এই জোছনা ধারায় পর্ব-২৯+৩০

0
297

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৯

পলি বেগম মনে মনে ধারণা করেছিলেন ফুয়াদকে থানায় ছাড়াতে গেলে রাগে, ক্ষোভে সে আবার হয়ত কোনো হট্টগোল করে বসবে। কিন্তু না, ফুয়াদ একটি কথাও বললো না। তার চোখ-মুখ কিরকম ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে। পুলিশে দেওয়ার মত এরকম একটা ভয়াবহ ক্রূর ব্যাপার নিয়ে পলি বেগমের সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া না করেই থানা থেকে বেড়িয়ে আসে।

পলি বেগম ওর একটু পিছনেই। তিনি দ্রুত পায়ে হেঁটে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। রাগে, ক্রোধে তার ফর্সা মুখটা বোধ হয় সামান্য লালচে দেখাচ্ছে। বাড়ির সকলে তাকে কোনো তোয়াক্কা না করে বেড়িয়ে গেছে। আর ফুয়াদ তো সবকিছু চূর্ণ বিচূর্ণ, লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। এখন থানা থেকে ছাড়ানোর পরও কেমন হাবভাব করে চলে যাচ্ছে। সবাই যেন তার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে। হঠাৎ করেই নিজেকে কেমন গুরুত্বহীন, তুচ্ছ আবিষ্কার করছে পলি বেগম।

-এই ছেলে, দাঁড়াও।

ফুয়াদ দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে।

-কিছু বলবে?

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নির্লিপ্ত মুখে জিজ্ঞেস করল ফুয়াদ।

-তুমি আমার সামনে বসে স্মোক করছো! আর কত অধঃপতন দেখতে হবে তোমাদের? চাচ্ছোটা কি তোমরা? তোমাদের উদ্দেশ্য কি? আমার বিরুদ্ধে জোট পাকিয়েছো সবাই মিলে?

চেঁচিয়ে বললেন পলি বেগম।

ফুয়াদ শান্ত গলায় তাকে বলল,

-রাস্তাঘাটে চেঁচামেচি করবে না। কার কি উদ্দেশ্য আমি জানি না। তবে তোমার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা।

-তুমি চূড়ান্ত বেয়াবদি করেছো আমার সাথে। আমাকে অপমান করেছো, সবার সামনে আমার মুখ ছোট করেছো। তুমি তোমার মাকে চিনো না? এতকিছুর পরও আমি তোমার প্রতি যথেষ্ট দয়া করছি।

-মাকে অবশ্যই চিনি। চিনি বলেই আর চিনতে চাচ্ছি না। আমার জীবনে মা বলতে কোনো শব্দ নেই। আই হেইট ইউ। আর আমার প্রতি দয়া দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। নয়ত তো জেলে পচে মরতে হতো।

-আমাকে ঘৃণা করার কথা বলছো! আমি তোমাদের পেটে ধরেনি? আদর, যত্ন করে বড় করিনি? পড়াশোনা করাইনি? বিলাসী জীবন দেইনি আমি তোমাদের? কোনো কিছুর কমতি দিয়েছি! আজ তোমাদের চোখে আমি জঘন্য মা হয়ে গেছি। আমি ভিলেন হয়ে গেছি।

বিক্ষিপ্ত মেজাজে অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফুয়াদ। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-সব করেছো। তবুও আমি তোমাকে ঘৃণা করি। কি করবে তুমি এর জন্য? আবার আমাকে পুলিশে দিবে? ডাকো পুলিশ। তোমার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। তুমি সব পারবে। ডাকো আবার পুলিশ ডাকো।

পলি বেগম নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বললেন,

-সং ভং বাদ দাও। তোমরা সবাই মিলে চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করছো।

তিনি থেমে আবার বললেন,

-তোমাকে সোজা একটা কথা বলি। সবাইকে আমি বাসায় ঢুকতে দিলেও এশাকে দিবো না। ওকে ছেড়ে যদি তুমি আসতে পারো তো আসবে।

ফুয়াদের মুখে বিদ্রুপের হাসি। সে হাসতে হাসতে বলল,

-এশার ব্যাপার ছাড়ো। তোমার এই দুর্দিনের পিছনে ওর কোনো হাত নেই। ও তোমার বাড়িতে বউ হয়ে না আসলেও তোমার এই দিন দেখতে হতো।

-আমার দুর্দিন!

