একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-০১

0
317

সূচনা পর্ব
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

পাত্রীর থেকে পরোক্ষভাবে রিজেক্ট হয়ে পার্থিব শুকনো মুখে বসে আছে বারান্দায়। পাত্রী তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে কী বিয়েটা ভেঙে দিবে নাকি দিবেনা এইটা ভেবেই কুল-কিনারা করতে পারছেনা। পাত্রীর কথা শুনে বুঝা গেল বিয়েতে মত নেই। কিন্তু কেন নেই, কিংবা পার্থিবের কিছুতে সমস্যা কী-না সে ব্যাপারেও সাফ সাফ কিছু জানাল না।
এতো ধোঁয়াশা পার্থিব পছন্দ করেনা। মনে যা, তাই প্রকাশ করা তার স্বভাব। মেয়েটা তার খারাপ লাগেনি, আবার দেখে যে মুগ্ধ হয়ে গেছে তাও না, তবে তার মায়ের পছন্দ হয়েছে। তাই সে নাও করতে পারছেনা। পার্থিব বারান্দা থেকে উঠে ঘরে চলে গেল। চিত হয়ে শুয়ে কল্পনা করতে লাগল বিকালের ঘটনা।

দুইজনকে কথা বলতে আলাদা রুম দেওয়া হলো। পার্থিব রুমে ঢুকে একবার মেয়েটার দিকে তাকাল। শুকনো মুখ। যখন থেকে দেখছে মেয়েটা শুকনো মুখেই ঘুরছে। কথোপকথন শুরু করার পর মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে লাগল। তবে কথায় কথায় এক পর্যায় মেয়েটি বলে উঠল,
‘এই দেশে কখনো বিয়ে হয়না৷ এই দেশে বিয়ের নামে চুক্তি হয়৷ অর্থের বদলে শরীরের চুক্তি৷ স্বামী স্ত্রীকে অর্থ দেয়, স্ত্রী তার বদলে নিজের শরীর দেয়৷ বিয়ে মানে তো এই৷ আর কী?’

সামনে দাঁড়ানো হবু পাত্রীর মুখে এমন বাক্য শুনে পার্থিব যেন আকাশ থেকে পড়ল৷ এ কেমন কথা! এমন কোনো কথা সে এই মূহুর্তে আশাই করেনি। তবুও সে স্থির হয়ে দাঁড়ানো৷ বিপরীতে কোনো প্রতুত্তর করার প্রয়োজন মনে করল না৷ সামনের মেয়েটি আবারো বলতে লাগল,

‘আমার মা অপরূপ সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা পরকীয়ায় জড়িয়ে ছিলেন৷ আর আপনি বলছেন, আমি কালো হওয়া সত্ত্বেও আমাকে পছন্দ করেন? বিয়ে করতে চান? ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে গেল না?’

পার্থিব বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার সামনে থাকা কঠিন ধাঁচের মেয়েটির দিকে৷ সে নিজে বিয়েতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিল না, শুধুমাত্র তার মায়ের কারণে বিয়ের ঝামেলায় জড়ানো৷ পার্থিব নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল, ‘আপনি এতোটা রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার কী আমাকে পছন্দ হয়নি?’

‘আমার পছন্দের কথা বহুদূরে৷ আগে আপনি বলুন, আপনার কী আমাকে পছন্দ হয়েছে? এইরকম আমার মতো জ ঘন্য কালো, খাটো মেয়েকে আপনার পছন্দ হয়েছে?’

পার্থিব কী বলবে ভেবে পেল না। ‘নিজের প্রতি এতো অবজ্ঞা! কীভাবে!’ আশ্চর্য হয়ে মনে মনে কথাটা কেবল ভাবল। তবে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল, ‘দেখুন, মানুষ নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেনা৷ যদি তাই হতো তাহলে সবাই নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবেই তৈরি করত৷ আপনার তো তাও হাত পা আছে, পৃথিবীতে এমনও অনেক মানুষ আছে যাদের হাত-পা নেই কিংবা জন্মগত ভাবেই অকেজো, অনেকে পৃথিবী মর ণ ব্যা ধি রোগ নিয়েও জন্মায়৷ সেইসব দিক হিসেব করে আপনার নিজেকে অব জ্ঞা না করে শুকরিয়া আদায় করা উচিত৷ সুস্থ আছেন তো, তাই মূল্য বুঝতে পারছেন না।’

