প্রণয়ী পর্ব-১৫+১৬

0
143

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৫.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

রোজার মাসে এমন ঝুম বৃষ্টি বোধহয় সকলের কল্পনার বাহিরে ছিলো। কাঠফাটা রোদের পর এক পশলা বৃষ্টি যেনো সকলের জন্য এক আশীর্বাদ। আশ্চর্যের মতো প্রিয়তার বাসার পরিবেশ ঠিক হয়ে গেছে। তুহিন আর প্রিয়তার বিয়ের বিষয়ে কথা বলে না। এমনকি অজানা কারণে আশরাফের নামটাও মুখে আনে না। প্রিয়তা এতে বেশ খুশি। তবে মধ্যিখানে তার চারপাশে জাইনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সে যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই জাইন উপস্থিত হচ্ছে। সেদিন ভার্সিটি গেইটের পাশে বাইকে বসে ছিলো। প্রিয়তা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে যেতে নিলে রকি তাকে ডাক দেয়। উপায়ন্তর না পেয়ে সে যায়। তার সাথে হৈমন্তী অথবা রিমি কেউ ছিলো না।

প্রিয়তা বলে,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ডেকেছেন?’

রকি জবাব দেয়,’ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমাকে আজকাল দেখা যায় না তাই ডাক দিছি।’

প্রিয়তা বলে,’জি বলেন শুনছি। আমার ক্লাস আছে দ্রুত বললে ভালো হয়।’

রকি চোখ তুলে জাইনের দিকে তাকায়। জাইন কিছু না বলে প্রিয়তার থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মারুফকে ইশারা করতেই সে শুকনো কাশি দেয়।

মারুফ বলে,’ইয়ে মানে আপু আপনার কাছে পানি আছে? একটু দেওয়া যাবে?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’সরি আমি যাকে তাকে পানি দেই না।’

রকিও বলে,’প্রিয়তা মারুফ ভাই পানি চাইছে দাও।’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানির বোতল বের করে রকির হাতে দেয় প্রিয়তা। রকি দেয় মারুফের হাতে। শেষে সেটা হাত বদল করে যায় জাইনের হাতে। জাইন বোতল খুলতেই প্রিয়তা হনহনিয়ে প্রস্থান করে বোতল না নিয়েই। সকলেই তাজ্জব বলে যায়। জাইন চমকায় না। প্রিয়তাকে একটু একটু করে সে আন্দাজ করতে পারছে। আর তার এই ত্যাড়া প্রিয়তাকেই ভালো লাগে। বোতলের ভেতরের পুরো পানি সে চোখে মুখে ঢেলে দেয়।

এরপর জাইনকে দেখেছিলো বাজারে। সে বাজার করতে গেছে জাইন তার পিছু পিছু হাঁটছিল। সে যেই দোকানে যাচ্ছে জিনিস কিনছে একই জিনিস জাইনও কিনে। এতো কিছুর মধ্যে জাইন তার সাথে কোনো কথা বলেনি শুধু তার আশেপাশে থাকে আর তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কল দেয়। প্রিয়তা জানে জাইন তাকে ছাদে যাওয়ার জন্য কল দেয় কিন্তু সে না কল রিসিভ করে না সেই সময় ছাদে যায়। সে ছাদে যায় কিন্তু অন্য সময় যখন জাইনের আসার কোনো চান্সই থাকে না। সে আসলে জাইনের সাথে কথা বাড়াতে চায় না। নিশ্চয়ই জাইন তাকে বুঝানোর চেষ্টা করবে সে যা দেখেছে ভুল। কিন্তু প্রিয়তা জানে সে ভুল দেখেনি। জাইনের হাতে রি ভ ল ভা র ছিলো যা সে স্পষ্ট দেখেছে। এমন একজন মানুষের সাথে কথা বলাটা অনুচিত। দেখা গেলো রি ভ ল ভা রে র ভয় দেখিয়ে জাইন তাকে বশ করতে চাইতে পারে। অসম্ভব তো কিছু না। এমনিতেই রাজনীতি তার অপছন্দ তার উপর এসব দেখে জাইনের থেকে দূরে থাকাটা তার কাছে শ্রেয় মনে হয়।

বিকাল বেলা রান্নাঘরে মিসেস মাসুমা আর প্রিয়তা ইফতারি ভাজছিলো। বেল্লাল হোসেন কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছেন। তুহিন এখনে ফেরেনি। ইফতারির আধাঘন্টা পূর্বে কলিং বেল বাজে। প্রিয়তা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই তুহিনের মলিন মুখটা দেখে প্রিয়তার কেমন জানি লাগে। তুহিন ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ারে ধপ করে বসে মাথা নিচু করে থাকে। বেল্লাল হোসেন পাশেই বসা ছিলেন। ছেলের চেহারা দেখে বুঝে নেন কিছু একটা হয়েছে তার।

‘তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ?’

‘আমার চাকরিটা চলে গেছে।’
তুহিনের কথা শুনে বেল্লাল হোসেন এবং প্রিয়তা উভয়েই চমকে তাকায়। রান্নাঘরে থাকা মিসেস মাসুমারও কান এড়ায় না কথাটা।

বেল্লাল হোসেন চিন্তিত হয়ে বলেন,’হঠাৎ এমন হলো যে? কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

‘ম্যানেজার আমার নামে বিচার দিয়েছে। আমি নাকি ঠিকঠাক কাজ করি না। তাই আজকে তারা আমাকে ছাটাই করেছে।’

‘চিন্তা করিস না একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।’

বেল্লাল হোসেন আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তুহিন না শুনেই নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা দেয়। ইফতারির সময় সকলের বেশ মন খারাপ থাকে। কেউ তেমন কথাবার্তা বলে না। বাসার পরিবেশ থমথমে হয়ে ওঠে। কোনো মতে রোজা খুলে সকলে উঠে যায়।

ইফতারির পর প্রিয়তা পড়তে বসেছে। বাসায় শুধু সে আর তুহিন আছে। বেল্লাল হোসেন আর মিসেস মাসুমা ডাক্তারের কাছে গেছেন। বেল্লাল হোসেনের শরীরটা ইদানীং বেশ খারাপ যাচ্ছে তাই তাকে এক প্রকার জোর করে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে।

‘অফিসের ম্যানেজার কে জানিস? কে আমাকে চাকরি থেকে বিতারিত করেছে জানতে চাস না?’

