অতুলনীয়া পর্ব-১৪

0
413

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ১৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমা বাসায় ফিরে শ্রেয়ার রুমে ঢু মা’রল। শ্রেয়া মুখ ভার করে বসে আছে। ফাতেমা তার হাতে থাকা শাড়িটার দিকে তাকায়। মূলত শাবানা বেগমই তাকে দায়িত্ব দিয়েছে শ্রেয়াকে সাজিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত করার জন্য। ফাতেমা শাড়ি নিয়ে শ্রেয়ার রুমে প্রবেশ করা মাত্রই শ্রেয়া বলে ওঠে,
‘আম্মু এটা কি কাজ করল ফাতেমা? এভাবে আমাকে না বলেই বিয়ের বন্দোবস্ত করে নিল!’

ফাতেমা শ্রেয়াকে বোঝানোর জন্য বলে,
‘তুই ভুল ভাবছিস! আন্টি মোটেই তোর বিয়ের বন্দোবস্ত করেনি। পাত্রপক্ষ তো শুধু দেখতে আসছে। আগে দেখা-সাক্ষাৎ হোক। তারপর তোদের একে অপরকে পছন্দ হলে বিয়েটা হবে। আর নাহলে নয়।’

শ্রেয়া তবুও যেন ভরসা পায়না। সে বলতে থাকে,
‘আমার সেটা মনে হয় না। বিভিন্ন নাটক সিনেমায় দেখিস না কিভাবে দেখতে এসেই কাবিন পড়িয়ে দেয়। আমার মনে হয় আম্মুও এমন কিছু ভেবেছে। নাহলে তোকে এই লাল শাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছে কেন?’

ফাতেমার হাতে থাকা শাড়িটার দিকে ইশারা করে উক্ত কথাটি বলে শ্রেয়া। ফাতেমা বলে,
‘তুই বেশিই ভাবছিস। আন্টি আমায় বলেছে এমন কিছু নয়। তাছাড়া পাত্রপক্ষের সামনে তো যেমন তেমন ভাবে যাওয়া যায়না। তাই তুই আর কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা পড়ে নে।’

শ্রেয়া তবুও মানতে চাইছিল না। তবে ফাতেমা বেশি জোরাজোরি করায় বাধ্য হয়েই শাড়িটা পরিধান করে নেয়। ফাতেমা শ্রেয়াকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে মৃদু হেসে বলে,
‘মাশাল্লাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে। তুই পছন্দ করবি কি না জানি না। কিন্তু তোকে যে দেখতে আসবে সে নিশ্চয়ই তোকে অপছন্দ করবে না।’

শ্রেয়া কিছুই বলে না। তার মুখ তখনো ভাড় ছিল।

শাবানা বেগমের ডাকে শ্রেয়াকে বাইরে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যায়। অতঃপর সোফায় বসিয়ে দেয়। ফাতেমা শাবানা বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পাত্রের মা-চাচি শ্রেয়ার রূপের প্রশংসা করতে থাকে। পাত্রের মা বলে,
‘মাশাল্লাহ, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। একদম চাঁদের টুকরো। এমন কাউকেই তো আমার ছেলের বউ হিসেবে চেয়েছিলাম। আমার ছেলের পাশে বেশ ভালোই মানাবে।’

এভাবেই টুকটাক কথাবার্তা এগোতে থাকে। শ্রেয়া হাতের তালা ঘষছিল। ভীষণই নার্ভাস ফিল হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে নেয় সে উত্তেজনায়। এরমধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠতেই শ্রেয়ার বুক ধড়পড় করা বাড়ে। পাত্রের মা বলেন,
‘আমার ছেলে বোধহয় এসে গেছে।’

শাবানা বেগম পাত্রপক্ষের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলে। তাই ফাতেমাই যায় দরজাটা খুলে দিতে। দরজাটা খুলেই হতবাক হয়ে যায় সে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
‘আপনি!’

২৭.
নয়না জেলে বসে ছিল। তার আশেপাশে আরো কয়েকজন মহিলা কয়েদীকে রাখা হয়নি। এরা প্রত্যেকেই ভীষণ ভয়ানক। সবাই খু**ন অথবা বড় ক্রাইমের সাথে জড়িত। নয়না যতই কুটিলা হোক এদের কাছে সে চুনোপুঁটি। তাই সবসময় এদের সাথে সমঝে চলতে হয়। আর এখানে আসার পর ফাতেমার প্রতি তার ঘৃণা আরো বেড়েছে। নয়না তো প্রতিজ্ঞাই করে নিয়েছে জেল থেকে বেরোনোর পর ফাতেমার জীবন জেরবার করে দেবে!

নয়না যখন বসে বসে এসব ভাবনায় ব্যস্ত ছিল তখনই কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলে ওঠে,
‘হ্যালো, মাই লিটল সিস্টার। কেমন আছিস তুই?’

নয়না অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকায়। উপরে তাকিয়েই সে নিজের বড় বোন নেহা মির্জাকে দেখতে পায়। নয়না উঠে দাঁড়িয়ে নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আপু তুই এসেছিস!’

নেহা হেসে বলে,
‘আসবো না কেন? আমার বোনটা জেলে বন্দি হয়ে আছে আর আমি চুপ করে বসে থাকব! যতই তুই আমার সৎ বোন হোস না কেন, আমাদের শরীরে তো একই রক্ত বইছে। মা আলাদা হলেও আমাদের বাবা তো একজনই।’

নয়না যেন ভরসা পায় নেহার কথায়। নেহাকে বলে,
‘তুই আমার জামিনের ব্যবস্থা করেছিস নিশ্চয়ই?’

