প্রণয়ী পর্ব-১৭+১৮

0
201

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৭.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

ঈদের দিন ফজরের সময় ঘুম ভাঙে প্রিয়তার। ঘুম ভেঙেছে বললে ভুল হবে মিসেস মাসুমা তাকে কয়েকবার ডেকে গেছেন। ঘুমঘুম চোখে সে উঠে বসে। গত রাতে বেশ দেরি করে ঘুমিয়েছে। হাত দিয়ে মাথার কেশগুলো এলোমেলো করে দিয়ে খোঁপা করে নেয়। হাই তুলে জানালার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায়। এই সময়টা চারিদিক এতো সিগ্ধ আর সুন্দর লাগে সেই সাথে দখিনা হাওয়াতে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চারিদিকে ফজরের আজানের প্রতিধ্বনিতে মুখরিত। ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে দাঁড়ায় সে।
গতরাতে ছাদে জাইন আসার পর সে বেশিক্ষণ থাকেনি। তার মা কল দেওয়ার মিনিট পাঁচেক পরই সে ছাদ থেকে নেমে আসে। জাইনকে আবারো বলে এসেছে সে যেনো ছাদে না আসে। এভাবে ঘনঘন ছাদে আসলে কারো না কারো তো চোখে পড়বে তখন লোকে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে নানান কথা রটাবে। প্রিয়তা ভয় পায়,সমাজের মানুষের কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা। তার কারণে পরিবারের মানুষ সমাজে হেনস্তা হোক সে চায় না। তাই তো তেইশ বসন্ত পেরিয়ে গেলেও কারো সাথে এখনো প্রণয়ে জড়ায়নি। সবসময় এসব এড়িয়ে গেছে। জাইনের আনাগোনা দেখে সে আচঁ করতে পারে জাইন বিনা কারণে এখানে আসে না। তার উদ্দেশ্য ভিন্ন কিন্তু সেসব জানার মোটেও আগ্রহ নেই প্রিয়তার। সে জানে এসব করে লাভ নেই। বাসা থেকে যেই ছেলেকে পছন্দ করবে তাকেই তার বিয়ে করতে হবে। প্রিয়তার ও এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পরিবার ভালোবেসে যেখানে দিবে সেখানেই সে যেতে রাজি। তারা আ গু নে ঝাপ দিতে বললেও সে দিবে।

‘প্রিয়তা উঠছিস?’
মিসেস মাসুমা আবারো দরজায় নক করে। প্রিয়তা জানালার পর্দা টেনে গিয়ে দরজা খুলে। ফজরের আজান শেষ হয়েছে একটু আগে।

‘গোসল করে নামাজ পড়ে আয় বাকি রান্না সেরে ফেলি। তার ভাই আর বাবা উঠে গেছে।’

‘তুমি যাও আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।’

‘শোন সেমাই বেড়ে খেতে দিস আমি রান্নাঘরে যাবো সোজা।’

‘আচ্ছা।’

মিসেস মাসুমা যেতেই প্রিয়তা গোসল করতে পা বাড়ায়। গোসল সেরে ফজরের নামাজ আদায় করে টেবিলের কাছে যায়। বাটিতে সেমাই বাড়তেই বেল্লাল হোসেন কক্ষ হতে বের হয়। প্রিয়তা বাবাকে সালাম দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। একটু পর তুহিনও আসে। সেমাই খেয়ে বাবা ছেলে একত্রে বেরিয়ে যায় ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে।

প্রিয়তা রান্নাঘরে যায় তার মাকে সাহায্য করতে। মা মেয়ে মিলে বেশ আয়োজন করে ঈদ উপলক্ষে। সকাল নয়টা বাজতেই বাসার কলিংবেল বাজে। প্রিয়তা দরজা খুলতেই তার চাচাতো ভাই-বোন ঘরে প্রবেশ করে। প্রিয়তা ওদের সেমাই দিয়ে বসে। এরিমধ্যে তার কক্ষে থাকা ফোনটা ক্রমাগত বাজতে থাকে। কয়েকবার বাজতে বাজতে কেটে যায়। মিসেস মাসুমা তাকে বলে গিয়ে ফোন ধরতে। মায়ের আদেশ মতো প্রিয়তা কক্ষে এসে টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা হাতে নেয়। কল রিসিভ না করে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিচ থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ আসছে। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই কালো রঙের জিপটা নজরে আসে। ফোন আবারো বেজে উঠে। ভেতর থেকে মিসেস মাসুমা চেঁচাচ্ছেন ফোনের রিংটোনের শব্দ পেয়ে। উপায়ন্তর না পেয়ে কল রিসিভ করে জানালা থেকে সরে দাঁড়ায় প্রিয়তা।
অপরপাশ থেকে অধৈর্য্য গলায় বলে,’কতগুলো কল দিলাম? কল রিসিভ করছো না কেনো?’

প্রিয়তা থমথমে গলায় জবাব দেয়,’ব্যস্ত ছিলাম তাই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন? না হলে কল রাখলাম।’

জাইন নিঃশব্দে হাসে।
‘সালাম দেওয়া ভুলে গেছো?’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা লজ্জাবোধ করে। সাথে সাথে সালাম দেয়।

‘জানালার কাছে একটু আসো।’

‘পারবো না।’

‘তাহলে আমি কি উপরে আসবো? সেমাই খেতে?’

