অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-৪+৫

0
378

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৪)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
পর্ব: ৪

আকষ্মিক মুখে কারো উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে সে হকচকিয়ে উঠে গেল। ভেবেছিল জুনায়েদকে দেখতে পাবে কিন্তু কৌশিককে দেখা মাত্রই আবার চোখ পিটপিট করে তাকায়, মনে হচ্ছে কেউ যেন তার আশায় এক বালতি এ সি ড ঢেলে দিয়েছে।

“আমার ঘুম উড়িয়ে দেখি তুমি বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছো?!”
কৌশিকের পুরুষালী কণ্ঠে সে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে কৌশিকই তাকে মন্ত্রমুগ্ধ নয়নে চেয়ে তার মূখে আদুরে ভঙ্গিতে হাত বোলাচ্ছে। কাশফি রেগে অবিলম্বে এক ঝাড়া দিয়ে কৌশিকের শক্ত শিরান্বিত হাত তার গাল থেকে সরিয়ে নেয়। অতিশয় ঘৃণায় সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“ আমি কোথাও যাবো না! ”

কৌশিক কাশফির উগ্র আচরণে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না করে কাশফির দিকে ঠিক আগের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সবার উদ্দেশ্যে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
“আমার ওয়াইফের সাথে আমার কিছু ব্যাক্তিগত কথা আছে, এই কক্ষ আমি দশ সেকেন্ডে খালি চাই।”

খোলসে থাকা মানুষ গুলোর চিনা বড্ড কঠিন, তাদের মুখে হাঁসি অন্তরে বিষ। কৌশিক মির্জা নব নির্বাচিত মেয়রের ছোট ভাই, প্রভাবশালী, বিত্তশালী, এলিট সোসাইটির একজন পার্লামেন্ট সদস্য। নির্দয়, নির্মম, জ’গ’ন্য আর বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ। তবে কাশফির কাছে সে স্বামী হিসাবে একজন টপ নচ অভিনেতা। এই ভদ্র, যত্নশীল, অনুরাগী স্বামীর ভান ধরা মানুষের মন ভোলানোর মুখোশ মাত্র।

কাশফির ঠোঁট ফাঁক করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কর্কশ স্বরে বলে উঠে — “আমি কোন কথা বলতে চাই না!”
কেউ তার কথা যেন কানেই নিল না। ছলছল চোঁখে শাড়ীর আঁচলটা শক্ত করে খামচে ধরে ওসির দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকায়, তাকে এখন কৌশিক মির্জার সাথে ছাড়া মানে তার ফিরে যাওয়া নিশ্চিত।
ম্যানিপুলেটিভ কৌশিক মির্জা কোন ক্রমেই হার মানে না। ওসি তার দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে চোঁখ দিয়ে আশ্বস্থ করে সবার পর তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
কক্ষের পিনপতন নীরবতার ফাঁকে কাশফির ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শোনাচ্ছে কেবল। তার হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার, মনে হচ্ছে এখনই কৌশিক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তার প্রা ন কে ড়ে নেবে।

কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলো ইতিমধ্যে। চারিদিকে ঘন কালো আঁধার নেমে পড়ায় কিছুক্ষণ পর পর দূরদূরান্তের ঝি ঝি পোকার মিলিয়ে পড়া আবছা ডাকও ভেসে আসছে।
বিশ মিনিটের মাথায় কাশফি দাঁতে দাঁত পিষে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেললো, কক্ষে বিরাজমান নিঃশব্দতা যেন তার গলা চে পে ধরছে।

“নয় ঘণ্টা হলো তুমি আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছ…”
কৌশিকের হাস্কী কন্ঠ থেমে গেল, সে কাশফির দিকে এক পলক চেয়ে মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
“কিন্তু তুমি ব্যার্থ, ইউ ফেইলড ইউর্সেলফ, ওয়াইফি।”

সমবেদনার ঠাট্টা করায়, কাশফির যেন পিত্তি জ্বলে উঠলো। কিন্তু প্রতিত্তরে কিছুই বলল না, সে জানে কৌশিক তাকে অতিষ্ঠ করতে পছন্দ করে, তাই সে আজ কোন ক্রমেই নিজের ভাব ভঙ্গি দেখাবে না।

চোখ মুখ মুছে কাশফি অনড় হয়ে রইল,
“আপনার সাথে আমি কোত্থাও যাবনা”
তার ভাবমূর্তিহীন হয়ে থাকার ব্যার্থ প্রচেষ্টা দেখে কৌশিক আনমনে হেসে ফেলে। পরপর শোনালো কৌশিকের জবাব — “আমি জানি!”

কাশফির চোঁখে মুখে বিস্ময় দেখে কৌশিক হাত বাড়িয়ে কাশফির মুখের সামনে পড়ে থাকা অবাধ্য চুল আঙ্গুলের ভাঁজে আলগোছে সরিয়ে দেয়।

“বাসর রাতে স্বামীকে রেখে পালিয়ে যাওয়া ঘোর পাপ।”
কাশফির ঘেন্নায় নাক মুখ কুঁচকে ফেলতে দেখে কৌশিক স্মিথ হাসে, পরক্ষণে কাশফি আবার নিজেকে অবেগশুন্য করে ফেলে। কৌশিক মনে মনে আওড়ালো — “ওয়েল প্লেইড কাশফি, বেশ ভালোই খেলছো!”

“তুমি মনে করছ নিজের আবেগ অনুভূতি লুকাতে পারলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিব? কাম’অন!!!”

তবুও কাশফির কোন হেরফের না দেখে কৌশিক পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে তার সামনে ধরে। কাশফি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কৌশিকের ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আতকে উঠে। বিস্ময়ে ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে যায়, একবার ফোনের স্ক্রিনে আরেকবার কৌশিকের কুটিল হাসির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফোনের ডিসপ্লেতে অজ্ঞাত অবস্থায় তার ছোট ভাইয়ের হাত দুটো জড়ো হয়ে বাঁধা ছবি। কাশফির বুক মুচড়ে উঠে, ততক্ষনে তার অজান্তেই চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে তবুও মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করছে না, সে কৌশিকের মতলব জানে। উগ্র মস্তিষ্কের কৌশিক মির্জা তার দুর্বলতা দেখতে চায়, তার ভয়, আর কান্নার কারণ হতে চায়, এক কথায় তাকে নিজের বাধ্যগত পুতুল বানাতে চায়।

সে তো বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে আইনের সাহায্য নিতে অথচ এখানে এসেও রক্ষা পেল না বরঞ্চ মনে হচ্ছে আরো বাজে ভাবে ফেসেছে।

“এত কাদলে মানুষ ভাববে আমি তোমায় মেরেছি।”
কৌশিক গম্ভির গলায় বলে পকেট হতে টিস্যু বের করে নিয়ে তার গাল মুছে দেয়। সে কৌশিকের ছোঁয়া হতে দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে তেজ দেখিয়ে চেঁচালো,
“আমার ছোট্ট ভাইকে এই জঘণ্য খেলায় না আনলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?”
কথার দলা পাকিয়ে আসছে গলায়, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে যে তাদের পরিস্থিতি এমন না হয়েও পারতো।

কৌশিক চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট করে নিম্ন স্বরে তবে কর্কশ পুরুষালী কণ্ঠে বলে,
“তুমি বাধ্য করেছ।”

কাশফি মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, ক্ষিপ্র মেজাজে বলে,
“আমার জীবন নষ্ট করে এক্সপেক্ট করেছেন আমি বুকে হাত গুঁজে তামাশা দেখবো?”

