#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১০)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
[নিচের নোটে চারুলতা আর কলাবতীর নাম বিড়ম্বনা নিয়ে বলা হয়েছে, দেখে নিবেন।]
১০.
নিগূঢ় কালো রাত, চারিদিকে চাপা হাহাকার, স্টুডিওর কক্ষের জিনিস পত্রগুলোতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনের জ্বলন্ত, ভয়ার্থ লেলুপাত গ্রাস করে নিল দামী ওক কাঠের আসবাব পত্র, তেজী বেগে ছুটে চলছে তৈলচিত্রের আর্টওয়ার্ক গুলোর দিকে। অথচ ঈশিতার হাতের তৈরি এক একটা চিত্র চোখ ধাঁধানো,
কস্টস স্মল ফরচুন।
প্রতিটা নিলামে উঠে ধনীদের টাকায় ক্রয় হয় কিন্তু সেই ছবিগুলো এখন আগুণের সংস্পর্শে রাখ হয়ে যাচ্ছে। নিজের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে চিৎকার করে আরিয়ানা,
“ঈশিতা ফিরে আয়, আমার ভয় হচ্ছে!”
নিরুত্তর ঈশিতার সবকিছুই আজ বেফাঁস, সবকিছু। জা’নো’য়া’রটা তার বিশ্বাস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, চারুলতার মতো শুধু ব্যবহার করতে জেনেছে। এখন এত অপ্রাপ্তির ভিড়ে কেবল একটা জিনিস চাই তার।
শয়’তা’ন’টার রক্ত, ততটা র’ক্ত যতটা তার হতে অন্তক্ষরণ হয়েছে। র’ক্তে স্না’ন করতে পারলে হয়ত স্বাদ মিটতো?
উহু মিটতো না!
রণমূর্তি হয়ে দাঁড়ানো আরিয়ানা ভয়ার্ত চোঁখে চেয়ে রইল, সখীর জন্য হাহাকার করেই যাচ্ছে। যদি সময়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকতো তবে সে সেগুন বাগানের নীলাম্বর আবরণে নিষ্প্রাণ হিমাদ্রীর সাথে কখনো দেখা করত না, ইতিহাস সাক্ষী যে তারা নিষ্ঠুর। তারা তার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে, তার সুখী পরিবার ভেঙে দিয়েছে, এখন তার সখীর দুর্দশার কারণ তারা অথচ সে নাকি এতদিন রা’ক্ষ’স গুলোর একজন কে নিজের গার্ডিয়ান এঞ্জেল ভাবছিল।
নিজের প্রতি নিজে ধিক্কার জানালো। এত বোকা কেউ হয় নাকি?
ঈশিতা আয়নার দিকে তাঁকিয়ে একবার একটা মিষ্টি হাঁসি দেয় পরক্ষণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে একটা হুংকার ছুঁড়ে শক্ত মুষ্ঠি দিয়ে আয়নায় অনবরত আঘাত করে। হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেলো। ভঙ্গুরমনা আরিয়ানা চিৎকার আর্তনাদ করে, তার চুল খামচে ধরে হাঁটু গেটে বসে —
“প্লিজ নিজের কিছু করিস না আমি সইতে পারব না ঈশিতা, প্লিজ!!!”
ঈশিতা উন্মাদের ন্যায় কাচে আঘাত করে ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে নিজের প্রতিবিম্ব কে গুঁড়িয়ে ফেলছে। কাঁচের ছোট ছোট টুকরো ঈশিতার মুষ্ঠিতে গেঁথে গিয়েছে কিন্তু ঈশিতা যেন শোধ বোধ হারিয়ে অব্যাহত। সম্পূর্ন কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার পর ঈশিতা ক্রন্দনরত আরিয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
“এই কুৎসিত চেহারা হৃদয়হীনা চারুলতার অনুস্মারক! সৃষ্টিকর্তা কেন এত নিষ্ঠুর হলেন? পারতেন না কি আমায় ধ্বংসলীলা রূপে না আনতে?”
কিশোরীর ক্রোধ পুরো স্টুডিওর দেওয়াল কাঁপিয়ে তুললো। অতঃপর খুবই নির্বিঘ্ন কন্ঠে বলল—
“এই চেহারা আগুনে ঝলসে যাক, ছাইটুকুও যেন বাতাসে মিলিয়ে পড়ুক! দূষিত চিত্তের মানুষটার ব্লাডলাইনের নিশ্চিহ্ন হতে হয় এটাই প্রকৃতির নিয়ম।”
চোঁখের পানি লেপ্টে আছে আরিয়ানার মুখে, কান্না করার ফলে তার কাঁধ বার বার ঝাঁকি দিচ্ছে। বার বার সে মাথা নেড়ে মন্ত্রের মতো জপে যাচ্ছে—
“তুই আমার ইশু, দূষিত, বাজে কিংবা হৃদয়হীনা চারুলতা নয়।”
ঈশিতা হাঁটু গেটে আরিয়ানার পাশে বসে তার রক্তাক্ত হাত দিয়ে চোখ মুছে আরিয়ানার কপোল মুছে দেয় এতে ঈশিতার রক্তে আরিয়ানা কপোল ভিজে গেলো। আরিয়ানা এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে বলে,
“তুই ভুল করেছিস, ভুল সবাই করে।”
ঈশিতা খিলখিলিয়ে ক্রুর হাসি হেসে বলে,
“আমি পাপ করেছি, কিছু পাপের ক্ষমা হয়না!”
