#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১৭
অরুনিমা ভাবছে:কি হয়েছে আয়ানের?সে কি তরীকে নিয়ে যাওয়ার কারণে আর আসছে না?
বুঝতে পারছে না অরুনিমা।
দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু আয়ানের কোনো খবর নেই। একটু পর ইমনের নম্বর থেকে ফোন আসলো। অরুনিমা বেশ অবাক হলো। ইমন কেন তাকে ফোন করলো? ফোনটা দ্রুত রিসিভ করে সে। ইমন ওপাশ থেকে বলছে:ম্যাম স্যার এক্সিডেন্ট করেছে। স্যারকে ফোন দিয়েছেন দেখে আমি আপনাকে ফোন দিলাম বলার জন্য।
ইমনের কথায় অরুনিমা ভয় পেয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো:উনি এখন কোথায়?কি অবস্থা এখন?
_স্যার হাসপাতালে আছেন। তেমন বেশি আঘাত পায়নি। হয়তো ব্যান্ডেজ করে চলে যাবেন।
_কোন হাসপাতালে আছেন?
_আপনি আসবেন?
_হুম।
_ওকে আমি আপনাকে লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।
অরুনিমা আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।তরীকে বললো: আয়ান ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে চলো হাসপাতালে যায়।
ইমন লোকেশন পাঠাতেই দুজনে দ্রুত বের হয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে পৌঁছে ইমনকে ফোন দিলো অরুনিমা। ফোন পেয়ে সে আসলো তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুজনেই ইমনের সাথে আয়ানের সিটে গেল। আয়ান শুয়ে ছিল। অরুনিমাকে দেখে মুচকি হাসি দিলো। অরুনিমা জিজ্ঞেস করলো: কিভাবে এলো এই অবস্থা?
_আরে আর বলো না। বাসা থেকে বের হয়ে তোমার ওদিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার গাড়ির সামনে একটা গাড়ি চলে আসলো। ভাগ্য ভালো এতটুকু আছি।
_বেশি ব্যথা পেয়েছেন?
_এইতো একটু।বাই দ্যা ওয়ে বাসায় বলিও না। বাসায় বললে সবাই টেনশন করবে।
_আচ্ছা বলবো না।
_তোমরা বসো সিটে গিয়ে।
আয়ান ইমনকে উদ্দেশ্য করে বললো: ইমন ওদের সিটে বসতে দাও। তুমি চেয়ারে গিয়ে বসো।
ইমন “ওকে স্যার” বলে উঠে অরুনিমা আর তরীকে বসতে দিলো।
একটু পর ডাক্তার আসলো আয়ানকে দেখার জন্য। তিনি বললেন আজকের রাতটা হাসপাতালে থাকতে। কিন্তু আয়ান নাছোড়বান্দা।সে কিছুতেই আর হাসপাতালে থাকবে না। শুয়ে থাকতে থাকতে সে বোর হয়ে যাচ্ছে।আর থাকা যাবে না।তাই ডাক্তার বাধ্য হয়েই তাকে ডিসচার্জ করে দিলো।
আয়ান হাসপাতাল থেকে নেমে গাড়িতে বসতে যাবে। তখনি অরুনিমাকে বললো: তোমরা তাহলে বাসায় চলে যাও। ইমনকে বলে গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি।
অরুনিমা সাথে সাথে জবাব দিলো:আমি আপনার সাথে যাবো। বাসায় যাবো না।তরী একা চলে যেতে পারবে।
আয়ান অরুনিমার কথায় মনে মনে হাসলো। তারপর প্রশ্ন করলো: আমার বাসায় যাবে কেন?
_আপনি একা একজন মানুষ। আপনার শরীর খারাপ।এই অবস্থায় একজন মানুষের সাথে থাকা প্রয়োজন।
_বুয়া থাকবে।
_না আমি যাবো।বুয়া কি আর নিজের মতো করে দেখাশোনা করে?
