেই ওর চোখ গেলো রাস্তার উল্টোপাশে দাড়ানো গাড়িটার দিকে। গাঢ় কালো খয়েরি রঙের ঝকমকে গাড়িটা ওর চেনা। আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলো ও সেদিকে। ওকে দেখে বুজো গাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ করে ওঠে। তাশদীদ নিশ্চিত হয়ে যায়, গাড়িটা তাথৈয়েরই। আশপাশ তাকাতেই তাথৈকে চোখে পরে ওর। তাথৈয়ের সাদা কুর্তায় লালশাক, সবুজশাকের ছোটছোট পাতা লেগে আছে, পা জুড়ে কাদা। পেছনে রুমন দুইচারটে জিনিস হাতে আসছে। শার্লিও আছে। কাছাকাছি এসে শার্লি সালাম দিলো তাশদীদকে। তাশদীদ সালামের জবাব নিয়ে কিছুটা বিস্ময়ে বললো,

– তোমরা এখানে কেনো?

– ওই রুমনের বয়ফ্রেন্ড এখানেই…

তাশদীদ ভ্রু কুচকে তাকালো। আটকে যায় শার্লি। পরিস্থিতি সামাল দিতে রুমন জোরপূর্বক হেসে বললো,

– না আসলে শার্লির গার্লফ্রেন্ড এ্…

মনেমনে নিজেকে একনাগাড়ে গালি দেওয়া শুরু করে শার্লি। রুমন কপাল ডলতে ডলতে নিজের চেহারা আড়াল করলো। দুজনেরই মনে হলো, নাকটা কাটা যাওয়ার এরচেয়ে ভালো উপায় আর দুটো নেই। এমন এক অস্থিতিশীল পরিবেশেও তাথৈ বেশ ধীরস্থির মস্তিষ্কে জবাব দিয়ে বসলো,

– আপনি এখানে। তাই!

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩৫.

‘তোমরা এখানে কেনো?’ এর উত্তরে ‘আপনি এখানে, তাই!’ এমন জবাবটা তাথৈয়ের কাছ থেকে মোটেও আশা করেনি তাশদীদ। সেকেন্ডের মতো আটকে থেকে, অসতর্কে হেসে বললো,

– আমি এতোটাও বিখ্যাত নই।

তাথৈ জবাব দিলো না। কিন্তু তাশদীদ চাইলেই জবাব পেয়ে যেতো। তাথৈয়ের চাওনিতে স্পষ্ট বলা ছিলো, ‘বিখ্যাত না হলেও পৃথিবীর এক এবং একমাত্র বিশেষ মানুষটার নাম তাশদীদ ওয়াসীর।’ শার্লি কিচ্ছুটি না জানার ভান করে বললো,

– আপনি এখানে কেনো তাশদীদ ভাই? ধারেকাছেই বাসা নাকি আপনার?

– পাঁচমিনিট হাটলেই আমার বাড়ি। বাজারে এসেছিলাম। যাইহোক, তোমরা এসেই যখন পরেছো, চলো আমার বাসায়। লান্চ করে তারপর ঢাকা ফিরো।

রুমন-শার্লি একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাথৈয়ের দিকে তাকালো। তাশদীদ ধমক দিয়ে বললো,

– ওরদিক কি তাকাচ্ছো? ও না গেলেও তোমরা যাচ্ছো আমার সাথে! চলো!

– আমিও যাচ্ছি।

তাথৈয়ের জবাবে আবারো কিঞ্চিত অবাক হয় তাশদীদ। রুমন-শার্লি লুকিয়ে-চুরিয়ে হাসলো। এই দাওয়াতের জন্য যে তাথৈ তীর্থের কাক, তা যদি তাশদীদ বুঝতো তাহলে আর ও ‘না গেলে’ শব্দদুটো উচ্চারণ করতো না। তাথৈ গাড়ি থেকে বুজোকে বের করে কোলে নিলো। তারপর চারজনে মিলে হাটা লাগালো। প্রীতিকার্নিশের কাছাকাছি আসতেই বুজো তাথৈয়ের কোল থেকে নেমে গেলো। তাশদীদ বললো,

– ও এখানে আগেও এসেছে। ওকে ওর মতো ছেড়ে দাও। হারাবে না।

বুজো বাড়ির সামনের ঘাসের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো। একপা দুপা করে এগোতে এগোতে তাথৈ একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলো বাড়িটা। সে সীমানায় পা রাখতেই শীতল বাতাস একদফা ছুঁয়ে গেছে ওকে। বড়বড় গাছের ছায়ায় দাড়িয়ে টিনেরশেডের বাড়িটা। সামনের দিকটায় গ্রিল করা বারান্দা। গেইটের ওপরের দিকে দুই প্রকারের বাগানবিলাস ঝুলছে। গোলাপী, হলুদ। চাল থেকে নেমে গেইটের গ্রিলে জড়িয়ে আছে ফুলভর্তি ডালগুলো। ডানপাশের দেয়ালে ছোট্ট একটা আয়তাকার নেমপ্লেট। মাটির তৈরী নেমপ্লেটটার মাঝে সুন্দরমতো ‘প্রীতিকার্নিশ’ লেখা, চারপাশে নকশা করা। নিচে সবুজ লতার নকল গাছ ঝুলছে। বাড়ির ভেতর থেকে তেলে ভাজার আওয়াজ আসছে। তাশদীদ গিয়ে গেইটের ছিটকিনিতে দুবার শব্দ করলো। তারপর সিড়ির সামনে জুতা খুলতে খুলতে ‘মা!’ বলে ডাক লাগালো। ভেতর থেকে মিসেস ওয়াসীর চেচিয়ে বললেন,

– তুই আজকেও কেনো বাধাকপি কিনেছিস তাশদীদ? কে খায় কে বাধাকপি এ সংসারে? আমার একার জন্য বাধাকপি রান্না করবো? ওদিকে তোর ভাই আজকেও এই দুপুরবেলা ব্যাট নিয়ে বেরিয়ে গেছে! আর তোর বাবা! সে এই এগারো পয়েন্টের সুগার নিয়ে আবারো লুকিয়ে ফ্রিজে রাখা পায়েস খেয়েছে জানিস? এই তাশদীদ? তুই কি ওদের কিছু বলবি? নাকি আমিই এই সংসার ছেড়েছুড়ে চলে যাবো? তোদের তিনপুরুষের অত্যাচার আমি আর নিতে পারছি না! তিনজনের এইসমস্ত কাজকর্ম সহ্য করার জন্য ওপরওয়ালা কি শুধু আমাকেই পেয়েছিলো?