‘একদম না।’

‘তাহলে জানালার কাছে এসে দাঁড়াও প্লিজ। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।’

‘আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি করছেন।’

‘কিছু করা শুরু করিনি এখনো। জাইন রহমান যদি একবার পাগলামো শুরু করে তুমি নিতে পারবা না। টালমাটাল হয়ে যাবা প্রিয়।’

‘আপনি চাইছেনটা কি?’

‘আপাততঃ চাইছি জানালার কাছে তুমি আসো। আমার হাতে সময় কম। কাম ফাস্ট।’

প্রিয়তা শ্বাস ফেলে। যত তর্ক করবে তত কথা বাড়বে কিন্তু সে এতো সহজে হার মানার পাত্রী নয়।

‘আপনি জানেন এসব লোকজন দেখলে আজেবাজে কথা বলবে?’

‘লোকে তো তখনো আজেবাজে কথা বলবে যখন দেখে জাইন রহমান ঘন্টার পর ঘন্টা এই বাসার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভেজে। বাইকে বসে রোদে পুড়ে অপেক্ষা করে। এখন ঈদের দিন গাড়ি নিয়ে একই জায়গায় অপেক্ষা করছে। এসব তাদের চোখে পড়বে না?’

জাইনের এসব কথার কোনো উত্তর প্রিয়তার কাছে নেই।

জাইন গলার স্বর নামিয়ে বলে,’তুমি এতক্ষণ কথা না পেঁচিয়ে এলে আমি সেই কখন চলে যেতাম। তুমিই দেরি করাচ্ছো।’

জাইনের কথার মাঝে প্রিয়তা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কানে ফোন। চোখমুখ দেখে বুঝাই যাচ্ছে ক্ষেপে গেছে সে।

কালো রঙের জিপের কাচ নামাতেই জাইনের চেহারা দৃশ্যমান হয়। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে আছে সে। গায়ে তার এক রঙা পাঞ্জাবী। সাদা রঙের পাঞ্জাবীর উপর পরেছে কালো কটি। পাঞ্জাবীর গলার দিকটায় সোনালী সুতোর কাজ। চোখে কালো রঙের সানগ্লাস আর ওষ্ঠে হাসি। জাইন প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ায়।

‘কি হলো স্ট্যাটু হয়ে আছো কেনো? আমাকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেছে? আই নো আমি হ্যান্ডসাম কিন্তু কারো কথা বন্ধ করে দেওয়ার মতো হ্যান্ডসাম জানতাম না।’

‘আপনি মোটেও হ্যান্ডসাম না। বিশ্রী লাগছে আপনাকে।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন শব্দ করে হাসে। প্রিয়তাকে ক্লান্ত লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুম হয়নি। গায়ে সুতির একটা মেরুন রঙের কামিজ। ওড়নাটা কপাল অবধি টানা। এতেই প্রিয়তাকে বেশ লাগে জাইনের কাছে।
‘ঈদের দিন মিথ্যে কথা বলো না প্রিয়। আজকে এটলিস্ট সত্যিটা বলো।’

‘আপনার তামাশা করা হয়েছে? আমি গেলাম।’

‘শুনো..’

‘আবার কি?’

‘সন্ধ্যায় চা খেতে যাবা আমার সাথে? আজকে অন্তত না কোরো না প্লিজ।’

‘মামা বাড়ির আবদার নাকি? আপনি আমার কে হন যে আপনার সাথে বের হবো?’

‘উম আমি তোমার সাহাযয়কারী,প্রতিবেশি আর একটু দূরের বন্ধু।’

‘দূরের বন্ধু মানে?’

‘তুমি দূরে দূরে থাকো তাই দূরের বন্ধু।’

‘যত্তসব ফালতু আলাপ। কল রাখছি।’

‘আরে শুনো তো।’

‘আবার কি?’

‘সালামি নিবা না?’

‘লাগবে না। যার তার থেকে আমি টাকাপয়সা নেই না।’

‘তাহলে কি নিবা?’

‘এক বস্তা ফুল গাছ। হয়েছে?’

‘শিওর?’

‘হ্যা সাথে আপনার মন্ডুটাও দিয়েন।’

‘তুমি বললে এক্ষুনি কেটে দিচ্ছি।’

প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে কল কেটে দেয়। জানালার পর্দা টেনে ভেতরের ঘরে যায়। মিসেস মাসুমা ইতিমধ্যে তাকে কয়েকবার ডেকেছে। জাইন কানে ফোন ধরে এখনো পর্দা দেওয়া জানালার পানে তাকিয়ে আছে। সকালের শুরুটা তার দারুণ হলো। প্রিয়তার রগচটা কথবার্তা তার কাছে একদম স্বাভাবিক লাগে। বরং ঐদিকে প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখে তার কষ্ট হয়েছে। প্রিয়তা রাগলে বকলে একদমই খারাপ লাগে না তার। এটাই বোধহয় প্রণয়।

……..

জাইন বাসায় ফিরে দেখে সোফায় জারিফ আর রমিজউদ্দিন বসে গল্প করছে। জাইন এসে তাদের পাশে বসে। সকালবেলা ঈদের নামাজ সেরে বন্ধুদের সাথে দেখা করে সোজা প্রিয়তাকে দেখার জন্য চলে গিয়েছিলো। সবে বাসায় ঢুকলো। অবশ্য বেশিক্ষণ থাকবে না। বের হবে আবারো। দলের লোকজনের সাথে দেখা করতে হবে।
মিসেস পারুল এক ট্রে ভর্তি নানান পদের সেমাই আর মিষ্টি রাখে জাইনের সামনে।

জাইন এতোকিছু দেখে প্রশ্ন করে,’এগুলো সব আমার জন্য?’