_তুমি কি নিজের মতো করে দেখাশোনা করবে?
আয়ানের কথায় অরুনিমা চুপ হয়ে গেল।কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।তা দেখে আয়ান মুচকি হাঁসি দিয়ে বললো:চলো তাহলে।
অরুনিমা আয়ানের সাথে গাড়িতে গিয়ে বসলো।সাথে ইমন আছে।তিনজনেই পৌঁছালো বাসায়।
আয়ানের বাসায় একজন মাঝ বয়সী মহিলা আছেন।তাই অরুনিমার থাকতে সমস্যা হলো না তেমন।সে মহিলাটার সাথে দিব্বি ঘুরে-ফিরে আছে। হয়তো আয়ানের বাসায় একা একজন মেয়ে হলে আনইজি লাগতো। কিন্তু সেই অসুবিধাটা হচ্ছে না তার।
প্রায় দুদিন সে আয়ানের বাসায় থাকলো।এই দুদিন কলেজে যাওয়া-আসার কাজটা ইমনকে নিয়ে করছে সে।আজ চলে যাবে।এই দুদিন আয়ানের অনেক দেখভাল করেছে। সবসময় কাছাকাছি ছিল।তাই আয়ান একটু দ্রুত সুস্থ হলো। কিন্তু আজ তার আর ভালো লাগছে না। অরুনিমা একটু পর চলে যাবে।সে মনে মনে ভাবছে যদি অরুনিমাকে সব সময়ের জন্য কাছে পেতো তাহলে সে আর বাসায় একা একা বোর হতো না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। অরুনিমা তো আজ চলে আসবে। ইমন এসে তাকে দিয়ে গেলো।
অরুনিমা বাসায় আসার পর একটু ঘুম দিলো।ঘুম থেকে উঠে ভাবছে আয়ানের খবর নেওয়া হয়নি।সে এখন কেমন আছে তা জানা উচিত।এই ভেবে আয়ানকে একটা ফোন দিলো।সে সাথে সাথে রিসিভ করলো।
_কেমন আছেন এখন?
_মুটামুটি।
_মুটামুটি কেন?আবার খারাপ লাগছে নাকি?
_হুম।
_কি বলেন? আপনি তো অনেকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।
_শরীর ভালো কিন্তু মন ভালো নেই।
_কেন?
_একা একা ভালো লাগছে না। তোমাকে অনেক মিস করছি।
আয়ানের কথায় অরুনিমা হাসলো। তারপর বললো: আস্তে আস্তে ভুলে যাবেন।
_তোমাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ?
_মানুষ চেষ্টা করলে সব সহজ হয়।
_আমি তো চেষ্টাই করবো না।সহজ-কঠিন বুঝবো কি করে?
_না বুঝলে থাকেন।আমি রাখছি।
_রেখে যখন দিচ্ছো কি আর করার।
অরুনিমা আয়ানের কথায় হেঁসে ফোনটা কেটে দিলো।
মাঝে প্রায় চার মাসের মতো কেটে গেছে। আয়ান আর অরুনিমার এখন রোজ কথা হয়। একজন আরেকজনকে সব কথা শেয়ার করে। ছুটির দিনে দেখা-সাক্ষাৎ করে। কিন্তু আয়ান এখনো তার মনের কথাগুলো অরুনিমাকে বলতে পারে নাই। দুজনেই হয়তো দুজনকে ভালোবাসে মনে মনে। কিন্তু কেউ কাউকে প্রকাশ করতে পারছে না।
অরুনিমাকে আজকে তার মা ফোন দিয়ে বাড়ি যেতে বললো। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার কারণটা শুনে তার মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।বেশ খানিকক্ষণ ধরে সে মন খারাপ করে বসে আছে।মাঝে তরী আসছিল রুমে।সেও আবার চলে গেছে। তখন থেকেই একা একা চুপচাপ বেলকনিতে বসে আছে সে। একটু পর আয়ানের ফোন আসলো।অরুনিমা রিসিভ করে সালাম দিলো।অরুনিমার গলার বিষন্ন স্বর শুনেই আয়ান বুঝে গেল অরুনিমার মন খারাপ। ব্যস্ত কন্ঠে সে প্রশ্ন করলো:কি হয়েছে তোমার?
