#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৫
এই মেয়েটির নাম হলো সুস্মিতা। নামের মতই তার হাসি সুন্দর। সম্পার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘ভিতরে আসবো?’
এ বাসায় কাউকে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার ও কে! তবুও বলল,
-জি আসুন।
সুস্মিতা ভিতরে ঢুকে শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। ইদানিং এত গরম পড়ছে! ও গাড়ি নিয়ে এসেছে। তবুও গলা শুকিয়ে গেছে। সম্পাকে বিনয়ের সাথে বলল,
-আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেওয়া যাবে?
-অবশ্যই যাবে। আপনি বসুন। আমি নিয়ে আসছি।
এ বাড়িতে এমনি ঝামেলার শেষ নেই। এই মেয়ে আবার কেন এসেছে। আশ্চর্য কারবার!
সম্পা ঠাণ্ডা পানি আনতে গিয়ে দেখলো ফ্রিজ লক করা। কয়দিন ধরে ভ্যাপসা গরম পড়ছে। রান্নাঘরে গরমটা আরো বেশি লাগে। এই গরমে সমস্ত রান্না একা করে ওর মেজাজ বাইরের আবহাওয়ার চেয়ে এই মুহুর্তে আরো বেশি উত্তপ্ত। সম্পাও একটু ঠাণ্ডা পানি খেতে চেয়েছিল। ফ্রিজের ভিতর কি এমন আছে যে সেটাকে লক করে রাখতে হবে! পলি বেগমের কাণ্ডকারখানা দেখলে এত রাগ হয়, প্রচণ্ড রাগ। সেই রাগ নিঃশব্দে হজম করা খুব কঠিন ব্যাপার। ইদানিং সে খাবার-দাবার সব আটকে আটকে রাখছে। নিশ্চয়ই এভাবে এশাকে শায়েস্তা করতে চাচ্ছে।
সম্পা এক গ্লাস লেবুর শরবত গুলে নিয়ে গেল সুস্মিতার জন্য। সুস্মিতা ঠাণ্ডা পানি ভেবে এক ঢোক খেয়ে রেখে দিলো। মেয়েটির কাছে ঠাণ্ডা পানি চেয়েছে। সে বোধ হয় একটু আতিথেয়তা করতে শরবত নিয়ে এসেছে।
-আপনি শরবত খেতে পছন্দ করেন না?
-আমি মিষ্টি জাতীয় কিছুই পছন্দ করি না।
সম্পা রাগের মাথায় ফট করে বলে ফেলল,
-আমার শাশুড়ি মা ফ্রিজ লক করে রেখেছে। সেজন্য আপনাকে ঠাণ্ডা পানি দিতে পারছি না। দুঃখিত। আপনি ফুয়াদকে বিয়ে না করে ভীষণ ভালো করেছেন। বড় বাঁচা বেঁচেছেন।
-আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?
-ছবিতে দেখেছিলাম।
-ও আচ্ছা।
সম্পা এবার একটু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল,
-আপনি হঠাৎ এখানে কেন এসেছেন?
-বিশেষ কোনো দরকারে আসিনি। এমনি।
সুস্মিতা একটু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-ফুয়াদ কোথায়? বাসায় আছে?
-না অফিসে। আপনি ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
-না, ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। বাসায় কি এই মুহুর্তে আপনি একা আছেন?
-না। আমার শাশুড়ি মা, বড় ভাবী, ফুয়াদের বউ আছে। তাদের ডাকবো?
সুস্মিতাকে একটু বিষণ্ণ দেখালো। সে এই বিষণ্ণতা লুকানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,
-ফুয়াদ সত্যি বিয়ে করেছে?
-হুম। আপনি জানেন না?
-শুনেছি। তবে বিশ্বাস হয়নি।
সম্পা এরপর বলার মত কিছু পেল না। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই ওর সাথে গল্প করতে আসেনি। ফুয়াদের সঙ্গেও নাকি দেখা করতে আসেনি। তাহলে কেন এসেছে? কাউকে ডাকতেও বলছে না। অদ্ভুত ব্যাপার! ও কি এখন বসে বসে এভাবে গল্প করবে?
