বন্ধুর পিরীতি ষোলো আনা পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
279

#বন্ধুর_পিরীতি_ষোলো_আনা
কলমে: মম সাহা

(৪)তথা অন্তিম পর্ব:

স্থির, থমকে যাওয়া মুহূর্ত। এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে কেউ কখনো এর আগে ছেলের সংসার নষ্ট করেছিলেন কি-না সেটা জানা নেই টুইটুবানির। চোখের সামনে ভেসে উঠছে নিজের আসন্ন ভাঙা সংসারটির চিত্র। সে জানে, শাশুড়ি যখন গলায় বটি ধরেছেনই আজ আর তাহলে কোনো গতি নেই। এই বিয়ে ভাঙবেই। শিরোধার্য তা। তার উপর শ্বশুরও বাড়িতে নেই। ব্যবসার কাজে আবারও শহরে গিয়েছেন। তিনি বাড়িতে থাকলে এত বড়ো ঘটনা কখনোই ঘটতো না।
নিজের ভাঙা সংসারের চিত্র কতবার চোখে ভেসে উঠল। শিউরে উঠল মন। যতই সে সোলাইমানের উপর রাগ করুক, অভিমান করুক কিন্তু ভালো তো বাসে অনেক। তার জীবনে সোলাইমানই একমাত্র সেই মানুষটা যাকে টুইটুবানি নিজের সুখ, স্বপ্ন, শখ ভেবেছিল।

জামেলা আক্তার ছেলের নিস্তব্ধতায় আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কিরে, সোলাইমাইন্যা! দে তালাক। এহনি তালাক দিবি নাইলে আমার লা শ দেখবি।’

জামেলার হুকমি মারাত্মক রকমের সত্যি মনে হচ্ছিল। উনার বোন রেহানা বেগম ধরতে গেলেন উনাকে কিন্তু জামেলা আক্তার ধমকে উঠলেন বোনকে,
‘আমার কাছে আইবি না, রুনু। কেউ আমার কাছে আইলে তারেও শেষ কইরা দিমু। এদিকে আমার আর আমার পোলার কথা হইতাছে।’

রেহানা বেগম বিচলিত ভঙ্গিতে বোনকে বুঝালেন,
‘আপা, বডিদাটা ছাড়। লাইগ্যা যাইবো তো। এডি কোনো কাম হইলো! পোলা আর পোলার বউয়ের উপর রাগ কইরা কেউ এমুন করে? ছাড় কইলাম।’

রেহানা, সালমা, বকুলের চিৎকার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড় জমে গিয়েছে। সবাই-ই আতঙ্কে চিৎকার করছে।
কেবল আতংক নেই একজনের ভেতর। সে হলো টুইটুবানি। কারণ মেয়েটা জানে, তার শাশুড়ি কখনোই নিজের ক্ষতি করবেন না। এসব মানুষ অন্যের ক্ষতি করতে পটু কিন্তু নিজের ক্ষতি কোনোদিন করে না। তাই এসকল নাটকই অন্তস্থলে পৌঁছায় না তার। বরং স্বামীর দিকে তাকিয়ে হেসেই বলল,
‘কী হইলো? আপনের আম্মা তো ওদিকে মইরা যাইতাছে। হেরে বাঁচান তাড়াতাড়ি। দেন তালাকা আমারে। হেরপর তো আপনের জীবনে সুখ আর সুখ। আমি পোলাপাইনের মুখ দেহাইতে পারি নাই কিন্তু হেরপর যারে আনবেন হেয় নিশ্চয় দেহাইবো। আপনের আম্মার মনের মতন হইবো তাই না? আইজ তো আপনের সুখের দিন। আনন্দের দিন।’
অতি দুঃখে মানুষের বিবেকবুদ্ধি নাকি লোপ পায়। টুইটুবানির ক্ষেত্রেও তা হলো। এতটাই পাথর হয়ে গেল সে যে কী বলছে, না বলছে নিজেও জানে না। আবার হয়তো জানে!