মিসেস পারুল উত্তর দে,’হ্যা,সব খাবি কিন্তু।’

জাইন আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’নুহাশ আর নিহারিকা কই?’

‘ওরা গেছে সালামি তুলতে।’

মিসেস পারুলর কথাটা বলে নিজ কক্ষে চলে যান। জারিফ আর বেল্লাল হোসেন চা পান করছিলো।
জারিফ প্রথমে শুরু করে,’শুনলাম বাঙলা দলের সভাপতি হয়েছিস। দল থেকে নাকি তোকে গাড়িও দিয়েছে?’

জাইন উত্তর দেয়,’গাড়ি না জিপ।’

‘ব্যবসায় হাত লাগালে এই রকম জিপ বহু আগেই কিনতে পারতি।’

‘ব্যবসা করে জিপ কিনলে সেই জিপে চড়ে আমি আরাম আয়েশ করতাম। আর এই জিপে চড়ে আমি মানুষের দুঃখ দূর করার কাজ করি।’

‘বয়স অল্প তাই এখনো ঝোঁকে আছিস। টাকা থাকলে মানবসেবা যে কোনো স্থান থেকেই করা যায় কোনো দলে ঢুকা লাগে না।’

‘টাকা দিয়ে দিলেই যদি মানবসেবা হতো তাহলে এতো মানুষ অনাহারে থাকতো না। দেশে এতো চাঁদাবাজি হতো না।’

বেল্লাল হোসেন এতক্ষণে মুখ খুলেন,’থাক জারিফ ওরে বুঝানোর চেষ্টা করো না। ও তোমার আর আমার থেকে অনেক বেশি বুঝে। তা আমার পয়সায় কেনা বাইকটা কোথায়? তোমার যেহেতু গাড়ি আছে সেহেতু আমার পয়সার বাইকের প্রয়োজন তো নেই।’

জাইন খাওয়া শেষে জবাব দেয়,’দিয়ে দিয়েছি।’

‘দিয়ে দিয়েছো মানে?’

‘আমার প্রয়োজন নেই আর তাই যার প্রয়োজন তাকে দিয়েছি। আপনিই তো বলেন নিজের অপ্রয়োজনীয় জিনিস অন্যকে দান করতে হয়।’

বেল্লাল হোসেন বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,’তাই বলে বাইকটা দিয়ে দিবা?’

জাইন তার কথার জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে কল বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। বেল্লাল হোসেন এখনো তাজ্জব বনে আছেন। ছেলেটা তার কথার জবাবই দিলো না!

……….

সারাদিন কাজ করে প্রিয়তা অনেক ক্লান্ত। সন্ধ্যা বেলা একটু শুয়েছিলো। কখন যে ক্লান্তিতে চোখজোড়া লেগে গেছে তা অজানা। দরজায় ক্রমাগত নক করার শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ ডলে ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে রিমি আর হৈমন্তী প্রবেশ করে।

রিমি প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়তার চোখমুখে এখনো ঘুমের রেশ।

রিমি বলে,’কিরে ঈদের দিন কেউ ঘুমায়? কল দিলাম ধরিসনি কেনো?’

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’ঘুমে ছিলাম টের পাইনি। তোরা হঠাৎ?’

হৈমন্তী বলে,’রিমি টেনে আনলো। বললো ঘুরতে বের হবে।’

প্রিয়তা বলে,’এই ভর সন্ধ্যায়? কালকে বের হবনি।’

রিমি জেদ দেখিয়ে বলে,’কোনো কালকে না। এখন বের হবি। রেডি হ জলদি।’

প্রিয়তা রিমিকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে পাত্তা দেয় না। অগত্যা প্রিয়তা তৈরি হতে যায়। বেশিক্ষণ সময় লাগে না তার। জামাটা বদলে চুলগুলো বিনুনি করে তা খোঁপা করে নেয়। সাজসজ্জা করলে বাসার লোকে অন্য কিছু ভাবতে পারে তাই সাধারণ ভাবেই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

রিমি প্রিয়তাকে দেখে বলে,’কিরে লিপস্টিক কই? টিপ কই? দুল কই?’

প্রিয়তা হতাশ গলায় বলে,’ভাইয়া দেখলে রাগ করবে।’

রিমি মুখ কালো করে তার কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়। হৈমন্তী প্রিয়তার সাথে বের হয়৷ তুহিন এখন বাসায় নেই তাই মিসেস মাসুমা আর বেল্লাল হোসেন অনুমতি দিয়ে দেয় বের হওয়ার জন্য।

সিঁড়ি দিয়ে মুখ কালো করে রিমি নামে। প্রিয়তা তাকে ডাক দেয়।

‘আরে মুখ কালো করছিস কেনো। একটা জিনিস দেখাই।’
প্রিয়তা ব্যাগ থেকে চুড়ি বের করে পরে। আর কানে এক জোড়া দুল পরে যেটা তারা মেলা থেকে কিনেছিলো।

রিমি হাসিমুখে বলে,’এগুলো কখন নিলি?’

