এই জোছনা ধারায় পর্ব-৩৫+৩৬

0
318

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৫

কি যে এক অবর্ণনীয় ভয়ঙ্কর রাত কেটেছে ফুয়াদের জীবনে। আত্মগ্লানি, অনুশোচনা, অপরাধবোধে পুরো পৃথিবীটা মুহুর্তেই অর্থহীন, তুচ্ছ মনে হয়েছে। মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয়নি। গোটা রাত সম্পাদের বসার ঘরের চেয়ারটাতে স্তব্ধ হয়ে ছিলো।

মায়ের সাথে কত দ্বন্দ্ব হলো। কত বড় বড় স্বপ্ন ভাঙলো। পছন্দের মানুষের সাথে বিয়েটাও ভেঙেছে। এতে দুঃখ পেয়েছে, ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু কখনো চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়ায়নি। সেই বহু বছরের জলশূন্য চোখে শ্রাবণের ধারা নেমেছে।

এসব দুঃস্বপ্ন না হলে এই অপরাধবোধ ওকে থামিয়ে দিবে, মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দিবে।

ভেবেছিলো ঢাকায় এসেই এশাকে বলবে, ‘এশা, একা বাঁচা তেমন কোনো আনন্দের ব্যাপার না। জীবনটা আসলে মাকড়সার জালের মত মায়ায় পেঁচানো। একটু দূরে গেলেই সুতোয় টান পড়ে। ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।’

দুঃখ, টানাপোড়েনে বেড়ে উঠে মেয়েটা কতই না স্বপ্ন নিয়ে ওকে বিয়ে করেছিলো! আর ও কি করলো! নিজের ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ সব মেয়েটার উপর মিটালো। চূড়ান্ত অন্যায়, অবিচার করলো।

এশা..সদ্য পরিস্ফুটিত বেলি ফুলের মন স্নিগ্ধ, ভীষণ মিষ্টি হাসির মেয়ে! মাঝে মাঝে কি বিষণ্ণ দেখাতো! মনে হতো ওর চেহারাটা আস্ত একটা মেঘলা আকাশ। কেন এত বিষণ্ণ দেখাতো ওকে? ভালোবাসার অভাবে?

ফুয়াদ আর কিছু ভাবতে পারছে না। মস্তিষ্ক অসাড়, অকেজো মনে হলো।

সকাল হয়েছে। সম্পা বিছানা ছেড়ে উঠেই আগে একবার বসার ঘরে উঁকি দিলো। ফুয়াদকে সেই রাতের মত একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে রাহাতকে ডাকলো ব্যস্ত গলায়,

-আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি এখনও উঠছো না কেন! গিয়ে দেখো ফুয়াদের অবস্থা। ইশ্! ছেলেটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। জনমের শিক্ষা হয়েছে ওর। এবার গিয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে সত্যিটা বলো।

রাহাত চোখ খুলে বলল,

-তুমি গিয়ে বলো। এশার মায়ের বাসার অ্যাড্রেস তো তুমি জানোই। দিয়ে দাও।

সম্পা আঁতকে উঠা চেহারায় বলল,

-আমি গিয়ে বলবো? সারারাত কবর দিয়ে রাখা মানুষকে আমি এখন জ্যান্ত করতে যাবো? পলি বেগমের তো বাসা ভরতি ভাঙার মত অনেক জিনিসপত্র ছিলো। গ্যারেজে দামি গাড়ি ছিলো। আমার বাসা ভরতি জিনিসপত্র নেই। গ্যারেজে গাড়িও নেই। ও জাস্ট আমার মাথায় একটা বাড়ি মারবে।

রাহাত বিছানা ছেড়ে উঠে লিভিং রুমের দিকে পা বাড়ালো। সম্পা পিছন থেকে ডেকে বলল,

-প্লিজ ওকে যা বলার বাসার বাইরে নিয়ে বলো। অনেক শখ করে জীবনে প্রথমবারের মত সংসারের জন্য কিছু কিনেছি। প্লেট, বাটি, গ্লাস গুলো সব টেবিলের উপর রাখা!

