অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
266

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৭)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১৭.

(অতীত) ২০২০ সাল,

ছেলেটা নিপুণ হাতে পিয়ানো কিবোর্ডে সফট নোট তুলছে, তার নোটের তালে টুটু পরিহিতা এক সদ্য কিশোরী ব্যালেরিনা নাচছে, সে এখন একজন White Swan হয়ে Dying Swan নৃত্য পরিবেশন করছে। মেয়েলী কন্ঠের নিচু টোনের গুনগুনের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্টুডিওর এক দেওয়াল হতে আরেক দেওয়ালে। প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি এমন যেন সে তার আত্মা কে ছেড়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে ভাসাতে চায়, ব্যালেট জুতা পরা পা খাড়া রেখেই উপরে তুলে নিয়ে তার নাচ এক মুহূর্তের জন্য থামে।
রূমে থাকা ছেলের অন্ধকার অবয়ব ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে, তার অন্ধকার মুর্তি দৃঢ়, মেরুদন্ড কঠোর নিয়মে সোজা। পরপর তার লম্বা লম্বা আঙুল পিয়ানো কিবোর্ডে রেখেই এবার নোট দ্রুত থেকে দ্রুততর করতে থাকে আর ধীরে ধীরে কিশোরী ব্যালেরিনার নাচের গতি বাড়ছে, তার ক্লাসিক্যাল টুটু ড্রেসের হাঁটুর উপরের ফ্যাব্রিক হাওয়ার বিপরীত সংঘর্ষে উড়ছে। পিয়ানোর নোটস উপরে তোলার সাথে কিশোরীর শ্বাস প্রশ্বাস যেনো সুর ভাজছে।
একপর্যায়ে এসে ছেলেটার হাত আর মেয়েটার নাচ একসাথে থেমে যায়।

কিশোরী পা থেমে গেলো দাড় করানো স্ট্রেইট লাইনে, আবির্ভাব ঘটেছে ব্যালটের জুতোর উপরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ঠিক দশ সেকেন্ড পর কিশোরী বসে পড়ে। তার ব্যালেট জুতো খুলতেই জুতোর কারণে পায়ের কাঁটা দাগটা দেখে নেয়। চোঁখে টলমলে পানি নিয়ে দাগটায় আঙুল বুলিয়ে দেয়।

“এইটুকু জ খ ম ব্যালেরিনা হয়ে সহ্য করা স্বাভাবিক ব্যাপার, নীলাম্বরী।”

কিশোরী হেলদোলহীন। ইদানিং ছেলেটার নরম স্বরে কঠিন বাক্য প্রায় বলে তবে কিশোরী তোয়াক্কা করেনা। সে আজও ছেলেটার দিকে চোখ তুলে চায় না, হাতের উল্টো পিঠে চোঁখের কর্ণিশ ছোঁয়া পানি মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে এখন আর আট বছরের বাচ্চা না যে ব্যালটের জুতো খুলেই মুখ ফুলিয়ে কান্না জুড়িয়ে দেবে।

“তোমার মতো পাথরের গায়ে কংকর কিছুইনা হিমাদ্রী। আমি মানুষ, না চাইতেই মাঝে মাঝে ভেঙে পড়ি তবে আবার ঠিক ভাঙ্গা টুকরো উঠিয়ে নিয়ে মাথা তুলে চলি।”

তৎক্ষণাৎ একটা হাঁসির শব্দ হলো, যেন কিশোরী কোন মজার জোঁক বলেছে। ছেলেটা তার গা কাঁপিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে।

“তুমি কখনইবা মাথা তুলে বেঁচে ছিলে নীলাম্বরী?”

কিশোরী নীলাম্বরী মাথা তুলে চায় তবে প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে চোখ অন্যপাশে ফিরিয়ে নেয়, এক দৃষ্টিতে গ্লাস দেয়ালের বাইরে রাতের আকাশে মনোযোগ দেয়। অগণিত তাঁরা সেথায়, তবে কি তারার মাঝে তার সুখ নিহিত? ঠিক কতটুকু সাধনার পর পরিবার পরিজন ফিরে পাবে? তার জুবায়ের ভাইকে ও কি ফিরে পাবে?
আজকাল জুবায়ের তার স্বপ্নেও ধরা দেয় না, শুধু পালিয়ে বেড়ায়। তার প্রাইভেট স্কুল পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী একটা স্বপ্নের ন্যায়, কিন্তু স্বপ্নে থেকেও যেন নীলাম্বরীর সুখ নেই, নীলাম্বরীর বিষাদে ভরা জীবনে এক টুকরো শান্তি এই ব্যালেট নাচ।

দাড়িয়ে ধ্যানমগ্ন থাকা কিশোরীর পায়ে আলতো স্পর্শে ধ্যান ভগ্ন হয়। মাথা নিচু করে দেখে নেয় হিমাদ্রী কে, হ্যাংলা পাতলা গড়নের ছেলেটা ঝুঁকে তার পায়ের ক্ষতে মলম ডলছে, চোঁখে মুখে একনিষ্ঠতা। তার মলম লাগানো শেষে সে তার শুকনো মুখ উপরে তুলে নীলাম্বরীর চোঁখে চোঁখ রেখে তাকায়—

“বিশ্রাম নিলেই ব্যাথা সেরে যাবে কাশফি।”

কাশফি হালকা হাসে। ছেলেটা পুষ্পকুঞ্জ একাডেমীর হয়ত, মাঝের মধ্যেই একাডেমীর হোস্টেল থেকে কিছুটা দূরের এই নির্জন জায়গার ছোট্ট স্টুডিওতে সে আসে। তাদের মধ্যকার সম্পর্কটাও তাদের মতোই নামহীন। কোন এক তাঁরা ভরা রাতে হিমাদ্রীর ভায়োলিনের সুরে নীলাম্বরী মোহিত হয়েছিল, তারপর থেকেই মাঝে মাঝে তাদের দেখা হয়।

হিমাদ্রী উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়,
“আমি উঠছি, তোমারও যাওয়া উচিত।”

হিমাদ্রী উত্তরের অপেক্ষায় থাকে না, নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়তে উদ্যত হয়। যদিও ছোট্ট স্টুডিওটার চাবি দুইজনের কাছেই আছে তবে ভয়ের কারণে নীলাম্বরী দাড়ায় না সুরসুর করে হিমাদ্রীর পিছন পিছন বেরিয়ে পড়ে। এরপর অন্ধকার রজনীতে দুই কিশোর কিশোরীর ছায়া মিলিয়ে পড়ে,

