দর্পণ পর্ব-৫+৬

0
211

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৫

দিলশাদ অবাক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখতে লাগলো। গ্রামের যে ছবি তাঁর মনে আঁকা ছিলো, সে রকম কিছুই দেখতে পেলো না। বিল পেড়িয়ে তাঁদের গাড়ি যখন লোকালয়ে আসলো সে অবাকই হলো । হবেই না কেন? গ্রামের সাইড হলেও গ্রামের ছিটেফোঁটাও তাঁর মনে হলো না। সেই শহরের প্রতিচ্ছবি। বাড়িগুলোর মধ্যে সব সৌভ্যতার ছোঁয়া। তফাৎতের মধ্যে শুধু তফাৎ শহরের বাসা চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ আর এখানে বাড়ির সামনে বড় বড় উঠান, আর রয়েছে সবুজ গাছগাছালি। এছাড়া দিলশাদের কাছে তেমন আর কোন তফাৎ মনে হলো না। এখন কোথাও গ্রাম আর আগের গ্রাম নেই। গ্রাম তাঁর নিজস্ব স্বত্বা হারিয়ে প্রতিনিয়ত শহরের মোড়কে মোড়াতে ব্যস্ত।

পরপর দুইটা সাদা ডুপ্লেক্স বাড়ি। প্রায় একই রকম দেখতে। সেগুলো পেড়িয়ে তিন নাম্বার বাড়িটার গেইট দিয়ে তাঁদের গাড়ি প্রবেশ করলো। এই বাড়িটা একতলা। বাড়িটা দেখতে সুন্দর! তবুও কেমন জানি একটা অযত্নের ছাপ। কিছু একটা নেই। তবে সাধারণ কাররো যে বাড়ি না, দিলশাদ ঠিকিই বুঝলো। কারণ একটা বাড়িই বলে দেয় বাড়ির মানুষের অভিজাত্য। তবে বলতেই হবে আগের বাড়ি দুটো বেশি সুন্দর। তাঁর একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো। এই বাড়ি গুলো কার। তবে নিজেকে দমালো। এই লোকটার সাথে কেন জানি আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্যই সেও বসে নেই। একটার পর একটা ফোন আসছে। আর সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে কথা বলছে। এতো এতো বিরক্ত আসে কোথা থেকে এর। বিরক্তর গোডাউন একটা।

গাড়ি বাড়ির উঠানে থামতেই দিলশাদ নামলো। নেমেই সোজা তাকালো। বিশাল একটা কাঠের দরজা। তাঁর দুটো পাট্টা হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজা বরাবর একজন বসে আছে। সে তাঁর খুব পরিচিত একজন। এর সাথেই সে বড় হয়েছে। তাঁর এক হাত জাপটে ধরে রাতের পর রাত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। তবে সেই পরিচিত একজনের সাথে এর কোন মিল সে খুঁজে পেলো না।

দিলশাদ ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো । তাঁর হাত, পা কাঁপচ্ছে। বুকের ভিতর থেকে মুড়িয়ে কিছু বেড়িয়ে আসতে চাইছে। তবে সে অনেক অনেক কষ্টে নিজেকে দমালো। এই সার্থপর মেয়েটাকে সে শাস্তি দেবে। অনেক অনেক শাস্তি। কারণ! সে তাঁকে সুখের সঙিতো করেছিলো। দুঃখের কেন করতে পারেনি। তাঁদের সম্পর্ক কি এতোটাই ঠুনকো ছিলো।

দিলশাদ এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো! হামিদা বানু, রুবিনা, ইউসুফ তাঁকে দেখে এগিয়ে আসলো। উসমান তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,—- উনি দিলশাদ! ভাবির বোন।

দিলশাদ সালাম দিলো। তবে তাঁর খেয়াল এদের দিকে নেই। তাঁর চোখ এদের পিছনে। ঐ যে সোফায়! যেখানে একজন বসে আছে পাথরের মতো। যার চোখের কোণা ভেজা। তবে সে নিশ্চুপ! কোন খুশি নেই, উচ্ছ্বাসতা নেই। কেন নেই?

