অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-৩৪+৩৫

0
279

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৩৪ এবং বোনাস পর্ব)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
(১৮+ পর্ব, কঠোরভাবে মুক্তমনা এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত)

কাশফি বাবার বাড়ি এসেছে আজ তিনদিন হল। বিয়ের পর যদিও তার বাবার সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে কিন্তু তখন ফোনে আতিকুর রহমানকে কেমন বিছিন্ন মনে হয়েছিল তবে কাশফি আসার পর থেকে আতিকুর রহমানকে বেশ হাসিমুখে আছেন। নিজে গিয়ে বাজার করে কায়েস এবং কাশফির সব পছন্দের জিনিস নিয়ে এসেছেন তারপর জয়তুন বিবিকে আদেশ করেছেন ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য ভালো করে রাঁধতে।
জয়তুন বিবি পাশের গ্রামের বৃদ্ধ বিধবা মহিলা। স্বামী মারা যাওয়ার পর আদরের ছেলেটাও তার খোঁজ খবর রাখেন না বলেই পেটের ক্ষুদার জ্বালায় এই বয়সে আয় রোজগার করতে হচ্ছে। তবে জয়তুন বিবির হাতের রান্না মুখে লেগে থাকার মতো, তিনি এই বয়সেও কাজে ভারী পটু। এমন বয়স্ক মহিলা আতিকুর রহমানের স্কুলে আয়ার কাজের জন্য হাত পাতেন বলে আতিকুর রহমানের বড্ড মায়া হয় তাই তিনি জয়তুন বিবিকে তার ঘরের কাজে রেখে দিলেন।

দুপুরের খাবার খেয়ে দেয়ে বিকেলের দিকে কাশফি কড়া লিকারের চা আর টোস্ট নিয়ে তার বাবার স্টাডি রুমে চললো। আতিকুর রহমান মেয়েকে দেখা মাত্রই মুচকি হাসি হেসে কাজ এক পাশে ফেলে বেলকনিতে পাতা চেয়ারে বসলেন। কাশফি এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়ে নিজে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।

“জামাই ভালো আছেন?”
তার বাবার মুখে কৌশিকের কথা শুনে কাশফি ভরকালো তবুও মাথা নেড়ে ছোট করে জানালো যে কৌশিক ভালো আছেন।
কাল বাসার স্টাফকে কল করায় জানতে পেরেছে কৌশিক কালই কাজ শেষ করে ফিরেছিল কিন্তু কাশফি এখনো কৌশিকের সাথে কোনো কথা বলতে চাইছে না। কারণ হিমাদ্রী ছিল তার পরিসর স্মৃতি জুড়ে, কৌশিক তো চাইলেই বলতে পারত যে সে হিমাদ্রী। নিজের উপর জোর খাটিয়ে কাশফি কিছুই ভাবতে পারছে না, তার অনুভূতিগুলো বিক্ষিপ্ত পর্যায়ে চলে এসেছে, এই পর্যায়ে সে কৌশিক থেকে না দূরে থাকতে পারছে, না কৌশিকের সম্মুখে দাঁড়াতে পারছে।

“শুনলাম কৌশিক নাকি কায়েসকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে।”

“ভুল শোনোনি তুমি বাবা, উনি পড়াশোনা আর প্রফেশন নিয়ে বেশ সিরিয়াস।”

তিনি মেয়ের উত্তরে তৃপ্তি পেলেন বোধহয়, মেয়ের ভালো কোন বাবা চাইবে না? আতিকুর রহমান মাথা নেড়ে ম্লান হাসলেন তারপর ফু দিয়ে ধোয়া বের হওয়া গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“তা তো ভালোই, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভালো।”

“ফার্স্ট ক্লাসের চিন্তা মাথায় নিয়ে পড়ছো তো?”

“জ্বি”

”ঈশিতা, তুমি কি পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পেরেছ?”

কাশফি কিছুটা অপ্রস্তুত হলো বোধহয়, বাবার সাথে নতুন জীবন, স্বামী কিংবা সংসার নিয়ে আলাপ আলোচনা করা নিয়ে পূর্বে কল্পনা করেনি তাছাড়া তার বাবা এমন কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবতেই পারছে না সে।

“চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বাবা।”
মেকি হাসলো কাশফি, প্রতুত্তরে তার বাবাও হাসলো। আতিকুর রহমান নরম কণ্ঠে মেয়েকে বোঝালেন,

“বেশ, সেটাই তোমার সংসার, গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও তোমার। বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী আপন হয়ে যায় তাই সম্মান করে চলবে।”

“জ্বি বাবা।”

“শোনো ঈশিতা, ভুল আমারও হয়েছে কৌশিক যতটা খারাপ নয় তাকে ততটা খারাপ ভেবে বসেছিলাম। আসলে সত্যি বলতে আমি ভয়ে ছিলাম…”

“কিসের ভয়?”

“আমি স্বার্থপরের মতো নিয়তি নিয়ে খেলতে চলেছিলাম কিন্তু আমার ব্যক্তিগত সার্থ করো জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অথচ আমি টেরই পেলাম না। ইদানিং অনুতাপ জেঁকে ধরেছে তাই ভয় হয়।”

“এমন বলো না বাবা, ভুল তো মানুষেরই হয়। তুমি হয়ত তার কাছে ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা পেয়ে যাবে।”

“কিছু ভুল ক্ষমা করার মতো হয়না, আমার ভুলেও কোনো ক্ষমা নেই।”
কথাবার্তার এই পর্যায়ে এসে কাশফি খানিকটা বিহবল হলো, তার বাবার হতাশা মিশ্রিত নিশ্বাস ফেলা নিয়েও সে বিব্রত। কী এমন ভুল যার জন্য তার বাবা অনুশোচনায় ভুগছেন…
কৌতূহল থাকার সত্ত্বেও কাশফি আলগোছে বিষয়টা পাল্টে নিলো,
“শুনলাম কাল মনিরদের পুকুর সেচ দিবে?”

“আজ তো দেখলাম মেশিন এনেছে।”

“মাছ বিক্রি করলে খবর দিও তো, কয়েক কেজি কিনে নিব। তোমার জামাই মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন পুকুরের মাছ নিয়ে গেলে খুশি হবেন।”

“তুমি আমাকে আগে বলবে না? দাড়াও আমি মনিরের বাপকে খবর দিয়ে রাখি।”

***

“কাল মম ড্যাডের বিয়ের পঁচিশ বছরের এনিভার্সেরি, তোদের কিন্তু আসতেই হবে, এই নে কার্ড!”

ফারাবী কার্ডে চোখ বুলিয়ে এক মুহূর্তে হ্যাঁ বলে দিলো কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো কাশফি। এমতাবস্থায় তার কোথাও বের হওয়ার ইচ্ছে নেই এমন বড়সড় আয়োজনে লোকজনের ভিড় যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না!

ঈশান তরীর হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে পড়ে মিনমিন করে বললো,
“তোদের ধনী লোকদের একটা সমস্যা টাকা কোথায় না কোথায় উড়াবি খুঁজে কুল কিনারা পাস না!”

“আর তোর মতো মানুষের সমস্যা হলো আমরা কি করছি না করছি এসব নিয়ে নাক গলানো।”
তরীর তেতো কথায় ঈশান ভেঙ্গিয়ে মিমিক্রি করলো।

“তোর ড্যাডেকে বলিস একদিন চায়ের দাওয়াত দিতে।”

“বাসায় চা পানি পাস না সেটা আগে বললেই হতো!”

“দুর, আমি তো তোর ড্যাডেকে বোঝানোর জন্য যাবো যে তার মেয়ের জামাই হিসাবে আমি মন্দ হবো না।”

“ছিঃ তোকে কে বিয়ে করছে?”

“ছিঃ মানে কী?!”

“ছিঃ মানে তোর মতো আহাম্মকের বউ হওয়ার করো ইচ্ছা থাকার প্রশ্নই আসে না!”