-বুঝতে পারছো না এখনো? নাকি বুঝতে চাচ্ছো না? যাই হোক তোমার সঙ্গে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আসি।

-বাড়াবাড়িটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না বাবা?

ফুয়াদ পিছনে তাকিয়ে বলল,

-বাবা? কিসের বাবা? কে বাবা? আমি মরে গেছি। এই শেষ বারের মত দেখছো তুমি আমাকে। তাতে অবশ্য তোমার মত পাষণ্ড, নির্দয় মায়ের কিছু আসে যায় না। তুমি আমার ভেতরটা বার বার ভেঙেছো। আমার স্বপ্ন গুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছো। এবার তুমি আমাকে একেবারে চূর্ণ বিচূর্ণ, তছনছ করে দিলে।

পলি বেগমের বুকের ভিতর হঠাৎ কেন যেন নাড়া দিয়ে উঠলো। তিনি ছুটে গিয়ে ফুয়াদকে ধরে বললেন,

-বাসায় চলো আব্বু। তোমার মা অনেক খারাপ মানুষ। কিন্তু তোমাকে এভাবে শেষ বার দেখার মতও নির্দয় না। এশাকে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দিবে। ওই মেয়ে আমার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য না।

ফুয়াদ বিরক্ত মুখে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা গাড়ি ডেকে চেপে বসে। এরপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পলি বেগমের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়।
__

এশার সারাটা রাত নির্ঘুম কেটেছে। নতুন জায়গায় একাকী! অন্যদিকে ফুয়াদের জন্য বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতা। চোখও বুঁজতে ইচ্ছে করেনি।

এই ফ্ল্যাটে এর আগে একদিন ফুয়াদের সঙ্গে এসে ছিলো। রান্না করেছে। সেই দিনটা খুব ভালো কেটেছিলো। ফুয়াদ ওকে একটু ভালোবাসলে ওর সব দিনই বোধ হয় অমন ভালো কাটবে।

এশা সকালে মুখ ধুয়ে মুখেও কিছু লাগায়নি। এলোমেলো অবস্থায় বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। ও এখন থানায় যাবে। ফুয়াদের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করবে না কোনো।

ও থানায় গিয়ে জানতে পারে ফুয়াদকে পলি বেগম ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। এশা একটু অবাক হলো। ছাড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেছে? বাসায়? বেশ অনেকক্ষণ আগে নাকি ছাড়িয়ে নিয়েছে। ফ্ল্যাটে তো ফিরলো না।

এশা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ফুয়াদের নম্বরে ডায়াল করলো। তার ফোন বন্ধ বলছে।
কয়েকবার চেষ্টা করলো। এরপর সম্পার কাছে কল দিলো। ফুয়াদ পলি বেগমের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে গেছে কিনা তা জানতে। রাহাত, ফয়সাল দুইজনেই যে বউ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে এই খবর ও জানে না।

সম্পা ফোন ধরতেই এশা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,

-ভাবী, ফুয়াদ কি বাসায় ফিরে গেছে?

-বাসায় ফিরে যাবে! ও থানা থেকে ছাড়া পেয়েছে?

-পেয়েছে তো। আপনি শুনেননি?

