এই জোছনা ধারায় পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
328

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৪১(শেষ পর্ব)

এশার পরনে সোনালী-রূপালি জরিতে কাজ করা সাদা রঙের একটি জামদানি শাড়ি। হাতে, কানে, গলায় স্বর্ণের গহনা। ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক। চোখে যত্ন করে আইলাইনার টেনেছে সব সময়ের মত। চুলের খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। ফুয়াদ এনেছে। এই চমৎকার জামদানি শাড়িটিও সে এনেছে গতকাল। ওর পছন্দের রঙ সাদা সেজন্য।

এই সাজে কি যে চমৎকার দেখতে লাগছে এশাকে! ও হাঁটুতে মুখ গুঁজে বিছানার উপর বসে আছে। মনে হচ্ছে অসম্ভব রূপবতী কোনো বিষণ্ণ সম্রাজ্ঞী!

ফুয়াদ লাগেজ গোছানো বন্ধ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এশা হাঁটু থেকে মুখ তুলে বিরক্ত গলায় বলল,

-কী ব্যাপার? দুপুর হয়ে গেছে। রাতে ফ্লাইট। আপনার এখনো লাগেজ গোছানোর কোনো তাড়া নেই। তিনটা শার্ট ভাঁজ করেছেন সবে!

-এশা তোমাকে দেখতে অমৃতা রাও এর মত লাগছে।

-অমৃতা রাও কে?

-চিনো না তুমি?

-উহুঁ!

-অমৃতা রাও একজন নারী ফুটবলার।

-ওহ।

ফুয়াদ শব্দ করে হাসলো।

-মানে তুমি সত্যি চিনো না? অমৃতা রাও বলিউডের অভিনেত্রী।

-আমি হিন্দি মুভি দেখিনি কখনো। বাংলাও তেমন দেখা হয়নি। কিন্তু মায়ের সঙ্গে উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের অনেক মুভি দেখেছি। মায়ের পছন্দের জুটি ছিলো।

-তাহলে তোমাকে নিয়ে হিন্দি রোমান্টিক মুভি গুলো সব দেখতে হবে।

-ঠিক আছে দেখবো। কিন্তু আপনি কি এই তিনটা শার্ট নিয়েই লন্ডন যাবেন?

ফুয়াদ আলমারি, ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,

-কি কি যে নিবো বুঝতে পারছি না। সবকিছু রেখে তোমাকে লাগেজের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

এশা কিছু বলল না। ওর বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠছে। ফুয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

-এইটুকু ছোট্ট জীবন! তোমার দিকে তাকিয়ে থেকেই বোধ হয় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কী দরকার লন্ডন ফন্ডন যাওয়ার!

এই বলে ফুয়াদ লাগেজ রেখে উঠে দাঁড়ালো। এরপর রুম থেকে বের হয়ে গেল।

কী আশ্চর্য কাণ্ড! লন্ডনের ভিসা পাওয়া একেবারে সামান্য ব্যাপার নাকি? সবকিছু ঠিক, রাতে ফ্লাইট আর এখন ইচ্ছে হলো না দেখে গেলাম না। বাড়াবাড়ি ধরণের খামখেয়ালি এসব। বিয়ের পর থেকে শুনে আসছে সে দেশের বাইরে যেতে চায়। তীব্র ইচ্ছা তার। সেই ইচ্ছে এখন এত তুচ্ছ হয়ে গেল!