“দেখিস আমার ভাগ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে লিখা আছে!”

“যা যা ভাওতাবাজী করবি না!”
ঈশান গাল ফুলিয়ে বিড়বিড় করে কী কী বললো, তরী সে কথা কানেই নিলো না। এদিকে কাচুমাচু হয়ে থাকা কাশফি মুখটা পাংশুটে করে বললো,

“আমি না গেলে হয় না?”

“মমের সাথে কথা বলিস, তোদের হাজার বার সেধে সেধে দাওয়াত উনি তো দিতে বললেন।”

“আচ্ছা আমি তোকে পরে জানাচ্ছি।”

“অত কিছু আমি শুনতে চাইনা, তুই ড্রেস কোড হিসাবে শাড়ি পড়ে আসবি।”

সেদিন কাশফি না চাইতেও কোনরকম রেডি হয়ে নেয়, কিছুক্ষণ পর ফারাবী রেডি হয়ে এসে যখন দেখলো কাশফির গায়ে কামিজ তখন যেনো বাজ পড়ল তার মাথায়। চ্যাচামেচি করে নিজের সাথে আনা ভারী কাজের লেভেন্ডার কালারের শাড়ীটা পরিয়ে সাজিয়ে দিলো। ফারাবী আজ কাশফির কোনো বারণ শুনলো না নিজের হাতে কাশফিকে সাজিয়েই তৃপ্তি পেলো। দিগন্তের গাড়ি কাশফির বাসার নিচেই ছিল, বউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার এদিকে ঘুমু ঘুমু অবস্থা দিগন্তের। এক ঘন্টা পর ফারাবী নেমে এলো ভোতা মুখো কাশফিকে নিয়ে তারপর চললো ভেন্যুতে।

ইভেন্টে তরীও শাড়ি পরেছে, কালো শাড়ি, স্মোকি লুক আর তার ড্যাজিলিং স্মাইলে পার্টি মাতিয়ে রাখার উদ্দ্যেগ নিয়েছে যেন। কাশফি হাতে গ্লাস নিয়ে তরীর মায়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ। এদিকে ফারাবী চুপটি মেরে দিগন্তের পিছু পিছু চলছে কারণ এসেই দিগন্ত কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে ফারাবীকে যাতে তার পাশেই থাকে, ফারাবীও তাই অমান্য করার সাহস দেখলো না।
তিন বান্ধবী খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আবার নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল। কাশফি পরিচিত গেষ্টদের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে মুখ বেজার করে তরী এসে কাশফির পাশে দাঁড়ায় তারপর গেস্টদের অগোচরে চোখ ছোট ছোট করে ফিসফিসিয়ে বললো,

“এটা তোর দেবর না?”
কাশফি তরীর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো কাব্য হাতের গ্লাস মুষ্ঠিতে শক্ত করে ধরে চোয়াল দৃঢ় করে রেখেছে। পাশের জনের কথায় তার কোনো মনোযোগ নেই তবে তরীর দিকে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি এতটা প্রকট যে তাদের মাঝের প্রবল অনুভূতি স্পষ্টত।

“হ্যাঁ।”

“ডিসগাস্টিং!!!”
তরীর ঝাঁঝালো কণ্ঠে কাশফি কিছুটা বিচলিত হলো। পার্সোনালি কাব্যের স্বভাব চরিত্র নিয়ে সে তেমন কিছুই জানে না তাই ঠাট্টার স্বরে বললো,

“এমন বিভেব করছিস কাব্য যেন তোর এক্স?”

তরী খিটখিটে মেজাজে কাশফিকে চোখ রাঙায়। জিভ বের করে নাক সিটকে ফেললো, তার অভিব্যক্তি এমন যেন কেউ তার মুখের উপর আবর্জনা ফেলেছে। নাকের ডগা ফুলিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে ভীষণ রকমের তেতো হয়ে বললো,

“এক্স মাই ফুট, সে যদি পৃথিবীতে অবশিষ্ঠ পুরুষও থাকে তবুও এই তরী আজিজ তার দিকে ফিরে তাকাবে না।”

“এতো ঘৃ না করিস কিন্তু কেনো?”

তরী শ্রাগ করে এক চুমুক ড্রিংক নিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে বললো,
“একে অপরের পার্সোনালি আর চিন্তা চেতনা ঘৃ না করি, বিশেষ কোনো কারণ নেই।”

কাশফি চমকালো বোধহয়, ফ্যালফ্যাল করে একবার তার বান্ধবী তারপর কাব্যের দিকে চেয়ে আসল সমীকরণ উদঘাটনে নামলো তবে ঘটনার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না।

“ঘৃ না করার জন্য কোনো স্ট্রং একটা কারণ চাই, তুই তো এমনি এমনি কাউকে ঘৃনা করতে পারিস না।”

সে পুরোটা গ্লাসের পানীয় এক ঢোকে শেষ করে বেখাপ্পা হাসি হেসে বাজ খাই কণ্ঠে বললো,

“কাব্য মির্জার মতো এরোগেন্ট, নরসিসিস্ট, ইগোয়িস্ট মানুষকে ঘৃ না করার কোনো কারণ লাগে না তাছাড়া তাকে দেখেই আমার দম আটকে আসে! He is an as’shöle!!!”

তরী ফের নাক সিটকে চোখ উল্টিয়ে নেয়, হাতের ইশারায় ওয়েটার কে ডেকে একটা ঠান্ডা পানীয় নিলো। তারপর পুরো গ্লাস দু চুমুকে শেষ করে ছোট ছোট চোখে কাব্যকে চেয়ে মিডেল ফিঙ্গার দেখিয়ে তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে নিলো। কাব্য চোয়াল শক্ত করে কিছু একটা উচ্চারণ করলো বোধহয় তারপর অন্যদিকে ফিরে হাটা ধরলো।

কাশফি এদের দুজনের কর্মকাণ্ডে বিস্ময় বিমূঢ়, সাধারণত তরী কাউকে অকারণে গা’লম’ন্দ করে না।
কাশফির ধারণা নিশ্চিত কিছু ঘটেছে! ভাবুক হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিবে তার পূর্বেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে গেলো।

কোনো খা খা রোদ্দুরে দিনের এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রশান্তি অনুভব করলো সে, তবে ভাবতে পারে নি এমন আকস্মিক সাক্ষাতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়বে, ভাবেনি শিরদাঁড়া বেয়ে হিম হিম শিহরণ বয়ে কাপিয়ে তুলবে তার ভগ্ন রুক্ষ হৃদয়। ব্যক্তিগত পুরুষের ধূসর চোখে আবদ্ধ হয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে শুকনো ঢোক গিলে এক নাগাড়ে চেয়ে রইলো চেয়ে রইলো কেবল। এই ছোট্ট জীবনে কি এমন একান্ত সুদর্শন পুরুষ দেখার স্বাদ কখনো মিটবে না?
থাক না মিটুক, না বলা হলেও মানুষটা তার হয়ে থাক!
এতো শত ভাবনার ভিড়ে হুট করে মনে প্রশ্ন জাগলো কৌশিকের চিন্তায় ডুবে আদা জল খেয়ে সে আবার হ্যালুসিনেট করছে না তো?! তৎক্ষণাৎ কৌশিকের চোখের স্পষ্ট কাতরতা তাকে শক্তভাবে জানিয়ে দিল ‘তুই ঠিক দেখছিস কাশফি!’