সম্পা এবার খুশি খুশি গলায় বলল,

-আমরা যে বাসা ছেড়ে চলে এসেছি, তুমি জানো না? ফয়সাল ভাই আর মারুফা ভাবীও নাকি চলে এসেছে।

এশা এসবের কিছুই জানে না। ও একটু ধাক্কা খেল। সম্পা আবার উৎফুল্ল স্বরে বলল,

-আমি আর রাহাত ছোট একটা বাসা নিয়েছি।
খুব ভালো লাগছে এখানে। সবকিছু নিজের মত করতে পারছি। কাউকে ভয় পেয়ে থাকতে হয় না। জানো এশা, বিয়ের পর এই প্রথম বোধ হয় একটা দিন শান্তিতে কাটালাম।

এশা চিন্তিত গলায় বলল,

-আচ্ছা ভাবী। রাখি এখন। পরে কথা বলবো।

ফোন রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো এশা। ও এখানে এসেছে এই ফাঁকে কি ফুয়াদ ফ্ল্যাটে গেছে? ও রিক্সা ডেকে আবার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এসে দেখে ফুয়াদ এখনো এখানে আসেনি। তাহলে বাড়িতে গেছে? এত ঝামেলার পর সেখানে যাওয়ার তো কোনো কথা না!

দুপুরের উত্তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে ও আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। বাড়ি থেকে নাকি সবাই বেড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি ও গিয়ে পলি বেগমের সামনে দাঁড়াবে! ব্যাপারটা একটু ভয়ের। কিন্তু ফুয়াদের জন্য মনটা যেভাবে উতলা হয়ে আছে তার কাছে এই ভয় অতি তুচ্ছ ব্যাপার। পলি বেগম তাকে থানা থেকে ছাড়িয়েছে। খোঁজ পাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া ছাড়া তো উপায় নেই।

পুরো বাড়ি জুড়ে সুনসান নীরবতা। কোথায়ও কোনো আওয়াজ নেই। এশা আশেপাশে তাকায়। ওদের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেটা বাইরে থেকে আটকানো। এখানে তাহলে ফুয়াদ আসেনি।

পলি বেগম কোথায় আছেন? তিনি নিশ্চয়ই এসব কিছুর জন্য ওকে দোষী মনে করছেন। মনে মনে ওকে হাজার বার খু*ন করছে। এই নির্জন বাড়িতে ওকে একাকী পেয়ে সত্যি সত্যি খু*ন-টুন করে বসবে না তো আবার!

পুরো বাড়ি খুঁজে এশা কাউকে পেল না। মালাকেও দেখছে না। এমন ফাঁকা বাড়ির সদর দরজা খুলে রেখেছে! ও গেটের কাছে এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলো পলি বেগম সকালে বের হয়েছে, এখনো ফিরেনি। মালাও বাসায় না। ফুয়াদও এখানে আসেনি।

ফুয়াদকে তাহলে কোথায় খুঁজবে ও? তার ফোনটা এখনো বন্ধ। যেখানেই থাকুক ফোন খুলে অন্তত একটা বার কল ও তো দিতে পারে। এশা উপায়ান্তর কিছু না পেয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে লাগলো। এর ভিতর ওর ফোনটা বেজে উঠে। রিংটোনের আওয়াজ পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফুয়াদ ফোন করেছে বুঝি! কিন্তু না, অপরিচিত একটা নম্বর।

ও হতাশ হয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,

-আমি ফুয়াদের বন্ধু। আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজায় তো তালা ঝুলানো। আপনি কোথায়?

এশা আবার দ্রুত ফ্ল্যাটের দিকে ছোটে। হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখে ফুয়াদের বন্ধু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বাসার ভিতরে ঢুকলো না। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ওর হাতে দুইটা খাম ধরিয়ে দিলো। একটা অনেক ভারি। ভিতরে টাকা বোধ হয়। আরেকটা চিঠির খাম হতে পারে।

(চলবে)

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩০

খাম দুইটা হাতে বিচলিত এশা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। ওর মাথায় এই মুহূর্তে অনেক প্রশ্ন, কিছুটা ভয় আর আশঙ্কা। ফুয়াদের বন্ধুকে ভিতরে এসে বসতে বলবে সেই খেয়াল হওয়ার আগেই সে চলে গেল।

হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে লিভিং রুমের লবি চেয়ারে বসে এশা। ব্যগ্র হয়ে খাম দুইটি খোলে। একটির ভেতর কয়েক বান্ডিল টাকা দেখতে পেল। অন্যটির ভেতর চিঠি!

