অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০২

0
185

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২

সকাল পেরিয়ে দুপুর নামলো ধরনী বুকে। সূর্য পুবাকাশ থেকে সরে অবস্থান নিয়েছে ঠিক মাথার উপর। ভূমিতে আছড়ে পরছে তার তীব্র রশ্নি। সূর্যের তাপে গরমে হাসফাস করার কথা কুঞ্জারির। তবে তেমন গরম অনুভব করলো না সে। কারণটা চৌধুরী নিবাসের আশেপাশে বেড়ে উঠা অসংখ্য গাছপালা। প্রায় পনেরো একর জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে চৌধুরী নিবাস। জমির ঠিক মাঝখানে দ্বিতল ভবন। বাড়ির পেছনে পুকুর। নাম ‘কাজলদিঘী’। নামকরণ করা হয়েছে কুঞ্জারির দাদি কাজল চৌধুরীর নামানুসারে। চৌধুরী নিবাস তৈরি করা হয়েছে প্রায় আশি বছর আগে। আফজাল চৌধুরীর দাদা এই জায়গা কিনে নেয় এক ব্যবসায়ীর থেকে। এরপর নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী শুরু করেন নির্মাণ কাজ। তবে ভাগ্য তার সহায় হয়নি। বাড়ির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরে পরলোক গমন করেন তিনি। এরপর নির্মাণ কাজে হাত দেয় তার বড় ছেলে আলিম চৌধুরী; কুঞ্জারির দাদা। তিনি ছিলেন শৌখিন মানুষ। বাড়ি সাজানো হয় তার ইচ্ছা অনুযায়ী। চৌধুরী নিবাসে তাই এখনো লেগে আছে শৌখিনতার ছোঁয়া। গাছ লাগানো ছিল আলিম চৌধুরীর শখ। তাই পুকুরপাড় ও তার আশেপাশে লাগানো হয় হরেক রকমের ফল গাছ। সেই সাথে আছে সেগুন, মেহগনি, তেলশূর, বৈলাম সহ বেশ কিছু কাষ্ঠল উদ্ভিদ। দেশ থেকে বিলুপ্ত প্রায় গাছ মল্লিকা ঝাঝি, কোরুদ ও রোট্যেলা গাছও দেখা যায় বাড়ির পিছনের ফল বাগানে। কাজল চৌধুরী ফুল পছন্দ করতেন খুব। তার ইচ্ছে অনুযায়ী বাড়ির সামনের ফাঁকা স্থানে লাগানো হয় গোলাপ, বেলি, ডালিয়া, গাঁদা, অপরাজিতা, গন্ধরাজ, জেসমিন সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। এছাড়াও ফুল বাগানের পাশ দিয়ে লাগানে হয় জারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, পলাশ ও কাঠগোলাপ গাছ। এছাড়াও বাগানের উত্তর পাশে আছে কুঞ্জলতার সমাহার। এগুলো লাগিয়েছেন আফজাল চৌধুরী। মেয়ের নামের সাথে মিল হওয়া এই ছোট কুঞ্জলতার তিনি ভীষণ যত্ন করেন। মনে হয় যেন মেয়েকে আদর করছেন। গাছপালার প্রাচুর্যের কারণে চৌধুরী নিবাসে শীতল পরিবেশ বিরাজমান।

কুঞ্জারির ঘর দোতলায়। ঘরের বারান্দা বাড়ির সামনের দিকে। বারান্দা ছুঁইছুঁই করে উঠে এসেছে একটা কাঠগোলাপ গাছ। এখন গ্রীষ্মকাল। কাঠগোলাপ গাছে সাদা হলুদের মিশ্রণে ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। কাঠগোলাপের মা তাল করা ঘ্রাণে ম-ম করছে কুঞ্জারির ঘর। কাঠগোলাপ গাছ বড় হলে পাতার সংখ্যা বেশ কমে যায়। কুঞ্জারি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কাঠগোলাপের পাতার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আলোক রশ্নি পড়লো কুঞ্জারির চোখেমুখে। কুঞ্জারি চোখ পিটপিট করলো কয়েকবার। হেসে তাকালো তীব্র দাপট নিয়ে আলো ছড়ানো সূর্যের দিকে। ফিসফিস করে বলল,

