অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৮

0
142

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৮

চৈত্রের দুপুর। ধরণী বুকে আছড়ে পরছে খা খা রোদ্দুর। পিপাসায় পথিকের ছাতি কাঁপে। সূর্যের দিকে দৃষ্টি মেলা দায়। ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে শাহবাগ মোরে রাস্তার একপাশে দাঁড়ালো কুঞ্জ। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। হাতঘড়িতে চোখ বুলালো। সবে সাড়ে বারোটা বাজে। অর্কের অফিস টাইম শেষ হবে দুপুর দুটোয়। এতক্ষণ রাস্তায় থাকার ইচ্ছে হচ্ছে না। আবার বাসায় যে যাবে তাতেও মন সায় দিলো না। অনেক ভেবে ঠিক করলো বাসায় যাবে। শ্বাশুড়ি মা নিশ্চয় বাসা থেকে বের করে দিতে পারবে না। নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে শুয়ে থাকবে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। রিক্সা নিয়ে চলে এলো পলাশীতে। কলিং বেল বাজিয়ে ঢোক গিলল কুঞ্জ। মনে মনে দোয়া করলো শ্বাশুড়ি যেন দরজা না খোলে। শ্বাশুড়িকে ভয় সে পায় না। কিন্তু এমন ক্লান্ত হয়ে ফিরে কথার পিঠে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয় না। আর চুপ থাকলে তিনি ধরে নিবে কুঞ্জ দুর্বল। কিন্তু কথায় বলে না, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।’ হলোও তাই। দরজা খুললেন স্বয়ং মিসেস তানহা। কুঞ্জারি মৃদুস্বরে সালাম দিয়ে ঢুকে গেলো বাসায়। বাইরে ঝামেলা করার ইচ্ছে ছিল না তানহার। তাই কুঞ্জারিকে ঢুকতে বাঁধা দিলেন না তিনি। ভিতরে এসেই হুংকার ছাড়লেন,
-এই মেয়ে লজ্জা নেই তোমার? আমি মানি না তোমাকে। তবুও কোন মুখে এই বাসায় পা রেখেছো?
ক্লান্ত কুঞ্জারি উত্তর না দিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো এক গ্লাস। কুঞ্জারি উত্তর না দেওয়ায় ক্ষেপে গেলেন তানহা। পুনরায় কিছু বলতে যাবেন তার আগে কুঞ্জারি বলে উঠলো,
-গণতন্ত্র বোঝেন মা?
বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করায় বিরক্ত হলো তানহা। চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল,
-তোমার থেকে আমার গণতন্ত্র কি শিখতে হবে?
কুঞ্জ হাসলো। হাসি মুখে উত্তর দিলো,
– That shall be the democratic which shall be the people, for the people; কথাটা কে বলেছেন মা জানেন? খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় একই ভাবে গণতন্ত্রকে বর্ণনা করেন আব্রাহাম লিংকন।
মিসেস তানহা ধৈর্য হারালেন। চিৎকার করে বললেন,
-এই মেয়ে তোমার থেকে গণতন্ত্রের ইতিহাস জানতে চেয়েছি আমি?
কুঞ্জ গম্ভীর হলো। কন্ঠে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল,
-গণতন্ত্র অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি মানুষ যে সিদ্ধান্ত নিবে তা মানতে হবে। এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা চার। দুঃখজনক ভাবে তিনজন মানুষ চায় আমি এ বাসায় থাকি। গণতন্ত্র মতে এটায় মেনে নিতে হবে। দুঃখিত মা। আমি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ। গণতন্ত্র না মানলে হবে?
কথাটা বলে তির্যক হাসলে কুঞ্জ। এরপর হেলেদুলে এগোতে লাগলো নিজের রুমের দিকে। তাহনা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে, জেদে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মেয়েটা তাতে অপমান করে গেলো!

চৌধুরী নিবাসের দুতলার এক কামরার বারান্দায় রেকিং চেয়ারে ফোন হাতে বসে আছেন রাইমা চৌধুরী। চোখ জোড়া বন্ধ তার। মৃদু দোল খেতে খেতে অপেক্ষা করছেন কারো ফোন কলের। তার অপেক্ষায় ব্যাঘাত ঘটালো আফজাল চৌধুরী। কিছু আগে খুঁজে খুঁজে এই ঘরে রাইমা চৌধুরীকে পেয়েছেন আফজাল চৌধুরী। কিন্তু কথা কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেন না। পঁচিশ বছর সংসার তাদের। অথচ কতো জড়তা। আফজাল চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। এরপর নিজের উপস্থিতি বোঝাতে খুকখুক করে কাশি দিল। রাইমা চৌধুরী দ্রুত চোখ খুললেন। আফজাল চৌধুরীকে দেখে অবশ্য অবাক হলেন না। দরকার ছাড়া এই লোক তাকে খুঁজবে ভাবাও বিলাসিতা। তাই চুপ থাকলো। কি দরকার জানতেও চাইলো না। আফজাল চৌধুরী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-কুঞ্জের সাথে কথা হয়েছে তোমার?
রইমা কিয়ৎকাল স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-কেন? বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলেছেন নাকি?
রাইমার ঠোঁটে বাঁকা হাসি, কন্ঠে তাচ্ছিল্য। আফজাল চৌধুরী রাগ করলেন না। মৃদুস্বরে বলল,
-কথা হয়েছে নাকি সেটা বলো।
-হয়েছে।
আফজাল চৌধুরী দ্রুত তাকালো স্ত্রীর দিকে। অস্থির হয়ে করলেন একসাথে অনেক প্রশ্ন,
-কেমন আছে কুঞ্জ? শরীর ঠিক আছে? কিছু লাগবে মেয়ের? আমার সাথে রাগ কমেনি মেয়ের?
রাইমা গভীর চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। তার চোখেমুখে ছেয়ে আছে অস্থিরতা। মেয়েকে নিয়ে কোন খারাপ খবর শুনলে হয়তো এখনি হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে। চোখে ছলছল করছে পানি। মেয়েকে যে ভীষণ মিস করছে তা বলে দিচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া মুখখানা। রাইমার চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
-মেয়েকে এতো ভালোবাসেন? তবে মেয়ের মাকে কেন ভালোবাসলেন না চৌধুরী সাহেব?
রাইমার কন্ঠে ভালোবাসা পাওয়ার সেকি আকুলতা। চোখের জল কপল বেয়ে গড়িয়ে পরছে। আফজাল চৌধুরী সহ্য করতে পারলেন না। তড়িঘড়ি বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। স্বামীর যাওয়ার পানে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো রাইমা। ঠোঁটের আগায় লেগে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি!

