ধূসর অবেলায় সন্ধি পর্ব-০২

0
190

#ধূসর_অবেলায়_সন্ধি
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_দুই

সময় যেমন কারোরই জন্য থেমে থাকে না, তেমনই পরিজনের মৃত্যুতে জীবন থেমে থাকে না। আজ বাদে কাল সব স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করতে থাকে। মিশুর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দুইদিন হলো। প্রতিনিয়ত মেয়েটার আতঙ্কে দিন কাটছে। কখন না যেনো ভাই ভাবী এসে মিশুকে তাড়িয়ে দেয়।
মা মারা যাওয়ার পর মিশুর জীবন চলছে জটিলতায়। এর থেকে ওর থেকে ধার করে বাজার করতে হচ্ছে তাকে। পরীক্ষা দিয়েছে মনপ্রাণ দিয়ে। সেদিন মামুন ও তার বউয়ের হুমকি ধমকি শুনে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছে মিশু। পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হবে সে। যার কারণে মনে বিরহ থাকা সত্বেও পরীক্ষা ভালোভাবেই দিয়েছে মিশু।
সন্ধ্যার আলো জ্বালিয়ে ভাই ও ভাবীর কথাই ভাবছিল মিশু। এমন সময় দরজায় করাঘাত শুরু হলো। দরজা ভিড়ানোই ছিল মিশু কে বলে আওয়াজ দিলো। দরজা খুলে তৎক্ষনাৎ হালিমা ভেতরে ঢুকে পড়লো। হাতে বড়ো সাইজের কাপড়ের ব্যাগ সমেত। মিশু বিছানা ছাড়লো, আওয়াজ তুলে কিছু বলার পূর্বেই হালিমার বড়ো বোন খাইরুন ঘরে ঢুকলো। খাইরুনের পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। পান খেলে মুখের চারপাশে লেগে থাকে। দেখতে অনেক বাজে দেখায়। পান খাওয়ার সময়ে মুখে অঙ্গভঙ্গির নাড়াচাড়া দেখলেই মিশুর বমি চলে আসে। হালিমা ব্যাগখানা রেখে বলল,” কই গো বুবু, আজ থেকে মিশকার সাথে মিলেমিশে থাকবা হ্যাঁ! ও মিশু, বুবু তোমার মায়ের বয়সী দেখো কোনো কষ্ট যেনো না হয়।”

” ভাবী, এটা আমার আর আমার মায়ের বাড়ি। তুমি তোমার বোনকে এভাবে এবাড়িতে রাখতে পারো না।”

” আমি চাইলে, এক লাথি দিয়ে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি। তোমার ভাই আমার কথাই বিশ্বাস করবে। অল্প বয়সে ঘরছাড়া হতে না চাইলে চুপ করে থাকো।”

হালিমা কথাটা বলে এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, চলে গেলো। খাইরুন আয়েশ করে বিছানায় বসে মিশুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো। একজন পুরুষের খারাপ নজরের থেকেও সেই চাহনি খারাপ লাগলো মিশুর কাছে। মিশু ওড়না দিয়ে ভালোভাবে শরীর ঢেকে পাশের ঘরে চলে গেলো। এখন সে এই নশ্বর পৃথিবীতে একমাত্র অসহায়। রাতে খাইরুনের জন্য হালিমা খাবার রান্না করে নিয়ে আসলো। মুরগি, গরু, ডিম, পোলাও সহ নানান প্রকারের রান্না খেলো খাইরুন। অথচ মিশু পাশের ঘরে অনাহারে ভুগছে তাকে কেউ সাধলোও না। রাত তখন এগারোটা বাজে। পাশের ঘরে মিশু বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে কাঁদছে। নিজের ঘর নিজের বাড়ি বলতে কিছুই রাইলো না মিশুর। আপন ভাইও পর হয়ে গেল বউয়ের কথায়। শেষে কী না আপন বোন থেকে বউয়ের বোন আপন হয়ে গেলো? কিছু সময় পর খাইরুনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। সে কাউকে বলছে,” নতুন মাইয়া পাইছি। দেখতে শুনতে হুরপরী। আজ বললে আজই মাইয়া রেডি। টাকা কিন্তু বেশি নিব এই মাইয়ার জন্য।”

মুখে হাত রেখে চাপা কান্না শুরু করলো। মিশুর ভাই ভাবী নিশ্চয়ই খাইরুনের মতলব জানে! টাকার প্রলোভনে পড়ে বোনকেও বিক্রি করে দিতে দ্বিধা করছে না। মিশু কিছুই বুঝতে পারছে না। এখানে থাকলে জীবনের শঙ্কা আর বাহিরে গেলে কী না হবে! ভাবতে পারছে না মিশু।

রাত তখন সাড়ে বারোটা। দুই ঘরে যাতায়াতের জন্য একটি দরজা রয়েছে। মিশু শুরুতেই সেই দরজা আটকে দিয়েছিল। মিশুর ঘরে বের হওয়ার জন্য আরো একটি দরজা রয়েছে যা এতদিন কাঠের আলমারির আড়ালে ছিল। মিশু ধীরপায়ে সেদিকে আগালো। আলমারির ভেতর থেকে আসবাবপত্র বের করে আস্তে আস্তে সামনের দিকে টেনে আনলো। গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে ঘরটা দেখে নিলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।