রাহাত ফুয়াদকে বাসার বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল,

-যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। জন্ম-মৃত্যুতে মানুষের কোনো হাত নেই। বিয়েতেও নেই। ওরকম একটা ফুটফুটে মেয়ের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা তোর মত ছ্যাঁকাখোরের জুড়ি কেন মিলিয়েছিলো তা তিনিই জানেন। ওর মা সারাজীবন ওই মেয়েটাকে নিয়েই বেঁচে ছিলেন। ভদ্রমহিলা এখন একবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন! আর কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। শোন, তুই পারলে তার সঙ্গে একবার দেখা করে আয়।

রাহাত ওকে মিনারা বেগমের বাসার ঠিকানা দিলো। ও উদভ্রান্ত, দিশেহারা মানুষের মত সেদিকে রওয়ানা হলো। মিনারা বেগমের সামনে যে কোন মুখে দাঁড়াবে সেটা ভাবার মত বোধশক্তিও হলো না।

ফুয়াদ যাওয়ার পর রাহাত বাসায় ঢুকেই সম্পাকে বলল,

-আগামী এক মাস কেউ কলিংবেল বাজালেই ফট করে গিয়ে দরজা খুলবে না। আগে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখে নিবে। ফুয়াদকে দেখলে কোনো ভাবেই দরজা খুলবে না।
__

এশা টিউশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। একেবারে ক্লাস শেষ করে বিকালের টিউশনটা করে ফিরবে। মিনারা বেগম বার বার বলছেন,

-এই শরীর নিয়ে বাসা থেকে বের হোস না। দেখ বাইরে কি রোদ! আরো অসুস্থ হয়ে যাবি। তোর টিউশনি করানো লাগবে না। মাঝে মাঝে ক্লাস করিস শুধু।

-মোড়ে নাকি একটা দোকান খালি হবে। আমি কথা বলবো নাকি তুমি বলবো?

-আমার কথা কি তোর কানে যাচ্ছে না? শরীরের সাথে এত জেদ খাটে না। নিজেকে এত শক্তিশালী প্রমাণ করার তো দরকার নেই।

-কিছু হবে না। চিন্তা করো না। কৈ মাছের প্রাণ আমার।

এই বাসায় ড্রেসিং টেবিল নেই। মিনারা বেগম কাঠের নকশি ফ্রেমের একটা ওয়াল মিরর এনে টানিয়েছেন। এশা সেটির সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুল গুলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল,

-সম্পা ভাবী আসলে আবার বাচ্চা হওয়ার খবরটা দিয়ো না কিন্তু। ওই বাড়ির কেউ যেন না জানে।

-কেন? এত লুকোছাপার কি আছে? তোর মাথায় চলছেটা কি? এশা তুই কি বাচ্চা নষ্ট করার কথা ভাবছিস নাকি? খবরদার! এই পাপ কাজ করার কথা ভাবিস না। ফুয়াদ চলে আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-ছিঃ, ছিঃ! কি বলছো! বাচ্চার জন্য তো এখনই আমার মায়া করছে। ফুয়াদ না আসলেও আমি ওকে নিয়ে তোমার মত একটা দুঃখী দুঃখী জীবন কাটিয়ে দিবো। সমস্যা নেই।

এশা ব্যাগটা হাত নিয়ে আবার বলল,

-লুকোছাপার কিছু নেই। সময় হলে আমিই সবাইকে বলবো। সম্পা ভাবী বা ওই বাড়ির কেউ জানলে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।

দেরি হয়ে যাচ্ছে। ও দ্রুত পায়ে হেঁটে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে যেতেই ডোরবেল বেজে উঠে। কে এলো? সম্পা ভাবী নাকি?