চিঠিটা হাতে নিয়ে ও কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে বসে রইল। কি যেন এক শঙ্কায় খুলতে সাহস হচ্ছে না। বুকের ভিতর ধ্বক, ধ্বক করছে রণঢাক বাজার মত। ফুয়াদ কি তবে চলে গেল! এই সংবাদটা ওর জানতে ইচ্ছে করছে না। নিজের অজান্তেই চোখ জোড়া ছলছল করতে থাকে।

এভাবে চিঠি না পড়ে বসে থাকলেই তো ফুয়াদ যদি সত্যি চলে যায় সেটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। এশা চিঠিটা পড়া শুরু করার আগেই তার উপর দুই ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।

এশা,

তোমার সঙ্গে একবার দেখা করা উচিত ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কিছুই ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না। মন, মেজাজ কতটা বিক্ষিপ্ত লিখে বোঝাতে পারবো না। তাছাড়া কত কিছুই তো করা উচিত। কোনোটাই তো ঠিকঠাক করলাম না। শুরু থেকেই আমি তোমার প্রতি অনুচিত আচরণ করেছি। আজও করছি। তোমাকে ভালো রাখা উচিত, ভালোবাসা উচিত! আমার থেকে তোমার প্রাপ্য আদর, যত্ন কিছুই তোমাকে বুঝিয়ে দিতে পারিনি। শেষ কিছুদিন চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিতৃষ্ণা, বিরাগ, বিষণ্ণতা বার বার আমাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।

মাঝে মাঝে আমি নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হই। তোমাকে দেওয়া সেই চড়টা আজও আমাকে লজ্জা দেয়। এরকম থার্ড ক্লাস স্বামী আমি হতে চাইনি। আমি জানি আমার কি করা উচিত! সবকিছু জেনে বুঝেও করতে না পারার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আরো একটা অনুচিত কাজ আমাকে দিয়ে হয়ে যাচ্ছে। নিজের মন, মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি।

আটাশ বছরের এই লম্বা জীবনের পরিচিত, চেনা জানা সব ছেড়েছুড়ে আমার অচেনা কোনো জায়গায় শহরে একাকী নিজের মত বাঁচতে ইচ্ছে করছে। হয়ত তাই যাচ্ছি। জানি এটা তোমার প্রতি চূড়ান্ত অন্যায়। বললাম তো এশা আমি জেনে বুঝেই সব অন্যায় করছি। নিজের মন আমার আয়ত্তের বাইরে।

ছোটবেলা থেকে নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে বড় হওয়া আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় লালিত স্বপ্ন হলো নিজের মত বাঁচা। আমার ধারণা নিজের মত বাঁচতে পারলেই পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমি পেয়ে যাবো। একটা পিছুটানহীন, নির্জন, একাকী জীবনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার। পরিবারের তীব্র কোলাহলই আমার মনে এই পিছুটানহীন, নির্জন জীবনের লোভ জাগিয়েছে। সমস্ত কিছুর প্রতি আমাকে বিতৃষ্ণ করে তুলেছে। আমার জীবনে এসে তুমিও সেই বিতৃষ্ণার অংশ হয়ে গেছো। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। সমস্ত দোষ, অপরাগতা সব আমার। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমাকে এই দোষের শাস্তি দিবে।

সবকিছু ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার বেলায় এই মুহূর্তে আমি আমার জীবনের একমাত্র পিছুটান হিসেবে তোমাকেই অনুভব করছি কেবল! সেজন্যই জানালাম। এসব কথা তোমার সামনে এসেও বলতে পারতাম। কিন্তু কারো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সাথে অপরাধবোধও আছে।

তুমি এই ফ্ল্যাটেই থেকো। আন্টিকেও এখানে এনে রাখো। তোমরা দুই মা-মেয়ে দারুণ ভাবে বাঁচো। ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করো। জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করো।

আর কি লিখবো এশা? মাথা কাজ করছে না। দুঃস্বপ্নের মত একটা রাত কাটিয়েছি গতকাল। এই শহর ছেড়ে চলে যেতে পারলেই এই দুঃস্বপ্ন সঙ্গে ভেঙে যাওয়া সমস্ত স্বপ্নের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে থাকবো।