বাচ্চা হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই সে কেমন গড়িমসি করছে। যে মানুষটা বিয়ের পরই বলেছিল কখনো বাচ্চা কাচ্চা চায় না। সেই মানুষটা বাচ্চা হওয়ার খবরে এতটা খুশি হলো! বাড়াবাড়ি রকমের আত্মহারা হয়ে গেল! কেমন পাগলামি করে বসলো! এখন লন্ডন যাওয়াও বাতিল করতে চাচ্ছে। এত আহ্লাদের তো প্রয়োজন নেই এশার। যেটুকু পেয়েছে তাই ওর জন্য রূপকথার মত।

তার এই পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। ফুয়াদ চলে গেলে ভীষণ কষ্ট হবে, অসুবিধা হবে, সারাক্ষণ বুকের ভেতর হাহাকার করবে, তাকে একটু জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষায় চোখ ভিজে যাবে! তবুও ইচ্ছে করছে না। প্রিয় মানুষের স্বপ্ন পূরণের পথে পিছুটান হতে আছে?

*

ফুয়াদ বাসা থেকে বের হয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলো।

পলি বেগম অনেক দিন পর আজ রান্না ঘরে ঢুকেছেন। ফুয়াদ চলে যাবে। ওর পছন্দের কিছু রান্না করবেন। আলু দিয়ে শিং মাছের ঝোল, চিংড়ি মাছের বড়া আর নারকেলের পিঠা। তার শরীর খুব একটা সুস্থ না। এইটুকু করতেই কষ্ট হয়ে যাবে। বাকী যা রান্না নাজমা আর সুমি করবে।

কিছুক্ষণ পর ফুয়াদ বাসায় ফিরলে পলি বেগম বললেন,

-যেতে ইচ্ছে না করলে বাদ দাও। বাচ্চা হওয়ার পরে তিন জন এক সাথে যেয়ো।

পলি বেগমের এই পরিবর্তন নিয়ে এখনো সবার মনে শঙ্কা রয়েছে। তিনি পুরোপুরি সেরে উঠলে বুঝা যাবে আসলেই তার মন, চিন্তা-ভাবনা সত্যি এতটা পরিবর্তন হয়েছে কিনা! তার ভুল, দোষ গুলো তিনি সত্যিই উপলব্ধি করতে পেরেছেন কিনা! হয়ত সত্যি পেরেছে। হুট করে একাকীত্ব, স্বামী-সন্তানদের সাথে দূরত্ব তাকে অনেক কিছু উপলব্ধি করিয়েছে! চোখ খুলে হাসপাতালের বিছানায় কাউকে না দেখার ভয়াবহতা হয়ত তার অহংকার গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

ফুয়াদ রুমে এসে এশাকে বলল,

-যেতে ইচ্ছে করছে না। থেকে যাই?

এশা ইস্পাতের মত কঠিন মুখে বলল,

-আমি কোনো নরম, লিকলিকে মেয়ে না ফুয়াদ! যথেষ্ট শক্ত মেয়ে আমি! এ বাসায় অসুবিধা হলে মায়ের কাছে চলে যাবো। আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমি একবারেই ভয় পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে আর এই কথা বলবেন না। তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে আবার আহাম্মক বলবো।

-তুমি হঠাৎ করে এত নির্দয়, পাষাণ হয়ে গেলে কীভাবে এশা!

-আপনি লন্ডন যাওয়ার জন্য লাগেজ গোছাবেন নাকি আমি মায়ের বাসায় যাওয়ার জন্য লাগেজ গোছাবো?

এশার এই ভয়াবহ রাগের মুখে না পড়লে ও নির্দ্বিধায় লন্ডন যাওয়া বাতিল করে দিতে পারতো। কিন্তু ফুয়াদ এই মুহূর্তে আবিষ্কার করলো ও এই মেয়েটাকে কেমন ভয় পাচ্ছে।

ফুয়াদ অত্যন্ত গম্ভীর মুখে লাগেজ গোছাতে লাগলো। এশা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ওর এত লোভ হয় আজকাল সারাক্ষণ ফুয়াদের সাথে থাকার! এই লোভ তো সে ই বাড়িয়েছে। এই মানুষটার এতখানি ভালোবাসা পাবে তা তো ও কখনো ভাবেনি!

