মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-১০

0
156

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-১০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়। রাগ কমে যেতে থাকে। ঠিকঠাক একমাসও অতিক্রম হয়নি। খান বাড়ির সকলে এক শুক্রবারে এসে উপস্থিত ইরাবতীর ফ্লাটে। ইরাবতী যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো তাদের। যতোই হোক তার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। ইরাবতীর মা বাবা সব জেনে কিছু বলেন নি। তবে কষ্ট পেয়েছেন। একমাত্র ছেলে তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিলো বিষয়টা যেমন অবিশ্বাস্য তেমনই কষ্টের। তাদের বললে কি তারা বিয়ে দিতে মানা করতেন? সন্তানের সুখেই তো তাদের সুখ। তারা কয়েক দিন থেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। এরমধ্যে মেহের তাদের মন জয় করে নিয়েছে। নিজের ছেলের উপরও তাদের রাগ কমে গেছে। খান বাড়ির মানুষজন প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘মেহেরের পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের বাড়িতে রাখতে।’

কিন্তু ইশান স্পষ্ট করে মানা করেছে। সে তার বউয়ের সবরকম দায়িত্ব পালন করতে পারবে। ইরাবতীও ভাইয়ের সাথে সহমত। তার ভাইয়ের অবর্তমানে সেও সবরকম খেয়াল রাখবে।

সুতরাং খান বাড়ির কেউ আর কোনো কথা বলার সুযোগ পাননি৷ মেহের ও ইশানের সম্পর্ক আগের মতোই। মেহের ইরাবতীর সাথে থাকে। ইরাবতী কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে দুজনকে সময় দিচ্ছে। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশায়।

সময় যথা নিয়মে চলে যাচ্ছে। একদিন রাতে বাসায় ফিরে যখন খাবার টেবিলে সবাই খাবার খাচ্ছে তখন মেহেরের একটি কথা শুনে ইরাবতীর খাওয়া থেমে যায়। সে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি বললে মেহের?’

মেহের ভাত চিবাতে চিবাতে বলল,

‘ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখা শেষ।’

ইরাবতীর হৃদপিণ্ড বরাবর যেনো কেউ ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। চোখে অশ্রু টলমল করছে। মেহের পুনরায় বলল,

‘পাত্রী কে জানি না। ভাইয়াকে আমি মেসেজ করেছিলাম। সে নাকি নিজেও পাত্রী দেখেনি। মা ও ভাবি পছন্দ করেছে কারণ তার নিজের কোনো পছন্দ নেই।’

ইরাবতী অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো,

‘ওহ।’

‘তুমি ঠিক আছো?’

ইশানের কথায় ইরাবতী অনেক কষ্টে হাসলো।

‘কি হবে আমার? ঠিক আছি আমি। তোরা বরং খেয়ে নে। আমি উঠছি।’

‘তুমি তো কিছুই খেলে না আপু।’

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না মেহের। যদি ক্ষিধে পায় তো পরে খেয়ে নিবো না-হয়।’

মেহের ও ইশান একে-অপরের দিকে তাকালো। দুজনের কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে কি হলো ইরাবতীর!

*
গভীর রাত। ঘুমের মধ্যে কানে কারো মৃদু কান্নার শব্দ আসতেই ঘুম ছুটে গেলো মেহেরের। উঠে বসে দেখলো পাশে ইরা নেই। কান্নার শব্দটা বারান্দা থেকে আসছে। সে ধীরপায়ে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে লাইট অন করে দিলো। ইরাবতী চমকে চোখমুখ মুছতে শুরু করলো। মেহের অবাক হয়ে বলল,

‘তুমি কাঁদছিলে আপু!’

ইরা কোনো উত্তর দিলো না। মেহের দু’কাধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরালো।

‘তোমার কি হয়েছে আপু? ছোট বোন মনে করে বলতে পারো আমায়। ‘

ইরাবতী হাসলো,

‘তেমন কিছু না মেহের। মাথা ব্যথা করছিল। আমার জন্য তোমার ঘুমটা ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই? যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। তুমি হয়তো জানো না আমি এরকম রাত জেগে অভ্যস্ত।’

মেহের পুনরায় অনুরোধ করলো,

‘বলো না আপু।’

ইরাবতী চমৎকার করে হাসলো,

‘কিছু জিনিস থাকে যা কাউকে বলা যায় না। নিজের মধ্যে গোপন করে রাখতে হয় সারাজীবন!’

ইরাবতীর হাসিটা মেহেরের কাছে বড্ড কষ্টের মনে হলো। কষ্ট চেপে মানুষ যে হাসিটা হাসে? ঠিক তেমনই হাসি সেটা। ইরাবতীর কথাটা শুনে সে শতভাগ নিশ্চিত মারাত্মক কোনো কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে ইরা।

মেহের বারান্দা থেকে প্রস্থান করার আগে বলল,

‘তুমি ও এসো ঘুমাবে।’

*
পরদিন সকালবেলা ইরাবতী যখন হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে তখন আচমকা কলিংবেল বেজে উঠলো। সে নিজেই দরজা খুলে দিলো। মাহতাব দাড়িয়ে আছে। ইরাবতী হেসে ভেতরে আসতে বললো।কিছু নাস্তা নিয়ে এসে রাখলো মাহতাবের সামনে। মাহতাব ভোজন রসিক। সে খেতে খেতে বলল,

‘দাওয়াত দিতে এসেছি। মাহিরের এনগেজমেন্ট ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।’

ইরাবতীর মাথা ভো ভো করে ঘুরতে লাগলো। সে সোফার হাতল ধরে বসে পড়লো। মাহতাব উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘আর ইউ ওকে ইরা?’

ইরা হাসতে চেষ্টা করলো,

‘আমি ঠিক আছি ভাইয়া। মনে হয় প্রেশার লো হয়ে গেছে। আপনি খান না, আমি ঠিক আছি। মেহের ও ইশান বাসায় নেই। দুজন কলেজ ও ভার্সিটিতে।’

মাহতাব অবাক হয়ে ইরাকে দেখলো। সে সহজ-সরল মানুষ। সেজন্য সরল মুখে বলে ফেলল,

‘মাহিরের এনগেজমেন্টের কথা শুনে তুমি হঠাৎ অসুস্থ কেন হলে ইরা?’

ইরা চমকে গেলো। কিন্তু মুখশ্রীতে তার বিন্দুমাত্র চাপ পড়তে দিলো না। বলল,

‘আরে কি বলেন ভাইয়া। আমার ভাইয়ের বউয়ের ভাইয়ের এনগেজমেন্ট। আমি তো খুশি হয়েছি। অনেক দিন দাওয়াত খাই না। হসপিটাল হতে বাড়ি, বাড়ি হতে হসপিটাল ছুটতে ছুটতে সময় পাই না। তবে এবার অবশ্যই সময় বের করে যাবো। আমাদের আত্নীয়দের কারো শুভদিন বলে কথা।’

মাহতাবের মনে হলো ‘মানুষ যখন কিছু লুকাতে চায় তখন বেশি কথা বলে।’ ঠিক যেমন ইরাবতী বলছে। কিন্তু কি লুকাতে চাইছে ইরা!’

ইরা ফের তাড়া দিলো,

‘আপনি কিছু খাচ্ছেন না কেন ভাইয়া?’

মাহতাব উঠে দাড়ালো।

‘আগামীকাল সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট। আসলে মাহিরের সময় নেই। বুঝোই তো বিজি পারসন সে। এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের অনুষ্ঠান করে ফেলতে হবে। তারপর সে আর সময় পাবে না। কারণ তার দেশের বাহিরে খেলতে যেতে হবে। যদি পারো তো মেহেরকে নিয়ে আজই চলে এসো।’

‘আমি আগামীকাল যাবো ভাইয়া। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি মেহের ও ইশানকে আমি আজই পাঠিয়ে দিবো। আপনি চিন্তা করবেন না।’

‘আন্টি আঙ্কেলকে ফোন করে বলে দিয়েছি। তারা আসবেন বলেছেন।’

ইরা হাসলো,

‘তাহলে তো হলোই। আমি যদি হসপিটালের সিডিউল চেঞ্জ করে আসতে পারি তো যাবো।’

মাহতাব রেগে বলল,

‘কি এক ডিউটি তোমার ইরা। তুমি যদি না আসো না তবে আমি মারাত্মক রাগ করবো তোমার উপর। সবমসময় কি আর ছুটি নিবে নাকি তুমি?’ কয়েকটা দিনের জন্য ছুটি তো নিতেই পারো।’

‘আচ্ছা আচ্ছা নিবো। আপনি তবুও রেগে যাবেন না বেয়াইন সাহেব।’

মাহতাব হেসে প্রস্থান করলো। ইরা চোখের চশমা খুলে তা পরিষ্কার করলো। তারপর টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে আবারও তা চোখে পড়ে নিলো। জীবন বড়োই নিষ্ঠুর। জীবন তাকে এক ইঞ্চি ও কষ্ট দিতে ছাড় দিবে না। জীবন কেন সবসময়ই তাকে কষ্ট দেয়? ইরাবতীর জন্ম হয়েছে কি শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্য! পৃথিবীতে ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের কেউ বুঝে না কেন? কেন কেউ ভাবে না তাদেরও মন আছে। তাদের ও কারো বুঝা উচিত। তাদেরও কারো ভালোবাসা উচিত। কেন আপনি বুঝলেন না মাহির? ইরাবতীর মনের কথা কেন আপনি বুঝলেন না!

ইরাবতী দূর্বল পায়ে হেটে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ফোন করে সিডিউল চেঞ্জ করে রাতে নিয়ে নিলো। তার চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল,

‘আমার শুরু করা সেই অন্যরকম উপন্যাসটা আর শেষ করা হবে না মাহির। সেটা অসমাপ্তই পড়ে থাকবে হয়তো। আমি গত বইমেলায় অন্য বই বের করেছি। এই উপন্যাসটা আপনি হীনা অসম্পূর্ণ থাকবে মাহির। সাথে অসম্পূর্ণ থাকবে লেখিকা ইরাবতী আমিন!’

সন্ধ্যায় মেহের ও ইশানকে খান বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো ইরা। তারপর রাতের আঁধারে বিষন্ন মনে চলে গেলো হসপিটালে। রোগীদের সেবা করলে যদি একটু কষ্ট কমে। রোগীদের সুখ দুঃখের কথা শুনলে যদি একটু শান্তি অনুভব করা যায় তো মন্দ কি। সে তো চলতে পারছে, খেতে পারছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সে সুস্থ আছে। হসপিটালের কতো মানুষ বেঁচে থাকতে যুদ্ধ করে। তাদের কষ্টের কাছে ইরাবতীর এক তরফা এই দুঃখ খুবই সামান্য! ইরাবতী কোথায় যেনো পড়েছিল,

‘মৃত্যু মানুষের চেয়ে জীবিত মানুষকে হারিয়ে ফেলাটা বড্ড কষ্টের!’

(চলবে)