“আমার কোলে বসে দেখতে পারো, এই স্পেস কেবল তোমার জন্য বরাদ্দ।”
কাশফির সুপ্ত রাগ উপলব্ধি করে কৌশিক বাকা হাসে, বেশ ভালোভাবে ম্যাডামের মাথায় চড়ে বসতে পেরেছে । কাশফি দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট জোড়া একত্রে করে সরু লাইনের মতো করে, কৌশিককে বে’হা’য়া’পনা অগ্রাহ্য করে বলে,
“আপনি কেন হাত ধুয়ে আমার পিছনে পড়ে আছেন?”

প্রতিত্তরে কৌশিক এক নাগাড়ে চেয়ে থাকে, তীর্যক দৃষ্টিতে বেষ্টিত করে। পরক্ষণে কিছু ভেবে বুকে হাত ভাজ করে ঠোঁটের সূক্ষ্ম কোণা উপরে তুলে হেসে বলল —
“সোনা, তুমি কি আমার মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনতে চাইছো?”

কাশফি তেতে উঠে কৌশিকের দামী ফোন কেড়ে নিয়ে ফ্লোরে আছড়ে ভেঙে ফেলে ভাঙ্গা গলায় জোর দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

“আমাকে কথার মাঝে ফাঁ সি য়ে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না!!!”
কান্নায় ফোলা মুখমণ্ডল, ক্রোধে লাল হয়ে থাকা চোখ মুখের দিকে মনোযোগ দেয় কৌশিক। মেয়েটা কে রাগাতে তার ভীষণ ভালো লাগে। চোঁখ চিকচিক করছে তবুও জেদ চেপেছে, কৌশিক মির্জার সামনে সে কোন ক্রমেই কাঁদবে না।

কৌশিক তার হাতে হাত রেখে বলে, আরেক হাত বুকে রেখে নাটকীয় ভাবে বলে—
“সোনা, ইউ অলমোস্ট গট মি, আম ট্রুলি ইমপ্রেসড!”

কাশফি চোখ শক্ত করে বুজে, দাঁত কড়মড় করে, সে জানতো কৌশিক উত্তর দিবেনা বরং ভুলিয়ে ভালিয়ে যা তা বলা শুরু করবে।
“আমাকে সবাই ঈশিতা ডাকে আপনিও ঈশিতাই ডাকবেন আর কোন বড়সর মতলব ছাড়া আপনি কারো পিছনে পড়া মানুষ না কৌশিক। খেলার গুটি যেহেতু আমি, জানার অধিকার আমার আছে।”

কৌশিক চোখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে, কাশফি বরাবরই খেয়াল করেছে যতবারই সে কৌশিককে উত্তেজিত করার লক্ষ্যে পাল্টা জবাব দিয়েছে ততবার কৌশিকের এমন অঙ্গভঙ্গি করেছে। খুবই নিচু তবে তার তেজস্বী কণ্ঠে বলল,

” অমার যা ইচ্ছে তা ডাকতে পারি আর আমি পুরুষ তুমি নারী, ওয়ান্স আপন এ টাইম, তোমার মতো ডেড-ড্রপ গর্জিয়াস একজন আমার চোখে পড়েছিল তারপর ইটস আল নিউরোট্রানসমিটার এন্ড ডোমাপিন। সহজ বিষয় প্যাঁচানোর কিছু নেই!”

কাশফি মুহুর্তমধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিকের দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকায়,
“ইউ মিন ইনফ্যাচুয়েশান কৌশিক?! মোহের বসে আপনি আমার জীবন নষ্ট করেতেও ভাবলেন না? ফ্যান্টাস্টিক”

কৌশিক কাশফির বিদ্রুপ শুনে চোখ মুখ শক্ত করে নেয়। উগ্র মেজাজ নিয়ে কাশফি নিজেকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে দুর্বল কদমে থানা থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মাথায় একটা চিন্তা, প্রথমে তার ভাইকে খুঁজে বের করতে হবে। কৌশিক এতক্ষন কাশফির কাজকর্ম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যাস্ত, ঠিক চার কদমের জন্য পা বাড়ানোর আগেই সে কাশফির কোমর ধরে টেনে, শক্ত হাতে তার গলার পিছনের অংশ ধরে নিজের বুকে মিশিয়ে নেয়। পরপর পুরুষালী কণ্ঠে স্ট্রেইটফরোয়ার্ড জবাব দেয়,

“ক্ষণিকের মোহ হলে এত লম্বা সময় অপেক্ষা করতাম না কাশফি। আমি তোমার ভয়, রাগ, ঘৃণা ভীষণ উপভোগ করি, এতটাই উপভোগ করি যে তোমার চোখে অন্য করো জন্য ঘৃণা দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় মিসেস মির্জা….”

কাশফির কোমরে পুরুষালী হাত আরো শক্ত হয়ে আসলো, কৌশিকের গরম নিশ্বাস তার মুখে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ কাশফির কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কাশফিকে অপ্রস্তুত আর সম্পূর্ন বিহ্বল করতে পেরে কৌশিক বাকা হাসে,

“আমি তোমার ডেনায়াল গেইম অনেক পছন্দ করি, সোনা। সাউন্ডস ফাকড আপ রাইট?!”

কাশফি হিতবুদ্ধির মতো চেয়ে আছে, আজ সে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। বড় একটা ঢোক গিলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে — “ব’ল’দ পেয়েছেন?”