আরিয়ানা ক্রন্দনরত মুখে হতাশাজনক শ্বাস ফেলে, সে বোঝাতে অক্ষম। ঈশিতা আগের ন্যায় শান্ত হয়ে বসে বলে,
“ভালোবাসার ডেফিনেশন ভিন্ন ভিন্ন, যেমন আমার জীবনে ভলোবাসা কখনো অমৃত সুধা হয়ে জীবন গড়তে আসেনা, আমার জীবনে ভালবাসা আসে ধ্বংস হয়ে। আমি এর এক বিশেষ নাম রেখেছি, কি জানিস?”
কাশফি বিস্ময়বিমূঢ় অরিয়ানার উত্তরের অপেক্ষা করে না। একটা স্মিথ হাসি ফুটে তার মুখে, জড়ানো গলায় বলে,
“নিউরোটক্সিন! আমার জন্য ভালোবাসা নিউরোটক্সিনের ন্যায়— বিষাক্ত আর আমি জেনে শুনেই এই বিষ পান করেছি।”
হঠাৎ এক বিকট শব্দে কানের শ্রবণশক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিল। আরিয়ানা চিৎকার করে করে ঈশিতার নাম ডাকলো তবে পোড়া গন্ধে কথা বলতে না পেরে কেশে উঠলো। জবাব না পেয়ে মনে হলো সাদা ঝাঁঝালো ধোঁয়া গিলে ফেললো ঈশিতাকে। পরক্ষণে কয়েক জোড়া বুটের শব্দ শুনতে পেলো, কেউ যেনো তাকে টেনে তুলছে এরপর কানের মধ্যে একটা কড়া একটা শব্দ বাজতে থাকলো—
‘বি…ই…ই…ই…প’
অতঃপর ঝাপসা দৃষ্টিতে একটা বিঘুটে হাসি দেখতে পেলো। খুবই চেনা হাঁসি, তৎক্ষণাৎ তার গায়ে কাঁটা দিতে শুরু করলো। পরপর কানে বাজলো অভিশপ্ত সেই ডাক— “মায়াহরিণী তুমি বড্ড জালিয়েছো!”
তার দম আটকে আসে,
নাহ, এটা ভ্রম!
সবটা তার মস্তিষ্কের বানানো কাহিনী।
বেরিয়ে যাও!!!
তার চিৎকারের কোন শব্দ নেই
আর্তনাদ গুলো ফিকে ফিকে…
“কাশফি!!!”
অচমকা কৌশিকের শক্ত পোক্ত কন্ঠ বিধলো কানে, পরপর কাশফির ধ্যাণ ভাঙ্গলো যেন। চিলেকোঠার ঘরের ছোট খাটের কিনারা শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে সে, এতোটাই শক্ত করে ধরেছে যে নখ উল্টে যাওয়ার উপক্রম। নিজেকে স্থিত করে সে বিছানার ধার ঘেষে বসে পড়ল। তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ইদুরের ভয়, সব কিছু যেন মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। শঙ্কায় তার দেহ কাঁপতে লাগলো, মনে মনে নিজেকে বুঝ দিলো ‘না, ঈশিতা আর আরিয়ানার সাথে কিছুই হয়নি। তারা কিছু করতে পারেনি তার, এসব তোর ভ্রম!’
ডাক্তার ইয়াহিয়া খানের মতে তার ভিশনগুলো কিছু কিছু মস্তিষ্কের বানানো ইলুশন বা বিভ্রম, এদের কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এসব ইলুশান নিয়ে বেশি ভাবতে নেই, ভাবলে এরা মস্তিষ্ক কাবু করে তাকে উন্মাদে পরিণত করে নিবে।
হয়ত এতদিন আরিয়ানার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আরিয়ানার ব্যক্তিগত জার্নাল ছুঁয়ে দেখেনি সে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে বোকামি করেছে। যেই আরিয়ানার অস্তিত্বের কোন ছিটে ফোটা আজও সে পায়নি তাকে জোর পূর্বক আকড়ে ধরে কি এমন সাধন হবে?
তন্মধ্যে কৌশিকের ডাকে কাশফি ভাবনার ইতি টানে। হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে নিজের কপাল চাপড়াতে ভুললো না সে। কোন রকম দরজায় তালা ঝুলিয়ে ধড়ফড়িয়ে নেমে পড়ল চিলেকোঠার ঘর থেকে। আসেপাশে উকি দিয়ে সাই করে ছুট দিলো তার কামরায়। এদিক ওদিক না ফিরে জার্ণালটা একটা ওড়নায় মুড়ে নিলো। আশে পাশে তাঁকিয়ে এবার চোখে পড়ল তার প্রসাধনীর ব্যাগটায়। তার প্রসাধনী আর যাবতীয় জিনিসের আড়ালে মোড়ানো জার্নালটা সন্তপর্নে লুকিয়ে নিলো।
শাড়ি ঠিক আছে কিনা দেখে নেয় একবার। অপ্রত্যাশিত ত্রাসে কম্পমান হাত দিয়ে তার মুখ মুছে নেয়, কপালের বিন্দুবিন্দু ঘাম মুছে কয়েকবার নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্থ করে পিছনে ফিরতেই হতচকিত হয়ে আতকে উঠে, টলটলে পায়ে মনে শঙ্কা নিয়ে দুইকদম পিছিয়ে যেতে গেলেই টাল সামলাতে হিমসিম খায়। অপ্রস্তুত হয়ে পরে যেতে নিলেই কৌশিকের শক্ত পোক্ত হাত তাকে ঘিরে ধরে।
কাশফি আড়মোড়া ভেঙে পড়ার জন্য চোঁখ কুচকে বন্ধ করে নেয়। তার হাত খামচে ধরে পাঞ্জাবীর কাঁধের অংশ, এতে ইস্ত্রি করা মসৃণভাঁজ খানিকটা নষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে বেষ্টনে আবিষ্কার করে চোখ মেলতেই হতবুদ্ধ বনে যায় কাশফি, এতটা নিকটে দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি।
কৌশিকের পাঞ্জাবী ছেড়ে সরে গিয়ে নিজের মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ালো।
“কি করছিলে?”