-ধরার বুকে তীব্র আলোক রশ্নি ছড়ানো দীপ্তমান সূর্য তুমি বলো তো তোমার চেয়ে তীব্র তেজ আর কার আছে? প্রশ্ন শুনে হাসছো বুঝি? তাচ্ছিল্য করে বলছো, আমার চেয়েও তেজীয়ান? তাই আবার হয় নাকি। তবে শোনো, এক বেপরোয়া পুরুষের তেজী দৃষ্টি তোমার তেজকেও অনায়াসে হার মানায়। তার চোখে চোখ রেখে কথা বলা দায়।

আরোও কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে কাঠগোলাপের ঘ্রাণ নিলো কুঞ্জারি। এরপর ফিরে এলো ঘরে। সকালে দরজা লাগিয়েছে আর খোলা হয়নি। খোলার প্রয়োজন বোধও করলো না। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াসরুমে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হতেই তার ঘরের দরজার মৃদু ভাবে টোকা দিলো কেউ। কুঞ্জ ঘড়ির দিকে তাকালো একপলক। তিনটা বিশ বাজে। আবার শোনা গেলো টোকা। সাথে হালকা আওয়াজ,
-বড় আপা!
কুঞ্জের ঠোঁটে খেলে গেলো হাসির রেখা। তবে শব্দ করলো না। আওয়াজটা নুহাসের। সে চুপ করে থাকলো। আবার এলো সেই একই আওয়াজ। ছোট একটা শব্দ,
-বড় আপা! দরজা খোলো।
কোনরূপ আওয়াজ না করে দরজা খুলে দিলো কুঞ্জ। হাতে প্লেট নিয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন ভাই-বোন। পূর্ব কাচুমাচু করে বলল,
-ভেতরে আসি বড় আপা? তোমার রুমে বসে খেতে ইচ্ছে করলো।
কুঞ্জারি সরু চোখে তাকালো ভাই-বোনের দিকে। বড় বোনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে ভরকে গেলো তারা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কুঞ্জারি হাসলো। সকালের নাস্তার পর নিজে খায়নি। তার সাথে সাথে এই বিচ্চু বাহিনীও খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে হালকা স্বরে বলল,
-ভিতরে আয়।

একে একে ভিতরে ঢুকলো পূর্ব, নুহাস এবং কুহু। কুহু প্রবেশ করতেই ডান পাশ থেকে প্লেট হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালেন রাইমা চৌধুরী। মা’কে দেখে অবাক হলো কুঞ্জ।
-আম্মু তুমি!
কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়। রাইমা চৌধুরী হাসলেন। মুখে বললেন,
-ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে? নাকি অনুমতি শুধু তোমার ভাই-বোনের জন্য।
-তোমার জন্য তো কখনো নিষেধ ছিলো না আম্মু। অনুমতি চাইছো কেনো? সরাসরি রুমে ঢুকে যাবে।
কুঞ্জারির খাটে বসে আছে ওরা তিনজন। পাশে এসে বসলেন রাইমা। কুঞ্জ এসে মায়ের ধারে বসলো। তিনজন ভাত নিয়ে বসে আছে। অথচ মুখে দিচ্ছে না। কুঞ্জ ভ্রূঁ কু্চকে তাকালো ওদের দিকে।
-কি সমস্যা? আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেনো? ভাত মুখে দে।
উত্তর দিলো না কেউ। বড় বোনের দিকে তাকিয় রইলো নির্বাক হয়ে। রাইমা ভাত মেখে তুলে ধরলেন মেয়ের মুখের সামনে। ধীর কন্ঠে বললেন,
-তুমি ভাত মুখে দেওয়ার আগে ওরা দিবে না। তুমি হা করো তো দেখি। তুমি খাওয়া শুরু করলেই ওরা খাবে।
কুঞ্জের চোখে মুখে ছেয়ে গেলো স্পষ্ট অপরাধবোধ। ছলছল করে উঠলো দুই নয়ন। বাবার উপর রাগ করে সে তার আদরের ভাই-বোন গুলোকে কষ্ট দিলো! সে তো জানতো ওরা তাকে ছাড়া খাবে না। অথচ যার সাথে রাগ করলো সে দিব্যি তাকে ছাড়া খেয়ে নিয়েছে। মনে করেছে তার কথা? কই আজ তো কেউ ডাকেনি তাকে খাবার টেবিলে। খোঁজও নেয়নি সে খেয়েছে কিনা। দ্রুত হা করলো কুঞ্জ। ভাত মুখে নিয়ে তাকালো ভাই-বোনের দিকে। চোখের ইশারায় বুঝালো খাওয়া শুরু করতে। দ্বিমত করলো কেউ। একে একে সবায় মুখে ভাত নিলো। খেতে খেতে চললো চার ভাই বোনের খুনসুটি। বড় বোনের মন ভালো করার সকল চেষ্টা করে গেলো ছোট তিনজন।

