পান পাতার বৌ পর্ব-০৫

0
145

#পান_পাতার_বৌ
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি

-“ভাবী তুমি এরকম বলদের মতো কাজটা করতে পারলে? শর্বরীকে একা যেতে দিয়েছো। এখন ও সবটা বলে দিলে? তোমাদের ভালো জিনিস হজম হয়না? এত ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো? ভাইকে তো এখনো বলিনি আমি। ভাইকে বললে তোমার সংসার না ভেঙে যায়!”

-“আপা, বেয়ান সাহেবাকে কেমনে নিষেধ করতাম? পরে যদি রাগ করে?”

-“তুমি আজ রাতের বাসে করেই সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আমি অন্তত বাগদান আগানোর ব্যবস্থা করতেছি।”

-“আচ্ছা আপা।”

শর্বরী বাড়িতে ফিরতেই কিছু বোঝার আগেই তার মা তাকে নিয়ে চললেন বাসস্ট্যান্ডে। শর্বরীর কোনো কথায় শোনা হলো না।শর্বরীর বাবা সকালেই গ্রামে গেছেন। আরজু বেগম ভেবেছিলেন মেয়েকে নিয়ে পরেই ফিরবেন কিন্তু আলেয়া বেগমের কথায় তার মনে যে ভয় ঢুকেছে তাতে আর ক্ষীণকালও এ শহরে তিনি থাকতে পারবেন না। শর্বরী নিশ্চুপ। তার মা কেবল জিজ্ঞাসা করেছে সে কিছু বলেছে কিনা। শর্বরী মাথা নাড়িয়ে না বলেছে।

-“তোর ফোনটা দে তো।”

শর্বরী ফোনটা দিল। এ ফোন সে যে আর পাবে না তা মোটামুটি বুঝে গেছে সে। হঠাৎ মায়ের এ পরিবর্তনের পেছনের কলকাঠি যে তার ফুপু নেড়েছে বুঝতে বাকি নেই তার। তার মা বরাবরই ভীতু মানুষ আর তাকে ভয় দেখানোর একমাত্র বস্তু হচ্ছে তার সংসার। সংসার ভেঙে যাবে এ ভয় দেখিয়ে গ্রামের কত ফকির যে তার মায়ের জমানো খুচরোগুলো ভাওতাবাজি করে নিয়ে গেছে তা তার মা টেরও পায়নি! শর্বরী বুঝে উঠতে পারে না মানুষ এত বোকা কী করে হয়।

_____________

-“কেস তো ক্লোজড। তারপরেও আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে যে স্যার?”

-“ইরিনার বিষয়টা ভাবাচ্ছে। ওর যদি সুইসাইড করার থাকতো তাহলে হাসপাতালে কেন করলো না? জেলে আনার পর কেন? হাসপাতালে তো আত্মহত্যা করা সহজ ছিল।”

-“পাগলের অত কী আর ভাবার আছে? হঠাৎ মাথায় ভূত চাপছে, মরে গেছে।”

-“মোটেও না আমিন। থানায় আত্মহত্যা করলে কেসটা আরো বড় হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ইরিনার বাবা পোস্ট মর্টেম করতে দিলেন না আর কী। উনিও কেসটা ঘাঁটাতে চাচ্ছেন না।”

-“বড়লোকদের ব্যাপার স্যার! বাবা মা কেন যে এদের জোর করে বিয়ে দেয়! শেষে ছেলে মেয়ে দুটোই তো মরলো।”

-“আচ্ছা আমিন। অনেক রাত হয়েছে। বাসায় যাও তুমিও।”

আমিন চলে যেতেই সীমান্ত মাথা চেপে ধরে বসলো। ইরিনার বিষয়টা বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল মেয়ে তো সে না। অন্তত এটুকু সীমান্ত নিশ্চিত। কেসটার কোনো একটা রহস্য তো ছিল যা ইরিনা আড়াল করতে চেয়েছে। আদনানের পরিবারও হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। ইরিনার বাবা যে সেখানে একটা বিনিময় করেছেন তাও বুঝেছে সীমান্ত। সীমান্ত ডাক্তার দাসকে কল করলো। ইরিনা মারা যাওয়ার পর প্রাথমিক পরীক্ষা তিনিই করেছিলেন।

-“হ্যালো দাসমশাই।”

-“সীমান্ত রাতের দুটো বাজে। তোমরা বড্ড জ্বালাচ্ছো ভাই!”