শেষ কথায় সামান্য রাগ, শ্লেষ প্রকাশ পেল। শ্রুতির ভাবান্তর হলো না৷ নিজের মুখের রাগ কন্ঠে মেশাল৷ বলল, ‘এমন কথা আমার শুনার প্রয়োজন নেই৷ এই যে আজ আপনি এই কথা বললেন না? জ্ঞান দিলেন? কিছুদিন পর দেখা যাবে আমাকে বিয়ে করে অন্য মেয়েদের সাথে পর কীয়া করে বেড়াচ্ছেন। হ্যাহ…চেনা আছে আপনাদের৷’

পার্থিব অবাক হলো৷ বুঝল এই মেয়েটি নিজের সাথে সাথে ছেলেমানুষের প্রতি অগাধ ঘৃ ণা পুষে রেখেছে নিজের মনে। তাই সে যতো যাই বলুক শুনবে না৷

‘তো আপনি আমাকে বিয়ে করছেন না। তাই তো?’ শ্রুতি অবগত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল৷

‘জীবনে প্রেম করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ তাই পরিবারের উপরই ছেড়ে দিয়েছি সব৷ যেখানে আপনাকে আমার পরিবার পছন্দ করেছে সেখানে না বলার কোনো উপায় নেই। তার উপর আপনাকে আমার আম্মার অসম্ভব পছন্দ হয়েছে৷ আমারো আপনাকে দেখে খারাপ মনে হয়নি। পছন্দ হয়েছে বলা যায়। ভালোবাসাটা যদিও হয়নি৷ তবে আমার বিশ্বাস বিয়ের পর ঠিক ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে৷ আর আপনার কথামতো যদি বিয়েটা ভেঙেও দেই, এতে আপনার কোনো লাভ নেই৷ কয়জনকে ভাগাবেন এইভাবে? শেষে দেখবেন ধরে বেঁধে কোনো বুড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল৷ তখন? এরচেয়ে বেটার আপনাকে যেহেতু আমার ভালো লেগেছে তাহলে বিয়েটা আমিই করি৷ আপনি নিজে বিয়ে ভাঙতে পারলে ভাঙুন, এতে আমি কিছু বলব না। কিন্তু আমি এখানে কোনো সাহায্য করব না৷ তো…বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বিয়ের ডেট ঠিক করে আপনাকে জানাব। সেই পর্যন্ত নিজের যত্ন নিবেন৷ খেয়াল রাখবেন৷ নাহলে দেখা যাবে বিয়ের দিনে আপনাকে পে ত্নীর মতো লাগছে। আসছি…’

শ্রুতি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

.
পাশাপাশি বসে আছে দুইবোন। বিভা-শ্রুতি। দুইজন এর পরনে একই শাড়ি। গাঢ় খয়েরী রঙের। ঠিক যেমন ছোট্টোবেলায় তারা একই জামা পড়তো৷ দুইজন যা করতো মিল রেখে করতো৷ সেই কারণে বিয়েটাও হয়তো একই দিনে পড়লো।
শ্রুতি এর বুকে ব্যথা হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে সবকিছু সপ্ন৷ সামনেই কাজী বিয়ে পড়াচ্ছে তার বড় বোন বিভার৷ বিয়ে পড়ানোর প্রতিটি কথা বি ষের মতো বাজছে শ্রুতির কানে৷ এতো অসহ নীয় যন্ত্রণা কেন হচ্ছে? এইতো কাজী বলছে,
‘বলো মা কবুল?’
বিভা বলল না৷ পাথরের ন্যায় বসে রইল৷ শ্রুতি তার বড় ঘোমটা উঁচু করে বোনের দিকে তাকাল৷ নিষ্প্রভ, ক্লান্ত মুখ দেখে নিমিষেই শ্রুতির চোখ আষাঢ়ের ভরা নদীতে রুপান্তরিত হলো৷ পাশ থেকেই বিভাকে ধাক্কা দিল শাহিনা৷ বলল, ‘কীরে বিভা, কবুল বলিস না কেন? বল মা, কবুল বল?’
শ্রুতির কোমল চাহনি মূহুর্তেই বদলে গেল। রাগ নিবারণের জন্য চেয়ে রইল অন্যত্র৷
শাহিনার প্রশ্নে বিভা নড়ে উঠে বলল ‘হ্যাঁ?’
যেন অন্য জগত থেকে বর্তমানে ফিরল৷ শাহিনা একই কথা দ্বিতীয়বার বলার পর বিভা পাথরের ন্যায় বলল, কবুল কবুল কবুল৷