তুহিনের গলা পেয়ে প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। তুহিন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘তুই যেদিন থেকে এই বাড়িতে এসেছিস সেদিন থেকেই আমার জীবন নরক বানিয়ে দিয়েছিস। বললাম আশরাফকে বিয়ে কর তা করবি না বেশ অন্তত ভালো ব্যবহার তো করতে পারতি সেটাও করিসনি। কি বলেছিস কে জানে,উনি ক্ষোভে উল্টোপাল্টা বলে আমার চাকরিটা খেয়ে দিলো। ভেবেছিলাম ওনার সাথে সুসম্পর্ক গড়তে পারলে আমার প্রমোশনের বিষয়টা উনি দেখবেন। কিন্তু তুই সবটা ঘেঁটে দিলি। সামনে ঈদ আমি শুধু দেখবো সংসারটা চলে কিভাবে। তুই শুধু নিজেরটাই দেখলি।’

তুহিনের কথা শুনে প্রিয়তার চেহারায় আঁধার নেমে আসে। সত্যিই তো সে শুধু নিজেরটা দেখলো বাসার সকলের কথা ভাবলো না।

‘তুই এসে পুরো সংসার খেয়ে দিয়েছিস। আমাদের তিনজনের সংসারে তুই একটা বি ষা ক্ত কাঁটা। যেই কাঁটা না পারছি ফেলতে না পারছি গিলতে।’

কথাগুলো বলেই তুহিন হনহনিয়ে দরজা খুলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। এখনো তুহিনের বলা কথাগুলো হজম করতে পারছে না সে। ভেতর থেকে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে তার। না চাইতেও তুহিনের বলা কথাগুলো তাকে ভেঙে দিয়েছে।

জাইন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর তার সাথে মারুফ, শাকিল,রফিকও উঠছে।
মারুফ বলে,’শোন আজকে শরম লজ্জা ভেঙে লাইলীকে আই লাভ ইউ বলবি।’

শাকিল বলে,’মেয়েরা আই লাভ ইউ এর চেয়ে আমি তোমাকে ভালোবাসি বললে বেশি খুশি হয়।’

মারুফ শাকিলের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে,’তোর তো দেখি বহুত এক্সপেরিয়েন্স। কিরে তলে তলে টেম্পু চালাস?’

শাকিল জিভে কামড় দিয়ে বলে,’ছি ছি আমি এইসবে নাই।’

রফিক এর মধ্যে বলে,’ভাবী যদি আজকেও ছাদে না আহে?’

মারুফ জবাব দেয়,’আজকে তাহলে ওর বাসার দরজা বাইরামু। না খুললে ভাঙ্গুম।’

জাইন বিরক্তি নিয়ে বলে,’চুপ করবি তোরা। আগে প্রিয়র রাগ ভাঙাতে দে। পরে এসব বলা যাবে।’

মারুফ জাইনের কাঁধে হাত রেখে বলে,’একবার হাত থেকে তোর লাইলী ফসকে গেলে কিন্তু সারাজীবন কানবি। তুই ওর জন্য কতটা ডেস্পারেট, ওরে কতটা চাস সেটা বুঝা। আর রাজনীতি করলে এসব তো নরমাল সেটা তো এমনিতেই বুঝে যাবে।’

রফিকের হাত থেকে ফুলটা নিয়ে জাইনের হাতে দেয় মারুফ। জাইন সেটা বাম হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে। লাল টকটকে গোলাপ। এটা দিয়েই আজ সে প্রিয়তাকে নিজের মনের কথা বলবে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জাইন মনে মনে আওড়ে নেয় কি বলবে। মারুফ,শাকিল,রফিক সেখানেই থেমে যায়। জাইন একাই ছাদে আসে। পাশের ছাদর বেঞ্চে নারী অবয়ব দেখে বুঝে এটা কে।
মনে মনে কথা গুলো সাজিয়ে নেয়।
‘আমি তোমাকে নিজের করে চাই প্রিয়। তোমাকে ছাড়া আমার দিবা নিশী কাটে না। তোমার চাহনি, তোমার রাগ সবটাই আমাকে মাতাল করেছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আই এম ইন লাভ উইথ ইউ প্রিয়। আই লাভ ইউ এ লট প্রিয়। প্লিজ জাইন রহমানকে নিজের করে নাও।’

লম্বা শ্বাস নিয়ে ছাদ টপকে পাশের ছাদে চলে যায় জাইন। আজকে নীল রঙের একটা পাঞ্জাবী পরেছে সে তার উপর কালো কটি। মারুফই জোর করেছে তাকে পাঞ্জাবীটা পরতে।

জাইন প্রিয়তার পিছনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নেয়। তার কেমন নার্ভাস লাগছে। মনে হচ্ছে বড়সড় কোনো পরীক্ষা দিবে সে। জীবনে দ্বিতীয়বার ভীষণ ভয় হচ্ছে। প্রিয়তা কি উত্তর দিবে সেটা ভেবে। প্রিয়তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কয়েকবার কাশি দেয় কিন্তু প্রিয়তার কোনো সাড়াশব্দ নেই।

জাইন গলার স্বর নামিয়ে প্রিয়তাকে ডাক দেয়,’প্রিয় তুমি এখনো রেগে আছো?’