জামেলা আক্তার ছেলের নিশ্চুপতা সহ্য করতে না পেরে হিং স্র কণ্ঠে বললেন,
‘চুপ কইরা আছোছ ক্যান? তুই কী চাইতাছোছ আমি গলায় পোঁচটা দিয়া মরি?’

সোলাইমান এবার বহু সময় পর সকলের উদ্বিগ্নতাকে শান্তি দিয়ে কথা বলে উঠল। রাশভারি, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ম রো, আম্মা। তোমার হায়াত যদি এই পইয্যন্ত হয় তাইলে আমি আর কী করতে পারুম? আল্লাহ তায়ালা যদি তোমার মরণ লেইখ্যা রাহে আইজ, এই মুহুইর্তে তাইলে কার সাইধ্য আছে তা বদলানের? কারো সাইধ্য নাই।’

সোলাইমানের কথা যেন বি স্ফো র ণ ঘটাল এমন ভয়ঙ্কর মুহূর্তে। প্রথমে তো কেউই বুঝে উঠতে পারল না ও কী বলেছে কিন্তু যখন বুঝে উঠল তখন তাজ্জব বনে গেল। সবারই অবাকের পাল্লা ভারি হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাসই করতে পারল না কেউ যে সোলাইমান, অতি মা ভক্ত সোলাইমান মা’কে মরে যেতে বলছে।
জামেলা তো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। অবাক স্বরে বললেন,
‘আমারে মইরা যাইতে কইতাছোছ?’

সোলাইমান ভীষণ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘আমি মইরা যাইতে বলার কে, আম্মা? আমি কেবল এডাই বুঝাইলাম, তুমি মরো কিংবা যা ইচ্ছা করো আমি তালাক দিমু না। এই মাডি ভাগ হইয়া গেলেও আমি অরে ছাড়ুম না।’

‘ছাড়বি না!’

‘না আম্মা, ছাড়ুম না। আইজ থেইক্যা পাঁচ বছর আগে যহন আমি অরে ভালোবাইস্যা ফেলছিলাম। নিজের পছন্দের কথা আব্বারে জানাইয়া কইছিলাম বিয়া করলে অরেই করুম ঠিক তহনই আমি অরে চিরজীবন আমার কইরা রাহনের সিদ্ধান্ত নিয়াই কথাডা কইছিলাম। এমনে এমনে তো কই নাই, আম্মা। যেই মাইয়াডা চিরডা জীবন আমার মুখের দিকে তাকাইয়া তোমার হগল অত্যাচার, অপমান সইয্য কইরা গেছে তারে আমি ছাড়ি কেমনে কও। পাঁচটা বছরে কত হাজারবার তুমি তারে ছুডু করছ কিন্তু অয় মুখটা বুইজ্জা সব সইয্য করছে। আমি কইতাম— ময়না, আম্মা হইল বেহেশত। তারে দুঃক্কু দিও না।
মাইয়াডা হেই কথা মাইন্যা চলছে। তুমি তারে কষ্ট দিলেও সে তোমারে দেয় নাই। এমনকি হেইদিন তার আব্বার এমন বড়ো অপমানের পরেও হেয় কথা কয় নাই। এমন একটা মানুষরে আমি কেমনে ছাড়ুম কইতে পারবা? আল্লাহ্ যে আমার এ কামের ক্ষমা করব না।’

ছেলের কথায় হতভম্ব জামেলা। বটি ধরে রাখা মুঠোটা ঢিলে হয়ে এলো।

‘হেয় যদি কিছু না কইয়াই থাহে তাইলে আইজ আমার লগে এই চোপা কে করল?’