এতদিনের হারিয়ে যাওয়া মানসিক শান্তি আর বক্ষের অভ্যন্তরীণ শুন্য স্থান কৌশিকের দেখা পাওয়া মাত্রই নিমিষে পূণ্য হয়ে এলো। মানুষটাকে চারদিন দিন পর আজ প্রথম দেখছে অথচ মনে হচ্ছে চার বছর সাক্ষাৎ হয়নি তাদের। দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ মিলিয়ে ভাবলো কৌশিক কী খওয়ার দাওয়ার ঠিক মতো খায়নি? তবে হালকা শুকনো লাগছে কেনো তাকে?
যখন দুই পা দুই পা করে কৌশিক এগিয়ে এসে থামলো কাশফির সম্মুখে তখন কাশফির অনুভুতি জলোচ্ছ্বাসের মতো উথাল পাতাল শুরু করলো, অস্থির চোখজোড়া স্থির হলো কৌশিকের মদ্যক অক্ষিপট আর উন্মাদনাময় দৃষ্টিতে।
একজোড়া ধূসর অক্ষিপট বেহায়া হয়ে বিচরণ করলো কাশফির চোখ, ঠোঁট তারপর গলা। মাদক চাহনিতে গেঁথে নিলো কাশফির নাজুক সত্তা।

“শালী গুলো দেখছি কাজে বেশ এক্সপার্ট।”
কৌশিকের হাবভাব আর মুখভঙ্গি দেখে কাশফি ভরকে গেল। ভ্রু কুঁচকে অবাক কণ্ঠে শুধলো,

“কি কাজ?”

“তোমাকে রেডি করে আমার সামনে আনার কাজ, তুমি তো গর্তে ঢুকে ছিলে তাই দায়িত্ব তাদের উপর চাপলো।”

কাশফি হা করে চেয়ে রইলো শুধু, মানুষটা তাকে দেখার জন্য এতো মরিয়া হয়ে ছিল? অথচ সে নাকি একটা কল ও করলো না। কাশফির চোখ প্রচুর জ্বলছে। এত কষ্ট নিজেকে না দিয়ে তার কৌশিকের সাথে থাকলেই তো হলো…
এই নিয়ে তো কম দোটানায় ভুগেনি সে!

“গর্তে কোথায় ঢুকলাম? বিয়ে হয়েছে বাবার বাড়ি বেড়াতেই পারি।”

“এক সপ্তাহ থাকা কি বেড়ানো হতে পারে? আমি তো ভেবেছি তুমি পার্মানেন্টলি শিফট হয়ে গিয়েছ সেখানে।”

“আমার বেড়ানো নিয়ে বিদ্রুপ করবেন না কৌশিক!”

“বিদ্রুপ কবে করলাম?”

“অস্বীকার করছেন?”

কৌশিক প্রতুত্তর করলো না শুধুমাত্র পর্যবেক্ষক নজরে দেখতে থাকা কৌশিক কাশফির ভূবনমোহিনী রূপে মত্ত, সেই কাশফিকে শাড়িতে দেখা মাত্রই তো তার পুরুষসত্তা ঘায়েল হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল।
তীব্র স্বামী অধিকার জেঁকে উঠলো তার মাঝে, প্রাবল্য অধিকারবোধ দেখিয়ে কাশফির পিঠে হাত পেঁচিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে টেনে তার কাছে নিয়ে আসলো, যেনো নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার তীব্র বাসনা তার। একটুও অপ্রস্তুত হলো না কাশফি বরং কৌশিকের বুকে মিশে গেলো। তারপর সুরসুর করে কৌশিকের আবিষ্ট কোলোনের ঘ্রাণ তার নাকে বিধে মোহে বশ করে নিলো। প্রতিবার কৌশিকের সামান্যতম জিনিসে নিজেকে হারানোর পিছনে সে কোনো কারণ খুঁজে পায় না। প্রতিবার কোনো দৃঢ় আকর্ষণ বল যেন তাকে কৌশিকের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অকারণে কৌশিক কে নিজের কমফোর্ট জোন ভাবার কারণ খুঁজে পায়না সে।

কৌশিক সন্তপর্নে কাশফির হাতের গ্লাসটুকু নিজের হাতে নিয়ে কাশফির লাগানো চুমুকের জায়গায় নিজে চুমুক বসিয়ে পুরোটা শেষ করে নেয় তারপর খালি গ্লাস ওয়েটারের ট্রেতে রেখে দিলো।

“আপনি শুকিয়ে গিয়েছেন কৌশিক।”
ধরা গলায় উচ্চারণ করলো কাশফি কিন্তু কৌশিকের শক্ত কন্ঠের অভিমানী জবাবে দমে গেলো।

“বউ ঘরে না থাকলে স্বামী তো শুকাবেই।”

“আপনি স্বাস্থ্য নিয়ে হেলা ফেলা করছেন?”
উদ্বেগ হয়ে ছলছল চোখে চেয়ে রইলো কৌশিকের পানে, কৌশিক বুঝলো বোধহয়। ভিতর ভিতর আত্মতৃপ্তির সঞ্চার হলো। আজকাল কাশফির স্ত্রী স্ত্রী গলা আর ভাবমূর্তি দেখে কৌশিকের মন খুলে হেসে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় — ‘দেখো পৃথিবী আমার ভালবাসা হারায় নি, আমি ঠিক আগের মতো আগলে নিয়ে তাকে নিজের করতে পেরেছি।’

“তুমি ফেরার দিন গুনছি কাশফি, বড্ড শূন্যতার ভুগছি আজকাল।”
ভয়া’নকভাবে কাশফির বুক কাপলো, খুব করে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো তার ‘আমিও ভালো নেই কৌশিক’ কিন্তু বলা হলো ছলাৎ ছলাৎ করে জ্বলে উঠলো তার বক্ষস্থল। সারা শরীর কেঁপে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম এমতাবস্থায় কৌশিকের চোখে চোখ রাখার মতো সাহস হলো না। কেনো জানি মানুষটার কাছে সে খোলা বইয়ের পাতা।

কাশফি নিজের গ্লাসের পানীয় শেষ করে আরো কিছুক্ষণ কৌশিকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো তারপর যখন কৌশিক তার পরিচিত ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো তখন কোনরকম পালিয়ে বেড়ানোর বাহানায় ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

ওয়াশরুমে কাজ সেরে সিঙ্কের লাইনে এসে হাত ধোয়ার সময় পুরো ওয়াশরুমে উপস্থিত একজন মহিলা হাত ধুয়ে বের হয়ে পড়ে, বাকি রইলো একা সে ওয়াশরুমে। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে পার্স থেকে ফোন বের করে উবার কল করে নেয়। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকা মানে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেকোনো সময় কৌশিকের কথায় চলে আসতে পারে।

তরীকে ফোন করে জানিয়ে দিলো যে সে বেরিয়ে পড়ছে এক্ষুনি, তারপর যেই দরজা খুলে বের হবে কৌশিক এসে দরজা ভিড়ে ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমের ভিতর তারপর নিমিষেই ছিটকিনি লাগিয়ে কাশফিকে সিঙ্কের পাশের দেওয়ালে এনে নিজের শরীরের সর্বোচ্চ বলে দেওয়ালে চেপে ধরলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় কাশফি বিমূঢ়, পরক্ষণে তাকে আশ্চর্যের উৎকর্ষে নিয়ে কৌশিক বলিষ্ঠ হাতে তার মাথা ধরে কাছে টেনে প্রবল বেগে হামলে পড়লো তার ঠোঁটের উপর। কৌশিকের মারাত্বক চুমুতে আবিষ্ট হয়ে মাতাল কাশফিও, জড়িয়ে ধরে কৌশিক কে নিজের মাঝে নিহিত করে নিলো তারপর একজোড়া ওষ্ঠাধর অন্যজোড়ায় ডুবে একাকার হয়ে সিক্ত হয়ে গেল। বলিষ্ঠ হাত বিচরণ করলো কাশফির নরম কোমর, উরু হয়ে আরো নিম্নাংশে, এমন প্রগাঢ়, শ্বাসরুদ্ধকর, ঘনিষ্ঠ চুমু একপর্যায়ে পৌঁছে কৌশিক কাশফিকে কোলে তুলে নেয় কিন্তু থামে না, কাশফিকে সিঙ্কের পাশের কাউন্টার টপে রেখে ঠোঁট ছেড়ে কাশফির গলার ভাজে মুখ গুজলো। সম্মহিনী ডাকে প্রিয়তমাকে দুর্বল করে তার পালস পয়েন্টে আঙ্গুল বুলিয়ে আদ্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।