-“স্যরি স্যরি। একটু কথা ছিল।”

-“হ্যাঁ বলো।”

-“ইরিনার লাশে আপনি অদ্ভুত কিছু দেখেছিলেন?”

-“না সীমান্ত। এটা সুইসাইডই ছিল। আমি যখন যাই তখনও ইরিনা বেঁচে ছিল কিন্তু এতটা অসাড় হয়ে পড়েছিল যেন ওর বাঁচার ইচ্ছেই নেই। আর ও খুব সাধারণ একটা পাওডার বিষের কারণে মারা গেছে। যে মরতে চায় তাকে আসলে হাজার ধরে রাখলেও সে বাঁচবে না। হয়তো আদনানকে মারার গিল্ট থেকে বা ফাঁসির ভয়ে ও এমন করেছে।”

-“গিল্ট থেকে তো কোনোভাবেই না ডাক্তার!”

-“ভাই সীমান্ত, তুমি বিয়ে করোনি। আমি তো করেছি। তুমি কি চাইতেছো তোমার জন্য আমার ডিভোর্স হোক?”

সীমান্ত হেসে ফোন রাখতেই শর্বরীর কথা মনে পড়লো তার। মেয়েটার সাথে কথাও শেষ করতে পারেনি তখন। এত রাতে কি জেগে আছে সে? অত না ভেবে শর্বরীর নম্বরে কল দিল সীমান্ত।

-“হ্যালো কে?”

আরজু বেগমের ঘুমঘুম গলা শুনে খট করে ফোনটা কেটে দিল সীমান্ত। এই বয়সেও মেয়ের ফোন রিসিভ করে মা! লজ্জা লাগলো সীমান্তর। একটু পর শর্বরীর নম্বর থেকে কল আসলো। সীমান্ত বুঝে উঠতে পারলো না রিসিভ করবে কিনা। দোনোমনা করতে করতে শেষমেশ রিসিভ করেই ফেললো।

-“আপনি এত রাতে? কোনো সমস্যা?”

-“স্যরি। মিস করছিলাম তোমায়।”

-“রাত দুটোর দিকে? ঘুমান না আপনি?”

-“অভ্যাস করতেছি। তোমাকে বিয়ে করলে জেগে থাকবো।”

-“কেন?”

ভয় পেয়ে গেল শর্বরী। সীমান্ত কি সব জানতে পেরেছে? কে বললো? তার ফুপু? তার তো বলার কথা না!

-“এটা বিয়ের পর বলবো। বিয়ের আগে বলা বারণ।”

-“ঘুমান।”

-“থানায় ঘুম আসে না।”

-“আপনি বাড়িতে যাননি? আন্টি চিন্তা করবে তো।”

-“মা তো জানে তোমার সাথে থাকার কথা।”

-“ছিঃ! আপনি এত অসভ্য কেন?”

-“মাফ করেন মহারানি। ঘুমান আপনি। আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য এই অধমকে মাফ করিয়েন জানপাখি।”

শর্বরী কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সীমান্তরও তো ঘুম দরকার।

-“আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে বউ?”