অতীতের অতল গভীরে…

এলার্মের তীক্ষ্ণ শব্দে কাশফি চোঁখ জোড়া কুচকে খুলে নেয়, ঘুমুঘুমু চোঁখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখে। সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে সে এবার এলার্ম অফ করে শোয়া থেকে উঠে পড়ে। ব্যালেট আর পিয়ানোর এই স্বপ্নটা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা। বছর খানেক আগে সে প্রথমবার শুধু সে একটা ব্যালেটের নৃত্য দেখেছিল আজ দ্বিতীয়বার দেখছে। তার মাথাটা ঝিম ধরে আছে, সর্বমোট মিলিয়ে চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে কিনা সন্দেহ। তার উপর আজ থেকেই তার টেস্ট পরীক্ষা শুরু কিনা। কাশফি ঝটপট অজু করে সালাত আদায় করে নেয় তারপর মাথা ব্যাথা উপেক্ষা করে রিভাইস দিতে বসে।

কলেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা পনেরো, পরীক্ষার হলে প্রবেশ মাত্রই অন্তুর সাথে দেখা হয় তবে অন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয় যেনো সে চিনেই না। কাশফিও প্রতিদিনের মতো কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অন্তুর এমন আচরণ প্রায় বছর খানেক আগ থেকেই দেখে আসছে।
একদিন হুট করেই অন্তু কাশফির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তারপর থেকে তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। কাশফি কনফিউজড ছিল ঠিক তবে অবশ্যই খারাপ লাগেনি দুইদিনের সঙ্গীর জন্য।

অন্তর মতো তার জীবনে ক্ষণিকের জন্য আসা আরেজন মানুষের প্রস্থান ঘটেছে। সেই রজনীর পর হতে কেটে গেছে বহু মাস। তবে কৌশিক মির্জা যেন ধুলোয় মিশে গিয়েছে, না কোন ফোন কল না টেক্সট মেসেজ পেয়েছিল কাশফি। কাশফি নিজেও মেনে নিয়েছে তবে এইসব মেনে নিতে পারেনি কাশফির sub conscious mind, তার হুট করে দেখা দুঃস্বপ্ন জুড়ে ছিল কৌশিকের বিচরণ, কৌশিকের ঠাণ্ডা মাথায় করা খু ন। বাধ্য হয়ে স্লিপিং পিল নিতে হয়েছে অনেকবার।

কাশফি সিটে বসে পড়ে, তার সামনে তরী আর পিছনে ফারাবী আর ঈশান। গরমে ফারাবী ফকফকে সাদা মুখ লাল টমেটোর মতো হাল হয়েছে। কাশফি তরীর সাথে বসে আবার বইয়ে চোখ বুলিয়ে নেয়।

***

২০২১ সাল,

“নাঈমা তুমি হিরণের আরেকটু কাছে গিয়ে কাঁধের হাতটা আলগা করো— ”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক এইভাবে… ডোন্ট মুভ!!!”

“ওয়ান, টু, থ্রী এন্ড…” — ক্যামেরার ‘স্ন্যাপ’ শব্দ — “পারফেক্ট শট”

“আমেজিং নাঈমা ওয়ানস মোর!”

“পোস্টার ঠিক রেখে গলা উচুঁ করো, ইয়াপ… হিরণ, তুমি নাঈমার হাত ধরে চোখে চোখ রাখো লাইক লাভিডাভি লুক।”

“পারফেক্ট!”

ফটোগ্রাফার মডেল দুজনকে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার ভঙ্গিমা দেখিয়ে দিচ্ছে। মডেল হিরণ কাজে মনোনিবেশ করলেও নাঈমা বারবার আড়চোখে পায়ের উপর পা তুলে রাখা জোভান কে দেখছে আর বাঁকা হাসছে।

সামার কালেকশান নিয়ে কয়েকটা ফ্যাশন লাইন অ্যান্ড টেক্সটাইল কোম্পানির কোল্যাবোরেট চলছে। জোভান ছাতার ছায়ায় বসে থাকতে থাকতে মহা বিরক্ত তার উপর বসে বসে নাঈমার ঢং দেখার আদো কোন মানে আছে?
নাঈমা তার এক্স গার্লফ্রেন্ড, তার প্রতি কোন অনুভুতি কাজ করে না ঠিক তবে নাঈমার বর্তমান উদ্দেশ্য তাকে জেলাস ফিল করানো যা চরম বিরক্তিকর ঠেকছে এমনিতেই গায়ে পড়া লোক তার পছন্দ না।
জোভান তার বাবার প্রতি একপ্রকার বিরক্ত হয়ে দুই মাসের এই সম্পর্কে জড়ায়। তাছাড়া নাঈমা যথেষ্ঠ সুন্দরী আর নিজের পাশে সুন্দরী নারী কে না দেখতে চায়? তার বাবার ইচ্ছে ছিল তিনি তার ভাইয়ের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবেন কিন্তু বাঁধ সাধে জোভান, কাজিন ম্যারিজে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এরপর থেকেই বাবা ছেলের মাঝে দ্বিধা দ্বন্দ।

জোভান চেয়ার থেকে উঠে তার পোলো শার্ট ঠিক করে নেয়, ফের কোন দিকে দৃষ্টি না ফেলে গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। ম্যানেজার অবশ্যই তাকে থামানোর জন্য আসছিল তবে তার চোখ পাকানো দেখে আর সাহস হলো না।
রেগে গিয়ে চড়ে বসে বন্ধুর জিপে, তার বন্ধু সিনান বইয়ে মুখ গুঁজে ছিল এতক্ষন, জোভানকে আসতে দেখে বই মুখ থেকে নামিয়ে একটা গা জ্বালানো হাসি দেয়।

“বছর খানেক পর আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে দেখা হয়েছে, স্যার। অনুভূতিটা কেমন যদি একটু জানাতেন?”

সিনানের টিটকারী শুনে জোভান চোঁখ উল্টিয়ে বেশ গমগমে সুরে বলে,
“একদম ফা’ইজ’লা’মি করবিনা শা’লা!”

