পান পাতার বৌ পর্ব-০১

0
277

#পান_পাতার_বৌ
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“আপনার স্বামীর আপনাদের ষোলো বছর বয়সী কাজের মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে এই সন্দেহ করে আপনি ওনার হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন?”
সীমান্ত প্রশ্নটা করে খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। সামনে ইরিন বসে আছে নির্লিপ্ত হয়ে। তার মাঝে ন্যূনতম অপরাধবোধ নেই, তার সন্দেহ ভিত্তিহীন জানার পরেও!

-“মিসেস ইরিন, আপনার স্বামী আদনান হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। ওনার পরিবারের লোকেরা আপনার উপর ফিজিক্যাল টর্চারের কেস করেছে।”

-“তো? জেলে পাঠাবেন আমায়? ওর পরিবার তো তাই চায়! আমি জেলে যাই আর ওনাদের ছেলে একেক দিন একেক মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করুক।”

-“আপনি দাবি করেছেন আপনার স্বামীর আপনার বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে যতদূর জেনেছি আপনার স্বামী তাকে বোনের মতো স্নেহ করতেন।”

-“হ্যাঁ এখন সবাই মিলে এসব চক্রান্ত করছেন তো? করুন। ঐ দুশ্চরিত্র লোকের সব মেয়ের সাথেই সম্পর্ক আছে। বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা মেয়ে, ভাবী সবাই ওর সাথে ভাব জমিয়ে রাখতো। নষ্ট চরিত্রের সবাই!”

ইরিন চেঁচামেচি শুরু করলো। সীমান্ত লেডি কনস্টেবলকে ডেকে নিজে বেরিয়ে এলো। বাইরে ডাক্তার দাস বসা। সীমান্ত তার মুখোমুখি বসলো।

-“একই কথাই তো বলছে ডাক্তার। অনুতাপ নেই বরং এখান থেকে বেরোলে স্বামীকে পিস পিস করে কেটেও ফেলতে পারে।”

-“ডাউটিং ডিসঅর্ডার! অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।”

-“মেয়ের বাবা প্রভাবশালী। সরকারি অ্যাসাইলামে এভাবে পাঠানো যাবে না। আপনি বরং রিপোর্ট তৈরি করে দিন মেয়ের মাথার সমস্যা। তারপর ওর ফ্যামিলি এসে বেইল করে নিয়ে যাবে।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে তবে মেয়েটার প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। এত সন্দেহবাতিক! বিয়ের এক মাস না যেতেই যা করেছে, বাপ রে!”

-“ডাক্তার, মেয়েরা জন্মগত সন্দেহবাতিক। তিল থেকে তাল বানাতে ওদের গাছ লাগে না।”

-“এই ভয়ে বিয়ে করতেছেন না?”

-“কাঁটা ঘায়ে নুন ছিটায়েন না ডাক্তার।”

সীমান্ত বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। ডাক্তারের কথায় রাগ দেখালেও ঘটনা সত্যি। সীমান্ত এখনকার কেসগুলো দেখেই বিয়ে করতে ভয় পায়। এই মাসেই তিনটা কেস সে দেখেছে এসব সাংসারিক গ্যাঞ্জামের। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সীমান্ত। বয়সটা সাতাশে এসে ঠেকেছে আর বিয়ের শখটা আসমানে উড়তে বসেছে।

পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। সীমান্ত ফোন বের করে দেখল তার মা সালমা খানমের কল। মায়ের কল উপেক্ষা করলে বাড়িতে ঠাই হবেনা নিশ্চিত। কল রিসিভ করলো সে।

-“এই তাওসীফ! কই তুই? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। বলেছিলাম না আজ বিকেলে তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। দশ মিনিটের মধ্যে যদি তুই বাড়িতে না আসিস তাহলে তোর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।”

-“আম্মাজান, আপনার ছেলে পুলিশ! একটু তো আমার অবস্থাটা বুঝুন।”

-“তুই না আসলে তোর বাপের বিয়ে দিয়ে ঘর ছাড়বো আমি। তারপর থাকিস বুড়া বাপ আর সৎ মা নিয়ে।”

-“ধূর! রাখেন আসতেছি।”

সীমান্ত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে কনস্টেবলকে জানিয়ে বের হলো। জিপ নিয়ে গেলে জ্যামে পড়ে আধঘণ্টার বেশি লাগতে পারে ভেবে বাইক নিয়েই বের হলো সে। পাঁচ মিনিট হতে না হতেই ফোন বাজতে লাগলো। মায়ের ফোন ভেবে সীমান্ত বিরক্ত হয়ে বাইক সাইড করলো। ফোন বের করে দেখে কনস্টেবল আমিন কল করেছে। আর্জেন্ট ভেবে রিসিভ করলো সে।

-“হ্যাঁ বলো।”

-“স্যার তাড়াতাড়ি থানায় আসেন। ঐ ইরিন ম্যাডাম পাগলামি করতেছে। ওনার বাড়ির লোক আসছে কিন্তু উনি আপনার সাথে কথা বলবে। আর কারো কথা শুনতেছে না।”

-“আজব মুসিবত! ডাক্তারকে পাঠাও।”

-“কারো কথায় শুনতেছেনা স্যার। প্লিজ একটু আসেন। ওনার বাপ আমাদের মাথা নষ্ট করে ফেলতেছে।”

বিরক্তিতে চ’কারান্ত শব্দ করে বাইক ঘুরালো সে। আজ বোধহয় তার বাবার বিসর্জনটা নিশ্চিত! পাঁচ মিনিটের ঐটুকু রাস্তা আড়াই মিনিটে এসে থানার ভেতরে ছুটলো সীমান্ত।

-“আমিন? সমস্যা কী? কোথায় ঐ মহিলা?”

-“নিজেকে ইন্টারোগেশন রুমে লক করেছে স্যার। বলেছে আপনি ছাড়া আর কারো কথা শুনবে না।”

-“ডাক্তার দাসরে ডাকো।”

ডাক্তার দাস পাশেই ছিলেন। সীমান্তকে আসতে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন।

-“ডাক্তার এসব কী? আমাকে কেন ডাকতেছে ঐ মেয়ে?”

-“সেটা তো ওর সাথে কথা বললে বোঝা যাবে। তুমি যাও কথা বলে বোঝার চেষ্টা করো।”

-“আচ্ছা দেখতেছি।”

-“আর শোনো, ওর কথা শুনো। হুটহাট মানা করলে কী করে বসবে কে জানে!”

-“আচ্ছা।”

সীমান্ত সন্তর্পণে ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকলো। ইরিন মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে বসে আছে। পড়নের পোশাক বড্ড এলোমেলো দেখাচ্ছে। সীমান্ত চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো।

-“তাকাও আমার দিকে!” ইরিন করুণ স্বরে বলে উঠলো।

-“সমস্যা কী আপনার?” ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছে সীমান্ত।

-“একটু কথা বলবো। বসো এখানে।”

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসলো সীমান্ত। ইরিনের তীর্যক চাহনি মোটেও ভালো ঠেকছে না তার।

-“অফিসার, আমার হাতটা ধরবেন একটু? উঠে দাঁড়াবো। প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে।”

সীমান্ত বুঝতে পারছেনা ইরিনের মাথায় চলছে টা কী! সে খুব সাবধানে হাত ধরে ইরিনকে উঠালো। একটু হাঁটতেই ইরিন পড়ে যেতে ধরলে সীমান্ত তৎক্ষণাৎ ধরলো তাকে। ইরিন এবার বাঁকা চোখে তাকালো।

-“জানতাম! তোমরা সব পুরুষ এক রকম! চরিত্রহীন সবাই, সব্বাই নষ্ট!”

-“কাউকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানো চরিত্রহীনতা? আপনি এলোমেলো পোশাকে বসে থাকার পরেও আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছি, সাহায্য করতে চেয়েছি এসব চোখে পড়েনি? ম্যাম, যার চোখ যেমন বলে একটা কথা আছে। আপনার চোখের সমস্যা হয়েছে। বাইরে চলুন।”

-“তোমরা আমার স্বামীকে নির্দোষ বানাতে চাইছো? বানাও! তোমাদের আধিপত্য যখন তখন আর কী বলবো।”

-“আমাদের আধিপত্য? পুরষ নির্যাতনের আইনের কথা শুনেছেন? অথচ কিছু হলেই নারী নির্যাতনের মামলা করার ভয় দেখানো হয়। আপনার স্বামী এই দূরাবস্থার মধ্যেও নিজের পরিবারকে বলে কেস উঠিয়ে নিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই নাটক? পরিবারের কাছে যাচ্ছেন, সেখানেই ভালো থাকুন। সক্রেটিস বলেছেন যে যত কম জানে, সে তত সুখী। নিজেকে অসুখী নিজে বানায়েন না ম্যাম।”

ইরিন চুপ হয়ে গেল। সীমান্ত পরিবারের কাছে তাকে হস্তান্তর করে মহিলার স্বামীর কথা ভেবে আফসোস করলো। পরক্ষণেই নিজের মায়ের কথা মনে হতেই ঘড়ির দিকে তাকালো। আধঘণ্টা হয়ে গেছে ততক্ষণে। ব্যস! আর রক্ষে নেই। আর কিছু ভাবার আগেই সালমা খানমের দ্বিতীয় কল এসে উপস্থিত।

-“কোথায় তুই?”

-“বের হইছিলাম কিন্তু একটা আর্জেন্ট কাজে আবার আসা লাগলো। এখন বের হলেও পৌঁছাতে সময় লাগবে। আপনারা গিয়ে দেখে আসেন আজ। আমি পরে…”

-“মেরে পিঠের ছাল-চামড়া তুলবো তোর। বাসায় আসা লাগবে না। আমি এড্রেস পাঠাতে বলতেছি সৌমিককে। তুই একবারে ওখানে আয়।”

-“ইউনিফর্মে?”

-“তো কী খালি গায়ে যাইতে চাস? রামছাগল! এবার দেরি হলে হয় খালি!”

খট করে কলটা কেটে দিলেন সালমা। সীমান্ত বেচারা কী আর করবে। অসহায়ের মতো বাইক নিয়ে আবার বের হলো। তাই বলে ইউনিফর্ম পড়ে মেয়ে দেখতে যাবে! ভাবতেও বিব্রত লাগছে তার।

__________

খাবার দাবারের আয়োজন দেখে সন্তুষ্ট হলেন সালমা। তিনি জানিয়ে রেখেছিলেন কেবল তিনি, তার স্বামী এজাজ এবং তাদের ছেলে সীমান্ত আসবে। তবুও তারা সাত-আটজনের খাবারের আয়োজন করেছে। সালমা বেগমের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে সীমান্ত, ছোট ছেলে সৌমিক এবং মেয়ে সবার বড়, সায়বা। সায়বার বিয়ে হয়েছে দেড় বছর হলো। সালমা সবাইকে নিয়ে আসতে চাননি। এত মানুষ গিয়ে মেয়ে দেখা তার পছন্দ না। মেয়ের বাড়ির লোকজন ছোটলোক মনে করবে। অবশ্য এটা মেয়ের বাড়ি না, তার ফুপুর বাড়ি। মেয়ের নাম শর্বরী। মেয়ের ফুপু আলেয়া সালমা খানমের বান্ধবী। শর্বরী এখানে বেড়াতে এসেছিল। গত পরশু সালমা খানম এখানে তাকে দেখে পছন্দ করে ফেলেন। আজকে মেয়ের বাবা-মাসহ মেয়েকে দেখতে এসেছেন। সব ঠিক থাকলে শীঘ্রই মেয়ের গ্রামে গিয়ে বিয়ের পাকা কথা সেরে ফেলবেন।

-“সালমা, সীমান্ত কোথায়? এখনো আসলো না ছেলেটা! এভাবে বসে থাকতে তো খারাপ দেখায়।”

-“আপনারও তো ছেলে। আপনিই বোঝান একটু। আমার মান সম্মানের চিন্তা তো তার নাই!”

এজাজ চুপ করে গেলেন। বেশি কথা বাড়ালে সালমা খানম অযথা চেঁচামেচি শুরু করতে পারেন। এই মহিলার চেঁচানোর বাতিক আছে। সালমা খানম সীমান্তকে কল করার জন্য বসার ঘর থেকে একটু সরে উঠোনের দিকে আসলেন। নেটওয়ার্ক খুঁজতে খুঁজতে দরজার কাছে আসতেই পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো।

-“মাইয়া দেখতে আইছো?”

সালমা পেছনে ফিরলেন, একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে। মহিলার বয়স কমসে কম সত্তর।

-“জ্বী খালাম্মা।”

-“তা মাইয়ার যে আগে একবার বিয়া হইছিল হেইডা কী জানাইছে তোমগোরে?”

সালমা খানমের পায়ের নিচে জমিন নড়বড়ে হয়ে উঠলো। এ কেমন কথা? মেয়েটার একবার বিয়ে হয়ে গেছে অথচ আলেয়া তাকে জানায়নি! এত বড় ধোকা!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।]