ইউসুফ হেসে তাঁকে স্বাগতম জানালেও। হামিদা বানু আর রুবিনার মুখ কালো। বড় বোন তো বড় বোন। এই মেয়ে তাঁর চেয়েও সুন্দর। তাঁর উপর এই মেয়ে নাকি কিছুদিন এ বাসায় থাকবে । তাঁর এটা ভালো লাগছে না। বাড়িতে আছে জোয়ান ছেলে, কখন কি হয়ে যায় ঠিক আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা উসমান এই মেয়েকে আনতে গেছে। অথচো তাঁকে কিছু বলার প্রয়োজনও মনে করে নি। হামিদা বানু ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসতে লাগলো। না! এই ছেলারা তাঁর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচো তাঁর তিন ছেলে এখনও তাঁকে যমের মতো মানে।

হামিদা বানুর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হলো আলি হোসেন। তাঁর খুব নামডাক। না এই নামডাক কোন পিতৃউরসে থেকে সে পায় নি। নিজে অর্জন করেছে। আলি হোসেনদের আগের অবস্থা ভালো ছিলো না। তাঁর বাবা অকালেই চলে যায়। বাবা চলে যাওয়াতে তিনভাই, এক বোন আর মায়ের দায়িত্ব এসে পরে তাঁর ঘাড়ে । আলি হোসেন লেখাপড়া তেমন করেন নি। তাই সংসারের ঘানি টানতে বিদেশে পারি জমান। সেখান থেকেই সংসারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটা জমিও কিনে ফেলেন। তবে বিদেশে সে বেশিদিন থাকতে পারেন নি । যে কোম্পানিতে গিয়েছিলেন সেটা বন্ধ হওয়ার কারণে চলে আসতে হয়। দেশে ফিরে এসে সে আবার অর্থ কষ্টে পরেন। তখন তিনি সেই কেনা জমি বিক্রি করেন তবে যতোটাকা দিয়ে কিনেছিলেন তাঁর ডবল দিয়ে। তখনি তাঁর মাথায় বুদ্ধি আসে। আর তখন থেকেই তিনি জমি কেনা বেচার ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কপাল ভালো ছিলো। অল্পতেই দু-হাত ভরে টাকা আসতে লাগলো। তখন তাঁর নাম হয় দালাল আলি হোসেন। এই এক নামে তাঁর অবস্থা দিন দিন উপরে উঠতে থাকলো। উপরে উঠতে উঠতে তাঁর টাকা, নাম, বন্ধু বান্ধব এর সাথে শত্রুও বাড়লো। শিক্ষা না থাকলেও তাঁর ছিলো অঢেল বুদ্ধি। কিভাবে দমন করতে হয় সে ভালো করেই জানে। আর সেই জানা অন্য কাওকে জানতে গিয়ে দালাল থেকে আলি হোসেন হয়ে গেলো ভাই আলি হোসেন। শুধু সে উপরে উঠলেন তা না। ভাই দেরও উঠালেন! বিভিন্ন ব্যবসায় লাগিয়ে দিলেন। বোনকে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিলেন।

তারপর হামিদা বানু তাঁকে দেখে শুনে বেছে নিজের মনের মতো বিয়ে করালেন। রোকসানাও ছিলো মনের মতো। সুন্দর, শান্তশিষ্ট মেয়ে। সাত চরেও রা করতো না। সুখের সংসার ছিলো আলি হোসেনের। তবে রোকসানার মৃত্যু সব ভেঙে চুরে দিলো। ছোট্ট ইউসুফ আর এই ভাঙা সংসার হামিদা বানু আর রুবিনা আগলে ধরলেন। তবে সমস্যা হলো এক বছরের মাথায়। আলি হোসেন ঘোষনা দিলেন সে আবার বিয়ে করবেন। ইউসুফের জন্যও তো একটা মা দরকার। হামিদা বানুর অবশ্য কোন আপত্তি করলো না। ব্যাটা মানুষ বউ ছাড়া কতোদিন থাকবে।