“নিজেকে এত ছোট করে কেন দেখছো? এছাড়া তুমি যা জানতে চেয়েছো আমি তো তাই বললাম।”
কৌশিকের নিচু স্বরের আওড়ালো, ঘন ঘন গরম শ্বাস কাশফির মুখে এসে লাগলো। তাদের মাঝের অতি নগণ্য দূরত্বে নিজের অবস্থান কৌশিকের বুকে আবিষ্কার করে তড়িৎ গতিতে সরে দাঁড়ায়। চোখে আশ্চর্য আর বিভ্রান্তি নিয়ে বলে,

“ইউ আর সিক অ্যান্ড ইউ নিড টু সি আ ডক্টর কৌশিক, ASAP! আপনি বড়সড় মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।”
তার বলে শেষ হওয়ায় আগেই কৌশিক কাশফিকে তার দিকে ফিরিয়ে চোয়াল শক্ত করে ধরে, ক্রুর হেসে তার কান্না শুকিয়ে যাওয়া মুখ বেশকিছুক্ষণ পরখ করে। তারপর হিম শীতল কণ্ঠে বলল,

” আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছ কিন্তু তুমি কি জানো তুমি এতটা প্যাথেটিক যে নিজের ভুল স্বীকার করার ভয়ে অতীত ভুলিয়ে দিয়েছ কাশফি। ট্রাস্ট মি, তুমি একটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করছো, ডার্লিং।”

নিজের ব্যাপারে এসব বাজে কথা শুনে কাশফির মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো,
“কারো ব্যাপারে না জেনে কিছু বলবেন না, টাকার দাপট আর ক্ষমতা আছে মানে কি আমার মাথা কিনে নিয়েছেন?”

কৌশিক কাশফির নরম গালে আরো চাপ প্রয়োগ করায় সে কঁকিয়ে উঠে বড় বড় নখ দিয়ে কৌশিকের হাত খামচে ধরে। কৌশিক শব্দ করে হেসে মাথা নেড়ে বলে,
“তুমি আসলেই প্যাথেটিক সোনা!”

কাশফি কৌশিকের হাত থেকে নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিয়ে আঙুল দিয়ে শাসিয়ে বলে,
“শাট আপ! আমি কখনোই এমন ছিলাম না।”
কৌশিক মুখে জিপার টানার ভঙ্গী করে চুপ হয়ে গেল। এতে কাশফি যেন আরেক দফায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।

“জাস্ট ড্রপ ইয়ুর এ্যাক্ট কৌশিক মির্জা, আমি এতই প্যথেটিক হলে আমার ভাইকে কি’ড’ন্যাপ করার প্রয়োজন ছিলনা, আমি ডাবল স্ট্রান্ডার্ড হলে প্রয়োজন ছিল আমাকে মুক্ত করে দেওয়ার। তাহলে কেন করছেন না?”

কৌশিক মাথা ঝেকে বোঝায় যেন সে কাশফির কথা মেনে নিয়েছে যা দেখে হতবম্ব কাশফির কাছে নিজেকে পাগল পাগল মনে হতে লাগল, লোকটা এত সহজে মেনে নিয়েছে? কাশফি নিজেকে আশ্বস্থ করার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করতে নিয়েও আটকে যায়। সে যেন আরেক দফায় বোকা বনে যখন কৌশিক তার গুটিয়ে নেওয়া পাঞ্জাবীর হাতা খুলে সোজা করে কাফলিঙ্ক আটকে নেয়। তাহলে সে কি কাশফির কথা মেনে নিয়েছে? এত সহজে?!!

“আপনি চলে যাচ্ছেন?!”

“অবশ্যই, অন্তত থানায় হানিমুন করার মতো ফালতু রুচি আমার নেই!”
কাশফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৌশিকের হাতে তার নখের আঁচড় দেখেই তার মন প্রফুল্লতায় ভরে উঠে। পরক্ষণে আবার কৌশিকের ত্যাড়া কথা শুনে পিন্ডি চটকায়,

“আপনি আমার টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?”

“এমন কিছু কি বলেছি?!”

“আপনি এমন টাই বুঝিয়েছেন!”
কাশফি থেমে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল, এটা সে কি করছে? খ’চ্চ’রের বা’চ্চার মতো আবার কৌশিকের কথায় ফেসে কি বলার ছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে।

কাশফিকে তপ্ত নিশ্বাস ফেলতে দেখে কৌশিক মাথা এপাশ ওপাশ কাত করে ঝাঁকি দিতেই মট করে শব্দ হয়। নিজের ভাবনায় আদাজল খাওয়া কাশফির কানের কাছে এসে বলে,
“আমি জীবিত থাকতে তোমার মুক্তি হবে না আর তোমার ভাই নিরাপদে আছে। তবে এখন, তুমি কৌশিক মির্জার বাধ্য স্ত্রীর মতো তার সাথে ফিরবে, ওকে? ”
কানের কাছে গরম শ্বাস আর পরপর কৌশিকের কন্ঠ শুনে কাশফি আতকে উঠে বুকের উপর থাকা শাড়ি খামচে ধরে, স্বভাবসুলভ কৌশিকের পিঠে চাপড় দেওয়ার জন্য হাত তুললে কৌশিক ভ্রু জোড়া উচুঁ করে কাশফির হাতের দিকে দৃষ্টি পাত করে।

“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না, আর আমার ভাইকে আমি খুঁজে নিব। সো কাইন্ডলি, গেট লস্ট!”
উপরে তোলা হাত নামিয়ে কাশফি ঠান্ডা মাথায় হালকা পাতলা অপমান করে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই কৌশিক মুখে একটা রহস্যময় হাসি রেখে বলে উঠে,

“তুমি আর তোমার বান্ধবী আরিয়ানা মেহনাজ কাশফি পুস্পকুঞ্জ আর্ট একাডেমী থেকে জাতীয় শিশু শিল্প প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়েছিলে। মনে পড়ে?”
কাশফি থ মেরে দাড়িয়ে থাকে, তার মস্তিষ্কে আবার সেই একাডেমির গেইট, ক্যানভাস, রঙ, তুলি আর একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ তলায় গ্রুপ ওয়ার্কের প্রতিচ্ছবি ভাসতে থাকে। সে চোখ শক্ত করে বুঝে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে আবার পিছনে ফিরে কৌশিকের দিকে তির্যক দৃষ্টি দেয়। অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কিছু বলার আগেই কৌশিক আবার বলে,

“আরিয়ানার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমার বাবা অপরাধ বোধে ভুগেছিলেন।”

কাশফির হৃদপিণ্ড জোরে জোরে লাফাতে শুরু করলো, পাশের নোংরা দেওয়াল ধরে নিজেকে ধাতস্থ করল, সে যেন এবার আশ্চর্য্যের সপ্ত আসমানে। মাথা ঝিম ধরে আসছে তার। অতি কৌতূহলের বসে সে সেদিন দুই পাতা পড়েছিল, এখন মনে হয় সেইদিন জার্নালটা না পড়লেই ভালো হতো। দু দিকে মাথা নেড়ে চেচিয়ে বলল,
“আপনি কিছুই জানেন না!”
সে কথাটা যেন নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলেছে। আবার কৌশিকের দিকে র’ক্ত চোঁখে চেয়ে মেঝের দিকে চেয়ে বলে— “ আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই আপনার অজানা কৌশিক…”

কৌশিক তাদের মাঝের দুরত্ব কমিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ল তার বদনে, মাস্কি পুরুষালী ঘ্রান নাকে গিয়ে বিধলো, ধীরে ধীরে কৌশিকের দেহ হতে আগত উষ্ণতা যেন আলোর ন্যায় তার মাঝে বিচ্ছুরিত হলো। পরবর্তীতে শক্ত পুরুষালী কণ্ঠ এলো কানে—
“ ভয় পেয়েছিলো?” — কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল— “পাওয়াটাই দরকার!”