এশা ব্যস্ত মুখে দরজা খুলে। দেখে দরজার সামনে ফুয়াদ দাঁড়ানো। ওর বুকের ভেতর ধাক্কা খায়। অস্বাভাবিক ভাবে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে। ধ্বক, ধ্বক করে। হাত-পায়ের ঈষৎ কাঁপুনি টের পায়। পৃথিবীটা অন্যরকম মনে হয়।

মনের ভিতরের এই ঝড়ঝাপটা লুকিয়ে ও স্বাভাবিক গলায় বলল,

-ফুয়াদ আপনি! অনেকদিন পর! কেমন আছেন?

ফুয়াদ কোনো উত্তর দিতে পারে না! অনুভূতিশূন্য দৃষ্টি তার। এশা.. এগুলো কি বিভ্রম? ওর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে আকস্মিক মৃত্যু শোকে? ও স্বপ্নের জগতে আছে নাকি বাস্তবে! স্বপ্ন, বাস্তব নাকি বিভ্রম– সবকিছু গুলিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ফুয়াদ।

এশা মিনারা বেগমকে ডেকে বলল,

-মা, উনাকে বসতে দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসি।

ও এরকমই ভেবে রেখেছিলো। ফুয়াদ যদি আবার কখনো এসে ওর সামনে দাঁড়ায় ঠিক এভাবেই এড়িয়ে যাবে। এশা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগলো।

স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা ফুয়াদ মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-আন্টি, ও এশা?

এশা ততক্ষণে চলে গেছে। মিনারা বেগম ফুয়াদকে দেখে যতটা বিস্মিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হচ্ছে ওর প্রশ্ন করে। এই ছেলেকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বিদেশি পাগলা গারদে ছিলো নাকি!

-এশা বেঁচে আছে!

ও বিড়বিড় করে বলল। এরপর মিনারা বেগমকে পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে খাটের পর বসলো। মিনারা বেগম বিচলিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে আসেন।

-ফুয়াদ বাবা, কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? কই ছিলে তুমি এতদিন?

ফুয়াদ কোনো কথা না বলে বেসিনের দিকে যায়। অনেকক্ষণ ধরে চোখে মুখে পানি দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর শোকে নির্ঘুম এক যন্ত্রণাদায়ক রাতের বিভীষিকা থেকে এখনো বের হতে পারেনি।

ওর লোপ পাওয়া চেতনা, বুদ্ধিজ্ঞান ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগলো। বেসিনের সামনে থেকে এসে আবার খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে। চোখ বুঁজে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে। একজন মৃত মানুষকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার প্রবল স্বস্তি, আনন্দ হচ্ছে মনে। সবকিছু কি দারুণ ভাবে দুঃস্বপ্নের মত মিথ্যা হয়ে গেছে! সারা রাত তো এই প্রার্থনাই করেছে।

-আন্টি আপনার সামনে একটা সিগারেট ধরাই? আমার ব্রেনটা তাহলে আরেকটু সচল হবে।

মিনারা বেগম ফুয়াদের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছেন না। ফুয়াদ ফিরে আসবে এই ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস ছিলো। ফিরে তো এসেছো ও। কিন্তু পাগল হয়ে। আধা পাগল নাকি পুরো পাগল তা এখনো পরিষ্কার না। ওদিকে তার মেয়েটা সন্তান-সম্ভবা। দুশ্চিন্তায় তার মাথায় চক্কর দিচ্ছে।

তিনি চিন্তিত গলায় বললেন,

-ধরাও।

ফুয়াদ সিগারেট ধরালো। ধীরে ধীরে সেটি শেষ করে মিনারা বেগমকে বলল,

-দুঃখিত আন্টি! আপনার সামনে বসে সিগারেট ধরানোর জন্য! কিন্তু আমি নিরুপায়।

মিনারা বেগম শুকনো মুখে বললেন,

-ঠিক আছে। সমস্যা নেই।

-আপনাকে এরকম চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? চিন্তা করবেন না। আমার মাথা খারাপ হয়নি। এই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। আচ্ছা এবার বলুন এশা কোথায় গেল বের হয়ে?