ও যদি একবার থেকে যেতে বলে সে আনন্দের সঙ্গে লন্ডন যাওয়া বাতিল করে দিবে। কিন্তু এতদিনের স্বপ্ন, এত টাকা-পয়সা খরচ হলো। তা বলা উচিত হবে না।

-তোমার কয়টা জামাকাপড় দাও তো এশা। অনেক দিন ধরে পরেছো এমন।

-আমার জামাকাপড়! আমার জামাকাপড় দিয়ে কি করবেন?

-বিমানের পাখা মুছবো। ননসেন্স!

এশা বোকার মত তাকিয়ে থাকলো।

-তোমার গায়ের ঘ্রাণ আমার ভালো লাগে এশা।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফুয়াদের বুকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। ওর এই মুহূর্তে এত কান্না পাচ্ছে। ফুয়াদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি থেকে যান। ওদের বাচ্চাটা যখন জন্মাবে তখন ফুয়াদ কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকবে! ওই দূর দেশে বসে মানুষটা নিশ্চয়ই ব্যাকুল হয়ে থাকবে!

ও দু’হাতে ফুয়াদের গাল, ঠোঁট, কপাল ছুঁতে ছুঁতে বলল,

-আমার এত সৌভাগ্য কেন ফুয়াদ?

-নিজেকে হঠাৎ এত ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে কেন?

-জানি না। আমি আগে চোখ বন্ধ করলেই শুধু দুঃখ দেখতে পেতাম।

-এখন কি দেখো?

-আমার স্মৃতি থেকে সারাজীবনের সমস্ত দুঃখ, যন্ত্রণা মুছে গেছে।

-সাত দিনেই?

-হুঁ।

-এত পাগল মেয়ে তুমি এশা। সামান্য এইটুকু ভালোবাসায় তোমার জীবনের সমস্ত দুঃখ, যন্ত্রণা মুছে গেছে। আমি যে আরো ভয়াবহ ভাবে ভালোবাসতে জানি।

এশার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। ও কান্নারত মুখে ফুয়াদের ঠোঁটে লম্বা চুমু খায়। দীর্ঘ চুমুর শেষে ও ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলল,

-ফুয়াদ আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবেন অনেকক্ষণ? দুই, চার, পাঁচ ঘন্টা?

ফুয়াদ ওর চোখের জলটুকু যত্ন করে মুছে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রাখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দুই হাতে ওর মুখটা উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ওর বিষিয়ে যাওয়া, ত্যক্ত-বিরক্ত জীবনটা কতখানি মায়ায় জড়িয়ে গেল। বিস্মিত মনে ভাবে।

*

গেটের সামনে গাড়ি এসে থেমেছে। শফিক আহমেদ তাড়া দিয়ে বললেন,

-তাড়াতাড়ি বের হও। জ্যামে পড়লে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।

পলি বেগম আবারও ফুয়াদকে বলল,

-এখন যেতে ইচ্ছে না করলে পরে যেয়ো। টাকার কথা ভেবো না। আমি দিবো।

ফুয়াদের বিপত্তি এক জায়গায়ই হয়েছে। এশার সঙ্গেই পেরে উঠছে না। অথচ সে কান্নাকাটি করে চেহারা লাল করে ফেলেছে। কিন্তু ফুয়াদ যাবে না বললেই চোখ-মুখ শক্ত করে এমন ভাবে তাকায়! ওই চাহনিতে ফুয়াদ সত্যি সত্যি বোধ হয় ঘাবড়ে যায়।

মিনারা বেগম এসেছেন কিছুক্ষণ হলো। তিনি আর কখনো এই বাসায় আসবে না বলে মনস্থির করেছিলো। কিন্তু মেয়ের জামাই দেশ ছাড়ছে, না আসলে তা কেমন দেখায়! এশা মায়ের কাছে বিমর্ষ মুখে বসে আছে।