-কাউকে ডাকবো?
সম্পা আবার জিজ্ঞেস করল। সুস্মিতা বলল,
-আপনার কি তাড়া আছে?
-না তাড়া নেই। কিন্তু আপনি কি এখানে আমার সাথে গল্প করতে এসেছেন?
-না তা অবশ্য আসিনি। আচ্ছা ফুয়াদ এখন কি করছে? চাকরি নাকি ফ্যামিলি বিজনেসেই আছে?
-ফ্যামিলি বিজনেসেই আছেন।
-ফুয়াদের বউ চাকরি করে নাকি পড়াশোনা?
-কোনোটাই না। বিয়ের আগে পড়াশোনা করত। এখন সেটিও বন্ধ।
-ওহ। কোন ক্লাসে পড়তো?
-অনার্স থার্ড ইয়ার।
সুস্মিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সম্পাকে বলল,
-আমি বিশেষ কোনো দরকারে আসিনি। এ বাড়ির কারো সাথে দেখা করতেও আসিনি। তবে আপনাকে পেয়ে বোধ হয় ভালো হলো। আমি আপনার সাথেই একটু কথা বলে চলে যাবো।
এই মেয়েটি নাকি খুব ধনী পরিবারের। দেশের বাইরে থেকে লেখাপড়া করেছে। তার শখ হলো ভ্রমণ করা। ফুয়াদের সঙ্গে যখন বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন শুনেছিল এই বয়সেই নাকি সে ত্রিশটা দেশে ঘুরেছে। এখন নিশ্চয়ই আরো বেশি হবে।
সুস্মিতাকে তখন খুব দাম্ভিক, নাক উঁচু কল্পনা করেছিল সম্পা। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের পরিচয়ে ওর সেই ভুল ভাঙলো। সুস্মিতার আচার ব্যবহার, কথাবার্তায় দারুণ বিনয় আর নম্রতা।
সম্পা একটু ইতস্তত করে বলল,
-আমার শাশুড়ি মাকে একটু ডেকে দেই? আপনি এ বাসায় এসেছেন অথচ আমি তাকে ডাকিনি জানলে ঝামেলা হবে।
-ঠিক আছে যাওয়ার আগে আমি তাহলে তার সঙ্গে দেখা করে যাবো। আচ্ছা এখন আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো।
-কি কথা?
-ফুয়াদকে বিয়া না করা আমার জন্য রাইট
ডিসিশন ছিলো নাকি রং? এই ব্যাপারটা আমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা দেয়।
-অবশ্যই রাইট ডিসিশন ছিলো। আপনি তো আর আমাদের মত সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। বিদেশী ডিগ্রি, দেশ-বিদেশ ঘোরা বন্ধ করে আটপৌরে গৃহিণীর মত জীবন কাটাবেন।
সুস্মিতার চোখে মুখে অসহ্য দুঃখ দেখা গেল। সে বেদনা জর্জরিত কণ্ঠে বলল,
-এসব যুক্তি আমার মনকে কেন শান্ত করতে পারছে না বলুন?
সম্পা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সুস্মিতার চোখ ভেজা দেখালো। একটু পরই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো। সম্পা বিব্রত বোধ করলো। এই মেয়েকে এখন ও কি বলে সান্তনা দিবে!