‘ঐ যে মেলা থেকে নিয়েছিলাম। এগুলো হাত ব্যাগেই রেখেছিলাম।’

রিমি নিজের ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে প্রিয়তাকে লাগিয়ে দেয়। হৈমন্তী নিজের ব্যাগ থেকে কাজল বের করে প্রিয়তার চোখে পরিয়ে দেয়। সমস্তটা তারা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে করে। তুহিনের ভয়ে সেজেগুজে বের হয়নি। কিন্তু যখন দেখলো তুহিন বাসায় নেই তখন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সাজগোজ শেষ করলো।

বিল্ডিং থেকে নেমে তিনজন এক রিকশায় চড়ে বসে। তিনজন মিলে প্রথমে সেই বালুরমাঠে যায়। ঈদ উপলক্ষে সেখানে মেলা চলছে। মেলায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখে আর নানান জিনিস খায়। সময়টা ভীষণ ভালো কাটে তিনজনেরই। দু ঘন্ট ঘুরাঘুরির পর প্রিয়তা বাসায় ফিরে। প্রিয়তা ফেরার কিছুক্ষণ পরই তুহিন বাসায় ফেরে। সে রাতে ফোন সাইলেন্ট করে প্রিয়তা এক শান্তির ঘুম দেয়।

পরের দিন সকাল বেলা প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠতেই বাহিরের হট্টগোল তার কানে আসে। কি হয়েছে দেখার জন্য বের হয় সে। তার উপর ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। মিসেস মাসুমা সহ অন্য ফ্ল্যাটের মহিলারা কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। প্রিয়তা সেদিকে এগিয়ে যায়।

এক মহিলা বলে,’আরে ভাবী বইলেন না আমি তো ভয়ে শেষ। কি যে অবস্থা।’

আরেকজন বলে,’আমি বলছিলাম না এই বিল্ডিং এ জ্বি নে র উৎপাত আছে।’

মিসেস মাসুমা বলে,’আমার তো বিশ্বাসই হয় না এমন কিছু হতে পারে।’

প্রিয়তাকে দেখে প্রথমজন বলে,’আরে প্রিয়তা জানো কি হইছে?’

প্রিয়তা তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মহিলা প্রিয়তার হাত টেনে বলে,’এক ভূতুরে কাহিনী ঘটে গেছে।’

মহিলার মেয়ে এসে বলে,’মা আমি আপুরে দেখাই আনি।’

প্রিয়তা এখনো বুঝতে পারছে না ঘটলোটা কি। মেয়েটা প্রিয়তাকে ছাদের দিকে নিয়ে যায়। না বুঝে প্রিয়তা মেয়েটার সাথে যেতে থাকে। মেয়েটার নাম রুমা। পড়ে ক্লাস টেনে অথচ এতো পাকনা। প্রচুর বকবক করে। প্রিয়তা মেয়েটাকে সবসময় এড়িয়ে চলে। এখনো হাবিজাবি বলে প্রিয়তার মাথা খাচ্ছে সে। ছাদে আসতেই প্রিয়তা দেখছে বিল্ডিং এর অনেকেই ছাদে।

রুমে বলে,’আপু দেখেন ঐ যে।’

প্রিয়তা ছাদের রেলিং এর নিচে তাকাতেই দেখে সেখানে ফুলের টব। কমপক্ষে শত ফুলের টব রাখা। সবগুলো গাছেই নানান রঙের,নানান রকম ফুল ফুটে আছে। এক ছেলে গাছগুলে ভিডিও করছিলো জানায় এখানে নিরানব্বইটা টব রয়েছে।

প্রিয়তা অবাক হয়ে টবগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। সে আসলেই বাকরুদ্ধ। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এগুলো আনলো কে আর এখানে রাখলো কে?

রুমা এসে প্রিয়তার পিছনে দাঁড়ায়।
‘ছয়তলার আন্টি সকাল বেলা ছাদে কাপড় মেলতে আইসা দেখে এই কাহিনী। উনি চিৎকার দিতেই সবাই এসে উপস্থিত হয়। সবাই বলতেছে এটা কোনো মানুষের কাজ না জ্বি নের কাজ। কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না এক রাতে এতো ফুল সহ গাছ জোগাড় করে এনে রাখা। আর তাছাড়া আমাদের বাসার গেইট তো বন্ধই থাকে।’

রুমার কথা প্রিয়তার কাছে আজগুবি লাগে। জ্বি ন আছে সে বিশ্বাস করে কিন্তু এই এলাকায় যেটা রটানো রয়েছে সেটা সে বিশ্বাস করে না। আর জ্বি ন কেনো ফুল গাছের টব এনে রাখবে? তার কি লাভ? প্রিয়তা সকলের কথা বিশ্বাস করে না। তবে মনের কথা মনেই রাখে। সারা এলাকায় জ্বি নের এই কারবার মূহুর্তেই রটে গেছে। অনেকে এর সাথে তেল মশলা মিশিয়ে আরো ভালো করে ঘটনা রটাচ্ছে। সকলের একটাই প্রশ্ন,জ্বি ন নিরানব্বইটা টব কেনো দিলো? মিল করে একশত কেনো দিলো না? নিশ্চয়ই এর পিছনে জ্বি নের উদ্দেশ্য আছে কোনো।

প্রিয়তা নিজ কক্ষে এসে পায়চারী করতে থাকে। কাহিনী ঘটলোটা কি সেটাই বুঝতে পারছে না সে। ফোনের কথা মনে হতেই বালিশের পাশে হাতরায়। একটু খুঁজতেই ফোন পেয়ে যায়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো মেসেজ। সবগুলো সিম কোম্পানির মেসেজ। এর মধ্যে একটা মেসেজে তার চোখ আটকায়। মেসেজটা এসেছে রাত তিনটায়।