একপলক পেছনের রুমন, শার্লি, তাথৈয়ের দিকে তাকালো তাশদীদ। তিনজনই থমকে আছে। নিশব্দে হাসলো শার্লি রুমন। এইযে এতো দৃঢ় ব্যক্তিত্বের তাশদীদ, সেও এক নারীর কাছে নাস্তানাবুদ। মায়ের কাছে। তাশদীদ ক্ষুদ্র শ্বাস ছাড়লো। মাসের এই একটা দিন ওর মায়ের মেজাজটা গরম থাকে। এই জুনিয়রদেরও আজকেই সাভার আসতে হলো। যদিও মিসেস ওয়াসীর অতিথি দেখলে সবচেয়ে বেশি খুশি হন। তাশদীদ জোরালো হেসে গেইট ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। পেছনপেছন ভেতরে ঢুকলো রুমন শার্লি। তাথৈয়ের পায়ে কাদা ছিলো। ও খেয়াল করলো, সিড়ির পাশেও একটা ট্যাপ আছে। জুতা খুলে জিন্স গুটালো ও। ট্যাপ ছাড়ার শব্দ শুনে তাশদীদ পেছন ফিরে দেখে তাথৈ নিচু হয়ে পা ধুচ্ছে। রুমন শার্লি ততোক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছে। তাশদীদ ওদের বারান্দার সোফায় বসতে বলে কিচেনের দিকে এগোলো। তাথৈকে হাত দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে পা ধুতে দেখে শার্লি বললো,

– আমি যে তাথৈকে চিনতাম, সে তার আঁইশ-কাদামাখা পা অন্যকাউকে দিয়ে ধোয়াতে অম্বুনীড়কে দশবার করে বেচে দিতো। দুবারও ভাবতো না। আর এই তাথৈ এই টিনশেডের প্রীতিকার্নিশে ঢুকবে বলে নিজের হাতে পায়ের কাদা, আঁইশের পানি ধুচ্ছে! ভাবা যায়?

রুমন ছোট্ট করে হেসে গুনগুনালো, ‘তাথৈ আলফেজ ভয়াল প্রেমে ম-জিলো রে! নিশা লাগিলো রে…’
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে থেরাপি সম্পর্কিত ম্যাসেজ দেখতে লাগলো ও। শার্লিও হেসে সোফায় বসে ফোনে মনোযোগ দিলো। কিচেনে ঢুকে মাকে বাজার গোছাতে মহাব্যস্ত পেলো তাশদীদ। চুলায় রান্না চরিয়ে বাকিসব গোছাচ্ছে সে। তাশদীদ বললো,

– মা? বাজারে ইউনিভার্সিটির তিনটা জুনিয়রের সাথে দেখা হয়ে গেছে। লান্চ করাতে নিয়ে এসেছি। তুমি চলো, ওদের সাথে দেখা করবে চলো।

মিসেস ওয়াসীর চিনির বয়াম আটকাচ্ছিলেন। তাশদীদের কথায় চকচকে চোখে তাকালেন উনি। বললেন,

– তোর জুনিয়র এসেছে?

– এমন করছো যেনো এরআগে আমার কোনো জুনিয়র এ বাসায় আসেনি?

– চুপ থাক তো! শেষবার তো সাত আটটা ছেলে এসেছিলো সেই কবে! তোর ফোর্থইয়ারে। আগে কতো ঘমঘন বাসায় আসতো বাচ্চাগুলো। আজ এ, কাল সে, আজ ওরা, কাল তারা! ঝমঝম করতো আমার প্রীতিকার্নিশ! এরপর যেইনা তুই দুরে গিয়ে ভর্তি হলি, বাসায় বাচ্চারা আসাই ছেড়ে দিয়েছে! তো তুই আমাকে আগে বলবি না ওরা এসেছে? দেখি সর সর! ওরা তো নতুন! কথা হয়নি কারো সাথে! কথা বলি গিয়ে! তুই সর! যেতে দে আমাকে!

মিসেস ওয়াসীর একাধারে বলতে বলতে বয়াম তুলে রাখলেন, চুলার আঁচ কমিয়ে হাত ধুলেন, আঁচলে হাত মুছতে মুছতে হাটা লাগালেন বারান্দায়। তাশদীদ অবাক হলো না। কোমড়ে হাত রেখে হেসে ফেললো। এই মা ওকে বাসায় ঢুকলে দেখলে আগে ওর গালে হাত রেখে বলে, ‘ইশ! ফাঁকিবাজ বাবার জন্য বাজার করতে গিয়ে রোদে পুড়ে গেছে ছেলেটা আমার!’ কিন্তু যেইনা শুনলো বাসায় ওর জুনিয়র এসেছে, মিসেস ওয়াসীর ভুলে গেছেন ওকে। এমনটাই ঘটে। প্রতিবার! মিসেস ওয়াসীর খুশিমনে বারান্দায় আসলেন। রুমন শার্লি তাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো। সালাম দিলো। মিসেস ওয়াসীর বড়সর হেসে সালামের উত্তর নিলেন। ওদের বসতে ইশারা করে বললেন,

– আরে বসো বসো! তোমরা এসেছো, আমি খুব খুশি হয়েছি। কেমন আছো? বাসার সব কেমন আছে তোমাদের?

মিসেস ওয়াসীর হাসি আর উচ্ছ্বলতা দেখে খুশি হয়ে যায় রুমন শার্লি। শার্লিও হেসে বললো,

– জ্বী আন্টি আলহামদুলিল্লাহ। সবাই ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

– হ্যাঁ আল্লাহ খুব ভালো রেখেছে আলহামদুলিল্লাহ। তাশদীদ যে বললো তোমরা তিনজন? আরেকজন কোথায়?