বিস্ফোরিত নয়নে কাশফি জিজ্ঞেস করল, “কি?!—— ”
সে থেমে গিয়ে আবার গলা পরিষ্কার করে বলল, “কি জানেন?!”
চোঁখ পিট পিট করে সে কৌশিকের দিকে চেয়ে থাকলো।

“নিগূঢ় আর তমসাচ্ছন্ন একটা অধ্যায়! সামথিং ক্রিপটিক অ্যান্ড স্কেপটিক্যাল…”
তৎক্ষণাৎ কাশফির মাথায় হাজার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। পশ্চিমের জানালা দিয়ে শা শা শব্দে দমকা হওয়ায় এসে তার গায়ে লাগছে তবুও তার কোন হেলদোল নেই।
অতীত মানে ভালো খারাপ এর মিশ্র জিনিস তবে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ মানে সে কি বুঝিয়েছে?
আনমনা কাশফি এমন ভাবে মেঝের দিকে চেয়ে আছে যেন তার সকল প্রশ্নের উত্তর সেখানে পুঁ’তে রাখা আছে। তার হৃদপিণ্ডের বেগতিক ওঠানামার শব্দ মোটামুটি কৌশিকের কর্ন কূহরে পৌঁছানোর মতন। বার বার মস্তিষ্কের ফ্ল্যাশব্যাক দেখায় যেন তার মাথায় যেন কেউ বেশ জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
কৌশিক তার ছুঁই ছুঁই অবস্হায় দাঁড়িয়েই ছিল, আকষ্মিক ভাবুক কাশফির চিবুকে আঙুল রেখে মাথা উপরে তোলে,

“তোমার আর আমার মাঝে তফাৎ কোথায় জানো? আমি নিজে কতটা জগণ্য সেটা শিকার করতে জানি আর তুমি নিজের মিথ্যা আর প্রতারণা ঢেকে নিজেকে ভালো উপস্থাপন করতে সব করতে পারো। ”

বেশ কিছুক্ষণ পর কাশফি বলে উঠে,
“আপনি কি আমাকে স্টক করছেন!”

জবাব এলো কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে,
“আবরার কবীর বিজনেসের জগতে খুবই পরিচিত একটা নাম আর তুমি তার বন্ধুর মেয়ে ছিলে।”

কাশফি রাগে পাশে থাকা চেয়ার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, তেতে উঠে চোঁখ, মুখ খিঁচে বলে,
“আমাকে কি আপনি ক খ শিখাচ্ছেন? আর কি জানেন আপনি আমার ব্যপারে…”
প্রত্যুত্তরে কৌশিক শুধু বাকা হাসে। কাশফি ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। জবাব না পেয়ে মেজাজ তুঙ্গে ওঠে, চোখ গরম করে চেচিয়ে শুধলো,

“কিছু বলছেন না কেনো?!”
কৌশিক একবার কাশফির ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে আবার তার চোখের দিকে তাকায়।

“তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড আরিয়ানা মেহনাজ কাশফি সু’ই’সা’ই’ডা’ল ছিল আর আরিয়ানা কে সামাল দিতে তুমি আরিয়ানার ছায়া হয়ে থাকতে কেন জানো?”
কাশফির মাথার ভিতর একটা সুক্ষ্ম ঝাঁকি দিল, আরিয়ানা তার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ন মানুষ হয়েও স্মৃতির কোথাও তার বিন্দুমাত্র আনাগোনা নেই। শুধুমাত্র একটা দৃশ্য চোখে ভাসলো পুস্পকুঞ্জ একাডেমীর সামনের পোড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার ধ্বংসাবশেষ আর কিছু না।
তির তির করে তার ঠোঁট জোড়া কাপছে।
ইন্ট্রোভার্ট ঈশিতা ইমরোজ কাশফিকে একাডেমীর সবাই একটা ফ্রিক(freak) মনে করত। তাকে সবাই অস্বাভাবিক ভাবার কারণ সে শূন্যে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতো, নিজে নিজে হাসতো আর তার আর্ট গুলো মনস্তাত্বিক আর আধ্যাত্মিক রকমের ছিল, মুলত তাই কেউ তার সাথে মিশতো না। আরিয়ানা ছিল খাপ ছাড়া আর সব সময় অনিশ্চয়তায় ভুগতো। পরে সে ইন্ট্রোভার্ট কাশফির প্রাণপ্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠে।

এতক্ষন তার ধ্যানে ছিলনা যে তার স্বামী, কৌশিক তাকে ছুঁয়ে দাড়িয়েছে, ইলেকট্রিক ভোল্টের মতো তার দেহে আচানক শিহরন পৌঁছায়। কৌশিকের মুখে জলের মতো শান্ত রূপ যেন সমুদ্রের ভয়াবহ ঝড়ের আভাস।
তার জীবনের অনেক বড় অংশ তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে, তার মায়ের চেহারা কিংবা তার তার পরিবারের কারো চেহারা তার মনে নেই। তার জীবনে কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কেন সে এমন ছিল, সেই অজ্ঞাত চিঠি প্রেরক, জুনায়েদ তারা কি তার কল্পনা মাত্র? সে জানে না।

কৌশিক বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কাশফির এক হাত তার হাতে তুলে নেয়। বিস্ফোরিত কাশফির চোঁখে চোখ রেখে তার পরানো আংটিতে চুমু দেয়। বিমূঢ় কাশফি ছোট করে প্রশ্ন করে — “ কেন? ”

“কারণ তুমি তোমার মায়ের চলে যাওয়া মানতে পারো নি, সবাই ভাবত তুমি বাক্শক্তিহীন, কিন্তু প্যাথেটিক কাশফি সিলেক্টেড মিউট ছিল… মানে ইচ্ছাকৃত মূক বধির, যে সব কিছুতে চুপচাপ ছিল আর না কখনো নিজের ডিফেন্ড করতো।”
কৌশিকের উত্তরটা যেন তার পৃথিবী কাঁপিয়ে তোলে, দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে আর মাথা ঘুরছে। সে যেন এক গোলক ধাঁধায় আটকা পড়েছে, এমন কিছু কৌশিক জেনেছে যা তার জানার কথা নয়। কৌশিক বিরাট রকমের মাইন্ড গেইম খেলেছে আর সে কাশফিকে জব্দ করতেও সফল হয়েছে।