————-

বাহিরের জগতে পা ফেলে মিশু দুর্ভিক্ষ জীবনের সাথে পরিচিত হলো। মিশুর মায়ের একজোড়া সোনার কানের দুল ছিল যার একটা মিশু ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলছিল। আসার সময় সে একটা কানের দুলই সাথে নিয়ে আসে। পরেরদিন সেই দুল অল্পটাকায় বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে জীবনের কঠিন মুহূর্ত পাড় করতে লাগলো মিশু। দুইদিন যাবত থাকার বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করলো কিন্তু একা মেয়েকে কেউ থাকার আশ্রয় দিলো না। শেষে একটা বাড়ি পেলো মিশু। বাড়ির মালিক ছিলো মধ্যবয়সী মহিলা। বাড়ি ভাড়ায় দিন চলে তার। মিশু যখন সাহায্যে হাত পাতলো মহিলাটি তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। ছেলের সাহায্যে মিশুর কাজের ব্যবস্থা করলো একটি গার্মেন্টসে। শুরু হলো মিশুর জীবনযুদ্ধের প্রথম ধাপ।

কেটে গেলো দুইমাস। এই দুই মাসে কেউ মিশুর খবর নেয়নি। নিবেই বা কেনো? মিশু তো তাদের বোঝ ছিল, চলে এসেছে বলে তারা বেঁচে গেলো। প্রথম মাসে মিশুর বাড়ির মালিকই খাওয়ার খরচ বহন করে। এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করায় ভালো পদে চাকরি পেয়ে গেলো মিশু। কিছুদিন পর এইচএসসির রেজাল্ট হলো। এ প্লাস পেলো সকল বিষয়ে। সেদিন মিশু কী কান্নাই না করলো। পড়াশোনার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে মিশুর মায়ের অথচ তার এই আনন্দের সময় মা-ই শামিল হতে পারলো না। মিশু রেজাল্টের দিন সামর্থ্য অনুযায়ী দান করল। আশ্চর্যজনক ভাবে রেজাল্টের পর পরই মিশুর ভাগ্য খুলে গেলো। মিশুর বুদ্ধিমত্তা দেখে অফিসের হিসাবরক্ষক কাজে নিয়োজিত হয়ে গেলো। অফিসের সিনিয়র অফিসারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে শুরু করলো। মিশুর পক্ষে ভর্তির কোচিং করা সম্ভব ছিলো না। কিছু বেসিক জ্ঞান নিতে থাকলো সে।

ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষের জীবন। ভালো সময়ের থেকে খারাপ সময়ের সাথেই বেশি পরিচিত হতে হয় মিশুর মতো মেয়েদের। অফিসের একজন শ্রমিক, যার নাম মানিক। হিসাবরক্ষকের কাজ পাওয়ার আগে মিশুর আন্ডারে কাজ করতো। পড়াশোনায় মুর্খ সে। মিশুকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। এদিকে মিশু মানিকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অফিসের সকলের প্রশংসা পাচ্ছে এখন মিশু। মানিককে কী সে পত্তা দিবে? মানিকের কথা বলার ধরণও খুব বাজে। একদম বস্তির ছেলে যাকে বলে। সুযোগ পেলে হয়তো নেশা করেও বেড়ায়। মিশুর উপরই নজর পড়ল তার।

একদিন অফিস ছুটির শেষে মিশু বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে মানিক পথ আঁটকে দাঁড়ালো। মিশু প্রথম হকচকিয়ে উঠলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে হাসিমুখে বলতে শুরু করলো,” কী ব্যপার,মানিক ভাই। পথ আটকালেন কেনো? কিছু বলবেন?”

মানিক গাল চুলকে জিভ ভিজিয়ে বলল,” তোমারে একটা কথা কইবার চাই।”

” বলুন, মানিক ভাই!”

মানিক আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,” তোমারে আমি বিয়া করমু।”

মিশু ভরকে গেলো। কাঁধের ব্যাগ শক্তকরে আকড়ে ধরলো। জীবনের প্রথম প্রপোজাল মিশুর। এর আগে কেউ মিশুর দিকে তাকিয়েও দেখেনি। প্রেম, ভালবাসা, সংসার নিয়ে মিশু ভাবেনি কখনো। আকস্মিক প্রপোজাল পেলে শরীর কাঁপুনি উঠে গেলো মিশুর। গলির মোড়েই মিশুর বাড়ি। এপথে মিশুর বাড়ির মালিক আসছিল। মিশুকে একটি ছেলের সাথে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলে এগিয়ে আসলো। মিশুর চোখেমুখে ভয় ও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্টত। মহিলাটি ছিল খুবই বুদ্ধিমতি। ছেলেটির কাছে এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,” এই বেডা, কেডা তুমি? কই থেইকা আইছো? আমার নাতনির পথ আটকাইছো কেনো? মানুষ ডাকমু? মাইয়া মানুষ দেখলেই জিহ্বা দিয়া পানি পড়ে? ও সাদ্দাম ও আক্কাস দেইখা যা তো!”

মানিক মহা বিপদে পড়লো। মহিলার হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো।জীবনে আর কোনো মেয়েকে জ্বালাতন করবে না বলে শপথ করে বিদায় নিলো।

মানিক চলে যেতেই মিশুকে ধরে মহিলাটি ঘরে নিয়ে আসলো। বিড়বিড় করে দোয়া দুরুদ পড়ে তিনবার ফু দিলো সারা গায়ে। মাথায় স্নেহময় হাত বুলিয়ে বলল,” দুনিয়াডা খুবই কঠিন রে মা! একলা চলতে গেলে মোমের মতো নরম হওয়া যাইতো না, পাথরের মতো শক্ত হইতে হইবো। তোমারে রক্ষা করার লাইগা এই বুড়ি আজীবন বাঁইচা থাকবো না। পেটের সাথে সাথে নিজের শরীরকেও রক্ষা করতে হইবো।”

আরেকবার মিশু বাস্তববতার মুখোমুখি হলো। আজকের ঘটনায় মিশু শিক্ষা নিতে পারলো যে, নারী তুমি অসহায় নও, সহায় হও। জীবনযাপনে নরম নয়, শক্ত হও।

চলবে…………………