প্রিয়তা কোনো জবাব দেয় না। শব্দ পেয়ে জাইন পাশের ছাদে তাকালে দেখে তিনজন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাইন ইশারা করে তাদের চলে যেতে বলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা চলে যায়।

জাইন এবার অধৈর্য্য গলায় ডাকে,’প্রিয় শুনছো। আম সরি। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো একটা সুযোগ দাও।’

এবারো প্রিয়তার জবাব আসে না তবে জাইন খেয়াল করে প্রিয়তা কাঁপছে। ঢোক গিলে সে প্রিয়তার সামনে যায়। মাথা নিচু করে প্রিয়তা বসে আছে। আবছা আলোতে তার চোখের জল চিকচিক করছে। জাইন হাঁটু গেঁড়ে প্রিয়তার সামনে বসে। গোলাপটা পিছনে লুকিয়ে রাখে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে প্রিয়তা কাঁদছে। তাকে দেখে মন হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে সে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার কাঁপুনি ধরে গেছে। এভাবে প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখে তার বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছে। সে প্রিয়তা হাসিমুখ সবসময় দেখতে চায় কিন্তু এখন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রিয়তা সবসময় স্বাভাবিক থাকে। হাসিমুখে না হোক এভাবে প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখবে কখনো ভাবেনি।

জাইন ব্যকুল স্বরে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো?’

প্রিয়তা কোনো জবাব না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘মন খারাপ?’
প্রিয়তা মাথা ডানে বামে নাড়ায়।

‘কেউ বকেছে?’
প্রিয়তা আবারো ডানে বামে মাথা নাড়ায়।

‘তাহলে ঐ চান্দিছিলা বিরক্ত করেছে?’
এবারো প্রিয়তা একই উত্তর দেয়।

‘তাহলে?’
প্রিয়তা নাক টেনে উত্তর দেয়,’কিইইছু নাহ।’

‘আমার উপর রেগে আছো?’
প্রিয়তা এবার কোনো উত্তর দেয় না।

‘মুখে না বলতে চাইলে মেসেজ করে বলো। আমি এখানে বসে আছি তুমি মেসেজ করো। ফোন এনেছো?’
প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।

‘আচ্ছা আমি নোটপ্যাড বের করে দিচ্ছি তুমি লিখে দাও।’
জাইন ফোনের নোটপ্যাড বের করে প্রিয়তার সামনে ফোনটা দেয়। প্রিয়তা নেন না। জাইন তার কোলে ফোনটা রাখে। প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে জাইনের দিকে তাকায়। জাইন ইশারা করে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে। কিবোর্ড চেপে টাইপ করতে শুরু করে।
ফোনের আলোতে প্রিয়তার চোখমুখ স্পষ্ট। ভেজা নয়ন জোড়া,গালে গড়িয়ে পড়া অশ্রু সেই সাথে কাঁপতে থাকা শুষ্ক ওষ্ঠ যা জাইনকে চুম্বকের মতো টানছে। অধিকার থাকলে এক্ষুণি প্রিয়তাকে বুকে টেনে শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে দিতো আদরে। দূর করে দিতো প্রিয়তার সকল বিরহ।
জাইনের ধ্যান ভাঙে প্রিয়তা তার দিকে ফোন এগিয়ে দিতেই। ফোন হাতে নিয়ে নোটপ্যাডের লেখাটা পড়ে সে।
‘কিছু হয়নি আপনি চলে যান। আমার এমনিতেই মন খারাপ। আপনি আর এখানে আসবেন না।’

লেখাটা পড়ে জাইন প্রিয়তার দিকে তাকায়। তার বুঝতে অসুবিধা হয়না প্রিয়তা মিথ্যে বলছে। নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু হয়েছে না হলে প্রিয়তার মতো শক্ত মেয়ে এভাবে চোখের জল ফেলে না।

‘তুমি বলবা না কি হয়েছে?’
জাইন প্রিয়তার দুই পাশে হাত রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসে। জাইনের আর প্রিয়তার দৃষ্টি একে অপরের দিকে। জাইন ডান হাত তুলে বৃদ্ধাঙুল দিয়ে প্রিয়তার ডান চোখের অশ্রু মুছে দেয়।

‘তোমার চোখে অশ্রু মানায় না। আমাকে একটা সুযোগ দাও এই অশ্রু মুছে দেওয়ার। আমি কিচ্ছু চাইবো না বিনিময়ে। অন্য কিছু না হোক বন্ধু হিসেবে বলো কি হয়েছে।’

প্রিয়তা জাইনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।

‘বাসায় কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

‘আপনি কেনো জানতে চান? কি হন আপনি?’

জাইন প্রিয়তার কথার কোনো উত্তর দেয় না। এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট তাকে থামিয়ে দিতে। জাইন বুঝে নেয় এভাবে সম্ভব না। শ্বাস ফেলে সে উঠে দাঁড়ায়। গোলাপটা হাতে তুলে নিয়েছে।

‘আমি তোমার প্রণয়ী হই প্রিয়। এই প্রণয়ী তোমার অশ্রু দ্রুত মুছে দিবে।’
কথাগুলো মনে মনে বলে জাইন। এরপর ছাদ টপকে অপর ছাদে যায়। উল্টোদিকে ঘুরে হাতে থাকা গোলাপটা ছুঁড়ে দেয় যা এসে প্রিয়তাদের ছাদে পড়ে। সিঁড়ি বেয়ে জাইন নেমে যায়। প্রিয়তার কি হয়েছে তা সে খুঁজে বের করবেই।

জাইন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়। কান্না থেমে গেছে গেছে কিন্তু এখনো তার হেঁচকি উঠছে। ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। কয়েক কদম ফেলতেই জুতার নিচে কিছুর অস্তিত্ব টের পায়। পা সরাতেই কিছু একটা দেখতে পায়। হাতে তুলে নিতেই দেখে লাল রঙের এক ফুটন্ত গোলাপ। জুতার নিচে পড়াতে একটু মুচড়ে গেছে। গোলাপটা হাতে নিয়ে প্রিয়তা হাঁটা দেয়।