“বন্ধু তুমি রাগো ক্যা, আমাগো নাঈমা ভাবী শুধু তোমার।”

সিনান বলে শেষ করেই পিছনে তাকিয়ে একটা লোকদেখানো রকমের মিষ্টি হাসি দেয়,

“আরেহ নাঈমা!”
জোভান পিছনে তাঁকিয়ে দেখে আসলেই নাঈমা দাড়িয়ে আছে, এবার দাত কড়মড় করে সিনানের দিকে ফিরে। সিনানের এক্সপ্রেশন এমন যে সে মাত্রই আকাশ থেকে টপকালো যেন। রাগে শক্ত হাতে সিনানের পিঠে চাপড় মেরে গাড়ী স্টার্ট করার নির্দেশ দেয়। সিনান মহা বিরক্ত, তার গাড়ীতে উঠে তাকে শাসানো! এটা কেমন বিষয়? তাই সিনান মুখ কালো করে ড্রাইভিং সিটে থেকে লাফিয়ে পিছনে চলে গেলো।

“বন্ধু তুমি প্রকৃতির মাঝে গিয়ে বিরহের গান ধরো, আমি সিঙ্গেল ভেজালমুক্ত মানুষ।”

জোভান মাথা ঘুরিয়ে দুই সিটে আয়েশী ভঙ্গিমায় হাত পা ছিটিয়ে বসে থাকা সিনানকে দেখে নেয়, যে এখন বই বুকে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন সুরে গান ধরেছে। জোভান কথা বাড়ালো না, জিপ স্টার্ট করতেই ধোয়া উড়ে চলতে শুরু করলো।

বোর্ড পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে, ফারাবীর মন পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করতে পারার বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত। প্রতিবার শাড়ি পরে তার কাজিন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে কিন্তু এইবার বোর্ড পরীক্ষার জন্য কিছুই হলো না। তাই ফারাবী নিজের মনের পাথর সমান বেদনা কমাতে আজ শাড়ি পড়ে বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যাবে। তরীর এসব পছন্দ না হওয়ার সত্বেও ফারাবীর জন্য না পরে উপায়ন্তর পেলো না। তরী ভোঁতা মূখে ফারাবীর সাথে দাড়িয়ে আছে, আর ফারাবী তাদের বাড়ীর গেইটের সামনে দাড়িয়ে কাশফির জন্য হাক ছাড়ছে,

“পেয়েছিস জান?”

ফিরোজ রঙ্গা শাড়িতে কাশফিকে দেখা গেলো দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে আসতে, তার চোখে মুখে অবিশ্বাস্য লেপ্টে। হাতের কাঁচের চুড়ি ঝন ঝন করে শব্দ তুলছে, ঘন চুলের খোঁপায় বাঁধা বেলি ফুল আর হাতে একটা শুভ্র পদ্ম হাতে।

“তুই এই পদ্ম ফুল আনার জন্য আমাকে ভিতরে পাঠিয়েছিস? Unbelievable!”

তরী হালকা হেসে কাশফি কে বলল,
“আমি প্রথমেই বলেছিলাম এই আ বা লের কথা ধরে ভিতরে যাস না।”

“এই পদ্ম ফুল কথায় হয় জানিস? খালে বিলের ময়লা অবজনায়।”
ঈশানের গম্ভির মুখে কথা শুনে ফারাবীর চোঁখ মুখ শুকিয়ে গেলো। সে তৎক্ষণাৎ ফুল তরীর হাতে ধরিয়ে দিলো। ফারাবীর কর্মকান্ডে কাশফি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

ঠিক তখনই ফারাবীর বাড়ির সামনে রাস্তা হয়ে জোভান আর তার বন্ধুর চড়া জিপ থামে, সামনে নাকি খুব সুন্দর একটা হ্রদ আছে তবে পথ তাদের দুজনের কেউই চিনে না।

হ্রদের নাম মহুয়াবনী, এই নাম নাকি দুইবোনের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিল। মহুয়া আর অবনীর মা তাদের বাবার পরকীয়া ধরতে পারার পর সেই হ্রদের জলে ডুবে আত্ম হ ত্যা করে, তারপর অতি শীগ্রই তাদের বাবা পরকীয়ায় লিপ্ত সেই নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে সৎ মায়ের অত্যাচার নিতে না পেরে দুইবোন তীব্র ঘৃণায় আর মায়ের মৃত্যুর জন্য শাস্তি স্বরূপ তাদের বাবার আর সৎ মাকে কু পি য়ে হ ত্যা করে নিজেরা সেই হ্রদে ঝাঁপ দিয়ে আ ত্ম হ ত্যা করে। এসব কতটুকু সত্য তা কেউ জানে না।

জোভান বাড়ীর বাইরে ছেলে মেয়েদের দাড় করানো দেখে গাড়ি থামাতেই কাশফির খিলখিলিয়ে হেসে উঠার শব্দ কানে আসে। এক নজরে চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। মুখে রাজ্যের মায়া লেপ্টে রয়েছে যেন চোঁখ ফিরানোর দায়। জোভানকে থমকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সিনান বিরক্তির শব্দ উচ্চারণ করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে।

“এক্সকিউজ মী!”
ঈশান তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকায়, কাশফিরও হাঁসি বন্ধ হয়ে গেছে। তারা সবাই এখন সিনানের দিকেই চেয়ে আছে। জোভান জড়তা ঠেলে সিনানের পূর্বেই কাশফির উদ্দেশ্যে বলে,

“মহুয়াবনী লেকটা কোন দিকে কাইন্ডলী জানাবেন?”

কাশফির পরিবর্তে ঈশান চট করে উওর দিলো,
“সামনে কালী মন্দির দেখবেন সেটা পার হয়ে বামে মোড় নিয়েই মহুয়াবনী লেক পেয়ে যাবেন।”

“ধন্যবাদ।”
জোভান আগের ন্যায় কাশফির দিকে তাঁকিয়ে থেকেই ধন্যবাদ জানালো যা ফারাবীর কাছে হ্যাবলার মতো মনে হলো। এদিকে জোভান এক দেখাতেই কাত, ভাবছে ইনিয়ে বিনিয়ে নাম জিজ্ঞেস করবে তবে তার পূর্বেই কাশফি সৌজন্যতা মূলক হাঁসির রেখা টেনে হাঁটা ধরলো। ইশ মেয়েটার কন্ঠ পর্যন্ত শোনা হলো না।

জোভান ভালো করে এই পথ ঘাট চিনে রাখে তাহলে সে কি খুব শীঘ্রই আবার আসতে চলেছে? জোভান হেসে জিপে চড়ে বসলো, তারপর চওড়া গলায় গান ধরে গাড়ি চালানো শুরু করে। তার ভাবমূর্তি দেখে বিহবল হয়ে যায় সিনান।

“মামা, তোর কি জর জর লাগছে?”
জোভান প্রত্যুত্তরে কেবল একটা মিষ্টি হাঁসি দেয়।

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৮)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১৮.
গ্রামীণ চওড়া মেঠো পথের একপাশের খড়কুটোর বাড়ি ঘর, টিনের চালা অন্যপাশের হরিৎ উপত্যকার বুকে হলদে সরিষা ফুলের বিচরণ, মৃদু বাতাসের ঝাপটায় দুলছে চোখ জুড়ানো হরিদ্রা পুষ্প গুলো। রিকশা চালক মনের আনন্দে গুনগুন করে গান ধরে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আজ হুড ফেলে আতিকুর রহমান ও দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যাস্ত, মাথায় পাতলা তুলোর ন্যায় চুল বাতাসে উড়ছে, তবে মাস্টারের বুঝি কোন তাড়া নেই আজ?
এটা শহরের থেকে কিছুটা দূরের সহজ সরল জীবন যাপন।