এশা, লাভলি গার্ল! টেক কেয়ার অফ ইয়োরসেলফ।

ফুয়াদ।

এশার চোখের পানিতে চিঠিটার অনেকখানি ভিজে গেছে। ধাক্কাটা সামলে কিছুক্ষণ পর ও চোখ-মুখ মুছে। কার জন্য কাঁদছে? যে ওকে ছেড়ে চলে গেছে! আবার নিতান্তই করুণা করে থাকার জায়গা আর টাকা দিয়েছে!

কায়দা করে নিজের দোষ, অপরাগতা স্বীকার করে নিজেকে উদারচেতা প্রমান করার চেষ্টা করেছে খুব! বিয়ের মত সম্পর্ক তার মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব দূর করতে পারে না! সে কি কখনো দূর করার চেষ্টা করেছে? বিবেকহীন মানুষের আবার অপরাধবোধ!

অসহ্য যন্ত্রণায় ওকে জ্বালিয়ে দারুণ ভাবে বাঁচার জন্য বলছে! চোয়াল শক্ত করে কান্না চাপানোর চেষ্টা করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এশা। নিঃশব্দে প্রায় ঘন্টা খানেক চেয়ারের উপরই বসে থাকে।

ভেবেছিল ফুয়াদ থানা থেকে ফিরলেই এই ফ্ল্যাটে ওদের ছোট্ট একটা চড়ুইপাখির সংসার হবে। বাসাটায় আসবাবপত্র কম। কি কি কিনবে তাও মনে মনে ঠিক করেছিল। কত বোকা ও!

এশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বেসিনে আয়নার সামনে উদাস মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর চোখ-মুখ ধুয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরি হয়। এখানে যতক্ষণ থাকবে ফুয়াদের করা এই করুণা, দয়ার কথা ভেবে ওর বেদনায় জরাজীর্ণ মনটা আরো অস্বস্তিতে ভুগবে।

গোছগাছ করার কিছুই নেই। এখানে ও কিছুই নিয়ে আসেনি। তাই সময় লাগলো না। এশা ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যে পলি বেগমের বাসা! ওটাকে পলি বেগমের বাসা ছাড়া আর কি বলা যায়!
__

পলি বেগম জরুরি ভিত্তিতে কাজের মানুষ খোঁজ করছে। এই শহরে বাঘের চক্ষু, সাপের মাথার মণি জরুরি ভিত্তিতে মিললেও কাজের মানুষ মিলানো যায় না।

অগত্যা আজকে রান্নাটা তাকেই করতে হয়েছে। শেষ কত বছর আগে রান্নাবান্না করেছে তার মনে নেই। সূর্য থেকে হাত খানেক দূরত্বের উত্তাপের মত মেজাজ টগবগ করছে পলি বেগমের। সবকিছু আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে হচ্ছে করছে। সবগুলোরে এক সাথে হাজতবাস করানো দরকার!

কলিংবেল বাজছে অনেকক্ষণ ধরে। পলি বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত। মালার শরীরটা ভালো না। সে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে। এই বাড়িতে যে আরামের জন্য এসেছে তা একেবারে হারাম হয়ে গেছে। বার বার কলিংবেলের শব্দে বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে দরজা খুলে।

দরজার সামনে অপ্রত্যাশিত ভাবে এশাকে দেখতে পেল। ও স্বাভাবিক ভাবে মালাকে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনার মা বাসায় আছেন?

মালা বিস্মিত না হয়ে পারে না। বিস্ময়টুকু মনে মনে হজম করে বলল,

-আছে।

-আমি একটু তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভিতরে আসবো?

-আসো।

এশা ভিতরে ঢুকে লিভিং রুমে বসে।

-আপনার মাকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে?

