#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৭
পলি বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি ভাঙচুরের দৃশ্য দেখলেন। এরপর তিনি নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। শফিক আহমেদ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কোথায় যাচ্ছো? ও যা করছে ওকে করতে দাও। রাগের মাথায় কোনো সিন্ধান্ত নিয়ো না। মনে রেখো দিন শেষে ওর জন্য তোমার হৃদয়ই বেশি পুড়বে। তুমি যতই কঠিন হৃদয়ের..।
তার কথা অগ্রাহ্য করে পলি বেগম রুমের দিকে যেতে উদ্যত হলেন। শফিক আহমেদ পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-কি করতে চাচ্ছো তুমি?
-সরে দাঁড়াও। বাড়ির প্রতিটি মানুষের চেহারা আজ আমি দেখেছি।
পলি বেগম তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলেন। শফিক আহমেদকে সেদিকে আসতে দেখেই সজোরে রুম আটকে দিলেন।
কেউই বাসা থেকে বের হয়ে ফুয়াদকে থামানোর জন্য আঙিনার দিকে গেল না। এতক্ষণ ওকে থামানোর চেষ্টা করতে করতে সবাই যেন ক্লান্ত।
তীব্র সাহস সঞ্চয় করে জীবনের মায়া ত্যাগ করে এই বাড়িতে আসা এশাও এই মুহূর্তে নিজেকে আবার কেমন ভীতু আবিষ্কার করলো। ফুয়াদের এই ভয়াবহ তাণ্ডবের জন্য কি বাড়ির সকলে ওকে দায়ী ভাবছে? ওর জন্য কি সে এমন প্রতিবাদ করছে? কিছুক্ষণ ভাবলো এশা। ভেবে ওর মনে হলো, এসব বহু বছরের পুরানো রাগ। হয়তবা জন্ম থেকে। এই ভাঙচুর, অশান্তি, অস্থিরতার পিছনে ওর কোনো দায় নেই।
এশা রুম থেকে বের হয়ে ফুয়াদের কাছে গেল। বাড়ির সকলের থমথমে মুখের দিকে একবার তাকালো কেবল।
ওকে দেখেই ফুয়াদ ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
-এই মেয়ে কি সমস্যা তোমার? রুমে বসে থাকতে বলেছি না তোমাকে? তুমি আবার এখানে কেন এসেছো? এক কথা তোমাকে কতবার বলতে হবে আমার?
-যথেষ্ট হয়েছে। আপনি এসব এবার বন্ধ করুন।
ফুয়াদ গাড়ি ভাঙা থামিয়ে রড হাতেই এশার দিকে এগিয়ে আসলো।
-তুমি কি করে বুঝলে যথেষ্ট হয়েছে?
ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ফুয়াদ। এশার আর কিছু বলার সাহস হলো না। ফের কিছু বলতে গেলে এই রডের বাড়ি বোধ হয় ওর মাথায় পড়বে। ও চুপচাপ ওখান থেকে চলে এসে নিচতলার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকলো।
বিয়ের পর থেকে দেখে আসা ফুয়াদের সঙ্গে আজকের এই মানুষটার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না। বিয়ের আগে প্রথমবার যখন দেখা হয়েছিল তখনই এশার মনে হয়েছিল, সে কোনো সহজ মানুষ নয় যাকে চট করে বুঝে ফেলা যাবে। আজও ওর তাই মনে হচ্ছে। এতদিন তাহলে কোন উদ্দেশ্যে সে মুখ বুঁজে বাড়ির অন্য সকলের মত সবকিছু বিনা বাক্যে মেনে চলেছে? দেশের বাইরে যাওয়ার টাকা জোগাড় করার জন্য শুধু? টাকা জোগাড় হয়ে গেছে? সে কি এবার চলে যাবে?
এসব ভাবনার মাঝে এশা এক পলক বাইরের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর চোখ জুড়ে পৃথিবীর সমস্ত অবিশ্বাস। পুলিশ এসেছে! পলি বেগম পুলিশে খবর দিয়েছে? নিজের রাগ, অহংকার, দম্ভ বজায় রাখতে একজন মা নিজের ছেলেকে পুলিশে দিবে?