সকলের মুখে যেন প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল৷ কিন্তু আমিন সাহেব শান্ত হতে পারলেন না৷ কারণ তার চিন্তা বিভাকে নিয়ে নয়, শ্রুতিকে নিয়ে৷ সে ঝামেলা না পাকালেই হলো৷ আমিন সাহেবের মুখ থেকে রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে৷ সব পুরুষ লোকেরা রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ এবার শ্রুতির বিবাহের পালা৷
বেশ কিছুক্ষণ পরেই কিছু পুরুষ লোক ঢুকল। আগের ন্যায় বিয়ে পরিয়ে বলল, বলো মা কবুল৷
শ্রুতি কিছু বলল না ৷ আমিন সাহেব এর চিন্তা হতে লাগল৷ শ্রুতি কী তবে কোনো ঝামেলা করবে? বড়ই অ স্থি র লাগছে আমিন সাহেবের৷ তরতর করে ঘাম ঝড়ছে৷ এতোক্ষণে নিশ্চয়ই তার প্রে শা র হাই-এ উঠে গেছে৷ শ্রুতি আমিন সাহেবের দিকে র ক্তা ক্ত চক্ষু নিয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে চেয়ে নিজের কন্ঠের তেজ খানিকটা বাড়িয়ে বলল, কবুল কবুল কবুল৷
আমিন সাহেব প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷

.
‘পার্থিব শ্রুতিকে কোলে নাও। ওকে কোলে করে তোমায় তোমার রুমে পৌঁছাতে হবে৷’

কথাটা কর্ণগোচর হতেই চিত্ত কেঁ পে উঠল শ্রুতির৷ ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ফুলে ফেঁপে ওঠা চোখ নিয়ে তাকাল পার্থিব এর দিকে৷ পার্থিব শ্রুতি এর পানেই চেয়ে আছে৷ শ্রুতির কান্না পেল৷ ভেতর থেকে কান্নারা যেন উথলিয়ে বের হতে চাইল। ছোট থেকেই পুরুষজাতির ওপর তার অজানা এক ভয়। সে কী করবে ভেবে পেল না৷ রাগ হচ্ছে তার৷ ভীষণ রাগ হচ্ছে৷ পরমূহুর্তে নিজেকে শান্ত করলো৷ কারণ সে বুঝেছে, তার শ্বশুরবাড়ি হলো একটা বিল্ডিং। তাকে উঠতে হবে চারতলায়৷ চারতলা পর্যন্ত নিশ্চয়ই পার্থিব শ্রুতিকে কোলে করে তুলবে না৷ নিশ্চিন্ত হলো শ্রুতি৷ কিন্তু তাকে অবাক করে পার্থিব সত্যি সত্যি এগিয়ে আসছে৷ কী করবে এখন ও?
শ্রুতি একটা টুল জাতীয় কিছুতে বসে আছে৷ সামনে একটা ছোট টেবিল৷ যেখানে বরণডালা সহ আছে কিছু সামগ্রী৷ পার্থিব শ্রুতির সামনে আসতেই শ্রুতি ধা ক্কা মেরে পানি ভর্তি কাঁচের জগ পার্থিব এর পায়ে ফেলে দিল৷
পার্থিব ‘আহহহহহ’ শব্দ তুলে দূরে সড়ে গেল৷
পার্থিব শ্রুতির সামনেই বসা৷ পায়ে বেশি কিছু না হলেও কেমন যেন একটা টনটনে ব্যথা করছে৷ আঙ্গুল কেমন যেন অসাড় অসাড় লাগছে৷ রক্ত জমেছে সম্ভবত। পার্থিব এর পায়ের দিকেই ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রুতি৷ কিছু মানুষজন মিলে তার পায়ে বরফ ঘষে দিচ্ছে৷ শ্রুতি আসলে এমন কিছু করতে চায়নি৷ আবার অন্যকিছুও মাথাতে আসেনি। সুন্দরমতো শাড়ি পরিহিতা একজন মেয়ে এগিয়ে এলো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘শ্রুতি? তুমি পার্থিব এর পায়ে ইচ্ছে করেই জগটা ফেলেছ মনে হলো আমার।’

যথাসম্ভব মাথা নুইয়ে ছিল শ্রুতি। কিন্তু মেয়েটির প্রশ্নে এমনভাবে তাকাল যেন তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে কেউ বারি দিয়েছে৷ চোখে ভয় স্পষ্ট। রাগী ধাঁচের হলেও নতুন জায়গায় এমন এক একটা কাজ করে বিপাকে পরে গেছে শ্রুতি৷ শুধু কোনোভাবে বাঁচতে পারলেই যেন হয়৷

চলবে~