সম্পার সান্তনা দেওয়ার দরকার হলো না। সুস্মিতা তার হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়।
সেই কখন চুলায় মাংস বসিয়ে রেখে এসেছে। আছে নাকি পুড়ে ছাই হয়েছে! সর্বনাশ হবে তাহলে। সম্পা দ্রুত রান্না ঘরের দিকে ছুটে যায়। ঝোল সব টেনে গেছে। নিচে সামান্য লেগেছে। তবে পোড়া গন্ধ আসছে না। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।
সম্পা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল না। ও পলি বেগমের রুমের দিকে গেল। সুস্মিতার আসার খবরটা পলি বেগমকে জানানো উচিত। যদিও সে বলেছে যাওয়ার সময় দেখা করে যাবে। কিন্তু সম্পার কেন যেন মনে হচ্ছে সে দেখা না করেই চলে যাবে। পরে আবার এটা জানাজানি হলে ও মুশকিলে পড়বে।
পলি বেগমের রুম ভিতর থেকে আটকানো। সম্পা কয়েকবার কড়া নাড়লো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুপুরে এই সময় সে প্রায়ই ঘুমায়। তার ঘুম খুব ভার। অনেকক্ষণ যাবৎ ডেকেও লাভ হলো না।
মারুফাকে ডাকবে? একবার ডাকতে চাইলেও পরে আবার ইচ্ছা করলো না। বদমাশ একটা! সব কাজ ওর উপর চাপিয়ে নিজে আরাম করছে।
এশাকে খবরটা দিবে কিনা সেটা নিয়ে খাকিনক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো সম্পা। স্বামীর প্রাক্তন বাড়িতে এসেছে নিশ্চয়ই খুশির খবর না। মেয়েটার শরীর অসুস্থ। এই অখুশির খবরটা ওকে দিয়ে লাভ নেই।
সম্পা লিভিং রুমে এসে দেখলো সুস্মিতা এখনো শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন তার কোনো তাড়া নেই। সে কি আজ সারাদিন এভাবেই বসে থাকবে? মেয়েটার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে না। কিন্তু সে হঠাৎ এ বাড়িতে কেন এসেছে কারণটা স্পষ্ট না। এখন তো মনে হচ্ছে শুধু মাত্র সম্পার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে। খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো!
-তরকারি কি পুড়ে গেছে?
-আর একটু দেরি হলেই পুড়ে যেত।
-আচ্ছা আমি এখন উঠি। ফুয়াদের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমার ইচ্ছে করছে না।
-আপনি আসলে কেন এসেছেন বলুন তো?
সুস্মিতা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আরেকটি গলা ভেসে আসলো। এশা লিভিং রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্বল গলায় বলল,
-ভাবী আপনার থার্মোমিটারটা একটু দেওয়া যাবে? জ্বরটা মেপে দেখবো।
কথাটা বলার পর সুস্মিতার দিকে চোখ গেল। ও সম্পার দিকে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সম্পা কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবে বুঝতে পারলো না।
-ফুয়াদের বউ?
সুস্মিতা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো সম্পাকে। ও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সুস্মিতা সোফা ছেড়ে উঠে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে এশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-হাই! আমি ফুয়াদের বন্ধু। এখান দিয়ে যাওয়ার পথে ভাবলাম একটু বসে যাই। কিন্তু ফুয়াদকে বাসায় পেলাম না।
-আপনি বসুন। ফুয়াদ দুপুরের খাবার খেতে এক্ষুণি বাসায় আসবেন বোধ হয়। আপনিও দুপুরে খেয়ে যাবেন।
এখানে আসা মোটেই উচিত হয়নি! কি দরকার ছিলো! নিজের মনকে শান্ত করতে এসে যেন আরো অস্থিরতা বাড়িয়েছি। ফুয়াদের সাথে বিয়ে হলে ও ভালো থাকতো না, ফুয়াদকে ছেড়ে চলে গিয়ে ও ভুল করেনি সেটা নিজের চোখে দেখতে এসেছে। এবং দেখেছে ও তো। তবুও কেন হাঁসফাঁস লাগছে? বুকের ভেতর ছটফট করছে!
ফুয়াদের কানের কাছে ফোন। সে ফোনে কথা বলতে বলতে বাসার ভিতরে ঢুকলো। বাসার দরজা চাপানোই ছিলো। কলিংবেল বাজানোর দরকার হয়নি। দুপুরে খাবার খেয়ে বিকালে একটা কাজে যাবে। আইইএলটিএস এর জন্য বই কিনতে হবে। ফোনে কথা বলতে বলতে অমনোযোগী ভাবে লিভিং রুমে প্রবেশ করে ফুয়াদ। সেখানে পা রেখেই ও থমকে গেল। ওর হৃৎস্পন্দন কয়েক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৬
ফুয়াদকে এত বিধ্বস্ত আর এলোমেলো মনে হলো! সুস্মিতাকে দেখে ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী ঝড়ে ভেঙেচুরে যাওয়ার মত অবস্থা হলো তার। নিজেকে সামলানোর খুব চেষ্টা করলো। এশা এখানে উপস্থিত। যত যা হোক মেয়েটা ওর বউ। কিন্তু নিজের ব্যাকুলতা, অস্থিরতা পুরোপুরি লুকাতে পারলো না ফুয়াদ। অবিশ্বাস্য গলায় প্রথমে বলল,
-সুস্মি তুমি!
