#হিসাব_মিলবে_কোথায়
কলমে : ফারহানা কবীর মানাল
|| তিন ||
রাতের খাওয়া শেষে মানিক বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিল। আজ থেকে তার বারান্দায় ঘুমতে হবে। বছরের বেশিরভাগ সময় বারান্দার ঘরটা স্টোর রুম হিসাবে ব্যবহার হয়। এখনও খাটের নিচে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন মজুদ করে রাখা আছে। পেঁয়াজ রসুন থেকে কেমন টকটক গন্ধ বেরচ্ছে। গন্ধটা মানিকের ভালো লাগছে না। মাথা ধরে আসছে। সে চোখ বন্ধ করতে চাইল। পারল না। তার চোখ পড়ল ফ্যানহীন ছাঁদের দিকে। এই ছাঁদে ফ্যান লাগানোর টাকা তার কাছে নেই। সত্যি বলতে তার মানিব্যাগে বিশ টাকার দু’টো নোট পড়ে আছে। কালকের মধ্যে এই টাকা শেষ হয়ে যাবে। সে অল্প হাসল, চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। জীবন কত অদ্ভুত খেলা দেখায়!
মানিকের মোবাইলে আলো জ্বলছে। মাঝরাতে কে তাকে মনে করতে পারে? ফারিসা? হলেও হতে পারে। কোন এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে রাত পার হয়ে যেত। এখন আর হয় না। ফারিসা কথা বলতে চায় না। কথা না বলার মধ্য দিয়ে কি তাদের সম্পর্কে চিড় ধরবে? এটা এড়িয়ে যাওয়ার অযুহাত নয় তো? মানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কেমন কষ্ট হচ্ছে। বিষাদে মন ভরে গেছে। প্রিয় মানুষের কথা মনে পড়লে এমন কষ্ট হয় কেন? যে প্রিয় তার কথা মনে পড়লে তো খুশিতে নেচে ওঠার কথা ছিল!
নববী চুলার পাশে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বছরের মধ্যে এই একমাস তার খারাপ সময় যায়। এমনটা নয় যে শাশুড়ি হিসাবে হাওয়া বেগম খারাপ মানুষ। বরং তাকে খুব ভালো বলা চলে। নববীকে কোন কাজে হাত লাগাতে দেয় না। সারাক্ষণ মা মা করতে থাকে। এমন শাশুড়ি নববীর পছন্দ নয়। শাশুড়ি হবে কঠিন প্রকৃতির। বউদের সাথে কড়া গলায় কথা বলবে। যুগের নিয়ম ভেঙে ভালো শাশুড়ি হওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে ভালো না। কেমন যেন নাটক নাটক মনে হয়।
হাওয়া বেগম বড় ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা দিন দিন আরও সুন্দরী হচ্ছে। অজানা ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। পাছে ফাহিমকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? না এমন হতে দেওয়া যায় না। তিনি কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। সহজ গলায় বললেন, ” মা! ইমনের বয়স তো কম হলো না। এবার আর একটা সন্তান নেওয়ার কথা চিন্তা করো। সংসারে পোলাপান থাকা ভালো। আল্লাহর রহমত থাকে।”
নববী বিরস গলায় বলল, “আপনার ছেলের রোজগার-পাতির অবস্থা ভালো না। আপাতত এসব নিয়ে ভাবছি না।”
” রিজিকের মালিক আল্লাহ। যে আসে সে তার রিজিক নিয়েই আসে।”
“জানি মা। সেজন্যই বোধহয় আপনার ছোট ছেলে সাতাশ বছর বয়সে এসে বাপ-ভাইয়ের টাকায় তিন বেলা পেট পুরে খেতে পারছে।”
হাওয়া বেগম মুখ কালো করে ফেললেন৷ নববী বলল, ” আমার কথায় কিছু মনে করবেন না মা। আমি কিছু মিথ্যে বলিনি। আমার ভাইয়ের বয়স আঠারো। সে-ও রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম করে মাছ-মাংস কিনছে। অন্যদিকে আপনার ছোট ছেলেকে কখনও এক আঁটি শাক নিয়ে বাড়ি আসতে দেখলাম না।”
মানিক টুথব্রাশ মুখে নিয়ে রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নববীর কথা কানে যেতেই উঁচু গলায় বলল, “হ্যাঁ ভাবী সব জানি। তোমার ভাই গাঁ’জা বিক্রি করা শুরু করেছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। গত মাসেই তো জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।”
“এসব কথা তোমায় কে বলে? ওসব তো এমনি ঝামেলার জন্য। শত্রু’তা করে ফাঁ’সিয়ে দিয়েছে।”
“শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। আমি সবই জানি। বাদ দাও।”
নববী কিছু বলল না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মফস্বল শহরে কোন কথা গোপন থাকে না। অদ্ভুত সমস্যা!