সোলাইমান হাসল। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে স্ত্রী’র বাহু জড়িয়ে ধরল। টুইটুবানি তখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার স্বামী আজ প্রতিবাদ করছে। তার এত বছরের আফসোস ঘুচিয়ে দিয়েছে এই মুহূর্তে। মা ভক্ত ছেলে আজ মায়ের মুখের উপর সত্যটুকু বলছে।

‘আম্মা, লেবু বেশি চিপলে তিতা হইয়া যায়। হেই কথা হুনছিলা? তুমি লেবু বেশি চিইপা ফেলছো তাই তিতা হইতে বাইধ্য হইছে। একটা মানুষ আর কত কথা সইয্য করব কও? তুমি এমন কী ব্যাপার বাদ রাখছ যার জইন্য অরে কথা হুনাও নাই? অর বাপ ক্যান গরীব। অর ক্যান গায়ের রঙ সুন্দর না। আমাগো ক্যান পোলাপান হয় না। এমনকি আমার বউ তার স্বামীর লগে ঘুরতে গেছে বইল্যাও তুমি কথা হুনাইছো। স্বামীর লগে তার ভালোবাসার সম্পর্ক সুন্দর বইলাও তারে কথা হুনতে হইছে। আইজ হেই কথা মুখে আনতোও আমার শরম করতাছে। যহন তুমি এইসব নিচু নিচু ব্যাপারে কথা শুনাইতা অরে তহন আমার মাডিতে মিইশ্যা যাইতে মন চাইতো। যেই মানুষটার কাছে আমি বড়ো মুখ কইরা কই আম্মা আমাগো বেহেশত, হেই মানুষটাই যহন এমন আচরণ পায় বেহেশত সমান মানুষটা থেইক্যা তহন কেমন লাগে জানো আম্মা? ময়না কষ্ট পাইলে আমারে কয়, অভিমান করে কিন্তু তোমার এই ব্যবহার আমারে যে ভিতর ভিতর কেমন ছুডু কইরা ফেলত এইডা আমি কাউরে কইতে পারি নাই। যেই আম্মারে আমি মাথাত কইরা রাখছি হেই আম্মা যদি পোলার আর পোলার বউয়ের কথা হুনোনের লাইগ্যা ঘরের টিনে,দরজায় কান পাইত্যা রাহে তারে আর কতডুকু সম্মান করা যায় কও তুমি। তা-ও তো এই মাইয়াটা তোমারে সম্মান করছে। এতডি বছর। আমি অর জায়গায় হইলে হইতো এইডা পারতাম না।’

নিজের চিরন্তন সত্য গুলো এভাবে ছেলের মুখ থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসবে তা যেন ভাবতে পারেননি জামেলা। তার উপর প্রতিবেশীদের ছি ছি ভেসে এলো। নিজেকে এমন লজ্জা থেকে বাঁচাতে তিনি তেড়ে এলেন টুইটুবানির দিকে। কেবল চুলির মুঠিটা ধরতে গেলেন,
‘মা গী, আমার পোলারে তুই…..’ বাকিটুকু আর বলতে পারলেন না। তার আগেই বাড়ি কাঁপিয়ে ধমকে উঠল সোলাইমান।

‘আম্মা, অর গায়ে যদি আর একটা টোকা পড়ে তাইলে এই বাড়িত আগুন লাগাইতে আমি দুইবার ভাবুম না। অনেক হইছে। আর না।’
সোলাইমানের ধমকে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল সকলের। সালমা, রেহানা এসে জামেলাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। সারা জীবন এই ছেলেটা মিনমিন করেছে সেই ছেলেরই এমন ধমক রুহ অব্দি পৌঁছে গেল যেন। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন উঠোনে। সোলাইমান একবার ফিরেও তাকাল না। বরং টুইটুবানিকে বলল তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে আনতে। সালমা দেবরকে আটকানোর চেষ্টা করল। বলল,
‘কী করো, ভাই? পা গ ল হইলা? আম্মা নাইলে রাগের মাথায় কইয়াই ফেলছে কয়ডা কথা। তাই বইলা তুমি বাড়ি ছাড়বা?’