কৌশিকের কোথায় নিজের শঙ্কা লুকিয়ে অসস্তি নিয়ে কিঞ্চিৎ বেখাপ্পা হাসি দেয়।
“একটু উপরে গিয়েছিলাম।”
“মিথ্যা বলতে তুমি ঢের অপক্ক আমার কাশফি।”
কৌশিকের রুদ্ধ কন্ঠে কাশফি মিইয়ে গেলো ক্ষানিকটা। তবে আমার কাশফি শোনায় কেপে উঠলো। ভয়ে নিজেকে ভিতরে ভিতরে গুটিয়ে নিলো। অমতা অমতা করে বলতে নেয়,
“অকারণে আমি মিথ্যে কেন বলব?—”
কথা সম্পূর্ন হওয়ার আগেই কৌশিক দূরত্ব অনেক টা ঘুচিয়ে কাশফির বদনে গরম নিশ্বাস ফেলে, তার ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে অগ্নিশিখা উদ্দীপ্ত হলো।
“উপরে এক্সাক্টলি কোথায়?!”
কাশফি চোঁখ জোড়া বড় বড় করে নেয়, হঠাৎ কি কারণে রেগে গিয়েছেন তিনি? পাংশুটে মুখে ছোট্ট করে জবাব দেয়— “ছাদে”
তড়িৎ বেগে রুষ্ঠ কন্ঠ তার জানে বাজলো — “কেন গিয়েছিলে?”
“সবকটা কাপড় আনা হয়েছিল কিনা…”
কৌশিক কিছুক্ষণ পরখ করল কাশফির মুখশ্রী পরপর ভস করে নিভে গেলো তার চোখের জলন্ত রাগের স্ফুলিঙ্গ। তবুও মুখ বেজার করে গমগমে সুরে বলে, “তাহলে তুমি কাউকে দেখতে যাও নি ছাদে?”
কাশফি ভরকে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে চায়— “কাকে?”
অতঃপর কৌশিক ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে কিছু না বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করে। হতবিহ্বল হয়ে কাশফি কৌশিকের যাওয়ার পানে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। সে কি তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল? কাশফি সন্দিহান দৃষ্টিপাত করে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে।
ধরা পড়েনি সেই তার রাজ কপাল।
সে ধরেই নিয়েছিল কৌশিক বেরিয়ে পড়েছে, আর আসবে না। কিন্তু ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাস উপলব্ধি করতে পেরে কাশফির লোম দাঁড়িয়ে যায়।
“নেক্সট টাইম থেকে তুমি শাড়ি শুধূ আমার সামনে পড়বে আর কোন ধরনের হিলস পরে তুমি মানুষের সামনে যাবে না।”
কৌশিকের রাশভারী কন্ঠের বিপরীতে কাশফির একটা ছোট উত্তর শোনা গেলো,
“প্ল্যাটফর্মস” (Platforms)
“কি?!”
কাশফি চোখ দিয়ে নিজের পায়ের দিকে ইশারা করে বোঝালো।
“এগুলো হিলস না প্ল্যাটফর্মস। ”
“উচুঁ জুতাই হিলস”
বিজ্ঞের মতন গম্ভির হয়ে আড়চোখে তাঁকিয়ে বলল,
“না জেনে ভুলভাল বলবেন না।”
কৌশিক খোলা লাগেজের সাজানো জুতো জোড়ার দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“তাহলে ওই সাদা জোড়া কি? ”
“এগুলো সাদা নয় অফ হোয়াইট আর অফ হোয়াইট গুলো পাম্পস (Pumps) ”
“তোমার ব্ল্যাক জোড়াও কি পাম্পস?”
“না সেগুলো স্টিলেটো।”
ভরকে গিয়ে কৌশিক সুধলো,
“Dagger নামের শর্ট’না’ইফের (short knife) নাম স্টিলেটো শুনেছি।”
কৌশিক কনফিউজড হয়ে কাশফির দিকে চায়, সে বিরক্তভাবমূর্তি একে চোখ উল্টে উচ্চারণ করল,
“ইটস স্টিলেটো হিলস।” (stilleto)
কৌশিক এবার চোখ কিঞ্চিৎ ছোট করে নয়। তার সামনে এসব পরছে সে মাতাল হচ্ছে ইটস নো বিগ ডিল, কিন্তু এসব মানুষের সামনে পরে তাদের নজর কাড়বে? হেল নো!
“হোল্ড অন! তুমি এসব নিয়ে যাচ্ছো আর ভাবছো আমি এসব তোমাকে বাইরে পরতে দিব?! সেটা হচ্ছে না ম্যাডাম।”
কৌশিকের গমগমে গলার প্রতিবাদের কাশফি নিজেকে বোল্ড দেখিয়ে বলল,
“আপনি ইদানিং আমাকে এত ম্যানহ্যান্ডেল করেছেন কেন?!”