_______________

এরপর দু’দিন প্রিয়তা ঘরবন্দী হয়ে ছিলো। ফোন বন্ধ করে ভার্সিটির ক্লাস অবধি মিস দিয়েছে। অথচ ঈদের পর তার সেমিস্টার ফাইনাল। বেল্লাল হোসেন প্রিয়তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও প্রিয়তা এড়িয়ে গেছে। বলাবাহুল্য বাসার পরিস্থিতি যা একটু সতেজ হয়েছিলো তা আবার মিইয়ে গেছে। তুহিন সারাদিন বাহিরে থাকে আর চাকরির খোঁজ করে। ঈদের আর বেশিদিন বাকি নেই এমন সময় তুহিনের চাকরি না থাকাটা তাদের জন্য বিশাল বিপদ। টেনেটুনে বেল্লাল হোসেন মাসটা চাল্লাচ্ছে। এরপর কিভাবে কি করবে তা এখনো বুঝতে পারছে না সে
দুপুরবেলা প্রিয়তা আর মিসেস মাসুমা বাসায় একা। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলে মিসেস মাসুমা গিয়ে দরজা খুলে। প্রিয়তা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটু পর তার দরজায় শব্দ হলে মাথা তুলে। মিসেস মাসুমা তাকে ডাকছে। ওড়ান ঠিকঠাক করে কক্ষের দরজা খুলে সে।
মিসেস মাসুমা হাসিমুখে বলে,’তোর ভাইয়ের চাকরি হয়েছে।’

প্রিয়তা অবাক চোখে তুহিনের দিকে তাকায়। এতো জলদি তাকে চাকরি দিলো কে? তাও মাসের মাঝে? অনেকগুলো প্রশ্ন সমেত দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা।

তুহিন বলে,’কালকে সকাল থেকে ডিউটি। আমার সব কিছু রেডি রেখো।’

মিসেস মাসুমা হাসিমুখে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ফ্রিজে রাখে। ইফতারির সময় বের করবে।

ইফতারির টেবিলে মিসেস মাসুমা হাসিমুখে সব কিছু রাখতে শুরু করে। প্রিয়তা তাকে সাহায্য করছে।

তুহিন এসে চেয়ার টেনে বসে।
‘আমার চাকরি হয়েছে।’

বেল্লাল হোসেন মিসেস মাসুমার কাছ থেকে এ বিষয়ে শুনেছেন।

‘হুম শুনলাম। কিন্তু এতো জলদি মাসের মাঝে কীভাবে চাকরি পেলে?’

‘রহমান ট্রেডার্সে চাকরিটা হয়েছে। আমাকে হুট করে কল দিয়ে বললো আপনি সিভি ড্রপ করেছিলেন আপনাকে জরুরি ভাবে অফিসে আসতে বলা হয়। আমি প্রথমে অবাক হই এরপর মনে পড়ে কয়েক জায়গায় সিভি দিয়েছিলাম তখন হয়তো ওখানেও দিয়েছি খেয়াল না করে। পরে না ভেবেই চলে যাই। যাওয়ার পর তারা আমার ইন্টারভিউ নেয়। শেষে জানায় আমি সিলেক্টেড।’

মিসেস মাসুমা বলে,’যাক আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে চিন্তা কমলো।’

বেল্লাল হোসেন বলে,’তা ঠিক আছে কিন্তু এবার অন্য বিষয়ে খেলাম না দিয়ে নিজের চাকরিতে খেয়াল দাও কাজে লাগবে।’

তুহিন বাবার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলে না। প্রিয়তার কাছে সবটা কেমন ঘোলাটে লাগছে। মনে হয় কোথাও কোনো গন্ডগোল আছে। কিন্তু সেটা কি ধরতে পারছে না এখনো। সবটা তো আর কাকতালীয় হতে পারে না?

……
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৬.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………

‘আজকে আমি সকলকে ডেকেছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে এবং সিদ্ধান্ত জানাতে। আশা করি সকলেই আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।’
খালেকুজ্জামানের কথা শুনে সকলে সোজা হয়ে বসে। আজকে দলের কার্যালয়ে সকলকে ডাকা হয়েছে। হুট করে রোজার মধ্যে কেনো তিনি ডেকেছেন সকলের অজানা। অবশ্য হুটহাট তিনি কি করেন কেউই বুঝে উঠতে পারে না।

‘তো যেটা বলছিলাম। আমি এখানে কিছু পরিবর্তন আনবো। কার্যালয় থেকে কিছু পুরাতন মুখ বিদায় নিবে সেই স্থানে যুক্ত হবে কিছু নতুন মুখ।’

এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলে মধ্যে কানাঘুষা চলতে শুরু করে। জাইনও বেশ অবাক হয় খালেকুজ্জামানের কথায়। খালেকুজ্জামান হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিচ্ছেন সেটা ভাবনার বিষয়।

গলা ঝেড়ে খালেকুজ্জামান আবারো বলতে শুরু করে,’আমি কার্যালয়ের মানুষদের মধ্যে কাজের গাফেলতি দেখেছি তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সভাপতি থেকে শুরু করে অনেক পদের লোককে বদলানো হবে।’

তিনি একে একে বদল কৃত পদের নাম এবং যাকে নিয়োগ দিতে চান তার নাম বলেন। সব নাম বলা শেষে আসে সভাপতির নাম।

‘কার্যালয়ের নতুন সভাপতির নাম বলার পূর্বে আমি বলতে চাই। যাকে আমি নির্বাচন করেছি তাকে অনেকেরই অপছন্দ হতে পারে কিন্তু সে এই পদের জন্য যোগ্য। আমি চাই সামনের কাউন্সিলর নির্বাচনে সে দাঁড়াক। আমি তাকে সকল প্রকার সাহায্য করবো। সে সবসময় অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করে। তার মতো ছেলে প্রতি ঘরে ঘরে প্রয়োজন। অনেক কথা বলে ফেললাম এবার আর কথা না বাড়াই নামটা বলে ফেলি। জাইন রহমান এদিকে চলে আসো। আজকে থেকে তোমার হাতে আমি আমার কার্যালয়ের সকল দায়িত্ব দিবো।’

জাইন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মারুফ আর শাকিল তাকে পিছন থেকে বলতেই সে এগিয়ে যায়। খালেকুজ্জামান জাইনের পিঠে চাপড় দিয়ে কাঁধে হাত রাখে।
‘ছেলেটা অল্প সময়ে যা কাজ করেছে অনেকেই সেসব বছরের পর বছর থেকেও করতে পারেনি। আজকে থেকে দলের সকল দায়িত্ব জাইনের। কারো কোনো দরকার হলে ওর সাথে যোগাযোগ করবেন। এরপর সে আমাকে জানাবে। কেউ আর আগের মতো সরাসরি আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। জাইনের মাধ্যমে সকল যোগাযোগ হবে।’

