শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব-১০

0
255

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_১০

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। পাখিরা ব্যাস্ত হয়ে তাদের নীড়ে ফিরছে। সেদিকে নজর নেই নিধির, সে নিস্তব্ধ হয়ে রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চে বসে আছে। হুট করে নিধির সামনে তিনটা ছেলে এসে দাড়ায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিধি চুপসে যায়। সে ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তার আগেই তিনটা ছেলের মধ্যে একজন নিধির দিকে একটা জলন্ত সিগারেট ছুড়ে মারে। জলন্ত সিগারেট টা এসে নিধির পায়ে পড়ে। তিনজনের মধ্যে থেকে একটা ছেলে এগিয়ে এসে নিধির হাত ধরতে যেতেই ভয়ে ছেলেটার চোখমুখ চুপসে যায়। তিনটা ছেলেই দৌড়ে সেই স্থান ত্যাগ করে। পুরো ব্যাপারটা যেনো নিধির মাথার উপর দিয়ে গেলো। কি হয়েছে সেটাই বুঝতে পারলো না সে। হঠাৎ ছেলেগুলোর পরিবর্তন দেখে বেশ অবাকই হয় সে। নিধি আর দেরি না করে একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে। এখান থেকে কিছুটা দূরেই নিধির একটা ফ্রেন্ডের বাসা আছে। সেখানেই আপাতত দু একদিন থাকবে ভেবেছে নিধি। নিধি রিক্সায় উঠে যেতেই গাছের আড়াল থেকে একটা ছেলে বের হয়ে আসে।

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয় ইকরা। দরজা খুলে প্রানপ্রিয় বান্ধবী কে দেখে খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠে ইকরার। সে এক হাতে নিধি কে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,

“ভুলেই তো গিয়েছিস তোর মিতা কে। কতদিন বলেছি ঢাকা এসে কয়েকটা দিন আমার সাথে থেকে যা, আমার একা একা ভালো লাগে না এখানে। তুই শুনলি কই সেটা! আজ হঠাৎ করে এতোবছর পর তোকে দেখে সত্যিই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।”

ইকরার কথা শুনে নিধি হেসে ফেলে।

“আনন্দ হচ্ছে, তো কাদছিস কেনো?”

নিধির কথা শুনে হেসে ফেলে ইকরা, সে দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে নিধিকে ঘরে ডুকার জন্য জায়গা করে দেয়। অনেক দিন পরে পুরনো বান্ধবী কে ফিরে পেয়ে দুজনেই গল্পে মেতে উঠে। গল্প করতে করতে নিধি তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও ইকরা কে খুলে বলে। এতে ইকরা কিছুটা ব্যথিত হয়ে বলল,

“কি মানুষ রে বাবা! তুই তো ওই অয়ন শ্লার কথা তোর বরকে বলেছিস, তাহলে তোর বর ওই মেয়েটা সম্পর্কে তোকে বললে কি এমন ক্ষতি হতো? আসলে আমরা মেয়েদের কেউ আপন ভাবতে চায় না। কিছু থেকে কিছু হলেই গায়ে হাত তুলবে, নয়তো বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলবে।”

ইকরার কথা শুনে নিধি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“সব ছেলে এমন না রে, কিছু কিছু পুরুষ আছে যারা মন উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। সেই পুরুষদের সঙ্গী আসলেই ভাগ্যবান।”

“আচ্ছা বাদ দে, তোর বর কি করে? নাম কি?”

“নিজেদের একটা কোম্পানি আছে, উনার নাম ফারিশ।”

নিধির কথা শুনে ইকরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

“কি বলিস! পুরো নাম কি? তোর জিজুর অফিসের বসের নামও ফারিশ।”

নিধি ইকরার কথা কে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,

“দুনিয়াতে কতো ফারিশ আছে, আর আমার মনে হয় না জিজু উনার মত হম্বিতম্বি করা মানুষের অফিসে কাজ করবে।”

“আরে তুই বল না প্লিজ!”

“মেহরাব ফারিশ শিকদার।”

নিধির কথা শুনে ইকরা পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। তবুও ইকরা সেটা নিধি কে বুঝতে না দিয়ে বলল,

“আচ্ছা বাদ দে, তোর যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পারিস। আমারও ভালো লাগবে, তাছাড়া তোর জিজু তো সারাদিন অফিসেই থাকে।”

ইকরার কথা শুনে নিধি তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ দোস্ত, আর দোয়া কর আমি যেনো খুব শিগরই একটা জব পেয়ে যাই। বাড়িতে গেলেও তো লা”ত্থি দিয়ে বের করে দিবে, এরচেয়ে একটা জব খুঁজে নিজের খরচ নিজেই বহন করি!”

“তোর পরিবারটা কেনো যে তোর সাথে এমন করে কে জানে!”

“বাদ দে এসব।”

“আচ্ছা।”
_____________

ইকরাদের ফ্ল্যাটে দুইটা বেডরুম, আর একটা গেস্টরুম আছে। ইকরা আর তার বর একটা বেডরুমে থাকে, আর অন্য বেডরুম টা নিধিকে থাকতে দেয় ইকরা। ইকরা নিধির রুমে এসে তাকে ডিনার করতে ডাকে। নিধিও বাধ্য মেয়ের মত ইকরার সাথে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। খাবার খেতে খেতে ইকরা নিধির চাকরির ব্যাপারে কথা উঠায়। ইকরা তার বর কে বলল,

“তুমি দেখো না নিধির জন্য কোনো চাকরি পাও কি না! ওর এখন একটা জবের অনেক প্রয়োজন।”

ইকরার কথা শুনে তার বর পিয়াশ মাথা নেড়ে বলল,

“চাকরি চাইলেই তো পাওয়া যায় না, একটু অপেক্ষা করতে হবে। তা নিধি তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”

“অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে।”

নিধির কথা শুনে পিয়াশ বলল,

“যদিও চাকরি পাওয়াটা একটু কষ্টে হয়ে যাবে, তবুও চেষ্টা করবো আমি।”

পিয়াশের কথা শুনে নিধি তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। খেতে খেতে নিধি আর পিয়াশ কুশল বিনিময় করে নেয়।

পরদিন অফিসে যেতেই পিয়াশের বস তাকে ডেকে পাঠায়, এদিকে হুট করে বস ডেকে পাঠিয়েছে শুনে ভয়ে চুপসে যায় পিয়াশ। কি ভুল করেছে সেটাই ভাবতে ব্যাস্ত সে, এসব ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় বার আবার একজন এসে তাকে বললো বস তাকে ডাকছে। এবার আর বসে না থেকে পিয়াশ গুটিগুটি পায়ে হেটে বসের কেবিনের সামনে যায়। দরজার সামনে দাড়িয়ে পিয়াশ ভীতু গলায় বলল,

“কামিং স্যার?”

পিয়াশের কথা শুনে তার দিকে তাকায় ফারিশ। ফারিশের চোখগুলো লাল হয়ে আছে, মনে হয় না রাতে ঘুমিয়েছে সে। ফারিশ ইশারায় পিয়াশ কে আসতে বলে। ফারিশ বেশ শান্ত গলায় বলল,

“বসো।”

ফারিশের এত শান্ত গলায় কথা শুনে পিয়াশ এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। কে জানে এখন তার উপর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে যাবে!

“কি আশ্চর্য! বসতে বলেছি তো!”

ফারিশের ধমক খেয়ে পিয়াশ তাড়াতাড়ি চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ফারিশ কলম হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল,

“কালকে তুমি একজন অপরিচিত নারী কে তোমার বাসায় আশ্রয় দিয়েছো তাই না?”

ফারিশের কথা শুনে হতভাগ হয়ে যায় পিয়াশ, যে লোক কাজ ছাড়া কোনোদিন “ভালো আছো?” সেটা জিজ্ঞেস করেনি, সেই লোক কি না এসব আজাইরা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে!

“অপরিচিত না স্যার, ও আমার ওয়াইফের বান্ধবী।”

“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম, তা কেনো তোমাদের বাসায় থাকছে সে?”

ফারিশের কথার জবাবে ঠিক কি বলবে পিয়াশ ভেবে ফেলো না।

“ওর সৎ মা ওকে অনেক অত্যাচার করে।”

“আর?”

“তার বরও অন্য নারীতে আসক্ত! এই অবস্থাতে তার থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই জব পাওয়া পর্যন্ত আপাতত আমাদের বাসায় থাকবে। আমরাই ওকে বলেছি থাকতে!”

পিয়াশের কথা শুনে রাগে থরথর করে কাঁপছে ফারিশ। সে টেবিলের উপর একটা ঘু’ষি মেরে বলল,

“আমার বউ চাকরি করবে!”

ফারিশের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় পিয়াশ, ফারিশ কি বলছে পিয়াশ কিছুই বুঝতে পারলো না।

“কি বলছেন স্যার! আপনি বিয়ে করেছেন? আর আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেনো?”

পিয়াশের কথা শুনে ফারিশ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“নিধি আমার বউ, পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। ওই চি’টার অয়ন কে তো তুমি চেনোই, ও গিয়ে আমার ওয়াইফ কে যা নয়তো তা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। আমিও রাগের মাথায় নিধির সাথে অনেক খারাপ বিহেভ করেছি, যার কারণে ও বাড়ি থেকে চলে এসেছে।”

ফারিশের কথা শুনে তো পিয়াশ একদম অবাক হয়ে গেছে।

“এখন আপনি কি ম্যাম কে ফিরিয়ে আনতে যাবেন?”

পিয়াশের কথা শুনে ফারিশ চুপ করে থাকে, কোনো জবাব দেয় না সে।

“আমি জানি নিধি কোনোদিনই আর আমার কাছে ফিরে আসবে না। ও সহজে রাগে না, অনেক শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে ও, কিন্তু একবার রেগে গেলে তা আর কমবে না জানি। পিয়াশ, আমি ওকে হারাইতে চাই না ভাই। তুমি প্লিজ কিছু একটা করো!”

ফারিশের এরকম অসহায় চেহারা দেখে পিয়াশ তো পুরোই হতভম্ব হয়ে যায়। সে কিভাবে ফারিশ কে সাহায্য করবে সেটাই ভাবছে!

ড্রয়িংরুমে বসে বসে নিধি টিভিতে টম & জেরি দেখছে। ইকরা রান্নাঘরে রান্না করছে। নিধি অবশ্য তাকে সাহায্য করতে চেয়েছে, কিন্তু ইকরা জোর করে তাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দেয়। তাই বাধ্য হয়ে নিধি টিভি দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠে। ইকরা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,

“নিধি দেখ তো কে এসেছে!”

নিধি কোলের উপর থেকে রিমোট টা রেখে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দিয়ে নিধি পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। রাগে ফুঁসতে থাকে নিধি।

চলবে…….