“মাই বিলাভড মিসেস মির্জা, তুমি আজকাল থেকে নয়, অনেক আগে থেকেই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করছ।”

প্রতিটা মানুষ তার জীবনের অনেক জিনিস মুছে ফেলতে চায়। কাশফিও মুছে ফেলেছিল কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় কৌশিক মির্জা, যা সবার অগোচরে থাকার কথা সেটাও সে জেনে গিয়েছে। ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে এসেছে তার কায়া, যেমনটা কৌশিক মির্জার সাথে প্রথম দেখায় হয়েছিল, একটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, ফেলিক্স স্টোনের ফিউনারেল সিরিমনিতে। সেদিন কৌশিক মির্জা দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছিল!
আর এই দুঃস্বপ্ন কা’টা’তে ঈশিতা ইমরোজ কাশফির আরিয়ানা মেহনাজ কাশফিকে খুঁজতে হবে। অতীত আর বর্তমানের প্যারানরমাল লাইন ভেদ করতে তার বান্ধবী আরিয়ানার প্রয়োজন।
তৎক্ষণাৎ যেন তার মাথায় চট করে একটা সুপ্ত পরিকল্পনা চাপে, এমন পরিকল্পনা যা সফল হলে কাশফির সব জটলার সমাধান পাবে আর অসফল হলে সে প্রাণ হারাবে। এটা লোহা দিয়ে লোহা কাঁ’টা’র একটা পরিকল্পনা। তার মত তুচ্ছ একজন কিছুই করতে পারবে না, আর আরিয়ানাকে খুঁজতে হলে কৌশিক মির্জাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
কৌশিক মির্জাকে কৌশিক মির্জা নিজেই পরাজিত করার ক্ষমতা রাখে ঠিক যেমন হীরা কে হীরা কাটতে পারে।

‘The weak are meat; the strong do eat.’

©️প্রোপীতা নিউমী( Propi Newmi )

#চলবে….

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৫)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

৫.

কমলদীঘির বাঁশ বাগানের অন্দরের রাস্তা দিয়ে দুটো চকচকে কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ শা শা বেগে ছুটে চলছে। দুই চারটা পাখি আর ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে, মাঝে মাঝে খুব কাছ থেকে শোনাচ্ছে খেক শেয়ালের ডাক। দূরের কিছু ঝোপঝাড় হতে জ্বল জ্বল করছে কিছু শিকারী জন্তুর দৃষ্টি। তমসাচ্ছন্ন রাত্রি, বেশ গুমোট আবহাওয়া, ভীতিকর আভার মাঝে কুচকুচে কালো গাড়ির তিরীক্ষ বেগ, সব মিলিয়ে গা ছমছমে একটা পরিবেশ। আট বছরের কায়েস ঘুমন্ত অবস্থায় টের পেয়ে ভয়ে বড় বোন কাশফিকে ঝাপটে ধরে, পরক্ষণে কাশফি তার ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শর্ত মোতাবেক কায়েসকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশের সিটে বসা কৌশিক দুই ভাই বোন কে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে, কাশফির পাশে গুটিয়ে থাকা শিশু কায়েস অঘোর ঘুমে মগ্ন আর পাশে তার ম্যাডাম জানলার দিকে ফিরে শূন্যে চেয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে যে কাশফির ধ্যান ধারণা এই জগতে নেই।
কৌশিক মির্জা নিজের অধিপত্যের বিষয়ে সর্বদা সচেতন। সে কাশফিকে তার বশ্যতা স্বীকার করাতে চায় তবে কাশফি কারো সামনে নজর নিচু করার মানুষ না। কিছুক্ষণ আগে কাশফির দেওয়া প্রস্তাব মনে পড়ে যায়, মুহূর্তমধ্যেই তার কপালের রগ ফুলে উঠল। কাশফি ভাবছে সে কৌশিককে ম্যানুপুলেট করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু সে আবার ভুল করেছে। কায়েসের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কাশফিও একই ভাবনায় বিভোর, তার মনে হচ্ছে কৌশিক মির্জা আবার মাইন্ড গেইম খেলেছে, খুবই নোং’রা ধরণের গেইম। তবে কাশফি যে তার ছোট্ট বিজয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে আছে তার ধারণা হয়তো কৌশিকের নেই।

কিছুক্ষণ পূর্বে থানায় কাশফি মনে সুপ্ত পরিকল্পনা এটে নিজের ভয়, হতাশা ঢেকে কৌশিককে চোঁখে চোখ রাখে। কৌশিকের চোঁখে মুখে বিজয়ের হাসির রেখা ফুটেছে। কৌশিক মির্জার জন্য ম্যানিপুলেশন একটা আর্ট আর আবেগহীন রূপ একটা মরীচিকা, কেবল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যার সৃষ্টি। কৌশিককে জব্দ করার একমাত্র উপায় তার পথ অনুকরণ, তাকে তার নিজ পন্থায় আটকানো।
কাশফি নিজের প্রথম সূক্ষ প্রদক্ষেপের একটা ছক কষে, খুবই ছোট একটা পরিকল্পনা মাত্র। চিন্তায় ডুবে তার উপরের ঠোঁট নিচের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে। পরক্ষণে চোখে একরাশ আত্মবিশ্বাসের ঝলক নিয়ে অকপটে বলে,

“লেটস মেক আ ডিল, কৌশিক।”
অতঃপর কৌশিকের সামনে দাড়িয়ে কাপা কাপা হাতে একটা চেয়ার টেনে তাতে পায়ে পা তুলে বসে। সে মনে মনে নিজের কাঁধ চাপড়ালো আর ভাবলো ‘ আম প্রাউড অফ ইউর বোল্ড মুভ ঈশিতা’ । নিজেকে বাহবা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে আড়চোখে কৌশিকের মুখ অবয়ব দেখে নিল কয়েকবার। লক্ষ্য করতে পেরে কৌশিক বেশ বিরক্ত বোধ করে।

“তোমার ছোট মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছো কাশফি?”
কৌশিকের নিচু স্বরের শব্দ মাটিতে পড়ার আগেই কাশফি তার তর্জনী আঙ্গুল নিজের দিকে ঘুরিয়ে স্পষ্টত বলে,

“ঈশিতা ইমরোজ কাশফি আপনাকে রান্না করে খাওয়ানো দুর এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়াবে সেই রাজ কপাল নিয়ে জন্ম হয়নি আপনার কৌশিক মির্জা।”
কাশফির ধৃষ্টতা দেখে কৌশিক চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে এক ভ্রু উচুঁ করে চায়।