শার্লি-রুমন আটকায়। ওদের হুশ হয়, মিসেস ওয়াসীরের প্রাণভরা ব্যবহারে ওরা দুজনেই তাথৈয়ের কথা ভুলে গেছে। এতোই প্রাণোচ্ছল তার হাসি আর কথা। অবশ্য হবেই বা না কেনো? তাশদীদ ওয়াসীরের মা সে। শার্লি বললো,

– ও্ ও বাইরে পা ধুচ্ছে আন্টি।

তাশদীদ পানি খাচ্ছিলো। মায়ের কথা শুনে ওরও তাথৈয়ের কথা মনে পরেছে। আবারো গেইটের দিকে এগিয়েছে ও। মিসেস ওয়াসীর গেইটে এগোতে এগোতে বললেন,

– এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না! পা কেনো বাইরেই ধুয়ে আসতে হবে? তামজীদ কি এ ঘরবাড়ি ঠিক রাখে? এসব…

তিনসিড়ির নিচে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা তাথৈকে দেখে থেমে গেলেন মিসেস ওয়াসীর। সাদা কুর্তা পরিহিত মেয়েটার গায়ের রঙও বেশ ফর্সা। কাধ বেয়ে ছাড়া পাওয়া সোজা চুল। চেহারায় বুঝতে না দেওয়া আকাঙ্ক্ষা। জামায় শাকপাতার ছোপ দাগ, জিন্স গুটানো, হাতেপায়ে পানিকনা। তাশদীদও দরজায়ই দাড়ানো। ও বোঝার চেষ্টা করছে, পা ধোয়ার পরেও কেনো ভেতরে ঢুকছে না তাথৈ? মিসেস ওয়াসীর আদুরে গলায় বললেন,

– দেখেছো? মেয়েটা এখানেই দাড়ানো। এসো মা এসো। ভেতরে এসো।

‘মা’ সম্বোধন শুনেই জামা খামচে ধরলো তাথৈ। চোখ ভরে ওঠে ওর। বহুদিন পর হাউমাউ করে কাদতে ইচ্ছে হলো। সামনে দাড়ানো আদরমাখা মুখের অধিকারীনিকে শক্ত করে জড়িয়ে কান্নার ইচ্ছে হলো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘আমায় কেউ মা ডাকে না!’
তবুও তাথৈ নিজেকে সামলায়। আড়চোখে একপলক পাশের দেয়ালে আটা কাগজটার দিকে তাকিয়ে, নোয়ানো স্বরে বললো,

– আমি অ্যারাবিক পারি না।

তাশদীদ বিস্ময়ে দেয়ালে তাকায়। মিসেস ওয়াসীর সেখানে একটা কাগজে ‘ঘরে প্রবেশের দোয়া’ লিখে রেখেছেন। আরবি তার নিজের হাতে লেখা। মুখস্ত বলে কাগজটা দেখার প্রয়োজন পরে না তাশদীদের। তাই এই কাগজ কে কেমন খেয়াল করে, এতোদিন একবারো মনে হয়নি ওর। মিসেস ওয়াসীর একটু আটকালেন। অতঃপর আবারো সুন্দরমতো হেসে বললেন,

– আচ্ছা ব্যাপার না। ভেতরে এসো তুমি।

তাথৈ তেমনি স্থির। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে তাশদীদ নিজেই উচ্চারণ করলো দোয়াটা। সিড়ির নিচে দাড়ানো অবস্থায় একদন্ড সময় নিলো তাথৈ। চেষ্টা করলো শুনে শুনে বলার। কিন্তু ওর টান ঠিক হয়নি। তাশদীদ এবারে ভেঙে ভেঙে দোয়া উচ্চারণ করলো। ওর সাথে ঠিকঠাক দুয়া শেষ করলো তাথৈ। পা রাখলো প্রীতিকার্নিশে।
শানবাধানো মেঝেতে খালি রাখতেই পায়ের তলা শিরশিরিয়ে ওঠে তাথৈয়ের। ওর পুরো শরীর ঝাকি দিয়ে ওঠে অদ্ভুত শীতলতায়৷ তাথৈ ভেবে পায়না, শার্লি-রুমনও তো ভেতরে ঢুকেছে। এই অদ্ভুত অনুভূতি কি ওদেরও হয়? নাকি কেবল ওরই হয়? অম্বুনীড়ের ভেতরের টাইলস করা মেঝেতে শেষ কবে খালিপায়ে হাটা পরেছে, মনে করতে পারে না তাথৈ। ওর শুধু মনে হচ্ছে, এই পুরো প্রীতিকার্নিশ জুড়ে কেবল মায়া-মমতার ঘ্রাণ৷ শুরু থেকেই যেনো অদ্ভুত হিম হাওয়া ওকে ছুঁয়ে চলেছে। গুটিগুটি পায়ে এসে সোফায় বসলো তাথৈ। তাশদীদ পাশের ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসলো। পরিচয়ের উদ্দেশ্যে সবে মুখ খুলেছে,

– মা ও…

– এই তুই যা তো! চুলার রান্নাটা দেখ গিয়ে। আমি ওদের সাথে পরিচিত হয়ে নেই। আসছি একটুপর। যা যা!

তাশদীদ গুরুত্বহীনতা নিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেলো কিচেনে। ও জানে, আজকে ওর মা আর ওর না। মিসেস ওয়াসীর ডাইনিংটেবিল থেকে কিছু ফল নিয়ে চপিংবোর্ডে কাটতে শুরু করলেন। বললেন,

– তোমরা সবাই কি ঢাকারই স্থানীয়?

– আমি বাইরের। হলে থাকি। রুমন আর তাথৈ এখানকারই।

শার্লির জবাবে তাথৈয়ের দিকে তাকালোন মিসেস ওয়াসীর। নরম গলায় বললেন,

– তোমার নাম তাথৈ?

তাথৈ অপ্রস্তুত হলো। এই প্রথমবার কারো নাম জিজ্ঞেস করায় ওর মুখ দিয়ে নিজের নাম বেরোলো না৷ কেবল ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে মাথা ওপরনিচ করে হ্যাঁ বুঝালো ও। তাথৈকে এমন নমনীয় জবাব দিতে দেখে রুমনের টেরেন্সের কথা মনে পরলো। একই প্রশ্নের জবাবে ও টেরেন্সকে যে চাওনিটা দিয়েছে, তাতেই ও বেচারার কলিজা গলা অবদি আসার কথা। মিসেস ওয়াসীর আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন ওদের সাথে। এরইমাঝে তাশদীদ কিচেন থেকে হাক ছুড়লো,

– মা?

মিসেস ওয়াসীর হতাশ হয়ে কিচেনের দিকে তাকালেন একবার। তাথৈও সেদিকে তাকালো। এখান থেকে তাশদীদকে দেখা যায় না৷ মিসেস ওয়াসীর কাটা ফলগুলো শার্লিদের খেতে বলে উঠে কিচেনে গেলেন। তাশদীদকে বললেন,

– হয়েছে! অনেক করেছিস। এখন যা তুই ওদের নিয়ে একটু হেটে আয়। এরমাঝে আমি বাকিটা শেষ করছি৷ যা!