‘এই পুষ্প তোমার সামনে তুচ্ছ প্রিয়,
তোমায় দেখলে পুষ্পরা সব লাজে মরে যাবে।
ওরা বলছিলো তোমার চেয়ে নাকি ওরা বেশি স্নিগ্ধ তাই ওদের নিয়ে এলাম দেখাতে,ওরা দেখুক জ্বলুক আর নিজেদের জন্ম স্বার্থক করুক।’

মেসেজটা পড়ে মাথায় হাত দিয়ে প্রিয়তা বিছানায় ধপ করে বসে। এইরকম অদ্ভুত কাজ জ্বি ন ব্যতিতো কে করতে পারে সেটা এতক্ষণ প্রিয়তার মাথায় আসেনি।
প্রিয়তা বিরবির করে বলে,’গুন্ডা থেকে মজনু।’

……….
(চলবে…)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৮.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………

তপ্ত গরম জানান দিচ্ছে বৈশাখ মাস এসে গেছে। কাঠফাটা রৌদ্র তাপে মানুষ হাসফাস করছে। কোথাও বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। চারিদিকে গ্রীষ্মের উত্তাপ। ঈদ শেষ হওয়ার সপ্তাহ খানেক পর প্রিয়তার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়।
ইতিমধ্যে দু’টো পরীক্ষা দেওয়া শেষ। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকতেই দেখে চেয়ারে তার খালাতো ভাই বসে আছে। ইনি প্রিয়তার আপন খালাতো ভাই না। প্রিয়তার নানুর বোনের মেয়ের ঘরের ছেলে। প্রিয়তার মায়ের সাথে তাদের খাতির থাকায় মাঝে মাঝে সে আসে। অল্প বয়সে বিয়েশাদি করে বাচ্চার বাবাও হয়ে গেছে সে। প্রিয়তার বয়স আর তার বয়স একই। আজও বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। কয়েক কিলোমিটার পরই পাশের থানায় তারা থাকে।

দুলাল প্রিয়তাকে দেখে বলে,’কিরে প্রিয়তা কেমন আছিস?’

প্রিয়তা শুকনো গলায় উত্তর দেয়,’ভালো।’

দুলালের স্ত্রী ময়না হেসে বলে,’ভাবছিলাম এবার তোমার বিয়েটা খাবো। তা কবে বিয়ে করবা?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’একত্রিশতম ফাগুনে।’

ময়না এলেই শুধু তার খালা মাসুদার মতো প্রিয়তাকে বিয়ে নিয়ে বলে। এতে প্রিয়তা বেশ বিরক্ত হয়। তবে দুলাল বিপরীত স্বভাবের।

ময়না না বুঝে প্রশ্ন করে,’কি?’

‘কিছু না ভাবী আমি ক্লান্ত। রুমে গেলাম পরে কথা হবে।’

ময়না মাথা নাড়ায়। প্রিয়তা নিজ কক্ষে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। মেহমান আসা মানে তার কক্ষ ছেড়ে দেওয়া। আজকে নিশ্চয়ই তাকে তুহিনের কক্ষ শুতে দেওয়া হবে আর তুহিন বাহিরে শুবে। প্রিয়তার মন খারাপ হয়। নিজ কক্ষ রেখে কোথাও শুয়ে শান্তি পায় না সে। এই কক্ষটা তার একান্ত শান্তির নীড়। একটু একটু করে এই নীড় সাজিয়েছে সে। মন ভালো করার জন্য চিন্তা করে ছাদে যাবে। ছাদের গাছগুলোর কি অবস্থা কে জানে। রোজ দু’বার করে দেখে আসে। মাঝে মাঝে গাছগুলোতে জল দেয় সে। ফোন হাতে নিয়ে ওড়না পেঁচিয়ে কক্ষ হতে বের হয় সে। মিসেস মাসুমা তাকে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে।

‘কিরে কই যাস?’

‘ছাদে কাপড় দিয়েছিলাম সকালে সেটা আনতে যাই।’

‘এই ভর দুপুরে ছাদে যাবি?’

‘যাবো আর চলে আসবো।’
মিসেস মাসুমা প্রিয়তার কথায় কান না দিয়ে ময়নাকে জ্বি নের কাহিনী শোনাতে থাকে। কিভাবে এক রাতের মধ্যে নিরানব্বইটা ফুল গাছের টব ছাদে এলো সেই গল্প। এলাকাবাসী মশলা মিশিয়ে একটা গল্প তৈরি করেছে এটা নিয়ে। সেটাই মিসেস মাসুমা ময়নাকে শোনাচ্ছে। ময়নাও মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে চলেছে।

মিসেস মাসুমা বলতে শুরু কর, ‘তো কাহিনীর সূত্রপাত নাকি অনেক আগে থেকে। এই বাড়িতে এক জ্বি ন থাকতো। সে প্রায় এটা ওটা এনে নাকি ছাদে রেখে যেতো। আমরা ভাড়া নেওয়ার পর এ ঘটনা শুনি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ঈদের পরের দিন সকাল বেলার ঘটনার পর বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী রুমার মা কলিংবেল চাপে তখন আমরা সবাই ঘুমে। উঠে দরজা খুলতেই ভাবী আমাকে জানায় ছাদে কে জানে অনেকগুলা ফুলের টব রেখে গেছে। প্রথমে আমি ভেবেছি হয়তো কোনো ভাড়াটিয়া কিনে এনেছে। রুমার মা আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। এতো গুলো ফুলের টব গেছে আমার তো জ্ঞান হারানোর অবস্থা। তারপর হলো কি…’

প্রিয়তা গুনগুন করতে করতে ছাদে আসে। ফুলগাছ গুলোর দিকে এগুতে নিলেই কারো চাপা হাসি কানে আসে। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে পানির টাংকির দিকে তাকায়। এরপর সেদিকে এগিয়ে যায়। কানে ফোন রেখে ওড়না দিয়ে কেউ মুখ চেপে হাসছে। প্রিয়তা শুকনো কাশি দিতেই মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা অবাক হয় ভর দুপুরে ছাদে রুমাকে দেখে।

গম্ভীর গলায় রুমাকে জিজ্ঞেস করে,’এখানে কি করছো?’