দুপুরে খাবার টেবিলে বসেননি আফজাল চৌধুরী। খাবার তার মুখে রুচবে না জানতেন। মেয়ে না খেয়ে আছে। সে কিভাবে খাবে? সবে দেখে এলেন মেয়ের ঘরে খাবার নিয়ে গেছে মেয়ের মা। তিনিও খাবার নিয়ে বসলেন তাই। কিন্তু হায়! হাত দিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করলো ভাত। মুখে তুললেন দুই কি তিন বার। মেয়ে বাড়ি থাকলে বরাবর মেয়েকে পাশে বসিয়ে নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস তার। বহুদিনের সেই অভ্যাস ত্যাগ করে খাওয়া হয়ে উঠলো না। এই অভ্যাস ছাড়তে পারবেন না হয়তো কোনোদিন! মেয়েটা যে তার বড্ড আদরের।

পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য । ধরা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার আলো। আকাশে হালকা লাল, গোলাপি রঙের আলোর ছড়া ছিটা। একেই বলে গোধূলি বেলা। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। চৌধুরী নিবাসের বাইরের সব গুলো ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলে উঠলো কিছু সময় পরেই। ধরনী ডুবে গেলো অন্ধকারের অতল গহ্বরে। কুঞ্জারির ফোনটা বেজে উঠলো আকস্মিক। ফোনের স্কিনে না তাকিয়েই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো সে। কথা বললো না।
-কালকে তবে ফিরছেন ম্যাম?
-হ্যাঁ! ফিরছি।
-কে রেখে যাবে?
-কেউ নাহ!
-কেউ না মানে? অবাক হলো ফোনের ওপাশের মানুষটা। পরের প্রশ্ন করলো,
-তুমি এতখানি রাস্তা একা ড্রাইভ করে আসবে? আর গাড়ি নিয়ে যাবেয় বা কে? কন্ঠে বিস্ময়ের রেশ তখনো বিদ্যমান।
-গাড়িতে আসছি না।
-তবে ফিরবে কি করে?
-বাসে আসবো।
আবার বিস্মিত হলো মানুষটা। কুঞ্জারির সাথে তার পরিচয়ের তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। এরমাঝে কখনো সে বাসে করে বাড়িতে আসা-যাওয়া করেনি। আকস্মিক বাসে আসার কথা শুনে হবাক হওয়ারই কথা।
-হঠাৎ বাসে আসবে কেনো?
-এমনিই! কোনো করাণ নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মানুষটা। মেয়েটা এতো চাপা কেনো? নিজের কোনো সমস্যা বলতে চায় না। জোড় করলো না আর। সময় হলে ঠিকই বলবে জানে সে।আবার বলে উঠলো,
-আমি বাস স্টেশনে থাকবো?
-ইচ্ছে।
-বেশ আসবো তবে।
-প্রয়োজোনীয় কাগজ পত্র নিয়ে আসবে।
-কালকেই?’ আবার অবাক হলো ফোনের ওপারের মানুষটা। বুঝতে পারলো গুরুতর কিছু হয়েছে। তবে কিছু বললো না। উত্তর এলো তৎক্ষনাৎ,
-আপত্তি আছে?
-না! আপত্তি থাকবে কেনো?
-তবে দেখ হচ্ছে কালকে।
কুঞ্জারির হাসির মৃদু শব্দ শুনলো লোকটা। তারপর কলটা কেটে গেলো। কল কেটে নিশ্চুপ বসে থাকে কুঞ্জ। শুকনো ঢোক গিলে কয়েকটা। কালকে সে স্বেচ্ছায় পরিবর্তন করে ফেলবে নিজের জীবনের কিছু অধ্যায়। যার পরিনাম কিংবা পরিণতি তার অজানা নয়। ভয়ংকর কিছু বয়ে আনতে পারে তার এই সিদ্ধান্ত আবার অতীতের সেই কালো অধ্যায় থেকে বের করে আনতে পারে কিছু মানুষকে। কি হবে জানে না কেউ। তবুও আশা রাখতে দোষ কোথায়?

#চলবে…?