কৌশিকের নির্জীব চোখে আকষ্মিক দমক দেখা দেয়, খুবই সন্তপর্নে তার ঠোঁটের সরু প্রান্ত বেকে উপরে উঠে।
“সুন্দর করে বলতেই পারো আমার কোলে বসার শখ অনেক!”
“কৌশিক হেঁয়ালি করবেন না একদম!”
“সেই সাধ্য আমার নেই তবে আদর করে আমার সিনিয়রিটি দেখাতেই পারি।”
তেতে উঠে চোখ গরম করে নেয়,
“মাফ করে দিন কথা কয়ে আমার ভুল হয়ে গেছে।”
কৌশিক যে এতক্ষন একটা দোপাট্টা নিয়ে দারিয়ে ছিল সেটা কাশফির চোখেই পড়েনি। কৌশিক কিঞ্চিৎ হেসে ওড়নাটা তার মাথায় পরিয়ে দেয়। তার স্বভাবগত হাস্কি কন্ঠে তবে কিঞ্চিৎ নিচু স্বরে বলে,
“তোমার শশুরবাড়িতে অল্প কয়েকজন পুরুষ মানুষ আছেন, তবে গার্ড আছে বেশ কয়েকজন। আগ বাড়িয়ে অন্য কোন পুরুষ মানুষের সাথে কথা বলতে দেখলে ঠ্যাং ভেঙে দিব।”
ওড়না মাথায় সুন্দর করে পিন দিকে সেট করে সে এবার কাশফির চিবুক উপরে তুলে কপালে প্রগাঢ় চুম্বন আকার পূর্বে বলে,
“আর পরপুরুষের তালিকায় জোভান সিকদার সবার উপরে। এখন থেকে এসব শাড়ী, সজ্জা এখন থেকে শুধু আমার সামনে পড়বে, মানে শুধু আমার চোখের জন্য বুঝেছো?”
কাশফি নিজের বেগতিক হৃদকম্পন আর বেসামাল আবেগ লুকানোর জন্য তড়িঘড়ি করে ল্যাগেজ চেক করছে। কৌশিকের সামনে নিজের কাবু হারানোর জন্য বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে তার লাগেজের চেইন বন্ধ করে নেয়। ভারী ভারী লাগেজ টেনে হিঁচড়ে রূমে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।
কৌশিক এসব দেখে একটা তপ্ত শ্বাস নেয়, এগিয়ে গিয়ে কাশফির হাত থেকে সাবলীল ভঙ্গিমায় লাগেজ নিয়ে নেয়। প্রশ্নাত্বক দৃষ্টি ফেলা কাশফির মাথায় টোকা দিয়ে বলে—
“তোমার কাজের নমুনা দেখা হয়েগেছে ম্যাডাম সরে দাড়াও।”
কৌশিক শক্ত হাতে লাগেজের হ্যান্ডেল টেনে বের করে মাটিতে দাড় করায়। হ্যান্ডেল ধরে একটু কাত করতেই নিচের চাকাগুলো দিয়ে সে অতি সহজে নিয়ে বের করে নিয়ে যায়।
লজ্জায় কাশফি ঘাড় চুলকে নজর লুকিয়ে রাখে। রাগ দেখাতে গিয়ে নিজের বোধ শক্তি লোপ পেয়েছিল নাহলে লাগেজের হ্যান্ডেল কেন দেখলো না। মনে মনে নিজেকে শায়েস্তা করতে ভুলে না সে!
***
কৌশিক গাড়ীর সামনে দাড়িয়ে ফোনে কথা শেষ করে আনমনা কাশফিকে চেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ আগে তার বাবা থেকে বিদায় নিয়ে এসে সেই যে বিষণ্ণ হয়ে আছে আর কিছুই বলছে না। কৌশিকের আনা চকলেট আর বাদাম হাতে নিয়ে কায়েস ড্রাইভিং সিটে বসা ড্রাইভারের পাশে আছে। পা দুলিয়ে দুলিয়ে মাথা নেড়ে খেয়ে যাচ্ছে সে। অবশ্যই সে কাশফির বারণ তোয়াক্কা করেনি।
কাশফি তার বন্ধুবান্ধব দের থেকে বিদায় নিয়ে এসে শক্ত মুখে কৌশিকের দিকে তাকায়। তার কামরা ছেড়ে আসার সময় আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। বিয়ের আগে কৌশিককে সে ঘৃণা করত ঠিক, যুক্তিযুক্ত কারন ছিল। একবার সে নিজেকে অচেতন অবস্থায় বিছানায় বাঁধা পেয়েছিল। খাটের হার্ডবোর্ডে কৌশিকের লিখা একটা স্টিকি নোটে লিখা ছিল—
“আমকে রাগানো ভুল সিদ্ধান্ত বোকা মেয়ে!”
আর জোভানের দেওয়া নুপুরটা খাটের পাশে পড়েছিল ছিন্নভিন্ন অবস্হায় পড়েছিল।
যেখানে তার কৌশল কে ঘৃনা করার দরকার সেখানে এলোমেলো অনুভুতি হানা দিচ্ছে। আই ঢাই না করে কাশফি প্রশ্ন ছুড়ে,
“কৌশিক আপনি আমার রুমে এসে অচেতন অবস্থায় আমাকে বিছানায় আটকে সেইদিন….”
“কিছুই করিনি তোমাকে ভয় লাগিয়েছি শুধু।”
কৌশিক সোজা সাপটা জবাবে কাশফি বিহ্বল হয়ে চোখ কুঁচকে নেয়।
“কেন?”
“তোমার জোভানের সাথে খোশ গল্প করা আমার পছন্দ ছিল না!”