খালেকুজ্জামানের কথা শেষ হতেই তালি দেয় সকলে। কিছু অনেকের চেহারা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে তারা খুশি না। বিশেষ করে পূর্বের সভাপতির মুখ অন্ধকার। এতোদিন সে ভালো রোজগার করতো আজ থেকে সেটা বন্ধ। তার সাথে আরো মানুষ খালেকুজ্জামানের উপর নয় জাইনের উপর ক্ষিপ্ত। তাদের ধারণা জাইনের ভালো মানুষির জন্য তারা পদ হারিয়েছে। এতো সহজে এই বিষয়টা তারা ছাড়বে না। এর শেষ দেখে তারপর ছাড়বে।

খালেকুজ্জামান জাইনের দিকে ফিরে বলে,’কংগ্রাচুলেশনস জাইন রহমান। তোমার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তুমি পারবে।’

খালেকুজ্জামান এরপর জাইকে জড়িয়ে ধরে। মারুফ,শাকিল,রফিক পিছনে দাঁড়িয়ে খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। অবশেষে তারা তাদের প্রাপ্ত স্থান পাচ্ছে।

………

জাইন বাসায় ফেরে সাহরির সময়। সকলে টেবিলে খেতে বসেছে এমন সময় সে বাসায় ঢুকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের কক্ষে চলে যায়। আজকে সারাদিন বেশ ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। রমিজউদ্দিন চশমার আড়ালে জাইনকে একবার দেখে নেয়। কিছুক্ষণ পর গোসল সেরে খেতে নামে জাইন। সকলের খাওয়া ততক্ষণে শেষ। জাইন খেতে বসতেই নিহারিকা সব কিছু এগিয়ে দেয়। রমিজউদ্দিন খাওয়া শেষ করে টেবিলেই বসে ছিলেন। তাকে দেখে মনে হয় সে এতক্ষণ ছেলেরই অপেক্ষায় ছিলেন। জাইনের ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি চুইয়ে পড়ছে এতে কাঁধের দিকটায় পাঞ্জাবী ভিজে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে সেই সাথে জাইনের থমথমে চেহারা। দেখে মনে হচ্ছে ঘুম প্রয়োজন তার।

জাইন তাড়াহুড়ো করে খাবার খাচ্ছে।
‘তা এভাবে তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছো কেনো?’

খেতে খেতে জাইন উত্তর দেয়,’সময় কম বের হতে হবে।’

‘এতো কিসের ব্যস্ততা তোমার?’

‘দলের কাজ আছে। ঈদের আগে সারতে হবে।’

‘দল তোমাকে খাওয়ায় নাকি পরায়? চলো তো আমার ক্রেডিট কার্ডে।’

‘সেটা এখন থেকে আর লাগবে না। দলের সভাপতি হয়েছি। মাসে মাসে মাইনে দিবে বলেছে। তাতে আমার চলে যাবে।’

‘ঐ সামান্য মাইনেতে চলবে তোমার? এখন না হয় একা টেনেটুনে চলবা কিন্তু বিয়ে করলে বউকে কি খাওয়াবা? আমি তো তোমার বউয়ের দায়িত্ব নিবো না।’

রমিজউদ্দিনের কথা শুনে জাইন চোখ তুলে তাকায়।

রমিজউদ্দিন আরো বলেন,’এখনো সময় আছে আমার ব্যবসায় ঢুকো। মাথা থেকে সমাজ সেবার ভূত নামাও। ব্যবসার হাল ধরো জারিফের মতো। আমরা না হয় তোমার পয়সায় খাই না কিন্তু অন্যের মেয়ে ঘরে আনলে তার দায়িত্ব পালন করতে পয়সা লাগবে।’

জাইন জবাব দেয়,’যাকে আনবো তার চাওয়া সীমিত হবে। সে দুই হাজার টাকা দিয়েও পুরো মাস সংসার চালাতে পারবে। যার থাকবে না অতিরিক্ত চাহিদা, থাকবে শুধু আমার প্রতি ভালোবাসা। সংসার চালাতে প্রচুর টাকা লাগে না।লাগে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস,সম্মান আর ভালোবাসা।’

‘অভাব যখন দরজা দিয়ে আসবে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালাবে। নাটক উপন্যাসে এসব মানায় বাস্তবে না। বাস্তবে অনেক কঠিন। আর এখন বাস্তবে এমন মেয়ে আছে নাকি? এমন মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে তোমার বয়স পাড় হয়ে যাবে।’

‘কেনো থাকবে না! আছে তো আমার আশেপাশেই আছে। খুব দ্রুত আপনাদের সামনে আনবো।’

‘তোমার প্রেমিকাও আছে? বাহ্! শুনো মেয়েটা তোমাকে না তোমার বাপের টাকা দেখেই আসবে মিলিয়ে নিও।’

‘সবাইকে এক পাল্লায় মাপা বন্ধ করেন আব্বা। সে যেমন তেমন মেয়ে না। ভদ্র পরিবারের মেয়ে আর টাকা পয়সা তো দূর তার তো আমার উপরই ইন্টারেস্ট নাই। ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ছিঁড়ে যায়,বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগে তবুও সে ফিরে তাকায় না।’

জাইনের কথা নিহারিকা আর নুহাশ হা করে গিলে। তার ভাইকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে এক মেয়ের পিছনে এভাবে ঘুরে।

রমিজউদ্দিন ছেলের কথা হজম করতে পারেন না। চেঁচিয়ে বলে,’দেখো ছেলেটা এতোকাল রাজনীতির নামে মানুষের চামচামি করতো আর এখন মেয়েদের পিছনে ঘুরে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মেয়ের পিছনে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করে এরপর আমার টাকায় নতুন জুতা কিনে পরে।’