পুলিশ দেখে শফিক আহমেদ ক্রোধে গলা ছেড়ে পলি বেগমকে ডাকলেন,
-কি করলে তুমি এটা? কীভাবে করতে পারলে?
পলি বেগম নির্লিপ্ত মুখে বলল,
-কি করেছি দেখতেই তো পাচ্ছো।
-নিজের রাগ, জেদকে সবার সামনে বড় করতে গিয়ে আজ তুমি সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেললে!
বাড়ির সকলে ছুটে যেতে লাগলো গেটের সামনে। শুধু পলি বেগম বাদে। এশা কান্নাভেজা চোখে সবার আগে ছুটছে।
-একটা মানুষও এখানে আসবে না সুপারিশ করতে। তাহলে এতক্ষণ যা করেছি তার চেয়ে ভয়াবহ কিছু করবো। খোদার কসম! আসবে না এদিকে।
ফুয়াদের কথায় সবাই থেমে গেল। এই মুহূর্তে ওকে জ্ঞানশূন্য মনে হচ্ছে। যেকোন কিছু করতে বসতে পারে। তাই কেউ আর সামনে আগানোর সাহস করলো না। সবাই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। শফিক আহমেদের চোখ জোড়া ছলছল করছে।
পুলিশের কাছ থেকে দুই মিনিট সময় চেয়ে ফুয়াদ এশাকে ডাকলো। এশার মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই মানুষটার সঙ্গে ওর তেমন কোনো প্রেম-ভালোবাসা হয়নি। সুন্দর কোনো স্মৃতিও তৈরি হয়নি। তবুও বুকের ভেতরটা এই মুহূর্তে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাকে কি থানায় আটকে রাখবে? মারধর করবে?
এশা এগিয়ে যেতেই ফুয়াদ পকেট থেকে একটা চাবি বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল,
-ফ্ল্যাটের চাবি। চিনে যেতে পারবে?
এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে ফুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো।
-কান্না করার মত তেমন কিছুই হয়নি এশা। তাছাড়া আমি তোমার সেরকম ভালো স্বামীও না যে আমার জন্য এভাবে কাঁদতে হবে। আই অ্যাম ভেরি ব্যাড পার্সন এশা। সময় নেই হাতে। যেতে পারবে? এক্ষুণি চলে যাও।
এশার কান্না থামলো না। ফুয়াদ এবার বিরক্ত মুখে ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বলল,
-আরে কান্না থামাও। কথা বলছো না কেন?
কান্না চাপিয়ে এশা কোনো রকম ঠোঁট নেড়ে বলল,
-পারবো যেতে।
-গুড। আসি তাহলে।
আশপাশ সব ভুলে এশা জড়িয়ে ধরলো ফুয়াদকে। ফুয়াদ এই আলিঙ্গন থেকে তৎক্ষণাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা না করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মুহূর্তে একটা উষ্ণ আলিঙ্গন ওর ভীষণ দরকার ছিলো।
__
পলি বেগম নিজের রুমে বসে আছেন। আজ যদি তিনি এই ধরণের উচ্ছৃঙ্খল কাজের জন্য ফুয়াদের প্রতি কঠোর হতে না পারতো, তাহলে এই বাড়িতে আজকের পর থেকে কে আর তাকে পরোয়া করতো? কেউ করতো না। সবার চোখ-মুখ দেখেছেন তিনি। তার এই দাপট ধুলোয় মিশে যেতো। তার রাগ, অহংকার, কর্তৃত্ব কিছুই আর বজায় থাকতো না। সবাই যা খুশি তাই করার সাহস পেয়ে যেত।
দরজায় পদাঘাতের শব্দ হলো। পলি বেগম উঠে দাঁড়ায়। দরজার ওপাশের মানুষটা লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যেতে চাচ্ছে।
তিনি দরজা খুলে শফিক আহমেদকে দেখতে পেল। তাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করলেন শফিক আহমেদ। রুমে ঢুকেই ড্রয়ার খুলে কিছু কাগজপত্র খুঁজে একটা ফাইলে ঢুকালেন।
-কি করছো তুমি? কাগজপত্র দিয়ে কি করবে? বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেয়ো না। ফুয়াদকে কাল সকালে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ওর নামে কোনো মামলা করা হয়নি। ও শুধু একটা দিন থানায় থাকবে।
শফিক আহমেদ গর্জে উঠে বললেন,
-তোমার বাপের অর্থবিত্ত, ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি নিয়ে তুমি থাকো। তোমার মুখের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়। বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত তুমি করেছো।
পলি বেগম হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
-তুমি কোথায় যাচ্ছো?