‘ভাবি, এই বাড়ি টুইটুবানিরে কহনো আপন কইরা নেয় নাই। আমি তবুও পাঁচটা বছর অপেক্ষা করছিলাম, ভাবছিলাম মাইয়াটারে আপন করবো এই বাড়ি। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল। যেহেতু এই বাড়িতে অর কোনো মূল্যই নাই সেহেতু এইহানে আর থাকার প্রশ্নই নাই। অরও তো একটা সুখের ঠিকানা দরকার। আমি আইজ হেই ঠিকানার খুঁজে বাইর হমু। যারে সুখী করার স্বপ্ন দেহাইছি এত বছর ধইরা তারে তো সুখী করাতেই হইবো। খালি দুঃখ হইলো, পাঁচটা বছর অর আমি নষ্ট করলাম।’

এই উদ্ভ্রান্ত সোলাইমানের বিপরীতে আর কেউই কোনো কথা খুঁজে পেল না। পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে অনেক মুরব্বিরাও বুঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু ছেলেটা নিজের সিদ্ধান্তে রইল অটুট। টুইটুবানি তাদের পরার জন্য কয়েকটা জামাকাপড় নিল মাত্র। আর কিছুই নিল না। ব্যাগ গুছিয়ে স্বামীকে বুঝানোর চেষ্টা করল। আরেক বার ভাবতে বলল কিন্তু সোলাইমানের চোখের রাগের সামনে তার কথা ধোপে টিকল না।

এই খা খা দুপুরেই ঘরের একটা কোণ খালি করে দিয়েই সোলাইমান বেরিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। যাওয়ার আগে তাচ্ছিল্য নিয়ে মাকে বলে গেল,
‘আম্মা, দেহো, তোমার হাঁটুর বয়সী মাইয়াট্যা তোমারে যেমন কইরা ভালোবাসছিল তেমন কইরা তুমি যদি তারে ভালোবাসতে পারতা তাইলে এই সংসারে আর অশান্তি থাকত না। যেই মানুষটা বাপ-মা, ভিটা-মাটি ছাইড়া আমাগো ভরসায় আহে তারে যত্ন নিতে হয় আম্মা। একটা মানুষের ভরসারে নষ্ট কইরা দেওয়া কত বড়ো পাপ হেইডা যদি বুঝতা! তোমার বাড়ির এক ফোঁটা জিনিস অয় নেয় নাই, আম্মা। স্বর্ণের চেইনডা অব্দি গলার থেইক্যা খুইলা রাইখা দিছে। অর বাপ গরীব হইতে পারে কিন্তু অরা ছুডুলোক না। অগো মন আমাগো ধন-সম্পদের চাইয়া বড়ো। ভালা থাইকো, আম্মা। আইজ আমি অনেক অধৈর্য হইয়াই বাড়ি ছাড়লাম। একটা মানুষরে তো আর বার বার অশান্তির দিকে ফালাই দিতে পারি না। আমি আমার বেহশত ছাড়লাম ময়নারে স্বর্গ দিমু বইলা। বেহশত যদি এমন যাতনার হয় তাইলে এর চাইয়া নরকই ভালো।’’

জামেলা আক্তার ছেলের মুখের দিকেও ফিরে তাকালেন না। অনুশোচনা তো দূর, অহংকারই চূর্ণ হলো না উনার। বিড়বিড় করে যেন আরও কী বললেন। মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশীরা হাসিঠাট্টা করল। জামেলার তেল আছে বলে খোঁচাও দিল।

বাহিরে আকাশ কালো করে বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরের দরজায় বসে লতি কাটছে টুইটুবানি। আব্বা ইলিশ মাছ এনেছেন। সোলাইমানের ইলিশ মাছ পছন্দ বলে। টুইটুবানি লতি কাটতে কাটতে বলল,
‘আব্বা, তোমারে কী চা কইরা দিমু? একটু চা খাইবা?’

করিম হাসান খাটে শুয়ে ছিলেন তখন। মেয়ের কথায় মেয়ের দিকে ফিরে তাকালেন। হাসি মুখে বললেন, ‘না, আম্মা। তুমি লতিডি কাইট্টা রান্দাডা বসায় দেও। জামাই আইলে গরম গরম ভাত যেন দুইডা দিতে পারো।’

‘আইচ্ছা। তুমি চা খাইলে কইও। বানায় দিমুনে।’