মিনারা বেগম মনে মনে বললেন, পাগলে তো আর বুঝতে পারে না যে সে পাগল হয়ে গেছে।

-এশা টিউশনে গেছে।

-বাসার ঠিকানাটা দিন।

-ঠিকানা আমি জানি না।

-ঠিক আছে। সমস্যা নেই। আমি আজ এখানে বেড়াবো। দুপুরে রান্না করেন আমার জন্য।

এই বলে ফুয়াদ ওখান থেকে বের হলো। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন করে রাহাতকে কল করে বলল,

-আমি তোমার বাসায় আসছি পুলিশ নিয়ে।

(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৬

রাহাতের বাসার দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সম্পা ফট করে দরজা না খুলে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো ফুয়াদ এসেছে। একা আসেনি সঙ্গে দুইজন পুলিশ নিয়ে এসেছে।

কী আশ্চর্য, ভয়ঙ্কর কাণ্ড! সম্পা চেঁচিয়ে ভীতু গলায় বলল,

-দেখো ফুয়াদ সত্যি পুলিশ নিয়ে এসেছে।

রাহাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত রেগেমেগে আগুন হয়ে দরজার কাছে গেল। সে ভাবতে পারেনি ফুয়াদ সত্যি পুলিশ নিয়ে আসবে। ফাজলামি, খামখেয়ালির একটা সীমা থাকে! এই সামান্য কারণে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের বাসায় কেউ পুলিশ নিয়ে আসতে পারে! পুলিশ নিয়ে আসা কোনো তামাশার ব্যাপার নাকি! তাও এই ভাড়া বাসায়! আর পুলিশের কাছে কি বলে অভিযোগ করেছে ও?

সম্পা রাহাতকে দরজা খুলতে বাঁধা দিয়ে বলল,

-প্লিজ দরজা খুলো না। সত্যি আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।

রাহাত বিরক্ত মুখে সম্পাকে সরিয়ে দিয়ে সজোরে দরজা খুলে। ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-এদেরকে কোথা থেকে ভাড়া করে এনেছিস? বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু! এদেরকে নিয়ে এক্ষুণি এখান থেকে যা।

ফুয়াদ নির্লিপ্ত মুখে বলল,

-ভাড়া করে আনিনি। ওনারা আসল পুলিশ।

রাহাত আরো খেপে গেল,

-মা তোকে পুলিশে দিয়েছে বলে আমরা বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তোর তো আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিলো বিদেশ যাওয়ার। টাকা-পয়সা সরিয়েছিস। আমাদের তো কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। হাতে টাকা পয়সা যা ছিলো সব কাছিয়ে এসেছে। এই মাস পরই চাকরির খোঁজে বের হতে হবে। মা ও আমাদের বাড়িতে সাধছেন না। সকালে টেবিল ভর্তি নাশতার বদলে এখন শুধু পরোটা ভাজি জুটে। সতেরো পদের তরকারি পাই না ভাতের টেবিলে। এসি রুমে ঘুমিয়ে অভ্যাস! এসি গাড়িতে চলাফেরা করে অভ্যাস। এখন রোদের মধ্যে রিক্সায়…।

ফুয়াদ কথার মাঝে রাহাতকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-নশ্বর এই পৃথিবীতে এত সুখ করে কি হবে!

