#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১১
বৃষ্টি থেমে গেছে বহুক্ষণ আগে। বাতাস আছে তবে তার তীব্রতা নেই। মৃদু ভাবে বয়ে চলছে। আকাশে ঘনকালো মেঘ নেই। নেই তার গর্জন। সাদা স্বচ্ছ অভ্র স্বাধীন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। ঝড়ের পর শান্ত প্রকৃতি। কে বলবে একটু আগে সে মেতেছিল ধ্বং*সের নেশায়। বিকেল বেলা। রোদ নেই ধরায়। প্রকৃতিকে লাগছে স্নিগ্ধ। ডাক্তার ইমরুল হাসান ওটি থেকে বের হয়ে এসে কুঞ্জের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন,
-কুঞ্জারি পেসেন্টের রক্ত ক্ষরণ হয়েছে অনেক। রক্ত লাগবে। ক্যান ইউ ম্যানেজ?
-ইয়াহ স্যার, আই ক্যান।
-দেন ডু ইট র্ফাস্ট।
-ওকে স্যার।
ডাক্তার চলে গেলেন নিজের কাজে। কুঞ্জ ফোন নিয়ে কারো নাম্বারে ডায়ল করবে ঠিক তখন মিসেস তানহা বলে উঠলেন,
-আমার ছেলেকে নিয়ে কোন বে*হায়া মেয়েকে ভাবতে হবে না। আমি রক্ত দিব আমার ছেলেকে।
কুঞ্জ তিশা নামে সেভ করা নাম্বারটায় ডায়াল করলো। ফোন কানে ধরে শীতল চোখে তাকালো শ্বাশুড়ির দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
-আপনার ডায়বেটিস আছে মা। আপনার রক্ত নিবে না ডাক্তার।
মিসেস তানহা আরো কিছু বলতে চাইলেন। কুঞ্জ সুযোগ দিলো না। কল রিসিভ হয়েছে। কুঞ্জ বলল,
-তিশু? হলে আছিস?
-হ্যাঁ কুঞ্জ। কেন কি হয়েছে? এনি পরবলেম? আসবি হলে? চলে আয়! এটার জন্য কল করতে হবে?
-তেমন কিছু না রে। একটা হেল্প করতে পারবি?
-কি হেল্প বল।
-তোর ব্লাড গ্রুপ AB+। ব্লাড দিতে পারবি?
কুঞ্জের কন্ঠে আকুতি। ভরকে গেলো তিশা।
-কার কি হইছে দোস্ত?
-অর্ক এক্সিডেন্ট করেছে দোস্ত। ইমরুল স্যার বলে গেলো দ্রুত রক্ত লাগবে।
কুঞ্জে কথা শুনে মনে হলো এখনি কেঁদে ফেলবে মেয়েটা। অথচ কখনো কোন ফ্রেন্ড কুঞ্জকে কাঁদতে দেখেনি। বান্ধবীর দঃখে তিশার মন খারাপ হলো। দ্রুত বলল,
-চিন্তা করিস না দোস্ত। আমি আসতেছি। সোহানা আর রিহানের ও সেম গ্রুপ। ওদেরও আনতেছি। তুই প্যারা নিস না। জাস্ট পাঁচ মিনিট দোস্ত। আসতেছি আমরা।
বান্ধবীর কথায় সত্যি চিন্তা কমে গেলো কুঞ্জের। এমন বন্ধু থাকলে চিন্তা কিসের?
সত্যি সত্যি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিশা, সোহানা আর রিহান চলে আসলো। ওদের দেখে কুঞ্জ দাঁড়িয়ে গেলো। তিশা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বান্ধবীকে। সোহানা আর রিহান পাশে দাঁড়ালো। কুঞ্জকে সাহস দিলো। ডাক্তার ইমরুল নিজের শিক্ষার্থীদের দেখে খুশি হলেন। বললেন,
-আপাতত দুই ব্যাগ রক্ত হলেয় হবে। দুজন আসো আমার সাথে।
রিহান উঠে দাঁড়ালো। সোহানা তিশাকে বলল,
-কয়েকদিন হলো জ্বর থেকে উঠলি। শরীর দুর্বল তোর। আমি দেই। তুই কুঞ্জের সাথে থাক।
ওরা চলে গেলো। কুঞ্জ আর তিশা একপাশে বসে রইলো। রিহানকে দেখে মিসেস তানহার মাথায় রাগ উঠেছিল। ডাক্তার চলে যেতেই চিল্লিয়ে উঠলেন,
-ওই ছেলে কে? ওই ছেলের সাথে ঘুরিস তাই না? খবরদার ওই ছেলের রক্ত আমার ছেলের শরীরে দিবি না!
তিশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিসেস তানহার দিকে। ওনার কথা থেকে বুঝতে পারলো উনি কুঞ্জের শ্বাশুড়ি! অর্ক ভাইয়া তো ভীষণ ভালো। আর তার মায়ের ভাষা এমন? তিশার রাগ উঠলো। তিশা ঠোঁটকাটা স্বভাবের। যা মনে আসে ঠাসঠাস মুখের উপর বলে দেয়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। বলে উঠলো,
-আপনি অর্ক ভাইয়ার আম্মু? মনে হচ্ছে না। যাইহোক ওই ছেলের সাথে ঘুরিস দিয়ে কি মিন করছেন আন্টি? কুঞ্জ প্রেম করে? প্রেম করতে ইচ্ছে হলে আপনার ছেলের সাথেয় করতো। শতবার তার প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিত না।
তিশার কথায় চমকে তাকালো মিসেস তানহা, আলম সাহেব ও অদিতি। প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল মানে? কি বুঝাতে চাইছে মেয়েটি? মিসেস তানহার মনে হলো কেউ তার সমানে সমীকরণ জোট দিয়ে বলেছে সমাধান করতে। কিন্তু তিনি কোনভাবে মিলাতে পারছেন না।
পূর্ব নিজের রুমে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। আপা আর ফোন দেয়নি। ব্যস্ত আছে বলে সেও আর দেয়নি। কিন্তু মন মানছে না। আপার কান্না এখনো কানে বাজছে। আপা এর আগে কখনো কেঁদেছিল তার সামনে? মনে করার চেষ্টা করলো। না কাঁদেনি। পূর্ব মনে মনে আওড়ালো, আপা অর্ক ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। ভীষণ!
নুহাস পূর্বের রুমে এসে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পরলো। পূর্ব শুধু একবার তাকালো ওর দিকে তারপর আবার ভাবনায় মশগুল হলো। আপাকে কল দিবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলো সে। নুহাস কিছুক্ষণ ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো পূর্বের দিকে। পরে চোখ দু’টো ছোট ছোট করে বলল,
-কাহিনি কি মামা? প্রেমে পড়ছোস? মাইয়া কেডা? পটতেছে না? প্যারা নিস না। আমি আছি না? শিখায় দিমুনে পটানোর উপায়।
নুহাস ভাব নিয়ে কথাটা শেষ করলো। পূর্ব ওর দিকে তাকিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করলো। তারপর বলল,
-সিরিয়াসলি নুহাস? পূর্ব চৌধুরী যারতার প্রেমে পড়ে না। আমি যার প্রেমে পড়বো সে আমাকে এমনেই ভালোবাসবে। এত কাহিনি করে পটায়তে হবে না।
নুহাস ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
-দেখা যাবে।
পূর্ব সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-দেখে নিস!
পূর্ব আবার আনমনা হয়ে গেলো। নুহাস এবার সিরিয়াস হলো। আলতো স্বরে বলল,
-কি হয়েছে পূর্ব?
পূর্ব অসহায় হয়ে ওর দিকে তাকালো। ধীর কন্ঠে বলল,
-দুপুরে বড় আপাকে কল করেছিলাম।
অস্থির স্বরে নুহাস বলল,
-কেমন আছে বড় আপা?
পূর্ব আনমনা হয়ে বলল,
-আপা কাঁদছিল নুহাস!
নুহাসের কলিজাটায় টান দিলো বোধহয় কেউ। আপা! তাদের বড় আপা কাঁদছিল। নুহাস অস্থির হয়ে উঠলো। পূর্ব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-আ..পার ক…ক..কি হয়েছে পূর্ব? আপা কাঁদছে কেন?