জাইন তার বাবার কথায় খেয়াল না দিয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দেয়। এখন তাকে এসব বুঝানো আর না বুঝানো একই কথা তাই জাইন চুপ।

মিসেস পারুল এসে রমিজউদ্দিনকে বুঝিয়ে নিজের কক্ষে যেতে বলে। রমিজউদ্দিন এতে আরো চটে যান। রাগ করে নিজের কক্ষে ঢুকেন। তবে তার আগে বলে যান কিছু কথা।
‘আমিও দেখবো কোন মেয়ে তোমার মতো অপদার্থের হাত ধরে আর কোন পরিবার তোমাকে মেয়ে দেয়। নিজেরে জীবন তো নষ্ট করেছো এখন আরেক মেয়ের জীবনও নষ্ট করতে চাও।’

মিসেস পারুল জাইনকে বলে,’কি দরকার আছে আবোলতাবোল বলে তোর বাপকে ক্ষেপানোর? জানিস তো সে একটুতেই চেতে যায়। তুই গতকালকে টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছিস সেটা নিয়েও চিল্লাপাল্লা করেছে। নিজের হাবিজাবি সামলে রাখবি না? আমার আর ভালো লাগে না তোদের যন্ত্রণা।’

জাইন স্বান্তনা দিয়ে বলে,’অপেক্ষা করো আর কয়েকদিন এরপর বউমা এনে দিবো তখন আর তোমাকে এতোদিক দেখা লাগবে না।’

মিসেস পারুল জাইনের কথায় পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। খাওয়া শেষ করে জাইন তড়িঘড়ি করে চুল আঁচড়ে বেরিয়ে যায়।

_______________

এক সন্ধ্যাবেলায় ইফতারির পর প্রিয়তা তার মায়ের সাথে স্থানীয় মার্কেটে এসেছে কেনাকাটা করতে। শাড়ির দোকানে গিয়ে অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটির পরও মিসেস মাসুমার শাড়ি পছন্দ হয় না। এভাবে তিন চারটা দোকান ঘুরে কিন্তু তাও সে নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতে পারে না। প্রিয়তা বিরক্ত হয় মায়ের কাজে।
বাহিরে চেঁচামেচির শব্দ হতেই দোকানদাররা কৌতুহল হয়ে বাহিরে উঁকি দেয়। এরপর দৌড়ে এসে তারা দোকানের শাটার নামাতে শুরু করে।
মিসেস মাসুমা প্রিয়তার হাত টেনে বলে,’কিরে বাহিরে আবার গন্ডগোল লাগলো নাকি?’

প্রিয়তা উত্তর দেওয়ার পূর্বেই এক দোকানদার বলে,’মা রা মা রি চলে আপা। মার্কেট সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ কইরা দিতাছি। জলদি পালান।’

মিসেস মাসুমা ভয়ে মিইয়ে যায়। মেয়েকে সাথে নিয়ে এবার সে বের হবে কিভাবে? পোলাপান মোটেও ভালো না। সুযোগ পেলেই অসভ্যতা করতে পারে।

প্রিয়তা মিসেস মাসুমাকে আশ্বস্ত করতে বলে,’কিছু হবে না মা। আমরা বেরিয়ে যেতে পারবো।’

মিসেস মাসুমা মেয়েকে ধমকান। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ কিভাবে শান্ত থাকবে? সব দোকানের শাটার নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও গিয়ে যে আশ্রয় নিবে উপায় নেই।

প্রিয়তা বলে,’আমরা পিছনের দিকটা দিয়ে বের হই।’

প্রিয়তার কথা মতো মিসেস মাসুমা তার হাত ধরে হাঁটা দেয়। ভয়ে তার গলা শুঁকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে সেই সাথে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।

পিছনের দিকটায় আসতেই দেখে দুই দল মা রা মা রি করছে। মিসেস মাসুমা থেমে যায়। প্রিয়তা মিসেস মাসুমার হাত টেনে আগায়। এরিমধ্য প্রিয়তার চোখ যায় এক কোণায়। পুরুষটা হাতে মোটা লাঠি দিয়ে বেধড়ক মা র ধ র করছে এক ছেলেকে। তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। কয়েক ঘা দিয়ে সে থামে। এরপর বাম হাত দিয়ে সিগারেটটা সরিয়ে ধোঁয়া ওড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রিয়তার পা থেমে যায়। কাউকে মা র ধ র করার সময় কেউ এভাবে সিগারেট টানতে পারে জানা ছিলো না প্রিয়তার।

মিসেস মাসুমা চেঁচিয়ে বলে,’প্রিয়তা চল জলদি।’

প্রিয়তার হুঁশ আসতেই সে মায়ের পায়ের সাথে পা মিলায় তবে তার দৃষ্টি এখনো সেদিকে। প্রিয়তার নাম কর্ণে পৌঁছাতেই পুরুষটা সেদিকে তাকায়। দু’জনের দৃষ্টি মিলিত হয়। সেই সময় তার হাতের আঙুলে থাকা সিগারেটটি শোভা পাচ্ছে ওষ্ঠাদ্বয়ের মাঝে। রফিককে চেঁচিয়ে ডাক দেয়। রফিক ছুটে আসতেই তাকে কিছু বলে। রফিকও মাথা নাড়িয়ে সেদিকে ছুটে। আপাততঃ এখানকার পরিস্থিতি জাইনের হাতের মুঠোয় তাই এটা নিয়ে পরে ভাববে। এখন নিজের ঘরের কথা ভাবা উচিত তার।

‘আন্টি আপনারা বের হতে পারবেন না। সামনের দিকটায় বিশাল ঝামেলা হচ্ছে। এখন রিকশা কিংবা সিএনজি কিছুই পাবেন না।’
অচেনা এক ছেলের এমন কথা শুনে মিসেস মাসুমা আরো ভয় পায়। প্রিয়তা তো রফিককে ভালো করেই চিনে।

প্রিয়তা বলে,’সেটা নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আমরা একটা ব্যবস্থা করে নিবো।’