এরপর ও পুলিশকে বলল,

-এই মামলার আসামি এই একজনই। আমার ধারণা ভাবী নির্দোষ। তার মত সহজ-সরল নরম মনের মানুষ নিশ্চয়ই এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় ছিলেন না।

সম্পা এবার দরজার সামনে এসে ভারী আহত গলায় বলল,

-তুমি সত্যি মামলা করেছো ফুয়াদ! এই তুচ্ছ বিষয়ে কেউ মামলা করে! ভাইয়ে ভাইয়ের ব্যাপার। মামলা না করে আমাকে বলতে। প্রয়োজন হলে আমি তাকে দুই দিন খেতে দিতাম না।

রাহাত উত্তেজিত মুখে বলল,

-অনেক ফাজলামি হয়েছে। যা এখান থেকে। নয়ত এই পুলিশ সহ তোকে বাথরুমে আটকে রাখবো। এই বদমাইশ কিসের মামলা করেছিস? কি অভিযোগে? কত ধারায়?

সম্পা চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল,

-বাথরুমে আটকানোর দরকার নেই। বাসায় ঢুকলেই কিন্তু ও আমার প্লেট, গ্লাস…।

-থামো তুমি।

ধমকে উঠলো রাহাত। এর ভিতর একজন পুলিশ সদস্য গুরুগম্ভীর গলায় বলল,

-আপনি কিন্তু আমাদের অপমান করছেন। আমরা নকল পুলিশ নই। দুই মিনিট সময় দিলাম আপনাকে। শার্ট গায়ে দিয়ে দ্রুত আমাদের সাথে চলুন। আপনার নামে কি অভিযোগ, কত ধারায় মামলা হয়েছে থানায় গেলেই জানতে পারবেন। দুই মিনিট সময় কিন্তু। কোনো গড়িমসি করলে জোর করে ধরে নিয়ে যাবো। সেটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না।

সম্পা অসহায় মুখে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এই তুচ্ছ কারণে তুমি সত্যি সত্যি নিজের ভাইকে পুলিশে দিবে!

দুই মিনিট পেরিয়ে গেলেও রাহাত শার্ট গায়ে দিলো না। দরজার সামনেই অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাগে ওর মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। ভাড়া বাসা বলে চিৎকার, চেঁচামেচি করতেও পারছে না।

-দুই মিনিট পেরিয়ে গেছে কিন্তু।

রাহাত থমথমে গলায় সম্পাকে আদেশ করলো,

-যাও একটা শার্ট নিয়ে আসো।

-সত্যি তোমাকে থানায় নিয়ে যাবে!

-দেখতে পাচ্ছো না! এত কথা বলছো কেন? যাও শার্ট নিয়ে আসো।

সম্পা শার্ট এনে বলল,

-আমিও তোমার সাথে যাবো।

আমিনুল নামের পুলিশ সদস্যটি বললেন,

-আপনাকে এই মামলার আসামি করা হয়নি। আমরা আপনাকে নিতে পারবো না। দুঃখিত!

রাহাত শার্ট গায়ে দিতে দিতে ফুয়াদের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,

-আসি থানা থেকে। তোকে যে আমি কি করবো।

-এসো চল্লিশার দাওয়াত তোমাকে।

সম্পা ভেবেছিল ফুয়াদ শেষমেশ নিশ্চয়ই বলবে এসব ফাজলামি। কিন্তু না! রাহাতকে সত্যি সত্যি পুলিশে নিয়ে গেল। সম্পা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছে। ওর এবার কান্না পাচ্ছে।

ফুয়াদ পুলিশের সঙ্গে যায়নি। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ে জুতা খুলছে। জুতা খুলে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে বলল,

-ভাবী দুপুরে আমার জন্য রান্না করার প্রয়োজন নেই। আমি এশাদের ওখানে খাবো। আচ্ছা গতকাল রাতে আমি ফুল নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো কোথায়?

ফুয়াদের আচরণে সম্পা বাক্যহারা হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বিহ্বল হয়ে বলল,

-আমার স্বামীকে তুমি পুলিশে দিয়েছো। আবার আমাদের বাসায় ঢুকে শুয়ে আছো! এসব কি মশকরা শুরু করেছো!