“তোমার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হলো খোলা আকাশ পেয়ে বেশ উড়াউড়ি করছো মিসেস মির্জা, ভুলে বসো না যে তোমার গন্তব্য আমি আর পার্মানেন্ট ঠিকানা আমার খাঁচায়।”
কৌশিকের শীতল কণ্ঠের কাশফির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা সূচের ন্যায় শিহরন বয়ে যায়। মুখে স্মিথ হাসি আর পানির মতো শান্ত রূপ দেখে সব কাশফির মাথায় যেন রক্ত চড়ে বসলো। কতটা ই’ত’র হতে পারলে মানুষ এমনটা বলতে পারে?
আবার নিজেকে আশ্বস্ত করে সে, কৌশিকের কথার জালে নয় কৌশিককে কথার মাঝে রেখে নিজেরটা বুঝে নিতে হবে। আরেক বারের মতো নিজেকে সামাল দিয়ে আবেগহীন হয়ে বেশ রয়েসয়ে বলে সে,

“ আমি জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ, কোন পোষ মানা পাখি না। তাছাড়া আপনি চুক্তির বিষয়টা খুবই সুন্দর ভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন কৌশিক!”
বলেই কাশফি কৌশিকের মতো করে কিছুক্ষণ ভবঘুরে হওয়ার অভিনয় করে একটা হাসি দিয়ে আবার ঠিক কিছুক্ষণ আগের কৌশিকের মতো কিছুটা রসিকতার ছলে বলে— “ভয় পেয়েছেন? পাওয়ারই দরকার!”

এতেও যেন কৌশিকের হাসি কমে নি বরং তার তার চোখে মুখে আচানক অদ্ভুদ রকমের উচ্ছ্বাস ভেসে উঠলো—
“তুমি নিজেকে চালাক দেখাতে গিয়ে বোকা বনে ঘুরে ফিরে আমার জালে আটকাচ্ছো মিসেস মির্জা!”
কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কাশফি প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তাহলে দ্যা গ্রেট কৌশিক মির্জা তার বিরুদ্ধেও পাল্টা ফন্ধি এটে রেখেছেন?
কৌশিক বুকে হাত গুজে টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল— “ এই ডিলে আমার প্রফিট কি?! ”

“আমি কমপ্লেইন তুলে নিব!”
কাশফির সোজা সাপটা জবাবে কৌশিক হো হো করে রুম কপিয়ে শয়তানের মতো হেসে উঠলো। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে থ্রেট দেওয়ার মতো কন্ঠে বলল—
“তোমাকে অস্তিত্বহীন করার ক্ষমতা রাখি ডার্লিং আর তুমি সাধারণ একটা কমপ্লেইনের ভয় দেখাচ্ছো?! সো ডাম্ব অফ ইউ!”

কাশফি চটপট নির্ভীক জবাব দেয়,
“ডিল করা তো আপনার থেকেই শিখেছি, কৌশিক। একটু আধটু না হয় দক্ষ। তাছাড়া বউ যেহেতু হয়েছি অনেক কিছুই শেখার আছে, শিখছি।”
কাশফি দুই কাঁধ হালকা ঝাঁকি দিয়ে শ্রাগ করে আরেকটা মুক্ত ঝরানো হাসি দিয়ে আবার বলল,

“এখন শর্ত হলো আপনি আমার ভাইকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন তারপর আমাকে পুষ্পকুঞ্জ আর্ট একাডেমী নিয়ে যাবেন পরিবর্তে আমি আপনার স্ত্রী হয়ে নিঃশব্দে আপনার সাথে যেতে রাজি আছি আর কমপ্লেইন ও তুলে নেওয়া হবে।”

কৌশিকের চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট ছোট হয়ে আসলো, মানে সে মোটেও পছন্দ করে নি। বেশ খানিকক্ষণ কাশফির মুখের দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে আছে সে, ঠিক বিরক্ত হচ্ছেন কিনা বোঝা মুশকিল।

“আমি বারবার তোমাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি আর ভাবছি তোমার এত সাহস কোত্থেকে হয় ডার্লিং?”
কৌশিক চিন্তামগ্ন ভঙ্গিমায় তার গালের চাপা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবার বলে,

“বাট দেটস নট ফেয়ার! তুমি একপার্শ্বিক দিকেই সুবিধা নিলে…”

কাশফি এক ভ্রু উচুঁ করে চায়, তার অনেক বলতে ইচ্ছে করল—
“আপনার মতো অ’মা’নু’ষকে দেখলে কিভাবে না’ক ফা’টানো যায় সেই পরিকল্পনায় থাকি, দেখেছি পর্যন্ত ঘৃণা করে এসেছি, দুই দণ্ড আগ বাড়িয়ে কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিলনা, নেই আর এমন মানুষের সাথে আমি বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনের অপমান করে থাকার প্রস্তাব দিচ্ছি তাও আপনি বলছেন নট ফেয়ার?!”

কিন্তু সে মনের কথা মনেই চেপে মুখের হাসি অক্ষত রেখে বলল —
“আপনিও কখনো ফেয়ার গেইম খেলেন নি কৌশিক! লেটস সে, লার্নট ফ্রম দ্যা বেস্ট! (let’s say, learnt from the best)।”
কৌশিক চোয়াল শক্ত করে কাশফির বাহু নিজের মুষ্ঠির শক্ত বাঁধনে আটকে ধরে। কাশফির হাসিতে কেমন এই গা জ্বলা ভাব, যেন সুদর্শন হাসিটা তার উপহাসের লক্ষ্যে দেওয়া। কৌশিক এক ঝটকায় কাশফিকে টেনে চেয়ার থেকে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বেশ নিচু তবে থ্রেটেনিং স্বরে বলে,
” খাঁচায় ফিরার সময় হয়ে গিয়েছে মিসেস মির্জা!!! ”

অপ্রস্তুত কাশফি কিছু বলার আগেই তাকে টেনে বাইরে আনা হয়। নিজেকে আড়ালে রাখলেও ভয়ে তার বার বার বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। জিপের পাশে দাঁড়ানো ওসি আব্দুস সামাদ দুইজনকে বের হতে দেখে ক্ষিপ্র কৌশিকের দিকে এগিয়ে আসলেন। কাশফি একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে। এখানে সে ছাড়া পেতে এসে নিজেই আবার খাচায় ফিরে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু কাশফি নিজেকে আবার মনে করিয়ে দেয় তার একমাত্র লক্ষ্য, যা কৌশিক মির্জা আর তার পাওয়ারকে ব্যবহার করেই সে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। ঠিক যেমন কৌশিক তাকে কোন এক অজানা কারণে ব্যাবহার করছে।