“এই বছর ম্যালা সৈষ্যা চাষ হয়েছে, পকেট ফাকা না থাকিলে আমি দেশের বাড়ির লিগা কিছু লইতাম।”
রিকশা চালকের হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠের বিপরীতে তিনি ও সরিষার তেল কিনার পরিকল্পনা করে রাখেন।

সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে রিকশা প্রবেশ করলো বামের বাঁকে। শীতের শেষ সময়, তবে সন্ধ্যার পরপর তিমির ঘনিয়ে আসলে শীতে প্রকোপ কিছুটা বেড়ে যায়। অসমতল মেঠো পথের দুইধারে সারি সারি গাছ গাছালি, হাতে গোনা কয়েকটা গাছের ডালের পাতা ঝরেছে কেবল। ঝাঁকি দিয়ে চলতে চলতে খানিকটা দূরে রিক্সার গতি কমে যায়, সম্পূর্ন থামে গ্রিলের তৈরি গেইটের সামনে। তাকালেই চোঁখে আসে দূরদূরান্তের দীঘি, বেডি বাঁধ খুলে দেওয়ায় জোয়ারের পানিতে পূর্ণ হয়েছে এসব দীঘি। এসব দীঘির বেশির ভাগই মালিকানা চিটাগং এর বাসিন্দা, জাল ফেললে হরেক রকম মাছের মেলা বসে। দীঘির জলে উপরে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে উড়ে চলছে পক্ষীর তিন চারটা ঝাঁক।
আতিকুর রহমান নেমে ভাড়া পরিশোধ করলেন, গেইট একটু ঠেলে ঢুকে পড়লেন সেথায়, কয়েকটা কয়েকটা আইলের উপর হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন তার দীঘির কাছটায়। নিজের একার দীঘি নয় তবে ভাগ বণ্টনে মেলা মাছ পেয়ে থাকেন। এখনকার বেশিরভাগ মানুষের কোটিকোটি টাকার মাছের ব্যাবসা। আইলের মাঝে মাঝে আবার খেজুরে খেজুরের গাছ লাগানো, গাছ হতে রস সংগ্রহের লক্ষ্যে কলসি আর বোতল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আজকের রোদ গায়ে লাগছে রাতে শীত পড়লে রস ভালো হবে। আতিকুর রহমান দীঘি পরিচর্যার শেষে বেরিয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ।

পীত বর্ণের এক্সকাভেটর মেশিনে চড়ে দীঘি কাটছে কিছু লোক, তত্ত্বাবধানে আছেন মেয়রের ম্যানেজার যিনি পান চিবুতে চিবুতে কিছু রঙ শার্টেও লাগিয়ে ফেলেছেন বটে। পাশেই মেয়রের আমের বাগান, গাছে মুকুল এসেছে, বারোমাসি আম কিনা। হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছু দূরে দেখতে পেলেন মাঠ জুড়ে মহিষ, এই জেলা মূলত মহিষ, খেজুর গাছ আর মাছের জন্য পরিচিত। টিচিং প্রফেশনে জয়নিং হওয়ার দুইদিন পর ওয়ানে পড়ুয়া এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন জাতীয় পশু কি? সে চর এলাকার বাসিন্দা, তার উত্তরে বলেছিল বাংলাদেশের জাতীয় পশু মহিষ।

আতিকুর রহমান পনেরো একরের দীঘির আশপাশ হাঁটতে উদ্যত হলো, এই দীঘি নাকি তার দাদা কাটিয়ে ছিলেন তিন চার বছর পরে বিক্রিও করে ফেলেন। দীঘি পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা কাছেই জেলে পাড়া। একপ্রকার মেঘনা নদীর শাখা বলা যায়, আসরের পরপরই জোয়ার আসায় জেলেরা নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে। জেলেরা একবার মাছ ধরে এনে বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে গেছেন, এরাই মূলত বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবেন। ব্যাস্ত জেলেরা আবার করে জাল নিয়ে নৌকায় উঠেছে, দ্বিতীয় দফায় জাল ফেলার উদ্দ্যেশে। তাজা নদীর মাছ দেখে রিকশা চালক আর আতিকুর রহমান কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দর দাম করে কিনে ফেললেন, এই মাছ আর কোথায় পাবেন? অবশ্যই জেলেদের থেকে সরাসরি কেনা গেলে ভালোই হতো, কম দামে পেয়ে যেতেন।

***

“এভাবে আমার বাড়ীর আসেপাশে দাড়িয়ে থাকা চরম ছ্যাচড়ামী ঠেকছে আমার নিকট।”

কাশফি ঝাঁঝালো কণ্ঠে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখলেও তার এক বালতি কাপড় থেকে বের করে আনা টকটকে লাল ওড়না খানা হতে আসা পানির ঝাটকায় সে পলক ফেলতে নেয়। পাশাপাশি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জোভান, ভাগ্যক্রমে আজ কাসফির দেখা মিলল। সে পরক্ষণে চোঁখ খুলে কাশফির দিকে চেয়ে প্রাণবন্ত হাসি হেসে বলল,
“আমি দুঃখিত!”

কাশফির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং অনমনীয় অঙ্গভঙ্গি অনড় রেখে পূর্বের স্বরে চয়ন করলো,
“আপনি দুঃখিত নন, আমাকে এভাবে দেখা বন্ধ করে দিন, আমার অস্বস্থিবোধ হয়।”

জোভান হেলদোলহীন, তার মতো যুবক একটা মেয়ের পিছনে লেগে থাকার মানে কি সে বুঝে না? নাকি বুঝতে চায় না।

“আমি তোমাকে পছন্দ করি ঈশিতা।”

“সেটা আপনার আর বাবার ব্যাপার।”

জোভান প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগে আবার মনে মনে কাশফির কথা পুনরাবৃত্তি করে, ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে নেয়,

“আপনি কি সম্মতি দিচ্ছেন ঈশিতা?”

“কিসের?”

“আমাকে পছন্দ করেন?”

“সেটা কবে বললাম?”
কাশফির কণ্ঠে বিরক্ত আর নাকের ডগায় রাগের লাল আভা।

“তাহলে আপনার বাবাকে জানানোর বিষয়…?”