“আজগুবি ব্যাপার! সে আমার বাগদত্তা ছিল।”
“এক্সাক্টলী, ছিল মানে অতীত।”
কাশফি মুখে বিতৃষ্ণা নিয়ে রুষ্ঠ কন্ঠে রাগ ঝেড়ে বলে,
“মানুষের সম্মান নিয়ে ভয় দেখাতে আপনি ভাবলেন না? ডিজগাস্টিং!”
কৌশিক কাশফির ছোট খাটো ধমক গায়ে না মেখে চোয়াল খানিকটা শক্ত করে বলে,
“এখন এসব বলে আমার মাথা গরম করোনা, ভালোয় ভালোয় উঠে পড়, ফাস্ট!”
কাশফি রাগে না কিছু করতে পারছে না সইতে। একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে একটু কাছে আসে, ভাবান্তর হয়ে কিছুক্ষন শূন্যে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভেবে লাজুক হেসে খুবই মিষ্টি করে বলে —
“শুনুন না!”
এরপর বাকিটুকু কোথায় কি যেনো হলো আর তৎক্ষণাৎ কৌশিক পায়ে সূক্ষ্ম একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল তবে নিজেকে দমিয়ে রাখার দরুন তার মুখে কোন বিশেষ পরিবর্তন ঘটল না।
তার অতি নিকটে কাশফি সরল মুখে হাঁসি টেনে দাড়িয়ে আছে যেন সে কিছুই জানে না। তার লম্বা লম্বা হিলস এর ধারালো দিকটা কৌশিকের পায়ের উপরেই রাখা। কাশফি সেইভাবে দাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দোষকুণ্ঠিত হওয়ার ভনিতা করে বলে—
“উপস, সরি!”
কৌশিক নিজের গম্ভির স্বর টেনে আওড়ালো — “ওয়াইল্ড ক্যাট”
কাশফি শুনেও না শুনার ভান ধরে গাড়ীতে বসে পড়ে। কৌশিক ঘুরে অন্য দরজা খুলে ড্রাইভার কে গাড়ি স্টার্ট করার ইশারা দেয়।
কৌশিক আলগোছে তার আনমনা ম্যাডামের এক হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। কাশফির বিশেষ হেলদোল নেই।
“আমাদের রোমান্সের শুরুতে প্রথম দেখায় আমি তোমার চক্ষুশূল ছিলাম, মনে পড়ে?”
কাশফি কিয়ৎক্ষণ স্মৃতিচারণ করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে — “রোম্যান্স?!”
তার টানা চোখ বড় করে মুখ শক্ত করে নেয়, চওড়া হয়ে ভারী গলায় বলে — “আমার জন্য সেটা ট্রমাটিক এক্সপেরিয়েন্স ছিল কৌশিক! প্লিজ, রোম্যান্স বলে অপমান করবেন না।”
“তোমার চোখের ঘৃণা আমার জন্য এপেটাইজার ছিল কাশফি। ভালোবাসা আর ঘৃণা একে অপরের বিপরীত সঙ্গা, কিন্তু এই দুই শব্দ জায়গা পরিবর্তন করতে আর কতক্ষন? আচ্ছা বলো তো তুমি কেন আমায় ঘৃণা করো?”
কাশফি বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আগের কথা তার টানতে ভালো লাগছে না।
“আপনি অবশ্যই মহামানব না কৌশিক। অনৈতিক তবে ক্ষমতাশীল, নির্মম, নিষ্ঠুর একজন ব্যাক্তি আপনি, চক্ষুসাক্ষী তো আমি নিজেই।”
কৌশিক মাথা নেড়ে একটা হাঁসি দেয়,
“এটা উওর নয়, উত্তর টা আমি বলছি”
কাশফি এবার আগ্রহ দেখিয়ে মাথা কৌশিকের দিকে ঘুরিয়ে আনে,
“আগে আমায় ঘৃনা করতে কারন আমি তোমার অনুভুতি পড়তে জানতাম, আর এখন ঘৃণা করার চেষ্টা করছো কারণ তোমার অতীত জানার মাধ্যমে আমি অপ্রকাশ্য থাকার কোড ভঙ্গ করেছি।”
কাশফি কৌশিকের দুই নিষ্প্রাণ চোঁখে তাকায়, লোকটার চোখ মাঝে মাঝে চেনা মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় তার চোঁখে অজস্র প্রহেলিকা ভাসে। কোন উত্তর না দিয়ে সে চোখ নামিয়ে বাইরের দিকে ফিরে।
“তুমি নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করো কাশফি। তাই নয় কি?!”
ঠিক তাই!
পাঁচ বছর লেগেছে তবুও কৌশিক নামের দুঃস্বপ্ন তার পিছু তো ছাড়লোই না বরং ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।
একটা মৃত্যু,
একটা ফিউনারেল,
অতঃপর তাদের দেখা…
#চলবে…
||| Note ||| — Don’t Skip
১) আমি পর্ব দুইয়ে কাশফির মা কলাবতীর কথা বলেছিলাম, যা পরে গুলিয়ে চারুলতা লিখে ফেলি কারণ চারুলতা আমার আরেক উপন্যাস এর ক্যারেকটার ছিল। তবে সব ঠিক কালকেই করেছিলাম এখন আল্টিমেটলি বলে রাখছি আতিকুর রহমান আর চারুলতা দম্পতির মেয়ের নাম ঈশিতা ইমরোজ কাশফি।
২) নেক্সট পর্ব তাদের পাঁচ বছর আগের অতীত মানে কাশফি আর কৌশিকের দেখা সাক্ষাৎ সহ আরো কয়েকটা গুরুত্ব পূর্ন পার্ট থাকবে। আমি আরিয়ানার জার্নালের পাতার লিখা তুলে ধরব সাথে অতীত, তবে গল্পে রোমান্স থাকবেই।
৩) গল্প ১৮+ দিয়েছি এইজন্য যেন ম্যাচুরিটি নিয়ে পড়া হয় কারণ এখানে ড্রা’গ, ট্রমা ছাড়াও আরো কিছুর উল্লেখ থাকবে যেটা একটু ক্রিটিক্যাল।
অবশেষে একটা কথাই বলব আপনাদের সাপোর্ট আর বিশ্বাস আমার ইনস্পায়রেশন💜
#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১১)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
১১.