মবিন সাহেব পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরছিলেন। মানিক তার পাশে গিয়ে বসল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “আব্বা, শুনলাম কুতুব কাকার মেয়ে মা’রা যায়নি। ইমনদের আনতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখেছিও।”
মবিন সাহেব চমকে উঠলেন। দ্রুত গলায় বললেন, “কি বলিস? সত্যি নাকি?”
“হ্যাঁ, সত্যি। তোমায় কে বলেছিল কুতুব কাকার মেয়ে মা’রা গেছে?”
“বউ মা বলেছিল। তাকে নাকি তার ভাই জানিয়েছে। বউমা-ই তো আমায় বলল- তোকে সাবধান থাকতে। তোর সাথে নাকি ওই মেয়ের সম্পর্ক আছে।”
“তুমি ভাবীর কথা বিশ্বাস করে নিলে?”
“না নেওয়ার কি আছে? নববী কি কখনও মিথ্যে কথা বলে?”
“তা-ও ঠিক।”
মানিক উঠে দাঁড়াল। মা- বাবা দু’জনেই বড় ছেলের বউকে খুব ভালো জানে। এরা তাকে কোন প্রকার সন্দেহ করবে না। কিন্তু ভাবী কেন এমন করবে মানিকের মাথায় আসছে না। ভালো সম্পর্ক না থাকলেও নববীর সাথে মানিকের কোন প্রকার শত্রুতা নেই। গতবছর ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নববীর হাতে ফারিসার ছবি পড়েছিল। মানিক ফারিসার একটা ছবি মানিব্যাগে রেখে দেয়। সেখান থেকে দেখেছে। এরপর থেকে নানান প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত মানিক সত্যি কথা বলে দিয়েছে। নববী সব শুনে খুব হেসেছিল। রসালো গলায় বলেছিল- তোমার ঘটকালি আমি করে দেবো। বিয়েতে কিন্তু আংটি গড়িয়ে দিতে হবে। সে-ই মানুষের এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায় না। মানিক চিন্তিত মুখে বিছানায় বসে পড়লো। এবং সেই মুহুর্তে কেউ একজন তার সামনে চায়ের কাপ ধরলো। মিষ্টি গলায় বলল, “সবার চা খাওয়া শেষ। শুধু আপনি বাকি ছিলেন। তাই নিয়ে এলাম।”
“আমি চা খাই না।”
মেয়েটি হাসল। সহজ গলায় বলল, “আমরা কেউ-ই চা খাই না। তরল জিনিস খাওয়া যায় না। পান করতে হয়। কাজেই আমরা সবাই চা পান করি।”
“হেয়ালি করা আমার পছন্দ না। আপনি আসতে পারেন।”
“মানিক ভাই! আপনি এমন অদ্ভুত কেন? আপার বিয়ের পর থেকে দেখছি আপনি সবসময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকেন।”
“বাড়তি কথা আমার পছন্দ না।”
“এমন কিছু কি আছে যা আপনার পছন্দ?”
মানিক কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। এর সাথে কথা বলার কোন মানে হয় না। কোন কথাই এই মেয়ের গায়ে লাগবে না। বেহায়ার মতো আবারও কথা বলতে আসবে। ভালোবাসলে মানুষ এমন বেহায়া হয়ে যায়।
তিথি সহজ ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “মানিক ভাই! আমি আপনাকে পড়তে পারছি।”
মানিক চমকে উঠলো। হড়বড় করে বলল, “পড়তে পারছেন মানে?”
“আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের মনের কথা পড়তে পারি এটা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
“না করি না।”
“আমি বিশ্বাস করি। এবং পড়তেও পারি। এই মুহুর্তে যে আপনি খুব কষ্ট আছেন তা আমি পড়তে পারছি।”
“আমি কোন কষ্ট নেই তিথি। তুমি দয়া করে এখান থেকে যাও। কেউ দেখলে খারাপ মনে করবে।”
“কেউ কিছু মনে করবে না। সত্যি কথা বলুন না যে আপনি চাইছেন না আমি এখানে থাকি।”
“হ্যাঁ, আমি চাই না।”
“কেন চান না? আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ? আমার নাক বোঁচা নাকি চোখ টেরা?”
“কোনটাই নয়। আমার ভালো লাগছে না।”
“আমাকে কি আপনার একটুও ভালো লাগে না?
মানিক জবাব দিল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তিথির সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। ফারিসার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ফারিসা তার কল রিসিভ করবে না। সকাল থেকে আশি বার কল দেওয়া হয়ে গেছে, একবারও রিসিভ করেনি। মানিক সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। আজ-কাল ফারিসা কথা মনে পড়লেই সিগারেট টানতে ইচ্ছে করে। এ ছাড়াও অনেক ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া যায় না। সম্ভব হয় না। দুই একটা ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেয়া যায়।
মানিকদের বাড়ির সামনে দু’টো বাগানবিলাস গাছ। গোলাপি ফুলে গাছ ছেয়ে গেছে। কিছু ফুল মাটিতে পড়ে আছে। হঠাৎই মানিকের চোখ পড়ল রাস্তার ওপাশে। নববী মানে তার ভাবী নজু কাকার সাথে কথা বলছে। দু’জনে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷ নববী হাত নেড়ে নেড়ে কিসব বলছে। নজু কাকা তার কথা মনযোগ সহকারে শুনছে, মাঝেমধ্যে মাথা নাড়াচ্ছে। মানিক একটু সরে দাঁড়ালো। তার মনের মধ্যে কু ডাকছে। ভাবী কোন পরিকল্পনা করছে না তো? ফারিসা বিয়ে খু’ন এসব কি ভাবীর সাজানো নাটক?
নববী নজু কাকার হাতে এক হাজার টাকা চারটে নোট গুঁজে দিল। মানিক খুব খেয়াল করে দেখলো নববী টাকা গুনছে। এক হাজার টাকার নতুন চারটে নোট দিয়েছে। নজু কাকাকে এতো টাকা দেওয়ার কি দরকার? সে একবার ভাবলো ওদের কাছে গিয়ে সবকিছু জানতে চাইবে কিন্তু তেমনটা করল না। কেউ-ই সত্যি কথা বলবে না। মানিক আড়ালে সরে গিয়ে ওদের কথা শুনতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। নজু কাকা উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন। নববীও চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। তার হাতে কয়েকটা চিপসের প্যাকেট। বোঝাই যায় এগুলো লোক দেখানোর জন্য।
মানিকের পকেটে মোবাইল কাঁপছে। কল আসেনি। বোধহয় এসএমএস। মানিক মোবাইল বের করল। কেউ একজন তার একাউন্টে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছে। অথচ আজ কারো টাকা পাঠানোর কথা না। মানিকের কারো কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা নেই। মানিক ওই নম্বরে কল দিলো। ওপাশ থেকে ভরাট গলায় একজন পুরুষ বলল, “কাকে চাইছেন?”
“এই নম্বরে টাকা এসেছে মাত্র? কে দিয়েছে?”
“রোগা মতো একটা মেয়ে দিয়ে গেল। নম্বর তো ভুল হয়নি। তারপরও ভুল হয়ে থাকলে জানাবো।”
“আচ্ছা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“ঠিক আছে।”
মানিক কল কেটে দিল। ফারিসার মাথায় কি চলছে? যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে টাকা দেওয়ার কি আছে? সে তো জুতো মে’রে গরু দান চায় না। মানিক ফারিসার নম্বরে কল দিলো। মোবাইল বন্ধ!
চলবে