-রিল্যাক্স ভাবী! আপনি সন্তানসম্ভবা মানুষ। এত চাপ নিবেন না।

-আমি তোমাকে মনে মনে কুৎসিত বকাঝকা করছি ফুয়াদ। ভদ্রতার খাতিরে শুধু মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না।

-ভেরি গুড ভাবী। আপনার এই ভদ্রতা আমাকে আপ্লুত করছে। আচ্ছা এশা কোন বাসায় টিউশন করে আপনি চিনেন? ওর নতুন ফোন নম্বর জানেন?

সম্পা আর কোনো কথা না বলে ধপধপ করে পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।

ফুয়াদ কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে এরপর উঠে গতকালের ফুল গুলো খুঁজলো। টেবিলের উপরে রেখেছিল। সেখানেই পেল। সম্পাকে ডেকে বলল,

-ভাবী আমি বের হচ্ছি। দরজা আটকে দেন।

সম্পা দরজা আটকে এশাকে ফোন করলো।

-শুনো এশা তোমার স্বামী রাহাতকে পুলিশে দিয়েছে।

-মানে! কি বলছেন ভাবী!

-যা শুনছো তাই বলছি। তুমি কোথায় এখন?

-আমি ক্যাম্পাসে। দুইটা ক্লাস শেষ হলো। ফুয়াদ রাহাত ভাইয়াকে পুলিশে দিয়েছে কেন?

এশা বিচলিত গলায় জানতে চাইলো।

-সেই কাহিনী বলার মেজাজ নেই এখন। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলবো। ওই বদমাইশের সঙ্গে এত সহজে ভাব করো না। সহজে পাওয়া জিনিসের মানুষ কদর করে না। ওকে নাকি দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। নিজের ভাইকে পুলিশে দিয়েছে ও!

এই বলে সম্পা ফোন কেটে দিলো। এশা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। ও সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করলো। এই মুহূর্তে সম্পার ফোনে কথা বলার মেজাজ নেই। সে ফোন ধরলো না।
__

ফুয়াদ অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে যেমন ভীষণ পানির তৃষ্ণা পায়। ওর ও সেরকম এশাকে জড়িয়ে ধরার তৃষ্ণা পাচ্ছে। ওই মেয়েটাকে বুকের মধ্যে আধা ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে রাখতে পারলে বোধ হয় ওর সকল অস্থিরতা দূর হবে।

এশার সঙ্গে সংসার করবে, ওকে যত দ্রুত সম্ভব লন্ডন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় ফিরেছিলো ফুয়াদ। তবে ওর জন্য এত আকুলতা, তৃষ্ণা নিয়ে ফিরেনি। রাহাতের এক কূট-বুদ্ধিতে ও কেমন ওলটপালট হয়ে গেল!

এশাকে আগে জড়িয়ে ধরবে নাকি ফ্ল্যাটে না থাকার জন্য ধমক দিবে? রাহাত এই কাজ না করলে আগে কিছুক্ষণ প্রচণ্ড রাগারাগি করতো, ঝাড়ি দিতো। এশা নিশ্চয়ই তীব্র রাগ, অভিমান করে আছে। এই মেয়ের এত অভিমান ও আগে বুঝতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও তো করেনি। এখন বুঝতে হবে রাগ, অভিমান, অভিযোগের তীব্রতা কতখানি। লন্ডন যাওয়ার আগে ভাঙাতে পারবে তো?

কয়েক কেজি মিষ্টি, ফলমূল কিনে মিনারা বেগমের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো ফুয়াদ। এশা এখনো ফিরেনি! অসহ্য ধরণের অপেক্ষা। ফুয়াদের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ঘুরেফিরে সেই রাহাতের উপর গিয়েই রাগটা চাপছে! সে অমন ভয়াবহ ফাজলামি না করলে ওর মন এত উতলা হতো না।

মিনারা বেগম মাছ, মাংস কিনে আনে মেয়ের জামাইয়ের জন্য। একা হাতে এত রান্নাবান্না করতে সময় লাগছে। দুপুর গড়িয়েছে। তার রান্না এখনো শেষ হয়নি।

ফুয়াদ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-আন্টি আমি রান্নাবান্না মোটামুটি জানি। আপনাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি?