তবে ঝামেলা বাঁধালো উমর আর উসমান। তাঁরা কঠিন ভাবে বললো,— আপনি বিয়ে করতে চান করবেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে এই ঘর, এই সংসার, সব আমাদের মায়ের। এখানে অন্য কাওকে আমরা গ্রহন করবো না। দাদী, ফুপু ইচ্ছে হলে থাকুক, না হলে নাই। তবে ইউসুফের জন্য তাঁরা দুই ভাই ই যথেষ্ট। তাঁর কোন মায়ের দরকার নেই। আর এটা আপনার বাড়ি। আপনি চাইলে আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী কে এই বাসায় অবশ্যই আনতে পারেন তবে আমরা তিন ভাই এ বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবো। এখন আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন।”

আলি হোসেন এমনি যাই যাক। তিনি তাঁর তিন ছেলেকে খুবই ভালোবাসেন। সাথে এই ডিসিশনে মনে মনে খুশিও হলেন। কারণ! হাজার হলেও তাঁর ছেলেরা বড় হয়েছে। আর ছেলেদের সামনে নতুন বউ নিয়ে বসবাস করা লজ্জার ব্যাপার। তাই অনায়াসেই তা মেনে নিলেন। তাঁর জায়গার অভাব ছিলো না। অন্য জায়গায় ঘর তুলে বিয়ে করলেন সাবিহাকে। সে ছিল বিধবা, থাকতো ভাইয়ে দের সংসারে। তাঁকে এক শর্তেই বিয়ে করা হলো। কোন সন্তান নেওয়া যাবে না। সেও বিনা দ্বিধায় তা মেনে নিলেন। তারপর থেকে এলাকায় আলি হোসেনের বাড়ি দুটো নামে পরিচিত এক. পুরাতন বাড়ি দুই.নয়া বাড়ি।

তিনি নিজে লেখা পড়া জানেন না। তবে দুই ছেলেকে পড়িয়েছেন । তাঁদের মাথা ছিলো ভালো, আগ্রহও ছিলো। কখনও তাঁরা তাঁকে নিরাশ করেনি। ছেলেদের তৈরি করেছেনও নিজের মনের মতো । তাঁর এখন বয়স হয়েছে। সব কিছু সামাল দিতে পারেন না। তাই তাঁর জায়গা এখন ধীরে ধীরে উমর নিচ্ছে আর যতো বাকি ব্যবসা সেগুলোর দায়িত্ব উসমানের। তাঁদের কপাল তাঁর বাবার মতোই। যখন থেকে দু-জন বাবার ব্যবসায় ঢুকেছে। দিন দিন তা ফুলে ফেঁপেই উঠছে।

আর এতো এতো টাকা পয়সা অন্যের মেয়ে এসে খাবে মতব্বরি করবে হামিদা বানু তা মানতে পারেন না। তাই তিনি চেয়েছেন তাঁর মোজো ছেলের মেয়ে সুমিকে উমরের বউ বানাতে। সুমি এই গুষ্টির একমাএ মেয়ে। বাইরে কেন যাবে।

তবে তাঁর আশায় পানি ঢেলেছে উমর। আর এখন উসমান। না উসমান এখনও তেমন কিছু করে নি। তবে করার আগেই তিনি লাগাম টানবেন। আর এই দীপার বোনকে অবশ্যই নজরে রাখবেন। এসব মধ্যবিত্ত ফ্যামেলির মেয়েরা পটাতে ওস্তাদ। একজনের মাথা খেয়েছে, আরেক জনেরটা সে দেবে না। সে মুখ কালো করেই বললো, — দরজায় কি দাঁড়ায় থাকবা নি। ভিতরে আসো। বোনের কাছে আসছো। যাও বোনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করো। এমনিতেই আমার দোষের শেষ নাই। বউতো বউ নাতবউকেও নাকি ছাড়ি না। আবার নতুন বদমান হইবে মেহমানদেরও ছাড়ি না।