_কিছু না।
_মিথ্যা বলছো আমাকে?আমি বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ।
_কী করে বুঝলেন?
_আগ্রহ থাকলে সব অনুমান করা যায়।তাই বুঝতে পারলাম।কি হয়েছে বলো?
_বাসা থেকে ফোন দিয়েছিল আম্মু।বলেছে কাল বাড়ি যেতে।
_হঠাৎ কাল বাড়ি যাবে কেন?
_আম্মুর এক কলিগের ছেলে লন্ডনে থাকে।দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হলো। বেশ ভালো স্টুডেন্ট ছিল, ভদ্র-নম্র ছেলে।
অরুনিমার মুখে ছেলেটার প্রশংসা শুনে আয়ানের গাঁ জ্বলছে। গম্ভীর গলায় বললো:ওর কথা আমাকে বলছো কেন?
_আরে শুনবেন তো ধৈর্য্য নিয়ে।
_আচ্ছা আচ্ছা বলো।
_উনার বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে।উনি আর উনার বাবা-মা আমাকে দেখতে আসতে চাচ্ছেন। তাই আমাকে আগামীকাল যেতে বলেছে আম্মু।
আয়ান অরুনিমা কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। তার চুপসে যাওয়া দেখে অরুনিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো:কথা বলছেন না কেন?
আয়ানের কোনো সাড়াশব্দ নেই এখনো। অরুনিমা ভাবলো সে শুনতে পাচ্ছে না।তাই “হ্যালো,হ্যালো” বলতে আছে সে। একটু পর আচমকা আয়ান বলে বসলো: আমাকে বিয়ে করবে?
অরুনিমা আয়ানের কথাটা আমল করতে পারছে না।সে কি ভুল শুনলো নাকি তার মনের কল্পনা এই দ্বিধায় আছে সে। তাই আবার প্রশ্ন করলো:কি বললেন? বুঝতে পারিনি।
_বলছি আমাকে বিয়ে করবে?আমি এতো ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে পারি না। সোজাসাপ্টা বলছি তাই। ভালোবাসো আমাকে?
অরুনিমা এবার চুপ হয়ে গেলো।সে কি বলবে আয়ানকে?এই ক’মাস আয়ানের সাথে সবসময় কথা হয়।সে অন্তত এতটুকু বুঝতে পারছে তার ফোনে প্রতিদিন আয়ানের একটা কল আসতে হবে। অন্যথায় সে অসম্পূর্ণ। এটাকে কি ভালোবাসা বলে তা তার জানা নেই।আয়ান লাইনে আছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না সে।অরুনিমাও কোনো জবাব দিচ্ছে না। একটু পর নিরবতা ভেঙ্গে আয়ান আবার বললো: তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন একজন সন্দেহভাজন হিসেবে জানতাম। কিন্তু কয়েকদিন ইনভেস্টিগেশনের পর বুঝতে পারলাম তুমি বেশ সহজ-সরল।তাই সবাই তোমাকে ফাঁসাতে চাই।সত্যি বলতে আমি খুব গরল মানুষ। তাই তোমার সরল মনটা আমার মনে এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনূভুতি বিশালতায় রুপ নেয় ভাইয়ার বিয়েতে। এরপর থেকে আমি বারবার তোমার সাথে কথা বলতে চাই।কোনো এক সুযোগে তোমাকে বোঝাতে চাই যে আমি তোমাকে চাই। সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে চাই শুধু। আমি প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু তোমাকে দেখার পর মনে হলো পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে। হয়তো আমার বুঝতে দেরি হয়েছিল। যদি ভালোবাসা নামক কিছু না থাকতো তাহলে পুরো পৃথিবীটাই অচল হয়ে যেতো।সবাই একাকিত্বের হতাশায় শেষ হয়ে যেতো। আমার প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস আছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।এটা আমি সিউর।
অরুনিমা কথাগুলো শুনে মনে মনে হাসছে।তার ইচ্ছা ছিল আয়ানের মুখে এমন কিছু শুনার।আজ তার সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো। কিন্তু সরাসরি আমিও তোমাকে ভালোবাসি এই কথা বলার মেয়ে সে নয়। এখনো সে নিরব হয়ে আছে দেখে আয়ান বললো: কিছু তো বলো?