কাশফি মহা বিরক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লাস্টিকের টকটকে লাল বালতিটা হাতে তুলে নেয়। যে বুঝতেই চায় না তাকে কি করে বুঝানো যায়? তাই দুই বছর ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা জোভান কে খানিকটা শাসিয়ে বলল,

“আমার মাইন্ড সেটআপ ওল্ড ফ্যাশন টাইপ, আমি বিয়েতে বিশ্বাসী, প্রেম আমার দ্বারা হবে না। আমার বাবাও এসব সমর্থন করেন না, আর আমি এখনকার স্থানীয়, আপনার এখানে দাড়িয়ে থাকা নিয়ে মানুষ আমার ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করতে পিছপা হবে না।”

ততক্ষণে আতিকুর রহমানের চড়ে বসা রিকশা এসে থামলো তাদের প্রাঙ্গণে, কাশফির হাক পড়তেই কাশফি নজর সরিয়ে নিয়ে ছুট লাগায়। জোভানের জন্য জমিয়ে রাখা রাগ রিক্সায় থাকা মাছ দেখে মাথায় যেনো আগুন দপ করে জ্বলে উঠলো। পুরুষ মানুষ কেনো বুঝতেই চায় না যে অসময়ে আনা মাছ কাটলে শরীর নোংরা হয়। বাবার প্রতি রাগ জমিয়ে হনহনিয়ে ভিতরে চলে গেলো সে, এই মাছ কুটা বাছা করলে সারা গায়ে গন্ধ বাঁধবে।
আতিকুর রহমান নজর বাঁচিয়ে চললেন আর না মেয়েকে টু শব্দ করে কিছু বললেন।

***

শিকদার পরিবারের বড় ছেলে সফিক শিকদার আর ছোট ছেলে সুমন শিকদার তবে তারা সব ভাইবোন আলাদা আলাদাই থাকে। বোনদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক বছর। সুমন শিকদারের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে তার আদরের ভাগ্নির সাথে বিয়ে দিয়ে বোনদের পরিবারের সাথে সম্পর্কটা গুছিয়ে নিবেন। কিন্তু তা আর হলো কই? তার ছেলেটা ঘাড়ত্যাড়া, বোনকে বিয়ে করার কথা শুনেই না করে দিয়েছে। সুমন সাহেব বুঝানোর চেষ্টা করায় অন্য সম্পর্কে পর্যন্ত জড়িয়েছে তার ছেলে, তাও শোবিজের এমন এক মেয়ের সাথে যে ভীষণ রকমের বেহায়া।
পরবর্তীতে তিনি আর জোরাজোরি করেন নি বরং এড়িয়ে চলেছেন, কেননা ছেলের প্রতি সুপ্ত নারাজ ছিলেন। কিঞ্চিৎ প্রয়োজন ছাড়া তাদের ঠিকঠাক হয়ে কথাবার্তা কবে হয়েছিল আল্লাহ মালুম!

বাগিচায় হাঁটতে হাঁটতে ডালিম গাছ পেরিয়ে দেখা মিললো তার পছন্দের লেবু গাছটার। তবে লেবু গুলো পূর্বের চাইতে ছোট হতে দেখে খানিকটা বিচলিত হন সুমন সাহেব। কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষন। ইস, কিসের ঘাটতি হলো! এটা সুমন সাহেবের অতি শখের বাগান। আর শখের তো দাম গুনতে নেই। চওড়া গলায় মধ্যবয়স্ক মালি কে ডেকে তিনি এটা সেটা করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে আগমন ঘটে তার সেই অবাধ্য ছেলেটার। টি শার্ট আর টি-শার্টে ফকফকা সাদা চামড়ার যুবকটা দৌড়ানোর দরুন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে থামে তার বাবার সম্মুখে। অতঃপর ব্যাগ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

“বাবা, আমি বিয়ে করতে চাই।”

ছেলের কথা শোনা মাত্রই বুকে জড়ানোর ইচ্ছা সম্পূর্ণ মাটি চাপা দিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তৎক্ষণাৎ, এই তারছেরা ছেলেটার মাথায় নতুন ভুত কি করে চাপলো? নাঈমা মেয়েটা তো ওয়াইফ ম্যাটেরিয়ালই না তাকে বাড়ির বড় বউ করার মতো দুঃস্বপ্ন তিনি কখনোই দেখেন নি। তবে আদো কিছু করার আছে? তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তিনি গাছ পর্যবেক্ষণ করায় মনোযোগ দেন।

“যা করার করো, প্রেম করার আগে তো আমাকে জিজ্ঞেস করোনি।”
তার বাবার ত্যাড়া কথায় সে থতমত খেয়ে যায়,

“প্রেম?”
গম্ভীর সুমন সাহেব প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেন না।
এদিকে কনফিউজড জোভান চিন্তাভাবনার পরিশেষে মুখে মিষ্টি হাঁসি টানে। কাশফির মতো বাধ্য মেয়ে তার বাবার পছন্দের শীর্ষে। আজ হয়ত তার বাবা তার উপর সন্তুষ্ট হবেন ভেবে সে মুখ ফিরিয়ে থাকা বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে শুধরে বাধা বিপত্তি ছাড়া বলে,

“আতিকুর রহমানের একমাত্র মেয়ে ঈশিতা ইমরোজ কাশফিকে বিয়ে করতে চাই বাবা। তোমার পছন্দ হলে তবেই বিয়ে করব।”

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৯)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১৯.

“জুন ভাইয়া!!!“
এক হাতে পুতুল জড়িয়ে ধরে সারা ঘর পায়চারি করছে ছোট পাঁচ বছরের মেয়েটা। নরম পায়ের প্রতি পদে ঝুন ঝুন নূপুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে দোল খাচ্ছে কানে। কিছুক্ষণ পর পর নাকে বিধছে আতর আর ধূপের ঘ্রাণ। পূর্ব বিচলিত মেয়েটা সেই নিয়ে ভাবান্তর ঘটালো না, আপাদত তার এখন জুন ভাইয়ার সাথেই গুরুত্বপূর্ন কথা আছে। গুটি গুটি পায়ে অন্ধকারে রুম খুঁজে নেয়। প্রতি দিনের মতো কর্নারের রুমটায় তার নানা ভাইয়ের গুনগুন শব্দে জিকির আর হাতে তাসবির শব্দ সে শুনতে পেলো না। বহিরাগত হয়ে সাই সাই করে আসা ঠান্ডা বাতাস পরিভ্রমণ করছে রুম জুড়ে।
জুন ভাইয়া বুঝি আজ নানার সাথে নামাজ শেষে মুনাজাত টুকুও করলো না? মেয়েটার একটু রাগ হলো, জুন ভাইয়া তো বললো সে প্রতিনিয়ত তার গর্দভের জন্য নামাজ শেষে মুনাজাত ধরে। তাহলে আজ?
মুখ ফুলিয়ে ছোট মেয়েটা খোলা জানালার কাছে এসে দাড়ালো তবে নানা ভাইয়ের রুমের জানালা কিছুটা উচুঁ হওয়ায় জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে পেলো না।