শফিক আহমেদ প্রত্যুত্তর করলেন না। তিনি খুব দ্রুত তার অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন।
-সবার সামনে নিজের অহংকার ধরে রাখতে একদিনের জন্য ছেলেকে থানায় দিয়েছো? আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও তুমি। নয়ত থাপ্পড় দিয়ে তোমার দাঁত আমি ফেলে দিবো।
-কি বললে তুমি?
-কি বলেছি শুনতে পাওনি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আর একটা কথা বললে থাপ্পড় দিয়ে তোমার সবগুলো দাঁত আমি ফেলে দিবো।
পলি বেগমের মনে হলো তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন! এসব দুঃস্বপ্নের চেয়ে কম কিসে? শফিক আহমেদ তাকে থাপ্পড় দেওয়ার কথা বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে! তার মাথা আরো ঘুরতে লাগলো। চারপাশ কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। অতি বিস্ময়ে তিনি বাক্য হারা হয়ে গেলেন।
শফিক আহমেদ দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। পলি বেগম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলেন তিনি সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয় পলি বেগম। রুম থেকে বের হয়ে তিনি আরো ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেলেন। সম্পা আর রাহাত ব্যাগপত্রর গুছিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। এর ভিতর মালা জানালো এশাও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
(চলবে)
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৮
এই অঢেল সম্পত্তি, ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি সবই তো পলি বেগমের নামে। স্বামী কিংবা সন্তানদের নামে কোনো কিছুই করেননি তিনি। তার সারা জীবনের ধারণা ছিলো, তার ছাপোষা ঘর জামাই কখনো এই বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনায়ও ভাববে না। আর জন্ম থেকে অর্থবিত্ত, প্রাচুর্যের মাঝে বেড়ে উঠা তার সন্তানেরাও এই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে কখনো মধ্যবিত্ত জীবন বেছে নেওয়ার মত সাহস করবে না।
কিন্ত হঠাৎ সবকিছু কিরকম ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে চোখের পলকে। আকস্মিক একটা ঝড় এসে যেন সবকিছু ভেঙেচুরে,চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। তার সংসার তো তার মর্জিতে সুন্দর ভাবেই চলছিলো না। ফুয়াদকে বিয়ে করানোই কি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে?
পলি বেগম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তি পাচ্ছেন না আর। তিনি ধপ করে সোফায় বসে পড়েন। সম্পা আর রাহাত সেদিকে একবার ফিরে তাকালো কেবল। এরপর ওরা তাকে কোনো রকম পরোয়া না করে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
এই বাড়িতে এসব দেখার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন! এই দৃশ্য দেখার জন্যই কি তিনি বেঁচে ছিলেন? এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিত পলি বেগম তৎক্ষণাৎ বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবার চেষ্টা করছেন।
শফিক আহমেদ কোথায় আর যাবে! কতদিন চলতে পারবে তাকে ছাড়া! বাপের একটা ভিটা ছাড়া তো কিছুই নেই তার। খালি ভিটায় গিয়ে কি শুয়ে থাকবে? যতই তেজ দেখিয়ে চলে যাক পলি বেগমের বিশ্বাস তার এখানে ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ফুয়াদকে তো কাল ছাড়িয়ে আনবে। এরপর ওর হাবভাব দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবে। যে ভয়াবহ স্পর্ধা সে দেখিয়েছে, নিজের ছেলে শুধু বলে ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন। আর এশা! যে এই মুহূর্তে পলি বেগমের সবচেয়ে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। সে ও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এই দুঃসাহস তো শুধু ফুয়াদের জন্য পেয়েছে। ফুয়াদই সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। এশা বাড়ি ছেড়ে কোথায় গেছে? মায়ের কাছে? সৎ বাপের আগের পক্ষের ছেলের সংসারে? কতদিন আর ঠাঁই হবে সেখানে? সবাইকেই নত হয়ে এখানেই ফিরে আসতে হবে।
রাহাত আর সম্পাকেও ফিরে আসতে হবে। পলি বেগম এখন শুধু ধৈর্য ধরে দেখবেন কার তেজ কতদিন থাকে। পেটে টান পড়লে সুরসুর করে চলে আসবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তার হাতে-পায়ে ধরে মাফ চেয়ে এখানে ফিরে আসা ছাড়া কারো কোনো গতি নেই।
-মা ঠাণ্ডা পানি দিবো?