পূর্ব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-অর্ক ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
নুহাসের ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা কিছুটা শান্ত হলো। হ্যাঁ সত্যি শান্ত হলো। আপার কিছু হলে এতক্ষণ পূর্বকেই মেরে দিত হয়তো। পূর্বের অপরাধ কোথায়? পূর্বের অপরাধ হতো এতক্ষণ কিছু না বলার জন্য। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নুহাস বলল,
-আর কথা হয়েছে?
-না! বুঝতে পারছি না কল দিব নাকি দিব না। আপা ব্যস্ত থাকবে স্বাভাবিক ভাবেয়। এখন কল দেওয়া কি ঠিক হবে? রাতে দেই বরং?
-আচ্ছা।
বলে নুহাস পূর্বের কাঁধে হাত রাখলো। আলতো স্বরে বলল,
-টেনশন করিস না। ঠিক হয়ে যাবে।
পূর্ব ধীর কন্ঠে বলল,
-অর্ক ভাইয়ার কিছু হলে আপা ভেঙে পড়বে নুহাস। বাজে ভাবে ভেঙে যাবে আপা!
নুহাস চুপ থাকলো। সে নিজেও তো ভেঙে যাবে কুহুর কিছু হলে।
অর্ককে রক্ত দেওয়া হয়েছে। এখন রিস্ক ফ্রি। কেবিনে শিফট করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে জ্ঞান ফিরবে বলেছে ডাক্তার। রিহান, সোহানা ও তিশা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কুঞ্জ ওদের বিদায় দিয়ে কেবিনে ঢুকবে ঠিক তখন মিসেস তানহা আলম সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
-ওই মেয়েকে আমার ছেলের আশেপাশে আসতে নিষেধ করো।
আলম সাহেব কিছু বলতে চাইলেন। কুঞ্জ মানা করলো বলতে। কেবিনে ঢুকে অর্কের বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। মিসেস তানহা পুনরায় কিছু বলবেন তার আগে কুঞ্জ বলে উঠলো,
-আপনি আসলে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানেন না। আর না কাউকে ভালোবাসতে জানেন। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারলে আপনি আমাকে নিয়ে এতো সমস্যা করতেন না। আমি ভাবতাম আপনি খুব সহজে ছেলে-মেয়ের ভালোবাসা মেনে নিবেন। আসলেও তো সেটায় হওয়ার কথা। যারা ভালোবাসা হারায় তারা তো বোঝে ভালোবাসা হারানোর কষ্ট। তাই না?
মিসেস তানহার চোখ দুটো কোটর থেকে বের হবার উপক্রম হলো। কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
-কি বলতে চাইছো তুমি?
কুঞ্জ বাঁকা হাসলো। অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-উফস সরি! বোঝেননি? নাকি বুঝতে চাইছেন না? কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলাম বুঝি? আমি কিন্তু দিতে চাইনি। বাধ্য আপনি করলেন!
মিসেস তানহা স্বামীর দিকে চাইলেন। চিৎকার করে বললেন,
-মেয়েটা আমাকে অপমান করছে। তুমি কিছু বলবে?
কুঞ্জ দরাজ স্বরে বলল,
-আমার স্বামী অসুস্থ। কোন ঝামেলা এই মুহুর্তে চাই না আমি। এখানে চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না।
এরপর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
-আপনার সাথে আমার বহু হিসাব নিকাশ বাকি তনুশ্রী উরফে তাহনা শিকদার। আপাতত নিজের ছেলের ভালোর জন্য চুপ থাকুন।
তনহা নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কুঞ্জের দিকে। কিছু বলতে চাইলো অথচ জিহ্বা নাড়াতে পারলো না। সারা শরীর অসার হয়ে এলো। তনুশ্রী! ডাকটা যেন কানে বাজলো বহু বছর পর! কত বছর এই নামে কেউ ডাকে না? এক,দুই? না না। প্রায় পঁচিশ বছর!
#চলবে…?