তাই জুতো জোড়া খুলে কোন রকম হাত পা আকড়ে খাটের উপরে উঠে সে, উঠেই চলে যায় জানালার সামনে। তার নানা প্রায়শই বিরশ মুখে বাইরে তাকিয়ে তার নানুর কবর দেখতেন। তবে ছোট মেয়েটা আজ ব্যতিক্রম কিছু দেখলো, তার নানুর কবরের পাশের জায়গাটা আর খালি নেই, পাশাপাশি খুড়া হয়েছে আরেকটি কবর। আধারে চারজন আবছা অবয়বকে দাঁড়িয়ে কবর খুঁড়তে দেখে মেয়েটা ভয় পেয়ে দূরে ছিটকে যায়।
তার নানা উদাস মনে বহুবার বলেছেন তার নানীর পাশের কবরটাই তার শেষ ঠিকানা, তবে কি?…
মেয়েটা এসব কিছু ভাবতে চায় না, দৌড়ে বের হয়ে খুঁজতে লাগলো তার মা কে।
মায়ের রুমে সজোরে ধা ক্কা দিয়ে দরজা খুলেই যেনো বে কু ব বনে গেলো। এটা তো আরেকটা বাড়ি,
ঠিক বাড়ি নয়।
তার বাসা!
সে স্তম্ভিত পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো তার বাসার মেইন ফটক। চকচকে ফ্লোরে তার প্রতিবিম্ব দেখে আরো ঘাবড়ে যায়। তার গায়ে ফ্রকের পরিবর্তে সেলোয়ার কামিজ কাঁধের একপাশে ওড়না মাটি ছুঁই ছুঁই হয়ে ঝুলছে। নিজের অবয়বে নাবালিকার পরিবর্তে একজন পরিপূর্ণ নারী দেখে খানিকটা থমকে গেলো।

হয়ত স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে?

কাশফি হেঁটে হেঁটে তাদের বসার রুমটায় পৌঁছেই পিলে চমকে উঠলো। সোফায় তার বাবা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। এক ছুটে বাবার হাত ধরে পালস চেক করে নেয়, বেশ দুর্বল রেট। মনে মনে ভয় আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।

“বাবা, তুমি চোঁখ খুলবে প্লিজ!”
কাঁদো কাঁদো স্বরের কথাটা কিছুটা বোধহয় আতিকুর রহমানের বোধগম্য হলো, তবে চোঁখ খুলার প্রচেষ্টায় তিনি ব্যাহত হলেন। কাশফি কোন রকম বাবার পকেট থেকে ফোন হাতড়ে বের করে এনে ডায়াল প্যাডে ৯৯৯ চাপতেই কল রিং হওয়ার আগেই কেটে গেলো।

লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলো নেটওয়ার্ক নেই। কাশফির ইচ্ছে করলো ভাগ্য কে গালমন্দ করতে!

“বাবা, আমার গায়ে ভর করে হাঁটতে পারবে তো?”

আতিকুর রহমান নিশ্চুপ। হতাশ হয়ে কাসফি বাবার হাত কাঁধে তোলার জন্য টানার পূর্বেই উপর থেকে ঠকঠক করে জুতোর শব্দ শুনতে পেলো। তৎক্ষণাৎ তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে তার পিছনেই কেউ দাঁড়িয়ে তাকে বাজপাখির মতো পরখ করতে ব্যাস্ত।
কাশফি সন্তপর্নে ওড়নার নিচে হাত ফেলে টি-টেবিল থেকে আলগোছে ফ্রুট কাটারটা হাতে গুঁজে নেয়, এবার মেরুদন্ড সোজা করে সাহস জুটিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। তবে ভুলে যাওয়া সেই চির পরিচিত Predator কে দেখা মাত্রই অপ্রস্তুত কাশফির নিশ্বাস আটকে আসে।

এলোমেলো ঘাড় ছুঁইছুঁই চুল, কয়লা রঙের জিন্স আর অফ হোয়াইট শার্ট পরনে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা, টাই লুজ হয়ে গলায় ঝুলছে বলা যায়। গম্ভীর মুখে মুখে কঠোরতা আর চোখে রাগের দীপ্তিমান অগ্নিশিখা নিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, দৃষ্টি যেনো এক কাশফিতেই বদ্ধ।

“দেখলেন কাশফি, আপনাকে আমি ভুলতে দিইনি।”

সেই পুরানো কর্কশ— হাস্কি, ডমিনেন্ট, পুরুষালি গম্ভীর গলা শুনে তার গায়ে যেনো প্রচণ্ড তেজে ইলেকট্রিক শক অনুভব করলো।
কাশফি সোফা ধরে নিজেকে ধাতস্থ করলো, একবার তার বাবা আরেকবার কৌশিক মির্জাকে দেখে নিলো। গলায় কথার দলা পাকিয়েছে কিন্তু ভয়ে তার শব্দ আর বেরুলো না।

“Did you miss me?”

“আমার বাবাকে…?”
বাকিটুকু কথা কাশফির গলায় আটকে রইলো। কৌশিকের মুখে তৎক্ষণাৎ সিগনেচার বাঁকা হাঁসির আবির্ভাব ঘটলো।

“তোমার বাবা বোধহয় তোমার মাকে মিস করছিলেন।”

কাশফি নির্বাক!
সে তর্কে জড়াতে চায় না, পশুকে মনুষত্য শেখানো আদো কি সম্ভব! পরাজিত হয়ে তাই গলা নিচু করে বিনয়ের স্বরে বললো —
“বাবার চিকিৎসার প্রয়োজন, প্লিজ।”

কৌশিক তার ক্যালকুলেটেড স্টেপ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিছুটা ব্যাঙ্গতক সুরে আফসোস করে,
“Little too late!”

কাশফি প্রতিবাদ করে কিছু বলার পূর্বেই দেখতে পেলো কৌশিক হল’স্টার হতে রি’ভ’লভা’র টেনে বের করে তার ভ্রুদ্বয়ের মাঝ বরাবর তাক করে ধরলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো যে কাশফির ঠিক হজম হলো না। একবার রিভলভার আরেকবার কৌশিকের চোঁখে চোঁখ রেখে পরখ করলো।

মৃত্যুর ভয় কার নেই? নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে সে লুকিয়ে রাখা ছু রি টা নিক্ষে প করতে নিলেই কৌশিক তার একহাত ধরে ফেলে অন্য হাত দিয়ে কৌশিকের মুখে নখের আঁচড় দিয়ে বাঁচতে চাইলে কৌশিক দুহাত তার মুঠোয় শক্তভাবে পুরে নেয়। কিছু বোঝার আগেই কাশফিকে কাচের গোল টেবিলে ছু ড়ে ফে লা হয় পরক্ষণে শক্ত পুরুষালি হাতের দম’রু’দ্ধকর মু’ষ্ঠি তার গলা চে পে ধরে। এবার সে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে ভয়ে চোঁখ মুখ শুকিয়ে যাওয়া কাশফির চোঁখে চোখ রেখে রিভলভার কপালে ঠেকিয়ে ধরলো,

“হ্যাপি ফ্যামিলি রিইউনিয়ন, সুইটহার্ট!“

দুঃস্বপ্নের পরিশেষে রাতের বিদঘুটে অন্ধকারে একপ্রকার দম বন্ধ হয়ে কাশফির ঘুম ভেঙে যায়, মুখ খানা ঘেমে নেয়ে একাকার। কৌশিক মির্জা নামক মানুষটা কেবলই তার দুঃস্বপ্ন এই বুঝ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলে আকস্মিক তার হাতে টান পড়লো। প্রথমে ভয় পেলেও পরে হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারলো যে তার হাত দুটো হার্ড বোর্ডের সাথে দড়ি দিয়ে বাধা। মুহূর্তেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলো।

তার রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ তাহলে কেউ কি করে ভিতরে এলো?!

কম্পিত হাতে কাশফি গিঁট খুলতে নেয়, খোলা মাত্রই ভয়ার্ত কাশফি শুন্য মাথায় দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকেই তার পায়জামা আর নিজেকে চেক করে নিলো। সব ঠিক ঠাক জানা সত্ত্বেও অজানা ভয় হানা দিতে থাকলো তার মাঝে। তবে কি…?!

চোঁখ বুঝে সে মনে ঢের সাহস জুটিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমের বাতি জ্বালিয়ে দিলো তবে আরেক দফায় আশ্চর্য হলো। তার খাটের নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে একটা নুপূর। এই নুপূর তো কাল সে তার দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখেছিল তবে ধারণা করেছে এটা জোভান নামের উদ্ভট লোকটার দেওয়া।
খাটের দিকে পরখ করতেই তার ভয় এবার জেঁকে বসলো। নিশ্বাসের উঠানামা অগ্রাহ্য করে সে বড়বড় চোঁখে খাটের হার্ডবোর্ডে লাগানো স্টিকি নোটের হ্যান্ড রাইটিং পড়ে নেওয়া মাত্রই নোট খানা টেনে ছিঁড়ে দূরে ছুড়ে ফেলে।

বরংবার মাথায় শুধু একটা নাম ঘুরপাক খাচ্ছে আর নোটের শব্দগুচ্ছ—
“আমাকে রাগানো ভুল সিদ্ধান্ত বোকা মেয়ে। আমানত খিয়ানত করার শাস্তি কি জানো?”

সেই রাত বোধহয় দুইজন মানুষ নির্ঘুম কাটিয়েছেন, একজন ভোরের আলোর অধীর অপেক্ষারত Predator অন্যজন তার Prey

***

আতিকুর রহমান ব্যাস্ত মানুষ তবে ইদানিং তিনি মহা ঝামেলায় আছেন। এই যে একটা দামড়া ছেলে প্রতিদিন তার বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করে, তাকে আসতে যেতে সালাম দেয়, প্রতিদিন তাকে চা খেতে বা নাস্তা করতে ডাকে। এমন আরেকটা আজব কান্ড আজ বাধিয়েছে ছেলেটা।

এসব নিয়ে ইদানিং তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে টুকটাক কানাঘুষা শুনেছেন তাই ভেবেছেন একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন তার মেয়েকে যে ছেলেটা কি কোন সমস্যা করছে কিনা তবে আসলে ছেলেটা তো কোন সমস্যাই করছেনা।

আজ আতিকুর রহমান বিরক্ত হয়েছেন বটে। তিনি সোজা মুখে বলেছেন মেয়ে বিয়ে দিবেন না তবুও এই ছেলের থামার জো নেই। তাছাড়া ছেলেটার পরিবারই তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তিনদিন আগে ছেলেটার বাবা তার স্কুল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা তুলেছেন। তখন মেয়ে বিয়ে দিবেন না বলার পরও আজ তাদের জন্য কেটে কুটে পাঁচ কেজির দীঘির মাছ পাঠিয়েছে।

আতিকুর রহমান ভেবে পাচ্ছেন না যে তিনি শুকরিয়া জানাবেন না লজ্জা পেয়ে চুপ থাকবেন। তার মেয়েটা খুব একটা কথা বলে না, এসব দেখেও বিশেষ হেলদোল নেই তার মাঝে তাই তার ভয়ের কোন কারণ ছিল না। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন এখন এসব নিয়ে কথাই বলবেন না, আরো কয়েক দিন গেলে না হয় দেখা যাবে।

টুকটাক কাজ শেষে তিনি হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে ভাবলেন, সাড়ে আটটা বেজে চলছে অথচ কাশফি এখনো উঠলো না? ভাবলেন রাত জেগে পড়াশোনা করেছে হয়ত তাই আর জাগ্রত করার জন্য উপরে গেলেন না।

***

কাশফি হন্তদন্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ে, স্যারের লেকচার গুলো নোটে না তুললে পরে তোলার জন্য রেখে দিলে সে পরীক্ষার আগে হায় হুতাশ করেও মিলাতে পারবেনা। এদিকে ভয়ে আর রাগে রাতের ঘুম না হওয়ায় চোঁখে নিচে কালি জমে গেছে। যা একটু ঘুম হয়েছে সকাল সাতটার পরে।

ধুপধাপ নেমে কলেজে গেইটে প্রবেশ করার পূর্বেই রিক্সা ওয়ালা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন —
“কি গো আফা ভাড়া দিবেন না?!”

কাশফির মাথায় চট করে ঢুকলো যে সে ভাড়া পরিশোধ না করেই প্রস্থান করছিল। ইতস্তত হয়ে ব্যাগ ঘটাতে ঘাটতে ঘটে আরেক বিপত্তি। তার ম্যানি ব্যাগটা তাড়াহুড়োয় বাসায় রেখে এসেছে হয়ত।
লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে রিক্সা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে —
“চাচা একটু অপেক্ষা করেন আমি ভাড়া শোধ করে দিবো।”

রিক্সা ওয়ালা চাচা বিরক্ত হয়ে চোঁখ কুচকে ফেসফেসে গলায় বলে—
“আগে কইতেন ট্যাহা নাই, বহাইয়া রাইখ্যা আমার লস কেন করবার?”

কাশফি অপরাধীর ন্যায় নিচে তাকিয়ে তার ফোন বের করে ঈশান কে কল করে,

“কিরে তুই এই টাইমে কেনো কল করলি? জানিস না আমি ক্লাসে?”

“ভালো করে জানি তুই ক্লাস না করে কোন দোকানে আড্ডা দিচ্ছিস। কথা না বাড়িয়ে কলেজের সামনে আয় আমি টাকা আনতে ভুলে গিয়েছি।”

“পাঁচ মিনিটে আসছি।”

কল শেষ হতে না হতেই নিজের পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়াতে বলার পূর্বে চিরচেনা ক্লোনের মাস্কি ঘ্রাণ সুরসুর করে নাকে এসে বিধলো। ইন্দ্রীয়ে অনুভব হওয়ার ক্ষনক্রমেই ঝড়ের বেগে শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল শিহরণ নেমে গেলো।

ঠিক যেনো কোনো দূর্স্বপ্নের মতো…
কাশফি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে কাঁধে থাকা ব্যাগের স্ট্র্যাপটা শক্ত করে ধরে। নিজেকে ধাতস্থ করে, পিছনে ফিরে দেখার কৌতূহল গিলে নেয়। তৎক্ষণাৎ তার বাহুতে শক্ত পেশল বাহুর ছোঁয়া লাগা মাত্র আড় চোখে পরনের অফ হোয়াইট শার্টটা দেখে সে যেনো থমকে গেলো।

হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ এমনিই চেয়ে রইল, তার মানে কি সে কাল রাত মানুষটা কে দেখেছিল কিন্তু রেসপন্স করেনি?
দপ করে তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। ঘৃণায় গা রি রি করছে তবুও সে কোন বাক্য ছুড়লো না। এখানে আপাদত কোনো সিন ক্রিয়েট করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাই নিজের রাগ আর ঘৃনা দমিয়ে রাখলো। মুখ সম্মুখে ফিরিয়ে এমনভাবে অবস্থান করলো যেনো সে কৌশিক মির্জা কে চোখেই দেখে নি।

কাশফির পাশে কৌশিক মির্জাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মধ্যবয়স্ক রিক্সা চালক রিক্সা থেকে নেমে দাড়িয়ে পড়েন। সে খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে সুন্দর করে সালাম দিলো। কৌশিকের নির্জীব আঁখি কালো চশমায় ঢাকা। বেশ শান্তভাব মূর্তি বজায় রেখে পকেট থেকে পাঁচ হাজারের নোট এগিয়ে দিয়ে রাশভারী কন্ঠে বললো—
“ম্যাডাম কে প্রতিদিন কলেজে আনা নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। আর রাস্তাঘাটে এভাবে কাউকে অপদস্থ করতে না দেখি, আপনার হক তাই সুন্দর করে চাইবেন।”

“জে আইচ্ছা।”

কাশফি হতচকিত হয়ে তাকিয়ে ছিল এতক্ষন, ধ্যান ভাঙলে কৌশিকের দিকে রাগে গজগজ করে শক্ত কন্ঠে বলে—
“আপনার দয়ার প্রয়োজন ছিল না, আমি ভাড়া শোধ করতে পারব!”

কৌশিক তার কথা কানে না তুললে সে রিক্সা চালকের দিকে তাঁকিয়ে শক্ত পুরুষালি কণ্ঠে বলে —
“চাঁচা উনার টাকা উনাকে ফিরিয়ে দিন আমি আপনাকে ভাড়া পরিশোধ করব বলেছি তো।”

পরপর শোনালো কৌশিকের হাস্কি কণ্ঠের কাঠ কাঠ জবাব —
“আমার কথার অবাধ্য হওয়া আমি পছন্দ করি না বুঝলেন তো?!”

রিক্সা ওয়ালা চাচা মাথা নেড়ে কাশফির দিকে তাঁকিয়ে বলে — “ম্যাডাম আমি অফেক্ষা করুম।”

চাঁচা টাকা পেয়ে খুশি হয়ে আর কিছুই বললেন না এদিকে কাশফি দাঁতে দাঁত চেপে আশেপাশে পরখ করে নেয়। ঠিকই অনেক জন তাদের বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে। কাশফি জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গলার আওয়াজ খানিকটা নিচে নামিয়ে তবে তেজী স্বরে বলল—
“মির্জা সাহেব, আপনার সমস্যাটা কি?!”

কাশফির মির্জা সাহেব ডাকটা কৌশিকের ঠাট্টা সমতুল্য মনে হলো। সে তো কাছের মানুষ, জনাব বললে কি মানায়?
সে চোখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে অগ্নিশর্মা হয়ে থাকা কাশফিকে দেখে। এলোমেলো চুল কোনরকম প্যাঁচিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে রেখেছে, ছোট ছোট চুল কপালে পড়ে আছে। ঘুমুঘুমু চেহারার ফুলো ফুলো চোঁখে যেন আরো স্নিগ্ধ লাগছে। হয়ত তার কারণে ঘুম হয়নি আর যা ঘুমিয়েছে পরে থেকে উঠে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে ম্যাডাম। কাশফির উচ্চতা কৌশিকের বুক পর্যন্ত। তাই সে তার প্রশস্থ দেহ কিছুটা ঝুঁকে কন্ঠ নামিয়ে শাসনোর সুরে বলে —

“নেক্সট টাইম কলেজে এভাবে যাতে না আসতে দেখি।”

“কী?”

“আপনার এমন স্নিগ্ধ মোহিনীরূপ অন্যকেউ দেখবে সেটা আমি চাইনা।”
কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আর নিজেকে দমিয়ে না রাখতে পেরে চোখে মুখে একরাশ ঘৃনা নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

“আপনি ফিরে কেনো এলেন আবার? আমাকে কি দু দণ্ড শান্তি দেওয়া যায় না?!”

“নিজের পাওনা আদায় করে নিতে এসেছি কাশফি। বলেছিলাম, ভুলতে দেবো না আপনাকে।”

“হেঁয়ালি করেছেন জনাব?”

“না তবে যাওয়ার আগে ওয়ার্ন করেছিলাম।”

“আমি আপনাকে ভয় পাইনা!”

কৌশিক তার সুঠাম দেহ দৃঢ় করে কাশফির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, তৎক্ষণাৎ কাশফির শ্বাস আটকে আসার জোগাড় যেনো। ততক্ষণে কৌশিক আঙ্গুলের আলতো স্পর্শে কাশফির গালে পরে থাকা চোখের পাঁপড়িটা তুলে নেয়,

“Convince yourself that you are not afraid of me, Kashfi. Yet, I keep stealing your sleep, don’t I?!”

কৌশিক আর দাড়িয়ে না থেকে রাস্তার অপর পাশে পার্ক করা মেটালিক সিলভার বিএমডাব্লিউর ড্রাইভিং সিটে থাকা লেভিনের চোখে চোখ রাখতেই বিএমডাব্লিউটা তার সামনে এসে থামে। সে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠার পূর্বে তার সিগনেচার স্মার্ক মুখে এনে থমকে দাড়ায়। পরক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে বিব্রত হয়ে থাকা কাশফির দিকে ফিরে তাকায়, অতঃপর তড়িৎ বেগে মুখ কাশফির কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,

“কাল আমারও ঘুম হয়নি কাশফি, চলুন বিয়ে করেই নাহয় দুজন এক বিছানায় শান্তির ঘুম দিবো।”

#চলবে…