রুমা জবাব দেয়,’কিছু না আপু।’

‘যাও বাসায় যাও।’

‘একটু পরে যাবো আপু। আর ফোনের বিষয়টা কাউকে বলবেন না প্লিজ। মা জানলে অনেক মারবে।’

‘বাসায় যাও।’

‘আপু বলবেন না তো?’

‘ভেবে দেখবো।’

রুমা ফোনের লাইন কেটে হাঁটা দেয় এরপর কি ভেবে আবার প্রিয়তার কাছে ফেরত আসে।
রুমা বলে,’আপু একটা কথা বলি?’

প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’কি?’

‘আপনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে জান ভাইয়ের সাথে প্রেম করেন এটা আমি জানি।’

রুমার কথা শুনে প্রিয়তার অক্ষিকোটরের বাহিরে বেরিয়ে আসা উপক্রম। এই মেয়ে কি সাংঘাতিক কথা বললো!

‘কি সব আজেবাজে বলছো।’

‘আজেবাজে না আপু। আপনাকে সন্ধ্যা বেলা জান ভাইয়ের সাথে ছাদে দেখেছি। সেদিন ও তো জান ভাই এলো। আপনার সাথে প্রেম না থাকলে এমনি এমনি তার মতো নেতা আসে?’

রুমার কথাবার্তা শুনে প্রিয়তার মাথায় বাজ পড়ে। মেয়েটা কি সব বলছে। এগুলো কারো কানে গেলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।
রুমা হাসি দিয়ে বলে,’ভয় পাবেন না আপু আপনার সিক্রেট আমি সিক্রেট রাখবো তবে আপনিও আমার সিক্রেট সিক্রেট রাখবেন। ওকে?’

প্রিয়তা রুমার কথা শুনে অবাক হয়। মেয়েটা তাকে ব্লাকমেইল করছে? বিনা দোষে প্রিয়তা ফেঁসে গেলো।

‘তুমি বাসায় যাও তো।’

‘থাক আপু লজ্জা পেতে হবে না। আপনার কোনো সাহায্য লাগলে জানাবেন।’

প্রিয়তা চোখমুখ খিচে হাঁটা দেয়। অসহ্য লাগছে তার কাছে সব কিছু। না পারছে রুমাকে কিছু বলতে না পারছে সইতে। রুমা৷ নিশ্চিন্তে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায়। প্রিয়তা যে তার নামে এখন আর বিচার দিতে পারবে না এটা সে নিশ্চিত।

প্রিয়তা গাছগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ বুলায়। জ্বি ন রেখে গেছে ভেবে বিল্ডিং এর মানুষ গুলো গাছের ভালোই যত্ন করছে। প্রথমে তো অনেকে ভয়ে আশেপাশেই আসছিলো না এরপর কে জানি রটালো গাছগুলো মরে গেলে জ্বি ন অসন্তুষ্ট হয়ে ক্ষতি করতে পারে তাই সকলে মিলে গাছ গুলোকে নিয়মিত পানি দিচ্ছে সেই সাথে মোটা পলি আর বাঁশ দিয়ে টবের উপর চালার মতো দিয়ে দিয়েছে যাতে এতো রোদে গাছগুলো না মরে। এমনিতে কেউ একটা গাছ এনে রাখলে পোলাপান সেটার পাতা ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলে কিন্তু এগুলো নষ্ট তো দূর বিনা কারণে কেউ হাতও লাগায় না।
প্রিয়তা চোখ বুলালে এ মাথা থেকে ও মাথা নজরে আসে শুধু গাছ। জাইন এখন আর আসে না। তার সাথে শেষবার চাঁদ রাতে দেখা হয়েছিলো। এরপর ঈদের দিন। ব্যস ঐটুকুই। সময় পেলে মেসেজ দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। প্রিয়তা বুঝতে পারে আজকাল জাইন ভীষণ ব্যস্ত থাকে। তার ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে। এতে অবশ্য প্রিয়তারই ভালো। সে নিশ্চিন্তে ছাদে ঘুরাফেরা করতে পারে।

কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে প্রিয়তা ছাদ থেকে নেমে আসে।

……..