– যথা আজ্ঞা!

তাশদীদ মাথা দুলিয়ে বারান্দায় আসলো। শার্লিদের উদ্দেশ্য করে বললো,

– চলো হেটে আসি।

শার্লি রুমন আগ্রহের সাথে উঠে দাড়ায়। তাথৈ বসেই ছিলো। তাশদীদের কপালে ভাজ পরে। তাথৈ বললো,

– আমি এখানেই থাকবো।

– এজ ইউ উইশ!

কাধ উঁচিয়ে বললো তাশদীদ। এরপর শার্লি রুমনকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো, ‘চলো যাই।’ বেরিয়ে যাওয়ার সময় শার্লি এসে তাথৈয়ের কানেকানে বললো,

– আমরা আসি। এরমাঝে তুই শাশুড়িকে পটিয়ে ফেল!

তাথৈয়ের গায়ে লাগলো না কথাটা। কাউকে পটানোর চাহিদা ওর নেই। ওর চাহিদা হয়তো মিসেস ওয়াসীরের আঁচলটা। বারান্দায় বসে কিচেনে দুলতে থাকা আঁচলটা চোখে পরছে ওর। তাথৈ বশীভূতের মতো উঠে দাড়ায়। একপা দু পা করে এগোয় কিচেনে। উঁকি দিয়ে দেখলো, মিসেস ওয়াসীর কড়াইয়ে খুন্তি চালাচ্ছেন। তরকারীর ঘ্রাণ আর ঝাঁঝে ভরে উঠেছে চারপাশের বাতাস। নাকে ঝাল শুরু হয় তাথৈয়ের। দু সেকেন্ডের মধ্যে ঘর কাপিয়ে হাচি দিয়ে ওঠে ও। একটানা হাচি দিতেই থাকে। মিসেস ওয়াসীর এসে ব্যস্তভাবে ছুটে এসে ওকে দুহাতে ধরে বললেন,

– আরে আরে! তুমি যাওনি ওদের সাথে?

ঝাঝে তাথৈয়ের নাক লাল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানি গরাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না ও। হাচি দিতে দিতে জ্বলতে থাকা চোখে মিসেস ওয়াসীরের দিকে কোনোমতে তাকালো ও। মিসেস ওয়াসীর ওকে দ্রুত পাশেররুমে নিয়ে আসলেন। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে, গ্লাসভর্তি পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

– ইশ! এডজাস্টার অন, কিচেনের জানালা খোলা, এরমাঝেও তোমার এমন অবস্থা? কিচেনে কেনো গিয়েছো তুমি? ইশ! নাও নাও! পানি খাও!

তাথৈ পানি শেষ করলো। মিসেস ওয়াসীর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

– এবার ঠিক লাগছে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝায় তাথৈ। মিসেস ওয়াসীর বললেন,

– তুমি বাইরে গেলে না? পুকুরের ওদিকটায় গেলে ভালো লাগতো। ওদিকে সুন্দর…

– আমার আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে।

মিসেস ওয়াসীর আটকালেন। ওনার মনে হয়েছিলো তাথৈ কম কথা বলে। এমন আদুরে কথাটা এমন স্পষ্টভাবে বলা যায়, পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না তার। আবারো তেমন চমৎকার হেসে বললেন,

– আচ্ছা বেশ। তুমি এখানে দু মিনিট বসো। আমি তরকারীটা নামিয়েই আসছি কেমন?

তাথৈয়ের তেমনি হ্যাঁ সুচক ইশারা। মিসেস ওয়াসীর রান্নাঘরে গেলেন। তাথৈ পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো। বড়বড় দুটো জানালার জন্য আলোবাতাসের অভাব নেই। খাট, ওয়ারড্রোব, ড্রেসিংটেবিল, পড়ার টেবিল, কালো খয়েরি রঙের কাঠের আসবাবে ছিমছামভাবে সাজানো। উঠে দাড়িয়ে জানালার দিকে গেলো তাথৈ। ঝুলতে থাকা সবুজ মানিপ্লান্টের আড়ালে ওর চোখে পরলো শার্লিদের। তাশদীদ উল্টোপাশ হয়ে দাড়িয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়ছে। সে একটা ঢিল পানির ওপরিভাগে তিন চারবার লাফিয়ে দুরে গিয়ে পরছে। মুচকি হেসে তাথৈ বইয়ের তাকে তাকালো। একলাইনে ধর্মীয় বই, একটাতে দেশি বিদেশি গবেষণার বই, একটাতে আলাদা আলাদা ভাষার বই। টেবিলের সবার সামনের খাতাটায় পাতাভর্তি বিক্রিয়া লিখে একটানে কেটে দেওয়া। বা কোনায় লাল মার্কারে লেখা, ‘Not found’
তাথৈ বিক্রিয়াগুলো পড়লো। প্রতিটি বিক্রিয়ায় এক রাইবোজের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষারকের ব্যবহার করা হয়েছে৷ তাথৈ বুঝে উঠলো না, উৎপাদ হিসেবে ঠিক কি চেয়েছে তাশদীদ। তবুও কলম নিয়ে নিজেনিজে দুইটা বিক্রিয়া লিখলো ও। এরমাঝেই কানে আসলো,

– মায়ের বউমা নাকি?

তাথৈ হচকিয়ে দরজায় তাকায়। তামজীদ ব্যাট কাধে বাঝিয়ে সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাথৈকে তাকাতে দেখেই ও উল্লাসে হেসে বললো,

– আরে! মায়ের বউমা যে!

তাথৈ আরেকদফায় থতমত খেয়ে গেলো। সরে দাড়াতে গিয়ে হাতে থাকা কলমটা পরে যায় ওর। ওইটুকো শব্দেও কেপে উঠলো তাথৈ। ওর ভয়ার্ত মুখটা দেখে তামজীদ শব্দ হেসে ফেললো। তাথৈ একবার পরে থাকা কলম দেখছে তো আরেকবার হাসতে থাকা তামজীদকে। একটুখানি দম নিয়ে, নিজেকে স্বাভাবিক করলো ও। বুকে হাত গুজে কাটকাট গলায় বললো,

– কারো বউ, বউমা কোনোটাই এখনো হইনি। কিন্তু তোমার ভাবী ডাকার ইচ্ছে হলে ডাকো। আমার সমস্যা নেই!