“বাসায় চলো কাশফি তোমাকে আমি যথেষ্ঠ স্পেস দিব।”
কৌশিকের হাস্কি গলার পুরুষালি আকুল কন্ঠের আবেদনময়ী ডাকে কাশফির না করতে যায় যায় অবস্থা। কৌশিকের আঙ্গুল এখনো কাশফির গলার পালস পয়েন্ট বুলিয়ে দিচ্ছে তারপর হুট করেই কৌশিক তার গলার ভাজে কামড়ে আবার জিভের স্পর্শে কাতর করে তুললো। ককিয়ে উঠে কাশফি আরো ঝাপটে ধরলো।

“আমি আরেকটু সময় নিতে চাই কৌশিক, প্লীজ।”
কাশফি রয়ে সয়ে বললো কিন্তু কৌশিক অবাধ্য, চোয়াল শক্ত করে কাঠ কাঠ কণ্ঠে নির্দেশ দিলো,

“সময় বাসায় ফিরে নিতে পারবে, প্রয়োজনে তুমি বিছানায় ঘুমাবে আর আমি সোফায়।”

“সম্ভব না কৌশিক।”

কাশফির নিভু নিভু কণ্ঠে কৌশিক মাথা তুলে কাশফির ঠোঁটের কোণে তার ঠোঁটের স্পর্শ করালো তারপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল,
“ঠিক আছে আমরা আলাদা রুমে থাকবো তবুও এভাবে দূরে দূরে থাকা অসম্ভব কাশফি।”

কাশফির গলা ধরে আসলো, দুহাতে কৌশিকের খোচা খোচা দাড়িযুক্ত চোয়াল ধরে, আদুরে স্পর্শে হাত বুলিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো, এই বুঝি কাশফি টলে পড়বে কৌশিকের বাহুতে তারপর কোনো বাধ মানবে না। নিজের ভাবনার ইতি টেনে বহুকষ্টে কাশফি উচ্চারণ করলো,

“আপনি চাইলে আমাকে আগেই জানাতে পারতেন কৌশিক তাহলে আমার সময় নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।”

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাশফির হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে তার অনামিকায় চুমু খেলো। তারপর ললাটে প্রলম্বিত চুমু একে জানালো,
“জানাতে তোমায় নয় বছর আগেও চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আগের মতো এবারও পরিস্থিতি হতে পালিয়ে বেড়াচ্ছো কাশফি।”

কাশফির ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাপলো, আসলে তো তাই। কেনো সে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়? সে কি পারেনা কৌশিকের সাথে বসে তার মাথার জটলা সমাধান করতে?
কথায় কথা বাড়বে তাই কাশফি দ্রুত টপিক পাল্টে নেয়, নিজের মানসিক অবস্থা আড়াল করে নরম হয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে কৌশিক, আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।”

“যদি আমি তোমায় আজ আমার কাছে রেখে দিই?”

“আমি থাকবো না কৌশিক।”

কৌশিক নারাজ হলো বটে তবে মুখ ফুটে আর কিছু ব্যক্ত করা হলো না তার, জিজ্ঞেস করে কাশফির মতামত চাইলো না বরং কাঠ কাঠ কণ্ঠে জানিয়ে দিলো,

“চলো, আমি তোমায় দিয়ে আসছি।”

কাশফি বিস্ময় বিমূঢ়, বারণ করার সুযোগ কিংবা শব্দ গুছিয়ে নিতে সুযোগ পেলো না, কিন্তু মন ঠিকই কৌশিকের কথায় সায় দিয়ে বললো তাকে সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে চলতে।
ইউজুয়াল আইস কোল্ড মুখবয়ব এবং ধৃষ্ট ব্যবহার দেখিয়ে কৌশিক মির্জা কাশফিকে বাহুতে আবদ্ধ করে সঙ্গে নিয়ে ওয়াশরুম পেরিয়ে এলো। সে বেপরোয়া, ভাবলেশহীন, আশপাশের বেশ কিছু অবাক নজরের পর্যন্ত তোয়াক্কা করলো না।

ভেন্যু থেকে বেরিয়ে পড়ার পথিমধ্যে ফারাবীর দেখা পেয়ে প্রহেলিকাময় হাসি হাসতে ভুললো না, ফারাবীও চোখ টিপে থাম্বস আপ জানিয়ে দেয়।
আজ কৌশিক ড্রাইভার নিয়ে আসেনি, তাই কাশফিকে দরজা খুলে তুলে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। তারপর স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো।
কাশফি নিজের অবাধ্য অনুভূতি চেপে নিজেকে আয়ত্তে এনে চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো, ভেবেছিল কৌশিক ঠিকই তাকে বাসায় পৌঁছে দিবে কিন্তু হলো তার উল্টো। কৌশিক গাড়ি থামালো একটা খোলামেলা জায়গার মডার্ন বহুতল ভবনের সামনে, সে নেমে কাশফির গাড়ির দরজা খুলে ধরায় কাশফি বেশ হকচকিয়ে যায়,

“কৌশিক আপনি কোথায় নিয়ে এলেন আমি তো বলেছি আপনাকে আমি বাসায় ফিরবো।”

কৌশিকের শান্ত জবাবে জানালো,
“অবশ্যই ফিরবে কিন্তু তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।”

কাশফি পার্স ফাঁক করে ফোনে সময় দেখে নেয়, দশটা বাজতে আর ছয় মিনিট বাকি।
“আর্জেন্ট কিছু দেখাবেন?”

“হয়ত…”
কৌশিকের খামখেয়ালীপনা দেখে কাশফি ভ্রু কুঁচকে চায়,

“কিন্তু বাবা তো অপেক্ষা করছেন।”

“তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে কাশফি।”

কাশফি ভ্রু উচু করে অবিশ্বাস্য নজরে শুধলো,
“বাবার সাথে কখন কথা বললেন আপনি?”

উত্তরে কৌশিক বাকা হেসে জবাব দিলো,
“সময় সুযোগ বুঝে।”
কাশফি কৌশিকের কথার ধাঁচ ধরে আর কিছুই বললো না কৌশিকের পিছু পিছু এলিভেটরে চড়ে ত্রিশ তলা পৌঁছে গেলো। তিনটা ব্লক পেরিয়ে আসতেই একটা চোখ ধাঁধানো খোলামেলা এপার্টমেন্টের সামনে এসে দাড়ালো। ঘরোয়া সব ডেকোরেশন আর থিম দেখে কাশফি থ হয়ে গেলো। ঘুরে ঘুরে কৌশিকের পিছু পিছু অবাক নজরে প্রতিটা রুম দেখতে লাগলো। কৌশিক তাকে বামের দিকের বড় একটা রুমে নিয়ে এসে বললো,

“আমাদের একাকী সময় কাটানোর একটা বেস্ট জায়গা হবে এটা কিংবা তুমি তোমার ছোট্ট ব্যালট স্টুডিও করে নিতে পারো।”
কৌশিক কাশফিকে নিয়ে গ্লাস স্লাইভ করে বড় ব্যালকনির সামনে এনে দাড় করায়, এতো উঁচুতে প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে কাশফি কিছুটা কাঁপলো কিন্তু বেশ ভালো লাগলো তার। মাথার তুলে রাতের নির্মল আকাশের দিকে চেয়ে একটা প্রশান্তির শ্বাস টেনে নেয়।

“দিনের বেলায় এখানে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের দেখা পাওয়া যায়।”
কাশফি তৎক্ষণাৎ দেখার চেষ্টা করলোর তবে বিফল হলো কিন্তু এই প্রথম এতো উচু থেকে নিচের দিকে তাকানোতে তার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা।

“তোমার পছন্দ হয়েছে?”.