কারিম হাসান মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন তারপর আবার দু’জনেই চুপ। বাহিরের বৃষ্টির শব্দ তুমুল থেকে তুমুল হচ্ছিল। ঘরের টিনে সুর তুলেছে সেই শব্দ। টুইটুবানিরা আচমকা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে বাবার বাড়িতে উঠেছিল। আজ তিন-চারদিন হলো তারা এখানেই। বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তবে পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে বলে তার শাশুড়ি নাকি যাকে পান তাকে ডেকেই ছেলের বউয়ের দুর্নাম গায়। উনার আদরের ছেলেকে উনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্য শাপ ছুঁড়েন। টুইটুবানি তার বিপরীতে শাশুড়ির নামে একটাও বাজে কথা বলে না। কেবল শুনে যায়। একটা কথা আছে— ময়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না মরলে। তার শাশুড়ি এই বাক্যটার প্রতিচ্ছবি।

‘জামাই কই গেছে, আম্মা? এই বৃষ্টি-বাদলের দিনে ভিইজ্যা যাইবো না! কই গেছে জানো? তাইলে আমি নাহয় ছাতাডা নিয়া আগায় যাইতাম।’
নিরবতা ভেঙে ভেসে এলো বাবার কণ্ঠ। টুইটুবানি লতি কাটতে কাটতে বলল, ‘জানি না তো, আব্বা। হয়তো বাজারে গেছেন। কইলো তো বেশিক্ষণ লাগব না।’
এরপর থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আইচ্ছা আব্বা, একটা কথা কও তো।’

করিম হাসান শুধালেন, ‘কী, আম্মা?’

‘হেইদিন ঐ বাড়িতে তোমারে কত ছুডু-বড়ো কথা হুনাইছে। শইলেও হাত দিছে। তোমাগো জামাই তেমন কোনো প্রতিবাদ করে নাই। তারপরেও তোমার তার জইন্য এত চিন্তা! ক্যান? তুমি একটুও রাগ রাখো নাই ক্যান?’

মেয়ের প্রশ্নে হাসলেন করিম হাসান। শোয়া ছেড়ে উঠে বসলেন। হাসিমুখ বজায় রেখেই বললেন,
‘সোলাইমান ছেলেটা কতখানি মাটির মানুষ তা আমি জানি। কহনো কোনো ঝামেলায় তারে দেখা যায় নাই। সবসময় ঝামেলামুক্ত থাকতে পছন্দ করত। কিন্তু সংসারের সাত পাঁচে তারে প্যাঁচাইয়া ধরাতে কত অভিযোগই তার উপর জন্মাইছে। কিন্তু এই অভিযোগ হেয় প্রাইপ্য না। এই যে আমি মাত্র দুইডা গরু পালি আর একটা ছুডু জমিন আছে। তোমার কুনুদিন মনে হয় নাই দুই গরুর দুধ বেইচ্চাই কী সংসার চালান যায়? তুমি আব্বারে দেখতে আইতা পারতা না বছরেও একবার অথচ সোলাইমান প্রতি হপ্তায় কমপক্ষে দুইবার আইস্যা দেইখা যাইত। আমার কী লাগে, হেই দিকে আছিলো তার খেয়াল। ঘরে ফলমূল হইতে রেশন কিছুই ফুরাইতে দিতো না হেয়। ফুরানের আগেই আইন্যা ভইরা থুইতো। কহনো তোমারে হইতো কইও নাই এই কথা। অথচ ভেতর ভেতর হেয় তোমার চাইয়াও বেশি আমার খেয়াল রাখছে। হের উপর আমি কেমনে রাগ করি কও? হের পরিবারের মানুষের দায় তো আমি হের উপর দিতে পারি না। হেয় হের জায়গায় অনেক বেশি ভালা।’

টুইটুবানি অতি বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার বলা কথা গুলোর মাঝে একটা কথাও তার জানা ছিল না। তার স্বামী যে এমন ভাবে শ্বশুরের ভরণপোষণ পরোক্ষ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তার কিছুই সে জানত না। মানুষটা কখনো বলেওনি।
অতি আনন্দে চোখ ভরে জল জমল তার। এত ভালো একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট হাজার বার মাথা ঠুকল মনে মনে। তার এত অভিযোগ, অভিমান যেই মানুষটাকে ঘিরে সেই মানুষটা যে এত অনবদ্য সে কী জানত? কেবল একটু বেশি মা’কে ভালোবাসত বলে সে কত কথাই না বলেছে। চুপ থাকত বলে কত অভিযোগই না করেছে! অথচ মানুষটার ভেতর কত ভালো গল্প লুকিয়ে আছে।