এই ছেলের মাথায় কি সত্যি গণ্ডগোল হলো! তার সেই বড়লোক, নাক উঁচু মেয়ের জামাই আজ তাকে রান্নায় সাহায্য করতে চাচ্ছে। কি ভয়াবহ ব্যাপার!

-আপনি কি আবার ভাবছেন আমার মাথায় সত্যি সমস্যা হলো কিনা! আসলে এশা এখনো ফিরছে না তো। অপেক্ষা ব্যাপারটা খুব কষ্টদায়ক। আপনাকে রান্নার কাজে সাহায্য করলে সময়টা একটু দ্রুত কাটতো।

ফুয়াদ এশার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছে! কি এক আনন্দে মিনারা বেগমের মন পুলকিত হয়। সেই আনন্দ তার গলায়ও প্রকাশ পেল,

-না, বাবা! কি বলছো। আমার রান্নাবান্না প্রায় শেষ। শুধু মুরগি ভুনাটা বাকী আছে। তোমার কোনো সাহায্য করতে হবে না।

-ঠিক আছে তাহলে মুরগিটা আমি ভুনা করার চেষ্টা করি।

ফুয়াদ রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকে মুরগি রান্না শুরু করে। মিনারা বেগম একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখেমুখে আশ্চর্য ভাব।
__

এশার শরীর দুর্বল লাগছে। ও আজ ক্লাস শেষে টিউশনে না গিয়ে বাসায় ফিরলো। দরজার সামনে এসেই ফুয়াদের জুতা দেখতে পেল। ওর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। কেমন উত্তেজনা, অস্থিরতা অনুভব করে। যে মানুষটাকে ও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তার উপস্থিতি ওর মনে এত ব্যগ্রতা তৈরি করছে কেন? সন্তান হওয়ার খবর জেনে ওর মন কি অজান্তেই সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেছে? নাকি এটা না হলেও একই অনুভূতি হতো?

ধীর পায়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করলো এশা। দুই রুমে উঁকি দিলো। ফুয়াদকে দেখছে না। বাথরুমও বাইরে থেকে আটকানো। ও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে অস্থির গলায় ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

-মা দরজার সামনে জুতা কার?

এশার আওয়াজ পেয়েই ফুয়াদ ভীষণ উদগ্রীব হয়ে এসে তৃষ্ণার্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অতিশয় আকুল গলায় বলল,

-এশা আমি তোমাকে এক ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই। আন্টি এখানে। রুমে চলো প্লিজ।

ফুয়াদের এই তীব্র আকুলতা উপেক্ষা করে এশা নীরস গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি রাহাত ভাইয়াকে পুলিশে দিয়েছেন কেন?

-এসব কথা পরে বলবো। তোমাকে জড়িয়ে ধরার তৃষ্ণায় আমার বুকের ভিতর চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

-আগে বলুন।

ফুয়াদ অধৈর্য গলায় বলল,

-এই খবর তোমাকে কে দিলো! সে আমার অনেক বড় উপকার করেছে। আমাকে কিছু ব্যাপার সঠিকভাবে উপলব্ধি করিয়েছে। যেগুলো আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

-তাহলে তাকে পুলিশে দিলেন কেন?

-পুলিশে দিয়েছি এটা সঠিক। তবে পুলিশ তাকে থানায় নেয়নি। বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়েছে।

-কিসব তামাশা করেন আপনারা!

-এখানে বসেই জড়িয়ে ধরবো তোমাকে?

ফুয়াদের গলা কিছুটা অসহায় শুনালো। এশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রত্যুত্তর করলো,

-আপনার স্পর্শ আমার ভালো লাগবে না। দুপুরে খেয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। আমি আপনার সাথে বিয়েটা রাখবো না।

(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা