#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-১১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
আলোক সজ্জায় সজ্জিত খান বাড়ি। মাহিরের এনগেজমেন্ট পার্টি টা খান বাড়িতেই হবে। কনেপক্ষ ইতিমধ্যে চলে এসেছেন। শুধু কনের আসাই বাকি। সে মূলত পার্লার থেকে সরাসরি এদিকে আসবে।
কালো স্যুটে মাহিরকে প্রিন্সের থেকে কম লাগছে না। সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে কথা বলছে। এককোণে দাড়িয়ে আছে মেহের ও নাতাশা। ইশানের কাঁধে হাত রেখে মেহেরের বাবা তাহসিন খান পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন রিলেটিভদের সাথে। মেহের বার-বার মুঠোফোন চেপে ইরাকে ফোন করছে। কিন্তু রিসিভ করছে না ইরা। পনেরো বারের সময় রিসিভ হলো কল। মেহের চিন্তিত স্বরে বলল,
‘তুমি কোথায় আছো আপু? ফোন ধরছিলে না কেন? জানো কতো চিন্তা হচ্ছিল আমার?’
ইরা ওপাশ থেকে হাসলো,
‘আমি ওটিতে ছিলাম মেহের।’
‘তুমি! তুমি এখনো হসপিটালে! কখন আসবে?’
‘আব্বা আম্মা কোথায়?’
‘আব্বা রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। আম্মা মায়ের সাথে আছেন কোথাও।’
‘ঠিক আছে আমি আসছি।’
*
হসপিটাল থেকে বাড়ি এসে ইরাবতী ফ্রেশ হয়ে নিলো। আজ সে সাজবে। যেরকম সাজ সে আজ পর্যন্ত সাজেনি। ইরাবতী খয়েরী রঙের সিল্কের শাড়ি শরীরে জড়িয়ে নিলো। কানে ভারী ঝুমকো। চুলগুলো খোঁপা করে তাতে কিনে নিয়ে আসা তাজা চারটে লাল গোলাপ গেঁথে নিলো। পায়ের নিচু জুতোটি খুলে হাই হিল পড়লো। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক। মুখশ্রীতে পাউন্ডেশন করা। গাল গাঢ় গোলাপি। যেনো দুটো টমেটো। চোখে লাল জরির আইস্যাডো। পাপড়িতে যোগ হয়েছে একস্ট্রা পাপড়ি। মাশকারা দিয়ে যা গাঢ় কালো করা হয়েছে। ইরাবতী নিজেকে পূর্ণরূপে আয়নায় দেখে নিলো। তাকে অপ্সরার থেকে কম লাগছে না৷ গলায় একটি চিকন প্যান্ডেট পড়ে নিলো সে। হাতে কারুকাজ করা খয়েরী রঙের চুড়ি। ইরাবতী নাকে সিম্পল একটি নোলক পড়ে নিলো। নখে শোভা পাচ্ছে খয়েরী রঙের নেইলপালিশ। সিম্পল একটি সাইড ব্যাগ কাঁধে রাখলো ইরা। যার ফিতা গড়িয়ে ব্যাগটা স্থান করে নিয়েছে পেটের কাছে। ব্যাগটা খুবই ছোট। ইরা সেটাতে শুধু টাকা নিয়েছে। স্মার্টফোন হাতে নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা গিফট বক্সটি হাতে তুলে নিলো সে। তারপর বেরিয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে।
খান বাড়িতে তুমুল হৈচৈ। বক্সে গান বাজছে৷ তার তালে তালে নাচছে মাহিরের বন্ধুরা। নাবিদ ও নিবিড় নিজেদের বউকেও নিয়ে এসেছে। শাওন ও সৈকতের সাথে কথা বলছে মাহির। তখনই খান বাড়ির প্রবেশ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো শাড়ি পরিহিতা এক অপ্সরা। শাওন ও সৈকত হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। মাহির কথা বলতে বলতে দুজনের দৃষ্টি যেদিকে সেদিকে সরাসরি কৌতূহল নিয়ে তাকালো। সৈকত শাওনের দিকে হেলে পড়ার ভান করে বলল,
‘হায়..! বুকে ব্যথা করছে রে দোস্ত। নার্সিং বেডি এতো সুন্দর কেন? আমারে ধর মামা।’
শাওন সৈকতকে সোজা করে দাঁড় করালো। চোখের চশমা ঠেলে ইরাকে দেখে নিলো। যার দিকে পার্টির সবার দৃষ্টি স্থির। ইরা সবার চাহনি উপেক্ষা করে মাহিরের সামনে এসে দাড়ালো। হাতের গিফট বক্সটি সামনে তুলে ধরলো।
‘আমার তরফ থেকে সামান্যতম উপহার মিস্টার ক্রিকেটার।’
মাহির চোখের পলক না পেলে তা হাতে তুলে নিলো। গিফট বক্স রেখে ইরার দিকে তাকালো আবার। বলল,
‘আপনাকে আজ সবথেকে অন্যরকম লাগছে। নতুন রুপে আপনাকে অপ্সরা লাগছে ইরাবতী।’
‘তাই?’
‘আপনাকে সত্যিই অনেক প্রিট্টি লাগছে। যদি বিশ্বাস না-হয় তো চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন। সবাই কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে আপনাকে।’
‘আপনিও?’
মাহির থমথমে কন্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ আমিও।’
ইরা কিছু বলবে তখনই দুটো মহিলা এসে দাঁড়ালেন। একজন ইরার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে বললেন,
‘মাশাআল্লাহ। আমি আমার ছেলের বউ পেয়ে গেছি। এই মেয়েটাকেই আমার ছেলের বউ বানাবো। কি নাম মা তোমার?’
ইরা হতভম্ব। বলল,
‘ইরাবতী আমিন।’
‘সুন্দর নাম মা। তুমি কি আমার ছেলের বউ হবে?’
‘আপনার ছেলে?’
‘আরে আমার ছেলে শাওন, মাহিরের বন্ধু। এই শাওন এদিকে আয় তো।’
শাওন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৈকত শাওনকে ঠেলে পাঠালো। মহিলা শাওনকে দেখিয়ে বললেন,
‘এটা আমার ছেলে শাওন, পেশায় ডাক্তার।’
ইরা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
‘আমি তো বিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি আন্টি। তবে আশা করছি আপনার ছেলের জন্য মনমতো বউ পেয়ে যাবেন শীগগির।’
মহিলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইরা প্রস্থান করলো। শাওন অবাক স্বরে বলল,
‘তুমি এতোক্ষণ এসব কি বললে মা?’
মহিলা মুখ ঝামটা মারলেন।
‘কি আর বলবো? হাঁদারাম কোথাকার, এখনো পর্যন্ত একটা প্রেম করতে পারলি না। মেয়েটাকে পটানোর চেষ্টা তো করতে পারিস। কতো সুন্দর মেয়ে।’
সৈকত হেসে ফেলল,
‘আন্টি আপনার ছেলের দ্বারা সেটা কখনোই সম্ভব না।’
শাওন রেগে তাকালো। বলল,
‘পৃথিবীতে কি আর কোনো মেয়ে নেই? আমার যখন বিয়ে করতে ইচ্ছে হবে আমি বলবো। তখন কানা লেংড়া যাকে পারো তাকে ধরে নিয়ে এসো। আমি চোখ বুজে বিয়ে করে নিবো।’
শাওন অন্যদিকে চলে গেলো। মাহির নিরব দর্শক হয়ে এতোক্ষণ সব দেখে গেলো। তার চোখ ঘুরেফিরে ইরাকে দেখছে। ইরার হাসি। মেহেরের সাথে হেসে হেসে কথা বলা। মাহদিকে কোলে নিয়ে কিছু বলছে। যার কারণে মাহদি হাসছে। মাহির সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেও হেসে ফেললো।
তারপর এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। সব লাইট বন্ধ হয়ে গেলো। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খান বাড়ির প্রবেশ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো সাদা গাউন পড়া একজন রমনী। যার উপর লাইটের আলো পড়েছে। সবাই কৌতূহল হয়ে তাকে দেখছে। বাবার হাত ধরে খান বাড়িতে এসেছে সে। যার সাথে মাহিরের এনগেজমেন্ট হবে কিছু মূহুর্ত পর। মাহির প্রথম বার তাকে দেখলো। মেয়েটিকে নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়। কিন্তু মাহিরের কোনো আকর্ষণ এলো না। কেন এলো না সে জানে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে কর্নারের দিকে। যেখানে দাড়িয়ে আছে রক্তজবা ফুলের মতো একজন রমনী!
মেয়েটির নাম অর্ষা। একজন বিজনেসম্যানের মেয়ে সে। মেয়েটিকে এনে দাঁড় করানো হলো মাহিরের পাশে। মাহির ইতস্তত করতে লাগলো। মাকে বলে উপরের দিকে হাটা ধরলো। দূরে দাড়িয়ে ইরা তা দেখলো। সুযোগ বুঝে সেও সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো। এটাই তার জীবনের প্রথম এবং শেষ সুযোগ।
ওয়াশরুম থেকে বের হলো মাহির। টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছছিল সে। তখনই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ইরা। মৃদু শব্দে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। মাহিরের নজর ইরার দিকে। ইরা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। মাহির প্রশ্ন ছুড়লো,
‘আপনি এখানে কেন?’
ইরাবতী উত্তর দিলো না। চোখ ছলছল করে উঠলো তার। দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো লিপস্টিকে ঢাকা ঠোঁট। মাহির অবাক হলো।
‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি ইরা।’
ইরাবতীর কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মাহির এবার উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘কি হয়েছে না বললে বুঝবো কিভাবে? আপনি কাঁদছেন কেন ইরা?’
ইরা আছড়ে পড়লো মাহিরের বুকে। মাহির ভারসাম্য রাখতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে গেলো। ইরা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাহির আশ্চর্য হয়ে ইরাকে নিজের থেকে সরাতে গিয়েও সরালো না। মাথায় হাত রেখে বলল,
‘আপনি কাঁদছেন কেন ইরা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার?’
ইরা এবার মাথা তুললো। মাহিরের চোখের দিকে তাকিয়ে তাছ্যিল হেসে বলল,
‘কি হবে বলে? আপনি পারবেন সেটা কমিয়ে দিতে? পারবেন মাহির?’
‘বলে দেখুন চেষ্টা করতে পারি।’
ইরা চোখে অশ্রু নিয়ে হাসলো। মেয়েটা সবসময়ই হাসে।
‘আমি আপনাকে…কবে কিভাবে..কি করে..! আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না মাহির। আপনি প্লিজ অন্য কাউকে নিজের করে নিবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়।’
মাহিরের চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। ইরা মাহিরের গালে হাত রাখলো।
‘আমি আপনাকে চাই মাহির। দিবেন আপনাকে?’
মাহির নিশ্চুপ। ইরাবতী আবার বলল,
‘আপনার বুকে মাথা রাখার একমাত্র অধিকার আমার মাহির। সেখানে কি না অন্য কেউ মাথা রেখে ঘুমাবে! এটা কিভাবে সম্ভব মাহির? আপনি কিভাবে পারলেন অন্য কারো সাথে এনগেজমেন্টে রাজি হয়ে যেতে? বুক কাঁপেনি?
ইরাবতী উত্তেজিত হয়ে এবার মাহিরের কলার চেপে ধরেছে। মাহির বিস্মিত সাথে ক্রুদ্ধ। ইরাবতী অনুনয়ের সুরে বলল,
‘কি হতো? কি হতো একটু ভালোবাসলে আমাকে?’
মাহির শক্ত কন্ঠে বলল,
‘কলার ছাড়ুন ইরা!’
ইরা নিজেও প্রচন্ড ক্রুদ্ধ। সে দ্বিগুণ জোরে কলার চেপে ধরলো। মাহির রাগে ইরাবতীর গালে ঠাস করে চড় দিয়ে বসলো। ইরা গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকাতেই মাহির ছুড়লো কথার আঘাত।
‘আপনার মতো নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েদের আমি দু-চোখে দেখতে পারি না ইরা। আমি আপনাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি! আপনিও ওই সব মেয়েদের মতো। আমার আপনাকে দেখে ঘেন্না লাগছে। ছিহ্!
ইরা এই বিধ্বস্ত রুপেও ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
‘আপনি ত্রিশ বছরে পা রাখলেন মাহির, কিন্তু আমাকে ঘরে তুললেন না!’
মাহির চমকে গেলো।
‘সেই মেসেজটা তবে আপনি করেছিলেন?’
ইরা একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে লাগলো। একসময় দরজা পেরিয়ে ছুটলো দিকবেদিক ভুলে।’
(চলবে)