“খুব সুন্দর, কেনো পছন্দ হবে না।”

“কেনার সময় তোমার কথা ভেবেই নিয়েছি।”

কাশফি হতবিহ্বল হয়ে তর্জনী তার দিকে ঠেকিয়ে ইশারায় শুধলো— “আমার কথা?”

কৌশিক ম্লান হেসে মাথা নাড়ায় তারপর কাশফির কাধ ধরে কাছে টেনে মাথার পাশে চুম্বনে আবদ্ধ করে নিলো, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মৃতির পাতায় ডুব দিলো।

“যখন ঘন জঙ্গল পেরিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে আমার পিয়ানো ভায়োলিন শুনতে আসতে তখনই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি মুক্ত আকাশের নিচে সবুজের অরণ্যে খোলা হাওয়ায় বিচরণ করা চঞ্চলা মেয়ে, তোমাকে দমানো সম্ভব না।”

কাশফি নিজেকে জঙ্গলের আধারে ঝি ঝি পোকার ডাকের মাঝে কল্পনা করলো। তার মুখে চওড়া হাসি নিয়ে ভাবতে লাগলো, চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল বলেই এদিক ওদিক ছোটাছুটির স্বভাব ছিল তাই তার বাবা মাঝে মাঝে দৌড়াদৌড়ি খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে যেতেন। পরক্ষণে তার বাবার উদাসীনতা আর ব্যস্ততার কথা ভাবতেই কাশফির হাসি গায়েব হয়ে গেলো।

“ধন্যবাদ কৌশিক, আমার একাকীত্ব অবসান করার জন্য।”
কাশফির ঠোঁটে কৃতজ্ঞতার হাসি দেখে কৌশিক নিজেও কৃতজ্ঞতাসূচক জানালো,

“তোমার আগমনের পূর্বে আমিও ছন্নছাড়া ছিলাম কাশফি।”

কাশফি আবেগপূর্ণ হয়ে গেলো তবে কথা বাড়ায় না, এমন শান্ত পরিবেশে কৌশিকের কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো এভাবে। কৌশিকও নড়লো না বরং খোলা আকাশের নীচে তার কাশফিকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো।

এরপর কৌশিক তাকে মাস্টার বেডরুমে নিয়ে এলো। বেডরুমের দেওয়ালে বিশাল জানালা আর জানালা পেরিয়ে খোলামেলা বারান্দা। প্রচণ্ড বাতাসের বেগে ধড়াম করে বেডরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু কাশফি ভয় পেলো না। তার অনড় দৃষ্টি আটকালো দেওয়ালে টাঙানো রক্তাক্ত হাতে পিয়ানো বাজাতে থাকা পিয়ানোয়িস্ট আর ক্রন্ধনরত ব্যালেরিনার ছবিতে। এতো মনোরম দৃশ্য দেখে কাশফির গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেল। চোখের কর্নিশে জমলো এক ফোঁটা অশ্রু, দুর্বল স্বরে মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এই ছবির অর্থ কি কৌশিক?”

কৌশিক অনেকক্ষণ কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। কিন্তু কাশফি আবারো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় সে ক্ষীন স্বরে জবাব দিলো,
“সব পেইন্টিংয়ের কি অর্থ থাকতে হবে?”

“আপনিই তো বলতেন শিল্পীদের আবেগ তার কাজে ভাসে।”

কাশফির উৎসুক চোখের দিকে চেয়ে কৌশিক কিছুক্ষণ পেইন্টিংয়ের দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমাদের একে অপরের মত বিনিময়ের মাধ্যম ছিল পিয়ানো আর ব্যালেট কিন্তু ঠিক আমরা একে অপরের দুঃখে কতটা কাতর ছিলাম তা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি কাশফি।”

কাশফি অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে একবার ছবির দিকে আরেকবার কৌশিকের দিকে চাইলো, পরক্ষণে বিস্ময় তার মুখ হা হয়ে এলো।
“আপনি নিজে এঁকেছেন?”

“এমন অবাক হলে কেনো?”

“বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি এতো সুন্দর করে আপনার অনুভূতি রঙ তুলিতে সাজাতে জানেন।”

“মনে মনে তোমাকে প্রতিনিয়ত আমি শ–খানেক বার কিংবা অজস্রবার আঁকি কাশফি, হিসেব নেই।”

“খুব নিখুঁত আপনার হাত, আপনি মানুষটাই বেশ আর্টিস্টিক কৌশিক।”
কাশফির চোখে মুখে বিস্ময় বিমূঢ়তা আর প্রশংসা দেখে কৌশিক ম্লান হাসলো। তারপর কাশফির পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,

“আর তাই বোধহয় আমার ম্যাডাম দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছেন।”
কাশফির বুক কাপলো। সে কৌশিকের চোখে চোখ রাখতেই হৃদপিণ্ড গতি তুললো, পেটে অজস্র প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে গেলো। শুধু প্রেম নয় ভয়ঙ্কর প্রেমে মজেছে সে!

“আমার ক্লান্ত লাগছে কৌশিক, প্লীজ বাসায় দিয়ে আসবেন?”
যখন কাশফি পা বাড়িয়ে পিছু হটবে তখন কৌশিক তার গা ঘেষে দাড়িয়ে পড়লো, তারপর কানের পাশে কাশফির চুল গুঁজে তার ঠোঁটের স্পর্শে কাশফিকে কাবু করে নিলো। কোমরে হাত রেখে ফিসফিস করে আকুল স্বরে বললো,
“ভীষণ ভালোবাসি কাশফি।”

কাশফি নাজুক হয়ে গেলো, কৌশিকের অবাধ্য বিচরণ কোমর হয়ে শাড়ি, বস্ত্র ভেদ করে চলে গেল কাপড়ের আড়ালে উন্মুক্ত বক্ষে। আবিষ্ট হয়ে কাশফির চুলে মুখ গুঁজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে আবার বললো,
“তুমিও কি আমার মতো একই দহনে পুড়ছো কাশফি?”

কাশফি হা না কিছুই বললো কেবল শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিন্তু পরক্ষণে কৌশিকের কাছে নিজের সমার্পনে বাধ্য সে। কৌশিকের ঘনিষ্ঠ ছোঁয়ায় গায়ে লোম দাঁড়িয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ, চেতনার অগোচরে কৌশিকের উষ্ণতা ছেয়ে গেলো তাকে, মাতিয়ে তুললো উত্তেজনার উচ্ছ্বাসে।

“চুপ থেকে না কাশফি!”

“কৌশিক প্লীজ আমায় যেতে দিন!”

“ধরেই বা কখন রাখলাম?”
কৌশিকের কন্ঠের দুর্বলতা শুনে কাশফির বুক ধক করে উঠল, মাথা পাশ ফিরে কৌশিকের চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। এতো আকুল আবেদন, এমন উন্মাদনার প্রতি সে খুবই দুর্বল। দিনে দিনে কৌশিকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে সেও। ঠোঁট কামড়ে কাশফি নিজেকে মুক্ত করে দিলো। আলগোছে কৌশিকের গলায় হাত রেখে কাছে টেনে নেয় আলিঙ্গন করে নিলো তাকে তারপর পায়ের আঙুলে ভর করে দাড়িয়ে লাজুক ভঙ্গিমায় ওষ্ঠে ওষ্ঠ মিলিয়ে দিলো।
খাঁচায় থাকা বন্য প্রাণীকে মুক্ত করে দিলো যেনো কাশফি, মুহূর্তেই তার শাড়ি এক টানে আলগা হয়ে ব্লাউজের বোতাম ছিটকে মেঝেতে পড়লো। চোখের পলক ফেলতেই নিজেকে বিছানা কৌশিকের নিচে উপলদ্ধি করতে পেলো। এক চুমুতে কাহিল করেও ছাড়লো না কৌশিক, তাকে অনুভূতির ভেলায় ভাসিয়ে দিলো। কাশফি কাতর হয়ে নিভু নিভু কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,

“Koushik, I’m out of breath.”