নেহা হাসে। হেসে বলে,
‘তোর জামিনের ব্যবস্থা তো করিনি তবে তোর স্বামীর জামিনের ব্যবস্থা করেছি।’

নয়নার মুখ চুপসে যায়। সে বলে,
‘তুই আমাকে সাহায্য না করে সোহেলের সাহায্য করলি?!’

নেহা নয়নার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে পৈশাচিক আনন্দ পায়। আর বলে,
‘কেন আমি তোর জামিনের ব্যবস্থা করব? তুই এটা ভাবলি কি করে? তোর মা আমার মায়ের কাছ থাকে আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছিল, তোর মায়ের জন্য আমার মা এবং আমার প্রতি বাবার একটা উদাসীনতা তৈরি হয়েছিল। তারপর তুই জন্ম নিলি! তুই জন্মাতেই বাবার সব ভালোবাসা তোর উপর এসে পড়লো। আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছিস তুই। একদম নিজের মায়ের স্বভাবই পেয়েছিস। ছোটবেলা থেকে আমার সব পছন্দের খেলনা, জামা সব কেড়ে নিয়েছিস। আবার এখন তো শুনলাম অন্য একজনের স্বামীও কেড়ে নিয়েছিস। কাড়তে শুধু তুই একাই পারিস না, আমিও পারি! এতদিন তুই সবার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস আর এবার আমি তোর সবকিছু কেড়ে নেব নয়না। তোকে একদম ধ্বংস করে দেব আমি।’

নয়না নেহার মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। নয়নার মাকে তার বাবা ভালোবাসত জন্য সে এটাকে ব্যবহার করে মির্জা পরিবারের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল। নেহা ও তার মাকে সবসময় দমিয়ে রাখত। নেহা এবং তার মা এমনিতেই বেশ সহজ সরল ছিল। তার উপর বাবার সাপোর্টও যেহেতু নয়নার উপর ছিল তাই নয়না সবকিছুতেই নিজের কতৃত্ব রাখতে চাইত। মৃত্যুর আগে নয়নার বাবা অবশ্য দুই বোনকে সমান সম্পত্তি দিয়ে গেছেন তবে তার পূর্বে অনেক বৈষম্য করেছেন।

নয়না তো জানত নেহা লন্ডনে গিয়ে এক ধনী বিজনেসম্যানকে বিয়ে করেছে। তাই ভেবেছিল আর কখনো দেশে ফিরবে না। কিন্তু এতদিন পর যে এমন প্রতিশোধের নেশা নিয়ে ফিরবে সেটা তো সে কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি!

নেহা মির্জা বলে,
‘প্রার্থনা কর তোর এই জেলের আয়ুষ্কাল যেন দীর্ঘ হয়। কারণ তুই জেল থেকে বের হতেই আমি সবকিছুর জন্য তোর উপর প্রতিশোধ নেব।’

২৮.
ফাতেমা অবাক হয়ে প্রত্যুষকে দেখছিল। প্রত্যুষ চৌধুরীর অবস্থাও অনেকটা এক। প্রত্যুষ চৌধুরীর মা এসে প্রত্যুষকে বলেন,
‘তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় ভেতরে আয়।’

বলেই তিনি প্রত্যুষকে ভেতরে নিয়ে যান। প্রত্যু্ষকে নিজের হবু বর হিসেবে দেখে শ্রেয়া যেমন অবাক তেমনি খুশি। লোকটা বেশ নিষ্ঠাবান এটা জানে শ্রেয়া। তাই তাকে স্বামী হিসেবে পেলে মন্দ হয় না। পারিবারিক ভাবে কথাবার্তা এগোতে থাকে। অতঃপর শ্রেয়া ও প্রত্যুষ দুজনের কাছেই জানতে চাওয়া হয় তারা একে অপরকে পছন্দ করে কিনা। প্রত্যুষের এমনিতে কাউকে পছন্দ ছিল না, তবে শ্রেয়ার ব্যাপারে সে যতোটা জানে এই মেয়েটাই ফাতেমাকে তার বিপদের দিনে আশ্রয় দিয়েছিল। তাই প্রত্যুষ বুঝতে পারে মেয়েটার মন ভালো। তার এমন ভালো মানসিকতারই জীবনসঙ্গীর দরকার ছিল। তাছাড়া শ্রেয়ার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো এবং সে দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী। প্রত্যুষের পরিবারও শ্রেয়াকে পছন্দ করেছে। তাই সব দিক বিবেচনা করে সে বিয়েতে মত দিয়ে দেয়।

শ্রেয়াও যেহেতু প্রত্যুষ চৌধুরীর উপর মুগ্ধ ছিল তাই সেও রাজি হয়ে যায়। প্রত্যুষ চৌধুরীর মা-বাবা এবং শাবানা বেগম সবাই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন যে দুজনে রাজি থাকলে আজই আংটি বদল হবে এবং সামনেই একটা ভালো দিন দেখে তাদের বিয়ে ঠিক করা হবে। যেহেতু দুজনেরই আপত্তি নেই তাই আজই আংটি বদল করানো হলো। যেখান থেকে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। ফাতেমা মন ভরে দোয়া করল এই হবু দম্পত্তির জন্য।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