২৫ অক্টোবর, ২০১৯
প্রায়শ পাঁচ বছর পূর্বে কৌশিকের সাথে কাশফির ট্রমাটিক প্রথম সাক্ষাৎ
“মির্জাদের অট্টালিকা হতে কিছুটা দূরে শ্যাওলা পুকুরে পাওয়া যায় ভাসমান পঁচা লাশ।
একসময় বাড়িটায় জমিদার থাকতেন পরবর্তীতে স্বপরিবারে বিলেত পড়ি জমান, একশত বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত বাড়িটায় মানুষের আনাগোনা ছিল না কিন্তু কিছুদিন হতে আগত দুর্গন্ধে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল আসেপাশের এলাকায় বসবাসরত মানুষজন এবং পথচারীরা। আজ ভোরে স্থানীয় একজন সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান পুকুরের পানিতে ভাসমান পঁচা লাশ। খবর দেওয়া হলে সকালে উদ্ধার কর্মী এসে শ্যাওলা পুকুর থেকে তিনটা ফুলে ফেঁপে ওঠা ভাসমান লাশ উদ্ধার করেন। ময়না তদন্ত করে জানা গিয়েছে শ্বাস রোধের ফলে মৃত্যু ঘটেছে এছাড়া শরীরে ক্ষত এবং একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ঘটনা মেয়র কায়েফ মির্জার কানে পৌঁছালে তিনি যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে আসামীদের দ্রুত চিহ্নিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন। আরো থাকছে বিস্তারিত…”
কাশফি বিরক্ত হয়ে চ্যানেল পাল্টে নেয়, গরম চায়ের মগে ধোয়া উড়িয়ে এক চুমুক দেয়। মির্জাদের এসব খবর আর নতুন কি? তাদের ক্ষমতা আছে তাই তারা এসব তিনবেলার খাবারের মতো নিয়মমাফিক করে। কাশফির রাগ হয় তবে ভয়ে কিছুই করতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই তার পুরো পরিবার গুম হয়ে বসবে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য জান প্রানের তোয়াক্কা করে না।
সাবেক মন্ত্রী কামরুল মির্জার সুপরিচিত ঐশ্বরিক অট্টালিকা এই বিজয়নগর শহরে, এই শহরের মেয়র কাইফ মির্জা তার নতিন, আর্কিটেক্ট ফিল্ড, হোটেল চেইন ছাড়া তার ক্ষমতাধর নাতিদের প্রভাব টাউন হল হতে দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।
কাশফি গুনগুন করে গান ধরে বারান্দায় পাতানো আসনে বসে বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে তুলে এক কামড় বসায়। পাশের বাসার টুটুল ব্যাগ কাধে অগোছালো জামায় গোমড়া মুখে বাসার দিকে হাটতে দেখে হাক ছুঁড়ে। নাদুস নুদুস টুটুল বিরক্তি মাখা মুখে পিছনে ফিরে তাঁকিয়ে চায়,
“কেউ বাইরে বের হলে পিছন থেকে ডাকতে নেই জানিস না ইশিবুবু ?!”
ভরকে গিয়ে কাশফি উত্তর দেয়,
“এমা এরকম কোন কথা আগে তো শুনিনি, এসব বিশ্বাস করলে পাপ হবে পাপ!”
“ওসব না শুনলে মা বকবে বুবু, তা কেনে ডেকেছিলে?”
“কায়েসটা নারকেল পুলি খাওয়ার বায়না করছে তাই বানিয়েছিলাম। কাকিমা কে বলে তুই আর ছোট্ট টুকি বুবুর কাছে আসিস। নারকেল পুলি আর ডালের বরা খেতে দিবো।”
“সত্যি?!” উচ্ছ্বাস ভেসে উঠলো তার গোলগাল মুখমণ্ডলে — “তোমার বান্ধবী তরী আপুও আসবে?”
“কেনো টুটুল সোনা, তুই কি তরীকে দেখতে আসবি?”
টুটুলের গাল লাল হয়ে যায় মুহূর্তে। ঘাড় চুলকে বলে,
“নাহ এমনি!”