রাহাত আর ফয়সাল ব্যাগ, লাগেজ সব নিয়ে গাড়ি ভরতে লাগলো। যারা যারা বিমানবন্দরে যাবে সবাই তৈরি হলো! কাঁদতে কাঁদতে এশার হেঁচকি উঠে গেল। ফুয়াদের সাদা শার্ট ও চোখের পানি, আইলাইনার, লিপস্টিক দিয়ে নষ্ট করে দিলো।

গাড়ি বিমানবন্দরে থামার পর ফুয়াদ গাড়ি থেকে নেমে ফয়সালকে বলল,

-ভাইয়া, আমি একটু আসছি। দুই মিনিট।

দুই মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট হয়েছে। ফুয়াদ এখনো আসেনি। ফোনও ধরছে না। প্রায় আধা ঘন্টা পর সে ফয়সালকে ফোন দিয়ে বলল,

-তোমরা বাসায় চলো যাও। আমার লন্ডন যেতে ইচ্ছে করছে না। এই মুহূর্তে আমি লন্ডন যাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে অপ্রস্তুত!

ফয়সাল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,

-মানে কি এসব ফাজলামির? তোর যেতে ইচ্ছা করছে না তো তুই বিমানবন্দর পর্যন্ত কেন আসলি?

-আরে এশার ভয়ে।

-বদমাশ! দুনিয়াতে কাউকে আজ পর্যন্ত ভয় পেতে দেখলাম না। সে এখন বউয়ের ভয়ে বিমানবন্দর আসে!

-দুনিয়ার সবাই আর বউ এক ব্যাপার না ভাইয়া! এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল।

-এখন তোর ভয় কেটে গেছে?

-না, কাটেনি। এশার রাগ না কমা পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরবো না। ওর রাগ কমলে আমাকে দয়া করে একটু জানিয়ো।

ফয়সাল ফোন কেটে দিয়ে তীব্র বিরক্ত মুখে সবাইকে বলল,

-ফুয়াদ লন্ডন যাবে না। তোমরা কি এখন এখানে পিকনিক করবে নাকি বাড়িতে যাবে?

এ ধরণের কাণ্ড ফয়সাল বা রাহাত করলে সবাই বিচলিত হতো। ফুয়াদ করেছে বলেই কেউ তেমন বিচলিত হলো না। সবাই আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

এশা থমথমে মুখে গাড়িতে বসে রইল। ফয়সাল ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-তোমার রাগ কমলে আমাকে বলো। ফুয়াদ জানাতে বলেছে।

-সে আমার ফোন ধরছে না। আপনি তাকে ফোন করে বলুন যে, আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। সে যেন রাতের ভিতরই বাসায় ফিরে।

-তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না যে তুমি খুশি হয়েছো।

-অতি খুশিতে আমি পাথর হয়ে গেছি ভাইয়া।

অতি শোকে মানুষ পাথর হয়। খুশিতে কেউ পাথর হয় কিনা ফয়সালের জানা নেই।

*

রাত দুইটার দিকে ফুয়াদ ফোন করে বলল,

-এশা সজাগ আছো? কতটুকু রাগ করেছো? একটু গেটের কাছে আসবে?

ও গেটের কাছে গিয়ে দেখে ফুয়াদ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-নদীর পাড়ে জ্যোৎস্না দেখতে যাবে?

এশা মনে মনে বলল, আপনি যদি বলেন আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে রাজী। কিন্তু মুখে কিছু না বলে চুপচাপ বাইকে চেপে বসলো।

বাইক থামার পর আশেপাশে তাকিয়ে এশার মনে হলো এই জায়গায় ও এর আগেও আরো একবার এসেছিল। ওই যে বিয়ের পর একদিন রাতে ফুয়াদ ওকে নিয়ে এসেছিল জ্যোৎস্না দেখাতে। এখানে বসেই তো সে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কটা কতদূর যাবে জানি না। কিন্তু তুমি কি এই ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারছো? তুমি কখনো মা হবে না..।’

এখানে দাঁড়িয়েই ও ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে ব্যাকুল স্বরে বলেছিল, ‘ফুয়াদ আমার ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।’

ফুয়াদ বাইক থেকে নেমে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

-জীবনটা কত অদ্ভুত এশা!