সুস্মিতাকে স্বাভাবিক দেখালো। পুরানো বন্ধুর সাথে অনেকদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দ তার মুখে। যদিও এই অভিব্যক্তি মিথ্যা। তার হৃদয়-মন তীব্র যন্ত্রণায় ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। সব অনুভূতি কি আর প্রকাশ করা যায়!
-এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম একটু বসে যাই। তোমার বউকেও দেখে গেলাম। ভীষণ মিষ্টি দেখতে।
ফুয়াদ কিছু বলল না। বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। কিরকম অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ তৈরি হলো ওদের দুইজনের জন্য। এশা কি কিছু আন্দাজ করতে পারছে? তার মুখ দেখে অবশ্য কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি বলেছে সে ফুয়াদের বন্ধু। তার সাথে কথাবার্তা না বলে রুমে বসে থাকা খারাপ দেখায়। সেজন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
-দুপুরে খেয়ে যাবে। বসো। আমি একটু ক্লান্ত। আসছি।
এই বলে ফুয়াদ নিজের রুমের দিকে চলে গেল। এশা একটু অবাক হলো। তাদের আচরণ বন্ধুদের মত সহজ মনে হলো না। কিরকম একটু জটিল মনে হচ্ছে। নাকি ও একটু বেশি ভাবছে!
-ও অফিস করে বোধ হয় খুব ক্লান্ত। বিশ্রাম নিক। আমি বসবো না। দুপুরে আমার দাওয়াত আছে এক জায়গায়। খেয়ে যাওয়াও সম্ভব না।
এশার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সুস্মিতা। এই বলে সে সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ফের সাধার মত সুযোগও দিলো না।
পলি বেগম ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরেছে। লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল,
-বাসায় কেউ এসেছিল? গলা শুনলাম মনে হলো।
সম্পা বলল,
-ফুয়াদের বন্ধু এসেছিল। চলে গেছে।
বাড়ির পরিবেশ পছন্দ নয় বলে ফুয়াদ কখনো এখানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে না। আজ হয়ত এসেছিল কোনো দরকারে। পলি বেগম এটা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
সম্পা এশাকে বলল,
-আসো তোমার জ্বরটা মেপে দিই।
এশা সম্পার সাথে তার রুমে গেল। জ্বর মেপে দেখল একশ চার ডিগ্রি।
-ফুয়াদকে ওষুধ আনতে বলোনি?
-না।
-কেন?
-এমনি।
এশা একটু থেমে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি লিভিং রুমে বসে এই মেয়েটার সাথেই কথা বলছিলেন? গলা শুনছিলাম অনেকক্ষণ ধরে।
-হ্যাঁ। আমি ছাড়া তো আর কেউ ছিলো না। সবাই যার যার রুমে।
-মেয়েটা কি সত্যি ফুয়াদের বন্ধু?
-তোমার কি অন্য কিছু মনে হচ্ছে?
-দুইজনের আচরণ কেমন মনে হলো। আপনি মেয়েটাকে আগে থেকেই চিনতেন?
-তোমার যখন এত কৌতূহল তাহলে বলছি শুনো। এই মেয়েটার সাথেই ফুয়াদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যে কোনো কারণে মেয়েটা শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেনি। ওকে ছেড়ে চলে গেছে।
এশা তৎক্ষণাৎ কোনো প্রত্যুত্তর না করে অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল। তার চেহারা বিষণ্ণ, বিস্মিত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
-উনি হঠাৎ এখানে কেন এসেছে?
-এমনি এসেছে নাকি।
-ফুয়াদকে সে ছেড়ে গিয়েছিল কেন?