“মিস ঈশিতা?”
কাশফির ধ্যান ভেঙে গেল। সবার সামনে দ্বিধায় পড়ে গেল। ঘর্মাক্ত হাতজোড়া মোচড়ামুচড়ি করে একবার কৌশিকের তাঁকিয়ে আবার ওসির দিকে ফিরে বেশ জড়তা নিয়ে বলল —

“আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, আমি দুঃখিত।”

দুইজনের মধ্যে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওসি এবার কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন— “ মিস ঈশিতা আপনাকে কেউ জোর করলে আপনি আমাকে জানাতে পারেন।”

কথাটা যে ডাইরেক্টলি কৌশিককে উদ্দেশ্যে করে বলা হয়েছে কৌশিক তা বুঝেছে, সে নিজের তীর্যক দৃষ্টি বজায় রেখে চোঁখ জোড়া গরম করে বলে—
“ মিসেস মির্জা সোজা সাবলীল বাংলায় বলেছেন তার কোন সমস্যা নেই, ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করলে দাঁড়ায় ‘she has no problem’ সো প্লিজ এক্সকিউজ আস!”
আর এদিক ওদিক না ফিরে টেনে এনে কাশফিকে গাড়ীতে ঢুকিয়ে নিজেও অন্যপাশে এসে ঢুকে পড়ল। তবে যাওয়ার আগে কৌশিক মাথায় আইস ব্যাগ দেওয়া এসআই আশরাফ কে চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে সে চলে যাচ্ছে মানে ছেড়ে দিবে না।

***

“তুমি আমার গর্ভের রত্ন ঈশিতা, আমার মাস্টারপিস!”
কাশফির সামনে একটা বড় ক্যানভাসে তার নিজ হাতে আঁকা ছবি, ক্যানভাসে নানান রঙে একটা শহুরের জীবনযাত্রার ছবির মাঝে একটা উদাসীন ছোট মেয়ের ছবি আঁকা। একজন পোলিশ মিলিয়নের ছবিটা 20,000$ এ নিলামে কিনেছেন। তাই আজ চারুলতা বেশ খুশি।
চারুলতা আর কাশফির শুধু পেছনের অংশ দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে ফোপানোর শব্দ এলো, কাশফি কি তাহলে কাদঁছে? চোখ গরম করে চারুলতা কষে এক থাপ্পড় লাগলেন কাশফির মুখে। জী’র্ণশী’র্ণ দেহের বারো বছরের কাশফি ছি’ট’কে পড়ল স্টু’ডি’ও রূমের এক কিনারায়। মিনমিন করে বলতে লাগলো— “আমার বাবার জন্মদিনের জন্য ছিল ছবিটা।”

পরপর শোনালো চারুলতার তেজী কর্কশ স্বর,
“বাবার মিশন থেকে জীবিত ফিরবে কিনা মৃত নির্ভর করছে তোমার উপর। তাই বলছি ভদ্রভাবে আচরণ করো!”

ফ্লোরে থাকা কাশফির ফোপানি আর গোঙানির শব্দ আরো বেড়েই চলছে হঠাৎ সব হওয়ায় মিলে যায়, ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের গভীরতা ও নিঃশব্দতা সম্পূর্ন স্টুডিও গ্রাস করে ফেলে।

***

কিছুটা তীক্ষ্ণ শব্দে গাড়ী থামে সরকারী স্কুলের শিক্ষক আতিকুর রহমানের দোতলা বাড়ির সামনে। আকষ্মিক ব্রেকে কাশফির মাথা ঝাঁকি দিয়ে সামনের দিকে ঢলে পড়ে, চোঁখ কুঁচকে সে দুই আঙ্গুলে কপাল টিপে ধরে। কিছুক্ষণের জন্য সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। (প্রোপীতা নিউমী)

আগে নাক বাঁকানো লোকটা, লেভিন গাড়ী থেকে নেমে পড়ে, পরপর ড্রাইভার বেরিয়ে পড়ে। কৌশিক আলগোছে বেরিয়ে আসে। তন্মধ্যে একজন গার্ড এসে কৌশিকের ঈশারায় কায়েসকে গাড়ী থেকে তুলে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। কৌশিকের তীর্যক দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাশফি বাঁধা দিতে চাইলেও গার্ড তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।
গার্ড যাওয়ার পর কৌশিক কাশফির জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাড়ায়। তার চাহনী তিরিক্ষি তবে বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গী নিরুদ্যম, চোঁখ যদি ভস্ম করতে পারত তাহলে হয়ত কাশফির ছাই টুকুও কেউ খুঁজে পেতো না। কাশফি নিজের ঘর্মাক্ত হাত শাড়ীতে মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। তার অস্বস্থি বোধ যেন তিনগুন বেড়ে গেল, কৌশিকের শকুনের মতো নজর তার প্রতিটা পদে যেন আটকে আছে। কাশফি গাড়ীর দরজা আটকে নিজের চুল, শাড়ির কুচি আর আঁচল ঠিক করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল তবে এসব লুকিয়ে চুরিয়ে নজর এড়িয়ে চলার প্রয়াস মাত্র। কৌশিক গম্ভির গলায় আবেগশূন্য হয়ে বলে,

“ আমার চুক্তির ভাগ আমি সম্পূর্ন করলাম এবার তোমার পালা। কা’ন্না’কা’টির এপিসোড শেষ করে সব গুছিয়ে নাও, কালই তুমি আমার সাথে মির্জা নিবাসে ফিরছো।”

তৎক্ষণাৎ কাশফির চোখ কপালে, সে প্রথমে ভেবেছিল কৌশিক মজার ছলে বলেছে। কিছুক্ষনপরও যখন কৌশিকের ভাবুমূর্তি অপরিবর্তিত দেখলো তখন তার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে লাগলো। তার এখনো চারুলতা নামের মহিলাকে দেখার বাকি! এখানে তার বাবা , ভাই কে রেখে সে অন্যত্র কী করে যেতে পারে? কাশফি ঢোক গিলে কৌশিকের চোঁখে চোখ রাখে,

“আমিও শর্ত পালন করেছি কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমাদের শর্তের মোতাবেক পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী যাওয়া বাকি!”

কৌশিক বেশ শান্ত মেজাজে বলে,
“তুমি ন্যায়সঙ্গত কোন চুক্তি করো নি কাশফি আর না আমি ফেয়ার গেইম (fair game) খেলি, সেটা তুমি নিজেই তো বললে।”

কাশফি একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুতি করে নেয়, সে কিছুটা ধারণা করেছিল কৌশিক এমন কিছুই করবে। তাই সে ছোট একটা ব্যাক আপ প্ল্যান করে রেখেছে, খুঁটে খুঁটে কৌশিক মির্জার দুর্বল পয়েন্ট বের করার পরিকল্পনা। সে কৌশিককে অনুকরণ করে শান্ত গলায় বলে,
“কৌশিক আপনি চুক্তিতে না করেন নি, তাই শর্ত মোতাবেক আমাকে সেখানে নিয়ে যাবেন!”