দিলশাদ এবার ভালো করে হামিদা বানুর দিকে তাকালো। বয়সে চামড়ায় ভাজ পড়লেও এখনও যে মুখে পড়েনি সে সেটা ভালো করেই বুঝলো।
তাঁর আবার এই এক সমস্যা! অল্পতেই বেশি বুঝে। বুঝে বলেই এই অল্প সময়ের এক ঝলকে সে অনেক কিছুই বুঝলো। বুঝে হামিদা বানুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো! হেসে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই তাঁর কেন জানি খুব মজা লাগতে লাগলো। কেন লাগছে আর কেও না জানুক সে ঠিক জানে। জানে বলেই সে মনে মনে আফসোস করতে লাগলো। এতোদিন প্রবাদ শুনেছে লোকে খাল কেটে কুমির আনে। আজ নিজের চোখে দেখলো।

উসমান ভেবেছিলো সে এখন হ্নদয় বিদারক কোন দৃশ্য দেখবে। দু- বছরের উপরে দুবোনের দেখা হচ্ছে। একজন আরেকজনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। গাড়াগড়ি করে কান্না করবে। লুটোপুটি খেতে খেতে দু- জন দু-জনের সুখ দুঃখের গল্প বলবে। তবে এমন কিছুই হলো না। ভাবি নির্বিকার মুখে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো । আর দিলশাদ! বোনের চেয়ে বোনের বাড়ি ঘরের প্রতিই তাঁর বেশি আগ্রহ দেখা গেলো। সে চোখ, মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখতে লাগলো। ফুপুতো বলেই ফেললেন, — তোমারা মার পেটের আপন বোনই তো?

ফুপুর কথায় দীপা সব সময়ের মতো চুপচাপই বসে রইলো। আর দিলশাদ মিষ্টি করে হাসলো! হেসে বললো, — ডিএনএ টেষ্ট রিপোর্ট লাগবে আন্টি?

তাঁর মিষ্টি হাসিতে রুবিনার কিছু এলোগেলো না। বরং সে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। এই মেয়েকে তার সুবিধার মনে হচ্ছে না। না শুধু চোখে চোখে না এর পিছুপিছু লেগে থাকতে হবে।

রুবিনার কিছু না এলোগেলোও, এলোগেলো অন্য একজনের। এই প্রথম সে মেয়েটার মুখে হাসি দেখলো। টোল পড়া মিষ্টি হাসি। আর এই হাসিতেই তাঁর দুনিয়া থমকে গেলো। থমকে যাওয়া দুনিয়া নিয়ে সে বিস্ময়ভরা মুগ্ধ চোখে তাঁকিয়ে রইলো।

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৬

দিলশাদ রুম থেকে বাইরে আসলো। খেয়ে দেয়ে ফ্রেশ ট্রেশ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। ড্রইং রুমে আপাততো কেও নেই। শুধু দীপা টেবিলের উপর পা তুলে বসে আছে । চুপচাপ একা! দৃষ্টি বাহিরের দিকে। হাতে তার গাজর।

দিলশাদ হাসলো! প্রেগন্যান্সির সময়টা মেয়েদের সুন্দর সময়! আবার আজবও। সে এগিয়ে গেলো। আবহাওয়ায় কেমন জানি একটা গোমট ভাব। বৃষ্টি হবে কিনা কে জানে। কাল রাতেওতো উথাল পাথাল হলো। রাতের কথা মনে হতেই আবার ঐ পাহাড়- পর্বতের কথা মনে হলো। সাথে সাথেই সে বিরক্ত হলো! ধুর! ব্রেইন এসব ডিলেট করবে কবে?