“Me too sunshine, me too. I can’t hold it anymore.”
কৌশিকের কথাবার্তায় কথাবার্তায় উত্তেজনার বেগ আরো গাঢ় হলো, দুজন মানব মানবীর শীৎকার প্রতিধ্বনিত হলো পুরো কামরায়।

“Fùck, I’m dying!”
কৌশিকের চাপা গোঙানির শব্দ এলো কাশফির কানে তারপর আবার সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো বক্ষস্থলে, উরুতে, কোমরে।

দেখতে দেখতে ভোরের আলো ফুটলো তবুও কৌশিক দমলো না। তীব্র রাগ, অভিমান, পিপাসা তার মাঝে, পাঁচদিনের জমানো গভীর প্রণয় এক রাতে আদো মিটানো সম্ভব?!

“থামুন কৌশিক!”
ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থায় দুর্বল স্বরে আওড়ালো কাশফি, তার হাঁপিয়ে উঠা দেখে কৌশিক প্রাণখুলে হাসলো। তার হাসির শব্দে কাশফি চোখ খুলে চেয়ে নেয়, কৌশিকের হাসি তার দেখা বড্ড দুর্লভ জিনিস।
কৌশিক কাশফির কপালে, চোখের পাতায় চুমু একে গলার ভাজে মুখ গুজে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে, তারপর পুরুষালী গলার ডিপ হাস্কী ভয়েসে আরেকবার কাশফির শরীরে ভয়’ঙ্কর কাঁপুনি তুলে দিলো।

“Do you think we are done? We are far more than done, sweetheart.”

***

কাশফি পিট পিট করে যখন চোখ খুলে তখন বিকেলের সোনালী রোদ জানালা হয়ে পুরো রুমে ঝলমলিয়ে খেলছে। পুরো কামরা পরখ করে কোথাও কৌশিকের দেখা না পেয়ে কাশফি আরমোড়া ভেঙে চাদরে মোড়ানো দুর্বল শরীর টেনে তুললো। নিজের গায়ে কৌশিকের শার্ট দেখে বিনিদ্র রজনীর স্মৃতি জেঁকে ধরলো তাকে, সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করলো নিজের মাঝে কৌশিকের অস্তিত্ব।

উঠতে গিয়ে দেখতে পেলো বিছানায় পড়ে থাকা একটা খাম, অনিশ্চিত হাতে তুলে খাম খুলতেই বেরিয়ে এলো হিমাদ্রীর উদ্দেশ্যে নয় বছর আগের তার এলেবেলে হাতের লিখা—

“শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ হিমাদ্রী, যদি পরবর্তীতে কখনো দেখা হয় তবে আমরা আর বন্ধু পরিচয় নিয়ে নয় কেবল পারিবারিক শত্রুর পরিচয় দিয়ে দেখা করবো।”

কাশফি চোখ বুলিয়ে কাপা কাপা হাতে নিচের পাতা উল্টে নেয়। খরখরে পুরোনো পাতায় কৌশিকের হাতে লিখা—

“ইহজীবনের শত্রু হয়েও তুমি কেবল আমার রও।
তোমার ধ্রুব প্রেমিক,
হিমাদ্রী।”

কাশফি গোসল সেরে রেডি হয়ে কাপড় পাল্টে নিয়ে বেরিয়ে এলো, পার্স খুলে তার ফোন নিতেই দেখতে পেলো ফোন অফ হয়ে আছে। নিজের কপাল চাপড়ে কাশফি এলিভেটর হয়ে নিচে নেমে ভেবেছিল একটা গাড়ি ধরিয়ে চলবে কিন্তু তার জন্য গাড়ি দাঁড় করানো দেখে সে কিছুটা চমকালো। তবুও বিনাবাক্যে সে গাড়িতে উঠে বসলো কিন্তু গাড়ি উল্টো দিকে চলায় কাশফি বিভ্রান্ত হলো।

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে প্লীজ বাসায় পৌঁছে আসুন।”

“ম্যাম, আমরা জেনারেল হসপিটালে যাচ্ছি। আপনার বাবা হসপিটালে ভর্তি।”

#চলবে

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৩৫)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, যার কোনো মাথাব্যথা নেই, অহেতুক চিন্তা নেই, ঝামেলাহীন জীবন যার সে কী আদো মুক্তি কামনা করতে পরে?
শত সমস্যায়, হত দরিদ্রতায়ও কেউ কেউ বেঁচে থাকার আশা নিয়ে থাকে তবে অতিকূর রহমানের মতো এমন একজন শিক্ষিত স্বাবলম্বী ব্যক্তি কেনো আ’ত্ম’ঘা’তী হবেন? কেনো তিনি আ/ত্মহ/ত্যার মতো পথ বেছে নিবেন?
আজ বিকেলের দিকে হাতের র গ কে টে সুইসাইড এটেম্পট করতে চেয়েছিলেন ঠিক সময়ে হাসপাতালে আনার ফলে বেঁচে গিয়েছেন তবে কন্ডিশন খুব একটা সুবিধার নয়, এখনও মা/রা/ত্ব/ক স্বাস্থ্য ঝুঁ/কিতে আছেন তিনি।

“কাশফি তুমি কী আবার জোন আউট হয়ে গেলে?”
কাশফির প্রখর অন্তর্দৃষ্টি রুমের হসপিটাল বেডটায়, যেখানে মেশিন সংযুক্ত নানান তার আর আইভি ক্যানুলা লাগানো তার বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। মন্থর গতিতে টিপ টিপ করে ব্যাগ থেকে রক্ত টিউব হয়ে আতিকুর রহমানের শরীরে প্রবেশ করছে। হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে প্রখর দৃষ্টি অনড় রেখে উচ্চারণ করলো কাশফি,

“আমি বুঝতে পারছিনা বাবা এমনটা কেনো করলেন?”

“হয়ত তিনি দীর্ঘকাল ডিপ্রেশন, হাইপার টেনশন কিংবা অন্য কোনো সমস্যায় ভুগছিলেন।”

কথাটা কাশফির মনে ধরলো না, ভীষণ তেতো শোনালো। সে দৃঢ় প্রত্যয় যোগে কৌশিকের কথার ঘোর বিরোধিতা করে মাথা নেড়ে নিজের যুক্তিযুক্ত কারণ দাড় করালো।

“এসবের কোনো কারণ তো থাকা দরকার, এত সাদা মাটা জীবন নিয়ে কারো কোনো নালিশ থাকে নাকি?”

“থাকতেই পারে কাশফি।”

“কিন্তু কেনো কৌশিক?!”
কাশফি মাথা ঘুরিয়ে কৌশিকের দিকে দ্বিধান্বিত চাহনি ফেলে চাইলো কিন্তু কৌশিক বেশ নিরুদ্বেগ, শান্ত আর স্থিরচিত্তে বসে আছে। বেশ অদ্ভুদ ঠেকলো কাশফির কাছে। তার গায়ে জড়ানো টিশার্ট আর পরণে জিন্স। দুই তিনবারের বেশি আজ পর্যন্ত কৌশিককে সে কোনো প্রকার আবেগ কিংবা ভাবপ্রবণতা দেখাতে দেখেনি। কী একটা অস্বাভাবিক ভয়াবহ আস্তরে আড়াল করে রাখে নিজেকে অথচ কাশফির আবেগ তার চোখে মুখে ভাসে।

“সব ‘কেনো’ র উত্তর হয়না। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হয়ত পাঁচ বছর, পাঁচ মাস কিংবা পাঁচ সেকেন্ডের ব্যাপার তাছাড়া মানুষের মন বোঝা বড্ড জটিল।”

কৌশিকের কথা শুনে কাশফি মৌন রইলো কিছুক্ষণ। তার মস্তিষ্ক ফাকা ফাকা লাগছে, কোনো অজানা অস্বস্তিতে বুকের দুরু দুরু ভাব কাটছেই না। মাথা তুলে নিকটবর্তী ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, ইতোমধ্যে দুই ঘণ্টার বেশি কে’টে গিয়েছে। কিন্তু তার প্রহর গোনা কি আজও শেষ হবে?