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩৬.

– কারো বউ, বউমা কোনোটাই এখনো হইনি। তোমার ভাবী ডাকার ইচ্ছে হলে ডাকো। আমার সমস্যা নেই!

তাথৈয়ের জবাব শুনে তামজীদ নিজেই এবার হচকিয়ে যায়। হাসি থেমে যায় ওর। তাথৈ নিস্প্রভ। তেমনি বুকে হাত গুজে থেকে বললো,

– মুসলিমরা একজন আরেকজনের ভাই হয়। সে হিসেবে যে আমার বর হবে, সে তোমার ভাইই হবে। সো ইউ ক্যান কল মি ভাবী। সমস্যা নেই!

তামজীদ কি ভেবে খুশি হয়ে গেলো আবারো। ব্যাট কাধ থেকে নামিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

– তোমাকে তামজীদের পছন্দ হয়েছে ভাবী। ইচ্ছে করে পাড়ামহল্লা জানিয়ে তোমাকে ভাবী ডাকি। কিন্তু সমস্যা হলো, এখন থেকেই তোমাকে ভাবী ডাকলে আমার আপন ভাই আমাকে আস্ত রাখবে না। এদিকটার কি করা যায় বলো।

তাথৈ বুক থেকে হাত নামালো। টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, পেছনদিকে দুহাত টেবিলে ঠেকিয়ে বললো,

– আমারো তোমাকে পছন্দ হয়েছে তামজীদ। আর তাথৈ আলফেজ যাকে পছন্দ করে, তাকে আস্ত রাখবে না, এতোবড় সাহসটা কারো নেই। সো রিল্যাক্স!

তামজীদ ব্যাট ঠিকঠাকমতো রেখে কোমড়ে হাত রেখে দাড়ালো। আরেকবার আপাদমস্তক দেখে নিলো তাথৈকে। ভাইয়ের ফোনে থাকা একমাত্র রমনীর ছবি বাস্তব হয়ে এ বাসায় এসেছে বলে কথা! তাথৈকে পরখ করার পর ওর মনে হলো, বেছেবেছে দুনিয়ার সবচেয়ে স্পষ্টভাষী, প্রখর-দৃষ্টির মেয়েটা ওর সামনে। তাথৈ বললো,

– কয় রানে আউট হয়েছো?

– আর বলো না। বারোতে গেছি।

– দুপুরবেলা লান্চ করে বিকেলবেলা খেলতে যেতে! হাফসেঞ্চুরি পাক্কা ছিলো।

মায়ের শাষনটা অন্য রমনীর কাছে অন্য ভঙিতে শুনে তামজীদ হাসলো। বললো,

– এখনই মায়ের মতো শাষন করছো দেখি! যাইহোক! তুমি কার সাথে এসেছো? আমার আপন ভাই তো তোমাকে দাওয়াত করে বাসায় আনার মতো মেটাল না। তাহলে?

তামজীদের কথার ভঙ্গিমা শুনে তাথৈ অতিকষ্টে হাসি সংবরন করলো নিজের। জবাব দিতে যাবে, মিসেস ওয়াসীর এরমাঝে রুমে আসলেন। তামজীদকে দেখে বললেন,

– ও! ছোট নবাব বাসায় ফিরেছেন? বলুন কি দিয়ে খেদমত করতে পারি আপনার? স্ট্যাম্পগুলো ধুয়েমুছে তাশদীদর আসা অবদি অপেক্ষা করবো? নাকি আমার খুন্তিতেই আপনি সন্তুষ্ট হবেন?

তামজীদ একবার মায়ের দিক তাকায়, তো একবার তাথৈয়ের দিক। দুপুরে খেলতে বের হলেই যে ওর নিয়ম করে মা-ভাইয়ের বকুনি জোটে, সেটা তাথৈয়ের জানাটা আবশ্যক ছিলো না। জোরালো হেসে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো তামজীদ। তার কাধে হাত রাখতে রাখতে বললো,

– কি যে বলো না মা! আমার কি আর এমন খেদমত নেওয়ার বয়স আছে? তুমি…

– খবরদার ধরবি না আমাকে! জলদি গোসল সেরে নামাজ শেষ কর! নইলে মার একটাও আজ মাটিতে পরবে তামজীদ! বলে দিচ্ছি!

তামজীদ গায়ে হাত দেওয়ার আগেই দ্রুততার সাথে সরে গেলেন মিসেস ওয়াসীর। শাষনের স্বরে বললেন কথাটা। তামজীদ বললো,

– আচ্ছা আচ্ছা। শান্ত হও! যাচ্ছি। এটা বলো এই ভা…মানে আপুটা কখন এসেছে? কার সাথে এসেছে? ভাইয়ার সাথে তো না তাইনা?

– কেনো? ওকে প্রীতিকার্নিশ আনতে তোর অনুমতি নেওয়া লাগতো?

তামজীদ দরজায় তাকিয়ে দেখে তাশদীদ এসেছে। পেছনে রুমন-শার্লিও আছে। ভাইয়ের স্বভাব নিয়ে তামজীদ যা জানে তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ায় ‘হেহ হেহ!’ করে হেসে গামছা নিয়ে গোসলে চলে গেলো ও। তাশদীদ একপলক তাথৈয়ের দিকে তাকালো। সে ওর পড়ার টেবিল ঘেষে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই তাথৈ সোজা হয়ে দাড়ালো। সরে আসলো ওখান থেকে। ওয়াসীর সাহেব বাইরে থেকে ডাক লাগালেন। সবাইকে খাবার টেবিলে বসার জন্য বলে ঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসলেন মিসেস ওয়াসীর। বাইরে এসে তাশদীদ বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তাথৈদের। তাথৈ খেয়াল করলো, তাশদীদের সাথে ওয়াসীর সাহেবের ব্যক্তিত্বের প্রচন্ড মিল। দৃঢ়তার পাশাপাশি সৌজন্যতা আর হাসির কোনোরুপ অভাব নেই ভদ্রলোকের ব্যবহারে। মিসেস ওয়াসীর ডাকে ডাইনিংয়ে এগিয়ে গেলো সবাই। ব্যস্তও হয়ে পরলো যারযার মতো। তাথৈ শুধু দেখছে। মিসেস ওয়াসীর কিচেনে খাবার বাড়ছেন, তাশদীদ হাতেহাতে তা এনে টেবিলে রাখছে, তামজীদ সবার প্লেট এগিয়ে দিয়ে টেবিলে জায়গা করে দিচ্ছে আর শার্লির সাথে হাসাহাসি করছে, ওয়াসীর সাহেব গ্লাসে গ্লাসে পানি ঢালছেন সাথে রুমনের সাথে কথা বলছেন। তাথৈ চাক্ষুষ দেখলো, পুরুষালি অহংকারের একবিন্দুও এ বাসার তিনপুরুষের মাঝে নেই। ছয় চেয়ারের টেবিলটায় তাশদীদ আরেকটা অতিরিক্ত চেয়ার এনে তামজীদ আর রুমনের মাঝামাঝি বসে গেলো। তাথৈকে বললো,