এসি রুমে বসেও তরতর করে মাকে ঘামতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল মালা।
-বিষ নেই? বিষ দাও আমাকে একটু। আমার চোখের সামনে থেকে যাও।
জোরে আওয়াজ করে তাতানো মেজাজে বলল পলি বেগম। মায়ের মনের অবস্থা ভালো করেই বুঝতে পারছে মালা। তাই রাগ না করে বলল,
-এখন মাথা গরম করলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। দেখো কে কয়দিন থাকতে পারে। সব গুলোকেই আবার তো সেই আসতেই হবে এখানে! ফুয়াদের বউটার একটা ব্যবস্থা করো। ও ই হচ্ছে আসল কালপ্রিট।
পলি বেগম কোনো প্রত্যুত্তর না করে গভীর ভাবে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইলেন। তার মুখ ইস্পাতের মত কঠিন দেখাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর তিনি মারুফাকে ডেকে বলল,
-কান্নাকাটি থেমেছে তোমার? কাঁদছো না কেন এখন?
তার গলায় ফেটে পড়া ক্ষোভ। মারুফা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। পলি বেগম এবার ফয়সালকে ডেকে বলল,
-তোমরা এখনো যাচ্ছো না কেন? বের হও আমার বাসা থেকে।
ফয়সাল বলল,
-মা আমরা তো কিছু করিনি।
-সব রসুনের এক গোড়া। খাইয়ে পরিয়ে কুকুর পেলেছি কতগুলো। আমার কুকুর এখন আমাকে ঘেউ ঘেউ করে। দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি আমি।
ফয়সাল বলল,
-মা ওদের রাগ আমাদের উপর দেখাবেন না।
-কার উপর রাগ দেখাবো সেটা তুই ঠিক করে দিবি? থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিবো। এই মুহুর্তে বেড়িয়ে যা আমার বাসা থেকে। কুত্তার বাচ্চা কতগুলো। তোদেরকে এমন শিক্ষা দিবো।
ফয়সাল এবার মেজাজ হারিয়ে মারুফার হাত ধরে পলি বেগমকে বলল,
-আমরা চলে গেলে তোমার শান্তি হবে? একজনকে জেলে ভরেছো। আরেকজন অতিষ্ঠ হয়ে চলে গেছে। আমি বা থেকে কি করবো। প্রয়োজন হলে ভিক্ষা করে খাবো।
-যা তোরা বাপ ছেলে সবাই মিলে ভিক্ষা করে খা।
পলি বেগম দেখলেন সত্যি সত্যি মারুফা আর ফয়সাল চলে যাচ্ছে। তিনি হতভম্ব মুখে তাকিয়ে রইল। এদের এত তেজ হঠাৎ করে আসছে কোথা থেকে? এরা কি সবাই তার বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছে? রাগে তিনি থরথর করে কাঁপছে। এই বেয়াদবি, দুঃসাহসের উপযুক্ত শাস্তি কি হতে পারে তিনি ভাবতে লাগলেন।
__
শফিক আহমেদ থানায় আসলো ফুয়াদকে ছাড়িয়ে নিতে। থানা থেকে তাকে বলা হলো,
-পলি ম্যাডাম কাল সকালে এসে উনাকে ছাড়িয়ে নিবে। তাকে একদিন এখানেই থাকতে হবে। এর আগে আমরা ছাড়তে পারবো না।
শফিক আহমেদ ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। কি করবেন তিনি এখন! তার কিছুই করার নেই। ফুয়াদকে এই মুহূর্তে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতা তার নেই। পৃথিবীতে ক্ষমতার বড় উৎস হলো টাকা। তিনি তো অধমের মত ঘর জামাই থেকে গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তার না আছে টাকা, না ক্ষমতা, না আছে নিজের কোনো পরিচয়।
-ফুয়াদের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে পারি?