“বাবার কথা আপনি আমাকে আগে জানান নি কেনো কৌশিক?”

“জানালে তুমি হাউ মাউ করে কেঁদে নেয়ে ভেঙে পড়তে তারপর তোমার ভাইয়ের উপর ঠিক এর কত বিরূপ প্রভাব পড়তো তুমি ধারণা করতে পারছো?”

কাশফি মাথা নাড়লো, বুকে ঢের কৃতজ্ঞতা চেয়ে গেলো। কৌশিক তো ঠিকই বলছে, সে কেনো এমন করে ভাবতে জানে না? ম্লান হাসলো কাশফি, কৃতজ্ঞতার সুরে কোমল স্বরে আওড়ালো,

“কায়েস কে সামলানোর জন্য ধন্যবাদ।”

কৌশিক কাশফির হাতে হাত রাখলো তারপর মুখ ভর্তি গম্ভীরতা বজায় রেখে তার ধা/রা/লো পূর্ণদৃষ্টি ফেরালো কাশফির পানে, আর সেই দৃষ্টি নিমিষেই গাঢ় অনুরাগী চাহনি হয়ে ঠেকলো কাশফির কাছে। কৌশিক কাশফির হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে নিজের ঠোটের কাছে নিয়ে আলতো চুমু খেলো তারপর গলা নামিয়ে পুরু স্বরে বুঝিয়ে বললো,

“বিয়েতে আবদ্ধ দুটো মানুষের তোমার আর আমার দায়িত্ব বলতে কিছু হয় না কাশফি।”

কৌশিকের সামান্য বাক্যে কাশফির মন কেড়ে নিলো যেন। তার বশীভূত তনুমন আরেকদফায় পুলকিত হলো, মনের ভেতর শতেক প্রদীপ জাজ্বল্যমান হয়ে বিমুগ্ধ করে তুললো তাকে। কৌশিক কে যত কাছ থেকে দেখছে ততই মোহিত হয়ে ঝুঁকে পড়েছে তার প্রতি। এই মানুষটা কে ভালবাসতে কি কারণ লাগে?

“আমি কেনো আপনার মতো এতো কম্পোজড থাকতে পারি না।”

কৌশিকের মুখ খানিকটা বদলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে উদয় হলো কপালের ভাজের। চোখজোড়া স্থির হয়ে কেমন নিস্তেজ রকমের হয়ে এলো। কাশফি ঘাবড়ে গেলো, মুখ হা করে কৌশিকের দিকে অনিশ্চিত রকমের চাইলো।

“তুমি মনে করো আমার শান্ত আর কম্পোজড হয়ে থাকাটা কুল?”
কৌশিকের কণ্ঠে নিশ্চল নিস্তব্ধতা, বস্তুত ঠান্ডা ধরনের জড়তা বিরাজমান।

কাশফি তার সিধে সাধা কথায় অপরাধমূলক বা আপত্তিকর কোনো অর্থ বুঝাতে চায়নি। তাই কৌশিকের এমন অভিব্যক্তি দেখে পুরোই থতমত খেয়ে গেল,
“এমনটা নয় কি?”

কৌশিক চাপা শ্বাস ফেললো, হাত সরিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার নিজেকে আড়াল করে নেয়। তারপর কিয়ৎ রাগ সংবরণ করে নেয়।

“আমার পরিস্থিতি আমাকে এমন করে দিয়েছে কাশফি, ট্রাস্ট মি তোমার জন্য এমন থাকাটা আমি মোটেই চাইবো না।”
কাশফি বেশ অবাক হলো, হাত নিশপিশ করলো কৌশিক কে কমফোর্ট করার জন্য কিন্তু নিজের অবস্থায় দাঁড়িয়ে সে তার হয়ে কিছুই বলতে পারলো না। কৌতুহলী দৃষ্টিতে কৌশিকের দিকে চেয়ে ভাবনায় মশগুল হয়ে গেল। কি এমন ছিল কৌশিকের জীবনে যা কৌশিক কে এমন অনুভূতি শূন্য করে দিয়েছে?

কোনরকম নিজের কৌতূহল দমন করে শক্ত হয়ে বসলো কাশফি। পরিস্থিতি ঠিক করতে গলা পরিষ্কার করে স্বাভাবিক হয়ে শুধলো,

“বাবার কী আজ জ্ঞান ফিরবে?”

“তোমার বাবাকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে তবুও তারা খুব একটা আশা করছেন না। তোমার উচিত ডাক্তারের সাথে সরাসরি গিয়ে কথা বলা।”

“আমার খুব ভয় করছে কৌশিক, এই যে দেখুন হাতের তালু ঘেমে নেয়ে একাকার!”
কাশফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা হাতের তালু কৌশিক কে দেখিয়ে ঘষে ঘষে হাঁটুতে মুছতে লাগলো। কৌশিক এতে ভ্রু কুঁচকে কাশফির হাত ধরে নেয়, তারপর পকেট থেকে টিস্যু বের করে ধরিয়ে দেয়।

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তুমি যদি চাও আমি তোমার সাথে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসবো।”

কাশফি খানিকটা হেয়ালির সুরে বললো,
“আমি বলা লাগবে?”

“তোমার কমফোর্ট জোনের বাইরে আমি যেতে অনিচ্ছুক কাশফি, ইটস ওকে টু হ্যাভ ইনসিউরিটিস।”
এমন পরিস্থিতিতেও কাশফি ফিক করে হেসে ফেললো, সে কৌশিকের শক্ত পেশল বাহুতে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,

“ইউ আর মাই কমফোর্ট, কৌশিক।”

কৌশিকের ঠোঁটের কোণে হাসি উকি দিলো, তবুও সে কোনরকম চেপে নিজেকে শক্ত রাখার যথা সাধ্য চেষ্টা করলো। চোখ বুজে তৃপ্তি আর সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে কাশফির চুলে ঠোঁট ঠেকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন।

“যেও তবে আগে চলো তোমার ক্ষুদা নিবারণ করে আসি।”

“আমার ক্ষুধা লাগে নি কৌশিক।”

“সেই রাতে খেয়ে ঘুমিয়েছ, রোগীর টেনশনে নিজে রোগী হয়ে যাওয়ার দরকার নেই।”

“কৌশিক আমার সত্যিই——”
কাশফি আবার দ্বিরুক্তি করতে চাইলে কৌশিক কঠোর স্বরে হুমকির সুরে বললো,

“হাসপাতালে কোলে তোলার কিংবা চুমু খাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে না চাইলে আসো আমার সাথে।”
কৌশিকের পুরুষালি গলার হুমকি কাশফির কাছে সম্মোহনী লাগলো পরপর ভয়ঙ্কর রকমের হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলো। কাশফি ঠোঁট কামড়ে মিনমিনে স্বরে বললো,

“চলুন।”

***

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অফ হোয়াইট কেবিনে মধ্য বয়স্ক সার্জন ডক্টর মাস্ক খুলে বসেছেন মাত্র। হাতের গ্লাভস ডাস্টবিনে ফেলে কৌশিক কে দেখে হাসিমুখে বললেন,
“প্লীজ হ্যাভ আ সিট কৌশিক এন্ড মিসেস মির্জা।”

কৌশিক আতিকুর রহমানের রিপোর্ট গুলো টেবিলে রেখে সার্জনের সামনে রাখলেন।

“বাবার কন্ডিশন কেমন?”
সার্জন হাত স্যানিটাইজ করে রিপোর্ট দেখতে বললেন,

“দেখুন মিসেস মির্জা, আমরা আপনার বাবার চেকআপ আর কিছু টেস্ট করিয়েছি এবং ফলাফল খুব একটা ভালো নয়। তবে আশা করছি কালকের মধ্যে তিনি জ্ঞান ফিরে পাবেন।”

কাশফি সন্দিহান দৃষ্টি কৌশিকের দিকে ফেলে আবার ডাক্তারের দিকে চাইলো, তারপর শঙ্কা মনে প্রশ্ন করে বসলো,
“খুব একটা ভালো নয় বলতে?”

“Kidney failure, মানে তার কিডনির ৯০% অকার্যকর হয়ে গিয়েছে।”
কাশফি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তার ঘর্মাক্ত হাত এখন ভীষণ রকমের কাপছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি করে সাফাই জানালো,

“কিন্তু তার তো কোনো সিম্পটম ছিল না!”

“ইন কেইস, ছিল তবে তিনি জানান নি।”
সার্জনের শক্ত কথায় কাশফি ভয়ে জমে গেলো। এক রাশ বিস্ময় আর শঙ্কা নিয়ে হা করে ঠাই দিয়ে রইলো।

“কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব?”

“সম্ভব হবে তবে যেহেতু তার ব্লাড প্রয়োজন তাই এই প্রসিজার করতে কিছুটা সময় নিতে হবে তাছাড়া আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

“আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট চাই, ডক্টর।”

“আমরা আমাদের বেস্ট চিকিৎসা দিয়ে যেতে পারি তবে কারো রিযিক আমাদের হাতে নেই মিসেস মির্জা। All you can do is pray.”

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাশফি থেমে থেমে বললো,
“যদি আমি প্রসিজার নিয়ে আগাতে চাই…”

“তবে কিডনি ডোনার খুঁজতে হবে। আপনাদের ব্যবস্থা করতে হবে নয়ত হাসপাতাল কতৃক ব্যবস্থা করা হবে।”

কাশফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তড়িঘড়ি করে বললো,
“আমার আর আমার ব্লাড টাইপ সেম তাহলে ডোনেট করতে পারবো?”

প্রতুত্তরে ডক্টর কিছু বলবে তার আগেই কৌশিক শক্ত জবাবে কাঠ কাঠ কণ্ঠে জানিয়ে দেয়,
“তুমি ডোনেট করতে পারবে না কাশফি।”

কাশফি বিষম খেয়ে কৌশিকের দিকে চেয়ে ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেলে,
“কেনো পারবো না।”

“তোমার ব্লাড টাইপ B+ কাশফি আর তোমার বাবার O+ তবে তোমাদের ব্লাড গ্রুপ সেম কবে থেকে হলো?”
কাশফির চোখে রাজ্যের চমক, সে যেনো বিশ্বাসই করতে পারলো না। আড়ষ্ট থ মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ।

“তাহলে মিসেস মির্জা আপনি আপনার বাবাকে ডোনেট করতে পারছেন না। তবুও সন্দেহ থাকলে টেস্ট করে নিতে পারেন আর রেজাল্ট আনম্যাচ হলে আপনাদের দ্রুতই একজন ডোনারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।”

ডক্টরের চেম্বার থেকে আসা মাত্রই কাসফি তার বাবার বেডের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। তার শরীর আত্মা সব ভয়াবহ রকমের কাপছে।
এতো বছর পুরোনো ঘটনা তবে তার মানসপটে জ্বলন্ত। তার ভাইয়ের মৃত্যু, তার মায়ের গুরুতর এক্সিডেন্ট, তারপর তার মায়ের মানসিক ভরসম্যহীনতা সব স্পষ্টত। আধো আধো চোখে তার বাবা কাদো কাঁদো মুখে নিজের রক্ত দান করেছিলেন, ভাগ্যক্রমে সে জ্ঞান ফিরে সজাগ হয় উঠেছিল কিন্তু তার মায়ের সার্জারির প্রয়োজন হয়েছিল।
জীবনের এতো বড় ধাক্কা তারপর পাওয়া তিতকুটে স্মৃতি সে তো আর চোখ ঝাপটেই ভুলতে পারে না।

“বাবা, প্লীজ ফিরে এসো।”

***

“কৌশিক আপনি কি বাবার ব্লাড গ্রুপ নিয়ে নিশ্চিত?”

“টেস্ট রেজাল্ট তোমার সামনেই কাশফি।”
কাশফি ব্লাড টেস্ট হাতে নিয়ে নিশ্চল হয়ে রইলো। ভুল কি হলো নাকি? কাশফির অবিশ্বাস্য লাগলো সবকিছু মাথা নেড়ে ঘোর অসম্মতি প্রকাশ করলো।

“কিন্তু নয় বছর আগে এক্সিডেন্টে যখন আমার ব্লাড লস হয়েছিল তখন বাবাই তো আমাকে রক্ত দিয়েছিলেন।”

“ব্লাড গ্রুপ O+ ইউনিভার্সাল ডোনার কাশফি হয়ত তাই তোমাকে দিতে পেরেছিল?”
কৌশিকের এমন কথা কানে আসতেই কাশফির মেজাজ বেজায় তুঙ্গে, তার নিকট এটা চরম হেঁয়ালি হয়ে ঠেকলো। সে চোখ মুখ খিচে তেতে উঠে কৌশিককে রেগে আগুন হয়ে বললো,

“কৌশিক আপনার কি মনে হয় আমি আবোল তাবোল বকছি? আমার ভাই আর মায়ের ব্লাড টাইপ O+ এক্সিডেন্টে আমার ভাইয়ের অন স্পট ডেথ হয় আর মা খুব বাজে ইনজুরিড হয়েছিল সেদিন বাবা আমার মাকে ব্লাড ডোনেট করতে পারেননি। এসব আমার চোখের সামনে হয়েছে কৌশিক, আমি চাইলেই ভুলতে পারিনা!”
বলতে বলতে কাশফির দম আটকে আসার উপক্রম, অশ্রু ভিড়ে চোখের কর্ণিশ চিকচিক করতে লাগলো।

কৌশিক কাশফির কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
“কাশফি, শান্ত হও। আমি একজন ডোনার খুঁজে নিব।”

“কৌশিক আমি এক্ষুনি আমার ব্লাড টেস্ট করাতে চাই।”

কাশফির অটলতা আর দৃঢ় উত্তরে কৌশিক বিরক্ত হলো, চোখজোড়া কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে চোয়াল শক্ত করে চাপা স্বরে বললো,
“কাশফি, আমি বলেছি আমি ম্যানেজ করে নিব।”

“টেস্ট করাতে সমস্যা কোথায়?”

“তুমি ডোনেট করতে পারবে না কাশফি।”

কাশফি বেখাপ্পা হাসলো, তার এখানে বসে থাকতেই অসহ্য লাগছে। কপাট রাগ দেখিয়ে চোখ মুখ খিঁচে রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
“তাহলে আপনার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনার মনে হয় আমি এমন সেনসেটিভ জিনিস নিয়ে আবোল তাবোল বকছি?”

“আমি তোমাকে শান্ত থাকার জন্য বলছি, কাশফি কারণ তুমি এক সপ্তাহ দুই দিন লেইট।”
কাশফি প্রথমে কানেই তুললো না পরক্ষণে কৌশিকের কথা উপলব্ধি করা মাত্র তার চোখ কপালে উঠলো। আসলেই তার ডেট আরো আগেই পেরিয়েছে তবে… কাশফির ঠোঁট জোড়া আলগা হয়ে হা হয়ে গেলো। আরেকদফা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে থ মেরে বসে রইলো সে। তার অভিব্যক্তি ঠিক কি রূপ হওয়া দরকার তার মাথায় আসছে না।

***

তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মনে ঢের সাহস জুটিয়ে জিপলক ব্যাগদুটো একজন হসপিটাল স্টাফের হাতে বাড়িয়ে ধরলো কাশফি, ঢোক গিলে কুণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“রিপোর্ট কখন দেওয়া হবে?”

“চব্বিশ ঘণ্টা পর ম্যাম।”

#চলবে