সে আশেপাশে একবার তাকালো! এই বাড়ির বাইরের টা যেমন তেমন তবে ভেতরটা সুন্দর, গোছানো। প্রতিনিয়তো এক দু- বেলা ঠিক ঘষামাজা চলে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দু- সাইডে সারিবদ্ধ রুম। এক সাইডে কিচেন তাঁর সামনে ডাইনিং। মাঝখানে গোল করে সোফা রাখা। এতো সুন্দর চাকচিক্যময় বাড়ি! এতোগুলো মানুষের বসবাস। অথচো তবুও কোন প্রাণ নেই।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে স্বাভাবিক ভাবে দীপার পাশে গিয়ে বসলো। একদম কাছে। শরীরের সাথে ঘেঁষে। এটা তাঁর ছোট বেলার অভ্যাস। কতো বকা খেয়েছে এভাবে গায়ের উপরে বসার জন্য। শুনে কে? আপুর সাথে না ঘেঁষে তার শান্তিই লাগতো না।

দীপা কেঁপে উঠলো! চোখে টলমলে পানি এসে হাজির হলো। কি এক যন্ত্রনা! এতোদিন কাঁদতে পারেনি এখন থামাতেই পারছে না। সে পানি ফেরানোর জন্য অন্য পাশে তাকালো।

দিলশাদ দেখলো! তবে দেখেও না দেখার ভান করলো। স্বাভাবিক ভাবে বললো, —- তোমাদের বাড়ির আগে আরো দু-টো বাড়ি। খুব সুন্দর! সেগুলো কার আপু?

দীপা দিলশাদের দিকে তাকালো! তাকিয়েই মনটা ভরে গেলো। মনের মধ্যে শান্তির মিষ্টি একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেলে। ইশ! কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা! নাকি তাঁর কাছেই লাগছে। কতোদিন পরে দেখা।

দীপা হাত উঁচু করে দিলশাদের গালে রাখলো! একদম বাবার কার্বন কপি! লোকে বলে মেয়েরা বাবার মতো দেখতে হলে চাঁদ কপালি হয়। তাদের চাঁদের জোছনার মতো সুখ ছড়িয়ে পড়ে। দিলশাদেরও নিশ্চয়ই হবে। দীপা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! আর যাই হোক তাঁর মতো জানি না হয়।

দিলশাদ তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট । সে যখন মায়ের পেটে। সেই ভাই ভাই করে আম্মুর মাথা খেয়ে ফেলতো। কিন্ত যখন দেখলো বোন। সে যে কি কান্না! প্রথম প্রথম তো সে দেখতেই পারতো না। কিন্ত আমাকে কাছে পেলেই ঐ ছোট হাতে যখন আমার আঙুল টাইট করে ধরে রাখতো। দূরে গেলে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতো। আমার কি যে ভালো লাগতো। আস্তে আস্তে এই দেখতে না পারা মেয়েটাই হয়ে গেলো তাঁর জান। তাঁর একমাএ কলিজার বোন। আর দিলশাদ সে তো বড় আপুর নেওটা। এই বড় আপু ছাড়া তাঁর চলতোই না । অথচো কি থেকে কি হয়ে গেলো।

দিলশাদ তাঁর বাহু দিয়ে হালকা ধাক্কা দিলো। কি হলো? বোবা হয়ে গেছো? নাকি কথা বলবে না! এতো বড়লোক বাড়ির বউ। গরীর ছোট বোনকে বুঝি উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না । ঠিক আছে! না বললে নেই। তুমি ভালো করেই জানো! আমিও খুব বেশিক্ষণ কারো ভাব গনায় ধরি না।

দীপা নিঃশব্দে হাসলো! হেসে আস্তে করে বললো — উমরের চাচাদের বাড়ি।
— উমর কে?
— এই বাড়ির বড় ছেলে।
— তুমি কে?
— আমি দিলশাদের বড় বোন।
— তাহলে এখানে কি করছো?
— সাজা কাঁটছি।
— কিসের?
— ভালোবাসার।

দিলশাদের চোয়াল শক্ত হলো! তবে এই বিষয়ে আর কিছু বললো না। সে বোনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বললো,— কষ্ট হচ্ছে আপু?