মিসেস মাসুমা প্রিয়তাকে ধমকে বলে,’তুই চুপ থাক। বাবাব বলো তো কি করবে তাহলে।’

রফিক জবাব দেয়,’আপনি চাইলে আমাদের ভাইয়ের গাড়িতে আপনাদেরকে পৌঁছে দিতে পারি।’

প্রিয়তা থমথমে গলায় বলে,’লাগবে না। আর মা বাইকে উঠতে পারে না।’

রফিক বলে,’বাইক না তো গাড়ি। আসেন দেরি করলে আপনাদের ক্ষতি।’

প্রিয়তা যেতে চাইছিলো না মিসেস মাসুমা তাকে টেনে নিয়ে যায়। মায়ের ধমক খেয়ে শেষে প্রিয়তা যায়। রফিক তাদেরকে গাড়ির সামনে এনে পিছনের দরজা খুলে দেয়। মিসেস মাসুমা প্রিয়তার দিকে তাকায়। কালো রঙের ছাদ যুক্ত জিপ গাড়ি।

প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’গাড়ি এটা কার? আর তাছাড়া আমাদের কেনো আপনারা পৌঁছে দিবেন?’

রফিক উত্তর দেয়,’জান ভাইয়ের গাড়ি এটা।’

প্রিয়তা গম্ভীর গলায় বলে,’আমরা যার তার গাড়িতে যাবো না। চলো মা।’

‘প্রথমত এই গ্যাঞ্জামে আপনারা এখান থেকে বের হতে পারবেন না। বের হওয়ার চেষ্টা করলে লাঠির আঘাত খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছাতে চাইলে গাড়িতে উঠুন।’

জাইনের গলা পেয়ে প্রিয়তা পিছনে ফিরে তাকায়।
মিসেস মাসুমা বলে,’তুই বেশি বুঝিস চল। বাবা আমাদেরকে পৌঁছে দাও।’

প্রিয়তা তার মাকে বুঝানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। শেষে মা মেয়ে পিচনের সিটে বসে। রফিক ড্রাইভিং সিটে বসে আর তার পাশের সিটেই জাইন বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। প্রিয়তা গাড়িটাকে ভেতর থেকে দেখে বুঝে এটা সম্পূর্ণ নতুন গাড়ি। জাইন গু ন্ডা মি করে নতুন গাড়ি কিনে ফেললো? অথচ সে জানতো জাইন মানুষের সেবা করে।

জাইন জানালার কাচ নামিয়ে বাম পাশের লুকিং গ্লাসটা হাত দিয়ে ঠিক করে নেয়। প্রিয়তা তার পিছনের সিটেই বসেছে। একটু এংগেল করে ঘুরাতেই আয়নাতে প্রিয়তাকে দেখা যায়। একটু পরপর ওড়না টেনে ঠিক করছে প্রিয়তা। মাথায় ঘোমটা দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গাড়িতে বসে সে বিব্রত।

গাড়ি এসে থামে প্রিয়তাদের বাসার নিচে। মিসেস মাসুমা হাসিমুখে নেমে ধন্যবাদ জানায়। জাইন চোখ নামিয়ে তার কথার জবাব দেয়। মিসেস মাসুমা হাঁটা দিতেই জাইন চোখ তুলে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুলের কাটা স্থানটা মুখে দেয়।

প্রিয়তা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,’গুন্ডা।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হেসে দেয়। আঙুলটা সামনে এনে দেখে এখনো র ক্ত বের হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল না দিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। সে এখন যাবে ঝামেলা মেটাতে।

_______________

‘কেমন আছো তুমি?’
পরিচিত গলা পেয়ে প্রিয়তা পিছনে ফিরে তাকায়।

‘আরে আন্টি আপনি। আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন?’

‘আমি তো ভালোই। তোমাকে কতদিন পর দেখলাম।’

‘আজকে তো চাঁদ রাত তাই বাজার করতে বের হলাম। আপনি এখানে?’

‘আমার মেয়ে ওর বান্ধবীর বাসায় গেলো ঈদের দাওয়াত দিতে তাই আমি ওর অপেক্ষা করছি।’

‘ও আচ্ছা। আমিও এই বাসাতেই থাকি চারতলায়। বাসায় চলুন আন্টি।’

‘না না আমার মেয়ে চলে আসবে। তুমি ঈদের দিন যেও বাসায়। ঐ যে দুই গলি পর মোড়ের তিন নাম্বার বিল্ডিংটা সেটাই আমাদের।’

‘ঠিক আছে আন্টি। আমি তাহলে আসি।’

‘যাও মা।’

প্রিয়তা কথা শেষ করে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকে যায়। মিসেস পারুল হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মেয়েটাকে তার ভালো লাগে অনেক। কত লক্ষী একটা মেয়ে। কথা বললেই ভালো লাগে।
প্রিয়তা বাসায় ফিরে বাজারের ব্যাগটা তার মায়ের হাতে দিয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। বেল্লাল হোসেন বাজার করে কল দেয় আর প্রিয়তা গিয়ে নিয়ে আসে। গতরাতেই তুহিন নতুন চাকরি থেকে বেতন বোনাস পায়। ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বেল্লাল হোসেনকে টাকা দেয় ঈদের বাজার করতে। আজকে ঐ টাকা দিয়েই বাজার করা হয়েছে।

দিনের বেলায় মাকে সাহায্য করেই কেটে যায় প্রিয়তার। ইফতারির পর প্রিয়তা নিজ কক্ষে এসে বসে বিশ্রাম নিতে এমন সময় কলিংবেল বাজে। মিসেস মাসুমাও নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছে। অগত্যা প্রিয়তা উঠে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই বিল্ডিং এর মেয়েরা তাদের ফ্ল্যাটের দরজায় ভীড় করে।

‘আপু তুমি আমাদেরকে মেহেদী পরিয়ে দাও।’

‘আপু প্লিজ দাও না।’

‘আমাদের সবাইকে পরিয়ে দিতে হবে।’

মেয়েগুলোর আবদার শুনে প্রিয়তা অবাক হয়। কারণ সে মেহেদী পরাতে পারে সেটা তো কাউকে বলেনি তাহলে জানলো কিভাবে?