– বুজোকে বাইরে ডগফুড দিয়েছি। ওকে নিয়ে টেনশন করো না।

তাথৈ কিছুই বললো না। সত্যি তো এটাই, ওর একবারো বুজোর চিন্তা হয়নি। ও জানতো, সবার খেয়াল রাখতে জানা তাশদীদ বুজোকে ভুলবে না। মিসেস ওয়াসীর তাথৈয়ের পাশেই বসলেন। খাবার বাড়ার সময়ও ওনারা চারজন মিলে তাথৈদের বেড়ে দিচ্ছিলো, খাবারের বাটিগুলো একজন আরেকজনকে এগিয়ে দিচ্ছিলো, কথা বলছিলো, হাসছিলো। সবাইকে পরখ করা শেষে সামনের বড়সর প্লেটের দিকে তাকালো তাথৈ। স্টিলের ইয়া বড় ছড়ানো থালাটায় ধোয়া ওঠা ভাতের মাঝে ডাল। তার চারপাশে গোলগোল করে লালশাক ভাজি, সবুজ রঙের কোনো এক ভর্তা, পেয়াজের ঝোলে টকটক করতে থাকা মাছের টুকরো আর গরুর গোশত সাজানো। এতো খাবার দেখে একমুহূর্তের জন্য চারপাশ ঘুরে ওঠে তাথৈয়ের। পাশে তাকিয়ে দেখে সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। কেবল ও পরেছে বিপদে। চামচ ছাড়া হাতে খাওয়ার অভ্যস নেই। এখানে সবার মাঝে ওর একার চামচে খাওয়াটাও ভালো দেখাবেনা। তাই সাহস করে কাপাকাপা হাতে ভাতে আঙুল চালায় তাথৈ। মিসেস ওয়াসীর দেখলেন, তাথৈ এতোটাই আলতোভাবে ভাত মাখাচ্ছে যে ভাত ওর হাতে ওঠার বদলে প্লেটে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওর চেহারায়ও ভাত ঠিকঠাকভাবে তুলতে না পারার অপারগতা। মিসেস ওয়াসীর বললেন,

– তোমার হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস নেই?

খাওয়া বাদ দিয়ে সবাই তাথৈয়ের দিকে তাকালো। তাথৈ একবার তাশদীদের দিকে তাকিয়ে মিসেস ওয়াসীরের দিকে তাকালো। তারপর নিঃসংকোচে না সূচক মাথা দুলালো। মিসেস ওয়াসীর হেসে ফেললেন। তারপর তাথৈয়ের হাত ধরে ধরে ওকে ভাত মাখানো, খাবারের লোকমা বানানো শেখালেন। তাথৈ একদম মনোযোগী ছাত্রীটার মতো তার হাতের ভঙিমা দেখছে, নিজেও লোকমা বানাচ্ছে। ওকে আনাড়ি হাতে ভাত মাখাতে দেখে তাশদীদ শুরুতে নিয়ব্দে হাসলো। পরে খাওয়ায় মনোযোগ দিতে গিয়েও আনমনা হয়ে গেলো ও। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালে সে চামচেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চামচে অভ্যস্ত মেয়েটা ওর মায়ের কাছে হাতে ভাত খাওয়া শিখছে, সে ব্যাপারটা কতোটা স্বাভাবিক, আপাতত সেটাই ওকে ভাবাচ্ছে।

প্রীতিকার্নিশে পা রেখে বারান্দায় রুমনকে দেখে থেমে গেলো রিংকি। খাওয়াদাওয়া শেষে রুমন, তাশদীদ আর ওয়াসীর সাহেব বারান্দায় বসেছেন। রিংকি শুনতে পেলো তাশদীদের ঘর থেকে একাধিক মেয়েলী আওয়াজ আসছে। অথচ এ বাসায় মিসেস ওয়াসীর ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। রুমনকে দেখে তাশদীদের বন্ধুবান্ধবী এসেছে, এমনটাই আন্দাজ করলো রিংকি। ওউ জানে, তাশদীদের চেনাপরিচিতদের প্রীতিকার্নিশে হরহামেশাই যাতায়াত থাকে। মনেমনে এটুকোও ভাবলো, আগেরদিন ওর জামায় চা ফেলে দেওয়া তাথৈ যেনো এখানে না থাকে। তাশদীদ অসময়ে বাসায় রিংকিকে দেখে ভ্রু কুচকালো। বললো,

– রিংকি? তুমি এখানে?

তাশদীদের নজরে আসতে পেরেই রিংকির ঠোঁটে হাসি ফোটে। ওয়াসীর সাহেবকে সালাম দিলো ও। তারপর তাশদীদকে হাতের বক্সটা দেখিয়ে বললো,

– আব্বু শেরপুর গিয়ে ছানার পায়েস এনেছে। আপনার তো পায়েস পছন্দ। আর আপনি আমাকে আর পড়াতেও যাবেন না। তাই আম্মু বললো দিয়ে যেতে৷

তাশদীদ আজও বিরক্তই হলো। পায়েস ওর বাবারও পছন্দ। এভাবে ওর নাম করে রিংকির এ বাসায় আসাটা মোটেও পছন্দ হলোনা ওর। রুমন কপাল ডলার ভঙিমায় মুখ লুকালো। যতোদুর যা শুনছে দেখছে, তাতে ওরই এখন ভয় করছে। তাশদীদ বললো,