মেয়েটা বেশ কয়েকদিন ধরে পিছু নেয় পূর্বের। এসবে পাত্তা দেয় না সে। নদীর পারে যাওয়ার সময় মেয়েটা আজও তার পিছু নিল। নদীর দিকে যাওয়ার পথটা শুনশান নীরব। লোকজন থাকে বললেই চলে। এমন একলা পথেও মেয়েটা তার পিছু নিয়েছে? ভয়ডর নেই নাকি? অবাক হলো পূর্ব। সামনে এগুতে গিয়ে হুট করে পিছে ফিরে ঠিক সামনে দাঁড়ালো মেয়েটার। দরাজ স্বরে বলল,
-নাম কি?
হঠাৎ এভাবে সামনে আসায় ভয় পেয়েছে মেয়েটা। বুক কাঁপছে তার। পূর্বের গম্ভীর স্বর শুনে কথারা তাকে সঙ্গ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তবুও কষ্ট করে আওরালো,
-তি..তি..তি
পূর্ব ভ্রূ যুগল বাঁকিয়ে বলল,
-হোয়ার তি…তি..তি! নাম বলতে বলেছি।
শুকনো ঢোক গিলে মেয়েটা উত্তর দিলো,
-তিথিয়া।
পূর্ব বাঁকা হাসলো। ঠোঁ বাঁকিয়ে বলল,
-নাইস নেম। তা মিস তিথিয়া আপনি জানেন এই রাস্তায় যে লোকজন আসে না। এমন লোকশূণ্য স্থানে কোন ছেলেকে ফলো করলে ফলাফল ভালো হবে তো?
তিথিয়া ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে বলল,
-আ’ম সরি। আর কখনো হবে না।
আর কিছু বলতে পারলো না। এক দৌড়ে চলে গেলো উল্টো পথে। পূর্ব যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-এতো সহজে ভয় পেয়ে গেলেন মিস তিথিয়া! এই সাহস নিয়ে পূর্ব চৌধুরীর পিছু নিয়েছিলেন?

প্রায় আড়াইটার দিকে অর্ক ফিরলো। তাহনা তখন ঘুমাচ্ছেন। দরজা খুলে দিলো অদিতি। অর্ক ফিসফিস করে জানতে চাইলো,
-মা কোথায়?
-ঘুমাচ্ছে।
-তোর ভাবি?
-ভাবি ঘরে।
অর্ক আর কথা বাড়ালো না। নিঃশব্দে চলে গেলো নিজের ঘরে। ঘরে গিয়ে দেখে বউ তার কাপড় গুছিয়ে রাখছে আলমারিতে। অর্ক মৃদু হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
-পাক্কা গৃহিণী হয়ে যাচ্ছেন যে মিসেস অর্ক।
কুঞ্জ ভ্রূ বাঁকিয়ে বলল,
-মিস থেকে মিসেস যখন হয়েছি পাক্কা গৃহিণী হতে হবে না?
আর্ক হেসে ফেললো। বউয়ের সাথে কথার যুদ্ধে সে জিততে পারবে না জানা কথা। কুঞ্জ এগিয়ে এলো। বরের টাই খুলে গলা জড়িয়ে ধরলো। আলতো হেসে বলল,
-গোসল করে আসো। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
অর্ক হাসলো। মৃদু ভাবে বলল,
-তুমি খেয়েছো।
কুঞ্জ না সূচক মাথা নাড়লো। অর্ক কুঞ্জে নাকে নাক ঘষে বলল,
-খাবার ঘরে নিয়ে আসো। একটা প্লেটে আনবে কিন্তু।
বউকে ছেড়ে বাথরুমের দিকে গেলো অর্ক। কুঞ্জ আনমনে হাসলো। চারদিকে কেমন সুখ সুখ বাতাস। সে বাতাস ছুঁয়ে গেলো কুঞ্জের সারা অঙ্গ জুড়ে। মুড়িয়ে দিয়ে গেলো ভালোবাসার চাদরে। ভালোবাসা এতো সুন্দর কেন? যারা ভালোবাসা পায়না তাদের বুঝি খুব কষ্ট? ভাবনার মাঝে মানসপটে ভেসে উঠলো মায়ের মুখ। কুঞ্জের মন খারাপ হলো। তার মায়ের ভাগ্যে ভালোবাসা ছিল না কেন? মায়ের ভাগ্যে একটু ভালোবাসা লিখলে কি ক্ষতি হতো ভাগ্যের মালিকের?

#চলবে…?