_আমার বাবা-মা আছে।আমাকে না বলে এসব কথা আমার বাবা-মাকে বলুন।তারা রাজি হলে এগোতে পারি। অন্যথায় আগে আগে ভুলে যাওয়া ভালো। তখন হারানোর কষ্টটা কম হবে।
_সত্যি বলছো? বাসায় বলবো?
_সেটা আপনার ইচ্ছা। আপনার বাসায় বলতে আনইজি লাগবে না?
_কেন আনইজি লাগবে?
_তো কি বলবেন?
_সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। শুধু তোমার সম্মতি দিলেই হলো। আমি পুরো পৃথিবীর সবাইকে জয় করে নিয়ে আসবো।
আয়ানের কথায় অরুনিমা শব্দ করে হেঁসে দিলো।তার হাঁসির আওয়াজ শুনে আয়ানও হাসলো। তারপর অরুনিমা ফোনটা কেটে দিলো।
ফোন কাটার পর আয়ান ভাবলো বাসায় কি বলা যায়।”আমি বিয়ে করবো” এভাবে কি নিজের বিয়ের কথা নিজে বলতে পারে কখনো? কাউকে তো মাঝখানে রাখতে হবে। আদনান ভাই বেস্ট হবে নাকি শ্রেয়া বেস্ট হবে? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো আদনান ভাই বেস্ট হবে। তখন তামিমা ভাবিকেও কাজে লাগানো যাবে। আদনান ভাই এদিক সামলালে তামিমা ভাবি অরুনিমার দিকটা সামলাতে পারবে। সাথে সাথে ফোন লাগালো আদনানকে। আদনান রিসিভ করতেই আয়ান বললো: ভাইয়া, তুমি এতো খারাপ কেন? আমার জন্য কি তোমার কোনো চিন্তা নেই?
আদনান অবাক হয়ে বললো: আমি আবার কি করলাম?
_কিছু করছো না এটাই তো সমস্যা। তুমি এখানে চুপচাপ কিছু না করে ঘুমাচ্ছো আর ওদিকে তোমার শ্বশুর তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছে।এটা কি মানা যায়?
_আরে আমার শ্বশুর তো মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিছে। আবার কিসের বিয়ের প্ল্যান করবে?
আয়ান এবার টাস্কি খেলো আদনানের কথায়। জোর গলায় জিজ্ঞেস করলো:কি বলছো? তোমার শ্বশুর মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে?
_হুম। আমার শ্বশুর মেয়ে বিয়ে না দিলে আমার শ্বশুর হলো কি করে?
আয়ান এবার বুঝতে পারলো। আদনান তামিমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। রাগী গলায় বললো: ভাইয়া,সিরিয়াসলি কথা বলার সময় মজা করো কেন?টেনশন লাগছে এমনে।তার মধ্যে তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছো।কেমনটা লাগে?
_আচ্ছা বল কি হয়েছে?
_অরুনিমাকে একজন ছেলে দেখতে আসবে তাই তোমার শাশুড়ি তাকে কালকে বাড়ি যেতে বলেছে।
আদনান আয়ানের কথায় হাসলো। তারপর বললো:এতো ছটপট করছিস কেন?সবে তো দেখতে আসছে।দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?
চলবে…