কৌশিক চোঁখ জোড়া ছোট ছোট করে চায়, এবার তার কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়ে এলো, সাদা চামড়ার উপর ফোলা ফোলা রগ দেখাচ্ছে। বাঘের ন্যায় জ্বলন্ত শিকারী চোঁখ জোড়ায় নজর বন্ধী করল কাশফিকে। কিছুক্ষণ চেয়ে গমগমে গলায় বলল,

“তুমি আমাকে অর্ডার করছ? সিরিয়ালি কাশফি?! লাস্টবার বলছি তোমাকে কোত্থাও নিয়ে যাওয়া হবে না আর কাল সোজা আমরা মোহাম্মদপুরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিব, প্রস্তুত থাকো!”

কৌশিকের কথায় ভয় পেলেও কাশফি নিজের ভয়কে দমিয়ে বড় গলায় প্রত্যুত্তর করে,
“আমিও শেষবারের মতো বলছি আমাকে হালকাভাবে নিয়ে আপনি আবার ভুল করেছেন কৌশিক!”

কৌশিক এবার দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয়, চোঁখের রগ লাল দেখাচ্ছে। সে চোয়াল শক্ত করে শুধলো — “ ঠিক কি বলতে চাইছো?”

“আপনি আপনার শর্ত পালন করেন নি কৌশিক তাই আমি আপনার বাড়ির চৌকাঠে পা রাখছি না।”
কাশফির মুখে আবার সেই গা জ্বালানো হাসি দেখে কৌশিক অপ্রস্তুত কাশফিকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির সাথে লাগিয়ে, তার দুইপাশের দিকের গাড়ির অংশে হাত দিয়ে তাকে আটকে নেয়।

“তুমি আমার অবাধ্য হওয়ার অনেক শাস্তি জমিয়েছো সোনা। ট্রাস্ট মি, প্রতেকটা কর্মের শুধে আসলে হিসাব নেব।”

কৌশিকের উষ্ণ নিশ্বাস কাশফির মুখ ছেয়ে গেল, ঘৃণায় ধাক্কা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও আবার কিছু মনে পড়তেই একটা ফিচেল হাসি দিয়ে কাশফি কৌশিকের দিকে তাকায়,

“মির্জা পরিবারের মানুষদের নৈতিকতার বড্ড অভাব। যেমন কথা দিয়ে কথা রাখতে না জানার মতো কাপুরুষ কৌশিক মির্জা— ”

কাশফি আর কিছু বলার আগেই কৌশিকের শক্ত পুরুষালী হাত তার গ’লা টি’পে ধরে, খুব একটা জোরে না তবে হালকাও নয়। কাশফির বাকি কথাটুকু গলায় আটকে আসে, মনে হলো তার শ্বাস আটকে আসছে। আশ্চর্য্য হয়ে থাকা কাশফির চোখ বড় বড় হয়ে আসে, শ্বাস না নেওয়ার ফলে তার মুখ র’ক্ত’শূ’ন্য দেখাচ্ছে, দুর্বল হাতে কৌশিকের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় কৌশিকের বাহু খামচে ধরে আরেক হাতে কৌশিকের বুকে আঘাত করে। একপর্যায়ে চোখে পানি চলে আসায় কৌশিক ছেড়ে দিয়ে স্বর ছোট করে বলে,
“আমি তোমার শ্বাস রোধ করিনি, তুমি চাইলেই নিঃশ্বাস নিতে পারতে কিন্তু তোমার মাইন্ড সেট করা যে তুমি নিশ্বাস নিতে পারবে না। Work smart not hard, মিসেস মির্জা। ”

কাশফি গলা ধরে হালকা করে কেশে উঠলো। আসলেই কৌশিক তার শ্বাস রোধ করেনি। তখন ভয়ে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাকে স্পেস দিয়ে কৌশিক সরে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। শক্ত পুরুষালী কণ্ঠে বলে,

“জাস্ট তোমাকে ছোট খাটো একটা লেসন দিয়েছি। আশা করি ভবিষ্যতে সাবধান থাকবে।”

কাশফি শূন্যে তাঁকিয়ে আছে নিজেকে ধাতস্থ করার লক্ষ্যে, মুখ হা করে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলো। অন্যপাশে থাকা কৌশিক নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার জন্য নিজের উপর রেগে আছে। শক্ত মুষ্ঠিতে ব্যাক ব্রাশ করা চুল খামচে ধরে চোয়াল শক্ত করে নেয়। কৌশিকে ক্রুদ্ধ অবস্হায় দেখে কাশফি চোঁখে চকচক করতে থাকা অশ্রু নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলে,

“ দ্যা গ্রেট কৌশিক মির্জাকে এই তুচ্ছ কাশফি রাগিয়ে দিল! Hats off to me, তাইনা?! নিজেকে নিয়ে আমি গর্বিত।”
কৌশিকের চোখে বিস্ময় আর মুখে তীব্র রাগ উপলব্ধি করতে পেরে কাশফি বাকা হেসে বলে,

” দ্যা পারফেক্ট কৌশিক মির্জা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানেনা। উপস মোমেন্ট ছিল, দুর্বলতা ধরে ফেললাম কৌশিক।”

কৌশিকের রাগ যেন চরম পর্যায়ে ছুঁই ছুঁই। তবে সে মুখ শক্ত করে কাশফিকে দেখেই গেল শুধু, মেয়েটা তাকে চমক তাকে বিশাল গেল।
স্কোর: কৌশিক ২ | কাশফি ১

“তাই বার বার বলেছি ডোন্ট টেক মি লাইটলি!”

কাশফি আর কোন রকম আগে পিছে না তাকিয়ে দুর্বল পায়ে বাড়ীর কাঠের খচিত দরজা ডিঙ্গয়ে ঢুকে পড়ল, তবে তাদের বাড়ির দরজায় কৌশিকের বাজখাঁই কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো— ”নিয়মানুযায়ী তোমাকে রাতে যেন আমার বিছানায় বধূ সেজে আমার পাশে দেখতে পাই, মিসেস মির্জা।”

কাশফি থমকে দাঁড়ায় মুখে তবে পিছনে ফিরে না। কিছু ভেবে তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি নিয়ে শাড়ির অগোছালো কুচি ধরে দোতলার দিকে তার বাবার রূমে অগ্রসর হতে হতে ভাবলো কৌশিক মির্জার কিছুক্ষণ আগের বাক্য —
“ Work smart not hard ”

কাশফি ফিচেল হাসে, স্ত্রী হিসাবে স্বামীর কথা মেনে চলা তার গুরুগম্ভীর দায়িত্ব।

#চলবে…