কিছুক্ষণ পর টুটুল তার তিন বছরের বোন সাথে নিয়ে আসে। এসেই দেখে তরী, ফারাবী বসে বসে গল্প শুরু করেছে। টুকি দৌঁড়ে এসে কাশফির কোলে চড়ে বসে। তাদের হইহুল্লোড় হাঁসি মজার ফাঁকে তাদের বান্ধবীর একটা ফোন কল পরিবেশ শান্ত করে দেয়।
***
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শামসুলের নাতি, বেশ নামকরা অভিজাত ব্যবসায়ী ফেলিক্স স্টোন, বিদেশের মাটিতে জন্ম হলেও পড়ালেখা শেষ করেই দেশে ফিরে যুবক অবস্থায় যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতিতে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ছিলো তার, এরপর নিজের ব্যবসা দাড়া করান, তবে শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষটা হুট করেই গত হয়েছেন কাল রাত্রি, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন, ঘুমের মধ্যেই নাকি স্ট্রোক করেছিলেন। ফেলিক্স স্টোন ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, তার ছোট মেয়ে অ্যাবেইগাল হলো কাশফির বান্ধবী যার জন্যেই কাশফি এর তার বন্ধুবান্ধব হন্তদন্ত হয়ে স্টোন ভিলায় এসে পড়েছে। হাসী খুশী অ্যাবিইগালের মুখে আজ বিষাদ আর বেদনার কালো মেঘ, ছোট মেয়েগুলো সবসময় বাবার আহ্লাদী হয়, সেও ছিল। অ্যাবি ও তার বাবার কথায় উঠে বসে এমন , তার বাবা তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়। ক্রন্দনরত অ্যাবির পাশে দাঁড়িয়ে কাধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে কাশফি, কোন এক সময় সেও তার জীবনে পরপর দুইজনকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল কেউ অচিরেই তার শরীর থেকে আত্মা খা ব লে নিয়ে তার সত্তাকে পু ড়ে ফেলেছে। আট বছর বয়সী কাশফি তখন অনেক কিছুই বুঝতে শুরু করেছিল। পরিবারের ছায়া মাথা থেকে সরে যাওয়ায় একটা নতুন পৃথিবীর সাথে পরিচিত হয়েছিল, সেখানে কেউ কারো জন্য না।
ফিউনারেল বিকালের জন্য রাখা হয়েছে, অনেক দেশী বিদেশী আত্মীয় স্বজন আর রাজনীতিতে জড়িত লোকজন এসে ভিড়েছে ফেলিক্স স্টোনের আবাসস্থলে। খ্রিষ্টানদের রীতি অনুযায়ী প্রায় সবাই তৈরী হয়েছে কালো পোশাকে, কাশফি আর তার বাকি বান্ধবীরা ফিউনারেলে যাবেনা তাই তারা রুমেই অপেক্ষা করছে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার। ছটফটে, দুরন্ত ফারাবী ও আজ চুপচাপ, তরী প্যাঁচামুখ করে দেওয়ালে টাঙানো উদ্ভট রকমের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, হয়ত কোন সমীকরণ মিলাতে ব্যাস্ত, ঈশান ফোন স্ক্রোল করছে আর কিছুক্ষণ পরপর নাক টানছে। জ্বর নিয়ে বান্ধবীদের সাথে এসেছে, অচেনা অজানা জায়গায় তিনজন মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া রিস্কের ব্যাপার। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মাহিন আউট অফ টাউন হয়ে আছে।
কাশফি ঘষে ঘষে ঘর্মাক্ত হাত জোড়া প্যান্টে মুছে নেওয়ার পরও বার বার ভেজা ভেজা বোধ হচ্ছে। অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষজন দেখলেই অস্বস্থিবোধ হয় আর তখনই বার বার হাত মুখ ধোয়ার জন্য হাত পা নিশপিশ করে। গলা, জ্বিভ, ঠোঁট শুকিয়ে টানটান হয়ে আছে। আসেপাশে তাকিয়ে দেখলো অ্যাবিইগালের খাটের পাশে পানির খালি বোতল, কিচেন কোথায় সেটাতো জানা নেই। ঈশান চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোঁখ নাক মুখ লাল হয়ে আছে জ্বরের প্রকোপে। ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে কাশফি নিজেই বেরিয়ে পড়ল পানি নিতে। দুই মিনিট ঘোরাঘুরি করে কিচেনে ফিল্টারের দেখা মিলল।
আনমনে কাচের বোতলের ঢাকনা আটকাতে আটকাতে আসার সময় কিছু অদ্ভুত শব্দে তার পা জোড়া বড় ব্যালকনির সামনে স্থগিত হয়। এটা অ্যাবিইগালদের বাড়ীর পিছনের বড় গার্ডেনটা। কাশফি আরেকটু সামনে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতেই দেখতে পায় কয়েকজন পুরুষকে,
তাদের মধ্যে শুভ্র শার্ট পরিহিত একজন পুরুষ, এলোমেলো চুল আর ইন করা শার্ট বের করায় কিছুটা কুচকে আছে, বয়স আনুমানিক ২৫ কি ২৬, গলার টাই লুজ, মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিক চিক করছে। তার আসেপাশে সুট, ফরমাল এটায়ারে বলিষ্ঠ চার পাঁচ জন— দেহ রক্ষক ঘেরাও করে দাড়িয়ে। দেহরক্ষীরা আর শুভ্র শার্ট গায়ে জড়ানো বিশৃঙ্খল লোকটার শকুনের মতো চেয়ে আছে বেটে, গোলগাল কাচুমাচু হয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে, তাদের কথবার্তার হালকা হালকা আওয়াজ শোনাচ্ছে। কাশফি বাইরের দিকে কান পেতে দিলো।
“ তাহলে ১৯ তারিখ রাত পনে বারোটায় মতিঝিলে তাকে লাস্ট দেখা গিয়েছে? কিন্তু আমার জানা মতো সে তো অন্যত্র ছিল? চালাকি করছো সাইফুল?”
