#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ফাতেমা বিমুঢ় হয়ে চেয়ে আছে ছোট্ট নিহার মরদেহের দিকে। এই পাষাণ নাঈম কি বিভৎস ভাবে হ**ত্যা করেছে এই নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে। লা*শের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি খুব সহজেই অনুমেয়। ফাতেমা স্থির থাকতে পারল না বেশিক্ষণ। ভেতর থেকে জ্বলে উঠল প্রতিশোধের আগুন। কিন্তু সে কিছুই করতে পারল না কারণ তাকে বেধে রাখা হয়েছে। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, নাঈমের এমন অবস্থা করবে যা সবার সামনে উদাহরণ হয়ে থাকবে যে পাপের ফল কতটা ভয়ানক হতে পারে। এদিকে নাঈম হেসে কুটিকুটি হয়ে বললো,
“মনে মনে নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভাবছ ভাবি? ভেবে নাও, ভাবনাতেই খুশি থাকো। বাস্তবজীবনে তো তুমি কিছুই করতে পারবে না। আর মাত্র একটা দিন মাত্র সময় আছে তোমার হাতে। এরপরই তোমাকে আমি বিদেশে পাচার করে দেব। তারপর সেখানে গিয়ে যা করার করো।”
বলেই বিশ্রী হেসে উঠলো। যেই হাসি ফাতেমার গা জ্বালিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। ফাতেমা কিছুক্ষণ স্থির থাকার চেষ্টা করলো। অতঃপর কঠিন সুরে বলল,
“পাপেরও বাপ আছে–এটা ভুলে যেও না নাঈম। আমাকে তুমি বিদেশে পাচার করতেই পারো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তোমার পাপ তোমার পিছু ছাড়বে। পাপ কারো বাপকেও ছাড় দেয় না। আর তুমি তো পাপের সব সীমাই অতিক্রম করে গেছে। ভেবো না যে, এত পাপের পরও তুমি মুক্তি পাবে। পাপের ঘড়া অবশ্যই পূর্ণ হবে। আর তারপরই তুমি চরম শাস্তি পাবে।”
ফাতেমার এসব কথায় গুরুত্ব দিতে চাইল না নাঈম। তার কাছে এসব ফাকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। এদিকে নেহা মির্জা ফাতেমার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“কে বিনাশ করবে এই পাপকে?”
ফাতেমাঃযে নেহা মির্জাকে বিনাশ করেছিল।
নেহা মির্জা অট্টহাসি হেসে বলে,
“সেটা তো নাঈমই করেছিল। তাই না নাঈম?”
নাঈম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“কই নাতো। আমি কেন নয়নার সাথে কিছু করতে যাব। তার সাথে তো আমার কোন শত্রুতা ছিল না।”
নেহা অবাক হয়ে বললো,
“সেকি! কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে তুমিই..”
“তুমি এটা খুব ভালো করেই জানো নেহা মির্জা যে এই নাঈম নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। যেখানে আমার নিজের কোন স্বার্থ নেই সেখানে আমি কেন কিছু করতে যাব, বলো আমায়?”
নেহা মির্জা এবার নিশ্চিত হলো যে নাঈম এসবের পেছনে ছিল না। তাহলে কে ছিল? সে ভীষণ ধন্দে পড়ে যায়। আর এদিকে ফাতেমা খুঁজে পায় নতুন আশা। নিশ্চয়ই কেউ আসবে এদের এই পাপের সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে–এটাই এখন তার ভাবনা!
৬৯.
বাসায় এসে নিহাকে খুঁজে না পেয়ে নুহাশ, নাজমা খাতুন সবাই ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ফারিয়াকে আপাতত মোহনা এবং ফাহিম নিজেদের সাথে করে নিয়ে গেছে। নিহাকে বাসার দীর্ঘদিনের কাজের লোক কুলসুমের ভরসায় রেখে গেছিল তারা দুজন। কিন্তু এসে দেখে কুলসুম নিজের ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে এদিকে নিহার কোন খোঁজ নেই। একেই ফাতেমার ব্যাপারটা নিয়ে নাজমা খাতুন ভেঙে পড়েছিলেন এখন নিহার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তাকে আরো বেশি ভাবিয়ে তুলছে। তিনি আর এত চিন্তা নিতে পারছেন না।
তার বিপি লো হয়ে আসছে। আরেকটু হলেই জ্ঞান হারানোর দশা। এদিকে নুহাশ খন্দকারও দারুণ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়লো। একদিকে ফাতেমার চিন্তায় বিভোর তার উপর এখন নিহাকে নিয়ে নতুন চিন্তার উপদ্রব শুরু হলো। নুহাশ হঠাৎ কিছু একটা মনে করে নাঈমকে ফোন করে বলল,
“হ্যালো, নাঈম। কোথায় তুই?”