-না তাও পারবেন না।
শফিক আহমেদ অসহায়ের মত থানা থেকে বেড়িয়ে আসলেন। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফুটপাত ধরে হাঁটলো।
দীর্ঘ সময় হেঁটে তিনি বসে একটু বিশ্রাম নেয়। এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন বাকীটা জীবন নিজের বাপের ভিটায় কাটিয়ে দিবেন।
__
এশা ফ্ল্যাটে ঢুকে বিমর্ষ মুখে অনেকক্ষণ যাবৎ একই ভঙ্গিতে বসে আছে। ওর ইচ্ছে করছে একটা বার একটু থানায় যেতে। কিন্তু ফুয়াদ নিষেধ করেছে ওকে এসব ব্যাপারে নাক গলাতে। থানার আশেপাশেও যেতে নিষেধ করেছে। শুধু ওকে না। বাড়ির অন্য সবাইকেও।
কিন্তু বাড়ির অন্য সবাই আর ও কি এক হলো? এই পরিস্থিতিতে ও কীভাবে স্থির থাকবে? ওর মনের ভিতর তো উথাল পাথাল অবস্থা! কতদিন তাকে থানায় আটকে রাখবে, কি করবে..ও কিচ্ছু জানে না। তাকে থানা থেকে ছাড়িয়েও বা আনবে কে? ফুয়াদের নিষেধ অমান্য করে থানায় যাওয়ারও সাহস হচ্ছে না ওর। লোকটা হঠাৎ করে কিরকম খেপাটে হয়ে গেছে।
এশার চোখে শুধু বার বার ফুয়াদের বিধ্বস্ত মুখটা ভেসে উঠছে। এত মায়া লাগছে কেন লোকটার জন্য! এত পরাণ পুড়ছে কেন! বুকের ভেতরটা কেমন ঝাঁঝরা লাগছে! একজন মা কি করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে! অথচ ওর মা ওর জন্য সারাটা জীবন কত সংগ্রাম করেছে। এশার চোখ আবার ভিজে যাচ্ছে।
__
পলি বেগমের সারা রাত ঘুম হলো না। মন-মেজাজ প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। সবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃসাহস কিছুতেই হজম করতে পারছেন না। তার এতদিনের গড়া সংসারটার বিধ্বস্ত রূপ তাকে নরকের যন্ত্রণা দিচ্ছে।
তিনি এখন প্রথমে থানায় যাবেন। নিজের দম্ভ, অহংকার ধরে রাখতে নিজের সন্তানকে পুলিশে দিয়েছে। ভেবেছিলো এতে সবার টনক নড়বে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। কেউ তাকে পরোয়া না করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে! শফিক আহমেদের চলে যাওয়া তাকে সবচেয়ে বেশি হতবাক করেছে। বদমাশ লোকটাকে তিনি দেখে নিবেন। পাখনা গজিয়েছে এক এক জনের।
তার গাড়ি তো ফুয়াদ ভেঙে চুরমার করেছে। ইতর, বেয়াদব পোলাপান পেটে ধরেছে! ইতরের পয়দা তো ইতরই হবে। ওদের বাপটাই তো বড় ইতর। রক্তের দোষ! একে কমচে কম এক বছর জেলে ভরে রাখা উচিত। শুধু নিজের সন্তান বলে পারছেন না।
পলি বেগম একটা রিক্সা ডেকে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। তিনি ফুয়াদকে থানা থেকে ছাড়িয়ে দিবেন তারপর যেখানে খু্শি যাক। তার বাড়িতে এত সহজে একটাকেও স্থান দিবেন না। অন্তত তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে সপ্তাহ খানেক ক্ষমা চাইতে হবে। প্রত্যেককে তার কাছে মাথা নোয়াতে হবে।
(চলবে)