– এটার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। তুমি…

ওয়াসীর সাহেব নিমীলিত স্বরে বললেন,

– এসেছো যখন, ভেতরে গিয়ে বসো রিংকি। তোমার আন্টি ভেতরেই আছে দেখো।

বক্সটা ডাইনিংয়ে রেখে, মাথা দুলিয়ে ঘরের ভেতরে চলে যায় রিংকি। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই ওর হাসিটা গায়েব হয়ে যায়। তাথৈ, শার্লি, তামজীদ, মিসেস ওয়াসীর; তাশদীদের বিছানার চারজন। মিসেস ওয়াসীর তামজীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর তার কলেজজীবনের কথা বলছেন। তামজীদ তার কোলে শুয়ে রুবিক্স কিউব মেলাচ্ছে, মাঝেমাঝে মাকে খোচাচ্ছে। শার্লি কোলে বালিশ নিয়ে বসে মিটমিটিয়ে হাসছে। আর তাথৈ দুহাতে হাটু জড়িয়ে বসে, হাটুতে থুতনি ঠেকিয়ে মুচকি হাসিতে মিসেস ওয়াসীরের কথা শুনছে। রিংকির পায়ের তলার ঠান্ডা শান জ্বলন্ত কয়লা হয়ে যায় যেনো। অদ্ভুতভাবে ‘আন্টি’ বলে ডাক লাগায় ও। উপস্থিত চারজনই দরজায় তাকালো। মিসেস ওয়াসীর হাসিমুখে বললেন,

– ওমা রিংকি? তুমি কখন এলে?

তামজীদ কপাল কুচকে বিরবিরিয়ে বললো,

– ওমা আপদ? এটা কেনো এলো?

শার্লি একবার রিংকির দিকে তাকায়, একবার তাথৈয়ের দিকে। ও তাথৈয়ের অভিমত বোঝার চেষ্টা করছে। তাথৈ হাটু ছেড়ে বাবু হয়ে বসে গেছে এবারে৷ রিংকি ভেতরে ঢুকে বললো,

– ওনারা কখন এসেছেন?

– ওরাতো দুপুরে লান্চ করেছে৷ তুমি এসো। কেমন আছো বলো? ও বাসার সব কেমন আছে?

– সব্বাই ভালো আছে! তুমি কেমন আছে আন্টি?

রিংকি বিছানা ঘুরে এসে হুট করেই মিসেস ওয়াসীরের গলা জডিয়ে ধরলো। তামজীদ ধরফরিয়ে উঠে বসে। রিংকির এই নাটকটা এরআগে ঘটেছে বলে মনে পরছে না। পরপরই ওর মনে হলো, এরআগে তাথৈও এ বাসায় আসেনি। ইতিমধ্যে শার্লি ওর কাছে তাথৈয়ের বিষয়ে বলেছে, সাথে রিংকির ইতিহাসও জেনে নিয়েছে৷ তামজীদ হিসেব করে বুঝলো, চা ফেলার ঘটনার জন্য রিংকির মনে তাথৈকে নিয়ে কিছুটা হলেও ভয় ঢুকেছে। তাই ওর মাকে এসে ওভাবে জরিয়ে ধরেছে সে। মিসেস ওয়াসীর রিংকির আকস্মিক আলিঙ্গনে কিছুটা হচকিয়ে যান। তবুও জোরপুর্বক হেসে বললেন,

– হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ।

রিংকি তার গলা ছেড়ে তাথৈয়ের পানে চাইলো। তাথৈ আবারো ওমন হাটু জড়িয়ে বসলো। মুচকি হেসে বললো,

– কেমন আছো রিংকি? এডমিশনের রেজাল্ট কবে দেবে তোমার?

রিংকির রাগ হয়। তবুও মুখে জবাব দেয়,

– দুদিন পর।

তাথৈ কথা এগোলো না। ঘাড় বাকিয়ে তাকিয়ে রইলো রিংকির দিকে। রিংকি মিসেস ওয়াসীরের গা ঘেষে বসলো। মিসেস ওয়াসীর আবারো বলতে লাগলেন। এরইমাঝে তাশদীদ দরজায় নক করে ভেতরে আসে। একপলক ওকে দেখে তাথৈয়ের দিকে তাকালো রিংকি। সে মিসেস ওয়াসীরের কথায় মনোযোগী। টেবিলে থাকা টুপিটা নিতে গিয়ে তাশদীদে চোখে পরলো খাতায় অতিরিক্ত তিনটা বিক্রিয়া লেখা। তৎক্ষণাৎ ওর চোখ যায় তাথৈয়ের দিকে। তাশদীদ গম্ভীর গলায় ডাক লাগালো,

– তাথৈ?

তাথৈ নিমীলিত চোখে তাকালো ওর দিকে। তাশদীদ বললো,

– এই পেইজের নতুন তিনটা রিয়্যাকশন তুমি লিখেছো?

– হু।

– এক্সপেরিমেন্টে এই রিয়্যাকটেন্ট পেয়েছিলে?

– ল্যাবে আঠারোটা চেক দিয়েছিলাম।

– এদিকে আসো।

তাথৈ মিসেস ওয়াসীরের মুখপানে চাইলো। হয়তো সে চাওনিতে এটুকো বলা ছিলো, ‘আমি না আসা অবদি আপনি একশব্দও বলবেন না প্লিজ।’ বিছানা থেকে নেমে আসে তাথৈ। তাশদীদ টেবিলের কোনায় বসেছে। তাথৈকে চেয়ার দেখিয়ে বললো,

– ডেরাইভ দ্য রিয়্যাকশন।

– আমি এখানে রিয়্যাকশন ডেরাইভ করতে আসিনি!

সুস্পষ্ট জবাব দিলো তাথৈ। তাশদীদ ততোতাই স্পষ্টভাবে বললো,

– এটার ডেরিভেশন না করলে তুমি প্রীতিকার্নিশ থেকে একপাও বেরোতে পারবে না। গট ইট?

‘বেরোতে চাইছেই বা কে?’
মনের জবাবটা মুখে দিলো না তাথৈ। খাতাকলম নিয়ে চেয়ারে বসে গেলো ও। ওই টেবিলের কোনায় তাশদীদ বসেবসে ওর লেখা দেখছে। আর এটুকোই সহ্য হলো না রিংকির। রাগে ফুসতে ফুসতে বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলটার ড্রয়ারে আঙুল রাখে ও। তারপর জেদ করে বন্ধ করে দেয় ড্রয়ারটা। হাত তুলে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে তখনতখনই।
রুমের সবাই ওরদিক তাকালো। তাশদীদ টেবিল থেকে নেমে ছুটে আসে একপ্রকার। রিংকির ডানহাত ধরে দেখে ড্রয়ারে চাপ লেগে অনামিকা আঙুলের একপাশ কিছুটা থেতলে গেছে। একই ড্রয়ারেই ফার্স্ট এইড বক্স ছিলো। তাশদীদ দ্রুততার সাথে মলম আর সেলোটেপ বের করে রিংকির হাতে লাগিয়ে দিতে লাগলো। শেষে একটা ধমক দিয়ে বললো,

– দেখেশুনে হাতপা ছুড়োছুড়ি করতে পারো না? বড় হওনি?

– বড় হয়েছি বলছেন?

মেজাজ আরো বিগড়ে যায় তাশদীদের। হনহনিয়ে এসে টেবিলে এগিয়ে টুপিটা নিলো ও। তাথৈকে বললো,

– আসরের আযান হয়েছে। আই থিংক তোমাদের বেরোনো উচিত। তোমরা আসো, আমি মসজিদে নামাজটা সেরে সামনেই দাড়াচ্ছি।

তাশদীদ তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওকে ওভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে বারান্দা থেকে মিসেসকে ডাক লাগালেন ওয়াসীর সাহেব। তামজীদও গেলো মায়ের পিছুপিছু। রুমন দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছিলো। শার্লি ওকে সাইডে ডেকে বলতে লাগলো কি ঘটেছে।
তাশদীদের ঘরে কেবল তাথৈ-রিংকি। তাথৈ চেয়ার ছেড়ে বেশ স্বাভাবিক ভঙিতে রিংকির দিকে এগোলো। তারপর ওর হাত তুলে আঙুলটা পরখ করলো। রিংকির বুক দুরুদুরু করলেও ভাবে প্রকাশ করলো না কিছু। আঙুলটা দেখতে দেখতেই, হুট করেই সেলোটেপটা টান মেরে খুলে ফেলে তাথৈ। তৎক্ষণাৎ ব্যথাতুর আওয়াজ করে ওঠে রিংকি। চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। একটুপরে চোখ তুলে তাকায় তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ ফার্স্ট এইড বক্সে থাকা আরেকটা নতুন সেলোটেপ নিলো। রিংকির আঙুলে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,

– নিজেনিজে ব্যথা নিলে ব্যথা কম লাগবে। অন্যজন ব্যথা দিলে দেখো, ব্যথা বেশি পাওয়া যায়।

– তাশদীদ ভাই হয় তোমার। সিস্টার না। ওর হাত থেকে তুমি নার্সিং ডিসার্ভ করো না। সো? আমার নার্সিং কেমন? পছন্দ হয়েছে তোমার?

– আ্ আপনি কি চাইছেন?

তাথৈয়ের হাত থামে। রিংকির প্রশ্নে হাত থেকে চোখ তুলে, ওর মুখের দিকে তাকালো ও। টের পেলো, যতোটা বাচ্চা ভেবেছিলো, রিংকি ততোটাও বাচ্চা না। ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বুকে হাত গুজে দাড়ালো তাথৈ। বললো,

– আমার চাওয়া জেনে তোমার কাজ নেই। তুমি বরং আমার না চাওয়া শোনো।

রিংকি তাথৈয়ের দৃষ্টি পড়ার চেষ্টা চালালো। কিন্তু লাভ হলো না। ও বুঝলো, তাথৈয়ের ওই সুক্ষ্ম হাসি আর তীক্ষ্ণ চাওনির ভাষা পড়ার বয়স ওর হয়নি। ওকে খুব বেশিক্ষণ হতাশ হতে দিলো না তাথৈ। তেমনই দীপ্ত কন্ঠে বললো,

– আমি চাই না তুমি তাশদীদকে আর কোনোভাবে ডিস্টার্ব করো।

রিংকি প্রসারিত চোখে চায়। তাথৈ বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বললো,

– তুমি তাশদীদের জবাবটা জানো রিংকি। তুমি এটাও বোঝো, ও তোমাকে নিয়ে বিরক্ত। এরপরও এমনসব কাজ করো, যাতে ও তোমার প্রতি আরো বিরক্ত হয়। এন্ড ট্রাস্ট মি, এই ব্যাপারটা আমি একদমই চাইছি না। আমি চাইছি না তুমি তাশদীদের বিরক্ত বা বিব্রতবোধের কারন হও। চাইনা ওর সামনে-পেছনে, আগে-পরে, জানা-অজানায় তুমি এমন কিছু করো না যাতে ও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়। তোমার কারনে তাশদীদ একবারো ‘অসহ্যকর’ ভাবনায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলুক, এটা আমি একেবারেই চাইছি না!

রিংকি স্তব্ধ! বিমূঢ়! ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোচ্ছে না। তাশদীদের জন্য এইভাবে কেউ কোনোদিন ওকে বলবে, তা হয়তো ওর ধারনায় ছিলোনা। ওকে আটকে থাকতে দেখে তাথৈ কিছুটা ঘাড় বাকালো। জিজ্ঞাসুসূচক চেয়ে বললো,

– তুমি বুঝতে পারছো রিংকি, আমি ঠিক কি চাইনা বুঝিয়েছি?

রিংকি হুশে আসে। তাথৈ যে তাশদীদের প্রতি দূর্বল, সেটা ও বুঝেও বুঝতে চাইলো না। তাথৈয়ের কথায় ভয় ও পেয়েছে। তবুও যেনো কোত্থেকে সাহস জুগিয়ে বলে ফেললো,

– তাশদীদ ভাইকে আমি ভালোবাসি।

তাথৈ জবাব দিলো না। কয়েকদন্ড নিরবে চেয়ে রইলো রিংকির দিকে। তারপর একবার ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো তাকালো ওর চোখে। এই অল্পবয়সী মেয়ের জেদ আটকাতে ও কোনো চুড়ান্ত মাত্রায় যেতে চাইছে না। তাই নিজেকে সংবরন রেখে ধীরস্থির গলায় জবাব দিলো,

– ভালোবাসা হলে সেটাকে আঘাতের দুঃসাহস আমি করতাম না রিংকি। বাট রিমেম্বার! তাশদীদকে এতোটুকোও হ্যারাজ করবে, এমন জেদকে আমি টলারেট করব না। করতে পারবো না। সো স্টে এওয়ে ফ্রম হিম। বেটার ফর ইউ!

#চলবে…