জাইন অফিসে লোকজন নিয়ে বসে আছে। খালেকুজ্জামান ভেতরের কক্ষে মিটিং করছে। জাইন ইদানীং খালেকুজ্জামানের সাথে বেশি থাকে। তার ঘুম পাচ্ছে অনেক। মাথা এলিয়ে দিলেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে সে। বিগত কয়েক সপ্তাহ তার ব্যস্ততায় কাটছে। আগের মতো ঘুরার সুযোগ পায় না সে। ফোন বের করে গ্যালারি থেকে প্রিয়তার ঝাপসা কিছু ছবি দেখতে থাকে। যেগুলো বিভিন্ন সময় সে তুলেছিলো। প্রিয়তাকে কাছ থেকে দেখে না অনেকদিন। ইচ্ছে করলেও যাওয়ার উপায় নেই।
চিন্তা করে প্রিয়তাকে মেসেজ দেওয়ার। দশটা মেসেজ দিলে একটা রিপ্লাই করে প্রিয়তা। মেয়েটা এতো কঠোর কেনো বুঝে উঠতে পারে না সে। সবসময় কি রকম কঠোরতায় নিজেকে ঢেকে রাখে। জাইনও তো কঠোর ব্যক্তি। এই হাতে কত মানুষকে পি টি য়ে জা হা ন্না ম দেখিয়েছে। কত মানুষের মাথায় রি ভ ল ভার ঠেকিয়ে মৃত্যু ভয় দেখিয়েছে। সেই মূহুর্তে তার চোখ মুখে কঠোরতা ব্যতিতো অন্য কিছু কেউ দেখতে পায়নি। অথচ প্রিয়তার সামনে গেলে সব কঠোরতা উড়ে যায়। ইচ্ছে করে প্রিয়তার আগে পিছে কিশোরের মতো ছুটতে। বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন প্রেমিকার জন্য পাগলামো করে জাইনেরও তা ইচ্ছে করে। এর আগে জাইনের দু’জন প্রেমিকা ছিলো। একজন ছিলো স্কুলে থাকা কালিন। দু’জনে একই ক্লাসে পড়তো। মেয়েটা জাইনকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। সে এসএসসি পরীক্ষার পর বিনা নোটিশে হুট করেই এক বুড়ো লোককে বিয়ে করে ফেলে। এরপর জাইন ভেবেছিলো আর প্রেম করবে না। কিন্তু কলেজে উঠেই এক জুনিয়রের সাথে তার প্রেম হয়। সেই জুনিয়রের সাথে অবশ্য বেশিদিন প্রেম টিকেনি। মাস দুয়েক পরই ব্রেকআপ। এরপর তো জাইন জড়িয়ে গেলো রাজনীতিতে। টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করতে করতে ভার্সিটিতে উঠলো। ভার্সিটিতে উঠে পুরোদমে রাজনীতিতে ঢুকে মানুষের জন্য কাজ শুরু করলো। এর মধ্যে কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাব পেলেও প্রেম করার মতো সময় পায়নি। যারাই প্রেম করতে চাইতো তাদের অবদার থাকতো রাত জেগে কথা বলতে হবে,নিয়ম করে ঘুরতে নিতে হবে। সময় বের করে এসব করা সম্ভব ছিলো না জাইনের। তাই সেসব প্রেম প্রত্যাখান করতো। তখন আর প্রেম করার সময়ই পায়নি। কোনো রকম গ্রাজুয়েশন শেষ করে আর পড়ার দিকে আগ্রহী হয়নি সে৷ বাসা থেকে অনেকবার মাস্টার্স করার জন্য প্রেসার দিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি। এসব ঘটনার কেটে গেছে চার বছর।

জাইনের ভাবনার মাঝে প্রিয়তা তার মেসেজের রিপ্লাই দেয়।
জাইন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রিপ্লাইয়ের দিকে।
জাইন লিখেছিলো,’জাইন তার ব্যক্তিগত চাঁদকে মিস করছে। দিনের বেলায় চাঁদের দেখা পেতে ইচ্ছে করছে। জাইনের চাঁদ কি করে এখন?’

প্রিয়তা রিপ্লাই দেয়,’দুঃখিত আপনি ভুল জায়গায় মেসেজ দিয়েছেন। নাসায় মেসেজ দিন তারা আপনাকে বলে দিবে চাঁদ কি করছে আর কোথায় আছে। এটা নাসার নাম্বার না।’

জাইন আবারো মেসেজ পাঠায়।
‘তোমার না পরীক্ষা চলছে? কেমন হচ্ছে পরীক্ষা?’

‘আপনি জানলেন কীভাবে? আমার বিষয়ে এতো আগ্রহ দেখাবেন না,ভালো লাগে না আমার।’

জাইন ফোনের দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে কি করে সবটা বুঝাবে। সে কত মিষ্টি মিষ্টি মেসেজ দেয় তার বিপরীতে প্রিয়তা ঝাঁঝালো উত্তর দেয়। তার প্রেম সত্ত্বা জাগে একমাত্র প্রিয়তাকে মনে পড়লে অন্যথায় সে ও এক কঠোর মানব। এই মূহুর্তে তার একমাত্র দূর্বলতা প্রিয়তা।
তার একবার প্রিয়তার সাথে দেখা করা উচিত। সে চাচ্ছে এদিকটা সব সামলে নিয়ে প্রিয়তাকে মনের কথা জানাতে। খালেকুজ্জামান মিটিং শেষ করে বের হয়। জাইন পকেটে ফোন ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখন তারা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে এক অনুষ্ঠানে।

___________

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে গাছ তলায় বসে আছে তিন বান্ধবী। আজকের পরীক্ষা তেমন ভালো হয়নি। তার উপর এতো বেশি গরম যে প্রাণ বেরিয়ে আসার উপক্রম। রিমি ফাইল দিয়ে বাতাস করতে করতে তাড়া দেয়। এখন সে আইসক্রিম খাবে। প্রিয়তা আর হৈমন্তীও তার সাথে যায়। এই গরমে ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিম খেলে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আইসক্রিম ওয়ালার কাছে আসে। তিনজন তিন রকম আইসক্রিম কিনে।

‘কিরে প্রিয়তা ক্লাস শেষ? বাসায় ফিরবি?’
দুলালের গলা পেয়ে প্রিয়তা পিছনে ফিরে তাকায়।

প্রিয়তা জবাব দেয়,’হ্যা শেষ। আইসক্রিম খাবেন?’