-অনেক। জীবনে বাচ্চা কাচ্চা না চাওয়া মানুষটা সেই বাচ্চা হবার খবর শুনে লন্ডন গেল না!

ফুয়াদ হাসলো। বলল,

-পরিবারটা আমার কাছে একটা প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা জায়গা ছিলো। এতটাই বিরক্তিকর ছিলো যে আমি আলাদা বাসা পর্যন্ত রাখলাম। পরিবার মানেই আমার কাছে মানসিক যন্ত্রণা ছিলো। এক ধরণের ট্রমা ছিলো। আমি বহুদূরে চলে যেতে চাইতাম। একাকী, নির্জন জীবন চাইতাম। ঠিক করলাম, বিয়ে করলেও কখনো বাচ্চা জন্ম দিয়ে পরিবার তৈরি করবো না!

ফুয়াদ একটু থেমে বলল,

-তিন মাস একাকী থেকে অনেক কিছু উপলব্ধি হলো, একা থেকে কোনো আনন্দ পেলাম না। মনে হলো একা থাকার চেয়ে বিরক্তিকর একটা পরিবার থাকাও ভালো। তখনই মনস্থির করলাম তোমার সঙ্গে সংসার করবো। আর বাচ্চা কাচ্চা ও দরকার। পরিবারটা আমার কাছে এখন আর বিরক্তিকর জায়গা না। ভালো লাগে। শান্তি পাই। সারাজীবন পর পাওয়া এই শান্তি ছেড়ে লন্ডন যাওয়াটা শাস্তি মনে হচ্ছিলো।

ফুয়াদ বসে। এশাও তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কাঁধে মুখ রাখে।

-আপনার এত বড় স্বপ্ন নষ্ট করলেন!

ফুয়াদ ওর মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

-তোমাদের কাছে এই স্বপ্ন একেবারেই তুচ্ছ এশা।

তোমাদের শব্দটা এশার বুকের মধ্যে কি এক অনুভূতি জাগালো!

-বাচ্চা হওয়ার ব্যাপারটা এখন না হলে আমি যেতাম লন্ডন। কিন্তু এই খবরটা শোনার পর থেকেই কেবল একটা ব্যাপারই মনে হলো যে তোমার পাশে থাকা দরকার এই সময়টাতে। এখন লন্ডন যাওয়াটা একবারে সত্যি আহাম্মকের মত কাজ হবে। আর আমার সন্তান জন্মের পর আমার ভিডিও কলে দেখতে ইচ্ছে করেনি। কাঁথার মুড়িয়ে সবার প্রথমে কোলে নিতে ইচ্ছে করেছে। সন্তানের প্রতি অনুভূতি অনেক তীব্র এশা!

এশা কিছু বলতে পারলো না। ওর গলার কাছে অতি আবেগে, আনন্দে, খু্শিতে কিছুটা দলা পাকিয়ে আছে যেন। ওর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

-তোমার হাজবেন্ড একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এশা। চিন্তা করো না। বাংলাদেশেই ভালো চাকরি করতে পারবো। বাবু হোক। তারপর না হয় তিন জন এক সাথে লন্ডন গেলাম। তুমি কি অনেকখানি রাগ করেছো? আরেকটা সাদা জামদানি কিনে দিলে রাগ যাবে? কিংবা গরুর মাংস দিয়ে এক প্লেট ভাত খাওয়ালে?

-আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে ফুয়াদ। মনের ভিতর আনন্দ রাখার জায়গা হচ্ছে না। রাগ রাখবো কোথায়?

চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে ফুয়াদ তাকিয়ে দেখলো এশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ও সেই অশ্রুজল মুছিয়ে দিতেই এশা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

(সমাপ্ত)