শর্বরীর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না তবে তার দীর্ঘশ্বাস সীমান্তর কানে ঠিকই বাজতে লাগলো।

-“কাল দেখা করি আমরা? এখন তো এই কেসটাও সলভ হলো।”

-“আমি গ্রামে এসেছি।”

-“আরে! তোমাকে একবার বিয়ে করি আর কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি যেতে দিব না। ঘুমাও যাও। আড়ি তোমার সাথে।”

সীমান্ত মুচকি হেসে কল কাটতেই হঠাৎ মাথায় আসলো আদনানের পরিবারের কথা। আদনানরা এক ভাই, এক বোন। আদনানের বোন বলেছিল ইরিনা সবসময় আদনানকে সন্দেহ করতো এমনকি দুর্ব্যবহারও কিন্তু ইরিনার পরিবার বলেছে সে বিয়ের পরপরই ফ্ল্যাটে উঠেছিল। নিজের শ্বশুরবাড়িতে সে কখনো যায়ইনি। তাহলে কি আদনান এসব বলেছে নিজের পরিবারকে? নাহ! আদনান তো ইরিনাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। আদনান ইরিনা ছাড়াও তাদের ফ্ল্যাটে একজন থাকতো, সে হলো আসমা কিন্তু আসমা এখন মিসিং। আসল ঘটনা আসমাই বলতে পারতো কিন্তু সে কোথায়? আদনানের উপর হামলার পরপরই সে যদি ভয়ে কোথাও চলে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই নিজের গ্রামেই গিয়েছে। আমিনকে সে যখন পাঠিয়েছিল তখন আসমা নিজের গ্রামে ছিল না। সবকিছুর মধ্যে এই আসমা চরিত্রটাই মিসিং। একে খুঁজতে হবে। অফিশিয়ালি কেস ক্লোজড হলেও সীমান্ত চায় অন্তত সত্যটা জানতে।

_________________

-“তোর মনে কি একটুও দয়া হয় না আমাদের উপর? যদি একটুও দয়া হয়, তাহলে এখনি ওকে কিছু বলিসনা।”

-“একটা মিথ্যে কতদূর যাবে মা? ওরা তো আংটি পড়াতে আসবে তখন তো ঠিকই জানবে। আমি না বললেও পাড়া পড়শী তো চুপ থাকবে না।”

-“ওদের কথা তোকে ভাবতে হবে না।”

শর্বরী চুপ রইলো। তার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এই মহিলাটা কেবল নিজের সংসারের চিন্তা করছে। শর্বরীর বিয়েটা ভেঙে গেলে আলেয়া বেগম তার মাকে সংসার করতে দেবেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ঘুমোতে গিয়ে তো লাভ নেই। শর্বরী মায়ের পাশ থেকে উঠে যায়। আরজু বেগম শর্বরীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই মেয়েটাকে তিনি কখনো পৃথিবীতে আনতে চাননি। অনেক জটিলতা ছিল তবুও সব বাধা উপেক্ষা করে জন্মায়। আরজু বেগম ছোট থেকেই অবজ্ঞা করে গেছেন শর্বরীকে। বড় ছেলে শানজুকে তিনি ভালোবেসেছেন, একমাত্র ছেলেকেই তিনি ভালোবাসেন। শর্বরীর প্রতি তার আর মায়া কাজ করে না। শর্বরীর বিয়েটা হয়ে গেলে শর্বরীর ভাগের জমিটা তিনি বিক্রি করতে পারবেন এবং জমি বিক্রির টাকাটা শানজুকে বিদেশে পাঠাতে পারবেন। তার ছেলেটার টাকার দরকার। নিজের কাছে যা ছিল সবটা তিনি দিয়েছেন। এখন আরেকটু টাকা হলেই তার ছেলে দেশে ফিরবে। শর্বরীর ভাগের জমির টাকাটা পেলেই তিনি তা পাঠাবেন। শফিক সাহেবকে এসব জানাননি আরজু। শফিক সাহেব মেয়ের প্রতি দুর্বল, তাকে জানালে তিনি হয়তো বেঁকে বসবেন। আরজু বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মেয়ে তো চলেই যাচ্ছে, ছেলেটা অন্তত তার বুকে ফিরে আসুক!

চলবে…