‘খেলে মন্দ হয় না। দে একটা।’

প্রিয়তা নিজের হাতেরটাই দেয় আর আরেকটা আইসক্রিম নেয় নিজের জন্য। দুলাল নিজের পকেট থেকে আইসক্রিমের দাম মেটায়। প্রিয়তা দুলালকে বাঁধা দিলেও সে শুনে না। রিমি আর হৈমন্তী অবাক হয় এসব দেখে।

‘উনি আমার কাজিন হয় দুলাল ভাই। দুলাল ভাই এরা আমার বান্ধবী।’
প্রিয়তার সকলের আলাপ করিয়ে দেয়।
রিমি বলে,’ভাই আপনি সিঙ্গেল?’

দুলাল হেসে বলে,’সিঙ্গেল কিন্তু একটা বাচ্চা আছে।’

রিমি দুঃখ প্রকাশ করে।
‘ভাই দিল টুট গায়া।’

রিমির কথা শুনে সকলে হাসে।

প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,’এখানে কি করছেন?’

‘আরে আসছিলাম পাশের ভূমি অফিসে কাগজ ঠিক করতে। ওরা বললো কাজ আপাততঃ হয়ে গেছে সামনের সপ্তাহে আবার আসতে। তাই বাসায় ফিরতেছিলাম। মনে পড়লো তুই তো এখানেই পড়িস তাই এলাম তোরে নিতে।’

‘ঠিক আছে আইসক্রিম খেয়ে এক সাথেই যাই চলেন।’

দুলালও মাথা নাড়ায় প্রিয়তার কথা শুনে। আইসক্রিম খাওয়া শেষ হতেই রিমি আর হৈমন্তীকে বিদায় জানায় প্রিয়তা। দুলাল নিজের বাইকটা নিয়ে আসে। প্রিয়তা দুলালের পিছনে উঠে বসে। এরপর এক হাত দিয়ে বাইকের পিছনের ধরে রাখে। চেষ্টা করে দুলালের থেকে দূরত্ব রাখতে। দু’জনের মধ্যে অবশ্য যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে। দুলাল বাইক স্টার্ট দেয়। যেতে যেতে নানান কথা বলে দুলাল। সেসব কথার জবাবে প্রিয়তা কখনো হেসেছে আবার কখনো হু হ্যা জবাব দিয়েছে। দুলাল খুবই মিশুক আর সরল মনের মানুষ। প্রিয়তার মাঝে মাঝে মনে হয় তুহিন এমন হলে মন্দ হতো না। এমন একটা ভাই থাকলে প্রিয়তার সব কিছু সহজ হয়ে যেতো।

জাইন ফোন কানে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলো। এই মূহুর্তে জিপে বসা সে। জিপ চলছে,গন্তব্য পার্টির অফিস। হঠাৎ বাহিরে তাকাতেই তার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বিপরীত পাশ থেকে একটা বাইক আসতে দেখে। বাইকের পিছনে বসা প্রিয়তাকে দেখে এক প্রকার বাকরুদ্ধ সে। প্রিয়তা তা-ও আবার এক ছেলের সাথে বাইকে ঘুরছে! প্রিয়তাকে হাসিমুখে দেখে জাইন মিন করে এই ছেলের সাথে প্রিয়তার সম্পর্ক রয়েছে। বাইকটা তাদেরকে অতিক্রম করে চলে যায়। জাইনের সর্বাঙ্গে ধীরে ধীরে জ্বা লা ধরে যায়। এই জন্যই কি প্রিয়তা তার ভালোবাসা বুঝেও না বুঝার ভান করে? প্রিয়তার জীবনে অন্য পুরুষ রয়েছে? না আর ভাবতে পারছে না সে। বিনা বাক্যে কলটা কেটে দেয় সে। থেমে থেমে রাগ উঠছে আর ইচ্ছে করছে এক্ষুণি বাইকের পিছু নিতে।

শাকিল বলে,’কিরে ঐইটা প্রিয়তা ছিলো না?’

মারুফ দেখেনি তাই সে প্রশ্ন করে,’কোনটা?’

শাকিল উত্তর দেয়,’আরে মাত্র বাইকে চড়ে গেলো। এক ছেলের বাইকে বসা ছিলো।’

মারুফ বলে,’আরে কি যা তা বলিস। প্রিয়তার মতো মেয়ে বসবে এক ছেলের বাইকে! এটা অসম্ভব মামা।’

‘আমি নিজের চোখে দেখলাম ও বসা ছিলো।’

মারুফ শাকিলের কথায় কান না দিয়ে জাইনের দিকে তাকায়। জাইনকে দেখে তার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না শাকিল যা বলছে সত্য। মারুফ ঢোক গিলে। সে জানে জাইন এ বিষয়টা এতো সহজে ছেড়ে দিবে না। বিরাট ঝামেলা বাঁধাবে। আর জাইন চেতলে প্রিয়তা দেখতে পাবে এক অন্যরূপী জাইনকে।

মারুফ মনে মনে বলে,’ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে তুমি ঠিক করোনি প্রিয়তা। যদি সত্যিই তোমার সাথে ঐ ছেলের সম্পর্ক থাকে তাহলে জাইন কি করবে তা তোমার ধারণাও নেই। ইউ আর ইন ট্রাভল প্রিয়তা।’

…………..
(চলবে..)