মিসেস মাসুমা মেয়েদের গলা পেয়ে বের হয়।
প্রিয়তা তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়।
মিসেস মাসুমা হেসে বলে,’ইয়ে মানে আমি ওদেরকে বলেছিলাম তুই একটু একটু মেহেদী পরিয়ে দিতে পারিস।’

প্রিয়তা হতাশ চোখে মায়ের দিকে তাকায়। সকলে তাকে টেনে ছাদের দিকে নিয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাদে আসে সে। চাঁদ রাত উপলক্ষে ছাদে সাজানো হয়েছে। বিল্ডিং এর পোলাপান ছাদে গান বাজাচ্ছে আর নাচানাচি করছে।
এক পাশে চেয়ার এনে প্রিয়তাকে বসতে দেওয়া হয়। সে সকলকে জানায় অল্প অল্প করে সকলকে দিয়ে দিবে। সবাই তার প্রস্তাবে রাজি হয়।

রাত এগারোটার দিকে ছাদে ভীড় কমেছে। মেয়েরা অনেকে চলে গেছে অনেকে রয়েছে। ছেলেরাও কিছু রয়ে গেছে।

জাইন ছাদে উঠে পাশের ছাদে এতো পোলাপানকে দেখে মারুফকে ইশারা করে। মারুফ তাকে আশ্বস্ত করে। এরপর সে আর শাকিল মিলে পোলাপানকে ধমকে বাসায় পাঠায়। তাদের নজর যায় এক কোনায় যেখানে একজন মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ এগিয়ে যেতেই মেয়েটা মুখ লুকায়।

‘এই মেয়ে এখানে কি? বাসায় যাও।’

মেয়েটা কোনো উত্তর দেয় না। পিছন থেকে রফিক বলে,’ভাই আমি দেখতেছি।’

রফিকের গলা পেয়ে মারুফ সন্দিহার দৃষ্টিতে তাকায়। রফিক তাকে ইশারায় সাইডে ডাকে। মারুফ আর শাকিল তার ডাকে সাইডে যায়।

‘ইয়ে মানে আসলে।’
রফিকের কথায় শাকিল ধমক দেয়।

‘যা বলবি স্পষ্ট বল। এসব কি?’

‘আসলে ও আমার গার্লফ্রেন্ড।’

রফিকের কথা শুনে শাকিল আর মারুফ যেনো আকাশ থেকে পড়ে।

শাকিল কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,’হা রা ম জা দা তুইও মেয়ে পটায় ফেলছিস? খালি আমিই পারলাম না কাউরে পটাইতে।’

মারুফ তার কাঁধে হাত রেখে বলে,’তুই একা না বন্ধু আমিও আছি। আয় গলা ধরে কান্দি।’

রফিক বলে,’থাক ভাই কাইন্দেন না।’

শাকিল ধমকে বলে,’সর এন্তে। মী র জাফর কোথাকার।’

রফিক আস্তে করে সরে তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে যায়। দূর থেকে এসব দেখে জাইন বিরক্ত হয়। ছাদ টপকে এই ছাদে চলে আসে। শাকিল আর মারুফ বিলাপ করতে করতে চলে যায়। রফিকও তার গার্লফ্রেন্ডকে বুঝিয়ে অপর ছাদে নিয়ে যায়। সকলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জাইন ফোন বের করে প্রিয়তাকে মেসেজ দেয়। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও মেসেজের কোনো উত্তর আসে না। ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চে ধপ করে বসে। এমন সময় তার কানে কানের গানের লাইন বাজে। খালি গলায় কেউ গান করছে। আশেপাশে তাকাতেই কাউকে দেখতে পায় না। এরপর খেয়াল করে পিছনের দিক থেকে আসছে শব্দটা। উঠে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। ট্যাংকির পিছনের দিকটায় খালি জায়গা রয়েছে সেখানে তেমন কেউ আসে না। এক প্রকাশ ভূতুরে পরিবেশ।
জাইন এগুতেই তার দৃষ্টিগোচর হয় এক রমনী। যে রেলিং ধরে গগনের পানে তাকিয়ে আছে তার গান গাইছে। কানে তার ইয়ারফোন। সম্ভবত তাতে গান বাজছে। জাইন ধীর পায়ে গিয়ে তার পিছনে দাঁড়ায়।

‘আমারো পরানো যাহা চায়,
তুমি তাই,তুমি তাই গো..
আমারো পরানো যাহা চায়..’

জাইন চুপচাপ দাঁড়িয়ে গান শোনে সেই সাথে পুরোটা ভিডিও করে রাখে। গান শেষ হতেই প্রিয়তার ফোন বাজে। বের করে দেখে মিসেস মাসুমার কল। কল রিসিভ করতেই মিসেস মাসুমা প্রশ্ন করে,’তুই কই? বাসায় আয়। তোর ভাই আর বাবা কল দিয়েছিলো আসতেছে তারা।’

‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে প্রিয়তা গুনগুন করতে করতে পিছনে ঘুরতে নিলেই চমকায়।এতক্ষণ কানে ইয়ারফোন থাকায় সে কিছু টের পায়নি।

জাইন বলে,’চলে যাচ্ছো? আরেকটু থাকো। আমার তো এখনো চাঁদ দেখা শেষ হয়নি। চাঁদ রাতে মন ভরে চাঁদ না দেখলে কি হয় বলো?’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা গগনের পানে চায়। কই চাঁদ তো নেই? তাহলে জাইন এই রাতের বেলা চাঁদ কিভাবে দেখছে? মন মনে প্রিয়তা জাইনকে পা গ ল উপাধি দিলো।

জাইন আবারো বলে,’এ চাঁদ সবার দেখার সৌভাগ্য হয় না। ইউ নো এটা আমার ব্যক্তিগত চাঁদ।’

প্রিয়তার এবার আর কোনো সন্দেহ নেই জাইনের মাথায় গন্ডগোল আছে সেই বিষয়ে। রাত এগারোটায় চাঁদ আসবে কো থেকে?

………..
(চলবে..)