শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব-০৪

0
230

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_০৪

ফারিশ আর নিধি দুজনেই মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিধিকে এখনো চুপ করে থাকতে দেখে ফারিশ এবার প্রচুর রেগে যায়। ফারিশকে রেগে যেতে দেখে ঘাবড়ে যায় নিধি। বিভ্রান্তিতে লুটোপুটি খেয়ে নিধি বলে,

“কি বলছেন আপনি!”

“বুঝতে পারছো না কি বলেছি?”

ফারিশের কথা শুনে নিধি নিভু সুরে বলে,

“না।”

নিধির কথা শুনে ফারিশ হুট করে নিধির এক বাহু টেনে ধরল। ফারিশের কাজে হতভম্ব হয়ে যায় নিধি।

“ডোন্ট আন্ডারস্টিমেট মি নিধি! যা বলছি তার উত্তর দাও, নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে!”

নিধি বুঝতে পারল ফারিশ সত্যটা না জেনে তাকে আর ছাড়ছে না। নিধি নিভু সুরে বলতে শুরু করল,

“আমি যখন দশম শ্রেনিতে পড়তাম, তখন অয়ন আমার পিছন পিছন ঘুরতো। সারাদিন আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করতো। তখন বয়স আমার কতোই বা ছিলো! অয়নের এসব পাগলামি দেখে আর না করতে পারলাম না তাকে। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি তখন। সবকিছু ঠিকই চলছিলো ২ বছর। কোনোদিন মনে হয়নি ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কোনোদিন কোনো বাজে প্রস্তাবও দেয়নি আমাকে অয়ন। যার জন্য আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। একদিন হঠাৎ অয়ন এসে কোনো কারণ ছাড়াই আমার সাথে ঝগড়া করতে শুরু করে দেয়। আমি বুঝতেও পারিনি, আমার কি দোষ ছিলো যে ও আমার সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার শেষপ্রান্তে সে আমাকে বলে, আমার মত এতো নিচ ফ্যামিলির মেয়েকে তার পরিবার মেনে নিবে না। তার সাথে আমি যেনো আর যোগাযোগ না করি। সেও আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। এসব বলে সেদিন অয়ন চলে যায়। তখন আবেগ হয়তো আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল, তবে আমি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে ছিলাম!”

বলেই থামে নিধি।

“কি হয়েছে তারপর? অর্ধেক বলে থেমে যাচ্ছো কেনো? রাতে কি খাবার খাওনি নাকি?”

ফারিশের কথা শুনে নিধি অবাক চিত্তে ফারিশের দিকে তাকায়।

“শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই তো বলেছি।”

ফারিশের ব্যাকুল চিত্ত হতাশ হলো, ফারিশ চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,

“আমি সবকিছুই জানি মেয়ে! আমার কাছে সব সত্যি বলো, আমি কিছু বলবো না তোমাকে!”

নিধি এবার একটু রেগে যায়, কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,

“কি আজব! সবকিছুই তো বলেছি। আমি আপনার থেকে কি লুকাবো আর?”

নিধির কথা শুনে ফারিশ সজোরে নিধির গালে থা’প্পড় দিয়ে বলে,

“অয়নের সাথে রাত কাটাসনি তুই? কি মনে করেছিস তুই, আমি কিছু জানতে পারবো না? আমাকে কি তোর এতোই বোকা মনে হয়?”

নিধি বিস্ময়াবহ! সে কল্পনাও করেনি ফারিশ তাকে চ’ড় মারবে তাও আবার ভুল কিছু শুনে! নিধির আর কিছু জানার আগ্রহ রইল না। টলমলে পায়ে হেটে নিধি বেলকনিতে চলে যায়।
★★
নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ হয়ে আছে চারিদিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। বাহিরের দমকা হাওয়ায় চুল উড়ছে নিধির। আকাশে মেঘেরা পাল্লা দিয়ে চলছে। বিষাদের নিবিড়তা যখন চারিদিক জুড়ে, আচমকা পাশ হতে কেউ একজন নিধির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

“মিথ্যে বলা আমার একদম পছন্দ না মেয়ে! সত্যটা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। তাই তো আমি এসেই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি সব।”

ফারিশের কথা শুনে নিধি তার দিকে ফিরে তাকায়। নিধি অবলীলায় বললো,

“আমি প্রথমেই বলেছি, অয়ন আমাকে কখনো কোনো বাজে প্রস্তাব দেয়নি। সেখানে আমরা কিভাবে রাত কাটাবো! আপনার কি আমাকে এতোই খারাপ মনে হয়? এসব আপনাকে কে বলেছে?”

নিরুত্তর ফারিশ নিষ্পলক চেয়ে থাকে, কিছুক্ষণ আগে করা কাজের জন্য ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সে। অফিসে যাওয়ার পরই অয়নের বয়ান শুরু হলো, নিধি তাকে ঠকিয়েছে, নিধির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সময় কেটেছে। আরো কত কি! এসব শুনেই ফারিশ আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাহিরের কাউকে নিয়ে এসব বললে ফারিশ হয়তো চুপ করে থাকতো, কিন্তু তার ব্যাক্তিগত জীবনের সাথে জুড়ে থাকা মানবীকে নিয়ে এসব বলাতে ফারিশ চুপ করে থাকতে পারেনি। অয়নের সাথে তো এসব নিয়ে রাগারাগি হয়েছেই, আবার বাসায় এসে নিধির কাছ থেকে সত্যটা জানতে চায় সে। তখন অয়নের রাগ সব নিধির উপরেই উঠায় ফারিশ। ফারিশ কে চুপ করে থাকতে দেখে নিধি বলে,

“খাবার দিচ্ছি, খেতে আসেন।”

নিধির কথা শুনে একমুহূর্তের জন্য নিধির উপর থেকে সব বিরক্তি দূর হয়ে যায় ফারিশের। একটু আগে কি খারাপ ব্যবহারটা না করেছে সে নিধির সাথে। অথচ! কি সুন্দর নিধি সবকিছু ভুলে এখন তাকে খেতে ডাকছে!
**
নিধি ডাইনিং টেবিলের উপর খাবার এনে রাখে। ফারিশ এসে চেয়ার টেনে বসে। নিধি ফারিশকে সযত্নে খাবার বেড়ে দেয়। খাবার বেড়ে দিয়ে নিধি রুমের দিকে পা বাড়ায়।

“নিধি।”

ফারিশের মুখে নিজের নাম শুনে চকিতে পেছন ফিরল নিধি। অবাক হয়ে বললো,

“কিছু লাগবে?”

“খেতে আসো।”

ফারিশের কথা শুনে নিধি হতভম্ব হয়ে যায়। ফারিশ কি করে জানলো সে খাবার খায়নি? নিধির কল্পনার মধ্যে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ফারিশ নিধিকে ধমক দিয়ে বলে,

“খেতে ডেকেছি শুনছো না? সবকিছু নিয়ে তোমার উপর এতো চেঁচামেচি করতে হয় কেনো আমাকে? সোজা কথা হজম হয় না তোমার?”

ফারিশের ধমক খেয়ে চুপসে যায় নিধি। নিধি মিনমিন করে বলে,

“সারাদিন আপনার ধমক খেয়েই তো পেট ভরে যায়, খাবার খাওয়ার আর কি প্রয়োজন!”

“কিছু বলেছো?”

“না না, কি বলবো আমি! আমি কি কিছু বলতে পারি নাকি?”

নিধির কথা শুনে ফারিশ তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। তা দেখে নিধি তাড়াতাড়ি এসে চেয়ার টেনে ফারিশের পাশে বসে পড়ে।

“অয়ন তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, তুমি তাকে আঁটকাতে চাওনি কেনো?”

ফারিশের কথা শুনে থমকে যায় নিধি, মানুষ নাকি তার বউ এর কাছ থেকে প্রাক্তন কে না আটকানোর গল্প শুনতে চায়! কি অদ্ভুত বর তার!

“কথায় আছে না, ভাগ্যে না থাকলে সাধ্যের মধ্যে থাকা প্রিয় জিনিসও হারিয়ে যায়, তেমন আরকি!”

ফারিশ বুক ভাঙা শ্বাস ফেলল! নিধির কথাটা কঠিন হলেও সত্য! যেটার বাস্তব প্রমাণ সে নিজেই।

“অয়ন কে এখনো ভালোবাসো?”

”জীবনে কেউই আমাকে আমার মত করে বুঝেনি। কি হবে আর মিছে মায়ায় জড়িয়ে থাকার!”

নিধির কথা বলার ধরনে থতমত খেয়ে যায় ফারিশ। সে বুঝতে পেরেছে নিধি কথাটা তাকেই ইঙ্গিত করে বলেছে। তাই কথা ঘুরানোর জন্য বলে,

“এসব তুমি রান্না করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“ওহহ, তাই তো বলি এতো বাজে খাবার তো বাড়ির কেউ বানাবে না।”

ফারিশের কথা শুনে নিধি হতবিহ্বল হয়ে যায়, সবাই তার রান্নার অনেক প্রসংশা করে, সেখানে ফারিশ একথা বলেছে!

“রান্না মজা হয়নি তো খাচ্ছেন কেনো?”

নিধির কথা শুনে ফারিশ খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলে,

“খুধা লেগেছে খাবো না?”

ফারিশের কথা শুনে নিধি আর কিছু বলে না। ফারিশ খাবার খেতে খেতেই বলে,

“শুনো মেয়ে, আমার বাড়িতে তুমি আমার বউ হয়ে এসেছো। তোমার সাথে আমারও মানসম্মান জুড়ে আছে। তোমার জন্য সেটা যেনো নষ্ট না হয় বলে দিলাম। অয়নের থেকে দশ হাত দূরে থাকবে। তোমাকে ওর কাছাকাছি দেখলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম!”

“শুধু কি আপনার সম্মান নষ্ট হবে বলে ওর থেকে দূরে থাকতে বলছেন নাকি জেলাস..”

নিধিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফারিশ চোখ রাঙিয়ে বলে,

“যা বলেছি তাই করবে, তর্ক কোরো না মেয়ে!”

ফারিশের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় নিধির।

“আপনি একটু আগে যে নরম কন্ঠে কথা বলেছেন আপনাকে তাতেই মানায়, এতো কঠোর মানুষ হওয়া আপনাকে মানায় না।”

নিধির কথা শুনে ফারিশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“কেউ আর এমনি এমনি কঠোর হয়ে যায় না, তীব্র আঘাত পেতে পেতে একসময় মনটা পাথরে পরিণত হয়।”

বলেই ফারিশ হাত ধুয়ে রুমে চলে যায়। আর নিধি বসে বসে ফারিশের বলে যাওয়া কথাটার কারণ খুজছে।

চলবে………