— না! ভালো লাগছে।
— তোমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে?
— জানি না!
— এই দু-জন কে রেখে, এই বাড়ির সবাইকে আমি যদি খুন করি। তোমার কি খারাপ লাগবে?

দীপা হেসে ফেললো! প্রাণ খোলা হাসি। ইশ! কতোদিন সে হাসে না।

দীপার হাসির শব্দে উমর দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে গেলে! আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই হাসি! এই হাসি দেখেই উমর পাগল হয়েছিলো। অথচো তাঁর জীবনে আসার পরে মেয়েটা হাসাই বন্ধ করে দিয়েছে। কতোদিন পরে দীপা হাসলো? সে মনে করার চেষ্টা করলো। তবে ব্যর্থ হলো। ব্যর্থ মন নিয়েই সে এগিয়ে এলো, তাদের সামনে বসলো।

সে বসতেই দীপার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তবে দিলশাদের কোন ভাবান্তর হলো না। সে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বোনের হাত জড়িয়ে ধরলো।

উমর হাসলো! হেসে বললো,— কেমন আছো দিলশাদ?

দিলশাদ মুচকি হেসে লজ্জা মাখা মুখে বললো– ভালো।

দীপা অবাক চোখে বোনের দিকে তাকালো ! এই মেয়ে আস্ত এক নাটকি। লজ্জা আর সে! লজ্জা এই মেয়ের ধারের কাছেও নেই। সে যাদের দেখতে পারে না। তাদের সাথে সে খুব কোমল সুরে কথা বলে। এমন ভাবে বলবে যেন মাখনের মতো গলে যাচ্ছে।

— কখন এসেছো?
— এইতো কিছুক্ষণ আগে।
— খেয়েছো?
— হ্যাঁ।
— আসতে কোন সমস্যা হয় নি তো?
— উহু!
উমর আর কিছু বললো না। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কি বলবে? সম্পর্কে তাঁরা শালী দুলাভাই হলেও, দূরুত্বটা অনেক। সে উঠে দাঁড়ালো! মেয়েটা তাঁকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে। পাওয়ারি কথা! অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গা। তাই সরে যাওয়াই ভাল মনে করলো। তাছাড়া সে সরে গেলেই দীপা সহজ হবে। দীপা কিছু মুখে না বললেও, সে জানে! তাঁকে দীপা সহ্য করতে পারে না। সে যাওয়ার আগে দীপার দিকে একবার তাকালো। কি আশ্চর্য! দীপাকে অন্যরকম লাগছে। অথচো যাওয়ার আগেও তাঁর চোখ মুখ ছিলো ফ্যাকাশে।

____

আলি হোসেন উঠে দাঁড়ালেন! তাঁর ভালো লাগছে না। ইদানিং শরীরটা আর চলছে না। অথচো তাঁর মা টিং টিং করে ঘুরে বেড়ান। এখনও চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেন। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই লাঠি তুলে তেড়ে আসেন। আর সে! সামান্য এখান থেকে ওখানে হাঁটতে গিয়েও হাঁপিয়ে যান।
সে ফোন বের করলো! কল দিয়ে গাড়ি বের করতে বললো। আম্মা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছে। কেন পাঠিয়েছে সে আন্দাজ করতে পারছে।

তখনি সাবিহা রুমে আসলো! এই মেয়েটাকে সে যখন বিয়ে করেছে, তখন ছিলো সে রোগা পাতলা। আর এখন তাঁর তিন ডবল। হবেই না কেন! দিন ভরে আরাম আয়াশে থাকে। কাজ টাজ নেই। শুধু বাপের বাড়ির মানুষদের সাথে বসে বসে ইমুতে আড্ডা দেওয়া। অথচো রোকসানা স্বামীর এতো টাকা পয়সা ছিলো, কাজের লোক ছিলো। তবুও দু-দন্ড বসার সময় পায়নি। মৃত্যুর দু-তিন ঘন্টা আগেও সে বাচ্চা পেটে নিয়ে দুনিয়ার কাজ করেছে। আচ্ছা! সে কি পারতোনা একটু স্ত্রীর খেয়াল রাখতে। যেভাবে উমর রাখছে।

উমরের বিয়েতে সে খুশি ছিলো না। থাকবেই বা কেন? আগে তাঁরা যাই থাক। বর্তমানের অবস্থা ভিন্ন! আর বর্তমানের সাথে ঐ ফ্যামিলি আত্মীয়তা মানায় না। তাও আবার শহরের মেয়ে। তাঁর শহরের মেয়ে পছন্দ না । কেমন উড়নচন্ডী একটা ভাব থাকে। তবে দীপার মধ্যে সেই ভাব নেই। মেয়েটাকে দেখলেই তাঁর রোকসানার কথা মনে পড়ে। যেন রোকসানার প্রতিচ্ছবি! রোকসানার প্রতিচ্ছবি হলেও রোকসানা সংসারকে সে আগলে ধরেনি। এমনকি আপন করেও নেয়নি। তাঁকে যা বলা হয় সে চুপচাপ করে। না বললে নাই। অথচো সে এমন এক মেয়েকে উমরের বউ রুপে চেয়েছিলো যে রোকসানার শেষ হওয়া সংসার আবার শুরু করবে। দীপা সেই মেয়ে হয়ে উঠেনি। হয়তো নিজেই চাইনি। মেয়েরা চাইলে সব পারে। চাইনি বলেই হয়নি।

— কোথায় যাচ্ছো?

আলি হোসেন বিরক্ত হলেন! তাঁর প্রশ্ন পছন্দ না । এই মেয়ে জানে। তবুও ঘুরে ফিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেই থাকে।

— কিছু বললে কথা বলো না কেন?
— ঐ বাসায়।
— ঐ বাসায় এখন আবার কি?

আলি হোসেন সাবিহার দিকে তাকালেন! তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললেন, —- ঐ বাসায়ই আমার সব। এটা তুমি জানো। আর জেনেই এসেছো। তাই ঘুরে ফিরে প্রশ্ন করবে না। বলেই আর দাঁড়ালেন না। বেড়িয়ে গেলেন।

সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সবারি সব আছে। শুধু তাঁরই কিছু নেই। প্রয়োজন তো হয়েছে! প্রিয়জন হতে পারলোনা কোনদিনও।

আলি হোসেন এসে সোজা মায়ের রুমে গেলেন। যাওয়ার আগে ড্রইং রুম খালি দেখে অবাক হলেন। সে যখনি আসে দীপাকে এখানে বসা দেখে। মেয়েটা দিন রাত এখানেই বসে থাকে। বসে বসে কি দেখে কে জানে? আজব এক মেয়ে। রুমে নাকি তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। তবে আজব এই মেয়েকে তাঁর তিনো ছেলে খুবই পছন্দ করে। উমরের কথা বাদ। তাঁর বউ, সেতো পছন্দ করবেই। কিন্তু উসমান, ইউসুফ তারাও এই মেয়ের বিরুদ্ধে একটা শব্দও শুনবে না। বয়সে ছোট এই মেয়ে উসমানের। তবুও চোখ তুলে অসম্মান হবে এমন কথা কখনও বলে না। সে একশ পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে। এই মেয়ে যদি এই সংসার আগলে ধরে। মা আর রুবিনার মাতব্বরি এক সেকেন্ডই ফুঁটে যাবে।

হামিদা বানু ছেলেকে দেখেই গদগদ হয়ে গেলেন! মুখে মধু ঢেলে বললেন,— আয় বাজান! আয়! মায়ের পাশে বস। দরকার ছাড়াতো আহোছই না। কি এক জলহস্তিরে বিয়া করছোস। জল থাইকাতো বাইরই হইতে দেয় না। কপাল ভালো! আমার সাথে থাকেনা। তাইলে সোজা কইরা ফালাইতাম।