বৃষ্টিতে ভিজে সোলাইমান যখন বাড়ি ফিরল তখন দুপুরের প্রায় মধ্যভাগ। টুইটুবানির রান্না শেষ। গোছগাছ করে রাখছিল খাবার গুলো। স্বামীকে ঘরে ফিরতে দেখেই ছুটে গিয়ে স্বামীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিল। গামছা দিয়ে চুল মুছতে আরম্ভ করল। সোলাইমান জামা খুলে রাখতে রাখতে বলল,
‘কী বৃষ্টিডা নামল দেহ তো! ভিইজ্জা চুবা হইয়া গেলাম।’

‘আপনে কোনো একটা জায়গায় দাঁড়াইতে পারলেন না? বৃষ্টিডা কমলেই আইতেন।’

সোলাইমান ভেজা শরীর নিয়ে জড়িয়ে ধরল টুইটুবানিকে। টুইটুবানির পেটে শাড়ি ভেদ করে তার শীতল হাতটি রাখল। এতে কেঁপে উঠল মেয়েটা। লাজুক স্বরে বলল,
‘ভাত খাইবেন না? চলেন।’

সোলাইমান মেয়েটার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘বৃষ্টির দিনে কেউ ভাত খায়?’

‘খায় না?’

‘না।’

‘তাইলে কী খায়?’

‘কেন? বউয়ের সোহাগ খায়।’
স্বামীর কথায় লজ্জায় যেন আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল টুইটুবানি। কণ্ঠ দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না যেন। তবুও কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে আধো আধো করে বলল,
‘আহেন তো, ভাত খাইয়া লন আগে।’

সোলাইমান মেয়েটার লজ্জা রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। ওষ্ঠে ছোটো চুমু খেয়ে বলল,
‘বাপরে, এত লাজ! পাঁচ বছরেও কী লজ্জা কমলো না? আমি কী পর?’

টুইটুবানি উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়। স্বামী রাগ করেছে ভেবে ব্যথিত হয়। বোকা বোকা কণ্ঠে বলে,
‘কী করুম? আপনের কাছে আইলেই আমার শরীর কাঁপের,অন্তর কাঁপে। এত ভালোবাসেন আপনে! আমার যে ভয় হয়। খালি লাগে এত ভালোবাসা আমার কপালে সইবো না।’

টুইটুবানির কথা শেষে হতেই হাস্যরত সোলাইমান মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ভরসা দিয়ে বলল,
‘ক্যান সইবো না? আমি চিরজীবন তোমার হইয়া থাকুম। যা-ই হইয়া যাক। ভালো যেহেতু বাসছি, ষোলো আনাই বাসমু। এক-আধ খানাও ফাঁক রাহুম না। তুমি দেখবা পরাণ, তোমারে এত ভালোবাসাই দিমু যে তোমার এই জীবনে আর কোনো আফসোস থাকব না। কে তোমারে ভালোবাসলো, কে বাসলো না তা নিয়া কোনো কষ্ট থাকব না।’

টুইটুবানি সেচ্ছায় স্বাসীকে জড়িয়ে ধরে। এমন করে কেউ কখনো কাউকে ভালোবেসেছে কী এর আগে?

দু’জনের এই নৈকট্যের মাঝেই বাহির থেকে স্বল্প পরিচিত একটি কণ্ঠ ভেসে আসছে। তাদের গ্রামের ছেলে- মুকুল চেঁচিয়ে সোলাইমানকে ডেকে বলল,
‘সোলাইমান, হুনছোছ? ঐ সোলাইমান, হুন। তোর আব্বা তো আবার বিয়া করছে। শহর থেইক্যা বউ নিয়া আইছে। অহন তোর আম্মা তো মাডিতে গড়াগড়ি কইরা কানতাছে। হুনছতনি খবরডা?’

[সমাপ্ত]