“ভাইয়া,আমি তো এখন চট্টগ্রামে কেন?”
“আসলে আমরা নিহাকে কুলসুম চাচির ভরসায় রেখে বাইরে গেছিলাম। বাসায় ফিরে দেখি নিহা বাসায় নেই।”
“সেকি! ও আবার কোথায় নিখোঁজ হলো। একেই ফাতেমা ভাবি নিখোঁজ এখন আবার নিহাও! এ কি বিপদ নেমে এলো আমাদের পরিবারে।”
“তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না নাঈম। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি। তুই ওখানে যেই কাজে গেছিস, সেই কাজটাই মন দিয়ে কর।”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”
নুহাশ খন্দকার ফোনটা রেখে দেয়। চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। নিজেকে আজ ভীষণ অসহায় জীবনে লাগছে। অর্পার মৃত্যুর পর আজ এই প্রথম সে এত বেশি চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে।
৭০.
ফাতেমা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। আজকের দিনটা তার কাছে নরকের মতো। সে যেন এমন এক চক্রবুহ্যে ফেসে গেছে যেখান থেকে বের হবার আর কোন রাস্তাই নেই। যেখানে সে দিনকে দিন আরো বেশি ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। যেখান থেকে বের হবার রাস্তা হয়তো সে এখন আর খুঁজে পাবে না। এখন যেন সব হারানো তার আগত ভবিষ্যত।
ফাতেমা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ আশেপাশে হয়তো কোন মসজিদ আছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে আযানের সুর। ফাতেমা একজন নামাজী নারী। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া তার নিত্যদিনের রুটিন। কিন্তু এখানে বন্দি থাকায় তার পক্ষে আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
আযানের পুরো সময়টা ফাতেমা চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে। সৃষ্টিকর্তার উপর তার ভরসা এখনো ফিকে হয়ে যায় নি। সে ভরসা রাখে আল্লাহর উপর। সে জানে রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে। তাই এখনো ভরসা রাখছে আল্লাহর উপর। যেকোন সময় আল্লাহ সব সমস্যা দূর করে দেবে।
★★★
নুহাশ হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। এমন সময় হঠাৎ তার সাথে দেখা হয় তাদের প্রতিবেশী মধ্যবয়সী ভদ্রলোক লতিফ সরকারের সাথে। লতিফ সরকারকে দেখে নুহাশ সালাম বিনিময় করে। লতিফ সরকার নুহাশকে দেখেই বুঝে যান যে সে ভীষণ চিন্তার মধ্যে আছে। তাই তিনি নুহাশের কাধে হাত রেখে বলেন,
“তোমায় এমন লাগছে কেন নুহাশ? দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনেক চিন্তিত! কিছু কি হয়েছে?”
নুহাশ বলল,
“আসলে আঙ্কেল, আমি আর আম্মু নিহাকে কুলসুম চাচির তত্বাবধানে রেখে একটু বাইরে গেছিলাম। কিন্তু বাসায় এসে থেকে আর ওর কোন খোঁজ পাচ্ছি না। কুলসুম চাচিও ঘুমিয়ে ছিলেন তাই কিছু বলতে পারছেন না।”
লতিফ সরকার বলেন,
“নিহাকে খুঁজে পাচ্ছ না মানে? আমি তো দেখলাম দুপুরের দিকে নাঈম ওকে নিয়ে কোথাও গেল।”
নুহাশ হতবাক হয়ে বলে,
“কি?!”
“হ্যাঁ, দুপুরে বাজার থেকে ফেরার পথেই তো আমি দূর থেকে ওদের দেখলাম। ওরা বোধহয় আমায় খেয়াল করেনি।”
“আপনি ঠিক দেখেছেন তো আঙ্কেল?”
“হ্যাঁ, আমার বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমার চোখে তো কোন সমস্যা নেই। আমি একদম ঠিক দেখেছি।”
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আঙ্কেল।”
বলেই নুহাশ গাড়িতে উঠে পড়ে।
“তার মানে নাঈম আমায় মিথ্যা বলেছে। কিন্তু এর কারণ কি? আমাকে এক্ষুনি নাঈমের লোকেশন বের করতে হবে।”
বলেই সে ফোন করল তার এক সহকর্মীকে।
“একটা নাম্বার দিচ্ছি, সেটার লোকেশন বের করে দাও।”
“জ্বি, আচ্ছা স্যার।”
একটু পরেই নাম্বার ট্রাক করে দিলেন সেই ব্যক্তি। নুহাশ তার জোরে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
“নাঈম আসলে কি করতে চাইছে, কিজন্য এত লুকোচুরি এটা এবার আমায় জানতেই হবে।”
বলেই নুহাশ গাড়ির স্পিড যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