লোকটার শক্ত পুরুষালী কণ্ঠে কাশফির মেরুদন্ড বেয়ে একটা অজানা শিহরন বয়ে গেল। এই শিহরন বেশ পরিচিত —কোন এক অজানা শঙ্কার আগাম বার্তা যেন।
গোলগাল লোকটা সাইফুল, সে মাথা এদিক ওদিক নেড়ে হাত জোর করে বলে — “না না! আমি শুনেছি তাই বললাম মির্জা সাহেব। ভূল তথ্য জানালে ক্ষমা প্রার্থী।”
মির্জা সাহেব তথা শুভ্র শার্ট জড়ানো লোকটা তার চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট করে নেয়, উপর হতে মূখের ভাব ভঙ্গি নিরুদ্বেগ— দেখে বোঝার জো নেই যে মানুষটা মুখ দিয়ে ছু রি চা লা তে মাহির। এতটা শান্ত আর কম্পোজড থাকতে দেখে সাইফুলের ঘাম ছুটছে। মির্জা সাহেব দুই কদম এগিয়ে দাড়ায় তবে তীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় দৃষ্টি এখনো সাইফুলের উপর সীমাবদ্ধ।
ঠোঁটের এক কোনে ক্রুর হাসির রেখা টেনে হাস্কি কণ্ঠে বলে উঠে,
“রোয়ান বেশ চওড়া দামে তাহলে তোমার বিশ্বস্ততা কিনে নিয়েছে। এক্সাকটলি কত? ত্রিশ নাকি পঁয়তাল্লিশ? আমার জানা মতে এইদুটো তার লাকি নাম্বার। ”
“না— ”
মধ্যবয়স্ক লোকটা কথা সম্পূর্ন করার পূর্বেই মির্জা সাহেব এক ভ্রু উচুঁ করে তাকে চুপ করিয়ে দেয়।
“আমার সাথে প্রতারণা করে এখন অভিনয় করছ আবার মিথ্যে বলছো। তিনটা ভুল— চরম ভুল। তোমাকে দুটো পথ দিচ্ছি, স্বীকার করে নিজের নিয়তি কে বেছে নাও আর নাহয় প্রত্যাখ্যান করতে থাকো তোমার মৃ ত্যু কঠিন থেকে কঠিন হবে।”
কিছুক্ষণ কোন জবাব দেওয়া ছাড়াই সাইফুল নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথা তুলতেই দেখা গেল তার চোখে পানি টলটল করছে, নিজের আসন্ন ধ্বংসকে দেখতে পারে শরীর কাপিয়ে কেঁদে উঠে। আর নিজেকে ধরে না রাখতে পেরে বলে ফেলে—
“রোয়ান রাশিয়া ব্যাক করেছে, কাল রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সাথে ডিল ফাইনালাইজ করেছে আমি আর বেশি কিছু জানি না।”
লোকটার কথা শেষ হওয়ায় পর পর সব স্তব্দ হয়ে যায়। পিনপতন নিরবতা চারদিকে, কাশফি কোন শব্দ না পেয়ে তাকিয়ে দেখতেই হকচকিয়ে মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে যায়। মির্জা সাহেবের সাদা শার্টে স্পষ্টত র ক্তে র দাগ আর ছোট-বড় ছিটেফোঁটা লেগে আছে, হাতের রিভলভারটা তাক করা ঠিক সামনে যেখানে কিছুক্ষণ আগে সাইফুল দাড়িয়ে ছিল। কচুমাচু হয়ে থাকা সাইফুলের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইল, চোখ জোড়া উল্টে গিয়েছে, বুকের বা পাশ চুইয়ে চুইয়ে লাল রঞ্জক তরল পড়ছে মাটিতে।
এহেন দৃশ্য দেখে কাশফি যেন প্রতিক্রিয়া করতে ভূলে গিয়েছে, চোঁখের পলকে কিভাবে কি হয়ে গেল? এত সুক্ষ প্রদক্ষেপে কি করে প্রাণ কেড়ে নিল? কিছুক্ষণ যেন সে মূর্তি বনে গেল পরক্ষণে তার শরীরে অসহনীয় কম্পন অনুভব হয়। হঠাৎ করে আবার সেই পুরুষালী হন্টেড কন্ঠটা শোনা যায় —
“ কৌশিক মির্জা কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না।”
কাশফি মির্জা সাহেব— কৌশিক মির্জার চোখে চোখ রাখতেই তার বুক মুচড়ে উঠলো, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কৌশিক মির্জার প্রাণহীন ছাই রঙ্গা চোখ জোড়া তাকে পরখ করে চলেছে — তাহলে কথাটা কি তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে?
এত নির্জীব কেন তার চাহনি? কাশফি কেপে উঠলো যেন।
ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া কাশফির হতবিহ্বল মুখের দিকে তাঁকিয়ে তার চোখ মুখে আকষ্মিক উত্তেজনার ঝলক দেখা গেলো। পরপর খুবই সন্তপর্নে তার ঠোঁটের ভাঁজ গাঢ় হয়ে ঠোঁটে সূক্ষ্ম কিনারা বেঁকে উপরে উঠে যায়।
উপলব্ধি করতে পেরে কাশফির গায়ে কাঁ টা দিয়ে উঠলো।
শিট শিট শিট!!!
মির্জা পরিবারের সবচেয়ে উগ্র, নির্মম, কুখ্যাত একজনের দৃষ্টিতে আসা মানে স্বয়ং মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ
তিনিই কি কৌশিক মির্জা?
তিনিই কি তথা কথিত জ্বলজ্যান্ত আতঙ্ক?!
“Well, you are truly doomed.”
#চলবে….