-এসব কেচ্ছা এখন বলতে গেলে বিকাল হয়ে যাবে। গোসল করে টেবিলে খাবার বাড়তে হবে। তুমি রুমে যাও। ফুয়াদকে ওষুধ আনতে বলো। জ্বরের তাপে চেহারা লালচে দেখাচ্ছে তোমার।
__
ফুয়াদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল সুস্মিতা গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে। ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। নতুন জীবনে দাঁড়িয়ে পুরানো প্রেমের মুখোমুখি হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম ব্যাপারগুলির একটি বোধ হয়।
নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয়ে ক্লান্তির বাহানায় রুমে চলে এসেছে। নিজেকে একটু সামলে আবার লিভিং রুমে যেতে চেয়েছিল। তার আগেই সুস্মিতা চলে গেছে। ভালো করেছে। সুস্মিতার প্রতি এখন আর ওর কোনো আবেগই খাটে না। তবুও ওই হাসি মুখ, খুব চেনা দুইটি চোখ.. এক সঙ্গে সংসার পাতার হাজারটা স্বপ্ন। হুট করে সব স্মৃতি যেন সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। সেই রুদ্ধ পথ থেকে বেড়িয়ে আসা খুব কঠিন!
ফুয়াদ সুস্মিতাকে ছাড়তে চায়নি। সে ই ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার অবশ্য কারণ ছিলো। থাকার মত কি একটা কারণও ছিলো না?
এসব কিছুই এখন অতীত। কিন্তু সুস্মিতা হঠাৎ এখানে কেন আসলো? তার এখানে আসার মত কোনো কারণ দেখছে না ফুয়াদ। ওরা একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। বিয়ের কথাবার্তা কিছু দূর এগিয়ে ঝামেলা হলো। এরপর সুস্মিতা ওকে ছেড়ে চলে গেল। এখান দিয়ে যাওয়ার পথে বসে যাওয়ার মত কোনো সম্পর্ক ওদের মধ্যে নেই। তাহলে সে কেন আসলো? ফুয়াদের সাথে দেখা করতে কিংবা কথা বলতে নিশ্চয়ই আসেনি। ওর সাথে যোগাযোগের অনেক উপায় আছে। সেজন্য বাড়িতে আসার দরকার নেই।
অফিস থেকে এসে এখনো পোশাক পরিবর্তন করেনি ফুয়াদ। সে দীর্ঘ সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর রুমে এসে প্রথমেই চোখ গেল বিছানার দিকে। এই গরমের ভিতর এশা কম্বল কাঁথা গায়ে কিরকম জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। ওর এলোমেলো চুল গুলো মুখ ঢেকে রেখেছে। চুল এভাবে এলোমেলো রাখতে ওকে আগে কখনো দেখেনি।
ফুয়াদের এই মুহুর্তে পুরো পৃথিবীটাই ওলটপালট লাগছে। সুস্মিতার জন্য বিধ্বস্ত হওয়া হৃদয়ে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে এশার মাথার পাশে বসলো। ধীরে ধীরে ওর মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিতে লাগলো। হাত গালে স্পর্শ হতেই জ্বরের তাপ অনুভূত হলো।
এশার এই অসুস্থতা গ্রাহ্য করার মত মেজাজ ওর নেই। তবুও কেন জানি এড়িয়ে যেতে পারলো না।
-গায়ে জ্বর এসেছে কখন? ওষুধ আনতে বলোনি কেন?
এশার থেকে কোনো উত্তর আসলো না। ফুয়াদের বিরক্ত লাগছে। সে আর কিছু না বলে পোশাক বদলে নিলো। তিনতলার ফাঁকা রুমটায় গিয়ে একা কিছুক্ষণ কাটাবে বলে মনস্থির করলো। রুম থেকে বের হতে গিয়েও আবার এশার কাছে ফিরে আসলো।
গায়ের কাঁথা সরিয়ে কপালে, গালে, গলায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-জ্বর কত মেপেছো?