আলি হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন! মনে মনে বললেন,— সত্যিই কপাল ভালো।

তখনি জসিম আর রুবিনা রুমে আসলো। রুবিনার হাতে নাস্তার ট্রে।

—- বয়! সবাই বয়! আর আলি উসমাইনারেও আইতে কয়। আমার কথার তো আবার দাম নাই।

আলি হোসেন মোবাইল বের করে মেসেজ পাঠালো! ফোন করতে তাঁর ইচ্ছা হলো না। ইউসুফ কোথায় আছে কে জানে? এই ছেলে তাঁর ধারের কাছেও আসে না। তাঁর সব কিছু তাঁর দুই ভাই।

— শোনো তোমরা ! আমি ঠিক করছি! সুমি আর উসমানরে বিয়া দিমু। তাও অতি শীঘ্রই। একজনে যে কাজ করছে। সেই কাজ সেও করবো না গ্যারান্টি কি? তাই সময় থাকতেই সাবধান।

— আমার কোন সমস্যা নাই! আগেও ছিলো না। সেটা তো তুমি জানোই! বরং আমি খুশি আমার একমাএ মেয়ে আমার কাছেই থাকবো। শান্ত ভাবে বললো জসিম।

— তো তোমার কি মত? তুমি কিন্তু কথা দিছালা। জসিমের মাইয়া, তোমার বাড়িরই বউ হইবো। হামিদা বানু আলি হোসেন দিকে তাকিয়ে বললো।

আলি হোসেন বড় একটা শ্বাস ফেলে বললেন, — যখন কথা দিয়েছিলাম তখন সময় ভিন্ন ছিলো। রোকসানা বেঁচে ছিলো। এখন সময় ভিন্ন। তবুও মত জানতে চাইলে আমার সমস্যা নেই। যদি উসমান রাজি থাকে। তুমি ভালো করেই জানো আমি ছেলেদের উপর জোর খাঁটাই না। অবশ্য খাঁটিয়েও লাভ হবে বলে মনে হয় না।

তখনি উসমান রুমে আসলো! সবাইকে এক পলক দেখে রুবিনার পাশে বসলো। অবশ্য আর জায়গাও নেই । হামিদা বানুর রুমে খাট, আর দুটো চেয়ার ছাড়া বসার আর জায়গা নেই। আলি হোসেন আর জসিম খাটে বসেছে বলে এটা খালি পরে আছে।

— এতো জুরুরী তলব কেন? কি হয়েছে?

হামিদা বানু ঘোরাফেরার ধারের কাছে গেলেন না। সোজা ভাবে বললেন, — আমরা সুমি আর তোর বিয়া দিতে চাই। তোর মত কি?

উসমান হালকা হাসলো! হেসে বললো,— বিয়ে দিতে চাও দাও! আমার সমস্যা নেই। সমস্যা হলে দেখা গেলো। আবার ইউসুফরে নিয়ে টানাটানি করছো। তোমরা তো আবার কসম খেয়ে বসেছো। সুমিরে এই বাড়িই বউ বানাবে। তাই এই ঝামেলা আমিই শেষ করি।

আলি হোসেন ছেলেন কথা শুনে হেসে ফেললেন! তবে কিছু বললেন না।

হামিদা বানু তেঁতে উঠে বললেন, — হারামজাদা! জীবন দিয়া দিলাম তোগো লিগা। আর আমার লগো মসকরা করো।

উসমান উঠে দাঁড়ালো! তাকে বেরুতে হবে। কালকে, আজকে বলতে গেলে কোন কাজ’ই হয়নি। তাই দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবে বললো,— তুমি কোন জীবন দাওনি দাদী! জীবন দিয়েছে আমার মা। বলেই চলে যেতে লাগলো।

হামিদা বানু রেগে ফেঁটে পড়লেন! এতো বড় কথা! সে তাঁর হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারলেন। ছুঁড়ে মেরে অবশ্য লাভ হলো না। উসমান ততক্ষণে বেড়িয়ে গেছে।

চলবে……