মালা এই কয়দিনে যে কাণ্ডকীর্তি দেখেছে খুব বেশি অবাক না হয়ে পলি বেগমকে ডেকে দিলো। এশাকে দেখেই পলি বেগমের মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম হলো। তার ইচ্ছে করলো ভারী কিছু দিয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করে লা*শ বানিয়ে দিতে।

এশা জড়তাহীন ভাবে বলল,

-এখানে আমি থাকতে আসিনি। আপনার সাথে একটা প্রয়োজনে দেখা করতে এসেছি। অযথা চিৎকার, চেঁচামেচি না করলে খুশি হবো।

এশার কথার ধাঁচ দেখে পলি বেগমের শরীরটা আরো জ্বলে উঠলো। তিনি মালার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-দারোয়ান ওকে কেন এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে?

মালা আস্তে করে বলল,

-আগেই মাথা গরম করো না। কি বলতে এসেছে শুনো।

পলি বেগম এশার মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করলেন,

-কি প্রয়োজনে এসেছো বলো? আমার সুখের সংসার তো ভেঙেছো। সবকিছু তছনছ করেছো। আমার কোল খালি করেছো। আর কি প্রয়োজন তোমার বলো?

এশা ওর ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি আর টাকার বান্ডিল গুলো বের করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বলল,

-আপনার ছেলের ফ্ল্যাটের চাবি। আর তার টাকা। আপনাকে এগুলো দিতে এসেছি।

ব্যাপারটা পলি বেগমের বোধগম্য হলো না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

-কিসের ফ্ল্যাট? কিসের চাবি? কিসের টাকা?

এশা বলল,

-আপনার ছেলের আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখা আছে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকে। ফ্ল্যাটের চাবিটা আমার কাছে সেদিন দিয়েছিলো। কিন্তু আমার এটার দরকার নেই। আপনার ছেলের ফ্ল্যাটের চাবি আপনিই রাখুন। আর টাকা গুলোও সে আমাকে দিয়েছে। এগুলোও রাখুন।

পলি বেগম তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। ফুয়াদের আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করা আছে! এই বিস্ময়ে তিনি অনেকক্ষণ কথা বলতে ভুলে গেলেন।

-ফুয়াদ কোথায়? এসব আমাকে কেন দিচ্ছো?

নীরবতা ভেঙে জানতে চাইলো পলি বেগম। এশা বলল,

-ফুয়াদ কোথায় আমি জানি না। এজন্যই এখানে এসেছি। নয়ত এই পাগলাগারদে আবার আসতে যাবো কেন! আপনি যদি তার খোঁজ পান তাহলে বলবেন যে, আমি তাকে ডিভোর্স দিবো। অন্তত আমার সামনে এসে যেন এই সম্পর্কটা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করে যায়।

কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে পলি বেগম বুঝতে পারছেন না। তিনি কেবল বললেন,

-মানে!

-মানে আবার কি! আমি আপনার নাদান ছেলেকে ডিভোর্স দিবো। ভীষণ খুশির সংবাদ তাই না? আপনি মিষ্টি বিতরণ করা শুরু করেন।

-এই মেয়ে তুমি সাবধানে কথা বলো। নয়ত কিন্তু আজ তোমাকে আমি…।

-কচু করবেন আপনি আমাকে। আপনার নাদান ছেলে ফিরলে তাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন। বিয়ের পর থেকে তো আপনারা আমাকে সামান্য শান্তি দেননি। এবার আপনার ছেলে যেন দ্রুত ডিভোর্সটা দিয়ে আমাকে মুক্তি দেয়।

এই বলে এশা ওখান থেকে উঠে চলে এলো। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। উপরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না চোখ তুলে। ব্যস্ত সড়ক! আশেপাশে মানুষের ভীড়! কোলাহল! এত মানুষের ভিতরেও ও কত একা।

চোখ দুইটি কাঁদতে চাচ্ছে। এশা শক্ত হয়ে রইল। এ যেন কান্নার সাথে লড়াই। ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা রিক্সা ডাকে। পিচঢালা রাস্তার বুক চিরে রিক্সা চলতে থাকে। ওর এখন নতুন একটা যাওয়ার মত জায়গা আছে। সেখানে যাবে।

(চলবে)