এশা ক্ষীণ গলায় বলল,
-একশ চার।
ফুয়াদ বাসার কাছের ফার্মেসি থেকে জ্বরের ওষুধ নিয়ে আসলো। সাথে দুইটা স্যান্ডউইচও আনে। জ্বর মুখে ভাত নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না।
-স্যান্ডউইচ খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।
ফুয়াদের গলা কেমন কর্কশ শোনালো। সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। এশা স্যান্ডউইচও খেল না, ওষুধও খেল না। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিঃশব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। সুস্মিতার এখানে আসা, তার জন্য ফুয়াদের অস্থিরতা, গায়ের প্রচণ্ড জ্বর, মাকে দেখেছে কতদিন হলো, মা কেমন আছেন—সব দুঃখ যেন হঠাৎ ওর মনে নাড়া দিয়েছে।
মা যদি পাশে বসে জলপট্টি দিয়ে দিতো ও বোধ হয় ভালো হয়ে যেত! মেজো মামার বাসায় মানুষটা অযত্নে আছে। মাকে একদিনের জন্যও যদি শান্তিতে রাখতে পারতো মৃত্যুর আগে!
নতুন বিয়ে হলে মানুষ মাসের মধ্যে কয়েক বার বাপের বাড়ি বেড়াতে যায়। এত বড় পৃথিবীত ওর কোথায়ও যাওয়ার নাই। ওর পৃথিবীটা এত সংকীর্ণ কেন!
অন্তত এমন একটা পরিবারে বিয়ে হতে পারতো যেখানে সবাই ওকে ভালোবাসত। একটা ভালো বরও তো আল্লাহ মিলিয়ে দিতে পারতেন। যে ভালোবাসত, আদর করত, যত্ন করত। মাথায় করে রাখতো। ওর একটু মন খারাপে উদ্বিগ্ন হতো। ওর একটু অসুস্থতায় অস্থির হয়ে যেত।
কাঁদতে কাঁদতে এশার হেঁচকি উঠে গেল। জ্বর আর কান্না মিলে ওর নাক-মুখ ফুলে লাল হয়ে গেল।
__
ফুয়াদ রাতে বাসায় ফিরে দেখলো এশার হুঁশ নেই। শরীরে হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না জ্বরের তাপে। দুপুরের সেই ওষুধ, স্যান্ডউইচ যেরকম রেখে গেছে সেরকমই পড়ে আছে।
-এশা, এই এশা।
ফুয়াদের কণ্ঠস্বর উদ্বিগ্ন শোনালো। এশা চোখ টেনে মেলতে পারছে না। ও জ্বরের ঘোরে কেবল হু হু করলো।
ফুয়াদ দ্রুত একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে ওর কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। হাত-পাও মুছিয়ে দিলো কয়েকবার। কিন্তু জ্বরের তাপ কমছে না।
দুপুরে ওষুধ খেলে এখন নিশ্চয়ই এই অবস্থা হতো না। ফুয়াদের এত রাগ হচ্ছে! রাগ ভুলে ও এশার গায়ের জামাটা খুলে শরীর মুছিয়ে দিলো। তার পরনে এখন শুধু অন্তর্বাস। ফুয়াদ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ধুর! এই বিপদের মধ্যে কোথায় কি নজর দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ যাবৎ জলপট্টি দিয়েও কোনো লাভ হলো না। এশার অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। সে চোখ মেলেই তাকাতে পারছে না। ফুয়াদের উদ্বেগ বাড়ে। এখন ওকে নিশ্চয়ই কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলা পর্যন্ত নিয়ে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিতে হবে।
ফুয়াদ ব্যস্ত মুখে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পাল্টিয়ে শার্ট-প্যান্ট গায়ে দেয়। শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে দেখল পলি বেগম আর শফিক আহমেদ রুমে ঢুকেছে। পলি বেগম এশার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
-জ্বরের জন্য নাপা খাওয়ালেই যথেষ্ট। তার জন্য এই রাতের বেলায় হাসপাতালে নিতে হবে কেন? এত আদিখ্যেতা করছো কেন? আজকাল বড্ড বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু।
ফুয়াদ যেন পলি বেগমের কথা শুনতে পেল না। ও এশাকে বিছানা থেকে কোলে তুলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা